আমিই সেই তন্নি পর্ব-০৫

0
18

#আমিই_সেই_তন্নি
#Nadia_Afrin


ছাদের এক কোণে উদাস মনে দাঁড়িয়ে আমি।মনের মাঝে সুক্ষ চিন্তা।
হাতে চায়ের কাপ।তাতে এক চুমুক দিয়ে পাশের ফাঁকা একতলা বাড়িটার দিকে তাকাই।এবাড়িটা কেমন নিষ্প্রাণ।রাতে জ্বলেনা আলো।দিনে ঘরে ঢোকেনা বাতাস।
সেই যে তালা ঝুলছে।আর খোলার নাম নেই।
বাড়ির মালিক গত হয়েছেন বছর চারেক হলো।এক ছেলে আছে শহরে।সেখানেই স‍্যাটেল।
বাপের ভিটে টুকুতে তালা ঝুলিয়ে সুখেই আছেন তারা।বছর বাদেও আসেননা।শহরের মানুষ তারা।গ্রামের এই আলো-বাতাসের ছিমছাম বাড়িও ক্ষেত লাগে।
মানুষ আসে,মানুষ যায়।ভিটে-ভাটি গুলো ধ্বংসস্থুপ হয়ে রয়েই যায়।

আপন মনে ভাবছিলাম এসব।নিচ থেকে ছেলের ডাকে একটু কেঁপে উঠি।
কাপ হাতে নিচে আসতে লাগি।আলিফ সদর দরজায় লাগেজ হাতে দাঁড়িয়ে হাসি-মুখে।আজ তার হোস্টেলে ওঠার দিন।
আমার চলার গতি থেমে যায়।ধীরে ধীরে নামছি।পা যেন চলেনা আর।
একটাই ছেলে আমার।ওকে ছাড়া থাকি কী করে!
মেয়েটাও কাছে নেই।ছেলেটা চলে গেলে বড্ড একা হয়ে যাবো আমি।

নিচে আসি আমি।
ছেলের সামনে দাঁড়াই।কিছুপল ওর দিকে তাকিয়ে রই।ওর মুখে হাসি।অথচ কষ্টে আমার বুকের পাঁজর যেন ভাঙছে।
নিজের আবেগকে সামলাতে পারিনা ।হুহু করে কেঁদে উঠি।
ছেলে আমার কাধে হাত রেখে বলে,”প্লিজ কান্না করোনা আম্মু।আমি কী সারাজীবনের জন্য চলে যাচ্ছি নাকি!”

তবুও থামিনা আমি।মা তো আমি।সন্তানের বিদায়ে খারাপ লাগবে স্বাভাবিক।
পারুল ভাবি সহ আলিফ বিভিন্ন কথা বলে শান্ত করে আমায়।
কান্না থামিয়ে হেঁচকি তুলছে।
আলিফ বলে,”এতো ভেঙে পড়োনা আম্মু।ইচ্ছে করে যাচ্ছিনা আমি।পড়াশোনার জন্য যাচ্ছি।ক‍্যারিয়ার গড়তে হলে এটুকু স‍েক্রিফাইস করতেই হবে।
আমি তো আসবোই আম্মু।মাসে একবার এসে তোমার সঙ্গে দেখা করে যাবো।”

আমি অসহায়ের মতো বললাম,”মাস শেষে তো অনেক দিন।সপ্তাহের ছুটিতে আসতে পারবেনা?
প্রয়োজনে সেদিন গাড়ি দিয়ে আমি নিজে তোমায় নিয়ে আসবো।”

“সেটা কী করে হয় আম্মু?
সপ্তাহের ছুটিতে আমার কাজ থাকবে।সারা সপ্তাহ ক্লাস করে ক্লান্ত থাকবো।ছুটির দিনে রেস্ট করবো,ঘুমাবো।”

কিছু বলতে চাইতে মুখ খুলেছি।পাশ থেকে পারুল ভাবি নিষেধ করে।
কানে কানে বলে,”কথায় কথা বাড়ে।থাক বাদ দাও।”

