আমি আছি পর্ব-৩৪+৩৫+৩৬

0
1001

উপন্যাসের নাম::#আমি_আছি
লেখনিতে:#সাদিয়া_আফরোজ
পর্ব: ৩৪
,
,
,
,
,
তৃধাকে জোরজবরদস্তি গেষ্ট রুম থেকে বের করে তালা ঝুলালো নবনী। হাতে পায়ে মেহেদী দেওয়াতে নড়তেও কষ্ট হচ্ছে তার। নবনী হাত ঝেড়ে বললো,, কাজ শেষ।আজ থেকে এই রুম তোমার জন্য নিষিদ্ধ। তুমি তোমার বরের সাথে থাকবে।

ব্যাপারটা স্বাভাবিক হলেও তৃধার সংকোচের ইয়াত্তা নেই। তীব্র অস্বস্তিতে ভুগছে সে। দুহাতের দিকে তাকিয়ে বলল,, এই মুহূর্তে যাওয়া জরুরি? কোথাও একটু বসি, কোমর ব্যাথা করছে।

নবনী ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে বরাবর এগারোটা। ভাইয়া আসার সময় হয়েগেছে। নবনী মাথা নেড়ে বললো,,সেটা আর হচ্ছে না। তুমি তোমাদের রুমে রেষ্ট নিবে চলো। খাওয়া দাওয়া তো শেষ প্রয়োজনে এক ঘুম দিয়ে সকালে ওঠো। এতে আমাদের সমস্যা নেই। শুধু গেষ্ট রুমে যাওয়া চলবে না। চলো চলো উপরে নিয়ে যাই।

অগত্যা তৃধাকে উপরে যেতে হলো। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে তৃধা। দম বন্ধ লাগছে তার। দ্বিধা দ্বন্দ্বে জড়িয়ে আছে সে‌। নবনীর কাছে তৃধার সমস্যা স্পষ্ট। নবনী লম্বা শ্বাস টেনে বললো,,” এতো সংকোচ বোধ করো না আপু। সব কিছুকে স্বাভাবিক ভাবে নাও। কিছু মূহুর্তের জন্য পেছনে ফেলে আসা সময় ভুলে যাও। মনে করো সব ভ্রম,সব দুঃস্বপ্ন। সমস্যা হলে ভাইয়ার সাথে কথা বলো। ট্রাস্ট মি ভাইয়ার অদ্ভুত এক ক্ষমতা আছে। দেখবে তোমার মন খারাপ, দ্বিধা দ্বন্দ্ব সব এক মুহুর্তে কেটে গেছে। আমি জানি তোমার জন্য সব সহজ হবে না। কিন্তু চেষ্টা করতে ক্ষতি কি? নিজেকে সাথে ভাইয়াকে একটা সুযোগ দাও। ভালোবাসা না হোক বন্ধু হওয়ার সুযোগ দাও। দেখবে ভালোবাসা এমনিতেই ধরা দিবে।
নবনীর বলা কথায় কোথাও না কোথাও একমত তৃধা। আসলেই সব কিছু স্বাভাবিক ভাবে নেওয়া উচিৎ। তাছাড়া পেছনে ফেলে আসা সময় মানুষ কেউ তার জন্য থেমে নেই। তাহলে সে কেন থাকবে? তৃধা লম্বা শ্বাস টেনে দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকলো। নবনী পেছন থেকে মুখ টিপে হেসে দরজা লাগিয়ে দিলো। তৃধা অবাক চোখে তাকিয়ে রয়। রুমটা চেনা যাচ্ছে না। পরিপাটি রুমটা আজ ফুল দিয়ে সাজানো। পুরো ঘর জুড়ে মৌ মৌ করছে ফুলের ঘ্রাণ। রজনীগন্ধা আর গোলাপ দিয়ে আবৃত বিছানার চারপাশ। হেঁটে হেঁটে দেখছে তৃধা। নুসাইব এসে দেখলে কি ভাববে? এই ভাবনা খানায় তৃধা শিটিয়ে যাচ্ছে। লোকটার জিবনে অন্য কেউ থাকলে এই রাতটা অন্য রকম হতো। এই রাত নিয়ে কতশত অনূভুতি তৈরি হতো হিসেব নেই। তৃধার খারাপ লাগাটা নুসাইবকে ঘিরে। তার জিবনে নিজের ছায়াটা মেনে নিতেই তো কষ্ট হচ্ছে তার। নুসাইব বড্ডো অবুঝ। ভাঙ্গা শামুকে পা কেটেছে। এইবার পুরো জিবন বিষিয়ে উঠবে তার। হুট করে এই সৌন্দর্য বিষাদে পরিনত হলো। দম বন্ধ লাগছে তৃধার। বেলকনির কাঁচের দরজা ঠেলে হড়বড়িয়ে বের হলো। বার কয়েক টেনে টেনে নিঃশ্বাস নিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। অতীত ,অপরাধবোধ দুটোতে মিলে কষ্টের পাহাড় তৈরি করছে মনে।

