#আমার_হৃদয়ে_সে
#রোকসানা_আক্তার
পর্ব-৩৩
দরজা ঠেলে হৃদয় ভেতরে ঢুকে।হাতে থাকা অনেকগুলো এক্সাম পেপারস সেন্টার টেবিলের রাখতে রাখতে বলে,
“যা ঝামেলা কলেজে!আজ থেকে আবার পরিক্ষা শুরু হয়েছে!”
বলে হৃদয় টেবিলের সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়ায়।মাথাটা সামান্য উপরের দিকে উঁচিয়ে লম্বা করে একটা শ্বাস ছাড়ে।আমি হালকা চোখে হৃদয়ের দিকে তাকাই।কপাল,গলায় বিন্দু বিন্দু ঘাম।শার্টের উপরের কিছু অংশ হালকা ভিঁজেও গেছে।চোখমুখ ফ্যাকাসে।মাথার চুলগুলো অগোছালো হয়ে আছে।দেখেই বুঝা যাচ্ছে হৃদয় ভীষণ ক্লান্ত!আমি কাপড়ের আঁচল ঠিক করে বসা থেকে আলতো পায়ে নামি।এতক্ষণে বিছানা ছিলাম।মা-বাবা যাওয়ার পর বিছানায় এসে বসেছি আর উঠি নি।এরমাঝে শাশুড়ী মা, হাসনা বহুবার এসেছে।সান্ত্বনা দিয়েছে।খেতে যেতে বলেছে।খেতে আর মুখে রুচি জমে নি।ছোট্ট একটা শ্বাস ছেড়ে হৃদয়কে বলি,
“ওহ!ফ্রেশ হয়ে আসুন।আমি খাবার বাড়ছি।”
বলে হৃদয়কে পাশ কেঁটে বেরিয়ে আসি।বেরিয়ে কাউকে দেখি নি।বোধহয় মা তার রুমে।আর হাসনা ঘুমিয়েছে।হাসনার রুমের দরজা বন্ধ।আমি নৈঃশব্দ পায়ে ডাইনিং এ এগিয়ে যেয়ে হদয়ের জন্যে শুধু একটা প্লেট নিলাম।তাতে ভাত বাড়লাম।সবজি,মাছ এবং ভর্তা আলাদা বাটিতে বাড়লাম।হৃদয় এরমাঝে চেয়ার টেনে এসে বসে।বলে,
“বউ?খেতে পেয়েছে তাড়াতাড়ি দাও।”
আমি ভাতের প্লেট ওর দিকে এগিয়ে দিলাম।ও প্লেটটা হাত বাড়িয়ে নেয়।বলে,
“তুমি খেয়েছো ত, পারিসা?”
আমি দমে এলাম কিছুটা।তারপর মাথাটা আলতো ঝাঁকলাম।তাতে বুঝালাম “খেয়েছি”।সে আর কিছু বললো না।খাবারে মনোযোগ দিলো।সে এখানে আর বলারও কিছু নাই।সে জানে আমার দুপুরের খাবারটা মা এবং হাসনার সাথে হয়।বিয়ের পরদিন ওরসাথে দুপুরে খেতে অপেক্ষা করেছিলাম।ভাবলাম ও আসলে ও এবং আমি দুপুরের খাবার একসাথে করবো।কিন্তু অপেক্ষাটা সেইদিন চারটের কাঁটায় পৌঁছায়।সে কলেজ থেকে ফিরতে খুব দেরী হয়ে যায়। আমার দুপুরে যেই খিদে ভাবটা ছিল তা বিকেলের দিকে খেতে বসাতে বমিতে পরিনত হলো।খেতে পারি নি।ভীষণ বমি পেয়েছিল সেদিন।তা দেখে হৃদয় বলে দিলো তারজন্যে যেন আর অপেক্ষা না করি।মার সাথে যেন খেয়ে নিই।কারণ সে কলেজ থেকে একই সময় প্রতিদিন ফিরতে পারে না।মাঝে মাঝে কলেজে চাপ থাকে ভীষণ।হৃদয়কে নুন,পানির জগ,গ্লাস দিয়ে বলি,
” আচ্ছা খান।খাওয়া শেষ হলে ডাকবেন।”
