উপন্যাসের নাম::#আমি_আছি
লেখনিতে:#সাদিয়া_আফরোজ
পর্ব: ২৯
,
,
,
,
,
,
বাড়িতে প্রবেশ করার পর সোয়েব শেখ-কে হাসি মুখে দেখা গেলেও সেতারা বেগম স্বভাব সুলভ মুখ গোমড়া করে আছে। নাবীব শেখ ব্যাগ পত্র নিয়ে সোয়েব শেখ আর সেতারা বেগমের জন্য বরাদ্দ করে রাখা রুমে নিয়ে রাখলেন। দুজনকে সোফায় বসিয়ে ফরিদা হক চট জলদি লেবুর শরবত করে আনলেন। সোয়েব শেখ শরবতের গ্লাস হাতে তুলে নিলেও সেতারা বেগম ঝাঁজালো গলায় বলল,, মেরে ফেলতে চাইছো নাকি? জানো না আমার ডায়বেটিস? চিনি খাইয়ে বিদায় করার জন্য লেগে পড়েছো।
শ্বাশুড়ির কথা গায়ে মাখলো না ফরিদা। তিনি মুচকি হেসে বলল,, আম্মা আপনারটায় চিনি দেইনি।
এইদিকে সোয়েব শেখ সেতারা বেগমকে চোখ রাঙিয়ে শাসানো চেষ্টা করছে।
সেতারা বেগম তোয়াক্কা করলো না। শরবতের গ্লাস তুলে মুখে নিয়ে চোখ মুখ কুঁচকে ফেললো।
সায়রা বানু ডায়নিং টেবিলে প্লেট সাজানোর কাজে ব্যস্ত। এই ব্যাস্ততার মাঝেও সেতারা বেগমকে দেখে চলেছে। এইটুকু সময়ে সায়রা বানু বুঝতে পারলো। ফরিদা হকের শ্বাশুড়ি তাকে মোটেও পছন্দ করে না। হয়তো ছেলে আর নাতি নাতনির খাতিরে সম্পর্ক রেখেছে।তা না হলে বিদায় করে দিতো।
তৃধা গোসল সেরে বেরিয়েছে। কাল রাতের পর থেকে সব কিছুতে কেমন জড়তা কাজ করছে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল মুছতে মুছতে নিজেকে বার কয়েক পরখ করে নিলো। আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে বিড় বিড় করে বলে উঠলো,, বিমোহিত হওয়ার মত রূপ তোর নেই তৃধা। তাও কেন লোকটা এতোটা বিমোহিত হলো? কেন মায়ায় জড়িয়ে ভালোবাসতে শুরু করলো? নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে থামলো তৃধা। তার উত্তর জানা নেই। কিছু প্রশ্নের উত্তর হয় না। চুল মুছে ওড়না জড়িয়ে বেরোলো রুম থেকে । কাল থেকে শুনছে আজকে নুসাইবের দাদা দাদী আসবে। সকাল গড়িয়ে দুপুর তাদের খবর নেই। রুম থেকে বের হতেই পা জোড়া থেমে গেলো। কিচেনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে একজন বৃদ্ধা মহিলা। তার চুলে পাক ধরলেও মেহেদী দিয়ে রাঙ্গানো সেই চুল। বয়সের কারণে চামড়া কুঁচকে ঝুলে গেলেও চেহারায় দাম্ভিকতার ছাপ স্পষ্ট। আটপৌরে হালকা গোলাপি রঙের ফুলেল শাড়ি পরা গলায় স্বর্নের চেইন, হাতে একজোড়া বালা আর কানে নাকে স্বর্নের অলংকার। দেখে বুঝা যাচ্ছে এক কালে ভীষণ সুন্দরী ছিলেন। তার সামনে দাঁড়িয়ে ফরিদা হক নতজানু হয়ে কথার জবাব দিচ্ছে। ফরিদা হকের ভীতু চেহারা দেখে তৃধা দুকদম পেছনে সরে দাঁড়ায়। যতটুকু শুনেছে এতে দাদি নামের মহিলা ভয়ংকর মেজাজী। তৃধা পালানোর তাগিদে পেছনে ঘুরতে নিলে সেতারা বেগমের চোখে পড়ে। তিনি কর্কশ গলায় ডেকে উঠলো,, এই মেয়ে!
তৃধার পা জোড়া বরফের ন্যায় জমে যায়। ফরিদা হক তৃধার দিকে তাকিয়ে আছে। তৃধা পুনরায় সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললো,, জ্বী!
,” এই দিকে আসো।”
ফরিদা হক চটজলদি বলে উঠলো,” আম্মা এইটা আমার বান্ধবীর মেয়ে তৃধা।”
বান্ধবীর মেয়ে শুনে বিস্মিত হলেও চুপ করে রইলো। তৃধা জানে সবাইকে সবটা বুঝানো যায় না। তাছাড়া এই মুহূর্তে এতো ঘটনা বলাও ঠিক হবে না। এমন ঘটনা পারিবারিক কলহ সৃষ্টির জন্য যথেষ্ট।
সেতারা বেগম বিরক্ত নিয়ে বললো,,” মেয়ে বোবা?”
ফরিদা হক মাথা নেড়ে বললো,” না আম্মা।”
,”তাহলে তুমি উত্তর দিচ্ছো কেন?”
শ্বাশুড়ির কথা চুপসে গেল ফরিদা। তৃধা ভয়ে জড়সড় প্রায়। ফরিদা হক হাতের ইশারায় কাছে ডাকলেন। তৃধার জমে যাওয়া পা দুটো দিয়ে কোনোরকম এগিয়ে আসে।
সেতারা বেগম কর্কশ গলায় সুধোয়,, নাম কি?
তৃধা কম্পিত গলায় বলল,, ‘তৃধা’।
,”আগে পিছে কিছু নেই? শুধু তৃধা?”
তৃধা ফরিদা হকের দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে ফেললো। ফরিদা হক কিছু বলবে তার আগেই তৃধা বলে উঠলো,” তৃধা বিনতে মাহাবুব।”
ফরিদা হক অবাক চোখে তাকিয়ে রয়। তিনি ভেবেছিলেন তৃধার নাম শুধুই তৃধা। তিনি জানেন না আধেয় তৃধার কোনো নাম আছে।
,” মা-বাবার নাম কি? বাড়ি কোথায় তোমাদের?”
এইবার তৃধা সত্যিই চুপসে গেল। তার কিছুই বলার নেই।এই বাড়িতে আসার পর থেকে কেউ এইসব জিজ্ঞেস করেনি। জিজ্ঞেস করলেও তৃধা বলতো না। তৃধা চায়না কেউ তার মা-বাবার নাম ধরে আক্ষেপ করুক। তার করা ভুলের মধ্যে ওই দুটো মানুষ কখনোই ছিল না, এখনো নেই। এইদিকে ফরিদা হক কি করবে বুঝতে পারছে না।
সেতারা বেগম ফরিদা হকের দিকে তাকিয়ে পুনরায় বলে উঠলো,” তুমি ঘামছো কেন? কি সমস্যা?”
এইদিকে মিনিট দুয়েক আগে নুইবের আগমন ঘটলেও টের পায়নি কেউ। নুসাইব ধীর পায়ে এগিয়ে এসে বলল,,” আসসালামুয়ালাইকুম দাদু। কেমন আছো?”
বড় নাতির কন্ঠস্বর শোনা মাত্র সেতারা বেগমের চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। মনে হচ্ছে হাতে চাঁদ পেয়েছেন। ফরিদা হক যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো।ছেলে একদম সঠিক সময়ে এন্ট্রি নিয়েছে। তৃধা কপালের ঘাম মুছে বড় করে নিঃশ্বাস ফেলে। হয়তো এই যাত্রায় বাচা যাবে। নুসাইব মুচকি হেসে বলল,” কেমন আছো?”