আর বলিনা কিছু।
ছেলে আমায় আলতো হাতে জড়িয়ে ধরে বেড়িয়ে যায়।
ওর যাওয়ার পানে তাকিয়ে চোখ থেকে টপটপ পানি পড়ে আমার।
নিজের ঘরের দিকে অগ্রসর হই।ভাবি ডাকে অনেক।শুনিনা।
আপন মনে আওড়াই,মায়ের কাছে থাকা বড্ড কষ্ট হয়ে গেছে তোদের।
একসময় এই মাকে ছাড়া কিচ্ছু বুঝতিনা।
কী এমন হতো সপ্তাহ বাদে এলে?
সেই রেস্টটা তুই বাড়িতেই নিতে পারতি।ঘরে শুয়ে ঘুমোতে।আমি না’হয় ঘুমন্ত তোকে দেখেই শাক্তি পেতাম।
ভাবতাম ছেলেটা কাছে তো আছে অন্তত।
মনটায় শান্তি পেতাম।
এখন মনে হয় আমার ভাগ‍্য টাই খারাপ।যাকে আকড়ে ধরে বাঁচতে চাই,সে ই ছেড়ে চলে যায়।
জানি ছেলে গিয়েছে নিজ ক‍্যারিয়ার,পড়াশোনার জন্য।তবুও মায়ের মন আমার,মানছে না কিছুতেই।
হয়ত আমি স্বার্থপর।তবুও মা তো!

ঘরে গিয়ে দরজা দিয়ে প্রচন্ড কেঁদেছি।কেঁদে একপ্রকার চোখ-মুখ ফুলিয়ে ফেলেছি।
এরই মাঝে এতিমখানা থেকে দুবার কল দিয়েছে।ধরিনি।ম‍্যাম ও কল দিয়েছে।রিসিভ করিনি।
মনটা বড্ড খারাপ ছিল আমার।
কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে কখন যে একটু ঘুমিয়েছি,সে খেয়াল নেই।
সন্ধ‍্যার আযানের শব্দে ঘুম ভেঙেছে।
উঠে বসি আমি।
ঘরটা পুরো অন্ধকারে ছেয়ে গেছে।লাইট অন করে বাইরে আসি।
আমায় দেখেই পারুল ভাবি দৌড়ে আসে একপ্রকার।
বলেন,”ঠিক আছো তো তুমি তন্নি?
দুপুরে খাবারের জন্য কতোবার ডাকলাম শুনলেই না।দরজাও বন্ধ করে রেখেছিলে।”

“আমি ঠিক আছি ভাবি।একটা চা করে দিও আমায়।মাথাটা ধরেছে ভীষণ।”

পারুল ভাবি কিচেনে যায়।
আমি সোফায় গিয়ে বসি।এমন সময় অর্নি আসে বাড়িতে।মুখে স্পষ্ট রাগ তার।
এসেই উচু গলায় বলে,”সমস‍্যা কী তোমার আম্মু?
কারণে-অকারণে ডাকো কেন শুধু আমায়?
তোমার কোনো আইডিয়া আছে,এই অহেতুক ডাকাডাকির জন্য আমার পড়াশোনার কতো ক্ষতি হয়। আজ পুরো ক্লাস শেষ না করেই পাঁচমিনিট আগে বের হয়ে আসতে হয়েছে আমায়।
গণিত ম‍্যামকে কী বলেছো তুমি?
সে কেন পাঠিয়ে দিল আমায় জোর করে?
তার ক্লাসে আমায় ছুটি কেন দিল?
আমি তো ছুটি চাইনি।”

আমি ভ্রু কুচকে বললাম,”মানে?
কী বলছো এসব?কে কাকে কী বলেছে?আমি বুঝতে পারছিনা।”

এরই মাঝে পারুল ভাবি হাজির।দূর থেকে আমাদের কথা শুনেছেন তিনি।
চায়ের কাপ টেবিলে রেখে বলেন,”তোমার মা কাউকে কিছু বলেনি অর্নি।ফোনটা আমি করেছিলাম।তোমায় আসতে বললাম,তুমি সরাসরি নিষেধ করে দিলে।
তাই বাধ‍্য হয়ে তোমার গণিত ম‍্যামকে সব খুলে বলেছি।তিনিই তোমায় পাঠিয়ে দিয়েছে।
তোমার এখানে আসাটা অনেক জরুরি অর্নি।আজ তোমার ভাই চলে গেছে হোস্টেলে।তোমার মা ভীষণ দুঃখ পেয়েছে।সারাদিন খায়নি।ঘরের দরজা বন্ধ করে কেঁদেছে।তুমি তার মেয়ে।তুমি কাছে থাকলে তোমার মায়ের ভালো লাগবে।একটু ভালো অনুভব করবে।
একটা দিন থেকে যাও বাবা।অন্তত নিজের মা টার জন্য হলেও থেকে যাও।”

মেয়ে হুংকার দিয়ে বলে,”এসব কী বলছেন আন্টি?
থেকে যাবো মানে?
আমার নাচের ক্লাস আছে।এখানে শুধু শুধু থেকে আমার লাভটা কী?
ভাইয়া চলে গেছে পড়াশোনার জন্য।এখানে আম্মুর দুঃখ পাওয়ার কী আছে?
সে কী চায়না আমরা পড়াশোনা করে ক‍্যারিয়ার গড়ি?”

