উপন্যাসের নাম::#আমি_আছি
লেখনিতে:#সাদিয়া_আফরোজ
পর্ব: ২০
তৃধার সামনে দাঁড়িয়ে আছে শিমুল। হাতে হাল্কা গোলাপী রঙের ফাইল, যেটাতে একজন নারী তার সদ্য জন্ম নেওয়া শিশুটিকে জড়িয়ে ধরে হাসছে।
তৃধা ফাইলটার দিকে তাকিয়ে আছে। শিমুলকে দেখার পর কি বলবে খুঁজে পাচ্ছে না। বলা উচিৎ কিনা সেটাও জানে না।
শিমুল তৃধাকে এক পলক দেখে নিলো। তৃধাকে চেনা যাচ্ছে না। আগের চাইতে বদলে গেছে অনেকটা। বলতে গেলে সুন্দর হয়েছে অনেক। রাজিয়া বোধহয় এই সৌন্দর্যের বর্ণনাই দিতো। যেখানে চকচকে রং আর শহুরে মেয়ে কথাটাই বেশি থাকতো। আসলেই তাই শ্যামবর্নের মেয়েটাকে এখন ফর্সা লাগছে। উঁহু!! শ্যামবর্নের নয় বরং অযত্ন অবহেলার রং ছিল সেটা। শিমুল ভেবে পায় না এই মেয়েকে রেখে সুমনার মাঝে কি দেখলো রজব। চাল চুলোহীন আগাগোড়া মেকাপে ঢাকা কৃত্তিম সৌন্দর্যে গড়া সেই মেয়ে। কিন্তু তৃধা? ভাবতে পারছে না শিমুল। মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করল,, কেমন আছেন ভাবী?
ভাবী সম্বোধনে কেঁপে উঠলো তৃধা। প্রশমিত হওয়া ক্ষতটা পুনরায় কাঁচা হলো। বুকের ভেতর ঝড় উঠলো আবার। এই ডাকের সুতো ছিঁড়েছে আরো আগে। যেই সুতোর জের ধরে বাঁধা ছিলো সম্পর্ক গুলো। সেই সুতো ছিঁড়ে বেরিয়ে এসেছে তৃধা। এখন আর সম্পর্ক গুলোও নেই।
শিমুলের টনক নড়লো। মস্ত বড় ভুল করে ফেলেছে সে। কালো ছায়া তৃধার নতুন জিবনে ফেলছে আবার। নুসাইবের দিকে তাকিয়ে বিনয়ের সাথে মাথা নিচু করে বললো,, দুঃখিত!! আপু হবে । আসলে মুখ ফসকে বের হয়ে গেছে।
উচ্ছাসিত চেহারা খানা গুমোট আকাশের মত হয়ে আছে। চোখ জোড়ায় বৃষ্টি নামবে নামবে ভাব। ঢোক গিলে সংবরণ করলো নিজেকে। অতঃপর জোর পূর্বক হেসে বলল,, এইতো আছি আলহামদুলিল্লাহ।
শিমুল দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে।তৃধারও একি অবস্থা। প্রশ্ন অনেক থাকলেও সম্পর্কটা প্রশ্ন করার মত জায়গায় নেই। করলেও উত্তরে সেই লোকটার প্রসঙ্গ এলে নিজেকে সামলানো মুশকিল হবে। নুসাইব তৃধার দিকে তাকিয়ে আছে। তার চেহারায় ছেয়ে যাওয়া মেঘ দেখে মনের মধ্যে প্রশ্নের ঝড় উঠছে। কে এই লোক? ওনাকে দেখা মাত্র কেন মেঘ এসে চোখে মুখে ভীড় করলো? তিক্ত অধ্যায়ে জড়িত নাকি তিক্ত কোনো পুরুষ?
নিজের মনকে বেঁধে রাখা দায়। গোলাপি রঙ্গা ফাইলে আঁকা ছবির দিকে তাকিয়ে বাঁধা বিপত্তি ভুলে ভেজা গলায় সুধোয়,, রাজিয়া ভালো আছে?
শিমুল জানে ঠিক কতটা ভার ঠেলে এই প্রশ্ন করছে তৃধা ভাবী। বুক চিরে চৌচির হচ্ছে হয়তো। বুক ফাটছে হয়তো মুখ ফাটছে না। শিমুল উত্তরে বললো,, আছে আলহামদুলিল্লাহ। কাল কিছু টেস্ট করে গেছে। আজ রিপোর্ট নিয়ে ডাক্তারকে দেখালাম। সব নরমাল।
তৃধা টেনে নিঃশ্বাস নিলো। পুরোনো সম্পর্ক গুলো চোখের সামনে দৃশ্যমান হচ্ছে একে একে। প্রতিটা নিঃশ্বাস পাথর সমান ভার নিয়ে বুকে জমা হচ্ছে। সেই ভার ঠেলে দাঁড়িয়ে থাকা মুশকিল। বুক কাঁপছে তার, শরীর দূর্বল ঠেকছে।
শিমুল কিছু বলবে তার আগে নবনী আর তমাল এসে হাজির। নবনী তৃধার হাত ধরে শিমুলের দিকে তাকালো। শিমুলকে নবনী চিনলো না, চেনার কথাও নয়। তাই বলে উঠলো,, চলো যাওয়া যাক।ভাইয়ার সময় লাগবে হয়তো।
নবনী ভেবেছিল শিমুল নুসাইবের পরিচিত কেউ। সেইজন্য তৃধাকে একপ্রকার টেনে বেরিয়ে আসলো সেখান থেকে। নুসাইবের নজর আর তৃধার চেহারার আদল দেখে সবটা না হলেও কিছুটা আন্দাজ করে নিলো তমাল।
শিমুল নুসাইবকে উদ্দেশ্য করে বললো,, কিছু মনে করবেন না আসলে তৃধা ভাবী। ভাবী বলে শিমুল চুপসে গেলো। কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে বললো,,তৃধা আপুকে দেখে নিজেকে আর আটকাতে পারলাম না। খোঁজ নিতে চলে এলাম।
তমাল বেশ হড়বড়িয়ে বললো,, সমস্যা নেই। ভাইয়া কিছু মনে করেনি। তাছাড়া ভাইয়া ভাবীকে সন্দেহ-টন্দেহ করে না। তমালের কথায় না বাঁধা দিলো,না ভাবাবেগ হলো। বরং নুসাইব শিমুলের দিকে তাকিয়ে আছে। শিমুল ভাই ভাবী শব্দ দুটো শুনে বেজায় খুশি হলো।দুর থেকে দেখে যা ভেবেছিল তা মিথ্যে নয়।
তমাল তাড়া দিয়ে বললো,, ভাইয়া তোমরা কথা বলো। আমি ওদের দেখে আসি। তমাল যেতেই শিমুল বলে উঠলো,, আমার ধারণা তাহলে ভুল নয়। বরং আপনিই তৃধা আপুর বর।
নুসাইব মাথা নেড়ে বললো,, হ্যাঁ আমি ওর হাসবেন্ড। কিন্তু আপনি কে?
