আমি আছি পর্ব-১৪+১৫+১৬

0
1021

উপন্যাসের নাম::#আমি_আছি
লেখনিতে:#সাদিয়া_আফরোজ
পর্ব: ১৪

নবনী ঘাবড়ে গেল। তৃধা তার ব্যাপারটা এইভাবে ধরে ফেলবে তার কল্পনাতেও ছিল না। দর দর করে ঘামছে সে। তৃধার কথায় নুসাইব তমাল দুজনই প্রশ্ন সূচক দৃষ্টিতে তাকালো। এইদিকে ফরিদা হককের বুঝতে বাকি নেই তৃধা কি বলতে চাইছে।

তৃধা লম্বা শ্বাস টেনে বললো,, আবাক হওয়ার কোনো কারণ নেই নবনী। এই সময়টা আমিও পার করেছি। পরিবারের ছত্রছায়া থেকে বেরিয়েছিলাম তখন। কলেজে নতুন মানুষ নতুন পরিবেশ সবটাই কেমন নজর কাড়া। তাছাড়া যে চোখ জোড়া বইয়ের পাতায় থাকতো সব সময় সেটা সবে চারপাশ খুতিয়ে দেখতে শুরু করেছিলো। সেই দেখাই কাল হলো। জিবনে প্রথম কাউকে ভালোলাগা,প্রথম কারো প্রেমে পড়া। তার সাথে ছোট ছোট মূহুর্ত, আবেগ অনুভূতি সবটাই ছিলো নতুন। বেশিদিন নয় চেনা পরিচয়ের , প্রায় তিনমাস। এরপর ধীরে ধীরে তার প্রেমে পড়া।

তৃধা থামলো কিছু সময়। সবার উৎসুক দৃষ্টি তৃধার দিকে। বাদ যায়নি নুসাইব সেও তাকিয়ে রয়।

সময় নিয়ে পুনরায় বলে উঠলো,,,এইচএসসি পরীক্ষার ঠিক তিন দিন আগে পরিবারের লোকজন ব্যাপারটা জেনে যায়। এখন এই মুহূর্তে যে পরিবেশ? সেটা আমার বেলাতেও ছিল। বিশ্বাস করো! তোমাকে যেমন তোমার পরিবার ভালোবাসে, স্নেহ করে ঠিক তেমটাই আমার পরিবার আমাকে করতো। বাড়ির সবচেয়ে বড় কক্ষটা আমার ছিলো। দামি দামি ফার্নিচার হতে শুরু করে এমন কোনো কিছু ছিলনা যেটা আমার রুমটাতে নেই। আবদার করতেই সব চোখের সামনে হাজির। কিন্তু কেন জানি ভালোবাসার মানুষের আবদারটা মেনে নেয়নি। অতি আদরের হওয়াতে রাগ জেদ সবটাই বেশি ছিলো। জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে তোমার মত আমিও সবটাই মেনে নিলাম। কিন্তু মনে মনে ঠিকই ঘর ছাড়ার ফন্দি আটলাম। ঠিক ভুল বিচার করার মত বয়স ছিলো না তখন।বয়সটাও জেদ করার ছিলো। ফলস্বরূপ পরের দিন মানুষটার হাত ধরে পালিয়ে গেলাম। ছোট থেকে যারা আগলে রেখেছে তাদের কথা একবারো ভাবা হলো না। পেছনে ফিরে দেখা হলো না। একবারের জন্যও মনে হয়নি তারা আমাকে ছাড়া কি করে থাকবে। সমাজের কথা তো বাদই দিলাম।
তৃধা থেমে বললো,,এরপর বিয়ে হলো সংসার হলো। যে মেয়ে এসি ,এসিরুম ছাড়া ঘুমাতো না সে গ্ৰামে ভাঙাচুরা টিনের চারচালার ঘরে থাকা শিখলো। যার নরম বিছানা পছন্দ ছিলো সে শক্ত বিছানায় অভ্যস্থ হলো। অন্ধকারে ভয় পাওয়া মেয়ে লম্বা সময় হারিকেনের নিভু নিভু আলোয় থাকা শিখলো। যে রান্না ঘরের চৌকাঠ কখনোই মাড়ায়নি সে তার স্বামীর জন্য হাত পুড়িয়ে রান্না শিখলো। বিশ্বাস করো নবনী সহজ ছিলো না। এতো কাঠিন্যতার পরেও কখনো আফসোস করিনি,আক্ষেপ করিনি। তিল তিল করে সংসার গুছানো আয়ত্ত করা খুব একটা সহজ ছিলো না। তার পরও তার পরিবার সহ থাকতে শিখে গেলাম। সবার প্রিয় হয়ে গেলাম ঠিকই, কিন্তু যার সব চেয়ে প্রিয় থাকার কথা তার অপ্রিয়র খাতায় নাম লিখালাম। দু’বছর কম সময় নয়। হঠাৎ একদিন তার মনে হলো, আমাকে তার আর ভালোলাগছে না। হঠাৎ মনে হলো না ধীরে ধীরে তার কাছে তিক্ত হলাম সেটা জানি না। তবে আমি ছাড়াও তার অন্য কেউ ছিলো যার সাথে সময় কাটিয়ে রাত করে ফিরতো। বুকে পাথর চেপে সেটাও নজরান্দাজ করলাম। দেখেও না দেখার ভান করে সংসার মুখি হলাম। তাও অল্প কিছুদিনের মধ্যে সব শেষ হয়ে গেল। গায়ে হাত তোলা,হুট করে সে নতুন বউ নিয়ে হাজির হওয়া।সবটাই যেন চোখের পলকে ঘটে গেলো।
তৃধা থামলো। গলা ধরে আসছে তার। বড় বড় নিশ্বাস ফেলে নিজেকে ধাতস্থ করলো। তৃধার কথা শুনে নবনী আর ফরিদা হকের চোখ জোড়া পুনরায় ভিজে উঠলো। নুসাইব আর তমালের চোখ জুড়ে বিস্ময়। দু’জনের মনের মধ্যে একই প্রশ্ন” মেয়েটা এতো কিছু কি করে সয্য করলো?”
তৃধা লম্বা শ্বাস টেনে আবারো বলে উঠলো,,আমি তখনো তার জন্য রান্না করে বসে, কিন্তু সে ঘরে নতুন বউ নিয়ে উপস্থিত। কেন জানি অপ্রয়োজনীয় তালিকায় খুব তাড়াতাড়ি ফেলে দিলো,মা বোন বাড়ির প্রতিটা মানুষের প্রশ্ন উপেক্ষা করে তালাক দিয়ে ফেললো। কত সহজে একটা সংসার ভেঙ্গে গেলো,কত সহজে একটা সম্পর্ক শেষ হয়ে গেলো নবনী। সেই আপন করে নেওয়া বাড়িটা মূহুর্তে পর হয়ে গেল। এক কাপড়ে বাড়ি ছাড়লাম। তৃধা লম্বা শ্বাস টেনে বললো,,জিবনে একবার হলেও মানুষ প্রেমে পড়ে নবনী। হতে পারে সেটা এক মূহুর্ত, এক যুগ কিংবা আজিবনের জন্য।ভালোবাসা পাপ নয়,
বরং ভুল মানুষটাই অভিশাপ।
তা না হলে চিন্তা করে দেখো আমি আজ যেখানে দাঁড়িয়ে সেখান থেকে আমার উচিৎ সমগ্র পুরুষ জাতিকে ঘৃ*না করা দোষারোপ করা । কিন্তু কি বল তো,সেই সুযোগ নেই, সেই বাড়ি ছেড়ে আসার পর যখন রাস্তায় রাত কাটানোর কথা ছিলো তখন আংকেল আমাকে নিয়ে এলো। তোমার ভাইদের দেখো। তাছাড়া আমার পরিবারেও পুরুষ আছে , তার পরিবারেও অন্যরা ছিল।। একজন খারাপ পুরুষ মানুষকে দিয়ে তো আর সবাইকে বিচার করা যায় না। একজন খারাপ থাকলেও শত শত ভালোর উদাহরণ আমার কাছে আছে। আমি বলছি না তোমার ভালোবাসার মানুষটা খারাপ। আমি আমার পরিস্থিতি দিয়ে তোমাকে বিচার করছি না। বরং চাইছি তুমিও যেন আমার মত ভুলটা না করো। অন্তত মানুষটা ভুল হলেও তোমার পরিবার যেন তোমার পাশে থাকতে পারে। আমার মত তোমাকে যেন পথে পথে ঘুরতে না হয়। হতে পারে এই পৃথিবীতে দ্বিতীয় কোনো নাবীব আংকেল নেই যে তোমাকে আমার মত করে আগলে রাখবে ঠাই দিবে।

