আমার হৃদয়ে সে পর্ব-৩৫

0
662

#আমার_হৃদয়ে_সে
#রোকসানা_আক্তার
পর্ব-৩৫

নভেম্বরের শেষ সময়।চারপাশ কেমন গুমোট বাঁধা মেঘলা।গত দুইদিন ধরে ঝাপটা বাতাসের সাথে বৃষ্টি নামছে।বৃষ্টি নামারও কোনো নিয়ম নাই।এই নামছে।আবার থামছে।আবার নামছে।এভাবে চলছে বৃষ্টির মেলা।শীতকালে বৃষ্টি দেখে ভার বিরক্ত লাগছে।আবার বিরক্ত হয়েও লাভ নেই।এটা বৈশ্বিক উষ্ণতার প্রভাব।আর বৈশ্বিক উষ্ণতা আমাদের দ্বারাই সৃষ্টি হয়েছে।শাশুড়ী মা আমার পাশে বসা।তিনি মনোযোগ দিয়ে সিরিয়াল দেখতেছেন।সিরিয়ালে বসেছেন মিনিট ত্রিশেক হবে।আমি বসেও সিরিয়াল না দেখার মতন।উনার কথাতে এখানে এসে বসেছি। উনার একা একা সিরিয়াল দেখতে নাকি ভালো লাগে না।হাসনাকেও বলেছেন উনার সাথে সিরিয়াল দেখতে।হাসনা সিরিয়াল দেখার বিপক্ষে।শোনা মাত্রই রুমের দরজা বন্ধ করে ফেলে।এখনো বন্ধ।হয়তো ফোন টিপতেছে।আমিও হাসনার মতন।সিরিয়াল দেখা আমার একদম পছন্দ না।তবে উপায় নেই।শাশুড়ী মা জোর করেছেন।না বসলে ব্যাপারটা কেমন খারাপ দেখাবে।বাইরে থেকে ধেঁয়ে আসা বাতাসের কারণে সিরিয়াল দেখতে উনার বোধহয় সমস্যা হচ্ছে।কেননা এরমাঝে উনি বার কয়েক কেঁপে উঠেছেন।আমি বলে উঠি,

“মা?জানালাটা বন্ধ করবো?”

শাশুড়ী এতক্ষণে যেন আমার এ’কথারই অপেক্ষায় ছিলেন।ছট করে বলে ফেলেন,
“হ্যাঁ বউমা, হ্যাঁ।জানলাটা বন্ধ করে।শীতের কারণে দেখার আমেজটাও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।”

আমি উঠে জানলা বন্ধ করতে গেলাম।এমন সময় সদর দরজায় কলিংবেল বাজে।শাশুড়ী মার দিকে একফোঁড় তাকিয়ে দরজা খুলতে এগিয়ে গেলাম।দরজ খুলে দেখি একজন প্রৌঢ়বয়সী লোক।অবশ্যি হৃদয়ের বাবার বয়সীই হবেন।উনি আমাকে দেখে হেসে বলে উঠেন,

“বউ মা, বুঝি?”
“জ্বী!তবে আপনি কে…!”
“তুমি চিনবে না।তোমার শ্বশুর বাড়ির সবাই চিনবে।”
“আচ্ছা ভেতরে আসুন।”
বলে সামনে থেকে সরলাম।উনাকে ভেতরে ঢুকার জায়গা করে দিলাম।উনাকে আমার শাশুড়ী মা দেখে ফেলেন।দেখেই হেসে বলেন,
“আরেহ ভাই যে!হঠাৎ আমাদের বাসায়?কি মনে করে?”
“বলবো।বলবো।আপনার বউ মা জিজ্ঞেস করে আমি কে।বলছি সে ছাড়া এ বাসার সবাই আমাকে চেনবে।”
“বউ মা নতুন এসেছে তো তাই চিনতে পারে নি।”
“সেটা তো বুঝেতে পেরেছি।তা বউ মা?”