বাইরে পরিবেশটা ভিন্ন। তমাল রাফি আর রিমানকে নিয়ে আলোচনায় বসেছে। কিভাবে কি করতে হবে সেটা নিয়ে পরিকল্পনা হচ্ছে। ফরিদা হক গম্ভীর মুখে মোবাইল কানে নিয়ে বসে আছে। তিন্নিকে কল দিয়েছে। মা শত রাগলেও সন্তানকে তো আর ফেলে দিতে পারে না। সন্তানের মায়া বড় মায়া। তিনি রেগে থাকলেও নুসাইবের প্রতি তিন্নির ভালোবাসাটা বুঝেন। বোন ভাইয়ের ভালো চাইবে ব্যাপারটা নিতান্তই স্বভাবিক। তিন্নিও ভাইয়ের ভালো চায়। ভালো চায় বলেই তো তৃধাকে মেনে নিতে পারছে না।
তিন্নি কল রিসিভ করেনি বরং তিন্নির বর চিন্ময় করটা রিসিভ করে। চিন্ময় সালাম দিয়ে কুশলাদি বিনিময়ের পর ফরিদা হক বিয়ের কথাটা জানায়। চিন্ময় খুশি হলেও নিজের স্ত্রীর কথা ভেবে বললো,, আম্মু তিন্নি ভীষণ রেগে আছে। বিয়ে হয়ে গেছে কথাটা শুনলে আরো বেশি রাগবে।

ফরিদা হক শান্ত গলায় বলল,, চিন্ময় তুমি একটা কাজ করো বাবা।

,’ জ্বী আম্মু বলুন।’

,’ফোন স্পিকারে দিয়ে তিন্নির সামনে রেখে তুমি রুম ছেড়ে বেরিয়ে যাও। যতক্ষণ না তিন্নি নিজে রুম ছেড়ে বের হবে ততক্ষণ তুমি তিন্নির কাছে এসো না। মেয়েটা ভীষণ রাগি, কি বলতে কি বলে মনে কষ্ট দিয়ে দেয়। ‘

চিন্ময় বরাবরই বাধ্য সন্তান। সে কথার বরখেলাপ করে না। শ্বাশুড়ির কথা মত তিন্নির সামনে মোবাইল রেখে বেরিয়ে পড়লো।

ফরিদা হক গলা ঝেড়ে বললো,, তিন্নি আমি জানি তুই আমার কথা শুনছিস। এও জানি তুই আমাদের উপর রেগে আছিস।তোর রাগ করাটা ভীষণ স্বাভাবিক। কিন্তু রাগে বশিভূত হয়ে এমন কোনো কাজ করা ঠিক নয় যা সংসারে অশান্তি বয়ে আনে। তৃধাকে নিয়ে তোর দাদুর সাথে কথা বলাটা মোটেও ঠিক হয়নি। সে যাই হোক আসল কথায় আসি। সকালে নুসাইব আর তৃধার বিয়ে হয়ে গেছে। কাল বাদে পরশু ছোট করে অনুষ্ঠান করা হবে।

তিন্নি এতো সময় চুপ করে থাকলেও এইবার মোবাইল হাতে নিয়ে হতবাক হয়ে বলল,,’ বিয়ে হয়েগেছে মানে? কিসের বিয়ে হয়ে গেছে?

,” বিয়ে বিয়েই হয়। তৃধা আর নুসাইবের বিয়ে হয়েগেছে। ধর্মমতে দুজন হ্যাসবেন্ড ওয়াইফ। ”

তিন্নি রাগে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বললো,” তোমাদের সবার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। তোমরা আমার ভাইকে একটা বিবাহিত মহিলার সাথে বিয়ে দিয়েছো। ভাইয়ারও কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?”