সেতারা বেগম নরম গলায় বলল,,” আলহামদুলিল্লাহ ভালো দাদুভাই।”
নুসাইবের আচরনে এমন মিষ্টতা দেখে ফরিদা হক কিঞ্চিৎ অবাক হলেও আপাতত চুপ করে রইলেন। নুসাইব দাদিকে জড়িয়ে ধরে তৃধার দিকে তাকিয়ে ইশার রুমে যেতে বললো। ইশারা পাওয়া মাত্র দৌড়ায় তৃধা। ফরিদা হক গোল গোল চোখ তাকিয়ে আছে। এইদিকে তৃধার এমন দৌড় দেখে হাসলো নুসাইব।
সেতারা বেগমের খুশির সীমানা নেই। এই প্রথম নাতি তার সাথে হাঁসি মুখে কথা বলছে, জড়িয়ে ধরছে। নুসাইব গলা ঝেড়ে বলল,, আসতে না আসতেই প্রশ্ন শুরু? দাদু তোমার এমন শক্ত কথা মেয়েটা নিতে পারবে না। দেখলে না, কেমন ভয়ে চুপসে আছে?
সেতারা বেগম রসিকতা করে বললো,, এতো বছরে আমার রত্নটা কোনো মেয়েকে খেয়াল করে দেখছে। কি ব্যাপার? শেষ মেষ মায়ের বান্ধবীর মেয়েকে মনে ধরলো?
মায়ের বান্ধবীর মেয়ে শুনে মায়ের দিকে তাকায় নুসাইব। ফরিদা হক ইশারায় ‘হ্যাঁ’ বলতে বললেন।
নুসাইব হেঁসে বলল,,” তোমার পছন্দ হয়েছে?”
সেতারা বেগম আক্ষেপ করে বললো,,” ঠিক করে তো দেখলামই না।”
নুসাইব তার দাদিকে ধরে ডায়নিং টেবিলের দিকে নিতে নিতে বলল,” আছো যখন দেখবে। শুধু শক্ত করে কথা না বললেই হয়। তৃধা অনেক ভীতু দাদু। নরম করে কথা বলে দেখো তোমার সাথে মিশে যাবে।
সেতারা বেগম আঁচল দিয়ে মুখ চেপে কুটকুট করে হাসতে হাসতে বলল,,” মন দেওয়া নেওয়া শেষ তাহলে?”
নুসাইব মাথা চুলকে হাসলেও কিছু বললো না।
সেতারা বেগম ফরিদা হককে ডেকে বললো,,” বউমা! তুমি কি ভাবছো?”
,” আম্মা ছেলে পছন্দ করেছে । তাছাড়া মেয়েটা আমাদের ও পছন্দ বাকি আল্লাহর ইচ্ছা। দোয়া করবেন।”
,” আল্লাহর ইচ্ছা বুঝবে কি করে? আল্লাহ তো তোমাদের দিয়ে তার ইচ্ছা পূরণ করাবে। তোমরা হাত গুটিয়ে বসে থাকলেতো হবে না। তোমার বান্ধবীকে জানাও। রাজি হলে বুঝবে আল্লাহর ইচ্ছা। আল্লাহ তো স্বয়ং এসে বিয়ে পড়াবে না। উসিলা হিসেবে মানুষ পাঠাবে। এখন তোমরাই সেই মানুষ।”
নুসাইব মায়ের চেহারার দিকে তাকিয়ে আছে। ফরিদা হক পড়েছে আরেক বিপাকে। তিনি ভালো করেই জানেন এই মূহুর্তে তৃধার অতীত সম্পর্কে জানলে চিৎকার চেঁচামেচি করে পুরো বাড়ি উঠিয়ে ফেলবে। যে আজ পর্যন্ত তাকে মেনে নেয়নি, সে আমৃত্যু তৃধাকেও নাতবউ হিসেবে মেনে নিবে না। বিয়ে হওয়ার আগেই ভেঙে দিবে। ফরিদা হক লম্বা শ্বাস টেনে নিজেকে ধাতস্থ করলেন। তার সাথে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলেন তৃধার সাথে নুসাইবের বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার পর সব বলবে। তার আগে কিছুই বলা উচিৎ হবে না। এতে করে তৃধা রাজি হওয়ার থাকলেও রাজি হবে না।
ফরিদা হক মাথা নেড়ে বললো,” আসলে আমার বান্ধবী তো দেশে নেই। আসলে ওর বাড়িতে সম্বন্ধ নিয়ে যাবো।
,” মেয়েটাকে রেখে চলে গেছে?”
,”কাজের জন্য গেছে। মেয়েটাকে আমার কাছে রেখে গেছে।”
,”ঠিক আছে, ঠিক আছে। বুঝেছি।”
ফরিদা হক হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন। এক সময়ে এতো এতো মিথ্যা বলে তিনি হাঁপিয়ে উঠেছে।
নুসাইব ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে বললো,, আম্মু আমি বের হচ্ছি নামাজের দেরি হয়ে যাচ্ছে।
,” ঠিক আছে তাড়াতাড়ি যা। তোর বাবা দাদা অনেক আগেই চলে গেছে। নুসাইব মোবাইল রেখে হড়বড়িয়ে বের হলো।”
ছেলে যাওয়ার পর ফরিদা হক আবারো ভেজা বেড়ালের মত হয়ে গেছে। সেতারা বেগম চেয়ার ছেড়ে নিজের রুমের দিকে হাঁটা ধরলেন।
শ্বাশুড়ির বসা চেয়ারটাতে ধপ করে বসে পড়লো ফরিদা হক। সায়রা বানু দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলেন। ফরিদা হক বুকে হাত রেখে বলল,, “সায়রা আমার মনে হয় প্রেশারটা আবার বেড়ে গেছে।”
,” আমিও সেটাই ভাবছি আপা। এমন শ্বাশুড়ি আমি আমার বাপের জন্মেও দেখি নাই। পুরাই দারোগা।”
ফরিদা হক চোখ বন্ধ করে মাথা নেড়ে বললো,” হ্যাঁ। এখন দারগা। বিয়ের পর সাত বছর মিলিটারি ট্রেনিং করিয়েছে এই দারোগা। তখন থেকে হাই প্রেশারের রুগী।”
_________
সপ্তাহের শুক্রবার তার উপর মেহমানদের আগমন। টেবিলে সাজানো খাবারের পদ দেখে সোয়েব শেখ বললো,, এতো কিছুর কি দরকার ছিল? হাল্কা পাতলা কিছু করতে। এতো খাবার খাবে কে? নাতি নাতনি গুলোও নেই। সেতারা বেগম গলা ঝেড়ে বললো,, হবু নাত বউ আছে। দেখবে?
সোয়েব শেখ তৃধাকে দেখেনি। তিনি জানেন না তার স্ত্রী কার কথা বলছে। তাই বললেন,” হবু নাত বউ?”
নাবীব শেখ চেয়ার টেনে বসে বললো,, ফরিদা, তোমার ছেলে কোথায়? তৃধাকেও দেখছি না? ব্যাপার কি? দুপুরে খাবে না নাকি?