বলে উনি পাশ ফিরে আমার দিকে তাকান।আমি এতক্ষণে আগের জায়গাতে ছিলাম।উনার ডাকে এবার শব্দহীন পায়ে এগিয়ে গেলাম।বললাম,
“জ্বী?”
“আমি তোমার শ্বশুর মশাই আছে না?”
“জ্বী…”
“তোমার শ্বশুর মশাইয়ের পুরনো বন্ধু।তোমার শ্বশুর এখানে আসার পর থেকেই তোমার শ্বশুরের সাথে আমার পরিচয়।”
“ওহ আচ্ছা।আচ্ছা আপনি বসুন আঙ্কেল।আমি আপনার জন্যে নাস্তা নিয়ে আসতেছি।”

পাশ থেকে শাশুড়ী মা বলেন,
“হ্যাঁ বউ মা তাই করো।”

আমি কিচেনে চলে এলাম।চা, বিস্কুট,দুই পদের ফলে সহ উনার সামনে ট্রে টাকা রাখলাম।উনি হেসে উঠলেন,
“কি দরকার ছিল বউ?এত কষ্ট করার?”
“আরেক ভাই কি যে বলেন!কতদিন পর আমাদের বাসায় এলেন।নিন ভাই।”

লোকটি চায়ের কাপ হাতে নিলেন।আমি চলে এলাম আমার রুমে।কিছুক্ষণ পর শাশুড়ী আমাকে আবার ডাকলেন।আমি বের হলাম।গিয়ে উনাকে আর দেখি নি।সম্ভবত চলে গেছেন।মা বললেন,
“যিনি এখন আসলেন না? মানে মুস্তাফা ভাই?উনার বড় মেয়ে ফারিহার আগামী সোমাবারে বিয়ে।আমাদের সবাইকে দাওয়াত দিয়েছে।বলেছে যেভাবেই হোক যেতে।এই যে কার্ড।”

কার্ডটা হাতে নিলাম।আর বললাম,
“বাবার হাতে দিলে ভালো হতো না কার্ডটা?যেহেতু বাবার বন্ধু?”
“গতকাল নাকি দোকানে দেখা হয়েছিল তোমার শ্বশুরের সাথে মুস্তাফা ভাইয়ে।কার্ড তোমার শ্বশুরের হাতেই দিতে চেয়েছিলো।তোমার শ্বশুর নাকি বললো কার্ডটা আমাদের হাতে দিতে।”
“বাবা যাবেন বিয়েতে?”
“মুস্তাফা ভাইকে বললো নাকি যাবে। ”
“যাক আলহামদুলিল্লাহ।টেনশন মুক্ত হলাম কিছুটা।তারমানে আমরা পরিবারের সবাই যাচ্ছি?”
“হু।”

৫৫.
আজ সোমবার।মা আজ সকাল সকালই রান্না ঘরে ঢুকেছেন।টার্গেট দশটার ভেতর রান্নাটা শেষ করে ফেলবেন।তারপর লম্বা সাঁজ দিয়ে মুস্তাফা আঙ্কেলের বাসায় ছুটবেন।বিয়েতে যাওয়ার খুশিতে হাসনা একটু আগে থেকেই তার সাজার সবগুলোই সরন্জাম নিয়ে বসেছে।কসমেটিকস,জামাকাপড়, জুতো আরো অনেককিছু। কোনটা পড়লে মানাবে,কোনটা মানাবে না।আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চয়েজ করতেছে।তার ওহেন কান্ড হেসেছি।আর আমার জামাইটা কোথায় এখন জানেন?রুমে!একটুপর নাস্তা করতে ডাইনিং এ আসবে।নাস্তা শেষ করে কলেজে ছুটবে।এক,দুই ক্লাস করিয়ে প্রফেসরের থেকে ছুটি নিয়ে চলে বাসায় ফিরবে।তারপর আমাদের সাথে বিয়েতে যাবে।গতকাল রাত অনেকবার বলেছি আজ সারাদিনের জন্যে ছুটি নিয়ে আসতে।মানে নি আমার কথা।সে কিছুতেই কলেজ মিস দিতে পারবে না।এক রেসপন্সিবিলিটিজ নামক ব্যাপার আছে তাই!আর আমার শ্বশুর কি করে এখন জানেন? উনার রুমে!আমি এখন উনার জন্যে নাস্তা নিয়ে যাবো।আপনারা হয়তো একটা বিষয় এখনো জানেন না।সেদিনের পর থেকে আমার শ্বশুর আমার সাথে এবং হাসনার সাথে হালকা পাতলা কথা বলেন।একদম বেশি কথা না আবার।প্রয়োজনীয় কথা বলেন।এই যেমন খাবার নিয়ে গেলে কোনোদিন খান।আবার কোনোদিন খান না।না খেলে বলেন,”খাবো না।নিয়ে যাও।”নিয়ে আসি।আর যেদিন খাবেন চুপ করে থাকেন।জবাব দেননা।আমি বুঝে ফেলি।খাবার রেখে চলে আসি।উনার দিকে ভালোভাবে তাকালে বুঝি আমার উপর থেকে এখনো রাগটা উনার পুরোপুরি যায় নি।তবে ইনশাআল্লাহ আমি পারিসা চেষ্টা চালিয়েই যাবো।হাল ছাড়বো না।দেখি শ্বশুর কয়দিন আমাদের সবার উপর রাগ করে থাকতে পারেন!

