আমি আছি পর্ব-২৬+২৭+২৮

0
1034

উপন্যাসের নাম::#আমি_আছি
লেখনিতে:#সাদিয়া_আফরোজ
পর্ব: ২৬
,
,
,
,
,
,
,
ভরসা পেয়ে শক্ত করে নুসাইবের হাত ধরলো তৃধা। নুসাইব আর তৃধার ইশারায় কথপোকথন দেখে রজবের মনে যেন আগুন ধরলো।

নুসাইব মৃধু হেসে অবাকতার সুরে বলল,”আরে আপনি? হোয়াট এ্যা কোইনসিডেন্ট! আজকে আবার দেখা হয়ে গেলো। উনি তো আপনার স্ত্রী তাইনা?

রজবের হেংলামো দেখে সুমনা এতক্ষণ ফুঁসছিলো। নুসাইবের কথা শোনা মাত্র তৃধাকে দেখিয়ে রজবের হাত জড়িয়ে ধরে তড়িঘড়ি করে বলে উঠলো,” জ্বী, আমিই ওনার স্ত্রী।

‘স্ত্রী’ কথাটা শুনে তৃধা নরম চোখে তাকায়।
রজব মলিন হেসে বললো,” আপনি তৃধার পরিচিত? জানতাম না তো।
রজবের কথা শোনা মাত্র তৃধা তৎক্ষণাৎ বলে উঠলো,’ জানার কথাও না।’
নুসাইব তৃধার ধরে রাখা হাত রজবকে দেখিয়ে বলল,’ শুধু পরিচিত নয়, খুব বেশি পরিচিত। হাসবেন্ড বলে কথা। তা আপনি কিভাবে তৃধাকে চেনেন?

নুসাইবের হ্যাসবেন্ড পরিচয়ে রজবের দুনিয়া ঘুরে উঠলেও সুমনা একটু বেশিই খুশি।রজবের পেছনে ফেরার চান্স নেই। চাইলেও রজব তৃধার কাছে ফিরতে পারবে না।
এইদিকে তৃধা অনূভুতিহীন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মন মস্তিষ্ক দুর্বল প্রায়। ক্রমশ ঠান্ডা হয়ে আসছে হাত পা। তৃধার ঠান্ডা হয়ে আসা হাতটা আরেকটু শক্ত করে ধরল নুসাইব।তৃধা যে ক্রমাগত ভে*ঙে পড়ছে তা বুঝতে বাকি নেই।
রজব তৃধার মুখের আদলে তাকিয়ে বললো,’ আমি তৃধার প্রাক্তন স্বামী।
কথাটা শুনে চমকায়নি নুসাইব বরং একধাপ খুশি হয়ে হাত বাড়িয়ে বললো,, আপনার সাথে দেখা হওয়াটা স্বপ্নের মতো। আমার খুব ইচ্ছে ছিলো দেখা করার।
নুসাইবের কথা রজবের বোধগম্য হলো না। সে প্রশ্ন করলো,’আমার সাথে দেখা করার ইচ্ছা, স্বপ্ন মানে? বুঝলাম না।
নুসাইব নরম চোখে তৃধার চুপসে যাওয়া চেহারার দিকে তাকিয়ে বললো,, ধন্যবাদ জানাতে। তৃধাকে ছাড়ার জন্য ধন্যবাদ।
নুসাইবের কথায় চমকে তাকালো তৃধা । নুসাইব মুচকি হেসে বলল,, আপনি না ছাড়লে তৃধার মত মেয়েটাকে হয়তো আমি পেতাম না। ওর মত মেয়েকে লাইফ পার্টনার হিসেবে পাওয়া আসলেই ভাগ্যের ব্যাপার। আপনি ভাগ্য পায়ে ঠেলেছেন বলেই তো আমি পেয়েছি। ধন্যবাদ আপনাকে। আপনার প্রতি চিরকৃতজ্ঞ থাকবো।
তৃধা অবাক চিত্তে তাকিয়ে রয়। নুসাইবের প্রতিটা কথাই যেন সত্য। স্বল্প সময়ের অভিনয় তা বুঝার উপায় নেই।
নুসাইবের প্রতিটা কথা রজবের বুকে ছু*রির আ*ঘা*তের মত মনে হলো। হঠাৎ করে অনুসূচনারা ঘীরে ধরলো তাকে।তৃধাকে পুনরায় পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি তৈরি করলো। অনেক কিছু বলার ছিলো,বলার আছে। মূহুর্তে অব্যাক্ত কথা গুলো গলায় দলা পাকিয়ে গেছে। মনে হচ্ছে কেউ গ*লা চি*পে ধরে আছে। তীব্র গলা ব্যাথায় চোখ জোড়া ভিজে উঠলো। নুসাইব চারজনের বিল দিয়ে বললো,, আজকের ট্রিট আমার তরফ থেকে। নেক্সট টাইম কফির দাওয়াত রইলো। আজ চলি, আল্লাহ হাফেজ।
তৃধাকে নিয়ে বেরিয়ে আসলো নুসাইব। পেছনে অশ্রুসিক্ত একজোড়া অসহায় চোখ তৃধা নুসাইবের দিকে তাকিয়ে আছে।

কিছুদূর যেতেই দাঁড়িয়ে পড়লো তৃধা। দুহাতে মুখ ঢেকে শ*ব্দ করে কেঁ*দে উঠলো। আশপাশের মানুষ গুলো তাকিয়ে আছে তৃধার দিকে। নুসাইব কি করবে বুঝতে পারছে না। তৃধার কান্নার বেগ বাড়ছে ব-ই কমছে না। লম্বা শ্বাস টেনে নিজেকে শান্ত করলো নুসাইব। থেকে থেকে কেঁপে ওঠা তৃধার গায়ে নিজের কোটখানা পরিয়ে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,, একদম কাঁদবে না। আজকের পর তার কাঁদার পালা তৃধা। আমি হলফ করে বলতে পারি সে ভালো নেই। আমার নিজের চোখে দেখা। কেন কাঁদছো তুমি!যে তোমার মূল্য দিতে জানে না, তার জন্য কেন খামোখা চোখে পানি ফেলছো? হুস! একদম কাঁদবে না।

ধীরে ধীরে তৃধা স্বাভাবিক হতে শুরু করলো। কান্নার বেগ কমে আসলে চোখ তুলে তাকায়। চারপাশের কয়েক জোড়া চোখ তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। নুসাইব আলগোছে তৃধার চোখ মুছে দিয়ে বলল,” Sometimes suffering is just suffering, it doesn’t make you stronger, it doesn’t build character, it only hurts Thridha.

তৃধা নিচের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ায়।

নুসাইব তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে বললো,, চলো যাওয়া যাক।
__________

বাড়িতে ফিরতে ফিরতে প্রায় আটটা। তৃধার হাতে চকলেট আইসক্রিম দেখা মাত্রই ফরিদা হক সায়রা বানুকে কুনুই দিয়ে গুঁতো দিলেন। ফরিদা হককের ইশারা বুঝতে সময় লাগলো না সায়রার।

নুসাইব বাজার সমেত বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলো। তৃধাকে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললো,, রুমে গিয়ে রেষ্ট করো।

ফরিদা হক মুখ টিপে হাসছে, সাথে সায়রা বানুও।
তৃধা রুমে যেতেই নুসাইব মাকে ডেকে সন্ধ্যায় ঘটে যাওয়া ঘটনা পুনরাবৃত্তি করলো। ফরিদা হক কি বলবে বুঝতে পারছেন না। রাগ দুঃখ দুটো মিলে মিশ্র এক অনূভুতি হচ্ছে তার।
সব শেষে নুসাইব মাকে বলে গেলো,, তৃধাকে যেন কেউ বিরক্ত না করে।
এই বিষয়ে ফরিদা হক ছেলের কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করলেন। বাড়িতে আসার পর থেকে কেউ তৃধাকে ডাকেনি। রাতে খাওয়ার সময় নুসাইব নিজেই গেছিলো তৃধাকে ডাকতে।