নবনী মাথা নিচু করে চোখের পানি ফেলছে। সত্যি সে বড় একটা ভুল করার চিন্তা করছিলো।

তৃধা তমাল আর নুসাইবকে উদ্দেশ্য করে বলল,, আপনাদের পারিবারিক ব্যাপারে আমার কথা বলা উচিৎ হয়নি। তাও বললাম কারন আমি কখনো চাই না আমার মত পরিস্থিতিতে অন্য কোনো মেয়ে পড়ুক। আরেকটা কথা,সব কিছুই সময় নেয় । হুট করে যেমন কাউকে ভালোবাসা যায় না, তেমন হুট করে ভুলাও যায় না। আমার মনে হয় নবনীর থেকে সবটা শুনার পর সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। আমার মত তাকেও যেন ছু*রি গলায় ঠেকিয়ে রাখার মত জোর করে রাজি করানো না হয়।অন্তত তাকে বলার সুযোগ দেওয়া হোক। হতে পারে সেই মানুষটা ভুল নয়। হতে পারে সে নবনীকে আগলে রাখার মত যোগ্যতা রাখে। যেহেতু নবনী এখনো ছোট না,আমি আশা করি সে বুঝতে পারবে তার পরিবার কখনো তার খারাপ চাইবে না। ভালো-খারাপের জ্ঞান তার আছে। বাকিটা আপনারা যা ভালো বুঝবেন।

কথা শেষে তৃধা নিরবে বেরিয়ে আসে। এই মুহূর্তে তাদের একা থাকা প্রয়োজন। তাছাড়া তৃধার নিজেরো দম বন্ধ লাগছে। নবনীর ঘর থেকে বেরোতেই নাবীব শেখকে দেখতে পেলো। তার বুকের পাশের পাঞ্জাবিটা ভেজা, সম্ভবত কেঁদেছেন তিনি। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন। নাবীব শেখকে দেখেও ধীর পায়ে সিঁড়ি বেয়ে ছাঁদে উঠে গেলো তৃধা। কিছু কিছু সময় আছে যখন মানুষ শত কষ্টের মাঝেও একা থাকতে চায়। সে চায় তার কষ্ট গুলো অপ্রকাশিত থাকুক। নিজেকে শক্ত রেখে অন্যের মাথার উপরের ছায়া আর পায়ের নিচের শক্ত মাটি হতে চায়। অবশ্য সেই মানুষটি নিঃসন্দেহে একজন বাবা। বাবারা কষ্ট লুকোতে পারদর্শী। সন্তানের মঙ্গল কামনা করতে করতে কবরে মাথা রাখলেও আক্ষেপ করেনা।নাবীব শেখ সেই বাবাদের মধ্যে একজন।
ছাদের কার্নিশে হাত রেখে আকাশে দৃষ্টি স্থির করলো। কুয়াশা চাদরে ঢেকে আছে সব।আজ চাঁদটা ঝাপসা ঠেকছে। শহরতলীতেও দারুন শীত পড়ছে, যাকে বলে হাড় কাঁপানো শীত। তৃধা সোয়েটার পরতে ভুলে গেছে। তবে গায়ে জড়ানো নুসাইবের দেওয়া সেই চাদর। উষ্ণতার আশায় চাদর দিয়ে নিজেকে আরো ভালো করে মুড়িয়ে নিলো।

নবনী মাথা নিচু করে বসে আছে। ফরিদা হক ইশারায় ছেলেদের বেরিয়ে যেতে বললেন। তিনি কিছুক্ষণ মেয়ের সাথে সময় কাটাবেন। নুসাইব বেরিয়ে গেল তার সাথে তামালও বেরোয়। নাবীব শেখ তৃধা যাওয়ার পর পরই নিজের রুমে চলে গেছে যার ফলে নুসাইব তমাল কেউই তাদের বাবাকে দেখেনি। ফরিদা হক মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে। আসলেই ভালোবাসা ভুল নয়। বরং মানুষটা ভুল হলে জিবন অভিশপ্ত হয়ে যায়। তিনিও তো নাবীব শেখকে ভালোবেসে ছিলেন। কই সেটাতো অন্যায় নয়। বরং মানুষটা সঠিক হওয়াতে সংসার এখনো চলছে।

তমাল নিজের রুমের দিকে গেলেও নুসাইব ছাদের দিকে অগ্রসর হলো। তার সময়ের প্রয়োজন একান্ত ব্যক্তিগত সময়। ছাদে পা রাখার সাথে সাথে এক অস্পষ্ট অবয়ব চোখে পড়লো। আজো সে একা নয়। কেউ আছে যাকে নুসাইব চেনে। এই আলো আঁধার মিলে অস্পষ্ট অবয়ব নুসাইবের পরিচিত। তৃধা ভয় পাবে দেখে গলা ঝেড়ে সামনে এগোয়। তৃধা নড়লো না। বরং সে তার জায়গায় স্থির। তার ইচ্ছে নেই পেছন ফেরার, সেধে দুদন্ড কথা বলার ইচ্ছেটাও নেই। দূরত্ব রেখে দাঁড়ালো নুসাইব। লম্বা শ্বাস টেনে ছাদের কার্নিশে হাত রাখে। তৃধাকি কাঁদছে? পুরোনো ক্ষতকে পুনরায় তাজা করা সহজ কথা নয়। তার এই মুহূর্তে তার কাঁদা উচিৎ। কিন্তু তৃধা কাঁদছে না। ব্যাপারটা অদ্ভুত ঠেকলো নুসাইবের কাছে। কষ্ট পেতে পেতে মেয়েটাকি পাথর হয়ে গেলো? অনূভুতি শূন্য নাকি অনূভুতিহীন?তার মনে হাজার প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। জিজ্ঞেস করবে করেও থামে।
তখন কুয়াশার চাদর ঠেলে একফালি চাঁদের দেখা। সেই খেয়াল নুসাইবের নেই। তার নরম দৃষ্টি তৃধাতে নিবদ্ধ। আবছা আলোয় তৃধার চেহারা ভীষণ স্পষ্ট নুসাইবের কাছে। মেয়েটা তখনো চিন্তিত ভঙ্গিতে তাকিয়ে। তা দেখে নুসাইব সুধোয়,,
কতটা ভালোবাসতে তাকে?