৫৬.
ঠিক দুপুরে আমরা সবাই রেডি হয়ে বাসা থেকে নামি।আমরা সবাই বলতে হৃদয়,মা,হাসনা,রুনু এবং আমি।আর বাবা আমাদের আগেই চলে গেছেন।যাওয়ার আগে আমাদের কিছু বলে যাননি।বাসা থেকে বের হবার সময় সেজেগুজে বেরিয়েছেন।তাই দেখেই বুঝলাম মুস্তাফা আঙ্কেলের বাসায় যাচ্ছেন।আমরা দুইটা এপার্টমেন্ট পার হলেই মুস্তাফা আঙ্কেলের বাসার সামনে এসে দাঁড়াই।আমি কৌতূহলী হয়ে যাই।সড়গড় পেছনে তাকাই।চোখ বড় করে হৃদয়কে বলি,
“আপনাদের বাসা থেকে তো এই বাসার দূরত্ব খুবই কম!”

হৃদয় হেসে দেয়।ওর হাসিটাতে আমার চোখ আঁটকে যায়।এতক্ষণে আমিতো হৃদয়কে খেয়ালই করিনি।পড়নে লাইট ব্লু জিন্স।স্লিভলেস ডেনিম করা পিংক কালারের শার্ট।শ্যাম উজ্জল মুখটায় বেশ মানিয়েছে ড্রেসাপ!এবার আরেকটু গভীরে তাকাই।গভীরতার দৃষ্টি নাকের দিকে।নাঁকের ঢগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে ছেলেটার!মাথার উপর সূর্য।তার এক রশ্মি মৃদু আলো নাঁকের উপর পড়েছে।বিন্দুগুলো মুক্তোর মতন চিকচিক করছে যেন।উইু!মন চায় সেখানে একটুখানি ছুঁয়ে দিই।

“পারিসা?দাঁড়িয়ে আছো যে?চলো না?”

টনক নড়লো এবার!চমকানোর মতন আশপাশে তাকাই।মা,হাসনা এবং রুনু অনেকখানি উঠে গেছে সিড়ি বেয়ে।হৃদয় আমার সাথে নিচে দাঁড়িয়ে আছে।মুস্তাফা আঙ্কেলের বাসা দু’তালায়।আমি হৃদয়ের হাত ধরে দু’তালায় উঠি।এসে পুরো ডাইনিং এবং হলরুম জুড়ে মেহমানের ঢল!মাকে,হাসনা এবং রুনুকে দেখছি না।এত মেহমানের মাঝে তারা যেন হাওয়া হয়ে গেল!হৃদয়ের কান বরাবর আমার মুখটা এগিয়ে এনে চাপা গলায় বলি,

“মা,হাসনা এবং রুনু কোথায়?তাদের দেখছি না!”
“আছে কোথাও।”

আবার বলি,
“বউকেও তো দেখছি না!বউ কোথায়?”