খাওয়া শেষে সবাই সবার রুমে গেলেও তৃধা বসে রইল ড্রয়িং রুমে। টিভির চ্যানেল বদলে বদলে দেখছে । নুসাইব ব্যাপারটা খেয়াল করলো। তৃধাকে না ডেকে ফ্রীজ থেকে দুবাটি আইসক্রিম আর একটা চকলেট নিয়ে হাঁটা ধরলো।
টেবিলের উপর আইসক্রিমের বাটি দুটো রেখে নিরেট স্বরে বলল,, দেখার মত কিছুই নেই। বরং চলো এক জায়গায় যাই।

তৃধা অমত করলো না। জায়গাটা কোথায় সেটাও জানতে চাইলো না। নুসাইবের পিছু পিছু হেটে চললো। যেন সে পুতুল, জীবন্ত পুতুল।

ছাদের লাইট গুলো জ্বালিয়ে দুজন মিলে বেতের সোফায় বসলো। তৃধা আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,, তারা ছাড়া দেখার মত কিছুই নেই,তাও মনে হচ্ছে কতো কিছু। দেখলেও শেষ হওয়ার নয়।

নুসাইব তৃধার হাতে আইসক্রিমের বাটি তুলে দিয়ে বললো,, তোমার মন খারাপ তৃধা। তুমি কষ্টে আছো। মন খারাপ হলে আকাশটা আপন মনে হয়। চাঁদ তারা সবচেয়ে বিশ্বস্ত মনে হয়। মনে হয় এদের সাথে দু’দন্ড কথা বললেই যেন শান্তি।

তৃধা অম্লান হাসলো। বললো,, আপনি তো সব জানেন দেখছি।

,” জানি না। জানার চেষ্টা করছি মাত্র। চেষ্টা বৃথা যায়নি । অনেক কিছুই জেনেছি।”

,” যেমন ? কি জানলেন?”

,” এই যে তুমি বোকা, অবুঝ, নিজের ভালো বুঝো না। শুধু শুধু পাহাড় সমান কষ্ট নিয়ে বসে আছো ,তাও একজন স্বার্থপরের জন্য।”

ভারী বুক নিয়েও শব্দ করে হাসলো তৃধা। গা কাঁপিয়ে হাসতে হাসতে হঠাৎ করে কেঁদে উঠলো। এবেলা নুসাইব কান্না থামালো না। বরং ধৈর্য নিয়ে তৃধার কান্না দেখছে। তৃধা কাঁদছে শব্দ করে কাঁদছে। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সেই কান্না।

আশেপাশে কারা শুনছে ,কারা শুনছে না সেই তোয়াক্কা নুসাইব করলো না। নুসাইব চাইছে তৃধার আকাশ সম কষ্ট আজ ধুয়ে মুছে যাক। কাঁদুক মেয়েটা। আজকেই যেন সব কিছুর অবসান হয়।

এর মধ্যে ঘন্টা পেরোয়। আইসক্রিম গলে গেছে সেই কবেই। নুসাইব নিঃপলক তৃধার দিকে তাকিয়ে এতক্ষণ। তৃধা চোখ মুছে নুসাইবের দিকে তাকাতেই নুসাইব হাত বাড়িয়ে চকলেটের পাকেট তৃধার হাতে ধরিয়ে দেয়। তৃধা অবাক চোখে তাকিয়ে রয়। লোকটার মুখে বিরক্তির ছাপ নেই। ধৈর্য ধরে বসে ছিল এতক্ষন তাও নিঃশব্দে।তৃধা ভেবেছিলো বিরক্ত হয়ে চলে যাবে। কিন্তু না, যায়নি । বরং কান্না থামার অপেক্ষায় চকলেট হাতে নিয়ে বসে আছে।

,” আর কাঁদবে?”

নুসাইবের প্রশ্নে ভ্যাবাচ্যাকা খেলো তৃধা। এ কেমন প্রশ্ন?

তৃধা দ্রুত মাথা নেড়ে বললো,” না”

নুসাইব সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে বলল,,”Never expect to get what you give Thridha, not everyone has a heart like you.”

তৃধা চকলেটের প্যাকেট ছিঁড়ে কামড় বসিয়ে বললো,, সবাই সমান নয়। তাছাড়া এক্সপেক্টেশন সবার কাছে করা হয় না। যে খুব বেশি আপন, ভালোবাসার ,মায়ার তার কাছেই করা হয়।

নুসাইব মুচকি হেসে বলল,, তোমরা মেয়েরা এমন কেন? এতো কেন ভালোবাসো? এতো কষ্টের পরো ভালোবাসা আসে কোথা থেকে? আমার মা আর তোমাকে দেখলেই পা*গল মনে হয়। দু’জন যুগান্তকারী উদাহরণ।

তৃধা চকলেটের প্যাকেট নুসাইবের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,, চকলেট পছন্দ এই জন্য। মিষ্টি ভালোবাসা বাড়ায়।

নুসাইব হেঁসে হাত বাড়িয়ে এক টুকরো চকলেট ভেঙে মুখে পুরে নিলো।

তৃধা শব্দ করে নিঃশ্বাস ফেলে বললো,, শুধু কি মেয়েরাই বাসে? ছেলেরা নয়? উদাহরণ আপনার বাবাকেই দেখুন। আন্টির প্রতি তার ভালোবাসা প্রকাশ করতে গেলে শব্দ-ও কম পড়বে। যদিও সবাই এক নয়। কেউ কেউ আছে যারা শুধু ছলনা করে। একটা কথা কি জানেন?

নুসাইব আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে।

তৃধা বলে উঠলো,, “ভালোবাসা যদি পানির মত তরল পদার্থ হতো। তবে পৃথিবীতে সব নারীর একটা করে ভালোবাসা নামক সমুদ্র থাকতো। ভালোবাসার সমুদ্র।সমুদ্র তার মালিকানায় থাকলেও সেই সমুদ্রের নাম তাদের ভালোবাসার মানুষটির নামে হতো। পুরুষের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ভিন্ন হতো। খুব কম সংখ্যক পুরুষের ভালোবাসার সমুদ্র হতো। বাদ বাকি সবাই অসংখ্য ডোবা কিংবা পুকুরের মালিক থাকত। একেক জনের অনেক গুলো ডোবা/পুকুর। তাদের ভালোবাসা একজনে সীমাবদ্ধ থাকতো না বলেই এমন হতো। অসংখ্য ভালোবাসার মানুষ আর তাদের জন্য জমিয়ে রাখা ভালোবাসা ভরা ডোবা পুকুর। সে ক্ষেত্রে আপনার বাবার একটা সমুদ্র আছে। যেটার নাম “ফরিদা হক”।

নুসাইব মুচকি হেসে বলল,,” আর তোমার?”

তৃধা মলিন হেসে বললো,,” সমুদ্র শুকিয়ে গেছে। ভালোবাসা নেই। মরিচিকার পেছনে ছুটেছিলাম। যার জন্য সমুদ্র সম নয় বরং সে ভালোবাসারই যোগ্য নয়।”

,” আমার সম্পর্কে ধারণা আছে? ডোবা পুকুর নাকি সমুদ্র হবে?”

তৃধা ভাবুক হয়ে বললো, হ্যাঁ আছে। আপনারো একদিন সমুদ্র সমান ভালোবাসা হবে। যতটুকু চিনি এতে আপনি ডোবা পুকুরের মালিক হবেন না। কি ঠিক বললাম তো?

