#আমিই_সেই_তন্নি
#Nadia_Afrin
পর্ব ১
বুধবারের এক উষ্ণ বিকেলে বারান্দায় বসে আছি আনমনে।
রকিং চেয়ারে মাথা ঠেকিয়ে আধশোয়া হয়ে আছে তন্নি।চোখের চশমাটি পাশেই পড়ে আছে মলিন অবস্থায়।
খুব দ্রুতই কেঁটে যায় যেন সময়।
এইতো সেদিন আলিফের জন্ম হলো।আজ তার বয়স সতেরো।নতুন কলেজে ভর্তি হয়েছে।ভীষণ ব্যস্ত বন্ধুবান্ধব ও নতুন জীবন নিয়ে।
মেয়েটার কথা আর কী বলবো!
মাকে তার মনেই থাকেনা।পড়াশোনা ও নাচ নিয়ে ব্যস্ত।নাচ ভীষণ প্রিয় আমার মেয়ে অর্নির।
নাচের স্কুলে ভর্তি ও হয়েছে।পড়াশোনা বাদে যেটুকু সময় পায়, নাচের পেছনে ব্যয় করে।
মানুষ বলে,নদীর স্রোতের মতো সময় বয়ে যায়।
আমি বলি নদীর স্রোতের চেয়েও সময় আরো বেশি দ্রুত।স্রোত তাও দেখা যায়।সময় যায়না।শুধু অনুভব করা যায়।
জীবনের অনেক গুলো বছর পার হয়ে যাওয়ার পর অনুভব হয় সময়কে।
যেমনটা হচ্ছে আমার।
খুব দ্রুতই যেন বুড়ো হলাম আমি।
যদিও লোকে বলে আমার রুপ,লাবন্য এখনো আছে।আমি তা মনে করিনা।আমি ভাবি আমি বুড়ি হয়ে গেছি।
এতো বড়ো বড়ো ছেলে-মেয়ে আমার।বয়স না হয়ে উপায় আছে!
চোখে আমার মোটা ফ্রেমের চশমা হলেও চশমা ছাড়াই দেখি স্পষ্ট।বয়স বোঝাতে ভারী চশমা ব্যবহার করি।
সতেরোতে বিয়ে করে আঠারোতে প্রথম সন্তানের মা হয়েছিলাম।ছেলের বয়স সতেরো হলে মায়ের হয় পয়ত্রিশ।
কিন্তু আমার নিজের কাছে মনে হয় পঞ্চাশ পেড়িয়েছে।
লোকে বলে এই বয়স তেমন কিছু না।
আমি বলি অর্ধেক পা কবরে গেছে।
যাকগে সেসম!
জন্মেছি একদিন।মরবো একদিন।বয়স শুধু সংখ্যা মাত্র।
মন হলো আসল।কিছু মানুষ শেষ বয়সে এসেও কতো আনন্দ করে বেড়ায়।জীবনটাকে রঙিন করে রাখে।আমার মনে আবার রঙ তো দূরে থাক,আলোও নেই।আগ্রহ খুঁজে পাইনা।
বেশি লোকের সমাগমে যাইনা।কারো গল্পে তাল দেইনা।কোনো উৎসবে যোগ দেইনা।
ঘরেই শান্তি পাই।ঘরের চার দেওয়ালই আমার সব।
ইদানিং একা থাকতে ভীষণ কষ্ট হয় আমার জানেন!