নুসাইব সিঁড়ি বেয়ে নামার সময় দেখলো টেবিলে সবাই থাকলেও তৃধা নেই। নুসাইবের বুঝতে বাকি নেই তৃধা দাদির ভয়ে রুমে ঘাপটি মেরে বসে আছে।
চেয়ার টেনে বসে বললো,” আম্মু তৃধাকে ডেকে আনো। দাদুর ভয়ে রুম ছেড়ে বের হচ্ছে না।”
ফরিদা হক হাতের বাটিটা টেবিলে রেখে চটজলদি তৃধাকে ডাকতে চলে গেলেন।
তৃধা সত্যিই রুমে ঘাপটি মেরে বসে আছে। দাদু নামক ভয়ংকর মেজাজী মহিলার প্রশ্নের তোপের মুখে পড়া মানেই শেষ।”
ভিড়িয়ে রাখা দরজা খুলে রুমে ঢুকলো ফরিদা।
বিনা বাক্যে তৃধার হাত টেনে বললো,, খাবি চল।
তৃধা মাথা নেড়ে বললো,, তোমরা খেয়ে নাও। আমি পরে খাবো।
,” পরে টরে হবেনা। এক্ষুনি যেতে হবে। চল আম্মা আর কিছু বলবে না। নুসাইব সব সামলে নিয়েছে।”
ফরিদা হক তৃধাকে এনে নাবীব শেখের পাশে বসিয়ে দিলেন। নুসাইব খেয়াল করে দেখলো তৃধা একদম চুপসে আছে। মাথা নুইয়ে টেবিলের দিকে তাকিয়ে আছে। হুট করে নুসাইবের মনে হলো এই মুহূর্তে একটা লাল বেনারসী হলে মন্দ হয়তো না। লাল বেনারসী পরা থাকলে নতুন বউ লাগতো তৃধাকে।
সোয়েব শেখ সেতারা বেগমের দিকে ইশারা করে।
সেতারা ফিসফিস করে বলল,, বড় নাত বউ।
সেতারা বেগমের ফিসফিস করে বলা কথা শুনেনি এমন কেউ নেই। তার ফিসফিস করে বলা কথা শোনার পর তৃধা নুসাইব দু’জন চোখাচোখি হয়। তৃধা চোখ নামিয়ে নিলেও নুসাইব ঠায় তাকিয়ে তৃধার দিকে। নাবীব শেখ খানিকটা অবাকই হলেন। এই ঘটনা এই পর্যন্ত কখন গড়ালো টেরই পেলেন না। তিনি ফরিদা হককে ইশারা করে তৃধাকে দেখায়। ফরিদা হক চোখ দিয়ে আস্বস্ত করলো,, তৃধা জানে।
নাবীব শেখ তখনো চিন্তিত। তার পিঠ পিছে কি হয়েছে সেটাই ভাবছে।
সোয়েব শেখ মাথা নেড়ে মুচকি হাসলো।
______
দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলেও তৃধা রুম ছেড়ে বের হয়নি।বের হলেই দাদু তাকে পাকড়াও করে রুমে নিয়ে যাবে। এই নিয়ে দুইবার বেঁচে ফিরেছে। তৃতীয় বার নিশ্চিত রক্ষা নেই।
নুসাইব অনবরত পায়চারি করছে। ফরিদা হক হড়বড়িয়ে ছেলের রুমে ঢুকে দরজা আটকে দিলেন। নুসাইব মায়ের এমন লুকিয়ে চুরিয়ে ঘরে ঢোকা দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। ফরিদা হক মোবাইল নিয়ে তমালকে কল দিতে দিতে বলল,, বাবুটা পাগল করে ফেলেছে। তোর আর তৃধার কথা শোনার পর আসার জন্য নাচানাচি করছে। এইটাকে একটু শায়েস্তা কর তো।
নুসাইব গম্ভীর মুখে বললো,, আমি বললেও থামবে না আম্মু। তোমার ছোট মেয়ে রিতিমত মাথায় চড়ে বসেছে। আমার মোবাইল দেখো এই নিয়ে পনেরোটা কল এসেছে। এই বিচ্ছু দুটো শান্তি দিচ্ছে না।
কল রিসিভ করার আগে কেটে দিয়ে বিছানায় বসলেন। নুসাইব মায়ের সিয়রে বসে বললো,, তুমি তৃধাকে কি বলেছো আম্মু?
ফরিদা হক ছেলের কৌতুহল দেখে মৃদু হেসে বলল,, তোকে বলা যাবে না। পার্সোনাল কথা।
নুসাইব কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল,,” ঠিক আছে জিজ্ঞেস করবো না।”
ছেলে চেহারার দিকে তাকিয়ে বলল,, তোর দাদুকে নিয়ে ভয় পাচ্ছি। তৃধা সম্পর্কে জানতে পারলে কুরুক্ষেত্র বাঁধিয়ে দিবে। আমি চাইনা এই মুহূর্তে তৃধা সম্পর্কে কোনো কিছু জানুক।
নুসাইব মাথা নেড়ে বললো,,” এইটা কি স্বভাবিক নয়? যেখানে তথাকথিত নিয়ম গুলো এখনো সমাজে প্রচলিত, সেখানে তৃধার ব্যাপারটা তো কলঙ্কের মত। সমাজ সব কিছু স্বাভাবিক ভাবে নেয় না। তৃধার জায়গায় কোনো ছেলে হলে কেউ মাথা ঘামাতো না। ছেলেদের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক হলেও মেয়েদের ক্ষেত্রে মোটেও স্বভাবিক নয় আম্মু। ডিভোর্সি মেয়েদের নিয়ে সমাজে কুৎসা রটে। দাদু জানলে আসলেই ঝামেলা করবে। এখন কোনো কিছু বলার দরকার নেই। এই মুহূর্তে তৃধাকে ডিফেন্ড করার মত অধিকার আমার তৈরি হয়নি। যখন তৈরি হবে তখন দুনিয়া জানলেও সমস্যা নেই। আমি সামলে নিবো।
ফরিদা হক মুগ্ধ হয়ে ছেলের কথা শুনছেন। নাবীব ঠিকই বলেছে। অতীতে ঘটে যাওয়া ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।
____________
কাল সন্ধ্যায় ঘটে যাওয়া ঘটনার পর থেকে রজব আর সুমনার মাঝে তুমুল ঝগড়া চলছে। রাত থেকে এই নিয়ে তৃতীয় বারের মত শুরু হয়েছে বাকবিতন্ডা। ঝগড়ার এক পর্যায়ে সুমনার গা*লে থা*প্পড় মে*রে বসলো রজব। থাপ্পড় খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল সুমনা। রজব রাগে ঘু*সি মে*রে ড্রেসিং টেবিলের আয়না ভেঙে ফেলে। সুমনার চোখের কোনে বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রুজল। রজব আঙ্গুল উঁচিয়ে বললো,, এর পরের বার তৃধাকে নিয়ে আর একটা বাজে কথা বললে সা*ফ মে*রে ফেলবো। সে তোমার মত গায়ে পড়া স্বভাবের নয়, তোমার মত লোভী নয়। মুখ সামলে কথা বলবে।
সুমনা বরফের ন্যায় জমে গেছে। রজব রাগে গজগজ করতে করতে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লো। সুমনা মাটিতে হাত থাবড়ে চিৎ*কার করে কাঁদছে।
চলবে,,
উপন্যাসের নাম::#আমি_আছি
লেখনিতে:#সাদিয়া_আফরোজ
পর্ব: ৩০ ( ১ম খন্ড)
,
,
,
,
,
,
তমাল,নবনী খুশিতে পা*গল প্রায়। দুজন মিলে কতশত প্ল্যান করছে হিসেব নেই। তমাল বদ্ধপরিকর কালকেই সে বাড়ি যাবে। নবনী বার কয়েক পরীক্ষার দোহাই দিলেও কাজ হলো না। শেষে নুসাইবের পাঠানো মেসেজ দেখে দমে গেলো। রাত দশটায় ডাইনিং টেবিলে বসে আছে সবাই। সায়রা বানু টেবিলে খাবার এনে রাখছে। এর মধ্যে তৃধা বেশ অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়ে গেছে। ডাইনিং টেবিলে আসার সাথে সেতারা বেগম তাকে নুসাইবের পাশে বসিয়ে দিলো। তার ঠিক পাশেই সেতারা বেগম। তৃধার কপালে ঘাম চিকচিক করছে। নুসাইব ব্যাপারটা খেয়াল করে তৃধার দিকে সরে বসে ফিসফিস করে বলে উঠলো,, রিল্যাক্স! এতো ঘাবড়ানোর কিছু নেই। তাছাড়া দাদি তোমাকে খে*য়ে ফেলবো না। স্বভাবিক থাকো।
তৃধা আলতো করে মাথা নাড়ালো।
গ্লাসে পানি ঢেলে তৃধার দিকে এগিয়ে দিয়ে সরে বসলো নুসাইব।
নুসাইবের কাজে আড় চোখে তাকায় তৃধা।
সেতারা বেগম আর সোয়েব শেখ মিটমিট করে হাসছে। ফরিদা বেশ স্বাভাবিক হলেও নাবীব শেখের চোখ জোড়া জলজল করছে। ছেলে বাপের লাইনে চলছে। গর্বে বুকটা ফুলে উঠছে তার।
সেতারা বেগম খাওয়া শুরু করলেও তৃধা খাবারের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। তৃধাকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে সেতারা বেগম বলে উঠলো,, খাও না কেন? মাছ দিবো?