নুসাইব মুচকি হেসে তৃধার চোখে চোখ রেখে বলল,” আমারো সমুদ্র আছে তৃধা। তৃধা নামক সমুদ্র। সমুদ্র আমার মালিকানায় হলে এর নাম করন তোমার নামে হয়েগেছে।”

কয়েক সেকেন্ডের জন্য ঘোরে মধ্যে চলে গেছে তৃধা। নুসাইবের চোখের দিকে নরম চোখে তাকিয়ে আছে। নুসাইব আলতো হেসে বলল। সেই সমুদ্র কন্যা বিচ্ছেদ বুঝেনা ,ছেড়ে যাওয়ার কারণ খুঁজে না।”

চলবে,,,

উপন্যাসের নাম::#আমি_আছি
লেখনিতে:#সাদিয়া_আফরোজ
পর্ব: ২৭
,
,
,
,
,
,
,
নুসাইবের কথা গুলো মস্তিষ্কে পৌঁছতেই সম্বিৎ ফিরলো তৃধার। চমকে উঠে দাঁড়ালো সে। নুসাইব মুচকি হেসে তাকালো তৃধার দিকে। তৃধা অদ্ভুত দৃষ্টিতে নুসাইবের দিকে তাকিয়ে বলল,, কি সব বলছেন? মাথা ঠিক আছে? পাগল হয়ে গেছেন?

নুসাইব সোজা হয়ে বসে বললো,, তোমার কি মনে হয়?আমি ঘোরের মধ্যে কথা বলছি? তৃধা আমি পাগল নই, অবুঝ নই। যা বলছি সজ্ঞানে বলছি।

তৃধা অবাক তাকিয়ে রয়। লোকটার মাথায় সমস্যা আছে। তা না হলে এইসব বলবে কেন? তৃধা কাঁপা গলায় বলল,, কি বলতে চাইছেন?

তৃধার চোখ মুখের দিকে তাকিয়ে পুনরায় বলে উঠলো,, ভালোবাসি তৃধা। যতটুকু ভালোবাসলে একটা জিবন দুজন মিলে একসঙ্গে পার করা যায় ততটুকু ভালোবাসি।

তৃধার ভ্রু জোড়া কুঁচকে এলো। হঠাৎ নুসাইবের কোনো কথাই তার মস্তিষ্কে ধারন করছে না। তার কাছে সব পাগল পাগল মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে সব ভ্রম।এই তো একটু পর ভ্রম কেটে গেলে সব কিছু আগের মত স্বাভাবিক হয়ে যাবে।

তৃধার চঞ্চল চোখ জোড়া দেখে নুসাইব বলে উঠলো,,
তোমাকে অনেক আগেই বলার কথা ছিলো। তুমি কি ভাবতে কি ভাববে সেই জন্য বলা হয়ে ওঠেনি। আজ মনে হলো নিজের ফিলিং এক্সপ্রেস করার জন্য এইটা উপযুক্ত সময়।দেখো তৃধা ভালোবাসার উপর কারো জোর নেই।তোমাকে পছন্দ করা থেকে শুরু করে ভালোবাসা পর্যন্ত যেমন কেউ আমাকে জোর করেনি। তেমনি আমাকে পছন্দ করা কিংবা ভালোবাসার জন্য কেউ তোমাকে জোর করবে না। তুমি হয়তো ভাবতে পারো, তুমি অসহায়, বেচারি একটা মেয়ে দেখে আমি তোমার উপর দয়া করে ভালোবাসার কথা বলছি। এও ভাবতে পারো এক বাড়িতে একই ছাদের নিচে থেকে দেখতে দেখতে ভালো লাগা, ভালোবাসার রূপ নিয়েছে। তোমার জায়গায় আমি থাকলে আমিও তাই ভাবতাম। কিন্তু কি বলোতো এমন কিছুই না। তোমার অতীত সম্পর্কে জানতে পারার আগেই তোমার জন্য আমার মনের অনেকটা জায়গা বরাদ্দ হয়ে যায়। রইলো কথা দেখতে দেখতে ভালোবাসা। সেটা হলে আমার কলেজ, ভার্সিটি , অফিস এইসবে কম মেয়ে নেই যাদের আমি ভালোবাসতে পারতাম না। ওইসব কথা শুধু মাত্র অজুহাত আমার কাছে। আমার কাছে চরম সত্য তুমি, যাকে আমি ভালোবাসি।ভালোবাসতে চাই তৃধা।

নুসাইবের কথা শুনে তৃধা পুনরায় বসে পড়লো। কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বললো,, দেখুন আপনি হয়তো আবেগের বসে এমন কথা বলছেন। আমার আর আপনার কোনো মিল নেই। আপনি বেটার কাউকে ডিজার্ভ করেন। যেখানে আমি একজন ডিভোর্সি মহিলা সেখানে আপনার এখনো বিয়েই হয়নি। তাছাড়া আপনার পরিবার আছে, সমাজে একটা স্থান আছে। সব থেকে বড় কথা আপনার ভাইবোন। চিন্তা করে দেখুন নবনীর এখনো বিয়ে হয়নি। এর মধ্যে এইসব শুনলে বিয়েটা আধেয় হবে কিনা সন্দেহ। তমাল ভাইকে দেখুন, আপনার সিদ্ধান্তের কারনে তার বন্ধু মহলে চলাও মুশকিল হয়ে যাবে। তিন্নি আপুও তার শ্বশুর বাড়িতে মুখ দেখাতে পারবে না। তাছাড়া আমি অতটা ভালো নই যতটা আপনি ভাবছেন। ঘর থেকে পালিয়ে আসা একটা মেয়ে যে দু’বছর সংসার করে আবারো ঘর ছেড়েছে। তাছাড়া আমার পরিবার সম্পর্কে ধারণা নেই আপনার। হতেও তো পারে তারাও ভালো নয়। বলার আছে ভাবুন কি বলছেন।

নুসাইব শান্ত হয়ে তৃধার কথা গুলো শুনছে। মেয়েটা কেমন করে নিজের সব দোষ তুলে ধরছে ,শুধু মাত্র তাকে ভালো না বাসার জন্য। নুসাইবের মনে হলো এরপর তৃধার প্রতি তার ভালোবাসা সাড়ছে ব-ই কমছে না। নুসাইব তৃধার কথার উত্তরে বললো,, তোমার অতীত নিয়ে আমার কোনো অবজেকশন নেই , না ছিলো কখনো। সে ক্ষেত্রে অতীতে যদি দুটো বিয়েও হতো তাও আপত্তি থাকতো না। দেখো তৃধা আমি চাইলে অবিবাহিত একটা মেয়েকে বিয়ে করতে পারি। কিন্তু সেই অবিবাহিত মেয়েটাতো আর তৃধা হবে না! আরো কি যেন বলেছিলে? ও হ্যাঁ, পরিবার? সেটা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। আমার পরিবার তোমাকে পছন্দ করে। ইভেন তমাল আর নবনী প্রথম থেকেই তোমাকে আমার পাশে আমার স্ত্রী রূপে দেখতে চায়। আমি যদি ভুল না হই এতো দিনে তামালের বন্ধুরা তোমাকে ভাবীও ডাকা শুরু করে দিয়েছে। নবনীর কথাও ভাবতে হবে না। সমুদ্র সমুদ্রের পুরো পরিবার জানে আমি তোমাকে পছন্দ করি। তিন্নি জানলেও কোনো অবজেকশন থাকবে না। আমার পরিবার আমার সিদ্ধান্তকে শ্রদ্ধা করে তৃধা । আমার সিদ্ধান্তের উপর কথা বলবে না কেউ। আর রইলো কথা সমাজের! সমাজ নিয়ে আমার মাথা ব্যাথা নেই। সমাজ ভালো দেখলেও প্রশ্ন তোলে ,খারাপ দেখলেও তোলে। সমাজের তথাকথিত লোকজন কখনো আমার প্রয়োজনে আসেনি। তারা আমার ব্যাক্তিগত জিবনে অপ্রয়োজনীয় বস্তুর মত। যারা না হলেও আমার জিবন চলবে।

নুসাইবের কথা শুনে তৃধা কি করবে, কি বলবে বুঝতে পারছে না।

নুসাইব পুনরায় বলে উঠলো,, তুমি বলেছিলে তুমি অতোটাও ভালো নও। প্রয়োজন নেই একশো পারসেন্ট ভালো হওয়ার,আমিও দুধে ধোয়া তুলসী পাতা নই। রক্তে মাংসে গড়া মানুষ একশো পারসেন্ট ভালো হয়না। বাইদা ওয়ে তুমি তোমার সংসার, পরিবার এইসবের অজুহাত দেখাচ্ছো তৃধা। আমার পরিবার কখনো তোমার পরিবার সম্পর্কে জানতে চেয়েছে?বলো চেয়েছে?