শিমুল মৃধু হাসে। বললো,,
‘ আমি কে? প্রশ্নের উত্তর খানিকটা কঠিন।এই মুহূর্তে আমি কেউই না। কেউ না বলতে কেউই না, দূরসম্পর্কের আত্মীয়ও না। আগে হলে বলতাম কোনো এক আত্মীয়। অবশ্য তখন এই পরিস্থিতিও হতো না।
শিমুল স্পষ্ট করে না বললেও এতোটা নির্বোধ নুসাইব নয়। শিমুল তৃধার প্রাক্তনের কাছের আত্মীয় বুঝতে দেরী হলো না।
‘আমি কে সেটা জরুরি নয় ভাইয়া। বরং জরুরি তৃধা আপু। আমি আগ বাড়িয়ে কথা বলছি দেখে ওনার অযত্ন অবহেলা করবেন না। মেয়েটা কম অযত্নে ছিল না।
নুসাইব মুচকি হাসলো। অতঃপর বলে উঠলো,, তার অতীত নিয়ে তাকে কষ্ট দিবো, অবহেলা করবো এমন মানুষ আমি নই। বরং সে আমার কাছে আমার যত্নের ফুল।
নুসাইবের কথা শুনে শিমুল প্রশস্ত হেসে বলল,, আমার মনে হয় এইবার আপু সঠিক জায়গায় এসেছে। ওনার মত একটা মেয়ের জন্য হয়ত আপনার মত কেউ একজনের খুব দরকার ছিলো। যে যত্ন নিবে কদর করবে। অতীতে সবার যত্নে থাকলেও যার যত্ন নেওয়ার কথা বেশি ছিলো সে অযত্নে রেখেছিল বেশি।বিশ্বাস করবেন কিনা জানিনা তার চলে যাওয়ার পর বাড়ির কেউ ভালো নেই। তাকে ঘিরে থাকা মানুষ গুলো তার জন্য ভালো নেই। এতোটা মায়ায় মোড়ানো তিনি। এতোটা আপন করে নিয়েছে সবাইকে। আপনি তো জানেন তৃধা আপুদের অবস্থা কেমন। অবশ্য আমি দেখিনি সত্য তবে শুনেছি। উনি রাজকন্যা থেকে কম নয়। তবে কি বলুন তো, ভুল মানুষকে ভালোবেসে সবটা ছেড়ে ছুড়ে এমন একজনের কাছে গেছিলো যাকে তৃধা আপুর পরিবার লক্ষ্য কোটিবার কেনার ক্ষমতা রাখে। রাজ প্রাসাদ ছেড়ে ভালোবাসার জন্য ভাঙ্গাচুরা ঘরে গিয়ে উঠেছে। আফসোস সেই ঘরে যার সঙ্গে গেছিলো সেই সবচেয়ে বেশি আঘাত করে ছেড়েছে।
নুসাইব নিরব শ্রোতা হয়ে শুনছে সব। তার কিছুই বলার নেই। তৃধার জন্য খারাপ লাগছে তার।
শিমুল তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে পুনরায় বললো, এতো কিছু বলার প্রয়োজন ছিলো না। তাও বলছি কারন বলা উচিৎ।এই সমাজে ডিভোর্সী কিংবা তালাকপ্রাপ্ত মেয়েদের নিয়ে কুৎসা রটানো হয়।সে ক্ষেত্রে সবাইকে জানানো উচিৎ তৃধা মেয়েটা খারাপ নয়, বড় লোক বলে অহংকারীও নয়, সংসার ভেঙ্গে বেরিয়ে আসার মত মেয়েও নয়।বরং মানুষকে আপন করে নেওয়ার মত অসাধারণ এক ক্ষমতার অধিকারী। এই মেয়ের আত্মসম্মানবোধ অনেক। দু’বছরে সংসারে অভাবের সব রং দেখেছে। না কারো কাছে হাত পেতেছে, না ওই বেইমানকে কারো কাছে ছোট হতে দিয়েছে। তার চাহিদা বলতেই যত্ন, সম্মান আর ভালোবাসা ছিলো। ভালোবাসা আঁকড়ে ধরে কঠিন সময় পার করে দিবে তবুও ছেড়ে চলে যাবে না। আসলে ভাইয়া কিছু মেয়ে আছে যাদের টাকা পয়সার অভাব সহ্য হয় তবে ভালোবাসার অভাব একটুও সহ্য হয় না। তৃধা আপু সেই মেয়েদের কাতারে পড়ে।
শিমুলের কথা শুনার পর নুসাইব উত্তরে বলে উঠলো,, ধন্যবাদ তৃধা সম্পর্কে এতো কিছু জানানোর জন্য। তাকে আরো বেশি আগলে রাখার চেষ্টা করবো।
শিমুল মুচকি হেসে বলল,, ঠিক আছে তাহলে। এইবার বিদায়ের পালা। আশা করবো কখনো যেন আর দেখা না হয়। অতীত জিনিসটা কষ্ট ছাড়া কিছুই দেয় না। আমি চাই আমাদের আর দেখা না হোক।
নুসাইবের চেহারার আদল স্বাভাবিক থাকলেও ভেতরে ভেতরে ভীষণ অবাক হলো। আসলেই তৃধার শুভাকাঙ্খীর অভাব নেই। মেয়েটা তার মায়াজালে জড়িয়ে নেয় সবাইকে।
শিমুলের বাড়ানো হাতে হাত মেলালো নুসাইব। শিমুল মুচকি হেসে বলল,, তৃধা আপুর তিক্ত অতীতের মধ্যে আমিও একটা চরিত্র। তৃধা আপুর খুব আদরের ননদ রাজিয়ার বর আমি। কখনো দেখা হলে এড়িয়ে যাবেন। সুখে অতীতের ছায়া পড়তে নেই। আলবিদা ভাইয়া।
শিমুল চলে গেছে। পেছনে রেখে গেলো একজোড়া কৌতুহলী বিস্মিত চোখ।
_______
শপিংমলে একটা দোকানে দাঁড়িয়ে তৃধা। দোকান বললে ভুল হবে এইটা আস্ত একটা ভালোবাসা। যেখানে সারিবদ্ধভাবে সাজিয়ে রাখা গল্প, উপন্যাস। খেয়াল করে দেখলো এইখানে কোনো একাডেমীক বই নেই। সাহিত্যে সজ্জিত লাইব্রেরী।
নবনী ডাগর ডাগর চোখে তাকিয়ে দেখছে সব। একটা উপন্যাস হাতে নিয়ে দুটো পাতা মেলে ধরলো। তমাল দাঁত দিয়ে নখ কামড়াচ্ছে। তার মত হবু ডাক্তার নখ খাচ্ছে এইটা যদি কেউ জানতে পারে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। তাও সে কামড়াচ্ছে। টেনশনে নখ খেয়ে ডায়রিয়া করে ফেলবে। নবনীর হাতে উপন্যাস দেখে মাথায় টোকা মেরে বললো,
‘ তোর মত পড়াচোররা উপন্যাস পড়তে পারে না। পড়লেও ময়লা আবর্জনা ভরা ব্রেনে সাহিত্য সংবলিত কিছুই ডুকবে না।’
,নবনী রেগে তাকালো।
তৃধা পুরোনো বই খুঁজল। যদিও এই লাইব্রেরীতে সেটা পাওয়া মুশকিল। এইখানে সব নতুন বই। হাল ছেড়ে নতুন গুলোই দেখলো। অবশেষে শরৎচন্দ্রের “দেবদাস” উপন্যাসটা নিলো। এই উপন্যাস তৃধা পড়ে ফেলেছে। এখন আবারো নিলো। এইবার আর নিজের জন্য নয়। বরং নবীব শেখকে উপহার স্বরূপ দেওয়ার জন্যই নিয়েছে। তিনি বই প্রিয় মানুষ। ফরিদা হকের মতে এই লোককে বই সমেত জঙ্গলে ছেড়ে দিলেও অসুবিধা হবে না।
রঙিন কাগজে মোড়াচ্ছে দেখে তমালের চোখ জোড়া চকচক করে উঠলো। নবনী তৃধার পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বললো,, গিফ্ট?
,, ‘হ্যাঁ।’
তমাল ফট করে বলে উঠলো,’ অন্য কিছু নাও। ভাইয়া উপন্যাস কম পড়ে।’
তৃধা সরু চোখে তাকালো। নবনী মাথা নেড়ে বললো,, হ্যাঁ । আগে পড়তো এখন আর পড়ে না।
দুই ভাইবোনের কথা শুনে তৃধা বলল,, এইটা আংকেলের জন্যে। তাছাড়া আমার মনে হয় না তোমাদের বড় ভাইয়ার সাথে উপন্যাস শব্দটা যাবে।
এমন সময় পেছনে এসে দাঁড়ালো নুসাইব। তৃধার কথায় কপালে ভাঁজ পড়লো। মনে মনে নিজেই নিজেকে সুধায়,’ এতোটাই বেরসিক আমি?
তমাল নিরবে নুসাইবের হাত চেপে লাইব্রেরীর বাইরে এনে বললো,, এইখানে দাঁড়াও। তোমাকে দেখতে পেলে কথা বন্ধ হয়ে যাবে।
তমালের কথা ভুল নয়। কথা না বাড়িয়ে অপেক্ষায় রইল।
নবনী সহ বেরোয় তৃধা।নুসাইব ভারী গলায় বলল,, চলো কিছু খাওয়া যাক। অনেক্ষণ তো হলো। ক্ষিদে পেয়েছে নিশ্চয়ই?
নুসাইবের বলতে দেরী হলেও তমাল আর নবনীর মাথা নাড়াতে দেরি হয়নি। মাঝখানে তৃধা নিশ্চুপ।
বিকেলে এলেও শপিং মল থেকে সব রকম কাজ সেরে বেরোতে বেরোতে সন্ধ্যা পেরোয়। শীত ঋতু সন্ধ্যাও হয় তাড়াতাড়ি। ধরনীর বুকে রাত নেমে এলো। শপিংমলের ভেতর থাকাকালীন শীত অনুভব না হলেও বের হতেই টের পেলো শহর জুড়ে শীত নেমেছে। হাড় কাঁপানো শীতে দাঁতে দাঁত লেগে যাচ্ছে। তৃধার ঠোঁট জুগল কম্পায়মান। নবনী তৃধাকে জড়িয়ে ধরে বললো,, আপু আমি জমে যাচ্ছি।
তৃধা ফিসফিসিয়ে বললো,, আমারো একই অবস্থা। কি করি বলো তো?