ফরিদা হক তৃধার প্লেটের দিকে তাকিয়ে দেখে করলা ভাজি দেওয়া। তিনি কিছু বলবে তার আগে নুসাইব তৃধার প্লেট থেকে করলা তুলে নিয়ে নিজের প্লেটে রাখতে রাখতে বলল,, ও করলা পছন্দ করে না। করলার চামচ অন্য তরকারিতে দিলে সেই তরকারিও খায় না। তুমি সেই করলাই দিলে।
তৃধা অবাক হয়ে তাকায় নুসাইবের দিকে। এতো কিছু তার জানার কথা নয়। এতোসব খেয়াল করলো কখন?
ফরিদা হক মুখ টিপে হাসছে। নাবীব শেখ ভাত মুখে পুরলেও চাবানো ভুলে গেছে। সেতারা বেগম ফোঁড়নকেটে বললো,, নাতিতো দেখি অনেকটাই এগিয়ে গেছে। সব দিকে খেয়াল তার। এইদিকে তৃধার মনে হচ্ছে তার দু’কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে। সোয়েব শেখ গালা ঝেড়ে বললো,,”আহ্হা,, সেতারা! ওদেরকে ওদের মত থাকতে দাও না। দেখো মেয়েটা তোমার কথার কারনে খেতেই পারছে না।
নুসাইব মৃদু হেসে তৃধার পাতে সবজি আর মুরগির মাংস তুলে দিতে দিতে ধীরে সুস্থে বলে উঠলো,, সব পূর্বপুরুষদের থেকে শেখা। পছন্দের প্রতি যত্নবান হওয়া খারাপ কিছু নয় দাদু। দাদাকে দেখছো না! পছন্দ করে দেখেই তো তোমার যত্ন নেয়, তোমাকে সহ্য করে আবার ভালোও বাসে। আমি সেই দাদার নাতি বলে কথা।
নুসাইবের কথায় সেতারা বেগম মুখ গোমড়া করলেও। প্রায় সবাই মিটমিট করে হাসছে। এর মধ্যে তৃধাও বাদ যায়নি।
খাওয়া দাওয়া শেষ হতে না হতেই সবাই সবার নির্ধারিত ঘরে চলে গেলো। তৃধার সময় কাটছে না। সে টিভিতে ছবি দেখছে তার পাশে সায়রা বানু বসে মনোযোগ সহকারে টিভির দিকে তাকিয়ে আছে।
_____
তমাল আর নবনী তিন্নির সাথে গল্প জুড়ে দিয়েছে। এক পর্যায়ে নবনী বলে উঠলো,, আপু তাড়াতাড়ি টিকেট কেটে ফেল। তৃধা আপু রাজি হলেই সানাই বেজে ধুমধাম করে ভাইয়া বিয়ের কাজ সেরে ফেলবে।
তমাল মাথা চুলকে বললো,, আমি শপিং এখন থেকেই শুরু করবো।
তিন্নি ভ্রু জোড়া কুঁচকে তাকিয়ে বলল,, তৃধা রাজি হলে ভাইয়া বিয়ে সেরে ফেলবে মানে? তৃধার রাজি হওয়া না হওয়ার সাথে ভাইয়ার বিয়ের সম্পর্ক কি?
তিন্নির কথায় তমাল নবনী দুইজনেই সকের মধ্যে আছে। তিন্নি জানে না ব্যাপারটা মেনে নিতে দুইজনেরই কষ্ট হচ্ছে। তমাল ফট করে কল কেটে দিল। তিন্নির সাথে কথা বলা আর বাঁশের সাথে মাথা ঠুকতে থাকা একই কথা। ভাইবোনের মধ্যে তিন্নি হচ্ছে বিয়েতে আসা সেই ফুফা যার মান ভাঙ্গাতে ভাঙ্গাতে বিয়ে শেষ হয়ে বাচ্চার আকিকা দেওয়ার সময় পর্যন্ত চলে আসে। এই মুহূর্তে তিন্নি প্রশ্নের ঝড় তুলবে। তমালের এতো সময় নেই সেই সবের উত্তর করার। তাছাড়া তমাল তিন্নিকে ভয় পায়। এই দিকে নবনী পড়েছে মহা বিপাকে। এই মুহূর্তে বোনকে কোথা থেকে ঘটনা বলবে সেটাই বুঝতে পারছে না। তিন্নি কল কেটে ভিডিও কল করলো। তমাল ডাটা অফ করে বসে আছে। অগত্যা নবনীকে রিসিভ করতে হলো। নবীর কিছু করার নেই। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবটাই তিন্নিকে জানায়। এই দিকে তিন্নি রেগে একাকার। তার ভাইকি ফেলনা নাকি? ভাই যথেষ্ট সুদর্শন, শিক্ষিত, স্মার্ট তার জন্য দরকার যোগ্য কাউকে। সেখানে তৃধার তার ভাইয়ের পাশে দাঁড়ানোর যোগ্যতাও নেই। কথায় আছে সিচুয়েশন ততক্ষন স্বাভাবিক যতক্ষণ না আপনি সেটা ফেইস করছেন । ঠিক তেমনি অন্যের দুঃখে কষ্টে ততক্ষন সহানুভূতি দেখানো যায় যতক্ষণ না সেটা আপনি অনুভব করছেন। তদ্রুপ অন্যের দূর্ভাগ্য দেখে আফসোসের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছালেও সেই দূর্ভাগাকে কেউ আপন করতে চায় না। তিন্নি তৃধার ব্যাথ্যায় ব্যাথিত হলেও তৃধাকে মেনে নেওয়া সহজ নয়। দুর থেকে তৃধা পছন্দ হলেও আপনের তালিকায় তৃধা নেই।
নবনী কি বলবে বুঝতে পারছে না। সে ফট করে কল কেটে দিয়ে মাকে কল করলো। নবনীর আগে তিন্নি কল দিয়ে শা*সিয়েছে সে কিছুতেই তৃধার সাথে নুসাইবের বিয়ে হতে দিবে না। ফরিদা হক অনেক বুঝানোর চেষ্টা করেও বুঝাতে ব্যর্থ হয়। শেষে তিনি কল কেটে মাবাইলটা বিছানার অপর প্রান্তে ছুঁ*ড়ে মারলো। নাবীব শেখ হাতের বইটা রেখে ফোন বন্ধ করে দিয়ে বললো,, এতো টেনশন করো না।শুয়ে পড়ো।
ফরিদা হক নাবীব শেখের কথায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে নিলে। নবনী কি করবে বুঝতে পারছে না। তিন্নির যে মেজাজ যে কোনো মুহূর্তে যে কোনো কান্ড বাঁধিয়ে ফেলবে। নবনী তমালকে কল দিয়ে সবটা জানায়। তমাল বিরক্ত হয়ে লম্বা এক মেসেজ লিখে নুসাইবকে পাঠালো।
যদিও যাকে নিয়ে এতো হইচই হচ্ছে তার খবর নেই। সে মুভি দেখতে দেখতে হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে তার সাথে সায়রা বানুও।