তৃধা মাথা নিচু করে বললো,,’ না’

,” তুমি বলোনি তোমার ব্যাক্তিগত কারন আছে। আমরা তোমার সেই ব্যাক্তিগত কারণ খুতিয়ে দেখতে চাইনি তৃধা। আমার বিশ্বাস তোমার পরিবার উত্তম একটা পরিবার হবে। তাদের ব্যবহার তাদের আচরন, তাদের মন মানসিকতা তোমার ব্যাক্তিত্বে প্রতিফলিত হয় তৃধা। শোনো, তুমি না চাইলে তোমার পরিবার সম্পর্কে কখনোই জানতে চাইবো না। প্রয়োজন নেই, দরকার হলে পুরো জিবন এইভাবে পার করে দিবো তাও প্রশ্ন তুলবো না। তাও প্লিজ তৃধা অজুহাত দিও না। তোমার দেওয়া অজুহাত গুলো আমার কাছে তুচ্ছ। ওইসব অজুহাতের ধার ধারি না আমি। আমার তুমি হলেই চলবে তৃধা। আর কিছুর প্রয়োজন নেই।

তৃধা নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখ থেকে অনবরত পানি গড়াচ্ছে। সে ঠিক কি বলবে বুঝতে পারছে না।

নুসাইব মাথা কাত করে তৃধার অশ্রুসিক্ত চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,,তৃধা! বিয়ে করবে আমাকে? চমকে তাকালো তৃধা। নুসাইব তুধার অশ্রুসিক্ত চোখে চোখ রেখে বলল,,”ট্রাস্টমি পেছনে সব দুঃখ কষ্ট ভুলিয়ে দিবো। তোমাকে তোমার মত করে ভালোবাসবো। একটা সুযোগ দিয়ে দেখো।

নুসাইবের আদুরে গলায় বলা কথায় তৃধা ঠোঁট চেপে কান্না আটকে বললো,, কিন্তু আমিতো আপনাকে ভালোবাসি না নুসাইব। যে আপনাকে বিন্দু পরিমাণ ভালোবাসে না তাকে নিয়ে জিবন পার করা এতো সহজ নয়। আমি আপনাকে একটুও ভালোবাসি না।

নুসাইব বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিয়ে বললো,, ভালোবাসতে হবে না তৃধা। আমার সাথে থাকতে থাকতে আমার উপর তোমার মায়া জন্মে যাবে। জানোই তো নারীরা মায়াবিনী হয়। তাদের চোখে মায়া বেশি। একটা সময় পর তোমার চোখেও আমার জন্য মায়া হবে। অগাধ মায়ায় পড়বে তুমি। তুমিও সময় নিয়ে ভালোবাসবে আমাকে, হতে পারে সেটা একবছর পর কিংবা জিবনের শেষ সময় গুলোতে তৃধা। আমি অপেক্ষা করবো। আমার অসুবিধা নেই।

তৃধা নিঃপলক তাকিয়ে আছে নুসাইবের দিকে।নুসাইবের প্রতিটা শব্দ তৃধাকে ক্রমশো দূর্বল করে তুলছে। তৃধা বুঝতে পারছে না কি হচ্ছে। মনে হচ্ছে অনুভূতির গোলক ধাঁধায় আটকে গেছে। সামনে বসে নির্দ্বিধায় অনূভুতি ব্যাক্ত করা লোকটার কথায় প্রত্যুত্তর করার মত শব্দ নেই তার কাছে। নিঃপলক তাকিয়ে শ্রুতিমধুর বাক্য গুলো শুনছে শুধু।

তৃধাকে অমন করে তাকিয়ে থাকতে দেখে নুসাইব আলতো হেসে বলে উঠলো,, আমি বলছি না এক্ষুনিই ভালোবাসতে হবে। তাড়া নেই তৃধা। সময় নাও ভেবে চিন্তে জানাও। ভেবে চিন্তে জানাও তুমি আমার জিবনের একান্ত ব্যক্তিগত রমনী হতে চাও। সময় নাও।

তৃধা আবারো বিষ্ময় নিয়ে তাকালো। নুসাইব না বলার অপশন রাখলো না। সময় নিয়ে ভেবে চিন্তে হ্যাঁ বলতে বললো।
নুসাইব হেঁসে বলল,, কেমন আন অফিসিয়াল প্রপোজ তাইনা? যাও আইসক্রিম এনেছিলাম তাও গলে গেলো। চকলেট-ও খাওয়া যাচ্ছে না। তুমি যখন পজেটিভ উত্তর দিবে তখন অফিসিয়ালি প্রপোজ করবো ওকে?

এই প্রশ্নের জবাব আধেও কি দেওয়ার মত? লজ্জায় ফেলার মত প্রশ্ন। তৃধা বসা থেকে উঠে বললো,, আমি ঘরে যাচ্ছি।
দাঁড়ালো না, যাচ্ছি বলেই হাঁটা ধরলো তৃধা। কিঞ্চিৎ বিরক্ত হলেও পেছন থেকে “সমুদ্র কন্যা” নামে ডেকে উঠলো নুসাইব। পকেটে হাত গলিয়ে দাঁড়িয়ে প্রগাঢ় হেসে বলল,,” বেষ্ট কাউকে পাওয়ার পর ,যে বেটার খোঁজে সে গাধার কাতারে পড়ে। তুমি আমাকে যতটা গাধা ভাবছো আমি ততটা গাধা নই তৃধা। কখনো ভুলেও বলবে না, তোমার থেকে বেটার কাউকে আমি ডিজার্ভ করি, যেখানে তুমি নিজেই বেষ্ট। সব সময় মনে রাখবে , Nusaib Sheikh always choose best.And you are the best.
__________
সকালের নরম রোদ চোখে মুখে পড়তেই বিরক্ত হলো তৃধা। অনেক রাত পর্যন্ত জেগে ছিল সে। ঘুম ধরেও ধরা দিচ্ছে না। চোখের পাতা ভারী হলেও মস্তিষ্ক জুড়ে নুসাইবের চিন্তা দাপিয়ে বেড়াচ্ছিলো। প্রথম থেকে এই পর্যন্ত নুসাইবের সাথে কাটানো সময় গুলো মস্তিষ্কে পুনরাবৃত্তি হতে থাকলো পুরো রাত। সেই ঘটনা গুলো পুনরাবৃত্তি করার পর তৃধা নিজেই বেকুব বনে গেলো। নুসাইবের প্রতিটা কাজে প্রতিটা ব্যাবহারে পছন্দের ব্যাপারটা স্পষ্ট ফুটে উঠলেও তৃধার নিজের চোখ ধরা দিলো না। এতোটা নির্বোধ তো সে ছিলো না? পুরো রাত চিন্তা করে তৃধার কাছে মনে হলো নুসাইব নিঃসন্দেহে ভালো একজন মানুষ হলেও তার মত একজন ডিভোর্সি মেয়ের জন্য বড্ডো বেশি বেমানান। তৃধা বিন্দু বিন্দু ভালোলাগায় লাগাম টানলো। যে প্লেটে খাচ্ছে ,তাতে ছিদ্র করার মত অতোটাও খারাপ মেয়ে সে নয়। তার মত একজনকে বউ করার চেষ্টা মানেই তো সোনার সংসারে ফাটল ধরানো। নুসাইব নিজের জিবনের সিদ্ধান্ত নিজে নিলেও তাকে ঘিরে তার মা বাবার অবশ্যই আশা আকাঙ্ক্ষা আছে। তার মত মেয়েকে বেছে নেওয়া মান-ই তো পিতা-মাতার সাথে পুত্রের সম্পর্কের মধ্যে তিক্ততা সৃষ্টি হওয়া। তৃধা চায় না এমন একটা সাজানো গোছানো সংসার তার মত আশ্রিতা একজন মেয়ের জন্য ভেঙে যাক। তাছাড়া নুসাইবকে সে ভালোও বাসে না । মন মস্তিষ্কে বুঝিয়ে শেষ রাতে ঘুমিয়েছিলো সে। এখন রোদ পড়াতে ঘুমটা ভেঙে গেল। তৃধা হাত দিয়ে রোদ আড় করে জানালার দিকে তাকালো। আজকেও দুটো চড়ুই পাখি জানালার কাঁচ ঘেঁষে বসে আছে। দু’জনের মধ্যে ভাব দেখা যাচ্ছে। তৃধা আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলো। ঘুম না হওয়াতে মাথা ধরে আছে। চা না খেলে মাথা ধরা যাবেনা। যেই ভাবা সেই কাজ চট জলদি উঠে ওয়াশ রুমের দিকে চলে গেলো।