মনে হয় কেউ নেই আমার।
রাত হলে দম বন্ধ লাগে।বারান্দায় বসে রাতের পর রাত কাঁটাই।খোলা আকাশ পানে তাকিয়ে রই এক দৃষ্টিতে।রাত পার হয় এভাবেই।
কখনো ঝুম বৃষ্টি হলে একা একাই ভিঝি।ভীষণ নিঃসঙ্গতা অনুভব করি।সঙ্গে কেউ থাকলে মন্দ হতোনা।অন্তত একজন বন্ধু থাকতো।
আগে কাজের চাপে এসব অনুভব করিনি।কাজ নিয়ে ব্যস্ত থেকেছি।
এখন কাজ কমে গেছে।কমেছেও ছেলের আদেশে।ছেলে এখন বড়ো হয়েছে।মাকে শাষণ করে।ভালো-মন্দের বুঝ দেয়।
এইতো সেদিনের কথা,,,
এক কাজে বাইরে গিয়েছি।হঠাৎ চোখে অন্ধকার।
গাড়ি অব্দি যে আসবো সেই অবস্থাও নেই।ধড়াম করে পড়ে গেলাম।
আশেপাশের মানুষ এগিয়ে এলো।হাসপাতাল নিল।ছেলেকে খবর দিল।
ছেলে হাসপাতাল এসে সে’কি বকা আমায়।
বারবার বলেছে কাজের প্রেশার কম নিতে। রেস্ট করতে।ঠিকমতো ঘুমাতে,খেতে।
আমি বাবা কাজ ছাড়া থাকতে পারিনা।হাতে কাজ থাকলে রাত জেগে হলেও কমপ্লিট করা চাই।এতো দিনের অভ্যাস আমার বয়সের কাছে হার মেনে যায়।
এরই মাঝে যুক্ত হলো ডাক্তার ভাই।ইনি আমার পরিচিত।ভাই-বোন তূল্য সম্পর্ক।
ছেলেকে বকতে দেখে তিনিও যোগ দিল।
অতিরিক্ত প্রেশার নেওয়ার ফলে শরীর ভেঙে পড়েছে।রাতে না ঘুমোনোর কারণ।সঙ্গে ঠিক মতো খাইনা।নিজের যত্ন নেইনা।রোদে রোদে ঘুরে বেড়াই।আরো কতো কী!
আমি কিঞ্চিৎ হেসে বলি,”দুনিয়ার সব অসুখ যেন আমাকেই পেয়েছে।”
ছেলে রেগেমেগে তেড়ে এসে বলে,”তুমি এখনো হাসছো আম্মু?
শরীরের দিকে তাকিয়েছো একবারো?
চোখের নিচের কালো দাগ গুলো দেখেছো কোনোদিন?
শুকনো হাত-পা গুলোর দিয়ে নজর দিয়েছো?
এতো অনিয়ম কেন করো আম্মু?
তুমি কী ছোট বাচ্চা?
মানুষ ধীরে ধীরে বড়ো হয়,ম্যাচিউর হয়।তুমি ধীরে ধীরে ছোট বাচ্চা হচ্ছো।
এবার তোমার অভিবাবক হয়ে আমাকেই নামতে হবে দেখছি।
আমাকে নিজের পিতার চোখে দেখবে আজ থেকে।যা বলবো তাই শুনবে।কথা না শুনলে বকা খেতে হবে।”
এরপর থেকে ছেলে পেছন লেগেছে আমার।রুটিন তৈরি করেছে।কখন কী খেতে হবে,কোনটা কখন করতে হবে সব লিখে রেখেছে।
সঙ্গে ঘুমের ঔষধ নিয়ে এসেছে।
কমেটির প্রধান পদটা আরেকজনকে দিয়েছি।
আমি শুধু এখন আমাদের গ্রুপ আর এতিমখানা সামলাই।বাহিরের কাজ খুব কমই করি।ছেলে করতে দেয়না।না জানি কবে এগুলোও বন্ধ করে ঘরে বসিয়ে দেয়।
কাজ ছাড়া ভালো লাগেনা।একাকিত্ব গ্রাস করে।
ছেলে রুটিন তৈরি করেছে ঠিকই।তবে রুটিন মতো কাজগুলো করিয়ে দিতে পারেনা।
সব দায়িত্ব আমার।খাওয়া,ঘুম,রেস্ট সব সব সব আমার একাই করতে হবে।
ওরা শুধু পরামর্শ দিতে পারে।হাতে ধরে করাতে পারেনা।একবেলা মনে না থাকলে মনে করিয়ে দিতে পারেনা।
সেই নিজের যত্ন আমার নিজেকেই নিতে হয়।
সত্যি সত্যিই মানুষটা আমি ছোট হয়ে গেছি।
অদ্ভুত চিন্তা করি।
মন চায় কেউ আমায় যত্ন করে খাইয়ে দিক।সময় মতো ঔষধ এনে হাতে দিক।
ঘুমের বড়িতে নয়,প্রাকৃতিকভাবে ঘুমোতে চাই আমি।ঘুমের বড়ি খেলে ঘুম হয় ঠিকই,তবে সেটা প্রশান্তির নয়।মনে হয় নেশার মাঝে চলে গেছি।অনেকটা সময় পর নেশা ভেঙে গেছে।
আমি চাই একটা সুস্থ, স্বাভাবিক ঘুম।কেউ স্বযত্নে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিক।
আমি ঘুমোই।সুন্দর একটা স্পপ্ন দেখি।পরদিন সেই স্বপ্ন মনে করি একটু হাসি।
ঔষধের ঘুমে স্বপ্ন হয়না জানেন!