অর্নির কথা শুনে আমি হতবাগ।
মেয়ে আমার দিকে আঙুল তুলছে।
উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলি,”ওকে কেন ডেকেছো ভাবি?
আমি কী বলেছি ডাকতে?
কারো সঙ্গ প্রয়োজন নেই আমার।
তন্নি একাই থেকেছে চিরকাল।বাকিটা জীবনও সে একাই থাকতে পারবেনা।
যতোটা যা করার করে দিয়েছি।পালন-পালন করে বড়ো করেছি ওদের।
এখন ওরা নিজেরা চলতে শিখেছে।হাত-পা বড়ো হয়েছে।খাওয়া শিখেছে নিজ হাতে।
তাই মায়ের দায়িত্ব শেষ।মাকে আর প্রয়োজন নেই।
এবার ওরা ওদের সিদ্ধান্ত নিজেরাই নিতে পারে।”

কথাগুলো বলে ঘরের দিকে যেতে লাগলাম।
অপমানে পারুল ভাবি মাথা নত করে আছে।
অর্নি ধীর স্বরে বলে,”কী এমন ভুল বললাম আমি?আম্মু এতো রিয়েক্ট কেন করছে?
আম্মু সবসময় আমার সঙ্গে এমন করে।এজন‍্যই বাড়ি থাকতে চাইনা আমি।”

মুচকি একটু হাসলাম আমি।
মনে মনে বললাম,বুঝ হওয়ার পর থেকে অভাব দেখিসনি তো, তাই একথা সহজেই বলতে পারছিস।বাবার নিষ্ঠুর রুপটা দেখলে আজ একথা বলতে পারতিনা।
সব হারিয়ে যখন আমি নিজে একা লড়াই করেছি,অভাবের সঙ্গে যুদ্ধ করেছি,তখন তুই দুধের শিশু।
ধীরে ধীরে যখন তোর বোঝার বয়স হয়েছে তখন আমার অবস্থা ভালো।নাম-ডাক কামিয়েছি।তাই বলা যায় ছোট থেকে বেশ উন্নত জীবনই পেয়েছিস।এর পেছনের কাহিনী তুই জানিসনা।
জানলে মায়ের দিকে প্রশ্ন তুলতিনা।

সেই রাতে কিছুই খাইনি আর।এমনি শুয়েছি।অর্নি চলে গেছে তক্ষুনি।
রাতে একটুও ঘুম হয়নি।শুন‍্য শুন‍্য লেগেছে।আলিফকে কল দিয়েছি।রিসিভ করেনি। পৌঁছেছে কিনা সেটাও জানিনা।সারাটাদিন পার হয়ে গেল।
একবার ভাবলাম ওর হোস্টেল গিয়ে খোঁজ নিয়ে আসি।কিন্তু আমার গাড়িটাও নেই।আলিফ নিয়ে গেছে।এখন এই রাতে গাড়িও পাবোনা।
মায়ের মন।তবুও যেতে চাইলাম।
বের ও হয়েছি।পারুল ভাবি আমায় দেখেই বুঝেছে হয়ত। রাগান্বিত কন্ঠে বলল,”এই রাতে ছেলের খোঁজে যেওনা।দায়িত্ব শুধু তোমার একার না।ওর ও আছে।আলিফ বাচ্চা নয়।
এইটুকু জ্ঞান ওর থাকাই উচিৎ।”

ভাবি রেগে আছে বুঝলাম।আর গেলাম না আমি।ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়েছি।ছেলের চিন্তায় সারারাত হাসফাস করেছি।

সকালে ভোর ভোর উঠে আগে পারুল ভাবির খোঁজ করলাম।মানুষটার ওপর কাল বড্ড রাগ দেখিয়েছি।
মাথা ঠিক ছিল না আমার।

ভাবি তখন সবে চুলোয় ভাত বসিয়েছে।
আমি তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।
ভাবি একবার আমার দিকে তাকালো।এরপর মিনমিনে স্বরে বললো,”কিছু লাগবে তোমার?চা করে দেব?”