এইদিকে নুসাইব পুরোরাত নির্ঘুম কাটিয়েছে। মনের কথা বলে দিলেও তৃধার জবাব নিয়ে টেনশনে আছে। তৃধাকে যতদূর চেনে ‘না’ ছাড়া ‘হ্যাঁ’ সে বলবে না। নুসাইব মনে মনে ঠিক করলো সে হাল ছাড়বে না। যতদিন না তৃধা রাজি হচ্ছে ততদিন চেষ্টা করে যাবে। প্রয়োজনে সদ্য একুশে পা দেওয়া যুবকের মত পাগলামি করে বেড়াবে। এতে যদি তৃধা রাজি হয়। উঠে হাত মুখ ধুয়ে বের হলো। ফরিদা হক ছেলের চোখ মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,, ঘুম হয়নি?

নুসাইব বিনা বাক্যব্যয়ে মাকে জড়িয়ে ধরলো। ছেলের হঠাৎ জড়িয়ে ধরায় টেনশনে পড়ে গেলেন তিনি। নুসাইব তমালের মত নয়। তমাল সকাল বিকাল মাকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকলেও, নুসাইব খুব বেশি কষ্ট না পেলে মাকে জড়িয়ে ধরে না। ফরিদা হক বেশ চিন্তিত। তিনি নুসাইবকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো,, কি হয়েছে বাচ্চা। বল আম্মুকে বল কি হয়েছে? মায়ের টেনশন হচ্ছে তো।

নুসাইব লম্বা শ্বাস টেনে বললো,, একটু দাঁড়িয়ে থাকো মা। ভালো লাগছে না।

অগত্যা ফরিদা হক ছেলেকে ধরে দাঁড়িয়ে রইলেন। যতই হোক মায়ের মন। সময়ের সাথে উতলা হচ্ছে ভীষণ। ছেলের কি হয়েছে জানার আগ পর্যন্ত শান্ত হবে না।

বেশ কিছুটা সময় পর নুসাইব বলে উঠলো,, তৃধাকে কাল রাতে পছন্দের কথা বলে দিয়েছি আম্মু। মেয়েটা এখনো পর্যন্ত কিছুই বলেনি। আমি শিওর পুরো রাত জেগে জেগে রিজেক্ট করার প্রাকটিস করেছে। টেনশনে পুরো রাত জেগে বসে ছিলাম। একটুও ঘুমাতে পারিনি আম্মু। তুমি তৃধাকে বুঝাও না।

ফরিদা হক কি বলবে বুঝতে পারছে না। তার বুঝদার ছেলেটা হঠাৎ এতো বাচ্চা হয়ে গেলো কি করে সেটা মাথায় ধরছে না। এই মুহূর্তে নুসাইবকে আঠারো বছর বয়সী ছেলে মনে হচ্ছে। যে স্কুল পড়ুয়া মেয়ের জন্য বায়না ধরেছে। ফরিদা হক ছেলের পিঠে হাত বুলিয়ে বললো,, এই ব্যাপার? ঠিক আছে আমি দেখছি।তার আগে নিজেকে ঠিক কর। চুল এলোমেলো, চোখ ফুলো, গেঞ্জি, ট্রাউজার কি অবস্থা। এইভাবে দেখে তো আমারই পছন্দ হচ্ছে না। তৃধা তো ফিরেও তাকাবে না। যা গিয়ে আয়না দেখ।
নুসাইব শব্দ করলো না। মায়ের বাধ্য বাচ্চার মত আবারো ফিরে গেলো রুমে।

তৃধা হাত মুখ ধুয়ে রুম ছেড়ে বের হয়। এই দিকে ফরিদা হক সায়রা বানুর সাথে মিটমিট করে হেসে ছেলের কান্ডের কথা বলছে। তৃধা কিচেনে ঢুকতেই দুজন প্রসঙ্গ বদলে ফেলেছে। তৃধা টেরই পেলো না। এই দুই রমনী তাকে আর নুসাইবকে নিয়ে আলোচনায় মশগুল ছিলো এতক্ষণ।

,”আন্টি! ভীষণ মাথা ধরে আছে। একটু চা দিবে?”

ফরিদা হক কয়েক সেকেন্ড তৃধার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তৃধার হাল দেখে নুসাইবারে বলা কথাটা মনে পড়ে গেলো। নুসাইব ঠিকই বলেছে এই মেয়ে পুরো রাত জেগে ছেলেটাকে রিজেক্ট করার প্রাকটিস করেছে। যার কারণে চোখ মুখের এই অবস্থা।

সায়রা বানু চায়ের লিকার করতে করতে বললো,, আপা আপনারা টেবিলে বসুন আমি নিয়ে আসছি সবকিছু। ফরিদা হক নিজে না গিয়ে তৃধাকে পাঠালেন। তৃধা টেবিলে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে আছে। তার মাথাটা ভীষণ ব্যাথা করছে। মনে হচ্ছে চা না খেলে এই মুহূর্তে ফেঁ*টে যাবে। ফরিদা হক নাস্তা রেখে আসার সময় সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে মুখটিপে হাসলেন। তার ছেলে শুধু তৈরি হয়নি বরং ফুলবাবু সেজে নিচে নামছে। নীল রঙ্গের পাঞ্জাবির সাথে সাদা পায়জামা,হাতে কালো রঙের ঘড়ি। গোসল করে চুলটাও মোছেনি। ব্যাস্ত ভঙ্গিতে মোবাইল ফোন দেখতে দেখতে নামছে। ফরিদা হক মনে মনে বার কয়েক ‘ মাশা-আল্লাহ ‘ বলে কিচেনে চলে গেলেন।

চলবে,,,

উপন্যাসের নাম::#আমি_আছি
লেখনিতে:#সাদিয়া_আফরোজ
পর্ব: ২৮
,
,
,
,
,
,
,
নুসাইব চেয়ার টেনে বসলো। সপ্তাহের শুক্রবার হওয়াতে তেমন কাজ না থাকলেও তিহানকে মেসেজ করাটা শুক্রবারের সবচেয়ে বড় কাজের মধ্যে একটি। কাল রাতের কাহিনীর সার সংক্ষেপ জানাচ্ছে বন্ধুকে। এইদিকে তৃধা যে টেবিলে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে আছে সেই খেয়াল তার নেই।