তৃধার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়লো। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে নুসাইবের চোখে চোখ রেখে বলল,, ঠিক যতটা ভালোবাসলে তালাক দেওয়ার একসেকেন্ড আগ ওবদিও তার সকল ভুল ক্ষমা করে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকা যায়!ঠিক ততটা ভালোবাসতাম তাকে। হুম! ততটাই বাসতাম।

চলবে,,

উপন্যাসের নাম::#আমি_আছি
লেখনিতে:#সাদিয়া_আফরোজ
পর্ব: ১৫

ফরিদা হক নবনীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,, পৃথিবীতে কোনো মা-বাবা চায় না তার সন্তানের চাওয়া অসম্পূর্ণ থাকুক। সব মা বাবা চায় সন্তানের অপ্রাপ্তি গুলো পূর্ণতা পাক। মারে আমি আর তোর বাবা সেই মা-বাবাদের মধ্যে পড়ি। আমিও চাই আমার সন্তানের চাওয়া পাওয়া গুলো পূরণ হোক। হোক সেটা সাফল্য কিংবা ভালোবাসা।

নবনী মায়ের কোলে মুখ গুঁজে কান্না রত গলায় বলে উঠলো,, আম্মু আমার ভুল হয়ে গেছে আম্মু । আমাকে মাফ করে দাও। আমি তোমাদের সবার মনে কষ্ট দিয়ে ফেলেছি।
ফরিদা হক মেয়ের অনুসূচনা দেখে আলতো হেসে বলল,, মা মোটেও কষ্ট পাইনি। কষ্ট পেয়েছে তোর ভাই দুটো। ওরা তোকে চোখে হারায় মা। তোকে ছোটবেলা থেকে সেই ছোট্ট পুতুলের মত করে আগলে রেখেছে। নুসাইব আর তিন্নি তোকে যতটা সামলেছে তার অর্ধেকটাও আমি সামলাইনি। তমালের বুঝ জ্ঞান হওয়ার পর তো সেই সারাক্ষণ সাথে সাথে থাকতো। চিন্তা করে দেখ হঠাৎ কেউ সেই পুতুল বোন নিয়ে এমন কথা জানালে কেমন লাগবে? তোর ভাই দুটো তোকে বেশি স্নেহ করে। একটু বেশি আগলে রাখতে চায়। তারা ছাড়া আর জাগতিক সকল পুরুষ তাদের বোনের খারাপ চাইবে ভেবেই এমন করেছে। তাদের চোখে তুই এখনো সেই পিচ্চিটাই আছিস।

নবনী মাথা উঠিয়ে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,,আমি কি করবো বলো আম্মু? কিভাবে ভুলবো সব? ফরিদা হক মেয়ের ধরা গলায় আকুতি ভরা কথা শুনে গভীর নিঃশ্বাস ফেললো। ভালোবাসা বড্ডো বেশি পী*ড়া দায়ক। নাবীব শেখের পরিবার যখন ফরিদা হককে মেনে নিবে না বলে জেদ ধরে তখন ফরিদা হকের পরিবারের লোকেরাও জেদ ধরে বসে। তারা কিছুতেই মেয়ে দিবে না। তখন ফরিদা হকেরও নিজেকে অসহায় লেগেছিলো। যখন ভেবেছিলো নাবীব শেখকে ছাড়া গোটা একটা জিবন তার পার করতে হবে। হৃদয়স্পর্শী লোকটাকে তার ভুলতে হবে। তাকে ছাড়া অন্য কোথাও সংসার করতে হবে, তাকে ছাড়া অন্য কারো সানির্ধে যেতে হবে। কত রাত বুকের অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে রাত কাটিয়ে ভোর করেছে তা তিনিই জানেন। ফরিদা হক বুঝতে পারছেন এই মুহূর্তে নবনী কেমন অনুভব করছে। নিশ্চয়ই তার বুকটাও ফাঁকা লাগছে! হারানোর যন্ত্রণা কুঁকড়ে কুঁকড়ে খাচ্ছে? তিনি লম্বা শ্বাস ফেলে বললো,, এখনো সময় হয়নি। এখনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। বাছবিচার করা হয়নি। কথা দেখা কোনোটাই হয়নি। তাহলে ভুলার প্রসঙ্গ আসছে কেন? দেখে শুনে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। সে যদি আমার মেয়েকে যোগ্য সম্মান, মর্যাদা, ভালোবাসা দিয়ে যত্ন করে আগলে রাখবে বলে আশ্বাস দেয় ,তাহলে আমি সপ্তপর্নে আমার মেয়ে তার হাতে তুলে দিবো। এখন ভালোবাসে বলে নিয়ে যাবে ,পরে অবজ্ঞা ,অবহেলা, অমর্যাদা করবে এমন ছেলের কাছে মেয়ে দিবো না। কখনো তেমন মনে হলে আমি আমার সম্পদ ঘরে এনে রাখবো।
নবনী মায়ের কথা শুনে বললো,, তোমার কি মনে হয়,আমি ভুল মানুষকে পছন্দ করেছি?

,, ভালোবাসা কখনো শুদ্ধ পুরুষ দেখে হয় না। ভালোবাসা ভালোবাসাই হয়।এই বয়সটা শুদ্ধ পুরুষ খুঁজে প্রেমে পড়ার বয়স নয় নবনী। এই বয়সটা শুধুই প্রেমে পড়ার বয়স। শুদ্ধ কিংবা ভুল পুরুষ দেখে প্রেম করার ফুরসত কই। তাকে আমার মনে ধরেছে ব্যাস । প্রেমে পড়ে ভালোবেসে অনেক ভুলই শুদ্ধ হয়ে ওঠে। বলা কঠিন কেমন মানুষকে পছন্দ করেছিস। শুধু একটা কথা খেয়াল রাখলেই হবে,ভালোবাসা ভুল কিছু নয় মা। তবে মানুষটা একান্ত ব্যাক্তিগত হওয়ার আগেই গন্ডি পেরুনো খারাপ। তাই তোকে সেই গন্ডি পেরুনোর আগে ভাবতে হবে।

নবনী মাথা নেড়ে মায়ের কোমর জড়িয়ে ধরে বলে উঠলো,, ঠিক আছে আম্মু। ফরিদা হক মেয়ের মাথায় বিলি কেটে দিতে দিতে বললেন,, হয়েছে এইবার ঘুমা।

তৃধা লম্বা শ্বাস টেনে আকাশের দিকে তাকালো। তার দৃষ্টি অনুসরণ করলো নুসাইব। কিছু সময়ের পিনপিনে নিরবতা কাটিয়ে তৃধা বলল,, একটা মেয়ে সব কিছু ছেড়ে ছুড়ে একজন পুরুষের হাত ধরে সংসার শুরু করে। নিজের সব ইচ্ছা স্বপ্ন বিসর্জন দিয়ে সেই পুরুষের সব দোষ গুণ গুলোকে আপন করে নেয়। সম্পূর্ণ অপরিচিত জায়গা, অপরিচিত মানুষ গুলোর সাথে মানিয়ে নিয়ে সুখে থাকতে চায়। ছেড়ে যাওয়ার হাজার কারনের ভীড়ে আঁকড়ে ধরে বাঁচার একটা কারন খুঁজে পুরো জিবন কাটিয়ে দিতে চায়। সেইখানে পুরুষ মানুষটার “মনে ধরছে না” বলে সেই মেয়েটাকে ছেড়ে দেয়। তার সকল বিসর্জন,ত্যাগ সব কিছু ওই “মনে ধরেছে , ভালোলাগে না “এই দুটো অজুহাতের কাছে ফিকে পড়ে। অদ্ভুত না ব্যাপারটা?

