আমিই সেই তন্নি পর্ব-১০

0
17

#আমিই_সেই_তন্নি
#Nadia_Afrin

১০
তড়িঘড়ি সিড়ি বেয়ে নামছি আমি।
ভাবি সোফায় বসে চা খাচ্ছে আর টিভি দেখছে।তার পাশে গিয়ে ধপ করে বসলাম।সোফায় মাথা এলিয়ে বললাম,”আজ রান্নাবান্না একটু আগেই সেরে নিতে হবে ভাবি।ইয়াসির স‍্যার আজ তার বাড়ি শিফ্ট হবে।আমাদের তাকে সাহায্য করতে হবে।”

ভাবি চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে কাপ টেবিলে রেখে বলে,”ভালোই হবে।একজন প্রতিবেশি পাওয়া যাবে।এখানে আসার পর স‍্যারকে বলবো বিয়ে করে নিতে।উনার বউয়ের সাথে গিয়ে আমি গল্প করে করে আসবো।”

আমি একটু বিব্রত হয়ে বললাম,”ঠিক আছে যেও।এখন চলো রান্না করি দুজনে।”

কিচেনে গেলাম।আলিফ নেই।মানুষ শুধু আমরা দুজন।আলিফ অনুষ্ঠান শেষে সেই রাতেই বন্ধুদের সঙ্গে চলে গেছে।
ওর কথা ভাবতে ভাবতেই ওর কল এলো।জানতাম কলটা আসবে। স্বাভাবিক ভাবেই রিসিভ করলাম কল।

আলিফ উত্তেজনা সহিত বলল,”ধন‍্যবাদ আম্মু।আমি জানতাম তুমি আমায় ফাঁকি দেবেনা কিছুতেই।ড্রেসটা ভীষণ পছন্দ হয়েছে আমার।”

আমি শুধু ‘হু’ সূচক উত্তর দিলাম।ছেলে কল রেখে দেয়।ভাবি সবজি কুটতে কুটতে বলে,”ছেলের পছন্দ হলো গিফ্ট?”

“মুখে বলল তো হয়েছে।মনে কী আছে জানিনা।বাদ দাও। কাজে মন দেই।আমার দায়িত্ব আমি অবশ্যই পালন করে যাবো সর্বক্ষণ,সর্বক্ষেত্রে।”

কাজে লেগে পড়ি দুজনে।রান্না শেষে গোসল করে খেয়ে নেই।বেলা তিনটার দিকে স‍্যার আসেন বেশ কিছু জিনিস নিয়ে।
এসেই আমাকে ডাকেন।
আমি ও ভাবি হাতে হাতে নামিয়ে নেই সব।উনার বাড়ি যাই।সর্বপ্রথম ঘরগুলো পরিষ্কার করতে হবে।
ভাবি ঝাড় দিয়ে,মুছে মুছে দিচ্ছে।আমি পাশের ঘরের ধুল ঝাড়ছিলাম চেয়ারের ওপর দাঁড়িয়ে।হঠাৎ চোখে এসে একগুচ্ছ নোংরা পড়ে।চোখ খিচে বন্ধ করে পিছিয়ে যাই।খেয়ালই নেই চেয়ারে দাঁড়িয়ে আমি।একটু হলেই পড়ে যাবো এমন সময় স‍্যার এসে ধরেন আমায়।চেয়ার থেকে নামায়।
আমি তখনো চোখ খুলতে পারছিনা।স‍্যার পকেট থেকে রুমাল বাহির করে আমার চোখ পরিষ্কার করে দেয়।ফু দেয়।
বিব্রত লাগে আমার।দূরে সরে এসে বলি,”ঠিক আছি আমি।ধন‍্যবাদ আপনায়।”

স‍্যার মাথা ঝাকায়।যে যার কাজে লেগে পড়ি।প্রায় সন্ধ্যার আগ দিয়ে আমাদের কাজ শেষ হয়।
ধরাধরি করে ফার্নিচারগুলো গুছিয়ে দেই।
কাজ শেষে বাড়ি ফিরে ফ্রেশ হয়ে নেই।স‍্যারকে বলেছি আজকে রাতে আমাদের সঙ্গে খেতে।
কিন্তু ইনি আসছেনা।ফোন দেই ধরেনা।আমার রাগ হলো ভীষণ।সারাদিন খেটেছে।না খেয়ে থাকবে নাকি এতোবড়ো রাতে?
পুরো গল্পটি নাদিয়া আফরিন পেজে দেওয়া আছে।ফলো দিয়ে পড়েনিন।
নাহলে হারিয়ে ফেলতে পারেন।
অন‍্য কোনো গ্রুপে বা পেইজে আর গল্পটি পাবেন না।সুতরাং সম্পূর্ণ গল্প পড়তে এবং আপডেট পেতে মূল লেখিকাকে ফলো দিয়ে রাখুন।