‘ কোনো গতি নেই আপু। এখন কিছু বললে ভাইয়া মে*রে লা*শ ফেলে দিবে। বাড়িতে থেকে আসার সময় বেমালুম ভুলে গেছি আপু। এখন মনে হচ্ছে ম*রে বরফ হয়ে যাবো’
এইদিকে তমাল বিরক্ত ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে। নুসাইবের চিন্তিত মুখ। তমাল গলা ঝেড়ে বললো,, ভাইয়া মানুষ চার গাড়ি দুই। তুমি তৃধা আপুকে নিয়ে চলে যাও আমি জংলিটাকে নিয়ে যাচ্ছি।
নুসাইব বিরক্ত হয়ে বলল,, তুই আসলেই গুড ফর নাথিং।
তমাল ভ্রু কুঁচকে বললো,, এমন হলে তোমাকে তৃধা আপুর বর বলে পরিচয় দিতাম না। এইবার থেকে ভাই বলে পরিচয় দিবো।
দাঁড়ালো না তমাল গটগট করে হেঁটে চললো গাড়ির দিকে। নুসাইব ঠায় দাঁড়িয়ে রয়। ভাই শব্দ শুনতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। চোখ মুখ কুঁচকে বিড় বিড় করে বলে উঠলো,,কি? ভাই? ইম্পসিবল!
তমাল ড্রাইভারকে কল দিয়ে আসতে বললো। এইদিকে ঠান্ডায় দুই রমনীর ভালোবাসা বেড়ে গেছে। তমাল দুটোর অবস্থা দেখে নিজের গায়ের দিকে তাকালো। পরনে টিশার্ট আর ব্লেজার । ব্লেজার একজনকে দিলে অন্যজনকে তো আর টিশার্ট দেওয়া যাবে না। তাছাড়া ব্লেজার কাকে দিবে? তৃধা আপুকে নাকি এই জংলিকে?
নুসাইব দুইজনের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে রইলো। কেয়ারলেসেলনেস এর একটা সীমা আছে এই দুইটা মেয়ে সেই সীমা পেরিয়ে গেছে। নবনী ভীতু চোখে ভাইয়ের দিকে তাকালো।
তমাল দুজনকে ডেকে এনে গাড়িতে বসালো।
ড্রাইভিং সিটে নুসাইব তার পাশে তমাল। পেছনে তৃধা আর নবনী। নুসাইবকে কোট খুলে হাতে নিতে দেখে ,তমাল ফটাফট ব্লেজার খুলে নবনীর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,, তাড়াতাড়ি পরে নে। তা না হলে একটু পর লা*শ নিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে। নুসাইব কোটটা তৃধার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,, এইটা পরে নাও। ঠান্ডা কম লাগবে।
নুসাইবের এহেন কাজে চমকায় তৃধা। প্রথমে শাল এখন কোট, লজ্জা, অস্বস্তি দুটোই হচ্ছে ভীষণ। নবনী তমাল দুটো ঘটনা সম্পর্কে অবগত দেখে লজ্জায় মিশে যাওয়ার জোগাড় হচ্ছে। নবনী মুচকি হেসে ভাইয়ের হাত থেকে কোট নিয়ে তৃধাকে জড়িয়ে দিতে দিতে বললো,, আরে তাড়াতাড়ি পরে নাও। তা না হলে শপিং করা জিনিস গুলো আর পরা হয়ে উঠবে না। তার আগেই দুজন ক*বরবাসি হয়ে যাবো।
তমাল মাথা নেড়ে বললো, হ্যাঁ তাড়াতাড়ি করো।
_____
রাত প্রায় এগারোটা। ফরিদা হক তৃধার দেওয়া শাড়িখানা নেড়েচেড়ে দেখছে। নবনী কালো রঙের শাড়িটা গায়ের উপর রেখে বললো,, দেখতো আম্মু সুন্দর লাগছে না?
ফরিদা হক কলাপাতা রঙের শাড়িটা ধরে বললো,, হুম খুব সুন্দর। তমাল শার্ট গায়ের উপর রেখে বললো,, মেজারমেন্ট নিলে কখন?
তৃধা মুচকি হেসে বলল,, সেল্সম্যান বললো। পছন্দ হয়েছে?
‘অবশ্যই। এইটা পরে ডেটে যাবো।’
নাবীব শেখ বই থেকে চোখ উঠিয়ে বলল,, এইটা এইজন্মের জন্য তোলা রাখো।
ফরিদা হক, নবনী আর তৃধা মুখ টিপে হাসছে। তমাল বিরক্ত হয়ে বলল,,কত মেয়ে আমার জন্য পাগল হয়ে পিছু পিছু ঘুরছে জানো বাবা?
‘আলবৎ জানি। পাগল বলেই ওরা তোমার পেছন পেছন ঘুরছে।
বাপ ছেলের ঝগড়ার ফাঁকে ফরিদা হক তৃধার হাতের দিকে তাকিয়ে বলল,, নুসাইবের জন্য?
তৃধা মাথা নেড়ে বললো,, হুম!
ফরিদা হক মৃধু হেসে বলল,, ফাইল পত্রের মধ্যে ডুবে আছে ।এখন আর নিচে নামবে না। তুমি গিয়ে দিয়ে আসো।
নবনী আর তমাল কৌতুহলী চোখে ব্যাগটা দেখছে। ভেতরে কি আছে সেটা দেখার কৌতুহল দমিয়ে রাখা দায়। তাও দুজন চুপচাপ বসে আছে।
নাবীব শেখ বইয়ের মলাট ছুঁয়ে বললো,, আমি স্টাডি রুমে যাচ্ছি। কেউ বিরক্ত করবে না।
তিনি যাওয়ার আগে তৃধার মাথায় হাত বুলিয়ে গেলেন।
একপা দু’পা করে নুসাইবের রুমের সামনে এসে দাঁড়ালো তৃধা। এই নিয়ে দ্বিতীয়বার রুমটাতে ঢুকবে। দরজায় কড়া নাড়তে গিয়ে দুবার পিছিয়ে তৃতীয়বারে কড়া নাড়লো।
ফাইল গুলো দেখতে দেখতে বিরক্ত হয়ে উঠে পড়লো। কাঁচের দরজা ঠেলে বারান্দায় দাঁড়িয়েছে সবে। এমন সময় দরজায় কড়া নাড়লো কেউ। এইসময়টাতে ফরিদা হক বাদে কেউ রুমে আসে না। নুসাইব বলে উঠলো,, দরজা খোলা আছে। ভেতরে আসো।
তৃধা চমকায়, অদ্ভুত লাগছে তার।ভেতরে থাকা মানুষটা কি করে জানলো বাইরে সে দাঁড়িয়ে? চোখ বুলিয়ে দরজার চারপাশ দেখে নিলো। নাহ্ কোনো ক্যামেরা নেই। তাহলে? সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো। আজো রুমটা গুছানো। বিছানা টান টান করা,বালিশ গুলো তাদের জায়গায় সজ্জিত। কাঁচের টেবিলে ফাইল গুলো সারিবদ্ধভাবে গুছিয়ে রাখা। তবে গুছিয়ে রাখা ঘরটায় ঘরের মালিক নেই। তৃধা ওয়ারুমের দিকে যেতেই নুসাইব বলল,, বারান্দায় এসো।আমি এইখানে।
চলবে,,
উপন্যাসের নাম::#আমি_আছি
লেখনিতে:#সাদিয়া_আফরোজ
পর্ব: ২১
দরজা খোলার শব্দ। এর পরের নিরবতা জানান দেয় কক্ষে প্রবেশ করা মানুষটা আর যেই হোক, সেটা মা নয়। নুসাইব ঘুরে তাকালো। কাচ ভেদ করে তৃধাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। নিঃশব্দে পদচারণ করে রুমটা খুঁতিয়ে দেখছে সে। কৌতুহলী চোখ, ঠোঁট জোড়া ঈষৎ ফাঁক। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই চক্ষুদয় চঞ্চল হলো। রুমের মালিকের খোঁজ চলছে। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে তৃধার গতিবিধি লক্ষ্য করে হাসলো। পছন্দনীয় রমনীর কৌতুহল দেখতেও ভালো লাগে।
কাজের চাপ বিরক্ত ভাব সবটা মূহুর্তে মিলিয়ে গেলো। আপাতত সর্বাগ্রে ইচ্ছে জাগলো কাঁচের দেয়ালের অপর প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা রমনীর সাথে কিছু সময় কাটানোর। ভাবতে ভাবতে মাথা চুলকে মুচকি হাসলো। অতঃপর ডেকে উঠলো,” বারান্দায় এসো। আমি এখানে।
হিম শীতল করা আবহাওয়া বাইরে। চারপাশে নিস্তব্ধতা ছেয়ে আছে। নুসাইব নিরবে তৃধার পাশে দাঁড়িয়ে। বাইরের ঠান্ডা আবহাওয়ার সাথে মানিয়ে নিতে দুমিনিট সময় লাগলো তৃধার। তাড়া নেই নুসাইবের। সময়টা ভালোই লাগছে তার। ইচ্ছে করছে এইভাবেই সময়ের চাকা থামিয়ে দিতে। আড় চোখে তৃধার ফেকাশে চেহারার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলে উঠলো,, থেমে যাক সময় ,থেমে যাক সব। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রমনী এই ভাবেই পাশে থাক। তাকে দেখার তৃষ্ণা মিটে না যাওয়া ওবদি দাঁড়িয়ে থাক।
নুসাইবের এমন অবান্তর ইচ্ছের কথা তৃধার শোনা হলো না। সে শাল সোয়েটার পরেও থেকে থেকে কাঁপছে। অবশেষে হাতে থাকা শপিং ব্যাগ নুসাইবের সামনে তুলে ধরে বললো,, “এইটা আপনার জন্য। আপনার পছন্দ সম্পর্কে জানা নেই। হয়তো পছন্দ নাও হতে পারে।”
আবছা আলো আঁধারের খেলায় তৃধার চেহারায় পূর্ন নজর দিলো। মেয়েটা তার দিকে তাকিয়ে আছে। হাত বাড়িয়ে ব্যাগটা নেওয়ার অপেক্ষা করছে হয়তো। দেরি করলো না। খুব যত্নে ব্যাগটা হাতে নিয়ে বলল,, “এইটা?”