ফরিদা হক কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল,” সেটা হলে তোর বাবাও আমাকে বিয়ে করা উচিৎ হয়নি। তখন হয়তো তোর বাবার মাথা খারাপ ছিল।

,” কিসের মধ্যে কি বলছো আম্মু? এইখানে বাবা আর তুমি আসলে কোথা থেকে?”

,” তৃধা নুসাইব এলে আমাদের কথা অবশ্যই আসে। শুধু নুসাইব নয় তোর বাবাও একটা বিবাহিত মহিলাকেই বিয়ে করেছে। যার আগে সংসার ছিল পরে তালাক হয়ে যায়। এর পর তোর বাবার মাথা খারাপ হয় সে ওই বিবাহিত মহিলাটাকে ভালোবেসে বিয়ে করে নেয়। এখন সেই মহিলা চার সন্তানের জননী। যাকে তোরা চার ভাইবোন আম্মু ডাকিস।”

তিন্নি একপ্রকার চিৎকার করেই বলে উঠলো,” পা*গল হয়ে গেছো ?কি আবোল তাবোল বলছো?”

ফরিদা হক মৃধু হেসে বলল,” তোর কি মনে হয়? তোর দাদু আমাকে কেন অপছন্দ করে? এতো মায়া এতো সম্মানের পরেও সে কেন আমাকে অ*পমান করে কথা বলে? তোর বাবা কেন তোদের গ্ৰামে নিয়ে যায় না? তিন্নি তুই ছোট না। একটু মাথা খাটিয়ে ভাবলে বুঝতে পারবি আমার কথা কতটা সত্য। তাছাড়া আমার অবস্থাও আগে তৃধার মত ছিলো বলে আমি তৃধাকে ছেলের বউ করিনি। বরং আমার ছেলে তৃধাকে চায় ,ঠিক যেমনটা তোর বাবা আমাকে চেয়েছিলো। তৃধা দিক থেকে কিছু না থাকলেও নুসাইবের দিক থেকে অনেক কিছুই আছে। শুধু আগে একটা বিয়ে হয়েছিলো বলে মেয়েটাকে তো ফেলে দেওয়া যায় না। তাছাড়া তার দোষ নেই বললেই চলে। মেয়েটা খারাপ না শুধু বিয়েটা ক*লঙ্ক হয়ে গেছে। তিন্নি, সবার দোষ গুণ থাকে। তৃধার মত আমারো এমন ক*লঙ্ক আছে। তাও তোর বাবা আমাকে নিয়ে ভালো আছে,সুখে আছে। আমাদের মাঝে কখনো দু’কথা হয়নি। আগামীতেও হবে না। আমি জানি আমার ছেলের ক্ষেত্রেও হবে না, যদি তোরা সবটা স্বাভাবিক ভাবে মেনে নিস। আমি আশা করবো আমার সন্তানদের মধ্যে কেউ তৃধাকে অসম্মান করবে না। তৃধাকে অসম্মান করা মানে আমাকে আমার অতীত নিয়ে অসম্মান করা।

ফরিদা হক কল কেটে দিয়ে গভীর নিঃশ্বাস ফেললেন। অন্যদিকে তিন্নি চি*ৎকার করে কাঁদছে। চিন্ময় তিন্নির কান্না শুনে হড়বড়িয়ে ঢুকলো রুমে। ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে তিন্নিকে জড়িয়ে ধরলো। তিন্নি তখনো কেঁদে যাচ্ছে। চিন্ময় জানে না তিন্নি কেন কাঁদছে। শুধু জানে তার বাচ্চার মা টা ভালো নেই। ফরিদা হককের কথা তিন্নির মনে গভীর প্রভাব ফেলছে। মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে তার। এমন বিয়ে নিয়ে কত সময় কত জনকে ফোড়ন কেটেছে হিসেব নেই কিন্তু এখন? তিন্নি কান্না বাড়ছে ব-ই কমছে না।
________

নুসাইব মাত্র বাড়ি ফিরেছে। গাড়ি থামতে তমাল ,রাফি আর রিমানকে নিয়ে ব্যাগ পত্র তুলে নিলো। তৃধার সাথে সাথে বাড়ির সবার জন্য শপিং করেছে নুসাইব। তমাল শপিং ব্যাগ গুলো রেখে রাফিদ, রিমানকে নিয়ে পুনরায় বেরিয়ে পড়লো।

নাবীব শেখ বাজারের লিস্ট তৈরি করছে। পাশে বসে ছেলেকে দেখিয়ে দিচ্ছেন সোয়েব শেখ। নুসাইবের কিনে আনা শপিং ব্যাগ গুলো দেখে ফরিদা হক অবাক হয়ে বললো,, কয় বছরের শপিং বাপ?