তৃধার কথার ভীড়ে হাজার অভিযোগ অনুযোগ লুকিয়ে। নুসাইব চাইলে ভালো সম্পর্ক গুলোরও উদাহরণ দিতে পারতো। কিন্তু এই মুহূর্তে সেটা উচিৎ নয়। তৃধা যদি সম্পূর্ণ পুরুষ জাতিকে নিয়েও অভিযোগ করতো তাও নুসাইব এমন মৌনতা অবলম্বন করতো। এতে যদি তৃধার আঘাতে জর্জরিত হৃদয় কিছুটা ভালো হয়,ক্ষতি কি তাতে।নুসাইব গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বললো,, হ্যাঁ বড়ই অদ্ভুত ব্যাপার।
তৃধা বুঝতে পারছে নুসাইবের অনেক কিছুই বলার আছে। কিন্তু এই মুহূর্তে বললে হয়তো তার খারাপ লাগবে এই ভেবেই বলছে না। তাই তৃধা যা বলছে নুইসাইব তাতে হ্যাঁ এ হ্যাঁ মেলাচ্ছে। শুধু নুসাইব নয় বরং এই বাড়ির প্রতিটা মানুষই এমন।তৃধা মুচকি হেসে নুসাইবের দিকে তাকিয়ে বলল,, আজ কেন জানি নিজেকে হাল্কা লাগছে। মনে হচ্ছে ভাবী কিছু মন মস্তিষ্ক থেকে নেমে গেছে। হয়তো কথা গুলো সহজে বলে ফেলাতে।

তৃধার কথায় মৃধু হাসলো নুসাইব। বলল,, বুকে চেপে রাখা কষ্টের কথা গুলো বলে ফেলাতে এমন মনে হচ্ছে। চেপে রেখে কি লাভ? বরং বলে দিলেই ভালো। মন হাল্কা হয়।

প্রত্যুত্তরে তৃধা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বললো,, দুই বছর, দুই বছরের জিবন বৃত্তান্ত কয়েক মিনিটেই শেষ। দুই বছরের এক একটা দিন ,এক একটা ঘন্টা,এক একটা মিনিট, সেকেন্ড সবাই যেন চোখের সামনে ভাসছে। তৃধা মুচকি হেসে আবারো বলে উঠলো,, বলায় কত সহজ মনে হচ্ছে তাই না?

নুসাইব জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,, সময় গুলো এতোটাই পীড়াদায়ক ছিল? নুসাইবের প্রশ্নে তৃধা নাকোচ করে বললো,, উঁহু। শুধু অভাব ছিলো ঠিকই তবে তার চেয়ে বেশি ছিলো সুখ।

,, তাহলে কি ভেবে কষ্ট পাচ্ছো?

,, সেই সুখের মুহূর্ত গুলো ভেবে। অনেক সময় সুখের মূহূর্ত গুলো কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বার বার মনে হয় সেই সব অভিনয়,সব ভ্রম। ভ্রম যদি না হতো এতো কিছুর পর ছাড়লো কেন? অভিনয় না হলে হুট করে ভালো না লাগার কারন কি ছিলো? সে আমাকে ছেড়ে অন্য কাউকে ভালোবাসছে সংসার করছে এতে বিন্দুমাত্র আফসোস নেই। আফসোস হচ্ছে সেই সময় গুলোর জন্য যেগুলো একসাথে কাটিয়েছিলাম। যে সময় গুলোতে ভালো থেকেছিলাম‌। কেন এতো ভালো সময় কাটালাম। তখন কেন তার ভালোবাসার মানুষ ছিলাম এখন কেন নেই? সুখের সময় গুলো কষ্ট দিচ্ছে।

তৃধার নিরবে নিভৃতে করা প্রশ্ন গুলো শুনে নুসাইব বলল,, ছেড়ে দেওয়ার কারন ছিলো না তৃধা। সমাজে এমন পুরুষ এখনো আছে যারা প্রকৃত সুখ ছেড়ে খানিকের মৌহের পেছনে ছুটে। তোমার প্রাক্তন সেই রকম ছিলো হয়তো।
তৃধা তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে বললো,, হবে হয়তো।
নুসাইব বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিলো। অতঃপর তৃধার দিকে তাকিয়ে বলল,, ভালো থাকতে শুরু করো। সে ভালো আছে, তোমার উচিত তার থেকে বেশি ভালো থাকা। নিজেকে পুরোনো তৃধার খোলস থেকে মুক্ত করে দাও। তোমার ভালো থাকার প্রয়োজন।

তৃধা মাথা নেড়ে বলল,, হ্যাঁ ভালো থাকতে হবে।

,, ঠান্ডায়তো জমে যাচ্ছো চলো ভেতরে যাই।
তৃধা হাতে হাত ঘসতে ঘসতে বললো,, তাও ভালো লাগছে এইখানে। এতো বিশাল আকাশের নিচে কষ্ট গুলো তুচ্ছ মনে হচ্ছে। চারদেয়ালে দম বন্ধ লাগে।

নুসাইব ভাবুক হয়ে বললো,, কাল আবার আসবো। আবার এই নিয়ে বিস্তার আলাপ হবে। ধীরে ধীরে কষ্ট ফিকে পড়বে। এখন চলো।
তৃধা মুচকি হেসে বলল,, তা ঠিক আছে, কিন্তু নবনীকে নিয়ে কি ভাবছেন?

নুসাইব থেমে বললো,, বুঝতে পারছি না।
তৃধা লম্বা শ্বাস টেনে বলে,, এই ব্যাপারে আমি আপনার সিনিয়র। চাইলে আইডিয়া দিতে পারি।
নুসাইব শব্দ করে হেসে বললো,, ঠিক আছে বলো।

,, বোনের সাথে কথা বলুন। তাকে বুঝানোর দরকার নেই বরং সে যাকে পছন্দ করে তার সাথে দেখা করুন। আন্টি বলেছে তার বড় পুত্র খুব মানুষ চেনে। তাই এই গুনটা কাজে লাগান। ভালো হলে পাকা কথা বলে রাখবেন ব্যাস।

,,যদি খারাপ হয়?

,, যদির কোনো জায়গা নেই। তাও বলে রাখি তখন বোনকে বুঝতে পারবেন। তবে হুট করে সিদ্ধান্ত নিবেন না। অনূভুতি,আবেগ এইসব হুটহাট সিদ্ধান্তে সুধরোয় না। বরং বিগড়ে যায়।

নসাইব মাথা নেড়ে বললো,,দেখা যাক। আপাতত ঠান্ডায় জমে যাচ্ছো সেই খেয়াল আছে?
তৃধা হাতে হাত ঘসতে ঘসতে বললো,, চলুন আসলেই ঠান্ডা।

তৃধা হুটোপুটি করে হাঁটছে।পেছন থেকে নুসাইব তা দেখে মুচকি হেসে পা বাড়ায়। তার সময় ভালো যাচ্ছে। তৃধাকে ঘিরে কাটানো সময় আসলেই ভালো যাচ্ছে।
_______

রাতে সবাই খেতে বসলো। নবনী মাথা নিচু করে বসে আছে। প্লেটের ভাতগুলো নেড়েচেড়ে দেখছে।
তৃধা সেই দিকে তাকিয়ে আছে। নবনীর মনের কথা গুলো যেন সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে। নাবীব শেখ গলা ঝেড়ে বলল,, ফরিদা তুমি আমার মেয়েটার বড্ডো অবহেলা করছো। কতো করে বললাম হাঁসের মাংস রান্না করো ,করলে না। হলের ঝাপসা ডাল খেয়ে খেয়ে মেয়েটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে। সেই খেয়াল আছে তোমার?