হলেও তা মনে থাকেনা।এলোমেলো লাগে।
কিন্তু এই বুড়োটাকে আর কে ঘুম পারিয়ে দেবে ভালোবেসে?
ছেলে পড়াশোনা নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত।রাত জেগে পড়ে।মেয়েতো এতিমখানা থেকে আসেই না।
এতে অবশ্য আমি খুশিই হয়েছি।বেঁচে থাকতে থাকতে ওরা নিজেদের জীবন,ক্যারিয়ার গড়ে নিক।আমি দেখে যেতে চাই।
আমার জীবনের সবই প্রায় শেষ।ওদের এখনো পুরো ভবিষ্যত বাকি।ওরা এগিয়ে যাক নিজ ছন্দে।
আমি না হয় পড়ে রইলাম এক কোণে।
আনমনে এসব ভাবছিলাম।
হঠাৎই ছেলের প্রবেশ আমার ঘরে।
এসেই নত মুখে বললো,”কী করছো আম্মু একা একা?
আমি চোখ কোচলে চশমা পড়ে মুচকি হেসে বললাম,”একা মানুষ একাই তো থাকবে।
আমার এক কাপ চায়ের সঙ্গী আর কে হবে।”
ছেলেকে দেখলাম একটু বিব্রত হলো।
প্রসঙ্গ পালটে বললাম,”কী বলতে এসেছো?কোনো দরকার?”
ছেলে মাথা ঝাকায়।
বলে,”আমি একটা বিষয় ভাবছিলাম আম্মু।
এখান থেকে আমার কলেজ দূরে। পৌঁছাতে সময় লেগে যায় বেশ।
তোহ চাচ্ছিলাম কোনো বয়েস হোস্টেল গিয়ে উঠি।
আমার কলেজের পাশেই এমন একটা হোস্টেল আছে।সবকিছুই ভালো সেখানকার।আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি।”
ছেলে থামে।
আমি দু-দন্ড মাথা নিচু করে রইলাম।এরপর বললাম,”যেতেই পারো।তবে সবে কলেজে ভর্তি হয়েছো।এর মাঝেই দূরে শিফ্ট হওয়া কোনো সমস্যার হবেনা?”
আলিফ ততক্ষণাৎ জবাব দেয়,”কোনো সমস্যা হবেনা আম্মু।আমার কিছু বন্ধুও সেখানে উঠেছে।
ওরা সব ব্যবস্থা করেই রেখেছে।তুমি শুধু অনুমতি দেবে।এছাড়াও আমি বড়ো হয়েছি।নিজের সুবিধা-অসুবিধা বুঝতে শিখেছি।ভেবেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি।”
একগাল হাসি আমি।ছেলে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।
উঠে দাড়িয়ে বারান্দার রেলিং ঘেসে দাড়ালাম।
বাচ্চারা বড়ো হয়েছে।নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিতে পারে।এখন আর আমাকে প্রয়োজন হয়না।
ভেবেছিলাম আলিফ পরামর্শ নিতে এসেছে।
এখন দেখছি সে শুধু জানাতে এসেছে আমায়।একপ্রকার কর্তব্য পালন করছে।মাকে বলা কর্তব্য।
ভালোই হয়েছে।ছেলে দিন-দুনিয়া চিনতে শিখেছে।সময় এসে গেছে এবার ওকে কাছ ছাড়া করার।নিজের জীবন নিজে গুছিয়ে নেওয়াই ভালো।কেউ কারো জন্য নয়।
কিন্তু মন যে আমার মানেনা।
এই সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়েই এতোকাল বেঁচে আছি।ওদের ছাড়া থাকি কীভাবে?
আমি বোধহয় স্বার্থপরের মতো কথা বলছি।বাস্তবতা কেন যে মেনে নিতে পারিনা!
ছেলে পেছন এসে দাড়িয়েছে ইতিমধ্যেই।ভীষণ আগ্রহী সে।
আবারো প্রশ্ন করলো,”কী হলো আম্মু?কিছু বললে না যে!”