ভাবিকে বললাম,”তুমি খাবার বেড়ে দাও ভাবি।আমি স‍্যারকে ডেকে নিয়ে আসছি।”

এক ছুট্টে তার বাড়ি গেলাম।
ঘর গুলোর লাইট জ্বলছে।
ড্রয়িংরুমের সোফাতে ঘুমন্ত অবস্থায় পেলাম তাকে।হয়ত অতিরিক্ত ক্লান্ত থাকায় গোসল করেই ঘুমিয়ে গেছে।
আমি আধবসা হয়ে বসলাম তার সামনে।ঘুমন্ত মানুষটাকে দেখতে ভীষণ স্নিগ্ধ লাগছে।ভেজা চুলগুলো কপালে আচড়ে পড়েছে।কিছুপল তাকিয়ে রইলাম আমি।নিজেকে বড্ড হ‍্যাংলা মনে হলো।এভাবে একজনের অগচরে তার দিকে তাকিয়ে থাকা উচিৎ নয়।
ডাকতে চাইছি কিন্তু মন মানছেনা।মানুষটার শান্তির ঘুম নষ্ট করতে ইচ্ছে করছেনা।

কিন্তু ডাকতে আমায় হবেই।ধীর স্বরে বললাম,”স‍্যার?স‍্যার শুনছেন?”

উনি ঘুমের ঘোরে ‘উমম’ বলে উঠলো।কাত থেকে সোজা হতে নিল।মাথাটা পড়ে যেতে নেয়।ওমনি আমি মাথার নিচে হাত দিলাম।
স‍্যারের ঘুম ভাঙে সঙ্গে সঙ্গে।পাশে তাকায়।দুজনের দৃষ্টি মিলে যায়।কিছুপল আমার দিকে তাকিয়ে রয় সে।
এরপর উঠে দাঁড়ায়।
আমি আমতা আমতা করে বলি,”ঐ আসলে আপনি ফোন ধরছিলেন না।খাওয়ার জন্য ডাকতে এসেছি।”

স‍্যার চোখ কোচলে বলে,”হ‍্যা।একটু ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম।আপনি কখন এসেছেন?”

“মাত্রই।”

আর কোনো কথা হলোনা।আমি উঠে দাঁড়িয়ে স‍্যারকে আসতে বলে চলে গেলাম।

বাড়িতে গিয়ে কেন যেন ভীষণ হাসফাস লাগলো আমার।ঘরে গিয়ে চোখে-মুখে একটু পানি দিলাম।
নিচ থেকে ভাবির ডাক ভেসে এলো।তৎক্ষণাৎ নিচে আসতেই দেখি স‍্যার অলরেডি চলে এসেছেন।তাকে টেবিলে বসিয়ে নিজ হাতেই খাবার বেড়ে দিলাম।
স‍্যার আমাদেরও বসতে বললেন তার সঙ্গে।
একসঙ্গেই খেলাম আমরা।স‍্যার খাওয়ার মাঝে মাঝে আড় চোখে আমার দিকে তাকায়।
সম্পূর্ণ গল্পটি আমার পেইজে দেওয়া আছে।নাদিয়া আফরিন ইংরেজিতে লিখে সার্চ দিলেই পেয়ে যাবেন আমার পেইজ।
ফলো দিয়ে সম্পূর্ণ গল্পটি পড়ুন।
ফলো না করলে হারিয়ে ফেলতে পারেন।

আমি চুপচাপ খাচ্ছি।খাওয়া শেষে স‍্যার বিদায় নিলেন। যাওয়ার আগে বলে গেলেন,”আজ আপনাদের অনেক খাটিয়েছি।একদিন আমার বাড়ি আপনাদের দাওয়াত থাকবে।আমার হাতের স্পেশাল রান্না খেয়ে আসবেন।”