বলে চলে আসি।বেলকনির রেলিং ধরে দাঁড়াই।হঠাৎ করে ঝলমল আলোয় ভরা পরিবেশের মাঝে আমার মনোকাশে মেঘ জমতে থাকে।চোখের কোলে অশ্রু টুপটাপ করতে থাকে!রেলিং আরো শক্ত করে চেপে ধরি!নিজেকে শান্ত করতে কোনো অস্ত্র ই যেন খুঁজে পাচ্ছি না।এভাবে আরো কিছুক্ষণ সময় কাটে।এমন সময় পেছনে কেউ প্লেট রাখার শব্দ কানে বাজে।আমি তরহর চোখের পানি মুছে নিই।খুব ভালোভাবে মুছে নিই।হৃদয় পাশে এসে দাঁড়ায়।দৃষ্টি দূরের ওই ঝাউড়ি গাছের উপর রেখে বলে,
“খাওনি তা নিয়ে মিথ্যে বললে কেন?”
আমি আড়চোখে হৃদয়ের দিকে তাকাই!হৃদয় ঝাউড়ি গাছ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আমার দিকে সরু চোখে এবার তাকায়।আবার বলে,
“খাবার নিয়ে মিথ্যে বলা আমার একদম পছন্দ না।”
মাথা নুইয়ে ফেললাম।নিশ্চয়ই মা বলেছেন আমি যে খাইনি।
“খেতে আসো।আমি তোমার জন্যে খাবার নিয়ে এসেছি।”
বলে হৃদয় উল্টো দিকে পা বাড়ায়।আমি সেখানেই স্থির দাঁড়িয়ে থাকি।আমাকে না আসতে দেখে হৃদয় চোখমুখ কুঁচকে ফেলে।বলে,
“আমার কথা শুনতে পাচ্ছ,তুমি?”
তাতেও হেলদোল নেই!হৃদয় অধৈর্য্য হয়ে পড়ে। দুই কদম পায়ে আবার আমার কাছে আসে।গালে আলতো হাত রাখে।বলে,
“কিছু হয়েছে?”
আমি টানা টানা চোখে হৃদয়ের মুখপানে তাকাই।হৃদয় ডান ভ্রুটা নাঁচায়।মানে বলতাম।আমি কিছু না বলেই হঠাৎ হৃদয়কে খুব জোরে জড়িয়ে ধরি।ওর বুকে মুখটা লুকিয়ে দুইচোখ বুঁজি!কেনজানি ওর বুকে মাথা রেখে কাঁদতে ইচ্ছে করছে।ভীষণভাবে কাঁদতে ইচ্ছে করছে।পারছি না।পারছি না কাঁদতে।আমার আকস্মিক এহেন কান্ডের হৃদয় মানে খুঁজে পায় নি।তারপরও সে দুই হাতে আমাকে আগলে নেয়।আবার বলে,
“কিছু হয়েছিল পারিসা?”
আমি কিছু বলি নি।ঠায় ওভাবেই থাকি।কয়েক সেকেন্ড পার হতে আপনাআপনি উনাকে আবার ছাড়িয়ে নিই।এবার মুখ খুলি,
“নাহ।কিছু হয়নি।খাবো।”
বলে ভেতরে যাই।হৃদয় হয়তো কিংকর্তব্যবিমূঢ়!ভাবছে মেয়েটার হুটহাট এ কেমন বিহেভ?এ কি করতেছে সে তা নিজেই জানে না!আমি প্লেট হাতে নিতে হৃদয় পেছন থেকে বাঁধ সাঁধে।কাছে এসে বলে,
“আমাকে দাও।তুমি বিছানায় গিয়ে বসো।”
আমি কিছু না ভেবে ওর হাতে প্লেটটা দিয়ে বিছানায় যাই।সে আমাকে অবাক করিয়ে দিয়ে তার ডান হাতটা ধুঁয়ে নিয়ে খাবার প্লেট নিয়ে আমার পাশে এসে বসে।ভাতের নালা গোল গোল করে তা আমার মুখের সামনে তুলে।হেসে বলে,
“হা করো?”
