আমার হৃদয়ে সে পর্ব-৩২

0
656

#আমার_হৃদয়ে_সে
#রোকসানা_আক্তার
পর্ব-৩২

৫১.
আজ হঠাৎ করে আমার মা-বাবা আমার শ্বশুর বাড়িতে আসেন।হাতে করে ফল,মিষ্টি,সন্দেশ,রসমালাই,দই,খির এবং বাহারী পদের জাঙ্কফুড খাবার আনেন।বাপের বাড়ির লোকদের দেখলে মেয়েরা খুশিতে আত্মহারা হয়ে যায়।কি থেকে কি করবে ভেবে পায়না।আমার কেনজানি সেরকম হচ্ছে না।মা-বাবাকে সেই প্রথমে আসার পর “কেমন আছেন”এটুকু বলেই শেষ।তারপর থেকে স্তব্ধ মুখে শাশুড়ী মা বসার সোফার একপাশে দাঁড়িয়ে আছি।আর সবার কথা শুনতেছি।আমার মা খেয়াল করেছেন আমি চুপচাপ।কথা বলার মাঝে বলে উঠলেন,
“পারিসা যে চুপচাপ?মনখারাপ তোর?”

আমি এবার হালকা নড়ে উঠলাম।জোরপূর্বক হাসলাম।বললাম,
“নাহ মা।মনখারাপ কেন হবে।”

পাশ থেকে শাশুড়ী মা বললেন,
“বউ মা?রুনু কি বানাচ্ছে না বানাচ্ছে।তুমি গিয়ে একটু দেখো ত।”

আমি মাথা নেড়ে কিচেনে এলাম।রুনুর ইতোমধ্যে সব ধরনের নাস্তা বানানো শেষ।শুধু লেবুর শরবতটা ছাড়া।রুনু আপাকে লেবু কাটতে বলে আমি আর দেরী না করে জগে পানি ঢেলে নিলাম।লেবু শরবত বানানো শেষ হলে সব হলরুমের টি-টেবিলে জড়ো করলাম।আমার শাশুড়ী মা পরিবেশন করাতে ব্যতিব্যস্ততুর হয়ে যান বাঁধ সাঁধেন।বলেন,
“আপা, বেয়াই সাহেব কোথায়?উনাকে যে দেখতে পাচ্ছি না?”

শাশুড়ী মা বলেন,
“আছে কোথাও।বাইরে হয়তো।”
“ওহ আচ্ছা।তবে বেয়াই সাহেব আমাদের পছন্দ করবেন না।”
বলে বাবা হো হো করে হেসে উঠেন।বাবার কথায় আমার বুকের অতলে কোথাও একটা দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে নিই।শাশুড়ী মা বলেন,
“আরেক নাহ সেরকম কিছু না।আপনার বেয়াই এমনিতেও একটু খিটখিটে স্বভাবের।তাই আর কি।”

তারপর এভাবে সবাই কথা বলতে থাকলেন।হাসনা কোথা থেকে এসে আমাকে টেনে তার রুমে নিয়ে গেলো।বললো,
“ভাবী?একটা কথা বলবো?”
“হ্যাঁ,বল?”
“তোমার চেহারা এবং তোমার মার চেহারা প্রায় সেইম।মা মেয়ে দুজন একরকম দেখতে!আল্লাহ!”
“হ্যাঁ,আমি এবং মা দেখতে একরম।এটা সবাই বলে।”
“তবে একটা দিক দিয়ে বৈসাদৃশ্য ভাবী?”

প্রশ্নসূচক চোখে তাকালাম হাসিনার দিকে।হাসনা হেসে উঠে বললো,
“তোমার বাম পাশের গালে একটা তিল আছে।যা তোমার মার গালে নাই।”
“সেটা অবশ্যি..!”

কথা বলার মাঝপথে থেমে গেলাম।কেননা বাইরের থেকে আমার শ্বশুরের গলার স্বর শুনতে পেলাম।উনি আমার বাবাকে কিছু বলছেন।আমি হাসনাকে পাশ কেঁটে হর্ণপায়ে দরজার মুখে গিয়ে দাঁড়ালাম।কান যুগল ক্ষিণ করলাম স্পষ্টত ওই মানুষগুলোর কথাগুলে শুনতে।আমার শ্বশুর খুব শুকনো গলায় বললেন,
“জ্বী, এতদিন আপনাদেরই খুঁজতেছিলাম।যাক ভালো হলো আজ দেখা হলো।’
” জ্বী,কিছু কিছু বলবেন,বেয়াই সাহেব?”
“অবশ্যই। বলতেই তো বললাম দেখা হলো ভালো হয়েছে।”
“বলুন কী বলবেন?আচ্ছা আগে আপনি বসুন।”

আমার শ্বশুর বসলেন।আমি অবশ্যি আমার শ্বশুরের মুখটা দেখতে পেলাম না কেমন ভঙ্গিমাতে আছে।কেননা আমি উনার পেছনের দিকে।মানে উনি যেখানে বসলেন সেখান থেকে এই রুমটা পেছনমুখী।

“মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন তার আগে আপনাদের কি ছেলের বাবার সাথে একবার কথা বলার প্রয়োজন বোধ হয়নি?আচ্ছা কথা বললেন না ভালো কথা সেটা বাদ।অন্তত বলা উচিত ছিল আপনাদের মেয়ের আগে এক জায়গায় বিয়ে হয়েছে।একটা অবিবাহিত ছেলের গলায় কীভাবে পারলেন একটা বিবাহিত মেয়েকে ঝুলিয়ে দিতে?কত স্বপ্ন ছিল আমার ছেলেকে নিয়ে।কত আশা করেছি ছেলেকে নিষ্কলুষ,সামাজিক,ভালো একটা মেয়ে দেখে বিয়ে করাবো।বিয়ে করা বউকে নিয়ে আত্মীয়দের থেকে কোনোরকম খোঁটা শুনতে হবে না।তাদের সামনে মুখ ছোট্ট করতে হবে না।বড় মুখ করে বউকে নিয়ে সবার সামনে দাঁড়াবো।হাসবো কথা বলবো।সেই মুখটা আমার রাখলেন না।আমার সব আশা-ভরসা আপনারা শেষ করে দিলেন!এতটা অবিচার কীভাবে করতে পারলেন?আপনাদের যদি এক ছেলে থাকতো তাহলে আপনারা কি কখনো পারতেন আপনাদের সেই এক ছেলের জন্যে একটা ডিভোর্সি মেয়ে বিয়ে করাতে?!”

আমার চোখ বেয়ে গড়গড় করে অশ্রু বেয়ে পড়লো। এতক্ষণে যা নিয়ে ভয় পেয়েছিলাম তাই ই হলো।
বুক চেপে ধরলাম।বুক থেকে যেন আগুন বেরুচ্ছে ।পেছন থেকে হাসনা আমার পিঠে হাত রাখলো।আমি স্পষ্ট চোখে দেখতে পাচ্ছি আমার বাবার চোখমুখে খুব হতাশ হতাশ ভাব।তিনি চোখে এঁটানো থাকা চশমাটা এক ঝটকায় চোখ থেকে খুলে ফেললেন।টেবিলের উপর রাখলেন।হয়তো নিজেকে ধাতস্থতা করে বললেন,

“দেখুন?বেয়াই সাহেব?আপনি যা ভাবছেন তা কিন্তু একদম নয়।আমরা ভাবলাম আপনি হয়তো আমাদের পারিসার ব্যাপারটা জানেন।কেননা,পারিসা হৃদয়কে আপনাদের তার ব্যাপারে বলতে অনেকবার বলেছিলো।যেদিন হৃদয় তার আপনার স্ত্রীকে, ভাই-ভাবীকে এবং অন্যান্য আত্মীয়দের নিয়ে আমার স্ত্রীর বোনের বাসায় হাজির হয় এনগেজমেন্ট করতে।সেদিন আমরা বুঝলাম হয়তো আপনারা সবাই জানেন।আর রাজিও।আপনি যে রাজি ছিলেন না তা স্পষ্ট ছিলাম না।কেননা সেদিন আপনি গ্রামে ছিলেন।আর হ্যাঁ,বিয়েটা হতো না।হৃদয়ের তাড়াহুড়োর কারণেই হয়েছে।আর আপনি যে বললেন আপনার ছেলের জন্যে নিষ্কলুষ একটা মেয়ে দেখে বিয়ে করাতেন!আপনি কি জানেন?আমার মেয়ে অভি,মানে পারিসার প্রথম স্বামীর সাথে একদিনও সংসার হয়নি?”

আমার বাবার মুখে শেষ কথাটা শুনে হৃদয়ের ভাবা বৈচিত্র্য ভঙ্গিমায় হেসে উঠলো।চোখের চশমা চোখ থেকে নামলো।বললো,
“হৃদয়ও আমাকে এই কথা বললো।বড়ই হাস্যকর কথা!আটমাস সংসার করার পরও বলছেন সংসার করে নাই?তা তার সংসার টা কি এলিয়েন এসে করলো আপনার মেয়ের বদৌলতে?নাকি কোনো পিশাচ!”

শাশুড়ী মা বলেন,
“দয়া করে তুমি একটু চুপ করো!আল্লাহর দোহাই লাগে!”

হৃদয়ের বাবা ওমনি শাশুড়ী মার দিকে হাত উঁচিয়ে থামতে ইঙ্গিত করেন।শাশুড়ী মা চুপ করেও থাকতে পারছেন না।মুখটা আরো কিছু বলতে উসখুস করে উঠে।পরক্ষণে হৃদয়ের অগ্নিশর্মা চোখে বলেন,
“চুপ করো দিলওয়ার তুমি!”