মাথা ঝাকালাম।
উনি চলে যেতেই আমি ঘরে গেলাম।বিছানায় শুয়ে শুয়ে আকাশের কথা ভাবছিলাম।মানুষটা কতোটা বাজে হয়ে গেছে।পাপ ওকে ভেতর থেকে ধ্বংস করে দিয়েছে।
ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে গেলাম।

পরদিনের কথা,

সকালে এক কাজে বাইরে গেছি।একজন মহিলা ক্লাইন্টের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছি।পার্ক মতো জায়গা।সেখানে বসেই দুজনা কথা বলছিলাম কাজের বিষয়ে।হঠাৎ কোথা থেকে যেন আকাশ এলো।
কথার মাঝখানে আমার নাম নিয়ে ডাকতে আরম্ভ করলো।প্রথমে পাত্তা দিলাম না আমি।
সেই মহিলা শুনতে পেয়ে আমায় বলল,”আপনায় মনে হয় ডাকছে তন্নি।”

শুকনো হাসি হেসে মাথা ঝাকিয়ে তাকে বসিয়ে সেদিকে গেলাম। রাগান্বিত স্বরে বললাম,”সমস‍্যা কী?ডাকছো কেন?দেখছো না কাজ করছি!”

আকাশ বলে,”তোমায় খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল।রাতে তোমায় নিয়ে স্বপ্নও দেখেছি।”

বললাম,”ভালো করেছো।চলে যাও এখান থেকে।আমি কাজ করছি।”
পুরো গল্পটি নাদিয়া আফরিন পেইজে দেওয়া আছে।ফলো দিয়ে পড়েনিন।
নাহলে হারিয়ে ফেলতে পারেন।
এছাড়াও আমার লেখা সব গল্প পাবেন আমার পেইজে।

এই বলে সরে এলাম।
আবারো কাজ নিয়ে কথা শুরু করেছি,আবারো ডাকে আকাশ।
মহিলা ভ্রু কুচকায়।আমি কিছু না বলে আবারো উঠে গেলাম। রাগান্বিত স্বরে বললাম,”কানা নাকি তুমি?দেখতে পাচ্ছো না কাজ করছি?
বিরক্ত করছো কেন অসভ‍্যের মতো?
কমনসেন্স ছাড়া লোকজন কোথাকার!”

গালি দিয়ে সরে এলাম।
সবে বসেছি।ওমনি ও এসে সামনে হাজির।মহিলা বিরক্ত সহিত উঠে দাঁড়িয়ে বলে,”হচ্ছেটা কী তন্নি ম‍্যাম?আমরা এখানে একটা কাজে এসেছি।আমার হাতে বেশি সময় নেই।লোকটা কেন বিরক্ত করছে এতো?কে উনি?”

আকাশ একগাল হেসে বলে,”আমি ওর স্বামী।ও আমার স্ত্রী।”

মহিলাটি চোখ বড়ো বড়ো করে তাকায় আমার দিকে।
লজ্জায়,রাগে মাথা ফাটাতে ইচ্ছে করছে আকাশের।
বললাম,”লোকটা পাগল।এনার কথা ধরবেন না।
চলুন আমরা গাড়িতে বসে বাকি কথা বলি।”

ভদ্রমহিলাকে নিয়ে চলে যেতে থাকি আমি।আকাশ পেছন থেকে বলে,”তোমার কোমরের ভাঝের তিলটা এখনো আছে কী তন্নি?”

এবার আর সহ‍্য হলোনা আমার।
পায়ের জুতো খুলে ছুড়ে দিয়ে বললাম,” নির্লজ্জ বেহায়া কোথাকার!”

গাড়িতে বসতেই মহিলা আমায় প্রশ্ন করে,”আপনারা পূর্ব পরিচিত কী?”

“একসময় ছিলাম।আপাতত কেউ নয়।
রাস্তার একটা পাগল লোক ও।ওর কথা ধরবেন না প্লিজ।চলুন আমরা কাজের কথায় যাই।”

মনোযোগ দিয়ে কাজ করে বাড়ি ফিরলাম বিকেল নাগাদ।এসে খেয়ে লম্বা একটা ঘুম দিয়েছি।সন্ধ‍্যার একটু আগে উঠেছি।
সোফায় বসে চা খাচ্ছিলাম।এমন সময় ভাবি দৌড়ে এলো আমার নিকট।কাঁদতে কাঁদতে বলল,”আমার ছেলেটার ভীষণ জ্বর তন্নি।জ্বরের ঘোরে ভুলভাল বলছে।ওর দাদি ফোন দিয়ে কান্নাকাটি করছে ভয়ে।আমাদের এক্ষুনি যেতে বলল।”