মায়ের কথা শুনে ক্লান্ত নুসাইব সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে বলল,, সবার জন্য করেছি তাই এতো মনে হচ্ছে। নাম লেখা আছে যার যার শপিং তাকে তাকে দিয়ে দিলে কমে যাবে। ‘
ফরিদা হক কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে বললো,, সর্বনাশ! তোর বোন বসে বসে আবার কিনছে। তাড়াতাড়ি মানা কর।’
নুসাইব ক্লান্ত গলায় বলল,, ‘আমি পারবো না। হাত পা ব্যাথা করছে।’

ফরিদা হক সায়রা বানুকে খাবার গরম করতে বলে পানির গ্লাস ছেলের দিকে এগিয়ে দিলেন। নুসাইব পানির গ্লাস থেকে দুই চুমুক পানি পান করে বললো,, ‘বাকিরা কই? সবার ডিনার কমপ্লিট?’

,’আমাদের সবার খাওয়া শেষ। তোর দাদু ঘুমাচ্ছে। তমাল সন্ধ্যা থেকে রাফিদ রিমানকে নিয়ে কিসব প্ল্যান করছে দেখলাম। আর নবনী তৃধাকে সন্ধ্যা থেকে শাস্তি দিয়ে বসিয়ে রেখেছে।’

নুসাইবের ভ্রু জোড়া কুঁচকে বললো,’ শাস্তি?’

,” তা নয়তো কি? সন্ধ্যা থেকেই মেহেদী দেয়াচ্ছে। না হাত নাড়াতে দিচ্ছে না পা নাড়াতে দিচ্ছে। এইদিকে তৃধা কিছু বলতেও পারছে না।”

নুসাইব মৃদু হেসে বলল,,’ থাক আম্মু ছোট মানুষ। একটু তো মজা করবেই। তুমি বরং আমাকে কিছু খেতে দাও। ভীষণ ক্ষিদা লাগছে।’

নাবীব শেখ কাজ করে শুতে চলে গেলেন। সোয়েব শেখও আর বসে নেই। তিনি রুমের দিকে হাঁটা ধরলো। হয়তো গিন্নী রেগে ঘুমায়নি। না জানি কি শা*স্তি অপেক্ষা করছে।

রাত প্রায় বারোটা।খাওয়া দাওয়া শেষ হতেই নুসাইব উপরে উঠে গেল। ফরিদা হক সায়রা বানুকে ঘুমাতে পাঠিয়ে নিজেই সবটা গুছিয়ে নিলেন।

এইদিকে রুমের সামনে ঘাঁটি গেড়ে বসে আছে তমাল নবনী। নুসাইব কোট কাঁধে নিয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। নবনী হাত পেতে বলে,, ‘টাকা না দিলে নো এন্ট্রি। ‘
তমাল দ্বিতীয় বারের মত বোনের সাথে সহমত প্রকাশ করলো।

এতো সময় নুসাইবের মনে না থাকলেও তমাল নবনীকে দেখে মনে পড়লো আজ তার আর তৃধার জন্য বিশেষ রাত। যাকে ফুলশয্যার রাতও বলে। বিশেষ রাত নিয়ে জল্পনা কল্পনা না করলে বন্ধ দরজার ওপাশের মানুষটাকে নিয়ে দারুণ চিন্তা হচ্ছে তার। এই দুটো নিশ্চয়ই তাকে অস্বস্তিতে ফেলেছে?

,” কি হলো ভাইয়া? দাও বলছি।”

নুসাইব দেরি করলো না। ওয়ালেটটা নবনীর হাতে দিয়ে বলল,, এক থেকে পাঁচ পর্যন্ত গুনবো এর মধ্যে দুজনকে যেন চোখের সামনে না দেখি।

নুসাইব এক থেকে পাঁচ পর্যন্ত গোনার আগেই দুইজন কেটে পড়লো।

রুমের মধ্যে পিনপিনে নিরবতা। নুসাইব চোখ বুলিয়ে খুঁজল তৃধাকে । তৃধা নেই কোথাও। বেলকনির কাঁচের দরজাটা হাট করে খোলা। নুসাইবের বুঝতে বাকি নেই সেই কাঙ্খিত ব্যাক্তি বেলকনিতেই আছে।

বেলকনিতে রাখা দুটো চেয়ারের একটাতে বসে আছে তৃধা। নুসাইবের উপস্থিতি উপেক্ষা করেছে নাকি টের পায়নি সেটা বুঝা যাচ্ছে না। নুসাইব গলা ঝেড়ে বললো,, মন খারাপ?