তৃধা চোখ বন্ধ করলেও তার কানে ঠিকই শব্দ আসছে। তার অপজিট সাইডে কেউ চেয়ার টেনে বসেছে সেটা বুঝতে অসুবিধা হলো না। তাও চোখ বন্ধ করে রেখেছে। ভেবেছিল হয়তো ফরিদা হক হবে।
নুসাইব মোবাইল টেবিলে রাখার সময় চোখ পড়লো তৃধার দিকে। আচমকা তৃধাকে সামনে দেখতে পাবে তা কল্পনাও করেনি। তৃধাকে এমন করে শুয়ে থাকতে দেখে কিছুটা চিন্তিত হলো নুসাইব। তৃধা এমন করে শুয়ে থাকার মেয়ে নয়। নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে। নুসাইব টেবিলের উপর ঝুঁকে তৃধার চেহারাখানা পরখ করে দেখলো। কপাল কুঁচকে চোখ বুজে আছে। হুট করে নুসাইবের মনে পড়লো নির্ঘুম রাত্রির কথা। নিশ্চয়ই তৃধার ও ঘুম হয়নি। পুরো রাত ভেবে কাটিয়েছে। গম্ভীর মুখে বসে পড়লো সে।এই মেয়ে সত্যি রিজেক্ট করার পয়তারা করছে।
ফরিদা হক চায়ের কাপটা রেখে তৃধার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,, উঠ চা খেয়ে নে।
তৃধা আড়মোড়া ভেঙে সামনে তাকাতেই চমকে উঠলো। নুসাইব ভাবলেশহীন ভাবে ভ্রুকুটি করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তৃধা হা করে রাখা মুখ বন্ধ করতেই ভুলে গেছে। এই মুহূর্তে কি রিয়েকশন দিতে হবে সেটা মাথায় আসছে না ।

এইদিকে নুসাইব চোখের পলক ফেলাতো দূরের কথা সামনে যে তার মা দাঁড়িয়ে আছে সেই তোয়াক্কাও করছে না। তৃধাকে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভ্রু জোড়া নাচিয়ে ইশারায় সুধোয়,, কী?
নুসাইবের ইশারার ধরন দেখে কাশি উঠে গেছে তার । কাশতে কাশতে অবস্থা খারাপ।

ফরিদা হক ছেলের দিকে চোখ রাঙানি দিয়ে তৃধার পিঠে চাপড় দিতে থাকলেন। নুসাইব বুঝে পায় না তাকে দেখে কাশির কি হলো। কাশি থামার পর নড়েচড়ে বসল তৃধা। নুসাইবের দিকে তাকালো না আর । বরং চা রেখে রুটি আর ভাজি খেতে লাগলো। ফরিদা হক কাবাবে হাড্ডি হতে চাইলেন না। তিনি নিঃশব্দে কিচেনের দিকে চলে গেলেন। আজকে না হয় কিচেনে বসেই নাস্তা করে নিবেন।

নুসাইব রুটি ছিঁড়ে মুখে দিতে দিতে বলল,, রাতে ঘুম হয়নি? চোখমুখের এই অবস্থা কেন?

তৃধা চোখ তুলে তাকিয়ে নুসাইবকে একপলক দেখে মাথা নাড়িয়ে বলল,, নাহ্, হয়নি।

নুসাইব গম্ভীর গলায় বলল,, আমি নাহয় তোমার চিন্তায় ঘুমাইনি । কিন্তু তুমি কেন ঘুমাও নি। আমার চিন্তায় নাকি?

নুসাইবের কথা শুনে তাকালো তৃধা। সামনে বসা মানুষটার চেহারা দেখে বুঝার উপায় নেই সে রসিকতা করছে নাকি চিন্তিত। কেমন গম্ভীর শক্ত পোক্ত গলায় কথা গুলো বলছে। তৃধা কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে বললো,,, হুম, আপনার চিন্তায় ঘুম হয়নি। পুরো রাত চিন্তা করে দেখলাম আমার যোগ্যতা কতটুকু আর আপনার কতটুকু। এও ভাবলাম আমার হয়ে আপনাকে কত ধরনের কথা শুনতে হবে। আরো আছে, শুনুন! বিয়েটা কোনো ছেলে খেলা নয়,তাও আমার মত মেয়েকে বিয়ে করা তো আরো নয়। আমি ধবধবে সাদা কাপড়ে পড়া একফোঁটা কালো রঙের মত। আমার সাথে আপনার , আপনার পরিবারের যায় না। তাই পুরো রাত ভেবে সিদ্ধান্ত নিলাম,,।

নুসাইব হাত উঠিয়ে বলল,, থামো আর সামনে আগাতে হবে না। ছোট একটা প্রশ্নের এতোশতো অজুহাত দেওয়ার প্রয়োজন দেখছি না। তোমার যোগ্যতা কম? ওকে ফাইন! মনে করো আমার পছন্দ ফালতু পছন্দ। রইলো কথা বিয়ের। তোমার কি আমাকে দেখে নাইন টেনে পড়ুয়া ছেলে মনে হয়? আমি আবেগের বশে বিয়ে করে পরে দেয়ালে মাথা ঠুকবো? তুমি তোমাকে “আমার মত মেয়ে” বলে কি বোঝাতে চেয়েছো জানি না। যেটাই বোঝাও আই রিয়েলি ডোন্ট কেয়ার। আমার তোমার মত মেয়ে হলেই চলবে। তৃধা! নিজের অতীতকে সাইডে রেখে শুধু আমার আর তোমার কথা ভাবো। প্লিজ এরপর ভালোবাসার উদাহরণ দিও না। দুজন মানুষের মাঝে শ্রদ্ধা- সম্মান,মায়া থাকলে “ভালোবাসা” ট্যাগের প্রয়োজন হয়না। আমি তোমাকে জোর করছি না। শুধু বলছি অজুহাত দেখিয়ে এড়িয়ে না যেতে। ট্রাস্টমি তৃধা! অতীত , সমাজ,লোকে কি বলবে,লোকে কি ভাববে, আপনি ভালো ডিজার্ভ করেন,আমি আপনার জন্য ঠিক নই এইসব বাদ দাও । মনে করো এইসবের অস্তিত্ব নেই তোমার জিবনে। এইগুলো বাদ দিয়ে চিন্তা করো। আমি তুমি মিলে আমরা হওয়ার চিন্তা করো। এইরকম একটা সকাল মুখোমুখি বসার কথা না ভেবে পাশাপাশি বসার কথা ভাবো। তোমার জন্য আমার অপেক্ষা, আমার জন্য তোমার অপেক্ষা করার সময়টা নিয়ে ভাবো। দেখবে তোমার জন্য উত্তর দেওয়া সহজ হয়ে যাবে।

তৃধা বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। নুসাইবের প্রতিটা কথায় কিছু একটা ছিলো যা তৃধাকে গভীর ভাবে স্পর্শ করে। তৃধার কাছে সেই অনূভুতির ব্যাখ্যা নেই। তৃধা অবাক তাকিয়ে রয়। একটা মানুষ এতো সুন্দর করে একটা জিবন কিভাবে তুলে ধরতে পারে তা তৃধার জানা নেই।

তৃধাকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে উঠে দাঁড়ালো নুসাইব। মুচকি হেসে পানির গ্লাস এগিয়ে দিতে দিতে বলল,,,ভেবে দেখো তোমাতে আমাতে মিলে আমরা হয়ে এমন আরো আরো ভোর হলে কেমন হবে!