চিন্তিত হলাম।ওদের তৈরী হতে বলে ঘর থেকে হাজার পাঁচেক টাকা এনে ভাবির হাতে দিলাম।
সে নিতে চাইলোনা।

বললাম,”কথা বা বাড়িয়ে টাকাগুলো রাখো।
চলো আমিও সঙ্গে যাবো।”

ভাবি বলল,”তার দরকার নেই।তুমি থাকো।তোমার ভাই,আমি গেলে পুরো বাড়ি ফাঁকা।তোমার থাকতে হবে।এলাকায় চোরের প্রকোপ শুরু হয়েছে।যদি গুরুতর কিছু হয় তো তোমায় খবর দেব।”

“তাহলে আমার গাড়িটা নিয়ে যাও।”

“কিন্তু তোমার যদি কোনো অসুবিধা হয়।”

“বলছি নিয়ে যাও।কোনো অসুবিধা হবেনা আমার।রিক্সাতে চলাচল করতে পারি আমি।গ্রামের রাস্তা গাড়ি নাও পেতে পারো।আর কথা না বলে তাড়াতাড়ি রওনা হও।ফোনে খবর জানিও।”

ভাবি ও ভাই চলে গেলেন।
আমি সোফায় গিয়ে বসলাম।ভাবির ছেলেটা ভীষণ ভালো।চেয়েছিলাম ওকে সহ আমার কাছে রাখতে।কিন্তু ছেলেটা থাকেনি গ্রামে অবস্থানরত দাদা-দাদির দেখভালের জন্য।

ভাবিরাও চলে গেল ওমনি আকাশ কালো হয়ে মেঘ ডাকা শুরু হলো।
দৌড়ে ছাদে গিয়ে কাপড় আনলাম।বাড়িতে আমি একা।আলিফকে কল দিলাম বাড়ি আসতে।সে রিসিভ করেনা।ম‍্যাসেজ দিয়ে বললাম,’আমি বাড়িতে একা।তুমি কাছাকাছি কোথাও থাকলে চলে এসো।’

এরই মাঝে শুরু হলো প্রচন্ড বৃষ্টি।
বাজ পড়ছে,বাতাস বইছে।
মনে ভয় হতে লাগে আমার।কারেন্ট ও চলে গেল এমনি সময়।এবার যেন আমি আরো ভয়।
তীব্র শব্দে বাজ পড়ছে।কানে হাত দিয়ে কালিমা পড়ছি আমি।শান্ত থাকার চেষ্টা করছি।কিন্তু পারছিনা।ভয়ে জড়সড় হয়ে বসে রইলাম অন্ধকারের মাঝে।এর মাঝে মনে হতে লাগছো বাড়ির ছাদে কেউ দৌড়াদৌড়ি করছে।বাড়ির পেছন থেকে কেউ আমার নাম নিয়ে ডাকছে।
মনে ভয় ঢুকলে যা হয় আরকি!
ডান পাশের জানালায় দু-তিনবার শব্দ হলো ভীষণ।
ওপরের ঘর থেকে কী যেন নিচে পড়ার আওয়াজ।সব মিলিয়ে আমি যেন ভয়েই হার্ট এ‍্যাটাক করবো।এমনিতেই আমি হার্টের রুগি।ভয়গুলো সব চেপে ধরায় দিক দিশাহীন হয়ে পড়লাম।
কাঁপা হাতে ফোন হাতে নিলাম।কল লিষ্টে সামনে যতোগুলো নাম্বার পেয়েছি কল দিতে লাগলাম।জানিনা কাকে কাকে কল দিয়েছি।বা আদৌ কল গিয়েছে কিনা!
মস্তিস্ক ঠিক নেই আমার। রীতিমতো ভয়ে থরথর করে কাঁপছি।
ভাগ‍্য খারাপ।ফোন গেল বন্ধ হয়ে।চার্জ শেষ।রাগে ভয়ে ফোনটা ছুড়ে মেরেছি।নিজের চুল নিজে ছিড়তে ইচ্ছে হচ্ছে।ভেঙে পড়লে চলবেনা।
অন্ধকার হাতরেই মোম খুঁজতে লাগলাম।এ ড্রয়ার-ও ড্রয়ায় হাতিয়েও কিছুই পেলাম না।কাজের সময় প্রয়োজনের জিনিস পাওয়া যায়না,আজ সেটার প্রমাণ পেলাম।
সাধারণত এসব ছোট-খাটো জিনিস ভাবি নির্দিষ্ট স্থানে গুছিয়ে রাখে।ভয়ের চোটে আমার কিচ্ছু মনে নেই।মোম খুঁজতে গিয়ে কিসের সঙ্গে যেন পা কেঁটে গেছে।সেদিকে খেয়াল নেই আমার।এক টুকরো আলোর খোঁজে ব‍্যস্ত আমি।