“তুমি যেতে পারো।কবে যাবে জানিয়ে দিও।”
ছেলের মুখে হাসির ছটা।এটাই আমি চাই।ওরা ভালো থাকুক।ওদের জন্যই সব পরিশ্রম আমার।নিজের জন্য কিচ্ছু নয়।
কল আসে ফোনে।কাজ পড়ে গেছে।এক্ষুনি যেতে হবে আমায়।এটাই জীবন আমার।
তৈরী হয়ে বের হই।কিছু লোকের সঙ্গে দেখা করি।কাজ ছিল।করে নিয়ে বের হয়ে গাড়িতে উঠবো এমন সময় ডাকে কেউ।
পেছন ফিরতেই দেখি সেই লোককে।সেদিন যখন অসুস্থ হয়ে পড়ে গেছিলাম,ইনিই হাসপাতালে নিয়েছিল আমায়।আলিফকেও জানিয়েছিল ইনি।বড্ড উপকার করেছিল মানুষটা।
আমি দাড়াই।লোকটা এগিয়ে আসে।
হাসি হাসি মুখ করে বলে,”চিনতে পেরেছেন?
আমি ঐদিন আপনাকে হাসপাতাল নিলাম।”
বললাম,”হ্যা চিনেছি।আপনাকে সেদিন ধন্যবাদ দেওয়া উচিৎ ছিল।দিতে পারিনি।
আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ আপনাকে।”
লোকটা খুব সামান্য হাসে।
প্যান্টের পকেটে হাত রেখে বলে,”আজ দেখা হবে ভাবতে পারিনি।
আপনার খোঁজ করেছিলাম।হাসপাতালেও গিয়েছিলাম পরে।
শুনলাম আপনাকে নাকি নিয়ে গেছে।মনটা তখন খারাপই হয়েছিল।
যাকে অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে আনলাম।তার একটু খোঁজ নেওয়া হলোনা ভেবে মনটা বিষন্নতায় ছেয়ে গেছিলো।”
আমি সৌজন্যতা সূচক হাসলাম।
লোকটা আবারো বলে,”তা আপনি ঠিক আছেন?
সুস্থ আছেন আপাতত?”
“জ্বী।ভালোই আছি।”
আমি চুপ গেলাম।
লোকটা নিজের হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে,”আজ তাহলে আসি।আমার ক্লাস আছে।
ভাগ্যে থাকলে অন্যকোনোদিন দেখা হবে।নিজের যত্ন নেবেন।
অসুস্থ দূর্বল শরীর নিয়ে বেশিক্ষণ বাইরে থাকবেন না প্লিজ।এবং সঙ্গে কাউকে নিয়ে বের হবেন।
বিপদের কথা বলা যায়না।”
“সঙ্গে নেওয়ার মতো কেউ নেই।যাকগে সেসব।আপনিও ভালো থাকবেন।আজ আসি।আমারো কাজ আছে।”
বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম।
মানুষের জীবন কতো বিচিত্র।ছোট্ট এই দুনিয়ায় দেখা হয়েই যায় সকলের সাথে।
গাড়ি করে সোজা এতিমখানায় পৌঁছালাম।
কিছু পেপার্স জমা দেওয়ার ছিল কমিটিতে।সেগুলো দিয়ে বসলাম একটি ঘরে।মাথাটা ভীষণ ধরেছে আমার।কেমন ঝিম ঝিম করছে।এক কর্মচারী আমার অবস্থা দেখে এককাপ চা বানিয়ে দিয়ে গেল।
চা হাতে বসলাম।
গণিত বিষয়ের শিক্ষিকা এগিয়ে এলো।
আমার পাশে বসে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।
চায়ে চুমুক দিয়ে বললাম,”কী দেখছেন ম্যাম?
এই বুড়িটাকি খুব সুন্দরী হয়ে গেছে?”
“আহ তন্নি!
নিজেকে সবসময় বুড়ি বুড়ি বলা বন্ধ করো।
তুমি নিজেই নিজেকে বুড়ি করে রাখছো।
চোখের বড়ো চশমাটা খুলে,চুলগুলো ছেড়ে,লাল টকটকে একটা শাড়ি সঙ্গে চোখে হালকা কাজল দিয়ে কখনো আয়নার সামনে দাড়িয়েছো?
দেখেছো নিজেকে সুক্ষ দৃষ্টিতে?