নবনী তিন্নির বর চিন্ময়কে মেসেজ দেয়। চিন্ময় মেসেজ দেখে তিন্নির খোঁজ শুরু করে। তিন্নি বাসার কোথাও নেই। এই সময় এপার্টমেন্ট থেকে বের হবে না তাই ভালো করে খুঁজে বেলকনিতে পেলো। তিন্নি তার দাদির সাথে কথা বলছে। যতক্ষণে চিন্ময় টের পায় তিন্নি কার সাথে কথা বলছে ততক্ষণে অনেকটাই দেরী হয়ে গেছে। দরজা থেকে সরে গিয়ে নবনীকে কল দেয়। প্রথমবার বাজতেই রিসিভ করলো নবনী। এরপর চিন্ময় যা বললো তাতে অবস্থার গতিবেগ খারাপের দিকে যাচ্ছে বলে ধারনা করছে নবনী। চিন্ময়ের সাথে কথা শেষ করে মায়ের ফোনে কল করলো। অনলাইনে না দেখে এইবার নাম্বারে কর করলো। প্রথমবার রিসিভ না করলেও পরক্ষনে ঠিকই রিসিভ করে। নবনী তার মাকে সবটা জানানোর পর তিনি আর শুয়ে থাকতে পারলেন না। শোয়া থেকে উঠে একপ্রকার দৌড়ে বের হলেন।
নুসাইব তমালের দেওয়া মেসেজ দেখে না ঘাবড়ালেও নবনীর পাঠানো মেসেজ দেখে আর বসে থাকতে পারলো না । তড়িঘড়ি করে রুম ছেড়ে বের হয় । তার দাদিকে সে চেনে। গুছানো সংসারে পে*ট্রোল ঢেলে আ*গুন দেওয়ার ব্যাপারে সে ওস্তাদ।
ফরিদা হক ঘামযুক্ত মুখশ্রী আচল দিয়ে মুছতে মুছতে বললো,, এখনো ঘুমাসনি?
তৃধা টিভি থেকে চোখ সরিয়ে বললো,, ঘুম আসছে না আন্টি। এইজন্য টিভি দেখছি।
এর মধ্যে নুসাইব এসে পড়লো। নুসাইব মায়ের চিন্তিত মুখ দেখে বুঝলো ঘটনা সম্পর্কে ফরিদা হক নিজেও অবগত। নুসাইব মায়ের দিকে তাকি চোখ বুজে আস্বস্ত করলো।
গলা ঝেড়ে বললো,, ঘুম না আসলে চলো।
তৃধা ফরিদা হকের দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে বললো,, কোথায়?
নুসাবই গাড়ির চাবি দেখিয়ে বললো,, একটা ফ্রেন্ড বউ নিয়ে হসপিটালে গেছে । আমার হেল্প লাগবে,বলেছিলো নবনী থাকলে নিয়ে যেতে যেহেতু মেয়েলি ব্যাপার আছে। এখন তো নবনী নেই। এই জন্য ভাবলাম তোমাকে নিয়ে যাই। যাবে?
ফরিদা হক তাড়াহুড়ো করে বললো,, অবশ্যই যাবে। অন্যের বিপদে পাশে দাঁড়ালে আল্লাহ খুশি হয়। যা মা।
ঘুরতে যাওয়ার কথা হলে তৃধা অবশ্যই না করে দিতো। কিন্তু এখন সেটা করবে না। এই মুহূর্তে তাদের সাহায্য করা উচিৎ। তৃধা রিমোট সায়রা বানুর হাতে দিয়ে বলল,, চেন্জ করতে হবে?
নুসাইব তৃধার পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার ভালো করে দেখে বললো,, পারফেক্ট। চেন্জ করার প্রয়োজন নেই । শুধু জুতো চেন্জ করে নাও।
তৃধা নতুন জুতো পরে বললো,, চলুন।
নুসাইব মায়ের দিকে তাকায়। ফরিদা হক রিনরিনে গলায় বলল,, আমি সামলে নিবো। তুই যা।
নুসাইব জানে তার মা সবটা সামলে নিবে। নিজের বেলায় মুখ বুজে সহ্য করলেও সন্তানের ব্যাপারে একচুলও ছাড় দিবে না। আপাতত তাকে বের হতে হবে। এই মুহূর্তে তৃধাকে বাড়িতে রাখা ঠিক হবে না।
নুসাইব গাড়ি স্টার্ট দিতে না দিতেই সেতারা বেগমের গলার আওয়াজ শোনা গেলো। তৃধা হড়বড়িয়ে বললো,, থামুন! আপনার দাদির মনে হয় কিছু হয়েছে। নুসাইব থামলো না বরং গাড়ি স্টার্ট দিয়ে একদম গেইটের সামনে নিয়ে স্লো করলো। দারোয়ান গেইট খুলে দেওয়ার পর বাড়ির সীমানা পেরিয়ে বললো,, দাদির কিছু হয়নি। তেমন সিরিয়াস কিছু হলে চিৎকার শুনতে না। এই মুহূর্তে সে তার আসল রূপে আছে, এই জন্য গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে মাত্র। এই আওয়াজ কম হওয়ার পর পর গোছানো সংসার গুলোতে ধস নামে।
নুসাইবের কথার ধরন , কুঁচকে থাকা কপাল বেঁয়ে গড়িয়ে পড়া ঘাম দেখে তৃধা বলে উঠলো,, এতো কিসের টেনশন আপনার? বন্ধুর জন্য নাকি দাদির জন্য?
নুসাইব গাড়ির স্টেয়ারিংএ এক হাত রেখে অন্য হাত দিয়ে কপাল মুছতে মুছতে মৃধু হেসে বলল,, তোমার জন্য।
চলবে,,,,
উপন্যাসের নাম::#আমি_আছি
লেখনিতে:#সাদিয়া_আফরোজ
পর্ব: ৩০ ( ২য় খন্ড)
,
,
,
,
,
,
সেতারা বেগম বাজ খাই গলায় ফরিদা হককে ডেকে উঠলো। স্ত্রীর চেঁচামেচিতে কাঁচা ঘুম ছুটে গেছে সোয়েব শেখের। চেঁচামেচির কারণ জিজ্ঞেস করার আগেই রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেছে সেতারা বেগম। ফরিদা হক টিভি বন্ধ করে সোফা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি জানতো এমন কিছুই হবে। এইজন্য তৃধা নুসাইব বের হওয়ার পরেও তিনি নিজ ঘরে গেলেন না। সায়রা বানু সোফা ছেড়ে দুরে সরে দাঁড়ালেন। বয়স হলেও সেতারা বেগম এখনো বেশ শক্ত পোক্ত মানুষ। হড়বড়িয়ে রুম থেকে বেরিয়ে সোজা ফরিদা হককের সামনে। ফরিদা স্বভাব সুলভ নরম গলায় বলে উঠলো,” কিছু লাগবে মা?”