আমি অবাক!আজ এই প্রথম হৃদয় আমাকে তার হাতে খাইয়ে দিতে এসেছে!
“কী হলো হাতে করো?”
আমি অবাক ভরা চোখেই মুখটা হাতে করলাম।এক লোকমা মুখে ফুঁড়ে দিলো।তবে সবটুকু খাবার শেষ করতে পারি নি প্লেটের।কয়েক লোকমা শেষ করতেই বমি চলে এলো।আপনারা জানেন কি না জানি না। আমি কোনো কারণে মন খারাপ করলে,বিষন্নতায় থাকলে সেদিন আমার পেটে কোনোকিছু হজম হয়না।সবকিছু বিতৃষ্ণা লাগে।আমার বমি বমি ভাব দেখে পরে আর হৃদয় জোর করে নি।ভাতে পানি ঢেলে তার হাতটা ধুঁয়ে নেয়।তারপর সেই হাতে আমার মুখ ধুঁয়ে দিয়ে আমাকে পানি খাইয়ে দেয়।
৫২.
সন্ধের আগে আগে ক্লান্তি শরীরটা নিয়ে শুয়ে পড়ি।ভাত খাওয়ানোর পর কিছুক্ষণ পর হৃদয়ই বলে শুয়ে থাকতে।আমি কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে থাকার পর হঠাৎ আমার দুই চোখ খুলে যায়।বাইরে থেকে কারো বিকট আওয়াজ কানে আসে।কেউ কারো সাথে গলা উঁচিয়ে উঁচিয়ে কথা বলছে!অসচল মস্তিষ্কে ভালোভাবে কোনোকিছু ঠাহরে আসছে না।আমি কাঁপা শরীর নিয়ে শোয়া থেকে উঠে দরজার কাছে এসে দাঁড়াই।বাইরে তাকিয়ে হৃদয় তার বাবার সাথে তর্কাতর্কি করতেছে!
“পারিসার মা-বাবার সাথে ওরকম ব্যবহার কেন করলে তুমি?কেন!জবাব দাও আমাকে!”
হৃদয়ের বাবা উনার রুমের দরজার সামনে সোজা দাঁড়িয়ে দুই হাত দুইপাশে ভাঁজ করে চোখমুখে কাঠিন্যতা ভাব ফুটিয়ে অন্যদিক তাকিয়ে থাকেন।
“কী হলো জবাব দিচ্ছ না যে!জবাব দাও আমার!”
বলে হৃদয় সোফার উপর খুব জোরে একটা ঘুষি মারে।হাসনা বলে,
“প্লিজ ভাইয়া,হট হয়ো না।প্লিজ রুমে যাও!”
“তুই সর!আগে উনার সাথে আমাকে হিসেবনিকেশ করতে দে!উনি আসলে চাচ্ছে টা কী?পারিসাকে বিয়ে করে আমি যেন মস্ত বড় অন্যায় করে ফেলেছি যে উনি যখন যা ইচ্ছে তাই করবে।যখন যা ইচ্ছে যে কাউকে তাই বলবে!হোয়াই!?”
হৃদয়ের বাবা তারপরও নড়ছে না।ওভাবেই ঠায় দাঁড়িয়ে।
“আমার জবাব চাই!”
হৃদয়ের বাবা এবার বলে উঠেন,
“জবাব চাস?তোর মতন ছেলের কাছে জবাব?বাবা হিসেবে বিয়ে করার আগে আমাকে একবার জানানোর প্রয়োজন বোধ তো করলিই না সাথে মানসম্মানটাও আমার রাখলি না!বাবা হয়ে এই পেলাম প্রতিদান!”