,” উপহার।”
,” তখন এইগুলো কিনেছিলে?”
,”হ্যাঁ! এইজন্য বিল দিতে মানা করেছিলাম। আপনি দিলে উপহার হতো কি করে?”
নুসাইব মুচকি হেসে প্যাকেটা নেড়ে চেড়ে বলল,”
কি আছে এতে?”
,”খুলে দেখুন। না থাক! আমি যাওয়ার পর দেখলে হবে।”
,”ঠিক আছে। এখন দেখবো না। উপহার জিনিসটা রয়ে সয়ে দেখতে হয়।”
তৃধা শব্দ করে নিঃশ্বাস ফেলল। না জানি পছন্দ হয় কিনা। অপছন্দ হলে তার খারাপ লাগবে। তাই বললো পরে খুলতে।
নুসাইব ব্যাগটা শক্ত করে চেপে ধরে বললো,, টাকা গুলো খরচ না করলেও পারতে। রেখে দিতে প্রয়োজন হলে খরচ করতে।
তৃধা বারান্দার রেলিংএ হাত রেখে বলল,, এই বাড়িতে আসার পর কিছুর প্রয়োজন হচ্ছে না। প্রয়োজন হতে দিচ্ছে না। আন্টি এক একটা জিনিসের খেয়াল রাখছে। নবনী তো আছেই। টাকা সংবলিত প্রয়োজন হবে না। তাছাড়া টাকা গুলো রাখাও ঠিক হবে না। ভালো মানুষদের দেওয়া টাকা, অচিরেই থেকে যাবে। ভাবলাম ভালো মানুষের টাকা ভালো মানুষদের জন্য খরচ হোক।
,”তৃধা!”
নুসাইবের ডাক শুনে তৃধা বাইরের দিকে তাকালো । ডাকে সাড়া দিলো না। নুসাইবের না বলা প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে কয়েক ক্রোশ দূরে জ্বলতে থাকা টিমটিমে আলোয় চোখ রেখে বলল,,সেই বাড়ি থেকে আসার সময় তার জেঠাতো ভাই দুজন মিলে পথ আটকে দাঁড়ায়। তারা কিছুতেই যেতে দেবে না আমায়। দিতোই বা কি করে? দু’বছর ধরে যাকে ছোট বোনের মত স্নেহ করেছে তাকে কেউ এমনি এমনি যেতে দেয়? তাও ঘরদোর হীন হয়ে। আমি থাকতে চাইলাম না। থাকা যায় না। সেখানে থাকা সাজেও না। তালাক হওয়া মেয়েদের প্রাক্তনের বাড়িতে থাকা শোভা পায় না। তাছাড়া আমি ফেরেস্তা কুলের মধ্যে পড়ি না। আমি মানুষ আমার কষ্ট হবে , কষ্ট হয়। নতুন বউ নিয়ে নতুন সংসার। দুষ্টু মিষ্টি আলাপচারিতা, ভালোবাসা মাখা মূহুর্ত। সাজানো গোছানো সংসার ভেঙ্গে আবারো গোছানোর ব্যাপারটা মেনে নিতে পারবো না। যেখানে থাকার কথা সেখানে না থেকে দূর থেকে কাউকে নিজের জায়গায় দেখতেও কলিজা লাগে। আমার এতো বড় কলিজা ছিলোনা। সিদ্ধান্তে অটল হয়ে এক কাপড়ে বেরিয়েছিলাম তখন। একা ছাড়বেনা বলে দুজন সঙ্গ নেয় । দুজন মিলে বাড়ি দিয়ে আসবে বললো। আমি বাধসেধে বুঝাই একা যেতে পারবো। তারা মেনে নিলো। দু’জনের সংসার খরচের টাকা আমার হাতে ধরিয়ে দেয়। নিতে মানা করায় বললো,” ভাই কিছু দিলে নিতে হয়।”
তৃধা লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে আবারো বলল,, খেয়াল করে দেখবেন সুখের মূহুর্তে পাশে থাকা মানুষগুলোর কথা মনে থাকবে কম। যারা দুঃখের মূহুর্তে পাশে থাকে তাদের কথা সারাজীবন মনে থাকে। তারা আমার দুঃখের মূহুর্তের আপন জন। সেই আপন জনের টাকা দিয়ে গ্ৰাম ছেড়ে শহরে এসেছি। এই টাকা গুলো দিয়ে আপনাদের কিছু দিতে পেরে শান্তি লাগছে।
নুসাইব চোখের পলক ফেলতে ভুলে গেছে, নাকি নিজ থেকেই ফেলেনি ব্যাপারটা বুঝতে পারছে না। তবে মনে হলো তৃধাকে উপলব্ধি করতে পারছে। তৃধার কথার গভীরতা তাকে ছুঁয়ে দিচ্ছে।
,”বাকি প্রশ্ন গুলো করে ফেলুন। আমি উত্তর দিতে প্রস্তুত। তাছাড়া আমি জানি এমন হুটহাট করে আমার অতীত আমার সামনে এসে পড়বে। তখনো প্রশ্ন থাকবে।প্রশ্ন করা উচিৎ, জানার আগ্ৰহ থাকা উচিত। আপনার জায়গায় আমি হলে এতক্ষনে জিজ্ঞেস করে ফেলতাম।
তৃধার কথায় টনক নড়লো।পর পর পলক ফেলে বাইরে তাকালো। এমন প্রশ্ন করার কথা চিন্তাও করেনি। যে প্রশ্ন করার কথা ছিলো তা করা হয়ে ওঠেনি। তাও মেয়েটা মন গড়া কথা বলে ফেললো। অবশ্য বলা স্বাভাবিক। এই জায়গায় অন্য কেউ হলে হয়তো সেই প্রশ্ন গুলোই করতো।নুসাইবের এইসব জানার আগ্ৰহ নেই।
নুসাইবের মৌনতা দেখে তৃধা মৃদু হেসে বলল,” অবাক হচ্ছেন? হওয়ার কথা। ভাবছেন আমি বুঝলাম কি করে? আসলে কি বলুন তো! ঘটনা এমন যে প্রশ্ন করা স্বাভাবিক। নির্দ্বিধায় বলতে পারেন।
,”কেন ভালোবাসলে সেই লোকটাকে?”
নুসাইবের এহেন প্রশ্নে থম ধরে গেলো তৃধা। লোকটা এমন প্রশ্ন করবে কল্পনাতেও ছিলো না। ভেবেছিলো শিমুলকে নিয়ে জানতে চাইবে। তৃধা তব্দা খেয়ে তাকিয়ে রয়।
,”অতীতে কি হয়েছিলো, কেন হয়েছিলো, কার কেমন ব্যাবহার ছিলো, আজকের দেখা হওয়া মানুষটা কে? সামনে যদি দেখা হয় তারা কে হবে? এমন সব প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার ইচ্ছে নেই তৃধা। আমার সকল কৌতুহল ভালোবাসা নিয়ে। তাকে কেন ভালোবাসলে?