আমি তার হাত দুটো ধরে বললাম,”কালকের জন্য দুঃখিত ভাবি।জানি আমার কথায় কষ্ট পেয়েছো।
আসলে আমার ভীষণ রাগ হয়ে গেছিলো।
আমায় ক্ষমা করে দাও দয়া করে।”

ভাবি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো।আমি তার মুখপানে তাকিয়ে আছি।

“আমি তোমায় নিজের বোনের মতো দেখি।হতে পারে আমি গরিব।তোমার বাড়ির কাজের লোক।কিন্তু তুমি কখনো আমায় সে নজরে দেখোনি।পরিবার মনে করেছো আমায়।বড়ো হিসেবে সম্মান দিয়েছো।
তোমার মতো মেয়ে আমি খুব কমই দেখেছি তন্নি।যেকোনো মানুষ তোমার সঙ্গে মিশলে তোমায় ভালোবাসতে বাধ‍্য।
আমিও তার ব‍্যতিক্রম না।তোমায় খুবই ভালোবাসি।তোমার কষ্টে আমার কষ্ট হয়।
চেষ্টা করি তোমার দুঃখগুলো ভাগ করে নেওয়ার।তবে পারিনা।তোমার দুঃখগুলো তুমি একান্ত করে রেখেছো।প্রকাশ করোনা।ভেতর ভেতর শেষ হয়ে যাও।
চোখের সামনে যে একটা দুটো কষ্ট দেখি,তা কমাতে আপ্রাণ চেষ্টা করি।
কাল সেকারণেই অর্নিকে ডেকেছিলাম।
আমি ভাবতে পারিনি মেয়েটা এমন করবে।
আমিও দুঃখিত তোমার কাছে।আমার জন্য তোমায় কতো গুলো কথা শুনতে হলো।”

“ব‍্যাপার না ভাবি।পরিবার আমরা।এরকম একটু-আধটু হয়েই থাকে।”

ভাবি কিঞ্চিৎ হাসলো।
চুলোয় চায়ের পানি বসিয়ে ডাইনিং এ খাবার রাখতে গেল।
আমি পানিতে চিনি দিচ্ছি তখন।
ভাবি দরজা অব্দি যেয়ে আমার দিকে তাকায়।
হাসি হাসি মুখ করে বলে,”একটা কথা বলি তন্নি।কিছু মনে করো না।ছেলেটা অভাব দেখলেও মেয়েটা দেখেনি।অভাবের সঙ্গে যুদ্ধও করেনি।
বেশ আদরেই মানুষ হয়েছে।
অধিক টাকা-পয়সার মুখ দেখে দেখে ছেলে-মেয়ে দুটো কেমন যেন হয়ে গেছে।
মায়ের কষ্ট আর তাদের চোখে পড়ে না।”

কথাটা বলে চলে যায় ভাবি।
আমি চুপচাপ রই। দীর্ঘশ্বাস ফেলি।আমার এক একটা দীর্ঘশ্বাস এক একটা না পাওয়ার আক্ষেপ।

চা হাতে সবে কিচেন থেকে বেড়িয়েছি এমন সময় কলিং বেলের শব্দ।
ভাবি আর আমি একে-ওপরের দিকে তাকাই।এসময় কে এলো?

ভাবি দরজা খুলতে এগিয়ে যায়।আমি মাথায় কাপড় টেনে সরু দৃষ্টিতে দরজার দিকে তাকিয়ে আছি।

দরজা খুলতেই ভেতরে প্রবেশ করে ম‍্যাম,তার হাজবেন্ড।
এগিয়ে আসি দ্রুত।হঠাৎ এনাদের আগমন?

ম‍্যাম আমার কাধ করে বলে,”ঠিক আছো তুমি তন্নি?কাল পারুলের মুখ থেকে সবটাই শুনলাম।
তোমার জন্য ভীষণ চিন্তা হচ্ছিলো।কল দিলাম ধরলেনা।তাই চলে এলাম দেখতে।”

“শরীরটা একটু খারাপ লাগছিল তাই তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েছিলাম ম‍্যাম।
আমি ঠিক আছি।সুস্থ আছি।”

ম‍্যাম বলেন,”যাক খুশি হলাম।
একজন গেষ্ট নিয়ে এসেছি কিন্তু।তাকে ভেতরে আসতে বলবে না?”

বাইরে উকি দেই।ইয়াসির স‍্যার দাঁড়িয়ে আছে।
আমি একটু নার্ভাস হই।আমতা আমতা করে ভেতরে আসতে বলি।

স‍্যার এসে সোজা আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলেন,”কেমন আছেন ম‍্যাম?”

“জ্বী আছি কোনোরকম।আপনি?”

“আমিও আছি ভালোই।হঠাৎ এসে আপনাকে বিরক্ত করলাম বুঝি?
আসলে একটা দরকারে এসেছি আমি।”

সামান্য হেসে বললাম,” অথিতি সৃষ্টিকর্তার বিশেষ নেয়ানত।যে ঘরে অথিতি বেশি,সে ঘরে সৃষ্টিকর্তা দেয় ও বেশি।তাই অথিতি দেখে কখনো অখুশি হতে নেই।
এছাড়াও আমার কেউ নেই তেমন আসার মতো।
ম‍্যাম ও স‍্যারই মাঝেমধ্যে আসে।এবার আপনি এসেছেন ভালো লাগছে।
তা কী দরকারে জরুরিভিত্তিতে আসা?”

