উপন্যাসের নাম:#আমি_আছি🤍
লেখনিতে:#সাদিয়া_আফরোজ
সূচনা পর্ব 🖋️ (১)
বাঁশের বেড়ার সাথে গুঁজে রাখা ছোট আয়না হাতে নিয়ে নিজেকে দেখে নিলো তৃধা। সংসার জীবনের দুটো বছর পেরুলো আজ ।এই দুই বছরে স্বামীর জন্য ঘটা করে সাজলো না সে। এইদিকে হারিকেনটা নিভু নিভু করে জ্ব*লছে। কারেন্ট কখন আসবে তার ঠিক নেই, গেছে যে ঘন্টা খানেক হয়েছে। ভাবতে ভাবতে নারকেল তেলের বোতল থেকে এক কোস তেল নিয়ে পুরো চুলে মাখলো। আজ পুরো দিন মাথায় চিরুনি করেনি,চুল গুলো এলোমেলো হয়ে আছে। হারিকেন হাতে নিয়ে বিছানার চাদর উঠিয়ে চিরুনি খুঁজে নেয়। মাঝখানে সিঁথি করে বেনি বাঁধলো। একটা সময় ছিলো যখন চুলে তেল দেওয়া নিয়ে মায়ের সাথে আটঘাট বেঁধে ঝগড়া করতো। চোখে কাজল আর চুলে তেল দেওয়া বারবরই অপছন্দের ছিল, তার সাথে চুলে বেনী করার ব্যাপারটাও। যদিও বিয়ের পর এই অপছন্দের ব্যাপার গুলো তার রোজকার কর্ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন চুল গুছানো মানেই , চুলে তেল দিয়ে বেনী করা। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে কাপড়ের পুটলি খুলে মোটা পাড়ের লাল শাড়িটা বের করে ঝটপট পরে ফেললো। এই শাড়িটা রজব কিনে দিয়েছে গত ঈদে। গুনে গুনে তিনবার পরা হয়েছে।শাড়িটা যতবার পরেছে ততবার রজব মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিল। রজবের সেই তাকানো কল্পনা করে মুখ ঢেকে লাজুক হাসলো। আয়না হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নিজের চেহারা দেখলো কতক্ষন।চোখ দুটো খালি খালি লাগছে। কাজল কালো চোখ রজবের পছন্দ। আজ কাজল না দিলে যেন অপূর্ন থাকবে সব। চোখ বুলিয়ে কাজলের কোটা খুঁজে দেখলো। কোথাও নেই,এমন সময় জিনিসটা খোয়া গেল! আফসোস করে শাড়ির আঁচল টেনে ঘোমটা দিয়ে দরজা খুলে বেরোয়।
সোহাগী মাত্র ছেলে মেয়ে দুইটাকে ঘুম পাড়িয়ে উঠেছে। এমন সময় দরজার কড়া নড়লো। সোহাগী ছেলেমেয়ে দুটোর দিকে তাকিয়ে বিরক্ত হলো।
“আসছি বাবা আসছি! দরজা ভে*ঙে ফেলো না। এই সময় কে এলো?”
দরজায় আরো দুইবার টোকা দিলো তৃধা।
“দেখেছো! দেখেছো! এমন ভাবে দরজা ধাক্কাছে আরে ছেলেমেয়ে দুটো উঠে যাবেতো।
সোহাসী এইবার গলার স্বর মৃধু উঁচিয়ে বললো,থাম আসছি।”
দরজা খুলে তৃধাকে দেখে সংকুচিত ভ্রুজোড়া সিথিল করে বললো,, আরে তুই? আয় ঘরে আয়।
তৃধা মাথা নেড়ে বললো,, এখন ভেতরে ঢুকবো না ভাবী। আপনার দেবর এসে পড়বে।
সোহাগী তৃধাকে একবার দেখে নিয়ে বললো,, দেবর বউতো নতুন কাপড় পরে আছে। ঘটনাকি ? আজ রজবকে খু*ন করবি নাকি?
তৃধা লাজুক হেসে বললো, যাহ!এইভাবে বলছেন কেন ভাবী?
” ঠিক আছে ঠিক আছে । দেখো কি লজ্জা পাচ্ছে,যা আর বলবো না। তা কি দরকারে এলি বোন?”