কথার গতি একটু উঁচুই ছিল।শাশুড়ী মা চুপ হয়ে যান!মুখটা অন্যদিকে ফিরে রাখেন।হয়তে কেঁদে দিয়েছেন।আমার বাবা শুধান,
“সংসার বলতে আপনি ভুলটা বুঝলেন।আমার মেয়ে অভির ফ্যামিলি,অভিদের সংসারের সব সামলাতে।তবে যার সাথে বিয়ে হয়েছে তারসাথে কখনো আমার মেয়ের কথা হয়নি।!মেলামেশাও হয়নি!আর আমাদের ফ্যামিলি, আমাদের মেয়ে কেমন তা একটু ভালো করে খুঁতিয়ে দেখার আপনার প্রতি আমার অনুরোধ রইলো, বেয়াই সাহেব।”

“দেখেছি।জেনেছি সব।আপনার মেয়ে ভালো।ফ্যামিলি ভালো।তবে কথা হলো, ডিভোর্স হয় কীভাবে?ডিভোর্স হবার পেছনে অবশ্যই অবশ্যই না কারণ ছিল!”
“জ্বী,ছিল।ভুল বোঝাবুঝি ছিল।দেখুন বেয়াই সাহেব,আমার মেয়ের প্রথম স্বামী মেয়েকে প্রথম থেকেই ভুল বুঝেছিলো মিথ্যে কিছু কথায়,আর মিথ্যে কিছু প্রমাণে।ভুল বুঝার পর মেয়ের সাথে ওই ছেলের অনেক মিসআন্ডার্সটেন্ডিং হয়েছিলো।মেয়ে তাকে বহুবার বুঝানোর চেষ্টা করেছিল।কিন্তু সে বুঝে নি।তারপর মেয়ে উপায় না পেয়ে আটমাস পর আমাদের বাড়ি চলে আসে।আমরাও মেয়েকে বুঝি নি।মেয়েকে আমরাও দোষ দিয়েছি।আসলে আমার মেয়ের কোনো দোষ ছিল না।দোষ ছিল ওই ছেলের যেই অন্য লোকের কথায় আমার মেয়েকে অবিশ্বাস করেছে কোনোকিছু না বিচারবিবেচনা করে।পরে ছেলে তারজন্যে অনুতপ্তও হয়।আমার মেয়ের কাছে মাফ চাইতে আসে।আমার মেয়ে ক্ষমা করেনি।ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দেয়।আমি জানি না আপনি এসব বিষয় জানেন কিনা।যদি না জানেন হৃদয়ের আশা করি সব জানতে পারবেন।”

“আমার জানতে হবে না কিছু আর।এরকম বাহানা দেবার ইস্য বহুৎ দেখেছি।সর্বশেষ এটুকুই বলবো আমার মনে যেহেতু আপনারা,আমার স্ত্রী এবং আমার ছেলে আমার মনে অনেক বড় আঘাত দিয়েছে আমি আপনাদের মেয়েকে আমার পক্ষ থেকে বউ হিসেবে সমথর্ন দেব কিনা জানি না।ভালে থাকবেন।”

বলে হৃদয়ের বাবা তনহন বসা থেকে উঠে নিজের রুমের দিকে চলে যান।আমি দরজা থেকে সরে বেলকনিতে চলে যাই।শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখটা দুইহাতে চেপে ধরি!ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠি।কিছুক্ষণ এভাবেই চলতে থাকে।হাসনা আমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে।কিছুতেই পারছি না।কীভাবে শান্ত হবো আমি?কীভাবে?আমি যে খুব বড় অন্যায় করে ফেলেছি হৃদয়কে বিয়ে করে!হৃদয়ের বাবার মানসম্মান,আমার মানসম্মান ধূলোয় মিশিয়ে দিয়েছি!আবারো অস্ফুট কেঁদে উঠলাম।এমন সময় পেছন থেকে,

“পারিসা?”

আমার মার গলার ধ্বনি।দ্রত চোখের পানি মুছে নিলাম।নিজেকে ধাতস্থতা করে পেছন ফিরে মার দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করলাম।পরে দেখি মার পেছন পেছন বাবাও এলেন।মা কিছু না বলে আমাকে হঠাৎ জড়িয়ে ধরলেন।কেমন ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় বলো উঠলেন,

“ভালো থাকিস,মা।যে যাই বলুক চুপ করে থাকিস।আল্লাহর দিকে তাকিয়ে ধৈর্য্য ধরিস।
পরের বাড়িটা বড্ড কঠিন রে মা!বড্ড কঠিন।”

বলে মা আমাকে আরো চেপে ধরেন।বাবা পেছন থেকে বলেন,
“দেরী হয়ে যাচ্ছে।চলো।”

মা আমার কাঁধ থেকে মাথা তুললেন।চোখের কোণে হয়তো পানি জমেছে।তা হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুছে নিলেন।বললেন,

“আসি রে, মা।গেলাম।ফোন করিস।”

আমি স্তব্ধ মুখে দাঁড়িয়ে রইলাম।মা যে চলে যাচ্ছে একটা শব্দও বের করতে পারলাম না।!নড়তেও পারলাম না!

চলবে…