,,ঠিক আছে কাল রান্না করবো তোমার আদুরে মেয়ের জন্য।

নুসাইব আড় চোখে নবনীর পাতের দিকে তাকিয়ে দেখলো সে কিছুই খাচ্ছে না। বাটি থেকে দুই টুকরো মাংস তুলে নবনীর প্লেটে দিয়ে বললো,, সবজি হলেও খাওয়া হয়। বাড়ি এলে ওসব খাওয়ার দরকার নেই।

তমাল ভ্রু গুটিয়ে তাকিয়ে আছে। সবার মাঝে নিজেকে অবহেলিত বাচ্চা মনে হচ্ছে। সে প্লেট এগিয়ে দিয়ে বলল,, আমিও বাইরে থাকি আমাকেও দাও। সব একে কেন দিচ্ছো ? ভালো করে দেখো আমি শুকিয়ে যাচ্ছি। তৃধা ঠোঁট কামড়ে হাঁসি আটকে রাখা তীব্র চেষ্টা করছে। নুসাইব ভাইয়ের কথায় অমত করলো না। বরং বাটির মাংস গুলো থেকে খুঁজে খুঁজে মুরগির মাথা বের করে তমালের প্লেটে দিয়ে গম্ভীর গলায় বললো,, আপাতত তোর এইটার প্রয়োজন খাঁ। ব্রেইন শার্প হবে। নবনীর চোখ এতসময় টইটুম্বুর থাকলেও নুসাইবের কথা আর কান্ড দেখে। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না। তৃধা সমেত একসাথে উচ্চ স্বরে হেসে উঠলো। তার সাথে ফরিদা হক আর নাবীব শেখ মুখ টিপে হাসছে। তমাল নুসাইবের দিকে তাকিয়ে বলল,, হবু ডাক্তার আমি। একটু সম্মান দাও। হাঁটুর বয়সী মেয়ে দুইটার সামনেও অপমান?

নুসাইব তমালের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,, এইটা স্নেহ। তাছাড়া ওরা মোটেও হাঁটুর বয়সী না। তোকে এক হাঁটে বিক্রি করে অন্য হাট থেকে আরো কম দামে কিনে আনতে পারবে।

তমাল বড় নিঃশ্বাস ফেলে বললো,, কেউ দাম দেয় না।

***

রাত প্রায় বারোটা ছুঁই ছুঁই। ফাইল গুলো রি-চেইক দিয়ে আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠলো নুসাইব। এমন সময় দরজায় কড়া নাড়লো কেউ। ঘড়িতে সময় দেখে কপাল কুঁচকে দরজা খুলে দিতেই নবনীর দেখা। নুসাইব কিছু বলবে তার আগেই নবনী তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো।
,, স্যরি ভাইয়া,স্যরি। আমাকে মাফ করে দাও। আর কখনো তোমাদের কষ্ট দিবো না।

নবনীর এমন কাজে চমকে উঠলো নুসাইব। অতঃপর বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,, কান্না করছিস কেন পিচ্চি।প্রায় বারোটা বেজে গেছে ঘুমাসনি কেন? নবনী হেঁচকি ওঠা গলায় বলল,, তোমাদের কষ্ট দিয়ে কিভাবে ঘুমাবো? ঘুম আসছে না ভাইয়া।
নুসাইব মৃধু হেসে বললো,, এই ব্যাপার?

,,হুম।

,, কিছু সময়ের জন্য খারাপ লাগলেও কষ্ট পেলেও এখন আর সেই কষ্টটা নেই। পিচ্চি মানুষের উপর মন খারাপ করতে নেই। নবনী চোখ মুছে সরে দাঁড়াতেই পেছন থেকে তমাল বলে উঠলো,, আম আটি মিলে গেছে এখন আমি তো গুটলি হয়ে নিচে পড়ে আছি। দুই পিস মাংস প্লেটে দিতেই সব পরিষ্কার হয়ে গেছে। দুই ভাইবোন মিলে আমাকে কোনঠাসা করা হচ্ছে?
নুসাইব মুচকি হেসে ডিভানের উপর বসে তাকিয়ে আছে। তমাল রুমে ঢুকে নবনীর সামনে দাঁড়াতেই নবনী তমালের হাত জড়িয়ে ধরে বললো,, ভাইয়া!

তমাল নবনীর মাথাটা বুকে জড়িয়ে ধরে বললো,, ভাইয়া ভুল হয়ে গেছে ক্ষমা করে দাও। এইসব কথা চলবে না। তোর বিয়ের দিন ওইসব আটা ময়দা মাখা অবস্থায় দশবার কান ধরে উঠবস করাবো। এরপর ক্ষমাটমা যা করার করে আপদ বিদায় করবো।
নুসাইব মুখ চেপে হেসে বলল,, আপাতত দুইবাচাল রুম থেকে বের হও। আমি ঘুমাবো।

তমাল নবনীর হাত টেনে বাইরে নিয়ে যেতে যেতে বললো,, চল চল এইটা বড় লোকের রুম‌। আমরা মিসকিন মানুষ।
দুজন যেতেই নুসাইব হেঁসে উঠল।

***

সকালে নাস্তা শেষে রোদ পোহাতে তমাল,তৃধা আর নবনী ছাদে উঠলো। নুসাইব তখন অফিসের জন্য তৈরি হয়ে রুম ছেড়ে বেরোয়।
এইদিকে ফরিদা হক নাবীব শেখকে আক্ষেপ করে বলছে ,,তৃধা মেয়েটাকে যত দেখি তত অবাক হই। এতো মায়াবী মেয়েটা। স্ত্রীর কথায় সহমত প্রকাশ করে বললো,, ঠিক বলেছো। এমন একটা মেয়ে আমাদের নুসাইবের জন্য হলে ভালো হতো।
ফরিদা হক বলে উঠলো,, ঠিক বলেছো। তৃধার মত একটা মেয়ে হলে আমি আমার বড় ছেলেটার সাথে বিয়ে দিয়ে দিতাম।

নুসাইব বেরুনোর আগে মা-বাবাকে বলে বের হয়। আজো তার ব্যতিক্রম নয়। রুমে পা রাখবে এমন সময় মায়ের কথাটা কর্ণ গোচর হলো। নুসাইব গলা ঝেড়ে রুমে ঢুকতে ঢুকতে বলল,,, তৃধার মত হলে তৃধা নয় কেন? যে আছে তাকে খুঁজতে হবে কেন?