“কাজলের কৌটা খুজে পাচ্ছিনা ভাবী। আপনার দেবর কাজল পছন্দ করে।”
সোহাগী মুখটিপে হেসে ভেতরে রুমে চলে গেল।
ফিরে এলো এক কৌটা কাজল নিয়ে।
তৃধা হাত বাড়িয়ে কাজল নিতে গেলে সোহাগী হাত চেপে ধরে ফিসফিসিয়ে বললো, ফেরত দিবি না। আজ থেকে এইটা তোর। রজবকে আঁচলে বাঁধ মু*খ*পু*ড়ি। আচল ছেড়ে বেরোতে দিবি না। বেটা মানুষরে ছুট দিলে পাখা গজায়।
তৃধা মুখ ঢেকে হেসে বললো,, ঠিক আছে ভাবী।
তৃধা দরজা ছেড়ে হুড়মুড়িয়ে পালালো। আর কিছুক্ষণ থাকলে ভাবী বেফাঁস কথা বলে লজ্জায় ফেলবে নিশ্চিত।
সোহাগী হাসে। আক্ষেপ করে হাসে। কার কপালে সুখ কতোদূর কে জানে!
যত্ন করে ডাগর চোখে কাজল ছোয়ালো তৃধা। কয়েকবার পলক ফেলে মুখ টিপে হাসলো।তার পছন্দের তালিকায় কাজল না থাকলেও ,কাজল দেয়া চোখ যে রজবের খুব পছন্দ।
ভিড়িয়ে রাখা দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো রজব। নিভু নিভু আলোয় চোখ বুলিয়ে নিলো রুমে। তৃধা রজবকে দেখে চোখ নামিয়ে দৃষ্টি মেঝেতে রাখলো। রজব নিভু আলোয় তৃধার দিকে চাইলো। লাল শাড়িটায় বেশ লাগছে তার তৃধুরানীকে।
শাড়ির আঁচল আঙ্গুলে পেঁচিয়ে রজবের চোখে চোখ রেখে মুচকি হাসলো তৃধা। কাজল কালো ডাগর আখিতে থমকায় রজব।তার ভাঙ্গাচুরা ঘরে হুর নেমে এলো নাতো! দুই পা ফেলে এগোয়,
তৃধা ঠোঁট চেপে হাসে। এইদিকে হারিকেনের নিভু নিভু আলোর সমাপ্তি ঘটে।
____
সকালে জমিলা শাক্ ধুতে গিয়ে তৃধাকে দেখে বললো।
“কিগো দেওরা বউ শুনলাম রজব নাকি চাকরি পেয়েছে?”
তৃধা ঠোঁট প্রসস্ত করে হাসলো।
” জ্বী ভাবী দোয়া করবেন।”
জমিলা মাথা নেড়ে বললো, তোর জন্য সবাই দোয়া করে। দুই বছর কম কষ্ট করলি না। রাজ প্রাসাদ ছেড়ে কি বুঝে এই কাঙ্গালের ঘরে এলি কে-জানে! অভাব ছাড়া কিছু দিয়েছে তোকে?
জমিলার কথায় ঈষৎ মন খারাপ হলো তৃধার। গলা স্বর ছোট করে বললো,, রজবের ভালোবাসাই যথেষ্ট ভাবী। আমার রাজ প্রাসাদ দরকার নেই। আমার অভাবের সংসারে ভালোবাসার কমতি নেই। আমি তার অভাবের সংসারে খুশি আছি। ডাল ভাত যা খাচ্ছি দুই জনে একসাথেই খাচ্ছি। অভিযোগ নেই ভাবী। রজব ভালোবাসে আমায়।
জমিলা অবাক হয়ে বললো, তোর জায়গায় অন্য কেউ হলে সংসার দুইদিনো টিকতো না। তোরে কি মাটি দিয়া বানাইছে আল্লাহ জানে।
জমিলার কথা শেষ হতেই সোহাগী থালাবাটি নিয়ে ঘাটে নামে।
” ভাবী কারে কি বুঝাও! টুনাটুনিতে ভালোবাসার কমতি নেই। দেখ না সকাল থেকে কেমন ফুরফুরা।”
জমিলা ঘাট ছেড়ে যেতে যেতে বললো,, তোর সংসার সুখের হোকরে তৃধা। এইবার তোর কোল আলো করুক।এমনই সুখে থাক তুই।
তৃধা পাতিল ঘষাঘষি করে কালি তুলতে তুলতে মাথা নাড়ে।
সোহাগী তৃধার খোঁপার দিকে তাকিয়ে বলল,, রজব এনেছে?