স‍্যার কিছু বলতে যাবে তার আগেই ম‍্যাম মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে,”আমি বলছি।আমার থেকে শোনো।
তোমার পাশের বাড়িটি পরিত্যক্ত না?
ঐযে লোকটা মারা গেছে।ছেলে থাকে শহরে।
ঐ বাড়ির বিষয়ে কথা বলতে এসেছি।”

“হুম।বুঝেছি।কিন্তু আপনাদের তো বাড়ি আছে ম‍্যাম।নতুন করে কার জন্য বাড়ি দেখতে এলেন?”

“ইয়াসির স‍্যারের জন্য।”

ম‍্যামের কথা শুনে আমি অবাক হই।স‍্যারের দিকে তাকাই দ্রুত।
স‍্যার মুচকি মুচকি হাসছেন মাথা নত করে।
পাশ থেকে ম‍্যাম বলেন,”উনার একটা বাড়ির প্রয়োজন ছিল শুনেছিলাম।উনি বলে রেখেছিল আমাদের। খুঁজে দেখেছিও।উনার পছন্দ হয়নি।শহরের ব‍্যস্ত পরিবেশে উনি থাকতে চায়না।তার পছন্দ গ্রাম‍্য টাইপ শান্ত পরিবেশের বাড়ি।
তাই অনেক ভেবে এই বাড়ির কথাই মনে হলো।
তা তন্নি তোমার কাছে তো বাড়িওয়ালা ছেলেটার এ‍্যাড্রেস, নাম্বার আছে তাইনা?
বাড়ির পাশে তোমার।থাকবে নিশ্চয়।সেগুলো আমাদের দিও।কথা ফাইনাল করবো।”

“তা তো আছেই ম‍্যাম।তবে ইয়াসির স‍্যারের কী পছন্দ হবে ঐ বাড়ি?
না মানে,একটু বেশিই কেমন হয়ে যাচ্ছেনা?
দেখেছেনই তো,বাড়িটার আশেপাশে কেমন ঝোপঝাঁড়ে ভর্তি।মানুষ না থাকলে যা হয় আরকি!”

“এজন‍্যই তো স‍্যারকে নিয়ে এসেছি।উনি চারপাশ ঘুরে নিজেই দেখবেন সবটা।”

আমি আর জবাব দিলাম না কোনো।
আড় চোখে স‍্যারের দিকে তাকালাম একবার।
পুরো গল্পটি নাদিয়া আফরিন পেইজে দেওয়া আছে।ফলো দিয়ে পড়েনিন।
নাহলে হারিয়ে ফেলতে পারেন।
এছাড়াও আমার লেখা সব গল্প পাবেন আমার পেইজে।
অন‍্য কোনো গ্রুপে বা পেইজে আর গল্পটি পাবেন না।সুতরাং সম্পূর্ণ গল্প পড়তে এবং আপডেট পেতে মূল লেখিকাকে ফলো দিয়ে রাখুন।

পারুল ভাবিকে সঙ্গে নিয়ে নাস্তা রেডি করলাম।
সকাল সকাল এসেছেন তারা।নাস্তাটা আগে দিয়ে পরে না’হয় ভারি খাবার দেব।
আমি সবাইকে বসিয়ে নাস্তা করালাম।
ম‍্যাম বললেন,”তন্নি তুমি একটু উনাকে বাড়ির আশপাশটা ঘুরিয়ে দেখাও।
আমার মাথাটা বড্ড ধরেছে।ঐ ঝোপ-ঝাঁড়ে গেলে আরো বাড়তে পারে।”

একটু আমতা আমতা করে বললাম,”আমি একা নিয়ে যাবো?”

“হ‍্যা।তোহ কী?তোমারই এলাকা।ভয় কিসের?ভুতের নাকি ডাইনীর?”