রুপ তখন আপনাআপনি ধরা দেবে।”
“আমার বাবা ওতো সময় নেই।দুটো খেয়ে শুতে পারলেই হয়।
এছাড়াও কালো গর্তের ভেতরে ঢাকা পড়া চোখ দুটিতে কাজল দিলে মানাবেনা ম্যাম।বড্ড বেমানান লাগবে।ভুত লাগবে।”
উচ্চশব্দে হেসে উঠি আমি।
ম্যাম ধীর স্বরে বলে,”এই কালো চোখেরই মায়ায় যে পড়বে তার কাছে অপরুপ হয়ে ধরা দেবে কাজল রাঙা চোখ দুটি।
অপ্সরা হয়ে ধরা দেবে তার চোখে।”
আমি চুপ করে রই।এসব কথা আমার কাছে ভিত্তিহীন।অবান্তর।
ম্যাম উঠে দাড়ান।
শান্ত ভঙ্গিতে বলেন,”স্বামীর মৃত্যুর পর শশুরবাড়িতেও ঠায় ছিল না আমার।নিজের ঘর থেকে বের করে দিল দুই মেয়ে সমেত।
পুত্র সন্তান না হওয়ায় কোনো অধিকারই রইলোনা ঐ বাড়ি।
মেয়েদের নিয়ে আশ্রয়ের জন্য এখানে এলাম।
তোমার সহযোগিতায় চাকরিটা পেলাম।তুমি বলো চাকরি আমি নিজ যোগ্যতায় পেয়েছি।
তুমি পাশে না থাকলে আমার এই যোগ্যতা মর্যাদা পেতো না।
এরপর কর্মজীবনে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।
মেয়ে দুটোকে মানুষ করে বড়ো করে তুললাম।একা একাই লড়াই করলাম এতোকাল।
বিয়ের প্রস্তাব এসেছে অসংখ্য।রাজি হইনি।ভেবেছি মৃত স্বামীর প্রতি অবিচার হবে।তাকে ঠকানো হবে।
একাই রয়ে গেলাম।
বয়স বাড়লো।মেয়েদের বিয়ে হলো।ভেবেছিলাম ছোট বেলার মতোই মেয়ে দুটো আমার সঙ্গ দেবে।অন্তত সপ্তাহ বাদে একটা দিন আমার সঙ্গে কাঁটাবে।
কিন্তু তা আর হলো কই।দিনশেষে তারাও স্বামী,সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।অভাগী এই মায়ের কথা আর ওদের মনেই পড়েনা।
একলা ঘরে পড়ে থাকতাম কেউ খোঁজ নেওয়ার নেই।কল দিলে কথা বলে না দিলে নাই।
মাঝবয়সে এসে একজন সঙ্গীর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলাম।একা থাকতে ভয় হতে লাগলো।
কেউ একজনকে খুব বেশি প্রয়োজন মনে হলো।
আবার মৃত স্বামীর কথাও চিন্তা করি।
ভাবলাম,যে দুনিয়াতে নেই তার প্রতি দুনিয়ার ভালোবাসা,অনুভূতি সবই মূল্যহীন।তার জন্য যাবে শুধু দোয়া টুকু।
এসব ভালোবাসা,কথা দেওয়ার কোনো মূল্য নেই।
তাই সিদ্ধান্ত নিলাম জীবনকে আর একটা সুযোগ দেওয়ার।
বিয়ে করলাম।মনের মানুষ পেলাম।
এখন আমার হেসে- খেলে দিন পার হয়।কাজ বাদে যতোটা সময় পাই স্বামীর সঙ্গে ঘুরতে যাই আনন্দ করি।
কাল আমাদের একবছর পূর্ণ হবে।
একটা ছোট্ট অনুষ্ঠান করবো।বলতে পারো বুড়ো কালে ভীমরতি।
কী করবো বলো!
শরীর বুড়ো হলেও মনটাযে সেই আগের রয়ে গেছে।লোকে বলুক যা ইচ্ছে।আমরা আমাদের মতো জীবনকে উপভোগ করি।লোকের কথা ধরতে গেলে সারাজীবন দুঃখে মরতে হবে।
কাল তুমি আসবে কিন্তু।সঙ্গে বাচ্চারাও।
দাওয়াত নয়।অনুরোধ,আদেশ,নির্দেশ সব রইলো।
না আসলে বর নিয়ে তোমার বাড়ি গিয়ে কিডন্যাপ করে আনবো তোমায়।”
“অবশ্যই চেষ্টা করবো।আপনি তো জানেন,হই-হুল্লোর খুব কমই পছন্দ করি।
অনুষ্ঠানে খুব কমই যোগদান করি।আপনার মনটা সতেজ রয়েছে ম্যাম।তাই যেকোনো কাজে আনন্দ খুঁজে পান এখনো।
আমার মনটা নির্জিব।বলতে পারেন মৃত।”
“মৃত মনকে জাগ্রত করো তন্নি।মৃত মনের অমৃত প্রয়োজন।ভালোবাসা প্রয়োজন।
আমার মতোই জীবনকে সুযোগ দাও।
এখন আমাদের আগের চেয়ে বেশি চাঙা থাকার কথা।আগে সন্তানদের মানুষ করা,বড়ো করা একটা দায়িত্ব ছিল কাধে।এবার আমরা কাধছাড়া হয়েছি।
চিন্তামুক্ত হয়ে বাকিটা জীবন পার করা উচিৎ আমাদের।কেন বুঝছো না তন্নি?