রাগে থর থর করে কাঁপছে সেতারা বেগমের শরীর। তিনি রেগে ধমকের সুরে বলল,” চুপ করো! এতো দরদ দেখাতে হবে না। তোমার কি মনে হয়? আমার থেকে এতো বড় ঘটনা লুকাবে আমি জানবো না? রাস্তা থেকে তুলে আনা মেয়েকে বান্ধবীর মেয়ে বলে পরিচয় দিচ্ছো। জাত নেই ,বংশ নেই, রাস্তা থেকে তুলে এনেছো।তারউপর আগে এক বিয়ে হয়েছে জেনেও আমার নাতির গলায় ঝুলিয়ে দিচ্ছো। কত বড় সাহস? আমার থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে কম করছো না। নিজে যেমন , ঘরেও তেমন তোলার চেষ্টা করছো। ভেবেছো আমি কিছুই টের পাবো না? এমনিতেই আমার ছেলের জিবন ধ্বং*স হয়ে গেছে। আমার নাতির জিবন কিছুতেই ধ্বং*স হতে দিবো না। আজকেই মেয়েটাকে ঘা*ড় ধরে বের করে দিবো। এমন মেয়েকে আমি জিবনেও নাত বউ হিসেবে মেনে নিবো না।
সোয়েব শেখ রাগে হিস হিস করছে। স্ত্রীকে নিয়ে কোথাও গিয়ে শান্তি নেই। একটা না একটা ভেজাল বাঁধিয়ে বসবেই বসবে।
পেছনে দাঁড়িয়ে আছে নাবীব শেখ। মায়ের ব্যবহারে চোখ মুখ বন্ধ করে নিলো। যেখানে নাবীব শেখ নিজের স্ত্রীর অতীত নিয়ে কখনো কিছু বলেনি সেখানে তার মা এতোটা আ*ঘা*ত দিয়ে বলছে। না জানি ফরিদার কতটা কষ্ট হচ্ছে।
ফরিদা হক কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল,, আপনি আমার মায়ের বয়সী,তাই আমি আপনাকে কিছুই বলি না। কিন্তু,,
ফরিদা হক-কে বলতে না দিয়ে সেতারা বেগম বলে উঠলো,, আমাকে কিছু বলার যোগ্যতা তোমার নেই ফরিদা। তুমি আমার সাথে কথা কেন আমার পাশে,,,
ফরিদা হক হাত উঠিয়ে বলল,, থামুন। এতক্ষণ আমি শুনেছি এইবার আপনি শুনুন। এতো বছরে কিছু বলিনি তার মানে এই না যে এখনো বলবো না। আপনি সাত বছরের আমাকে কম জ্বা*লাননি। এক একটা দিনকে জা*হা*ন্নামে পরিনত করেছিলেন। আমি কিছুই ভুলিনি। শুধু মাত্র আপনার ছেলের জন্য আমি সব সহ্য করে গেছি। একটা শব্দ পর্যন্ত করি নি। শা*রীরিক অ*ত্যা*চা*রে খান্ত হতেন না মানসিক অ*ত্যা*চার শুরু করে দিতেন। মা,আপনি আমার ছোট্ট ছেলেটাকেও ছাড়েন নি। একটা ছোট্ট বাচ্চাকে সব সময় তার মায়ের বিরুদ্ধে উস্কে দেওয়া কোনো ভালো মানুষের কাজ নয় । এতো এতো কথা শোনাতেন যে টিকে থাকা মুশকিল হয়ে যেতো। তার উপর ছেলের কাছে নালিশ তো ছিল রোজকার ঘটনা। শুধু মাত্র মা ছেলের সম্পর্কে ফাটল ধরবে দেখে কিছু বলিনি তখন। যদিও আল্লাহ আমাকে প্রচুর ধৈর্য্য, সহ্য শক্তি দিয়েছেন। আমি সহ্য করে গেছি। আমার উপর অ*ত্যা*চার করলে এখনো সহ্য করতে পারবো। কিন্তু আমার ছেলে মেয়েদের নিয়ে কিছু বললে, ওদের সিদ্ধান্তের উপর কর্তৃত্ব ফলানোর চেষ্টা করলে আমি ছেড়ে কথা বলবো না। এর জন্য যদি সমাজ আমাকে নিয়ে কু*ৎসা রটায় সমস্যা নেই। যদি আপনার ছেলে আমাকে ছেড়ে দেয় তাও সমস্যা নেই। আমি মা আমার ছেলে মেয়ে উপর আমার অধিকার বেশি। ওদের ভালো খারাপ আমি বুঝবো। ওদের বিয়েও আমি দিবো। প্রয়োজনে চার বিয়ে করা মহিলার সাথে বিয়ে দিবো। এতে আমি অবশ্যই আপনার থেকে পারমিশন চাইবো না। অধিকার ফলানোর হলে আপনি আপনার বাকি তিন ছেলেমেয়ের সংসারে গিয়ে ফলান। আমার সংসারে আপনার কোনো এখতিয়ার নেই। তাছাড়া তৃধা এখন আমার সংসারের অংশ। তাকে বের করা না করা সম্পূর্ণ আমার সিদ্ধান্ত হবে। এতে আমি আপনার কোনো কথাই শুনবো না। আমার ছেলের পছন্দ আমারো পছন্দ। বউ করতে হলে তাকেই করবো। আপনি এখন তৃধার জাত বংশ নিয়ে পড়ে আছেন, আমার তো জাত বংশ সবই ছিলো। তখন কেন রাজি হননি? আপনার মত জাত,বংশ, আগের বিয়ে ,সমাজ , সম্মান এইসবের দোহাই দেওয়ার সময় আমার নেই। তাছাড়া মনুষ্যত্বহীনের মত আচার আচরন করার শিক্ষা আমার পরিবার আমাকে দেয়নি। যাদের দিয়েছে তারাই এমন আচরণ করে। আসছেন যখন যতদিন ইচ্ছে ততদিন শান্তিতে থাকেন।তবে আমার সংসারে আ*গু*ন লাগানোর চিন্তা যদি মাথায় থাকে এক্ষুনি বেরিয়ে যান। যাওয়ার সময় আপনি আপনার ছেলেকেও নিয়ে যেতে পারেন। যেহেতু আমি তার জিবন ধ্বং*স করেছি। নিয়ে গেলেও আমি আপত্তি করবো না।
ফরিদার কথায় হতবিহব্বল হয়ে তাকিয়ে আছে নাবীব শেখ। কিছু কথা আজ নতুন শুনলো। কিছু না জানা, না শোনা অভিযোগ শুনে বারে বারে অবাক হচ্ছেন। কই ফরিদা তো আগে কখনো এইসব বলেনি?
সেতারা বেগম আঙ্গুল তুলে বললো,, তোমার সাহস দেখে অবাক হচ্ছি। তোমার সাহস কি করে হয় আমাকে এতো কথা শোনানোর। শিক্ষার অভাব, বড়দের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় পরিবার শেখায়নি?