তৃধা লাজুক হেসে বললো,, জ্বী ভাবী। প্রতিদিন একটা করে মালা নিয়ে আসে। বিয়ের আগে একদিন বলেছিলাম। তার মনে আছে।
সোহাগী তৃধার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,, এইবার একটা বাচ্চা কাচ্চা নে। দুইবছর তো হলো।
” মাত্রতো চাকরি পেয়েছে ভাবী।আরো কিছুদিন যাক।”
সোহাগী দ্বিধা দ্বন্দ্ব নিয়ে বললো,, একটা কথা বলার ছিল তৃধা।
“বলো ভাবী।”
“থাক পরে বলবো। তুই বরং রান্না বসা। রজব এসে পড়বে।”
তৃধা ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে পা বাড়ায়। আজ রজবের পছন্দের রান্না করবে। পটল ভাজি সাথে মসুর ডালের ভর্তা।
তৃধা সংসারে তৃধা তার স্বামী , শ্বাশুড়ি আর এক ননদ নিয়ে থাকে। ননদ রাজিয়ার বিয়ে হয়েছে একবছর হলো। তার স্বামীর দুই কুলে কেউ নেই। রেজিয়া বেড়িয়ে যাওয়ার সময় মাকে নিয়ে গেছে। দুমাস হলো তার আসার নাম নেই। এখন আবার ননদ অন্তঃসত্ত্বা সেই হিসেবে তৃধার শ্বাশুড়ী থাকবে আরো কদিন।
রজব বাড়ি ফেরে। তৃধা ঠোঁট ফুলিয়ে স্বামীর দিকে চায়। বউয়ের রাগ বুঝতে পেরে রজব ভাত মেখে তৃধার মুখের সামনে ধরলো। তৃধা মুখ ফিরিয়ে বললো, বাড়িতে আপনি থাকেন না। মাও নেই ছোট আপাতো গেছে সেই কবে। আমি একা বাড়িতে থাকি কি ভাবে?
” রজব ভ্রুকুটি করে বললো, কি বলো? রফিক ভাইয়ের বউ, সফিক ভাইয়ের বউ কেউ কি বাড়ি নেই? তারা নায়োর গেছে কবে?”
রাগে ফুসলো তৃধা।
” জমিলা ভাবী , সোহাগী ভাবী দুজনেই আছে । কেউ কোথাও যায়নি। আপনি একটু বেশি বুঝেন।”
রজব মুচকি হাসে।
তৃধা মুখ ফুলিয়ে বললো, আপনার বাড়ি ফিরতে দেরী হয়,আমি একা ঘরে থাকি।রাতে আমার ভয় লাগে না বুঝি?
রজব বউয়ের কথা শুনে হাসে। বউ তার ইনিয়ে বিনিয়ে বাচ্চাতেই আসছে তা আর বুঝতে বাকি নেই।
” মাকে বলবো চলে আসতে? তোমার একা ভয় করে বললে মা দৌড়ে দৌড়ে চলে আসবে।”
রজবের কথা শুনে ফুঁসে উঠলো তৃধা মুখ ভে*ঙে বললো, আমার মা ডাক শুনতে ইচ্ছে করে । আপনার করেনা বাবা ডাক শুনতে?
রজব ভাত মেখে তৃধার মুখে পুরে দিয়ে বললো,এতো তাড়া কিসের। আমাদের সংসারের খুঁটি একটু শক্ত হোক। চাকরিতে যাচ্ছি সপ্তাহ খানেক হয়নি তৃধুরানী।
তৃধা ভাত চিবোতে চিবোতে মাথা নাড়ল। রজবের কথা সত্য। সংসারটা আগে গুছাতে হবে। পরে নাহয় নতুন মেহমান আনার কথা ভাববে।
রজব আরেকটু ভাত তৃধার মুখের সামনে ধরে। তৃধা মুচকি হেসে মুখে পুরে নেয়। দুই বছরের সংসারে সুখের কমতি নেই। সময়ের সাথে মানুষ বদলায় কিন্তু রজব বদলায়নি,না বদলেছে তার ভালোবাসা। এই ভেবে তৃধা বুক ফুলিয়ে শ্বাস নেয়। ভালোবাসা সুন্দর, সব পরিস্থিতিতে ভালোবাসা সুন্দর।
_________
সপ্তাহ খানেক হলো সাফিয়া খাতুন আর রাজিয়া বাড়িতে এসেছে। মেয়ের বাড়ি থেকে আসা মাত্র সাফিয়া অনেকক্ষণ ছেলের বউকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে ছিলো। তৃধা শ্বাশুড়িমায়ের বুক থেকে মাথা তুলে মুখ ফুলিয়ে বললো,, এতো দিন পর মনে পড়লো আম্মা?এলে কেন মেয়ের বাড়ি থাকলেই পারতে।
তৃধার কথায় সাফিয়া খাতুন মুচকি হাসে। তার ছেলের বউয়ের রাগ হয়েছে। তিনি বুঝতে পেরেছেন। সাফিয়া তৃধার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,, থাকতে পারলাম কই! তোর চিন্তায় চিন্তায় আমার প্রেশার হাই হয়ে গেছে।
তৃধা ব্যাস্ত চোখে সাফিয়া খাতুনের দিকে তাকিয়ে বলল,, কখন! আমাকে বলোনি কেন? একবার কল দিয়ে বলতে পারতে।
সাফিয়া হেসে উঠে বললো,, তোর মোবাইল নষ্ট হয়েছে সেই কস্মিন কালে, কিভাবে কল দিবো?