একটু হেসে বললাম,”ওসব ভয় আমার নেই।আজ মারা গেলে কবরের বাসিন্দা হবো।মাটির নিচে রেখে আসবে।
ভুতের ভয় টয় আমায় ছুতে পারেনা।”

ম‍্যাম আবারো বলেন,”অর্নির কী হয়েছে তন্নি?মুখটা কেমন থমথমে লাগলো?
তোমার জন্য জোর করে পাঠালাম।কিন্তু মেয়ে থাকলোই না।মুখ ভার করে ফিরে গেল।”

পাশ থেকে পারুল ভাবি কিছু বলতে চাইলো।আমি তার হাত চেপে ধরলাম।বাহিরের লোকের সামনে এসব কথা উঠুক চাইনা।
বললাম,”ঐ এমনিই।পড়াশোনা আর নাচ নিয়ে বেচারা টেনশনে থাকে।এজন‍্যই চলে গেছে।আমিই যেতে বলেছি।শুধু শুধু মেয়েটার ক্লাস মিস করে লাভ নেই।”

ম‍্যাম আর কিছু বললোনা।

খাওয়া শেষ হলো।
আমি ঘরে গিয়ে দুটো মাস্ক এনে একটা নিজে পড়লাম ও অন‍্যটা স‍্যারকে দিলাম।
বাড়িটির আশপাশ ঝোপ-ঝাঁড়ে ঘেরা, দূর্গন্ধময় পরিবেশ।

দুজনে বের হলাম।
স‍্যার আর আমি হাঁটছি।মাঝখানে দূরত্ব তিনহাত মতো।
পথিমধ‍্যে প্রশ্ন করলাম,”শহর ছেড়ে এই গ্রাম‍্য পরিবেশ পছন্দ কেন আপনার?
লোকে গ্রাম ছেড়ে শহরে যায়।আপনি শহর ছেড়ে গ্রামে আসছেন?”

স‍্যারের দু-হাত পেছনে গোজা।মাথা নিচু করে বললেন,”ছোট বেলাটা কেঁটেছে গ্রামেই।গ্রামের শিতল আবহওয়া,পরিষ্কার বাতাস,মেঠো পথ,সকালের পাখির কিচিরমিচির,শিতের শিশির,গরমের উষ্ম হাওয়া,বর্ষার ভেজা মাটির ঘ্রাণ,শরৎ এর নতুন পাতায় হেসে খেলে বড়ো হয়েছি।কতো সুন্দর ছিল সেই জীবন।একটা চিন্তা-মুক্ত স্বাধীন আমি ছিলাম সেসময়।
এরপর পড়াশোনার তাগিদে শহরে এলাম।শুরু হলো জীবনের মারপ‍্যাচ।
পড়াশোনার চাপ,কড়া শাসন,একাকিত্ব, নিঃসঙ্গতা ছেড়ে ধরলো আমায়।
তবুও টিকে রইলাম।বড়ো হলাম।জীবনটাকে উপভোগ করতে চাইলাম।কিন্তু পারলাম না।
প্রতারণা,বিরহ প্রেম, বিশ্বাসঘাতকতা,ছন্নছাড়া জীবন আমায় গ্রাস করে নিল।তখন থেকেই ছোট বেলাটাকে খুবই মিস করি।মনে পড়ে সেই গ্রামের কথা।
স্থির করে রেখেছিলাম,জীবনে যাই হোক গ্রাম‍্য সেই আমি টাকে আমি আবার পেতে চাই।মুক্ত হাওয়ায় শ্বাস নিতে চাই।”

স‍্যারের বলা প্রতিটি কথাই ছিল মনমুগ্ধকর।আমি মুগ্ধ দৃষ্টিতে তার কথা শুনেছি।বর্তমানের এই যুগে এনার মতো প্রকৃতি প্রেমি মানুষ খুব কমই হয়।
আমার বিশ্বাস,যারা প্রকৃতি প্রেমি হয়,তাদের মনটা সরল-উদার।

কথায় কথায় পৌঁছে গেলাম বাড়ির সামনে।
চারপাশ ঘুরে দেখালাম।দেখার মতো তেমন কিছুই নেই আপাতত।গাছ-লতা পাতায় ভরে গেছে চারপাশ।
একটা বড়ো শিউলি ফুল গাছের নিচে দাঁড়ালাম আমি।একটা ফুল কুড়িয়ে নিলাম মাটি থেকে।
বললাম,”জানেন স‍্যার শিউলি ফুল আমার ভীষণ প্রিয়।খুব ইচ্ছে ছিল বড়ো একটি শিউলি ফুলগাছ হবে আমার বাড়ির এক কোণে।থোকা থোকা ফুল ধরবে।গাছের নিচে একটা দোলনা লাগাবো।কোনো এক মন খারাপের দিনে একাকি সময় কাঁটাতে সেই দোলনায় গিয়ে বসবো।হালকা ঘ্রাণ থাকবে বাতাসে।আমি চোখ বুজে দোলনায় হেলান দিয়ে তা উপভোগ করবো।
মন খারাপের সঙ্গী হবে এই মূহুর্তটা।
কিন্তু তা আর হলোনা।আমার বাড়িতে আছে একটা গাছ শিউলি ফুলের।কিন্তু ততো বড়ো নয়।মন চাহিদা মতো বড়ো হতে হতে আমি চলার ক্ষমতা হয়ত হারিয়েই ফেলবো।নয়তবা অস্তিত্ব বিলিন হয়ে যাবে।”