নুসাইবের কথায় সম্বিৎ ফিরলো তৃধার। সে আলতো হাতে পানির গ্লাস তুলে নিলো। নুসাইব মুচকি হেসে বেরিয়ে পড়লো।এমন মুগ্ধতায় ছেয়ে থাকুক বাকি জিবন।

কিচেনের দরজার পাশ থেকে ফরিদা হক আর সায়রা বানু সরে দাঁড়ালো। সায়রা দরজা আটকে বলে উঠলো,, আপা নুসাইব বাবার কথা শুনেছেন?ছেলে কিন্তু তৃধাকে বেশি ভালোবাসে। আজ সব কিছু ঠিক থাকলেও একটা কাজীর অভাব হচ্ছে। মনে হচ্ছে একটা কাজী হলে খেলা জমে যেতো।

ফরিদা হক চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল,, আমার ছেলে যেভাবে সেজেগুজে রেডি ।আমার তো প্রথম থেকে মনে হচ্ছিল একটা কাজী প্রয়োজন। বিশ্বাস কর সায়রা যেদিন তৃধা রাজি হবে সেইদিন সেইসময় সাথে সাথে হুজুর ডেকে বিয়ে পড়িয়ে ফেলবো। এখন যা শুনলাম এরপর এই মেয়েটাকে মোটেও হাতছাড়া করা যাবে না।

সায়রা মাথা নেড়ে বললো,, আপা একটা কথা বলি?

,” হ্যাঁ, বল ! জিজ্ঞেস করার কি আছে?”

,”তৃধার কোনো অতীত আছে তাইনা?”

ফরিদা হক কি বলবে বুঝতে পারছে না। ফরিদা হককে চুপ করে থাকতে দেখে সায়রা নিজ থেকে বলে উঠলো,” আমার মনে হয় তৃধা সেই অতীতের চেয়ে বেশি তোমাদের কথা ভাবছে। এইজন্য রাজি হচ্ছে না। আপা তুমি গিয়ে সোজাসুজি কথা বলে দেখো।
ফরিদা হক ভেবে দেখলো সায়রার কথা ভুল নয়। সায়রা যা বলেছে ঠিকই বলেছে। তাছাড়া তৃধা নিজেই বলেছে সে আমাদের পরিবারের জন্য যোগ্য নয়। তার মানে? ফরিদা হক চটজলদি কোমরে গুজে রাখা আঁচল ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,, সায়রা ! ঝাল কম দিয়ে রান্না বসাতে পারবি?।

সায়রা বানু মাথা নেড়ে বললো,, অবশ্যই পারবো।

,”শোন আজ রান্না তুই সেরে ফেল । আমি তৃধার সাথে কথা বলে আসি। রাজি না করিয়ে ছাড়ছি না।

সায়রা মাথা নেড়ে বললো,, আপা একদম টেনশন করার দরকার নেই। আজ সব আমি সামলে নিচ্ছি। তুমি যাও।

ফরিদা হক হাত ধুয়ে কিচেন থেকে বেরুলেন। এইদিকে তৃধা শূন্যে দৃষ্টি রেখে বসে আছে। চায়ের কাপ ধরে রাখলেও চায়ে একটা চুমুক পর্যন্ত দেয়নি। অবশ্য এতক্ষণে চা গুলো ঠান্ডা সরবত হয়ে গেছে।
ফরিদা হক তৃধার হাত ধরে বললো,, তৃধা মা চলতো।

ভাবনার জগৎ থেকে বিদায় নিয়ে বাস্তবে ফিরলো তৃধা। ফরিদা হককের দিকে তাকিয়ে বলল,, কিছু বলেছিলে আন্টি?

,” হুম, চল আমার সাথে। কথা আছে।

কথা আছে শব্দটা শুনতেই পিলে চমকে উঠলো তৃধার। মনের মধ্যে নানা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি যেটা ভাবছে সেটা হচ্ছে নুসাইব আর তার সম্পর্ক নিয়ে।

তৃধাকে আবারো উদাসীন হতে দেখে ফরিদা হক নিজেই টেনে তুললো তাকে।
তৃধা ফরিদা হকের হাতের মুঠোয় ধরে রাখা নিজের হাতটার দিকে তাকিয়ে আছে। ফরিদা হক বলে উঠলো,, এতো কি ভাবছিস।চল!
_______

বিছানার একটা কোনে বসে আছে তৃধা তার ঠিক পাশে ফরিদা হক। তিনি দুটো বড় বড় এলবাম নিয়ে বসেছেন। দুটো এলবাম-ই পুরোনো। তিনি বেছে সবচেয়ে বড় পুরোনো এলবামটা হাতে নিয়ে খুলে তৃধার সামনে ধরলো।

তৃধা তাকিয়ে আছে সেই এলবামের ঝাপসা হয়ে আসা ছবির দিকে। ছবিটা প্রায় নষ্ট হয়ে গেছে। রং ছড়িয়ে পড়েছে অনেকটাই। তৃধা খেয়াল করে দেখলো। একটা যুবক ছেলে শেরোয়ানি আর পাগড়ি পরে বসে আছে। তার পাশে বসা লাল বেনারসী পরিহিতা মেয়ে। যাকে দেখতে কিছুটা ফরিদা হকের মত লাগলেও যুবক ছেলেটার চেহারা তমালের মত লাগছে। তৃধা আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে দেখি বললো,, এইটা আংকেল আর তুমি ?
ফরিদা হক মাথা নেড়ে বললো,, হ্যাঁ। তোর আংকেল আর আমি। আরো আছে দেখ।
তৃধা একটা একটা করে ছবি দেখছে। এলবামের শেষের দিকে ছোট একটা বাচ্চার ছবি । যাকে কোলে নিয়ে ফরিদা হক বসে আছেন। তৃধা ছবিখানা খুতিয়ে দেখতে দেখতে বললো,, এইটা?

,” নুসাইব। ওর যখন তিনদিন বয়স তখন তোলা।”

এলবামটা শেষ হতে আরেকটা এমবাম তুলে নিলো। সেখানে নুসাইব আর ফরিদা হকের অসংখ্য ছবি। মাঝে মাঝে দু একটা ছবিতে নাবীব শেখকে দেখা গেলেও প্রায় সব ছবি তাদের মা ছেলের। কোথাও নুসাইব হাসছে তো কোথাও কাঁদছে। কিছু কিছু ছবি ঘুমানোর সময় তোলা। এলবাম শেষ হতেই ফরিদা হক জিজ্ঞেস করলেন,, দুটো এলবামের ছবি দেখে কি মনে হলো?

তৃধা মুচকি হেসে বলল,, সুন্দর একটা সুখী পরিবার।
ফরিদা হক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,, সুখী পরিবারটা এতো সহজ ছিলোনা তৃধা।

,”জানি আন্টি। কারন তোমাদের ভালোবাসার বিয়ে ছিল।”

ফরিদা হক মাথা নেড়ে বললো,” শুধু সেটা হলে সমস্যা হতো না তৃধা।”

তৃধা কৌতুহল নিয়ে বলল,” তাহলে?”