” তোমার ছেলে তো নতুন মোবাইল নিয়েছে ওইখানে কল দিতে!”
“দিয়েছি। রজবকে বলেছি সবটা।”
” তৃধার অভিমান হয়।
তার মা কি আমার মা নয়? একবার বললে কি হতো?”
রাজিয়া পাশ থেকে তৃধাকে জড়িয়ে ধরে বললো,, ভাইয়ের উপর অভিমান করে থেকো না ভাবী। আমি মানা করেছি বলতে। তুমি টেনশন করতে তাই।
তৃধা ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে।ইষৎ অভিমান রয়ে গেছে। ছোট আপা মানা করেছে ঠিক আছে । তবে সেতো বলতে পারতো?
,
,
তৃধার দিনকাল ভালোই যাচ্ছে সংসারে সুখপাখি বাসা বেঁধেছে। না ভালো থেকে উপায় আছে?রজব ইদানিং বেশ ফুরফুরে মেজাজে থাকে । আগের মত মুখটা টেনশনে চুপসে নেই। চাকরি, বেতন দুইটাই ভালো। দুইদিন হলো রাজিয়ার বর শিমুল এসেছে। রাতের খাবার খেয়ে আজই রওয়ানা দিয়েছে আবার। রাজিয়া একা থাকতে পারবেনা।তাই শিমুল বউকে বাপের বাড়ি রেখে কাজে চলে গেছে।
রাত করে ফিরেছে রজব। তৃধা ঘুম জড়ানো চোখে স্বামীর প্রতিক্ষার প্রহর চেয়ে বসেছিল এতক্ষণ। সাফিয়া খাতুন অনেক বার বলেছে,রজবের আসতে দেরী হবে তুই খেয়ে নে মা। তৃধা রিনরিনে গলায় বলে,, উনি এলে একসাথে খাবো।
রাজিয়া হেসে বলল, আম্মা কেন তুমি ভাবীর পেছনে পড়ছো। তুমি জানো না তোমার বউমা তোমার ছেলেকে চোখে হারায়।
রাজিয়ার কথা শুনে লজ্জায় মাথা নোয়ায় তৃধা। সাফিয়া তৃধার মাথায় হাত রেখে বলল,, তাই তো দেখতে পাচ্ছি। আমার ছেলে কপাল গুনে বউ পেয়েছে। লাখে একটা।
__________
মধ্যরাত
তৃধা চোখ কচলাতে কচলাতে বললো,, এতো দেরি কেন হলো আপনার? কটা বাজে খেয়াল আছে?