এরই মাঝে বাড়ির সদর দরজা ঠাস করে শব্দ করে খুলে গেল।মনেই ছিল না দরজা লাগাতে।বাতাসে দরজা খুলেছে,আমি ভেবেছি কেউ ইচ্ছে করে খুলেছে।
ভয়ে এবার কেঁদেই ফেললাম।মনে হচ্ছে এই বুঝি দরজার সামনে কেউ ছুড়ি নিয়ে দাঁড়াবে ভয়ংকর চেহারায়।অথবা আমার ওপর ঝাপিয়ে পড়বে।

বাড়ি থেকে বেশ খানিকটা দূরে একটা ক্ষেত মতো জায়গায় প্রচন্ড আলো নিয়ে বাজ পড়লো।চোখের সামনে এটা দেখলাম আমি।
মনে পড়ে নিজের ছোট বেলার কথা।
আমার খুব প্রিয় একজন বান্ধবীকে চোখে সামনে বাজ পড়ে মরে যেতে দেখেছিলাম।ওর পুরো শরীর পুড়ে গিয়েছিলাম।কী ভয়ানক দৃশ্য!

সেটা আজ চোখে চোখে ভাসছে।মনে হচ্ছে সেই বান্ধবীটা ঐ বাজ পড়া স্থান থেকে দৌড়ে আসছে আমার নিকট।

আর সেখানে থাকতে পারলাম না আমি।দরজা খোলা রেখেই দৌড়ে ঘরে চলে গেলাম।বিছানায় কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়ি।হালকা আলো ঘরেতে।সেই আলোয় মনে হচ্ছে পুরো ঘরের দেওয়াল যেন এগিয়ে আসছে।আমায় চাপা দেবে এক্ষুনি।শ্বাসকষ্ট শুরু হয়।
আমার পরিস্থিতিতে নিজেকে একবার কল্পনা করে দেখুন।চোখ বন্ধ করে সব অনুভব করার চেষ্টা করুন।আপনার মাঝেও অস্থিরতা দেখা দেবে।

ঘরে আর থাকতে পারলার না আমি।দৌড়ে বেরিয়ে এলাম।
সিড়িতে তখন আমি।নিচে একটা অবয়ব দাঁড়িয়ে দেখলাম।তার হাতে লাইট।
আলোর দিশা পেয়ে সেদিকে ছুটি।এতোটুকু শিওর যে সে একজন মানুষ।
ব‍্যাস এটুকুতেই হয়ে গেল আমার।কে বা কেন এসেছে দেখার দরকার নেই।দৌড়ে গিয়ে তার বুকে ঝাপিয়ে পড়ি।এতোটাই শক্ত করে চেপে ধরেছি যেন তার পাজরের মাঝে ঢুকে যাই আমি।
মিনিট তিনেক পার হয় এভাবেই।নিশ্চুপ পরিবেশে বাজের শব্দ ক্ষণে ক্ষণে।
পরিচিত এক কন্ঠস্বর।

“আপনি ঠিক আছেন তন্নি?”

কথাটি কানেতেই গেল না আমার।আমি চুপ।ওভাবেই ধরে আছি।

মিনিট দুয়েক পর আবারো স‍্যার বললেন,”তন্নি ঠিক আছেন আপনি?”

আমি শুধু তার দিকে অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকালাম।চোখে উপচে পড়া ভয়।স‍্যার প্রশ্ন করলেন,”কী হয়েছে?”