নুসাইবের কথা শুনে বিস্মিত হলেও উত্তর খোঁজার চেষ্টা চালালো। তৃধার চোখ জোড়া দিকবিদিক উত্তর খুঁজে চলেছে। “কেন” এর উত্তর নেই। রজবকে কেন ভালোবেসেছিলো জানে না। তবে ভালোবেসেছিলো। ভালোবাসার কারন নেই।
নুসাইব তার দিকে তাকিয়ে। কিছু প্রশ্নের উত্তর হয় না। এই যে এখন তৃধাকে যে প্রশ্ন করে ফাঁসালো এই প্রশ্নেরো উত্তর হয় না। ভালোবাসার ক্ষেত্রে “কেন” শব্দটা বড্ডো বেশি অকেজো।
নিরবতা ভেঙ্গে তৃধা বলল,” ভালোবাসতে কারণ লাগে না। ভালোবাসা ভালোবাসাই হয়। তাকে ভালোবাসার কোনো কারন ছিলো না।
তৃধার কাছ থেকে এমন উত্তরই আশা করেছিলো নুসাইব। উত্তর শুনে বললো,, বুঝলাম।
তৃধা মৃদু হেসে পুনরায় বলল,, উঁহু!আপনি বুঝবেন না। শুনলাম আপনার জিবনে বসন্ত আসেই নি।
তৃধার কথায় চমকে তাকালো” কে বললো এমন কথা? নিশ্চয়ই আম্মু বলেছে?”
তৃধা আলগোছে কানের পেছনে চুল গুঁজে চাপা হেসে বললো,, আপনি ছাড়া সবাই বলেছে। আপনার জিবনে প্রেম ভালোবাসা ছিলো না,নেই আর হবেও না।
নুসাইব চাপা হাসলো। ‘নেই আর হবেও না’ কথাটা সত্য নয়। বরং নুসাইব পাশে দাঁড়ানো রমনীর প্রেমে পড়েছে। সেই প্রেমে দিশেহারা প্রায়। এই ব্যাকুল মন প্রেমিক হতে চায়। সাক্ষাৎ কলেজে পড়ুয়া পাগল প্রেমিক। যার চক্ষু যুগল সর্বাক্ষন প্রনয়ীনির খোঁজে ব্যাস্ত। হাতে হাত ধরে নির্লজ্জের মত হাঁটতে চায়। কারনে অকারণে রেগে, রাগাতে চায়। রাগ ভাঙাতে আদুরে আবদার পূরণ করতে চায়। আঠারো বছর বয়সী প্রেমিক হতে চায়।
তৃধা গ্রীল থেকে হাত সরিয়ে নিলো। ঠান্ডা হাতজোড়া নিজ গালে ছুঁইয়ে দিতে দিতে বলল,,”ভালোবাসা এক অনিন্দ্য সুন্দর অনুভূতি।
যে অনুভব করেনি তার জিবনের আটআনা-ই বৃথা।
তৃধার কথায় ঠোঁট এলিয়ে হাসলো নুসাইব। অতঃপর বিড়বিড় করে বলে উঠলো,, ভাগ্যিস তুমি এলে,তা না হলে আমার জিবনেরও আটআনা বৃথা হয়ে যেত।
নুসাইবের কথা অস্পষ্ট শোনালো।
,” কিছু বললেন?”
নুসাইব মাথা নেড়ে বললো,” আটআনা বৃথা জিবনের কথা ভাবছি।”
,”আপনি ভাবুন আমি চলি। আর হ্যাঁ! যাওয়ার আগে বলে যাই,, এখনো সময় আছে । তমাল ভাই থেকে পেছনে পড়ার আগে প্রেমে পড়ুন। তা না হলে আংকেল আপনাকে ‘গুড ফর নাথিং’ বলবে। তাও একদম আপনার মত করে।”
তৃধার খিল্লি উড়ানো দেখে চোখ ছোট ছোট করে তাকালো। তৃধা মাথা নেড়ে শুভ রাত্রি বলে ছুটলো। এক ছুটে দরজা পেরিয়ে গেছে। চঞ্চল তৃধাকে দেখে কিছুটা অবাক হলো। চঞ্চল তৃধার দেখা পাওয়া মুশকিল। নুসাইব জানে মেয়েটা ভীষন গম্ভীর প্রকৃতির আর শান্ত স্বভাবের।
______________
চশমা ঠেলে বিরক্ত চোখে তাকালো সমুদ্র। সকাল থেকেই তার সাথে অদ্ভুত ঘটনা ঘটছে। দুই তিন দফা করে চার জোড়া মহিলা তাকে দেখে গেছে। এখন মুখের সামনে গুনে গুনে সাতটা ছবি ধরে রেখেছে তার মা শেফালী বেগম । তিনি আজ একটা না একটা ফয়সালা করেই ছাড়বে।
মহিলা গুলো আসার কারণ এখন স্পষ্ট হলো। বিরক্ত হলেও সমুদ্র ছবি গুলো একবার দেখে নিলো। মেয়ে গুলোর বয়স কম। দেখে নাইন টেনে পড়ুয়া মনে হচ্ছে। এতো অল্প বয়সী মেয়ে বিয়ে করা তার শোভা পায় না।
ব্যাপারটা বলতেই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো শেফালী বেগম। রেগে চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,
,”তোর জন্য বুড়ি আনবো কোথা থেকে?”
কিবরিয়া সাহেব বউয়ের রাগ দেখে ছেলের দিকে তাকালেন। এই যাত্রায় ছেলেকে আর বাঁ*চাতে পারবেন না ভেবেই আক্ষেপ করে নিউজ চ্যানেল দেখতে লাগলেন।
সমুদ্র ভীষণ শান্ত স্বভাবের। তবে এই মুহূর্তে তার মত শান্ত বোধহয় আর কেউ নেই এই দুনিয়াতে। সে সেই স্বভাবের বদৌলতে মায়ের কথা উপেক্ষা করে বললো,, এতো তাড়া কিসের মা। মেয়ে আমার পছন্দ করা আছে। একটু ধৈর্য ধরো।
শেফালী বেগম বিশ্বাস করলেন না। তিনি কিবরিয়া সাহেবের কাছ থেকে রিমোট কেড়ে নিয়ে টিভি বন্ধ করে বাজখাঁই গলায় বলল,, দেখেছো তুমি? কিছু বলবে এই ছেলেকে? শিক্ষক হয়ে মিথ্যা কথা বলছে। তাও মায়ের সাথে!
সমুদ্র মোবাইল বের করলো। লকস্ক্রিনে হাস্যোজ্জ্বল এক মেয়ের ছবি। মেয়েটা থুতনিতে হাত রেখে ভাবুক হয়ে হাসছে। সমুদ্র সেই ছবিতে আলতো করে হাত ছুঁইয়ে বললো,, বিশ্বাস না হলে দেখো।
চলবে,,,
উপন্যাসের নাম::#আমি_আছি
লেখনিতে:#সাদিয়া_আফরোজ
পর্ব: ২২
,
,
,
,
,
শেফালী বেগম ছবিখানা খুঁটিয়ে দেখছে।
কিবরিয়া সাহেব গম্ভীর মুখে নিজের স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আছেন।মেয়ে মানুষ যে কেন এতো কৌতহলী হয় তিনি আজও বুঝলেন না। তাদের সব ব্যাপারে কৌতুহল। মাছের পেটের ডিমের মত তুচ্ছ বিষয় থেকে শুরু করে চাঁদের বুড়ির চরকা কাটা নিয়েও পর্যন্ত কৌতুহল।
মায়ের ভাব ভঙ্গি দেখে সমুদ্র মাকে উদ্দেশ্য করে বলল,, পছন্দ হয়েছে?
শেফালী বেগম ছবিটা দেখতে দেখতে বললো,, একটা ছবি দেখে কি আর পছন্দ হয়?হতে পারে আমাকে দেখানোর জন্য ফেসবুক থেকে নিয়েছিস? তোর গেরান্টি নেই। যতই প্রভাষক টভাষক হোস না কেন আমার কাছে তো আমার ছেলে-ই। তোকে আমি হাড়ে হাড়ে চিনি সমুদ্র।
সমুদ্র চশমা খুলে চোখ কচলে পুনরায় পরলো। বাবার দিকে তাকিয়ে হতাশা ভরা নিঃশ্বাস ফেলে বললো,, সত্যি মা। ওর নাম নবনী শেখ।
শেফালী বেগম ছেলের চেহারা পরখ করে বলেন,,তোর স্টুডেন্ট নাকি ?
,”হ্যাঁ”
,”হঠাৎ স্টুডেন্ট? কি দেখে ভালো লাগলো?
কিবরিয়া সাহেবের ধৈর্য্যের বাঁধ ভাংলো। তিনি চরম পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে বলল,, শেফা কি হচ্ছে ? তুমি ওর মা হও। প্রশ্ন সেই ভাবে করো। তাছাড়া তোমার ছেলে ছোট নয়। ওর ব্যাপার ওকে বুঝতে দাও। অস্বস্তি বোধ করার মত প্রশ্ন করছো কেন ছেলেকে?