,” আমার সাহস আপনি কিছুই দেখেন নি মা। তাছাড়া পারিবারিক শিক্ষা আছে বলেই তো এতো দিন চুপ ছিলাম। না থাকলে তো আপনার মতই কথা বলতাম। অন্য কেউ বললেও অন্তত আপনি আমাকে পারিবারিক শিক্ষার কথা বলতে পারেন না।”
সেতারা বেগম রেগে স্বামীকে বলে উঠলো,, দেখেছো সোয়েব । দেখো ভালো করে তোমার ভালো বউয়ের নমুনা। আরো করো প্রশংসা।
সোয়েব শেখ ফরিদার দিকে তাকিয়ে বলল,, দেখছি সেতারা দেখছি। এ ও দেখছি তুমি ঠিক কতটা শাসন করেছিলে । সেতারা,,! র*ক্তে মাং*সে গড়া মানুষ ভালো হলেও ফেরেশতা হয় না। ফরিদা ভালো মানুষ তবে ফেরেশতা নয়। বিয়ের এতো বছর পরেও যখন তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলার সাহস পায়নি তখন সে অবশ্যই ভালো মানুষ। বরং তুমিই সম্মান ধরে রাখতে পারোনি। বউমার দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া পর্যন্ত কথা শুনিয়েছো।সে তার ছেলে মেয়েকে বিয়ে দিবে। তোমার কাজ তুমি শুধু দোয়া করবে। তা না করে তুমি ঝগড়া করছো। তুমি দাদি অবশ্যই তোমার জিজ্ঞেস করার অধিকার আছে। কিন্তু এইভাবে জিজ্ঞেস করার অধিকার নেই। বউমা সহ বসে সবটা জিজ্ঞেস করতে। খারাপ হলে ভালো বুদ্ধি দিতে , ভালো হলে খুশি হতে। তুমি সেটা না করে তার অতীত ঘেঁটে আনছো,তার পারিবারিক শিক্ষা নিয়ে কথা বলছো। ভেবো না আমি তাকে সাপোর্ট করছি। অবশ্যই তার ভুল আছে । কিন্তু তাকে ভুল করার জন্য উস্কে তুমিই দিয়েছিলে সেতারা। তর্কের পিছনে তোমার কন্ট্রিবিউশন বেশি। ছেলের সংসার সাজাতে সাহায্য করো , ভাঙ্গার জন্য তো অনেকেই আছে।”
ফরিদা হক মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। শ্বাশুড়ি সম্পর্কে হাজারটা অভিযোগ থাকলেও শ্বশুরকে নিয়ে একটা অভিযোগও নেই তার কাছে। শ্বশুর নামক লোকটা তাকে সব সময় নিজের মেয়ের মতই স্নেহ করে এসেছে।
সেতারা বেগম সোয়েব শেখের দিকে তেড়ে গিয়ে বললো,, তোমার তো সবসময় আমার দোষ গুলোই চোখে পড়ে। তোমার চোখে আমিই খারাপ। এখনো তুমি চাইছো আমার নাতির সাথে ওই তা*লাকপ্রাপ্ত মেয়েটার হোক যেমনটা তোমার ছেলে করেছে। সেটাইতো চাইছো?
,” ভালো হলে অবশ্যই চাইবো। না চাওয়ার কি আছে? তাছাড়া আমার ছেলে ভুল সিদ্ধান্ত নেয়নি। কই! বউমাকে তো খারাপ দেখছি না! তেমন হলে এতো দিনে তোমার ছেলে তোমার সাথে সম্পর্কই রাখতো না। বাড়ির কথা এখন যা শুনলাম আর এই বাসায় বেড়াতে এসে যে ভাবে হে*নস্থা করতে এই সব দেখলে তোমার ছেলে সত্যি সম্পর্ক রাখতো না । তখন নাতি নাতনির মুখও দেখতে না। তোমার বউমা আর যাই করুক বসে বসে তোমার ছেলের কান ভাঙ্গেনি। তৃধা যদি আমার বউমার মত হয়, তাহলে অবশ্যই আমি চাইবো সে আমার নাতির বউ হোক।
সেতারা বেগম রাগে গজগজ করতে বললো,, সবাই আমাকে দোষারোপ করো। পারলে এক্ষুনি বের করে দাও আমাকে।
নাবীব শেখ মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। মায়ের ব্যবহারে বারংবার অবাক হচ্ছেন তিনি। লোকে ঠিকই বলে,’ মা চিনতে হলে ছেলেকে বিয়ে করতে হয়’। তার কাছে মনে হচ্ছে কথাটা আসলেই সত্য। তা না হলে আগে কখনো মাকে এই রূপে দেখেনি। সেতারা বেগম ছিলেন কোমলমতি মা, কোমলমতি নারী। কারো দুঃখে কেঁদে ভাসাতেন তিনি। আজ সেই কোমলমতি মা কোথায়? একজন নারী হয়ে আরেকজন নারীকে ছোট করে কথা বলার মত মানুষতো তার মা নয়! নাবীব শেখ হতাশ, হতভম্ব হলেও কিছু বললেন না। সন্তান কখনো মায়ের বিচার করতে পারে না। মা যেমনই হোক না কেন মাতো মা-ই হয়। মায়ের বিচার করার অধিকার সন্তানের নেই। নাবীব শেখ মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে বললো,, ‘তোমাকে কেউ দোষারোপ করবে না মা। তুমি যেমন আমার মা ,তেমনি ফরিদা তার সন্তানদের মা। আমার আর তোমার মাঝে ফরিদা যেমন তৃতীয় পক্ষ,তেমনি ফরিদা আর ফরিদার সন্তানদের মধ্যে দুনিয়ার সবাই তৃতীয় পক্ষ। সে তার ছেলেমেয়েদের ভালো খারাপ বুঝুক। এতে আমরা কেউ কথা না বলি। যাও মা ঘুমিয়ে পড়ো। বাবা তুমি মাকে নিয়ে যাও।
সোয়েব শেখ ছেলের কথায় সেতারা বেগমের হাত ধরে রুমে নিয়ে গেলেন। এইদিকে ফরিদা হক নিঃচুপ দাঁড়িয়ে আছে। নাবীব শেখ সায়রাকে ডেকে বললো,, সায়রা আমার ছেলেমেয়েরা যেন এই ব্যাপারে না জানে। ওরা কষ্ট পাবে,দাদিকে নিয়ে খারাপ ধারনা হবে। আর হ্যাঁ তৃধাও যেন না জানে।
সায়রা মাথা নেড়ে বললো,, ভাইজান আমি কখনোই বলবো না।
,” যাও ঘুমিয়ে পড়ো।
সেতারা বানু মাথা নেড়ে চলে গেলেন।
ফরিদা হক ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। ছেলের সামনে মাকে এতো কথা শোনানো তার উচিত হয়নি। নিশ্চয়ই নাবীব কষ্ট পেয়েছে? লোকটাকে কষ্ট পেতে দেখলে, ফরিদার নিজেই ম*রন য*ন্ত্র*ণা অনুভব হয়। কিন্তু আজ তো সে নিজেই ক*ষ্ট দিয়েছে। তীব্র অপরাধবোধ ঘিরে ধরেছে ফরিদাকে। চোখ জোড়া ভিজে আসছে তার।
নাবীব শেখ মাথা কাত করে নিজের স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে দেখছে। ফরিদা হককের চোখ বেয়ে টুপ টুপ করে পানি পড়ছে ফ্লোরে। নাবীব শেখ আলগোছে ফরিদার মাথায় হাত রেখে সুধোয়,,” কাঁদছো কেন?”