রজব বউয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখে ঘুমে চোখ মুখ ফুলে আছে।
” এতক্ষণ অপেক্ষা না করে খাওয়া দাওয়া সেরে সুয়ে পড়তে। দেখো ঘুমে তোমার চোখ ভেঙে আসছে।”
তৃধা অভিমানি স্বরে বলল, আসুক। আপনি ছাড়া আমার ঘুম ভালো হবে না। খাওয়া তো গলা দিয়ে নামবেই না।
রজব হেসে বলল,, ঠিক আছে,, ঠিক আছে। তুমি ভাত বেড়ে রাখো আমি হাতমুখ ধুয়ে আসি।
রজব বেরিয়ে গেলে তৃধা তড়িগড়ি করে ভাত বেড়ে রাখলো। রাত অনেক হয়েছে। মানুষটা এতক্ষণ না খেয়ে ছিলো ভাবতেই তৃধার কলিজা কেঁপে উঠলো।
___________________
পুকুর ঘাটে বসে থালাবাটি ধুচ্ছে তৃধা। উপরে বসে আছে রাজিয়া। জমিলা আর সোহাগী থালাবাটি আর পাতিল নিয়ে এলো।
বড় জায়েরা আসায় থালাবাটি সরিয়ে জায়গা করে দেয় তৃধা। জমিলা আক্ষেপ করে বলে উঠলো, দেখেছিস রাজিয়া তৃধার গায়ের রংটা কেমন ময়লা হয়েছে! প্রথম যেদিন এই বাড়িতে পা রেখেছিল সেইদিনের সাথে আজকের কোনো মিল আছে? রংটা কত ঝকঝকা ছিলো। একদম ফর্সা ফর্সা।
তৃধা তোকেও বলি শুধু সংসার করলেই হয় না। নিজেরো যত্ন নিতে হয়।
তৃধা জায়ের কথা শুনে মুচকি হেসে বলল,, কি যে বলেননা ভাবী।
রাজিয়া ভাবীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ঠিকই তো বলেছে ভাবী। তোমার গায়ের রং কতো সুন্দর ছিল। একদম ফর্সা ফর্সা। এখন দেখো কেমন ময়লা হয়েছে?
সোহাগী তৃধার দিকে তাকিয়ে বলল, হ্যারে তৃধা কই গেলো তোর রং রূপ। পড়ালেখা জানা মেয়ে এমন হলে হয়? আমাদের কথা হলে ঠিক ছিল ।আমরা স্কুরের গন্ডি পেরুতে পারিনি। তুইতো কলেজে ওঠা মেয়ে। তুই এমন হলি কেন? কেউ দেখলে বলবে তুই শিক্ষিত ?নিজের দিকে নজর দে একটু।
রাজিয়া টিপ্পনি কেটে বললো, সোহাগী ভাবী আমার ভাবীর কি সেই সময় আছে? স্বামী ভক্ত বউ সে। নিজের চাইতে আমার ভাইয়ের খেয়াল রাখে বেশি।
ননদ আর জায়ের কথা শুনে চুপসে গেল তৃধা। কিছু বললেই তিনজন মিলে ঘিরে ধরবে। তিনজনের মধ্যে তিনজনই লজ্জা দিতে ওস্তাদ।
জমিলা হেসে উঠলো,
“তা যা বলেছিস বোন। রজবেরো বলি হারি,রাজ কপাল।”
জমিলার কথা শুনে তার শ্বাশুড়ী ফাতেমা খাতুন বলে উঠলো,, আমাদের রজব কম কিসের! যথেষ্ট ভালো ছেলে।
সোহাগী আর জমিলা শ্বাশুড়িকে দেখে ঘোমটা টেনে বসলো। রেজিয়া জেঠির কথা শুনে বললো,, হুম বেশী ভালো। এতো ভালো যে আমার ভাই না হলে ভাবী আর ভাইয়ের বিয়ের আগেই তাদের সম্পর্কের মাঝে বেগড়া দিতাম জেঠি।
রাজিয়ার কথা শুনে তৃধা ঠোঁট টিপে হাসলো।তার সাথে তাল মেলালো সোহাগী,জমিলা আর ফাতেমা খাতুন।
__________
রজবের বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছে তৃধা। রজব মোবাইল নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছে। সাথে অন্য হাত দিয়ে তৃধার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে।
“মোবাইলে এতো কি দেখছেন বলুন তো? আমার সাথে দুদন্ড কথা বললে ক্ষতি হবে নাকি?