কিবরিয়া সাহেবের কথা আমলে নিলেন না শেফালী বেগম। তিনি বিরক্ত হয়ে বলল,, তোর বাপের কথায় কান দিস না। মেয়েটাকে দেখে আসা উচিৎ । হাতে সময় আছে,চল এক্ষুনি রিং টিং পরিয়ে দিয়ে আসি।
সমুদ্র মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে বলল,, এখন না। যখন সময় হবে আমি জানাবো। আপাতত ওসব ঝামেলা থাক।
কিবরিয়া সাহেব রিমোট নিয়ে পুনরায় টিভি দেখতে লাগলেন। যেখানে মহা মানবগন তাদের স্ত্রীর সামনে তুচ্ছ। সেখানে কিবরিয়া সাহেব তো অতি সাধারণ মানুষ। তিনি ঠিক করেছেন এই ব্যাপারে আর কথা বলবেন না। পৃথিবীর সকল মা ছেলের মধ্যে বাবা হচ্ছে থার্ড পারসন। এই মুহূর্তে কিবরিয়া সাহেব থার্ড পারসন।
সমুদ্রের কথায় শেফালী বেগম কিছুটা স্বস্তি অনুভব করলেও সন্দেহের রেশ কাটেনি। তিনি জানেন ছেলে যতই চশমা পরুক না কেন! চশমার আড়ালে এখনো শান্ত চোখের দুষ্টু সমুদ্রই আছে।যার দুষ্টুমি রেকর্ড করা।
সমুদ্র মোবাইল নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। আর কিছুক্ষণ ঘরে থাকলে হাজার প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। আপাতত ঘরের বাইরে থাকাই সেইফ।
আজ সূর্য দেখা যাচ্ছে না। বাইরের পরিবেশ গুমোট। সমুদ্র মোবাইলে সময় দেখতে গিয়ে থামলো। বরাবরের মত চোখ দুটো নবনীর ভাবুক হাস্যোজ্জ্বল চেহারায় গিয়ে স্থির হলো। সেই ছবিটার দিকে গভীর চোখে তাকালো। মনে মনে বার কয়েক নবনী নামটা আওড়াতে লাগলো। নবনী তার জিবনের প্রথম প্রেম নয়, বরং নবনী দ্বিতীয়। সমুদ্র যখন প্রথম প্রেমে পড়ে তখন তার বয়স কেবল একুশ। একুশ বছরে যার প্রেমে পড়েছিলো বয়স বাইশ হতেই তাকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়েছিল। হয়তো এখন সে পূর্ণ সংসারী হয়ে উঠেছে। সমুদ্র জানে না।কখনো খবর নেয়নি।খবর নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি। ভালোবাসার মানুষকে সুখে থাকতে দেখে খুশি হওয়ার মত মহান সমুদ্র ছিলোনা ।সমুদ্র মনে মনে তাকে দুঃখী দেখতো।কান্নারত দেখতো, সমুদ্রের নামে দুফোঁটা নোনা জল ফেলতে দেখতো। এতেই সমুদ্রের সুখ, তার জন্য সে কষ্ট পাচ্ছে,তার জন্য সে ভালো নেই। তার মানে সেও সমুদ্রকে ভালোবেসেছে। ঠিক যেমনটা সমুদ্র বেসেছিলো। পুরোনো কথা ভেবে হাসলো সমুদ্র। কতোটা নাদান ছিল,কতোটা অবুঝ ছিলো সে।
নবনী তার জিবনে আসা দ্বিতীয় নারী। কথাটা শুনতে তিক্ত লাগলেও মিথ্যা নয়। যদিও প্রথম নারীর অস্তিত্ব বিলীন হয়েছে হেই কবেই। তবুও নবনী দ্বিতীয়,যাকে সমুদ্র সময় নিয়ে ভালোবেসেছে,বাসছে,ভবিষ্যতেও বাসবে।
একটা বয়সের পর পুরুষের আর প্রথম দেখায় ভালোবাসা হয় না। সেই বয়সে দেখে শুনে ভালোবাসা হয়। বিয়ে, সন্তান থেকে শুরু করে চামড়া কুঁচকে হাতে লাঠি ভর করে হাঁটা পর্যন্তের সময় কল্পনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। দীর্ঘ পথচলার কল্পনা করতে গিয়ে বাঁধা পড়ে পুরুষ। হ্যাঁ! এই নারীই সেই নারী যার সাথে অনন্তকাল থাকা যাবে। এই সেই নারী যার সাথে একান্ত ব্যক্তিগত মুহূর্ত পার করা যাবে। এই সেই নারী যাকে ঘীরে অজস্র সময় পার হবে। যাকে ঘিরে অজস্র অনুভূতি,মায়া জন্ম নিবে। এই সেই নারী যার উদরে লালিত হবে ছোট অস্তিত্ব। সমুদ্রের জিবনে সেই নারী নবনী। যাকে প্রথম দেখায় ভালোবাসেনি। বরং অল্প অল্প করে ভালোবেসেছে। নবনী সমেত গোটা একটা জিবন কল্পনা করে ভালোবেসেছে। নবনী তার জিবনে দ্বিতীয় হলেও নবনী ছাড়া কল্পনা করা দুস্কর, নবনীই শেষ নারী। এরপর জিবন নিয়ে আর ভাবা হয় না। নবনী নেই যেখানে সেখানে সমুদ্রও নেই। অথচ নবনীর সাথে দেখা হওয়া থেকে শুরু করে ভালোবাসা পর্যন্ত সময়ে কোনো প্রকার নাটকিয়তা ছিলো না। ছিল অদ্ভুত সব এক্সপেরিয়েন্স। সেই অদ্ভুত সময় গুলোর কথা ভাবতেই হাসলো সমুদ্র। ভাবতে থাকলো প্রথম থেকে।
প্রথম দেখার জের ধরেই চেনা তাকে। এরপর যখন দ্বিতীয়বার দেখা হয় তখন ভার্সিটিতে নেওয়া নবনীদের প্রথম ক্লাস ছিলো। বাকি সবার মত নবনীও বেশ উচ্ছ্বসিত। সে তার আশেপাশে বসা মেয়ে গুলোর সাথে সখ্যতা করতে ব্যাস্ত। এতো এতো মেয়ের মধ্যে নবনীকে চোখে পড়ার কথা নয়। তাও সমুদ্রের চোখে পড়লো। নবনীর সাথে সমুদ্রের তখন দ্বিতীয় দেখা। সেইদিনের ক্লাসে পাঠ্যপুস্তক সংবলিত কোনো পড়া ছিলো না। ভার্সিটি লাইফ নিয়ে সমুদ্র সবাইকে বিভিন্ন রকমের মোটিভেশনাল লেকচার দিয়েছিল।
সবাই বেশ আগ্ৰহ নিয়ে শুনছিলো , কেউ কেউ প্রশ্ন করেছিলো। সমুদ্র খেয়াল করে দেখলো পুরো ক্লাস জুড়ে নবনী একমাত্র মেয়ে ছিলো যে ঘুমে টালমাটাল হয়ে ছিলো। কিছু সময় আগেও ঠিক ছিলো হঠাৎ করে এতো ঘুম কোথা থেকে এলো জানা নেই। টেনে চোখ খুলে তাকাচ্ছে ,আবার কখনো কখনো মাথা নুইয়ে ঘুমোচ্ছে। সমুদ্রের তাকানো দেখে পাশের মেয়ে গুলো নবনীকে ঝাঁকিয়ে তুলেছিল।
এরপর থেকে যখনই ক্লাস নিতো তখনই নবনীকে দেখতো। প্রতি ক্লাসে নবনীর একই অবস্থা হতো। তার ঘুম পেতো। নবনীর প্রতি কোনো আকর্ষণ ছিল না। মেয়েটা চঞ্চল,অদ্ভুত প্রকৃতির হওয়াতে কৌতুহল নিয়ে দেখতো। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে মেয়েটা কিভাবে চান্স পেলো সেটা জানার কৌতুহল।
হুট করে একদিন নবনী থেকে পড়া জিজ্ঞেস করে বসলো। খুব সহজ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলো না নবনী। সমুদ্রের মেজাজ খারাপ হয়। গম্ভীর গলায় বলে দিলো,, নেক্সট ক্লাসে ঘুমালে সোজা বাইরে বের করে দিবো।
সমুদ্রের এমন কথায় লজ্জা পেলো নবনী। চোখ মুখ লাল হয়ে উঠেছিল নবনীর। সমুদ্র সেই দিকে নজর দিলো না তেমন।
পরদিন নবনীকে নতুন ভাবে দেখলো। চশমা পরে বেশ মনোযোগী ভেসে বসে আছে। যেন সব গুলো টপিক বুঝে একাকার। সমুদ্রের মায়া হলো। হয়তো চশমা আনতে ভুলে গেছে দেখে এমন অমনোযোগী ছিলো! চশমা পরা মানুষের কষ্ট বুঝে সমুদ্র। সে নিজেও চশমার উপর নির্ভরশীল। চশমা পরা মানুষ চশমা ছাড়া শুধু যে পরিস্কার দেখে না এমন নয়, বরং কানেও শুনে কম। কথাটা অবান্তর শোনালেও মিথ্যা নয়।
এর ঠিক দু’দিন পর নবনীর সাথে ধাক্কা লাগে সমুদ্রের। নবনী দুই সিঁড়ি উপর থেকে পড়ে। নবনী দৌড়ে আসাতে টাল সামলাতে পারেনি, হুমড়ি খেয়ে সোজা ফ্লোরে।তাছাড়া সমুদ্রও ধরার চেষ্টা করেনি। সে নিজেও পড়তে পড়তে বেঁচে গেছিলো,কি করে ধরবে তাকে?