_____________
হসপিটাল হলেও লোকজনের সমাগম কম নয়। কেউ ইমারজেন্সিতে ছুটে যাচ্ছে তো কেউ আবার অপারেশন থিয়েটারের দিকে। কেউবা আবার ঔষধপত্র কেনার জন্য হসপিটাল সংলগ্ন ডিসপেন্সারির দিকে । রোগী রাখার ওয়ার্ড গুলোর দিকে তেমন ভীড় নেই। সেখানে প্রায় সবাই ঘুমোচ্ছে। তৃধা আর নুসাইব অপারেশন থিয়েটারের সামনে পেতে রাখা চেয়ারে বসে আছে। যার বউ তার খবর নেই। অপারেশনের জন্য যখন তার স্ত্রীকে তৈরি করা হচ্ছিল তখনই সে অজ্ঞান হয়ে পড়ে। আপাতত তার স্যালাইন চলছে। এই দিকে তার শা*লাসাহেব হসপিটালে আসছে বলে জানালো।
বেশ কিছুক্ষণের নিরবতা শেষে তৃধা বলে উঠলো,, বেহুঁশ হওয়া লোকটা আপনার ক্লোজ ফ্রেন্ড? আচ্ছা ওনার বাড়ির লোকজন কোথায়? ওনারা আসেনি কেন? এখন ওনার স্ত্রীকে কে দেখবে? বেচারা বউয়ের টেনশনে বেহুঁশ।
তৃধা কপাল কুঁচকে কথা গুলো বলছে। দেখে বেশ বুঝা যাচ্ছে এইসব নিয়ে টেনশনে আছে।নুসাইব সোজাসুজি না তাকালেও আড়চোখে দেখছে তাকে। সোজা চোখে তাকালেই তো দোষ। মেয়েটা কথা বলাতো দুরের কথা, তখন তাকাতে ওবদি পারে না।
নুসাইব গলা ঝেড়ে বললো,, ক্লোজ বলতে , নাছিম কলেজে দু’বছর পড়েছে আমার সাথে। তখন এতো বেশি কথা হতো না। এরপর মাঝে মধ্যে যোগাযোগ হলেও অনেক বছর তার সাথে দেখা সাক্ষাৎ হয়নি। দুদিন আগে একটা নাম্বার থেকে কল আসে। কথা বলে জানতে পারলাম নাছিম কল দিয়েছে। খুব ক্লোজ না হলেও দুরের কেউও না। খুব ভালো বন্ধু আমার। প্রেমের বিয়ে দুই পরিবারের কেউ মেনে নেয়নি দেখে দুজন পালিয়ে বিয়ে করে। ওর ওয়াইফের প্রেগন্যান্সির কথা শুনে মেয়ে পক্ষের মন গলে গেলেও ছেলে পক্ষ মানে নাছিমের মা-বাবা কেউ মেনে নেয়নি। তাই কেউ আসেনি।
,”সেটা নাহয় বুঝলাম। কিন্তু মেয়ের পরিবার?”
,” এক ভাই আছে সে আসছে। মা অসুস্থ তিনি চাইলেও আসতে পারবে না। বাবা নেই কিছুদিন আগে মা*রা গেছে।”
,”ওহ্ আচ্ছা।”
,” অপেক্ষা করো দেখতে পাবে।”
হসপিটাল লবি দিয়ে দৌড়ে আসছে রুমেল। একটা ছেলেকে দৌড়ে আসতে দেখে দেখে তৃধা বললো,, মনে হয় ভাই এসে গেছে।”
তৃধার দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকালো নুসাইব। ভাইয়ের জায়গায় রুমেলকে দেখে উঠে দাঁড়ালো।
রুমেল হাঁটু ভর দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,, স্যার আপনি এইখানে?
,” তুমিই নাছিমের?”
,”জ্বী স্যার আমি দুলাভাইয়ের একমাত্র শা*লা। কিন্তু আপনি?”
,”ফ্রেন্ড।”
নুসাইবের চমকানো চেহারা দেখে মিট মিট করে হাসছে তৃধা।
,”স্যার দুলাভাই কোথায়? আপুকে অটিতে নিয়েছে কখন।”
,” নাছিমকে স্যালাইন দেওয়া হচ্ছে আর তোমার আপুকে দশ মিনিট আগে ওটিতে নেওয়া হয়েছে।”
,” ওহ্ আচ্ছা। ”
তৃধার দিকে চোখ পড়ায় রুমেল ফট করে জিজ্ঞেস করে বসলো,, স্যার উনি আমাদের ম্যাম?
নুসাইবের উত্তরের আশা না করেই রুমের তৃধার দিকে তাকিয়ে বলল,, আসসালামুয়ালাইকুম ম্যাম! কেমন আছেন ?
এইদিকে তৃধা একবার রুমেলের দিকে তাকাচ্ছে আরেকবার নুসাইবের দিকে তাকায়। সালাম নিতেও পারছে না আবার চুপ করে থাকাটাও উচিৎ নয়। তাই বলে উঠলো,, ওয়া আলাইকুম সালাম। কিন্তু আমি আপনার স্যারের ওয়াইফ নই।
ওয়াইফ নই কথাটা শুনেই নুসাইবের চেহারার রং পাল্টে গেলো। রুমেল নুসাইবের চেহারার পরিবর্তন লক্ষ্য করে বললো,,’ সমস্যা নাই, হতে কতক্ষন ম্যাম।’
রুমেলের কথায় তৃধা লজ্জা পেলেও নুসাইবের বক্র হাসি লক্ষনীয়।
রুমেল টেনশনের মাঝেও সেই হাসি এনজয় করছে।
_________
তোয়ালে মোড়ানো বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে বসে আছে তৃধা। বাচ্চাটা কিছুক্ষন কান্না করছে তো কিছুক্ষন চুপ করে ঘুমাচ্ছে। নুসাইব বার বার এসে বাচ্চাটাকে দেখে যাচ্ছে। কখনো গালে আঙ্গুল ছুঁয়ে দিচ্ছে,আবার কখনো বাবুর হাত ধরে দেখছে। তা দেখে তৃধা বলে উঠলো,”কোলে নিবেন?”
,”না না ঠিক আছে। তুমি নাও।”
তৃধা বুঝতে পারছে নুসাইবের ইচ্ছে থাকলেও বলতে পারছে না। তৃধা নুসাইবকে বসতে বলে আলতো হাতে বাবুকে তার কোলে তুলে দিলো। নুসাইব বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে আদুরে গলায় কথা বলছে। তৃধা বুঝে পায়না ছেলে হয়েও এতো গুছিয়ে কোলে নিলো কিভাবে। পরক্ষনেই মনে পড়লো ফরিদা হকের কথা। তিনি বলেছিলেন নুসাইব নবনীকে কোলে নিতো খেয়াল রাখতো। দু একদিন নয় বরং অনেক সময় ধরে।
এর মধ্যে নাছিম কেবিনে প্রবেশ করে। চুল উস্কে খুস্কো হয়ে আছে তার উপর চোখ মুখের কি অবস্থা। যে কেউ দেখলে বলবে রাস্তা থেকে পাগল উঠে এসেছে। নাছিম তার স্ত্রী চারুলতার চোখ মুখ মুছে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।
তৃধা অবাক তাকিয়ে রয়। স্ত্রীর অবস্থা দেখে এতোটা কাতর হতে কাউকে দেখেনি তৃধা। এতোটা ভালোবাসা আধেয় কি সম্ভব? অন্তত এখনকার সময়ে এমন দৃশ্য খুব একটা দেখা যায় না। মুগ্ধ হয়ে দেখছে তৃধা। তার সাথে মনে মনে বার কয়েক দোয়া করলো তাদের জন্য।
তৃধার এহেন চাহনি দেখে মৃদু হাসলো নুসাইব। আদরমাখা চোখে ভালোবাসা দেখছে তৃধা। চোখ দুটো বলছে ,,”ইস্!এমন যদি আমায় কেউ ভালোবাসতো। নুসাইব ভালো করেই জানে। তৃধা আর কিছুতে নয় বরং ভালোবাসায় আটকায়।
চলবে,,