নুসাইবের কথা শুনে ফরিদা হক নাবীব শেখ দুজনই
আচম্বিত নয়নে তাকালো।

নুসাইব তার মা-বাবার এমন রিয়েকশন দেখে একটুও অবাক হলো না। বরং চেয়ার টেনে বসে বললো,, তৃধাকে আমার সেই শুরু থেকেই পছন্দ। বুঝতে সময় লাগলেও ব্যাপারটাকে তো আর এড়িয়ে যাওয়া যায় না। আমি বেরুচ্ছি ।
নুসাইব দরজা পর্যন্ত যেতেই নাবীব শেখ বলে উঠলো,, আবেগে আপ্লুত হয়ে কথা বলো না নুসাইব। বিয়ে কোনো ছেলে খেলা নয়।

দরজার চৌকাঠ বরাবর দাঁড়িয়ে পেছনে ফিরলো নুসাইব। লম্বা শ্বাস টেনে বললো,, সেই বয়সটা পেরিয়ে গেছে বাবা। কোনটা আবেগ কোনটা অনূভুতি তা বুঝার বয়স হয়েছে আমার। দয়া মায়া ভেবেও ভুল করার কারণ নেই। তাছাড়া বিয়ের মত ব্যাপারটাকে কোনো ভাবেই ছেলে খেলা ভাবছি না। আফটার অল আমি তোমার ছেলে।
ফরিদা হকের মুখে রা শব্দ নেই। তিনি ক্ষনে ক্ষনে অবাক হচ্ছেন শুধু।

চলবে,,,

উপন্যাসের নাম::#আমি_আছি
লেখনিতে:#সাদিয়া_আফরোজ
পর্ব: ১৬

ছাদের কার্নিশ ধরে দাঁড়িয়ে আছে তৃধা। সকালের রোদ গায়ে মাখছে সে। খোঁপা খুলে চুল উন্মুক্ত করে দিলো। হাত চালিয়ে জট খুলতে খুলতে নবনী, তমাল দুজনের খুনসুটি দেখছে। নবনীর প্রেম নিয়ে খুনসুটি মারামারি পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। তমাল মিনিট দুই থেমে বললো,, ছেলে ভালো হবে না, রুচির সমস্যা যেই ছেলের, সে ভালো হওয়ার চান্স নাই। বড় মিয়াকে বলে ছেলের পেছনে নেডি কুকুর লেলিয়ে দিবো। দাঁড়ানোর অবকাশ নেই, পশ্চাতে দাঁতের দাগ পড়ার ভয়েই পালাবে।
নবনী ভ্রু কুঁচকে বললো,, কি বলতে চাইছিস ভাইয়া? রুচির সমস্যা মানে? ওকে দেখেছিস তুই?
তৃধাও বেশ আগ্ৰহ নিয়ে তাকালো। আসলেই কি তার সাথে তমালের দেখা সাক্ষাৎ হয়েছে?

তমাল মাছি তাড়ানোর মত শূন্যে হাত নেড়ে বললো,,
‘ন্যাহ্! এইসব রুচিহীন বস্তু দেখা লাগে? তার পছন্দ দেখলেই বুঝা যায় রুচির দুর্ভিক্ষ চলছে। ‘

তমালের কথায় অট্টহাসি হাসিতে ফেটে পড়লো তৃধা।

নবনী রেগে আগুন। তমাল তাকে এতো বড় অপমান করলো?এর জের ধরে তমালের সাথে তুমুল ঝগড়া মারামারি চলছে। তার সাথে বাকবিতন্ডা।

তৃধার হাঁসি থামছেই না। মৃদুমন্দ শিতল বাতাসের তালে চুল দোল খাওয়া তার সাথে প্রান খোলা হাঁসি। তৃধাকে সুখী প্রাণোচ্ছ্বল রমনীর তালিকায় ফেলছে।

ছাদের দরজায় দাঁড়িয়ে নুসাইব। বাঁদর দুটোকে দেখতে এসেছিলো। যদিও সে দুটো ছাড়াও তৃতীয় কেউ ছিলো। তাও বাহানা তমাল, নবনী। নরম রোদে প্রাণোচ্ছ্বল রমনীর হাসির ঝংকারে নুসাইবের কায়া থমকায়। চোখ জোড়া স্থির করে তাকিয়ে রয়। নিকষ কালো মেঘ সরে যেন এক মুঠো রোদ্দুর। কাঁপন ধরল হৃদয়ে, রয়ে সয়ে শ্বাস নেয় নুসাইব। মূহুর্তে বুকের মধ্যে শিতলতা ছড়িয়ে পড়লো।চোক্ষুজাড়া স্থীর হলেও অজান্তে ঠোঁট জোড়া প্রশস্ত হলো। সন্দেহের কুয়াশা সরে স্পষ্ট হলো সব। ভ্রম নয় বরং এই রমনী নিরবে নিভৃতে জমা হওয়া আঁজলা ভরা ভালোবাসা তার।

মারামারির এক পর্যায়ে তমালের দৃষ্টি ছাদের দরজায় গিয়ে পড়ে। বড় ভাইয়ের দৃষ্টি অনুসরণ করতেই তৃধাকে চোখে পড়লো। তৃধা হাসছে বেখেয়ালি হয়ে হাসছে।ভাইয়ের এহেন চাহনিতে মুখ টিপে হাসলো তমাল। এইদিকে সুযোগ বুঝে নবনী তমালের চুল দুহাতে টেনে ধরলো। ব্যাথায় চোখ মুখ খিচে চেঁচায় তমাল।

নুসাইবের ধ্যান ভাঙ্গে। ছাদের একপাশে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চোখেই পড়লো না তার।শান্ত চোখে তাকালো সে। প্রাপ্তবয়স্ক দুটো ছেলে মেয়ে সমানে চুলোচুলি করছে। ব্যাপারটা বিদঘুটে ঠেকছে। চোখ মুখ কুঁচকে ফেললো নুসাইব।

দুজন দুজনের চুল ধরে আছে। বিক্ষিপ্ত নবনী কয়েকগাছা চুল ছিঁড়ে ফেলেছে। তমাল সেটা পারছে না। আদরের ছোট বোন হওয়াতে চুল টেনে ধরলেও ছেড়াছেড়ি ওবদি এগোয়নি।

অবস্থার গতিবেগ দেখে দুইজনকে ছাড়াতে হুটোপুটি করে এলো তৃধা। তার সাথে এগিয়ে এলো নুসাইব। কে বলবে এরা বড় হয়েছে। হাতে পায়ে বড় হলেই মানুষ বড় হয়ে যায় না। বরং বুঝ বুদ্ধিতে বড় হতে হয়। বয়সের সাথে কাজের মিল নেই। স্কুল পড়ুয়া ছেলে মেয়ের মত চুল ছেড়া ছেড়ির প্রতিযোগিতা চলছে।

তৃধা নবনীর হাত ছাড়িয়ে নিতে আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। এইদিকে নবনী ছাড়বে না বলে পন করেছে। তমাল দাঁতে দাঁত চেপে বললো,, তোর ওই বেয়াদব প্রেমিককে যদি আমি টাকলা না করি আমার নাম বদলে দিস। নবনীর হাত পোক্ত হলো। নুসাইব কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। তৃধা নুসাইবকে দেখে বলে উঠল,, দাঁড়িয়ে আছেন কেন? এদের ছাড়ান না!
নুসাইব তমালের হাত দুটো ধরে বললো , কি হচ্ছে কি তমাল ছাড়!
ভাইয়ের ধমকে তমাল ছাড়লেও নবনী এখনো চুল মুঠ করে রেখেছে।

,, আমাকে ছাড়তে বলে এই বাঁদরটাকে কেন ঝুলিয়ে রেখেছো?ছাড়তে বলো।

তমালের কথায় নুসাইব বলল,, দুজনকেই বলেছি।

নবনী তমালের চুল ছেড়ে নুসাইবের পাশে দাঁড়িয়ে বললো,, তুমি ওকে কিছু বলো ভাইয়া। এই কাকের বাসা বলে ,আমাকে যে পছন্দ করবে তার রুচির দুর্ভিক্ষ আছে।