সেইদিন নবনীর চোখে চশমা নেই। বেচারি খুঁড়িয়ে হাঁটছে। সমুদ্র নিরেট স্বরে প্রশ্ন করলো,, বেশি ব্যাথা পেয়েছো? ডাক্তারের কাছে যাবে?
নবনী মাথা দোলায়। তেমন ব্যাথ্যা পয়নি। ডাক্তার প্রয়োজন নেই।
,”চশমা কই তোমার? চশমা ছাড়া না দেখলে চশমা পরতে হয় জানো না?
নবনী চোখ তুলে তাকালো না। মেঝেতে নজর ফেলে পায়ে হাত ঘসতে ঘসতে রিনরিনে গলায় বললো,, আমি চাশমা ছাড়াও দেখি স্যার। আনফরচুনেটলি চোখ একদম ঠিকঠাক।
সমুদ্র অবাক হয়েছিল “আনফরচুনেটলি” শুনে। ভাগ্যবসতো চোখ খারাপ হোক সেটা কেউ চাইবে না। কিন্তু নবনী চাইছে। সমুদ্র পুনরায় প্রশ্ন করে,, তাহলে ক্লাসে চশমা পরেছিলে কেন?
নবনী চোরা চোখে তাকিয়ে বললো,, আপনি প্রশ্ন করেন বেশি এই জন্য। চশমা পরা দেখলে তো ব্রিলিয়ান্ট ভেবে প্রশ্ন করবেন না তাই চশমা পরি।
নবনীর সোজাসাপ্টা উত্তর শুনে নবনীকে পাগল মনে হলেও কথায় যুক্তি আছে। চশমাধারি লোক জ্ঞানী হয়,কথাটা অনেকেই সত্যি মনে করে। সমুদ্র গম্ভীর গলায় বললো,, আর চশমা পরবে না। তা না হলে পুরো ক্লাস রেখে তোমাকে প্রশ্ন করবো।
এরপর থেকে নবনীকে আরেকটু বেশি চোখে লাগে সমুদ্রের। ক্লাস চলাকালে নবনীকে দেখা, নবনী অনুপস্থিত থাকলে নিভৃতে খোঁজ করা। ধীরে ধীরে নবনীকে নিয়ে ভাবা। এতো এতো ছাত্র ছাত্রীদের ভীড়ে একজনকে চোখে হারানোর অর্থটা না বুঝার মত অবুঝ সমুদ্র নয়। এর মাঝে কেটে গেলো ছয়টা মাস। ছয় মাসে সমুদ্র নবনীর ঘুমের কারন ধরে ফেলল। কিছু কিছু ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট আছে যাদের কাছে পুরো বই পানির মত মনে হলেও তারা আটকে যায় থিউরিতে। তাদের কাছে গানিতিক বিষয় থেকে থিউরিটা বেশি কঠিন মনে হয়। নবনী সেই রকম ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্টদের দলে। থিউরির প্রতি তার অগাধ অনিহা দেখেই ঘুমিয়ে পড়ে। সমস্যা সমাধানের চেষ্টা বৃথা যাওয়ার পর,নবনীর ঘুমিয়ে পড়ার ব্যাপারটা নজরান্দাজ করেছে বারবার। সেই ছয়মাসে আরেকটা জিনিস লক্ষ্য করেছে। নবনী তাকে দেখলেই নজর ঘুরিয়ে নেয়, চোখে চোখ পড়লেই ফিরিয়ে নেয়। ব্যাপারটা সুচের মত ফুটলেও চুপ ছিলো। ভাবলো নবনীর হয়তো তারমত শ্যাম বর্ণের পুরুষ পছন্দ করে না।তা না হলে নবনীর কেউ আছে।
এরপর,
হঠাৎ করে একদিন নবনীর সাথে দেখা, যেখানে শিক্ষক ছাত্রীর পরিচয় ছিলো না। নবনীকে দেখেছিলো একটা ক্যাফেতে। একা বসে হেসে হেসে ফোনালাপ চলছে। সামনে ধোঁয়া ওঠা গরম কফি।
সমুদ্র তার প্রয়োজন ভুলে বসলো। হঠাৎ করে একবুক সাহস নিয়ে চেয়ার টেনে মুখামুখী বসে পড়েছিল। নবনীর অবাক চোখে তাকিয়ে ছিলো তখন। সমুদ্র ভনিতা করলো না। বরং সোজাসাপ্টা বললো,,, তোমার জিবনে কেউ আছে নবনী? না থাকলে সেই কেউ একজন আমি হতাম।
সমুদ্রের স্পষ্ট মনে আছে সেইদিন প্রথম নবনী সমুদ্রের চোখে চোখ রেখেছিলো। তার সেই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ছিলো প্রশ্নের ছড়াছড়ি।
সমুদ্র যেন সাহস পেলো। গলা ঝেড়ে শান্ত গলায় বলে উঠলো,,, তোমার মনে অনেক প্রশ্ন থাকতে পারে। তুমি জিজ্ঞেস করলে উত্তর দিবো।
নবনী তখনো চুপ। সমুদ্র নবনীর চোখে চোখ রেখে বলল,, আমি হয়তো অতোটা সুন্দর নই। তোমার কল্পনায় থাকা রাজপুত্র নই।তবে তোমার প্রতি আমার অনূভুতি গুলোও কম নয়। আমার ভালোবাসার সময় কাল দীর্ঘ নবনী।
সমুদ্রের এহেন কথায় নবনী মোবাইল ঘটতে ঘাটতে মৃদু হেসে বলল,, আমার পরিবারের সবাই সুন্দর স্যার।সব পুরুষেরা রাজপুত্র টাইপ।
সেই কথা খানায় সমুদ্র কতটা আঘাতে জর্জরিত হয়েছিলো তখন ,তা বলে বোঝানোর মত নয়। সমুদ্র শ্যাম বর্ণের হতে পারে তবে অপছন্দনীয় নয়। তার টেবিলের ড্রয়ারে রাখা চিঠির সমাহার তো সেটাই বলে।
তখন নবনী মোবাইলটা সমুদ্রের সামনে ধরে বলে উঠলো,, সব রাজপুত্রের ভীড়ে এমন একজন শ্যাম সুন্দর পুরুষের অভাব ছিলো। বড্ডো বেশি দেরি করে ফেললেন ওশান বয়।
মোবাইলের স্ক্রিনে ভেসে ওঠা ছবি দেখে চমকে উঠলো সমুদ্র। বারবার পলক ফেলে নবনীর দিকে তাকালো। নবনী শব্দ করে হেসে উঠেছিল তখন। ছবিটা সমুদ্রের ছিল। প্রথম দিনের ছবি। নবনীর জন্য প্রথম হলে সমুদ্রের জন্য দ্বিতীয় দিন।ছবিতে সমুদ্র হাত নাড়িয়ে কথা বলছে। সমুদ্র নিঃপলক তাকিয়ে রয়। নবনী দুই ভ্রু উঁচিয়ে বলল,, কি ? কিছু বলার আছে মিঃ লেকচারার? জিজ্ঞেস করবেন না কিছু?
সমুদ্র খেই হারিয়ে সুধায়,, তুমি জানতে আমার কথা?
,”আলবৎ জানতাম।আল্লাহ প্রদত্ত একটা গুন মেয়েদের আছে। পছন্দ অপছন্দের ব্যাপারটা তারা চট বুঝতে পারে। খারাপ ভালো পরখ না করেই বুঝে যায় কোনটা খারাপ কোনোটা ভালো।তেমনি আমিও জানতাম আপনার ব্যাপারটা ছয় মাস বলে কথা। শুধু আমি কেন, আমার আশেপাশে বসা বান্ধবীরাও জানে। বইয়ের পাতা দিয়ে আমার ঘুমন্ত মুখ চুপিসারে ঢেকে দিতে দেখেছে। আপনার জন্য কতোটা বুলি হয়েছি জানেন?