ছেলে-মেয়ে বড়ো হয়ে যায়।ব্যস্ত হয়ে যায়।
ছেলেটা এখন কাছে আছে।কদিন পর বিয়ে করলে তার মতো সে সংসার নিয়ে ব্যস্ত হবে।মেয়ে পরের ঘরে যাবে।
তোমার কাছে কে থাকবে?
তুমি নামক এই বুড়োটাকে সামলানোর জন্য হলেও একজন মানুষ প্রয়োজন।”
ম্যামের কথা যৌক্তিক।
কিন্তু আমি মানতে নারাজ।
বললাম,”সে পরের চিন্তা পরে করা যাবে।
ছেলে-মেয়ে বড়ো হয়েছে।এখন ওসব ভাবলে চলবেনা।যখন সময় ছিল তখনই ভাবিনি।
এখন আর বলে লাভ কী?”
“সময় যখন ছিল,সময়কে কাঁটানোর মানুষও ছিল।ধীরে ধীরে সময়ের পরিবর্তন হয়েছে।কিছু মানুষ হারিয়ে গেছে।ছেলে-মেয়ে বড়ো হয়েছে।যে যার জীবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।
তুমি রয়ে গেলে একই স্থানে।
এভাবে আর কতোদিন তন্নি?
একটা বয়সে এলে চরম নিঃসঙ্গতা অনুভব হয়।
ইচ্ছে করে কেউ একটু থাকুক পাশে।
একটু ভালো লাগা,মন্দ লাগা উজাড় করে দেই তার তরে।”
উঠে দাড়াই আমি।
ম্যামের সঙ্গে কথা বারিয়ে লাভ নেই।
এখানে আমার কথা খাটবেনা।তাই পিছিয়ে যাওয়াই ভালো।
বললাম,”একটু কাজ পড়ে গেছে ম্যাম।বাড়ি ফিরতে হবে।আপনাকে অভিনন্দন ম্যাম।আগামী দিন ভালো যাক।সুখে থাকুন।”
হাঁটা ধরলাম আমি।
ম্যাম পেছন থেকে বলে,”পালিয়ে যাচ্ছো তন্নি?
এভাবে কতোদিন নিজের অনুভূতি থেকে পালাবে?
নিঃসঙ্গতা বড়ো ভয়ানক জিনিস তন্নি।
যা মানুষকে ভেতর থেকে শেষ করে দেয়।”
একটু হেসে বলি,”শেষ আমি হয়েই গেছি।দেহটা আছে।দেহখানি সৃষ্টিকর্তা তুলে নিলে মুক্তি পেয়ে যাই।”
এতিমখানা থেকে বের হলাম।
চোখ ভারী অশ্রুতে।ম্যামের বলা প্রতিটি কথাই ঠিক।কিন্তু আমি নিরুপায়।সঙ্গে ভীষণ ক্লান্ত ও।
জীবনে একা হাতে কতো দায়িত্ব পালন করলাম।কতো অর্জন আমার।
তবুও শান্তি নেই মনে।
সবকিছুকে কেমন বিষাক্ত লাগে।আমার সুখ আছে,তবে সেই সুখকে আমি অনুভব করতে পারিনা।এই সুখ আরো যন্ত্রণা দেয় আমায়।রাতের ঘুম কেড়ে নেয়।
ম্যামের কথা মতো সত্যিই কী কেউ এই কালো চোখ দুটির মায়ায় পড়বে?
এ ও কী সম্ভব?
চলবে?
✍নাদিয়া আফরিন।
#Nadia_Afrin
পর্ব ১
(নতুন গল্প শুরু হলো।সবাই রেসপন্স করে যাবেন। আকর্ষণীয় কিছু পেতে চলেছেন।চমকপ্রদ হবে কিছু।)