তৃধা উল্টো ঘুরে দাঁড়ালো। এই মুহূর্তে হাসি চেপে রাখা দরকার। তৃধার এই লুকোচুরি হাসি নুসাইবের দৃষ্টি গোচর হলো। চোখ ফিরিয়ে তমালের দিকে তাকিয়ে বলল,, কি সমস্যা?
তমাল চুলে আঙুল চালিয়ে ঠিক করতে করতে বললো,, যা সত্যি তাই বলেছি। এই বোচা চেহারা নিয়ে কে পছন্দ করবে বলো তো। তার উপর জংলি স্বভাব।
নুসাইব চেহারায় কঠিন ভাব রেখে বললো,, বাবাকে বলবো?
তমাল করুন চোখে তাকালো। নুসাইব সেটা দেখে বললো,, এইসব যেন আর দেখতে না হয়।

তৃধা ঠোঁট চেপে নবনীর চুল ঠিক করে দিচ্ছে।
নুসাইব পলক ঝাপটে আরো একবার তাকালো।

,, তমাল গলা ঝেড়ে বলে উঠলো,, অফিসের দেরি হচ্ছে ভাইয়া।

তমালের কথায় ঘড়িতে সময় দেখে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে পড়লো নুসাইব।

রোদের তেজ প্রখর হচ্ছে ক্রমাগত। তমাল তৃধাকে উদ্দেশ্য করে বলল,, আর থাকা ঠিক হবে না। চলো নিচে যাই। তৃধা নবনীর হাত ধরে নিচে নামতেই তমালের চোখ পড়লো তৃধার গায়ে জড়ানো শালে। এই শাল তমাল এনেছিল। গত বছর শীতে ইন্ডিয়া গিয়েছিল। সেই সুবাদে কাশ্মীরী শাল গুলো আনা। একটা নয় বরং গুনে গুনে সাতটা এনেছে। ছয়টা ছয় জনের জন্য হলেও একটা বাড়তি এনেছিল। তমালে এখনো মনে আছে এই শালটা ভাইয়ের জন্য পছন্দ করা হয়েছিল। তাহলে তৃধা আপুর কাছে এলো কি করে?

তমাল সাত পাঁচ ভেবে বললো,

‘তৃধা আপু শালটা তোমাকে ভাইয়া দিয়েছিলো?’

নবনী চমকে তাকালো। খেয়াল করেনি ঠিকই কিন্তু তমালের কথায় শালটা চিনতে দেরি হলো না। নবনী তমালকে চোখে ইশারা করলো। তমাল চোখ রাঙিয়ে চুপ থাকতে বললো।

তৃধা শালের দিকে তাকিয়ে বলল,, হ্যাঁ এবং না।

,,এটা কেমন কথা?

,, ছাদে আসার সময় সোয়েটার শাল কিছুই আনিনি। তখন আন্টি তার তোমার বড় ভাইয়ার হাতে পাঠিয়েছিলো। তাই হ্যাঁ না দুটোই বললাম।

তমাল ভ্রু জোড়া কিঞ্চিৎ কুঁচকে বললো,
‘ তুমি শিওর?’

‘হ্যাঁ। আন্টিতো প্রায় ভুলেই গেছিল এইটা তিনি দিয়েছেন। পরদিন ঠিক সকালে আরেকটা শাল নিয়ে হাজির। ‘

তমালের মাথায় শয়তানি বুদ্ধি কিলবিল করছে। চিন্তা করে দেখলো, ভালোবাসতে বাসতে মরে গেলেও তার শ্রদ্ধেয় বড় ভাই ভালোবাসার কথা বলতে পারবে না। ভালোবাসা যত তাড়াতাড়ি ধরা দিবে ততই ভালো। তমাল বাঁকা হাসলো।বলল,,
‘তোমার আন্টি ভুল বলেনি আপু। বরং এইটা ভাইয়ার শাল। হয়তো দেখেছে তুমি সোয়েটার,শাল কিছুই পরনি তার উপর ঠান্ডা ওয়েদার তাই আম্মুর কথা বলে এইটা তোমাকে দিয়েছে। দেখেছো ভাইয়া কতো কেয়ারিং?’

নবনী মুখ টিপে হাসছে।

থমকে দাঁড়াল তৃধা। সেই দিন সকালে কথা ভাবতেই অস্বস্তিতে পড়লো। কি ভাবছেন তিনি? হয়তো খারাপ কিছু। তৃধার পা চলেছে না। তীব্র অস্বস্তি হচ্ছে তার। বুঝতে বাকি নেই সেই সন্ধ্যায় চাদরের উষ্ণতার কারন। অস্বস্তি লজ্জা দুটোই ঘিরে ধরেছে তাকে।
_______

ফরিদা হক পায়চারী করছেন। ছেলের কথার আগাগোড়া কিছুই বুঝতে পারছেন না। হুট করে ভালোবাসা এলো কোথা থেকে?

নাবীব শেখ গম্ভীর মুখে বিছানায় পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে। তিনি স্ত্রীর পায়চারী দেখছেন। একটা সময় বিরক্তে ভ্রু জোড়া কুঁচকে বললো,

‘ থামবে তুমি?’

কোচকানো কপাল নিয়ে বিতর্কে ‘চ’ শব্দ করে বললো
‘ তুমি আছো থামাথামি নিয়ে। এইদিকে আমি টেনশনে শেষ।’

‘টেনশনের কি আছে? মেয়ে ভালো তারউপর ছেলের পছন্দ হয়েছে। পছন্দ কেন বলছি ভালোবাসা হবে। এই দিকে এতো এতো সুখবরের মাঝে তুমি বলছো টেনশনে শেষ?’

ফরিদা হক থেমে কয়েক সেকেন্ড স্বামীর দিকে তাকিয়ে পাশ ঘেঁষে বসলো। কন্ঠ খাদে নামিয়ে বলল,,
‘সবই মানলাম কিন্তু তৃধা বিবাহিত ভুলে গেছো? আমার হীরার টুকরো ছেলে নাবীব। একটা বিবাহিতা মেয়ের সাথে বিয়ে দিবো?
তিনি থামলেন ভারাক্রান্ত মন নিয়ে ফোস করে নিঃশ্বাস ফেলে পুনরায় বলেন,,তাছাড়া তোমার গুষ্টির মানুষ ছেড়ে কথা বলবে না। তোমার মা, ভাইয়ের বউ, তোমার বোন সবাই আমার উপর চড়াও হবে নাবীব। পাড়ায় জানাজানি হলে কি হবে ভেবে দেখেছো?’