স‍্যার বললেন,”আপনার সকল চাহিদা পূর্ণতা পাক।পূর্ণবতী হয়ে জীবনকে উপভোগ করুন আপনি।”

আমি মাথা নাড়লাম।
আরো কিছুটা হাঁটলাম।
হঠাৎ অসাবধানতাবশত আমার পা পিছলে গেল।
পেছন দিকে একটা গাছের দিকে হেলে যেতে লাগলাম।মনে মনে ঠিক করেই নিয়েছি আজ আমার মাথা শেষ।গাছের সঙ্গে লেগে প্রাণটা যাবেই হয়ত।
ভয়ে চোখ খিচে বন্ধ করেছি।
হঠাৎ কেউ ধরলো আমায়।কোমর পেছিয়ে ধরলো।
হাতের আঙ্গুল দিয়ে ছোঁয় নি।শুধু মাত্র হাতটা দিয়ে সামলে নিয়েছে আমায়।

সেকেন্ড পাঁচেক পর চোখ মেললাম।
স‍্যার আমার মুখোমুখি।দুজনের মুখেই মাস্ক।স‍্যারের দৃষ্টি স্থির।
কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম।লালচে বর্ণের চোখ দুটোতে শুধু আমি।
আচমকা কী যেন হলো।
স‍্যার একটানে আমার মাস্কটা খুলে দিল।
ঘাবড়ে গেলাম আমি।দ্রুতই উঠে দাঁড়ালাম।সরে গেলাম।
ক্ষীণ স্বরে বললাম,”কী করছেন স‍্যার।”

“আই এ‍্যাম এক্সট্রিমলি স‍্যরি ম‍্যাম।আমি ইচ্ছে করে করিনি একাজ।
আপনার মাস্কের সঙ্গে কাঁটা বিধেছিল।হয়ত কোনো গাছ থেকে পড়েছে।
আপনার লেগে যেত।তাই তাড়াহুড়ো করে মাস্কটা খুলে ফেলেছি।
আমি ভীষণ লজ্জিত আমার কর্মে।”

স‍্যার মাথা নত করে রয়।
আমি নিজেকে সামলে বলি,”ইটস ওকে স‍্যার।আমি কিছু মনে করিনি।আপনার দোষ নেই।আসলে হুট করে এমনটা হয়েছে তাই একটু ঘাবড়ে গিয়েছিলাম।
যাক গে বাদ দিন।আপনাকে ধন্যবাদ আমায় সাহায্য করার জন্য।
ঘোরা শেষ হলে চলুন বাড়ি যাই।”

আমি সামনে সামনে হাঁটি।স‍্যার আসে পেছন পেছন।এখনো তার চোখে-মুখে ভয়। সঙ্গে প্রবল অপরাধবোধ।
একটু হাসি আমি।মানুষটা মানবিকতা বেশ।
সঙ্গে দায়িত্বসম্পন্ন একজন ব‍্যাক্তি।

বাড়ি ফিরে ঘরে আসি আমি।ফ্রেশ হয়ে নিচে যাই।স‍্যার তাড়া দিচ্ছে ফিরতে।
আমি জোর করে সবাইকে খাবার টেবিলে বসাই।বেলা বেজে গেছে বারোটা।প্রায় দুপুর হয়ে এসেছে।
না খাইয়ে ছাড়া যায়না।
আজ প্রতিটি রান্না বেশ দেখে-বেছে করা হয়েছে।
এ‍্যালার্জি হতে পারে এমন কোনো রান্নাই হয়নি।
সেদিন আমার জন্য স‍্যারকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হলো।আজ কিছুতেই ভুল করা যাবেনা।
স‍্যারকে খেতে দিয়েও আমি বেশ নজর রেখেছি।কী খাচ্ছে-না খাচ্ছে খেয়াল করেছি।
স‍্যার আমার দিকে তাকিয়ে বলে,”শুধু আমার খাওয়া দেখলেই হবে ম‍্যাম?
নিজেতো কিছুই খাচ্ছেননা।”
সম্পূর্ণ গল্পটি আমার পেইজে দেওয়া আছে।নাদিয়া আফরিন ইংরেজিতে লিখে সার্চ দিলেই পেয়ে যাবেন আমার পেইজ।
ফলো দিয়ে সম্পূর্ণ গল্পটি পড়ুন।
ফলো না করলে হারিয়ে ফেলতে পারেন।