,”আমরা একজন আরেকজনকে ভালোবাসার কথা জানানোর আগেই আমার অন্যত্র বিয়ে হয়ে যায়।”

তৃধা অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে আছে। বিশ্বাস হওয়ার কথাও না। তৃধাকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে ফরিদা হক অম্লান হেসে বলল,, জানি অবাক লাগছে। কিন্তু এইটাই সত্য। নাবীবের সাথে বিয়ে হওয়ার আগে আমার অন্য একজায়গায় বিয়ে হয়। সেইখানে ছয়মাস সংসার করার পর সেই সংসারের ইতি টানতে হয়। এরপর আমি আবারো পড়ালেখা শুরু করি। নাবীবের সাথে আবারো দেখা। এরপর ধীরে ধীরে সম্পর্ক হয় দুজনের মাঝে। লোক জানাজানির পর কতো শতো ঝামেলা হিসেব নেই। প্রথমে তার পরিবার রাজি ছিলোনা। কারন আমার আগে বিয়ে হয়েছে। আমি তালাক প্রাপ্ত মেয়ে এইজন্য। পরে নাবীবের পাগলামোর কাছে তার পরিবার হার মানলেও আমার পরিবার বেঁকে বসে। দীর্ঘ সময়ের পর দুজনের বিয়ে হয়। সহজ ছিলো না। এই দুটো এলবামে সুখী দেখার পেছনের কাহিনী লম্বা তৃধা।

তৃধা বিস্ময় নিয়ে ফরিদা হককের কথা শুনছে।
ফরিদা হক কয়েক সেকেন্ড থেমে পুনরায় বলে উঠলো,,”কিন্তু কি বল তো তৃধা, এই সুখ আসতোনা যদিনা নাবীব স্ট্রং থাকতো। নাবীব তার কথায় অনড় ছিলো। আমি মেয়ে মানুষ পরিবার যা বলতো তাই করতাম। ভালোবাসায় মাটি চাপা দিয়ে সমাজ পরিবার এইসবের কথা ভাবতাম। কিন্তু নাবীব তেমটা মোটেও ছিলো না। আমার বিয়ে হওয়ার ছয়মাস পাগলের মত পাগলামি করে বেড়িয়েছে।
এরপর বিয়ে হলো সংসার হলো। দুজন চার ছেলেমেয়ের মা বাবা হয়েছি। কখনো আমার অতীতের কথা তার মুখে শুনিনি। বিশ্বাস করবে কিনা জানিনা। আমার ছেলে মেয়েরা এখনো পর্যন্ত জানে না তাদের মায়ের দুটো বিয়ে হয়েছে। নুসাইবের যখন ছয় বছর বয়স তখন তার দাদী আমাকে কথা শোনাতে গিয়ে বিয়ের কথা বলে বসে। ছোট্ট নুসাইব সেই কথা তার বাবাকে জিজ্ঞেস করে বসে। এরপর নাবীব আর একটা মিনিট সেইখানে থাকেনি। আমাকে আর নুসাইবকে নিয়ে শহরে চলে আসে। সেই থেকে এই পর্যন্ত আমার ছেলেমেয়েরা কেউ গ্ৰামে গিয়ে থাকেনি। ওদের বয়সে ওরা ওদের দাদার বাড়িটাকে শুধু একবার দেখেছে। তাও সকালে গিয়ে বিকেলে চলে এসেছে। আমাকে নিয়ে ছেলেমেয়েদের কান ভাঙ্গানো হবে দেখে কখনো গ্ৰামে গিয়ে থাকেনি। চিন্তা করে দেখো তৃধা শুধু মাত্র ভালোবাসার মানুষ কষ্ট পাবে বলে কতো কিছু করলো নাবীব।

তৃধা মাথা নেড়ে বললো,, আসলেই আংকেলের তুলনা নেই।
ফরিদা হক মুচকি হেসে বলল,” উঁহু! আছে। তার তুলনা আমার নুসাইব।

তৃধা ফরিদা হকের দিকে তাকিয়ে তার কথা বুঝার চেষ্টা করছে।
ফরিদা হক তৃধার দুহাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো,, আমার ছেলেটা সত্যিই তোকে ভালোবাসে তৃধা। ফরিদা হকের এহেন কথায় কেঁপে উঠলো তৃধা। আন্টি জানেন কিভাবে ? উনি বলে নিতো?ভেবতেই অপরাধীর মত মাথা নিচু করে ফেললো।

ফরিদা হক তৃধার হাত জোড়া নিজের কোলের উপর এনে বললো,,”নুসাইব ওর বাবার মত। যার হাত একবার ধরবে দুনিয়া উল্টে গেলেও সে হাত ছাড়বে না। মা আমার ছেলেটাকে ফিরিয়ে দিস না।

ফরিদা হককের আকুতি দেখে চোখ তুলে তাকায় তৃধা।

,” দেখ তৃধা, তোকে আমাদের প্রথম থেকেই ভীষণ পছন্দ। বিশ্বাস কর মা,তোর অতীত নিয়ে আমাদের পরিবারের কারো কোনো আপত্তি নেই। কেউ কখনো এই বিষয় নিয়ে দুই কথা বলবে না। আমার ছেলেটা খারাপ নয়। তোকে আজিবন আগলে রাখবে ।

তৃধার মুখে রা শব্দ। যেমন ছেলে তেমন মা। এদের কি মাটি দিয়ে তৈরি করেছে স্বয়ং আল্লাহ্-ই জানেন। কেন এরা অন্যের দোষ গুলো না দেখে ভালোবাসা বাসে? কেন এরা সবাইকে এতো আপন করে নেয়? তৃধা ফরিদা হকের হাতের দিকে তাকিয়ে বলল,, আন্টি তুমি আর আংকেল একে অপরকে ভালোবাসতে। কিন্তু আমি,,

ফরিদা হক তৃধাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,, সময়ের সাথে ভালোবাসাও হয়ে যায় তৃধা। বিয়ে এমন এক বন্ধন যেটা অপরিচিত মানুষটার উপরেও মায়া, ভালোবাসা তৈরি করে দেয়। সেখানে নুসাইব তো পরিচিত। তাছাড়া তোকে ভালোবাসে ছেলেটা।

তৃধা মাথা নিচু করে বললো,,আন্টি আমি,,।

ফরিদা হক তৃধাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,, তোর কিছুই করতে হবে না। শুধু একটা কাজ কর আগের মত আমার ছেলেটার সাথে স্বাভাবিক হয়ে কথা বল। অতীতকে অতীতের জায়গায় রেখে শুধু তোদের নিয়ে ভাব।

তৃধা হার মানলো। তার আসলেই কিছু বলার নেই। সে নিঃশ্চুপ বসে ভাবছে।

এমন সময় তমাল কল করে বসলো। ফরিদা হক রিসিভ করে ফোন লাইড স্পিকারে রাখলো। তমাল গলা ঝেড়ে বললো,, আম্মু তোমার বড় ছেলে কোথায়? কাল এতো এতো টিপস্ দিয়ে মেসেজ দিলাম একটা মেসেজও সিন করেনি।

তৃধা মোবাইলের দিকে তাকিয়ে আছে।
ফরিদা হক বলেন,, কিসের টিপস্? কিসের মেসেজ?

তমাল গলা ঝেড়ে বলল,, তৃধা আপুকে কিভাবে ভাবী বানাতে হবে সেই টিপস্। তোমার যে ছেলে এইজিবনে মুখ ফুটে বলতেই পারবে না।

ফরিদা হক মুখ টিপে হাসছে। এইদিকে তৃধার চোখ জোড়া কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। ভেতরে ভেতরে পুরো পরিবার তাকে নিয়ে ছপ কষছে? অবাকতার সাথে একচিলতে ভালোলাগাও ছেয়ে গেছে মনস্তাত্ত্বিক জুড়ে।

ফরিদা হক কল কেটে দিয়ে বললো,, এই ছেলের মুখ চলে বেশি। এখন যদি শোনে তুই নুসাইবের কথা জানেগেছিস , তাহলে ব্যাগপত্র গুছিয়ে সকালেই বাড়ি চলে আসবে। পড়ালেখা রেখে বিয়ের আয়োজন শুরু করে দিবে। বড্ডো পাজি হয়েছে।
_______

দুপুর সাড়ে বারোটার দিকে নাবীব শেখ তার মা-বাবা সেতারা বেগম আর সোয়েব শেখকে বাড়িতে নিয়ে এলেন।

চলবে,,