স্ত্রীর কথায় নাবীব শেখ শান্ত চোখে তাকিয়ে গভীর নিঃশ্বাস ফেলল। ফরিদা হক মমতাময়ী এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। সে তৃধা নামক মেয়েটিকে মমতার চাদরে মুড়িয়ে রেখেছে। তবে তৃধার ব্যাথ্যায় ব্যাথিত ফরিদার বদলানো রূপ ভীষণ অপরিচিত ঠেকলো। শুধু মাত্র মেয়েটার আগে বিয়ে হয়েছে দেখে এতো এতো অজুহাত দেখানোর ব্যাপারটা মেনে নিতে পারলেন না তিনি। সময়ের চাকা ঘুরছে। অতীতে যা হয়েছিলো বর্তমানেও তা হতে যাচ্ছে।

নাবীব শেখ সোজা হয়ে বসলো। অতঃপর ফরিদা হকের চোখে চোখ রেখে হেসে বললো,, তোমার কি মনে হচ্ছে না?সময়টা আরো একবার এসেছিল । অতীতে যা হয়েছিলো তা পুনরায় ঘটছে।এই যাত্রায় তুমি মায়ের ভূমিকায় ফরিদা। ভেবে দেখো একবার। তখনকার তুমি, এখনকার তৃধা আর আমি নুসাইবের চরিত্রে।

ফরিদা হকের দৃষ্টি স্থির হলো। প্রেক্ষাপট যাই হোক নাবীব শেখের কথায় তার কলিজায় সুচ ফুটলো। তিনি ফিরে গেলেন বছর ৩৬ আগের সময়ে। সেই সময় সেই পরিবেশ গায়ে কাঁটা দিচ্ছে এখনো।

ফরিদা হকের সাথে নাবীব শেখের প্রকাশ্যে প্রেম ছিলো না। তখন প্রেম শব্দটা কোনো কঠিন অপরাধ কিংবা পাপ থেকে কম ছিলো না। তাও সেই লুকিয়ে চুরিয়ে দেখা দেখি মিলে একে অপরের প্রতি অদৃশ্য টান।
যৌবনে পা দেয়া রক্ত গরম করা এক সাহসী যুবক নাবীব শেখ। সেই টগবগে যৌবনে প্রথম ভালোলাগা ফরিদা হক। রাস্তার দুই ধার ধরে নিরবে নিভৃতে হেঁটে চলা, চোখে চোখ পড়লে সরিয়ে নেওয়া। কেউ কাউকে না দেখলে আড়ালে আবডালে খোঁজ নেওয়া কিংবা দুর থেকে দেখে নয়ন তৃষ্ণা মেটানো সময়টা যেন জাদুকরী ছিল।

একদিন হুট করে খবর এলো ফরিদা হকের বিয়ে হয়ে গেছে। নাবীব শেখ পাগল প্রায়। ফরিদা হক নির্জীব নির্লিপ্ত ভাবে মেনে নিলেন সব। বাবার অসুস্থতার দোয়াই দিয়ে তাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসানো হয়েছে।
ছন্নছাড়া পাগলবেশে পাগলামী করতেও পিছপা হলে না নাবীব শেখ। অবস্থার গতিবেগ দেখে নাবিব শেখকে শহরে পাঠানো হলো। ভুলবে ভুলবে করে আরো বেশি বিগড়ালো সে।

এইদিকে মাস না পেরুতে সংসারে কলহ শুরু হলো ফরিদার। মেনে নেওয়া, না নেওয়া নিয়ে তেমন কোনো ফারাক পড়লো না। স্বামী, শ্বাশুড়ি আর ননদের অ*ত্যা*চারে অতিষ্ঠ প্রায়।বেলা হতেই গায়ে গতরে খেটে রাতের বিচার মজলিস শেষে স্বামী নামক পুরুষের আ*ঘাত। বিষিয়ে উঠলো ফরিদা। মানুষ ভালো হলেও শ্বশুর নাম মাত্র বাড়ির কর্তা।পুরুষ মানুষের কর্ম হারালে সংসারে দাম শূন্যে গিয়ে পৌঁছায় তার জিবন্ত উদাহরণ তিনি। তার রায় সংসার নামক বিচারশালায় খুব একটা প্রাধান্য পায় না। ফরিদার কষ্ট তার সহ্য সীমা অতিক্রম করলো। তিনি ফরিদা হকের বাড়িতে গিয়ে উঠলেন। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সবটা বলে শেষে একটা কথাই বলে বেরুলেন ” মেয়েটা বেঁচে থাকতে নিয়ে আসুন। তা না হলে কবর দেওয়ার জায়গা সেইখানেও আছে।”
,,ব্যাস!ছয়মাসের সংসার জিবন। এরপর ছাড়াছাড়ি হলো ফরিদা হকের। ছাড়াছাড়ির ব্যাপারটা নাবীব শেখ পর্যন্ত পৌঁছতে সময় লাগলো না। তিনি ফিরলেন গ্ৰামে। ফরিদা হক বসে নেই, তিক্ত কথার বেড়াজাল ভেদ করে আবারো কলেজের গন্ডিতে। নাবীব শেখের বদৌলতে তিক্ত সময় ভুলে প্রনয়ে জড়ালেন। ভালাবাসায় ভাটা পড়লো সেই তিক্ত ছয়মাস।
সমস্যা হলো বিয়ের কথা বলায়। নাবীব শেখের বাবা ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে মেনে নিলেও এতে বাধ সাধলেন তার মা। একটা তালাক প্রাপ্ত মেয়েকে তিনি কিছুতেই ঘরে তুলবেন না। তার ছেলেটা অবিবাহিত, দেশেকি মেয়ের অভাব পড়েছে? তিনি এই বিবাহিত তালাক প্রাপ্ত মেয়েকে বিয়ে করাবেন?

ফরিদা হকের বাড়ির লোক প্রথমে রাজী থাকলেও পরে তারা বেঁকে বসে। দুই বাড়িতে দুইজনের অবস্থা দেখার মত। নাওয়া খাওয়া ছেড়ে বিছানায় পড়ে। ছেলের অন্নশন কাটাতে রাজি হলো নাবীব শেখের মা। দীর্ঘ ঝড়ঝাপটা শেষে বিয়ে হলো তাদের। ৩৬ বছর পার করলো পায়ে পা মিলিয়ে। তিল তিল করে গড়া সংসারে অতীত নিয়ে দুকথা ছিলো না। প্রায় ভুলে বসেছে সব। আজ নাবীব শেখের কথায় পুরোনো ক্ষত তাজা হয়ে এলো। দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়তেই ব্যাতিব্যাস্ত হলেন নাবীব শেখ।

‘ কাঁদছ কেন ফরিদা?’

ফরিদা হক চোখ মুছবেন তার আগেই আলগোছে চোখ মুছে দিলেন নাবীব শেখ।

সেই টান টান চামড়ার বয়স থেকে এই কুঁচকে যাওয়া চামড়ার বয়স পর্যন্ত একসাথে। দুকথা হয়নি কখনো। আক্ষেপ, আফসোসের বালাই মাত্র ছিলোনা তার। যেটুকু প্রয়োজন তার চেয়ে বেশি সম্মান, ভালোবাসা দিয়ে আগলে রেখেছে তাকে। তাহলে আজ কিভাবে ভুল বুঝলো এই লোকটাকে?বাধ ভেঙ্গলো ফরিদা হকের ডুকরে কাঁদলেন তিনি। নাবীব শেখ স্ত্রীর মাথা বুকে জড়িয়ে মাথায় হাত বুলালেন। কিছু সময় অতিক্রম হতেই নাবীব শেখ বলে উঠলো,,

‘ তুমি যা ভেবে কষ্ট পাচ্ছো তা নিয়ে আমার বিন্দু পরিমাণ আফসোস নেই ফরিদা। আমি তোমার অতীত নিয়ে প্রশ্ন তোলার মত লোক নই। তোমার অতীত কখনো আমাদের মাঝে আসেনি, না আসবে। কাঁদছ কেন ফরিদা,থামো এবার।

চলবে,,,

(রি-চেইক দেওয়া হয়নি। ভুল গুলো শুধরে দিবেন প্লিজ।)