এটা জিজ্ঞেস করা মাত্রই উন্মাদের মতো আমি বলতে লাগলাম,”ছাদেতে কেউ হাঁটছে।ঘরে কেউ ভাংচুর করছে।দেয়াল এগিয়ে আসছে।আমায় কেউ ডাকছে।মৃত বান্ধবী দৌড়ে আসছে।দরজার কাছে ছুড়ি নিয়ে কেউ দাঁড়িয়ে আছে।”

স‍্যার আমায় শান্ত হতে বলে বললেন,”কেউ নেই দেখুন আপনি।কেউ নেই।”

আমি মানলাম না।তার দু-বাহু ধরে বললাম,”আছে আছে সব আছে।ঐ দেখুন দাঁড়িয়ে আছে।দৌড়ে আসছে।”

স‍্যার এবার ধমক দিলেন আমায়।কেঁপে উঠি আমি।
আমার দু-বাহু চেপে ধরে ঝাকিয়ে বলে,”কিচ্ছু নেই তন্নি।কিচ্ছু নেই।হুশে ফিরুন।এগুলো সব আপনার মনের ভুল।ভয় পেয়ে মনে মনে একাই এসব কল্পনা করেছেন।এসবের বাস্তব কোনো ভিত্তি নেই।”

থমকালাম আমি।হুহু করে কাঁদতে কাঁদতে নিচে বসে পড়লাম।ভয়ে আমার কাপুনি কমেনি তখনও।
স‍্যারও বসলেন সামনে।আমি কাঁদতে কাঁদতে তাকে অনুরোধ করলাম,”পাপ হলে হোক,আমায় একটু জড়িয়ে ধরুন না স‍্যার।আমি মনে হয় মরে যাবো।”

আমার কন্ঠে আকুতি,অনুরোধ।স‍্যারের মায়া লাগলো বোধহয়।
জড়িয়ে নিলেন বুকে।এভাবেই পার হলো আরো মিনিট পাঁচেক।
কাপুনি কমেছে কিছুটা।
তিনি ধীর স্বরে বললেন,”ঠিক আছেন?”

আমি মাথা ঝাকালাম।

“বাড়িতে কেউ নেই?”

এবারে মাথা নাড়লাম।

স‍্যার আমায় ধীরে ধীরে ওঠালেন।সোফার কাছে নিয়ে যেতে চাইলেন।পায়ের ব‍্যাথায় খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটছি আমি।
তিনি আমার হাঁটা দেখে টর্চটা পায়ের দিকে তাক করলেন।
সঙ্গে সঙ্গে উচ্চস্বরে বললেন,”ওহ মাই গড!
আপনার তো পা কেটে গেছে অনেকটা।
এখানে বসুন আমি ঔষধ নিয়ে আসছি।”

স‍্যারের হাত আকড়ে ধরে কান্নাভেজা কন্ঠে বললাম,”প্লিজ যাবেন না আমায় একা রেখে।আমার ভীষণ ভয় করছে।”

অগত‍্যা সে আমার পায়ের কাছে বসলো।পকেট থেকে রুমাল বাহির করে পায়ে বেধে দিল।

“আপনার কী এখনো ভয় করছে?”

এবারেও মাথা ঝাকালাম।
স‍্যার টর্চটা পাশে রেখে বলল,”আমি এখানেই আছি।মোম খুঁজছি।ভয় পাবেন না।”

তিনি ড্রয়ারে খুঁজলো।শেষ ড্রয়ারে মোমের প‍্যাকেট পেয়েও গেল।অথচ আমি তখন পাইনি। তাড়াহুড়োর আর ভয়ের চোটে হয়ত হাতে পেয়েও বুঝতে পারিনি।

কিচেন থেকে লাইটার এনে মোম জ্বালাতে শুরু করেন তিনি।খোলা জায়গায় মোম গুলো রাখেন।
কিন্তু বাতাসে নিভে যায় বারবার।
সদর দরজা আটকে দেন।পুরো ড্রয়িং রুমটা মোমের আলোয় আলোকিত হয়।
এবার একটু শান্ত লাগছে আমার।কাজ শেষে স‍্যার এলেন।আমার পাশে বসে বললেন,”এখনো ভয় করছে?”