নবনীর চপলা কন্ঠে বলা কথা গুলো ধৈর্য্য নিয়ে শুনছে সমুদ্র। নবনীর করা প্রশ্নের উত্তর দেয়নি সেদিন বরং প্রশস্ত হেসে বলে ছিলো,” ভালোবাসি”।
সেইদিন গুলোর কথা ভেবে হাসলো সমুদ্র। গ্যালারি ছবি গুলো থেকে বেছে বেছে নবনীর ছবি গুলো দেখতে লাগলো। সমুদ্র ভেবেছিল নবনীকে একান্ত নিজের করে পাওয়ার জন্য চার বছর অপেক্ষা করতে হবে। লম্বা সময় হলেও আপত্তি ছিলো না। সমুদ্র চেয়েছিলো বিয়ের আগেই নবনী গ্ৰাজুয়েশন কমপ্লিট করুক। এই জন্য সম্পর্কের কথা দুই বাড়ির মানুষ থেকে লুকিয়েছিলো তবে সেটা এখন আর হওয়ার নয়। শিঘ্রই নবনীর বাড়িতে যেতে হবে। সমুদ্র মোবাইলখানা যত্ন করে বুক পকেটে রেখে হাঁটা ধরলো। মাকে বলতে হবে যাতে অতিসত্বর তার পুত্রবধূ ঘরে আনার ব্যবস্থা করে।
___________
রাত জেগে কাজ করেছিল নুসাইব তার থেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিলো তিহানের সাথে কথা বলা। মেজর তিহান ব্যাস্ত মানুষ তাকে পাওয়া মুশকিল। তার সাথে কথা বলতে হয় গভীর রাতে। বিষয় বস্তু প্রেম ভালোবাসা প্রাসঙ্গিক। প্রেমে পড়া ,ভালোবাসার ব্যাপারে তিহান নুসাইব থেকে এগিয়ে।নুসাইবের আলোচনার টপিক তৃধা আর তাকে নিয়ে হলেও তিহানের সাথে খোলামেলা আলাপ হলো না। সারসংক্ষেপে পছন্দের ব্যাপারটা বললো। নুসাইব রক্ষণশীল পুরুষ, বন্ধুত্ব যতই গভীর হোকনা কেন তৃধার অতীত নিয়ে কোনো প্রকার আলাপ আলোচনা করলো না।
সব শেষে তিহান একটা কথাই বলেছিল,” তুই মানুষ চেনা লোক। তোর যদি মনে হয় মেয়েটাকে নিয়ে গোটা একটা জিবন পার করে দিতে পারবি তাহলে দেরী করিস না। তাকে বলে ফেল। অতিসত্বর বলে বিয়ের আয়োজন টায়োজন কর। তোর জিবনের রঙিন বসন্ত দেখার সুযোগ আমাদেরো হোক।”
কথা আর কাজ শেষ করতে করতে অনেকটাই দেরী হলো। সব মিলিয়ে নামাজ পড়ে বিছানায় পিঠ লাগিয়েছিলো। এখন সকল দশটা অফিসের তাড়া নেই, রুমেল সামলে নিবে সব। তাই আড়মোড়া ভেঙে বিছানা ছাড়লো।
এইদিকে ডাইনিং রুমে গল্পের আসর বসেছে। আলোচনা নানার বাড়ি আর দাদার বাড়ি নিয়ে ।দাদার বাড়ির গল্প কম হলেও নানীর বাড়ির গল্পের অভাব নেই। তমাল চোখ মুখ সিরিয়াস করে বললো,, তৃধা আপু আমার দাদার বাড়ি দেখার মত। জিবনে একবার গিয়েছিলাম। তাও প্রাচীন কালে। তখন নবনী হেঁটে হেঁটে মাটি খেতো। তৃধা মুখ টিপে হাসছে। নবনী দাঁত দিয়ে ঠোট কামড়ে রাগ সংবরণ করছে। ফরিদা হক কাজের ফাঁকে ফাঁকে ছেলেমেয়েদের কথা শুনছে। মাঝে মাঝে দুয়েকটা কথা তিনিও বলে যাচ্ছেন। গল্পের আসরে
নাবীব শেখ পদার্পণ করলো। তমাল চোখ মুখ কুঁচকে তাকালো। যেন দূরসম্পর্কের আত্মীয় এসেছে। নবনী বাবার কাছ ঘেঁষে বসলো। তমাল তৃধাকে ইশারা করে বললো,,যতই বাবার পাশে গিয়ে বসুকনা কেন ,সেইতো ডাস্টবিন থেকেই তুলে এনেছিল।
নবনী মুখফোলায়।
নাবীব শেখ গলা ঝেড়ে ফরিদা হকে ডেকে বললো,, মোড়ের দোকানে কথা বলা শেষ। চুক্তি করে এসেছি।
ফরিদা হক বড় বড় চোখ করে বললো,, পাগল হয়ে গেছো?
,” না । বাপ হওয়ার দায়িত্ব পালন করছি। তুমি আর তৃধা ওকে রান্না শিখিয়ে দিবে ফেইল করলেই দোকানের মালিকানা বদলে যাবে।ওই দোকানের কাষ্টমার বেশি, রান্নার হাত ভালো হলে রিপিট কাষ্টমার হবে অনেক।
তৃধা সমেত সবাই বুঝার চেষ্টা করছে কি নিয়ে কথা হচ্ছে।
ফরিদা হক রাগে গজগজ করতে করতে কিচেনের দিকে চলে গেলেন। মায়ের রাগ দেখে তমাল জিজ্ঞেস করলো,, কি হয়েছে বাবা?
নাবীব শেখ গম্ভীর গলায় বলল,, তোর জন্য দোকান ঠিক করেছি। মতি মিয়ার চায়ের ভান্ডার। শুধু মতির জায়গায় তমাল লাগিয়ে দিবি। ফেইল করলে চিন্তা নেই। বাবা তোর জন্য ভবিষ্যৎ তৈরি করে দিয়েছি। কাষ্টমারের অভাব পড়বে না। চুক্তি হয়ে গেছে। ডাক্তারিতে ফেইল করলেই দোকানে বসিয়ে দিবো।যে ভাবে বাড়িতে এসে বসে আছিস ফেইল নিশ্চিত। এই জন্য কথা পাকা করে ফেলেছি।
নবনী ওড়নায় নিজের মুখ চেপে ধরে। তৃধা মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। তমাল বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল,, ফেইল করার চান্স নেই। রাতে তোমার স্টাডি রুমেই থাকি। তাও যদি ফেইল টেল করি তবে ঠিক আছে দোকানে বসলাম। শোনো বাবা, দোকান একা সামলানো মুশকিল । যেখানে আইন বলে শিশু শ্রম নিষিদ্ধ সেখানে বাইরের কাউকে রাখা যাবে না। ভাবছি তোমাকে আমার সেক্রেটারি রাখবো। ঘরের টাকা বাইরে যাওয়া চলবে না।বাপ ছেলে দুজন মিলে টাকা কামাবো। দোকানের নাম রাখবো বাপ ছেলে ভান্ডার। দারুন না?
নাবীব শেখ দাঁতে দাঁত চেপে ফুঁসে উঠলেন। বাজখাঁই গলায় ডেকে উঠলেন ফরিদা হককে।
ফরিদা হক দায়সারা ভাব নিয়ে স্বামীর সম্মুখে দাঁড়ায়। নাবীব শেখ চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,, তোমার ছেলেকে কিছু বলবে? বেয়াদব হয়েছে। কঠিন বেয়াদব। বাপকে বলছে চাকরি দিবে।তাও আবার সেক্রেটারি,কতবড় সাহস।
তমাল ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। এইখানে খারাপ কি বললো? রাগার কি আছে?
তৃধা মুখ লুকালো। তার দম ফাটানো হাসি আসছে।
ফরিদা হক লম্বা শ্বাস ফেলে বললো,, চুরি না করলে কোনো কর্মই খারাপ নয়। দরকার হলে চা আমি বানিয়ে দিবো। দুইজন মিলে বিক্রি করবে। সমস্যা কি?
যেমন মা তার তেমন ছেলে। নাবীব শেখ আর এক মুহূর্ত বসলেন না। হনহনিয়ে উঠে রুমে চলে গেলেন।
নাবীব শেখ যাওয়ার পেছনে দমফাটানো হাসিতে ফেটে পড়লো সবাই। নবনী আর তৃধা রিতিমত একজন আরেকজনের গায়ের উপর পড়ছে। এই সুন্দর সময়টা উপরে দাঁড়িয়ে দেখছে নুসাইব। নিঃসন্দেহে এমন সময় গুলো স্বর্নাঅক্ষরে লেখার মত।
চলবে,,,,
(ভুল অবশ্যই সংশোধন করে দিবেন।)