“তুমি আমার বাবা হয়েছো ঠিকই।তবে তোমার মনমানসিকতা ঠিক হয়নি।পারিসার সাথে ছোট্ট একটা শব্দ ” ডিভোর্স” যুক্ত হয়েছে বিধায় তুমি সেটার রেশ ধরে তার সাথে,আমার সাথে এবং পরিবারের সবার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছো!বাবা “ডিভোর্স ” শব্দটার তুমি মানে বুঝো?তুমি একটিবারও ভেবে দেখেছো পারিসাকে আমি বিয়ে করে আমি যে নেক আদায় করেছি।আমি তাকে অন্ধকারময় জীবন থেকে সুন্দর একটা জীবন দান করেছি।সমাজের মানুষের গীবত থেকে তাকে মুক্ত করেছি।আর সবথেকে বড় কথা আমি পারিসাকে ভালোবাসি।আর পারিসার সম্পর্কে কতটুকু বা জানো তুমি?পারিসা আমাকে যতটুকু ভালোবাসে।যতটুকু শ্রদ্ধা করে।তোমাদের সবাইকেও যতটা শ্রদ্ধা করে।মান্যতা দেয়। অন্য জায়গায় বিয়ে করালে ততটুকু পাবে তার নিশ্চয়তা দিতে পারতে?তখন বাইরে সম্মান পেলেও ঘরে চলতো অশান্তি!শুধুই তুখোড় অশান্তি!কখনোই সুখী নিজেরাও হতে পারতে না।আমিও না!শুকরিয়া।তুমি সেসব না ভেবে করে বারবার সমাজ সমাজ করছো!সমাজ কি তোমাকে মুখে তুলে খাইয়ে দেবে?দেবে না।আর পারিসা কোনদিক দিয়ে অযোগ্য?সে একজন শিক্ষিতা,সুশ্রীতা,ভদ্র ঘরের মেয়ে!আমার মতন ছেলে যে তাকে পেয়েছে এটাইতো আমার মহান আল্লাহর কাছে হাজারো শুকরিয়া।তবে আমার দুঃখ সেখানে নয়।আমার দুঃখ এখানে তুমি কীভাবে পারলে আমার শ্বশুর-শাশুড়ীকে অপমাণ করতে!তোমাকে আমি কি সেই রাইটস দিয়েছি?বলো দিয়েছি?!”
হৃদয়ের বাবা চুপ!হৃদয় বলে,
“কথা নাই তোমার মুখে এখন আর!আরও থাকবেই বা কীভাবে!তুমি আজ যা করলে না সেটা কোনো শত্রুও শত্রুর সাথে করে না!আমি আজ সাঁফ সাঁফ বলে দিচ্ছি সবার সামনে!মা তুমি সাক্ষী!তোমার স্বামী যদি আরও কোনোদিন পারিসার মা-বাবা আমাদের বাসায় এলে উনাদের সাথে আবার ওরকম অসদাচরণ করে তাহলে সেদিন এর হিসেব অন্যভাবে নিব!!”
বলে হৃদয় পেছন ঘুরে আমাকে পাশ কেটে বেলকনিতে সোজা চলে যায়!বাইরে তাকিয়ে বারকয়েক জোরে জোরে শ্বাস ছাড়ে!আমি সেই শ্বাস ছাড়ার শব্দ এখান থেকে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি।আমি টিপটিপ পায়ে ওর কাছে যাই।পিঠে আলতো হাত রাখি।বলি,
“কেন এরকম করছেন?বাবার দোষ কোথায়!দোষ বরং আমার এবং আপনার!আমরা উনার মনে কষ্ট দিয়ে বিয়ে করেছি!উনারতো আপনাকে নিয়ে অনেক বড় স্বপ্ন ছিল।সেই স্বপ্নটা আমরা শেষ করে দিয়েছি!”
হৃদয় কিছু বললো না।সেদিকেই তাকিয়ে থাকলো।
চলবে…