“নাহ।”

স‍্যার যেন স্বস্তি পেলেন। দীর্ঘশ্বাস নিলেন।
কিচেন থেকে পানি এনে আমায় খাওয়ালেন।এরপর প্রশ্ন করলেন ‘হয়েছেটা কী। আর ভাবি কোথায়।

“ভাবির ছেলে অসুস্থ তাই ভাই-ভাবি গ্রামে গেছেন।বাড়িতে আমি একাই ছিলাম।আলিফকে কল দিয়েছিলাম ধরেনি।
হঠাৎ খুব জোরে বৃষ্টি শুরু হয়।বাজ পড়তে থাকে।ছোট বেলায় বাজ পড়ার সঙ্গে আমার জীবনের এক দূর্ঘটনা জড়িয়ে আছে।
সেসব মনে পড়ে ভয় পেয়ে যাই আমি।”

“ওহ আচ্ছা বুঝলাম।এবার শান্ত হন।আপনার পরিস্থিতিতে থাকলে যে কেউই ভয় পেত ।”

আমি ফট করে স‍্যারের দিকে তাকিয়ে বললাম,”আপনি এখানে এলেন কী করে?”

“আপনার ফোন থেকে আমার ফোনে মিসড কল গিয়েছিল।পরে কল ব‍্যাক করলে দেখি ফোন বন্ধ।
আমার চিন্তা হচ্ছিলো।এজন‍্য ছাতা নিয়ে বাড়ির বাইরে বেড়িয়ে একটু উকি দেই।দেখলাম আপনার বাড়ির দরজা খোলা।এই ঝড়-বাদলের সময় সদর দরজা খোলা দেখে ভাবলাম কিছু হয়েছে কিনা।
এজন্যই এলাম।”

আমি দু-দন্ড চুপ থেকে বললাম,”এলাকায় চোরের প্রকোপ শুরু হয়েছে।এজন‍্যই একা বাড়ি রেখে ভাবির সঙ্গে যেতে পারিনি আমি।
আপনি সব ফেলে এলেন যদি কোনো সমস্যা হয়।”

“সেসবের ভয় আমি পাইনা।এছাড়াও কাল সবে শিফ্ট হয়েছি আমি।থাকার মতো কটা ফার্নিচার ছাড়া ঘরে কিচ্ছু নেই।চোর এসে নেবে টা কী তাহলে?
আর আমি আসার সময় বাড়ি তালা দিয়ে রেখেও এসেছি।সুতরাং চিন্তা করবেন না।”

“আমার জন্য শুধু শুধু কষ্ট করতে হলো আপনায়।”

স‍্যার সামান্য হেসে বললেন,”কষ্টের কী আছে?
একজনের বিপদে অন‍্যজন পাশে থাকবে এটাই মনুষ্য জাতির ধর্ম।
আমরা দুজন ভালো বন্ধু।বন্ধুর বিপদে বন্ধুই তো এগিয়ে আসবে।
এখন আবার আমরা প্রতিবেশিও।প্রতিবেশির কাজই প্রতিবেশির উপকারে আসা।”

আমি চুপ রইলাম।বাজ কমেছে।বৃষ্টি এখনো হচ্ছে।ঠান্ডা বাতাস বইছে।
শীত লাগছে আমার।শাড়ির আচল দিয়ে শরীর পেচিয়ে দু-হাত মুড়ে আছি।তবুও শীত কমছেনা।মূলত ভয়ে আমার জ্বর চলে এসেছে।

স‍্যার বুঝতে পারেন বিষয়টি।চারপাশে তাকিয়ে একটা চাদর পান খুঁজে।সেটি এনে আমার গায়ে পেচিয়ে দেন তিনি।পাশে বসেন।
দুজনের মাঝখানে একহাত মতো দূরত্ব।
আমি মাথা নিচু করে।
স‍্যারও চুপচাপ নিজের হাত ঘসছেন।
সামনের টেবিলে জ্বলছে একটা মোমবাতি।সেটির হলুদ আলো দুজনের মুখে এসে পড়েছে।
আমার পানির পিপাসা পায়।পানি খেতে ঝুকে নিচের গ্লাস নিতে নেই।আঘাত লাগা পায়ে চাপ পড়ে। আর্তনাদ করে উঠি।
স‍্যার তড়িঘড়ি এগিয়ে এলেন।নিচে বসে পানির গ্লাস হাতে নিয়ে আমার মুখের সামনে ধরলেন।
পানি পান করলাম।গ্লাসটা টেবিলে রাখলেন তিনি।
আমার দিকে তাকালেন।
দুজনের দৃষ্টি স্থির।স‍্যার নিচে বসা।আমি সোফাতে।
স‍্যার অস্পষ্ট স্বরে বলে,”আমি সর্বক্ষণ আপনার পাশে থাকতে চাই তন্নি।”

চলবে।