রজব তৃধার মাথায় চুমু আটলো।
” কাজ করছি তৃধুরানী। অফিসে মেইল গুলো চেক করে ম্যানেজারের কাছে জমা দিতে হবে। তা না হলে এমনি এমনিতো আর বেতন দিবে না।
রজবের কথায় চুপ হয়ে গেলো তৃধা। কাজের মধ্যে বেগড়া দেওয়ার মতো বউ সে না।
________
ইদানিং রজব খুব বেশি দেরি করে ফিরছে। যতবারই জিজ্ঞেস করছে, রজব ততবারই বলেছে কাজ ছিলো। এতে করে তৃধা আর ঘাটালো না। কিন্তু সাফিয়া খাতুন চুপ করে থাকেন নি। তিনি ছেলেকে কড়াকড়ি ভাবে বলে দিয়েছে রাত দশটার পর ফিরলে ঘরে জায়গা দিবে না। মায়ের কথা অমান্য করেনা রজব। তাও দুই একদিন দেরি করে ফেলেছে। তৃধা শ্বাশুড়িকে বুঝিয়ে শুনিয়ে রজবকে বকা খাওয়া থেকে বাচিয়ে নিয়েছে।
,
,
ঘড়ির কাটায় বরাবর একটা। রজব তখনো মোবাইল নিয়ে পড়ে আছে। তৃধা রজবের বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছে। আজকাল আগের রজবকে দেখেনা সে। এ যেন এক অন্য মানুষ। খুব কাছে থেকেও যেন দুরে চলে গেছে। তৃধা রজবের বুক থেকে মাথা সরিয়ে বালিশে রাখলো। অভিমানে বুক ভারী হয়ে উঠেছে। তৃধা সরে যেতেই রজব অন্যদিকে মুখ করে সুয়ে পড়লো। তৃধা আচ করতে পেরে তাকিয়ে দেখে রজব তার দিকে পিঠ করে সুয়েছে। অভিমানে তৃধার চোখ ভেঙে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। মনে হলো বুকের বা পাশটা কেউ খামচে ধরেছে। সেই রাতে আর ঘুম হলো না তৃধার।
*
*
দিনকাল ভালো যাচ্ছেনা তৃধার ।মনে হলো অভাবের সংসারে সুখ বেশি। টাকাকড়িতে দূরত্ব বই কিছুই নেই। লোকে বলে অভাব দুয়ারে এসে দাঁড়ালে ভালোবাসা জানালা দিয়ে পালায়। তৃধার কাছে মনে হলো ব্যাপারটা উল্টো। অভাবে সংসারে ভালোবাসা আরো বেশি থাকে। বরং টাকা হলে ভালোবাসা পালানোর তাগিদে জানালা খোঁজে।
আজ রজব তাড়াতাড়ি ফিরলো। দেখে তৃধা একটু বেশিই খুশি। খাওয়া দাওয়া শেষে সুয়ে পড়লো সবাই। রজব তখনো মোবাইল ফোন নিয়ে ব্যাস্ত। তৃধা ঘুম জড়ানো চোখে রজবের বুকের উপর থেকে মুখ তুলে চাইল। রজব তৃধাকে উদ্দেশ্য করে বলল,, তুমি ঘুমিয়ে পড়ো আমার একটু কাজ আছে।
তৃধা কথা না বাড়িয়ে চোখ বুঝে নিলো।ঘুম না এলে জোর করে কি আর চোখ বুজে রাখা যায়! অনেকটা সময় পর তৃধা চোখ মেলে তাকায়। রজব এখনো মোবাইল নিয়ে ব্যাস্ত। কি এমন দেখছে রজব! তৃধার কৌতুহল জাগলো। মোবাইলের দিকে তাকিয়ে থমকে গেলো। লজ্জায় চোখ জোড়া খুলে পড়ার জোগাড়। রজব একটা মেয়ের আপত্তিইকর ছবি খুতিয়ে খুতিয়ে দেখছে।এক মূহুর্তের জন্য তৃধার পুরো পৃথিবী থমকে গেলো। চোখ জোড়া টলমলে। তৃধা এক দৃষ্টিতে মোবাইলের দিকে তাকিয়ে আছে। রজবের হুঁশ নেই। সে আপত্তিকর ছবি আর আপত্তিকর আলাপচারিতায় ব্যাস্ত। তৃধার চোখের কোন বেয়ে নোনা জল গড়িয়ে পড়লো।যখন দেখে মেয়েটার পাঠানো মেসেজে স্পষ্ট করে লেখা ,, “আজ এতো জলদি গেলে কেন?আর কিছু সময় থাকলে কি হতো? এই কয়েক দিনে তুমি আমার অভ্যাস হয়ে গেছো রজব।”
তৃধার বুঝতে বাকি নেই রজবের রাত করে ফেরার কারন কি ছিল। তৃধার গলার স্বর আটকে আসছে। বুকের ভেতরটা কেমন ভারী ভারী লাগছে। রজব উত্তরে কি লিখলো সেটা দেখার সাহস হলোনা।ঘৃনায় পুরো শরীর গুলিয়ে উঠলো। ঘুমের ভান ধরে সরে এলো রজবের বুক থেকে। চওড়া বুকের মানুষটা এখন আর ব্যাক্তিগত নয়। ভালোবাসার সাথে বুকে মাথা রাখার অধিকারেরো ভাগ হয়েছে।
চলবে,,,