একটু লজ্জা পেয়ে যাই আমি।
ম‍্যাম মজা করে বলে,”এতো নজর রাখার প্রয়োজন নেই তন্নি।আমরা সব এখানেই আছি তুমি খেয়ে নাও।”

এভাবেই হাসিঠাট্টায় খাওয়ার পর্ব শেষ হলো আরো একবার।
এবার উনাদের বিদায়ের পালা।
ম‍্যাম আর তার হাজবেন্ড আগে আগে বেড়িয়ে গেছে।
স‍্যার হাঁটছে।পিছে আমি।
একবার পেছনে তাকালেন তিনি।
স্মিত হেসে বললেন,”বাড়িটা ভীষণ পছন্দ হয়েছে আমার।
খুব দ্রতই কাগজে কলমে বাড়িটা নিজের করে নেব।
পরিবেশ ভালো এখানকার।সঙ্গে রয়েছে পছন্দের মানুষ।থাকতে ভালোই লাগবে।
আজ আসি।আবার দেখা হবে।”

স‍্যার চলে গেলেন।
‘পছন্দের মানুষ বলতে কাকে বুঝিয়েছেন উনি?পরিচিত কেউ?
উনিতো বলেছিল উনার পরিচিত কেউ নেই এখানে।
তাহলে?

আমার ভাবনার মাঝখানে ছেলের কল এলো।স্ক্রিনে তাকিয়ে মুখটা উদাস হয়ে গেল আমার।
রিসিভ করতেই আলিফ বলে,”স‍্যরি আম্মু।ফোন করতে মনে ছিল না।আসলে কাজে খুব বিজি ছিলাম।এসে একা হাতে সব গুছাতে হয়েছে তাই ফোন করার সময় পাইনি।আমি ভালো আছি ঠিক আছি।
কিছু জিনিস করতে হবে আমার আম্মু।টাকার প্রয়োজন।বিকাশে পাঠিয়ে দিও।এখন রাখছি।খাওয়ার সময় হয়েছে আমার।তুমিও খেয়ে নিও।অর্নি ও নিজের খেয়াল রেখো।”

ছেলে করলোনা আমার উত্তরের আশা।কল কেঁটে দিল সে।
আমি সোফায় বসলাম।হাতে হেলান দিলাম মাথাটা।
মানুষের জীবনে ব‍্যস্ততা থাকবে স্বাভাবিক।এই ব‍্যস্ততার মাঝেই প্রিয় মানুষগুলির খোঁজ নিতে হয়।দুটো কথা বলতে হয়।অন‍্যথায় তারা হারিয়ে যায়।
অবশ‍্য আমার বিষয় আলাদা।আমিতো মা।ওরা জানে,মাকে যতো কিছু বলি বা করি,এই মানুষটা দিনশেষে ঠিকই হ‍্যাংলার মতো থেকে যাবে।
এর দায়িত্ব থেকে মুক্তি নেই।এনার কোনো আরাম নেই।
তাই এর সঙ্গে যা-তা করা যায়।
আমিও যে মানুষ।আমারও যে ভালো লাগা মন্দ লাগা আছে তা ওরা জানেই না।
কাল সারাটা রাত ঘুমাইনি ছেলের চিন্তায়।আমার এই কঠোর পরিশ্রম,ক্লান্ত দিন,চোখের নিচের কালো দাগের কেন্দ্রবিন্দু যে ওরাই তা ওরা বোঝে না।সে অনুযায়ী আমায় কদর ও করেনা।
একটা দিন চলে গেছে।রাত পার হয়েছে।তবুও মাকে কল দিয়ে জানানোর প্রয়োজন মনে করেনি।বলল নাকি কাজের চাপ।
অথচ গিয়েই ঘুরতে গিয়ে ছবি উঠে আপলোড করেছে।তখন ব‍্যস্ততা ছিল না।মাকে কল দিতে বা ধরতে ওদের খুব কষ্ট হয়।
টাকার প্রয়োজন না হলে হয়ত আজো কল দিত না।

উক্ত কথাটি ভেবে আমি নিজেই লজ্জা পেলাম।নিজ সন্তানের বিষয়ে এসব কী ভাবছি আমি?
মনকে নিজেই বুঝ দিলাম হয়ত সত‍্যিই ব‍্যস্ত ছিল ও।
এই অযাচিত যুক্তি ভেবে নিজেই হাসলাম।
মাঝে মাঝে নিজের মিথ্যা যুক্তিতে নিজেরই হাসি পায় আমার।

চলবে।