এ’কথার পিঠে হৃদয় আমার দিকে সরু চোখে তাকায়!তার তাকানোর ভঙ্গিতেভ্যাবাছ্যাকা খেয়ে যাই! হৃদয়কে এ আবার কি কথা বললাম!সে জানবে কি করে যে বউ কোথায়!আমিও না মাঝে মাঝে কেমন উদ্ভট কথাবার্তা বলে ফেলি!দাৎ!ভাবনার মাঝে কোথা থেকে মুস্তাফা আঙ্কেল আমাদের সামনে এসে দাঁড়ান।বলেন,
“এসেছো তোমরা?”

হৃদয় সালাম করে উঠলো।আমিও সালাম করলাম।তিনি হাসিমুখে জবাব নিলেন।বললেন,
“আচ্ছা,এভাবে না দাঁড়িয়ে ওখানে গিয়ে আগে বসো।আঙ্কেল একটু পর এসে কথা বলতেছি।”

দেখেই বুঝা যাচ্ছে মুস্তাফা আঙ্কেল ভীষণ ব্যস্ত।ব্যস্ত না হয়েও উপায় নাই।মেয়ের বিয়ে বলে কথা। ব্যস্ততা
থাকবেই।হৃদয় মাথা নাড়ে।তারপর আমার হাত ধরে লোকসমাগম এড়িয়ে একটা রুমের সামনের কিছু অংশ খালি।সেই খালি জায়গাটা দুইটা লাল চেয়ার দখল করে আছে।হৃদয় সেখানে নিয়ে সে একটা চেয়ারে বসে।এবং আমাকে অপরটিতে বসায়।
বসার কিছুক্ষণ পর কোথা থেকে হাসনা এসে আমার বাম বাহু চেপে ধরে।উৎফুল্লতার সুরে বলে উঠে,

“আরেহ এখানে বসে আছো কেন,ভাবী?বউকে দেখবা না?বউকে যা সুন্দর করে সাজিয়েছে না ?দেখলে ফিদা হয়ে যাবা!আমি মাত্র দেখলাম।মাও এবং রুনু আপা বউয়ের রুমেই আছে।”

হৃদয় বলে,
“আচ্ছা,তাহলে তুমি হাসনার সাথে সেখানে যাও।আমি এখানেই আছি।”
বউকে দেখাতে হাসনা আমাকে করিডোর দিয়ে বড় একটা রুমে নিয়ে আসে।রুমে অনেক মানুষজনই আছে দেখছি।।মাকে এবং রুনুকেও দেখেছি।হাসনা টেনে একেবারে বউয়ের সামনে আমাকে এনে দাঁড় করায়।বলে,
“ফারিহা আপু?এই যে দ্যাখো?এই হলো আমার ভাবী।আর ভাবী?ইনিই ফারিহা আপু।মানে বউ!”

শেষ কথাটা বলে হাসনা কটকট করে হেসে দেয়।ফারিহা নামের নববধূ কিছুটা লজ্জার মতন করে মাথা নুইয়ে নেয়।তারপর ফারিহার সাথে আমি পরিচিত হলাম।ফারিহাও হলো।অনেকক্ষণ বসে বসে দুইজন অনেক কথা বললাম।কথা বলার ফাঁকে কেউ একজন পেছন থেকে বললো,

“আচ্ছা?তোমার মাথাটা একটু সরাও বউকে দেখতে পাচ্ছি না।”

আমি ফারিহার কিছুটা সামনে বসা ছিলাম।আমার কারণে হয়তো ফারিয়াকে আমার পেছন থেকে দেখতে সমস্যা হচ্ছিল।আমি সরে এবার আরেকটু দূরে বসলাম।বসে পেছন থেকে বলা মহিলার দিকে কেনজানি অজান্তে তাকালাম।দৃষ্টিটা মুহূর্তে সেখানেই আঁটকে গেলো!আমার সেই স্থির দৃষ্টির সামনে অভির মা দাঁড়িয়ে আছেন এখন।মানে আমার প্রথম শাশুড়ী মা!

চলবে…