তৃধা চমকে উঠলেও দ্রুত সামলে নিলো নিজেকে। মাথা নেড়ে বললো,,” হ্যাঁ আবার না। মিশ্র অনুভূতি।”

চেয়ার টেনে তৃধার পাশে বসে নুসাইব। আগের মত স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল,, হ্যাঁ এর কারনটা বলা যাবে?’

,” লুকানোর কিছু নেই। বলা যায়।”

নুসাইব মুচকি হেসে বলল,” আমার সময় আছে শোনার মত, তুমি বলো।’

তৃধা সময় নিয়ে বলল,,’ মা-বাবার দোয়া ছাড়া প্রথমবার বিয়ে করেছিলাম। এইবারো তাদের ছাড়া বিয়ে হলো। মা-বাবার দোয়াটা ভীষণ জরুরী। এখন বুঝতে পারি। এই জন্য মন খারাপ হচ্ছে।’

,” বাবা-মায়ের রাগ সন্তানের উপর স্থায়ী হয় না। এখন রাগলে একটু পর ঠিকই বুকে টেনে নিবে। তোমার তো আড়াই বছর হলো তৃধা। দেখো হয়তো তাদের রাগ পড়েগেছে আরো আগে। তোমার ঠিকানা জানেনা দেখেই খোঁজ করতে পারেনি মনে হয়। একটা কাজ করো, কাল তুমি আমি গিয়ে উঠি বাসায়। দেখবে বাকি রাগটাও পড়ে গেছে।”

নুসাইবের কথা শুনে তৃধা মুচকি হেসে বলল,, অতো সহজ?

,”চাইলে সব সহজ। না চাইলে কঠিন। তুমি চাইলে আমি গিয়ে কথা বলবো।”

তৃধা মলিন হেসে বললো,,” মা-বাবা কেউ আপনাকে চিনবে না। তাছাড়া তারা রজবকে চেনে। পরিচয় দিতে গেলে কাহিনী লম্বা হবে। তার সাথে কষ্টটাও বাড়বে। এমনিতেই একবার মে*রে ফেলেছি। মান সম্মান সব শেষ করে দিয়েছি। আবার সম্মান মাড়ানোর সাহস নেই। তারা হয়তো ভালো আছে।”

নুসাইব ছোট করে নিঃশ্বাস ফেলে তৃধার দিকে তাকালো। এই আবছা আলোতে তৃধার চোখ জোড়া চিকচিক করছে। কাঁদতে চেয়েও হয়তো কাঁদছে না। নুসাইবের কষ্ট হলো ভীষণ। এই মেয়েকে আরো বছর আড়াই আগে দেখলে কি হতো? কেন এতো দেরি করে দেখলো। তখন দেখা হলে গল্পটা ভিন্ন হতো। পরিবার বাঁধ সাধলে পা ধরে বসে থাকতো। অন্তত তৃধাতো ভালো থাকতো।

তৃধার সজাক ইন্দ্রিয় জানান দিচ্ছে একজোড়া চোখ গভীর ভাবে দেখছে তাকে। সেই দিকে ফিরে তাকালো তৃধা। নুসাইব মৃদু হেসে বলল,, ‘ভাবতেই অবাক লাগছে আমার ঘরেও বউ আছে।’
নুসাইবের এহেন কথায় চমকালো তৃধা। হঠাৎ করে এমন কথা তাও নুসাইবের তম লোক থেকে?

নুসাইব মুচকি হেসে বলল,, ‘এতো চমকানোর কিছু নেই। আমার সর্ব প্রকার রসিকতা বউয়ের জন্য তোলা ছিলো বলেই আমি বেরসিক মানুষ নামে পরিচিত। তা না হলে আমারো মন আছে। বিগত কয়েক মাস কেউ সেখানে বসে রূপকথার চাঁদের বুড়ির মত চরকা কাটছে।’

চোখ জোড়া নামিয়ে নিলো তৃধা। লজ্জায় কুঁকড়ে যাওয়ার মত অবস্থা। নুসাইব ক্লান্ত চোখে তাকিয়ে বললো,, “এইবার বউ বউ লাগছে।”

_____________

ছবির এলবাম জুড়ে বাচ্চা মেয়ের ছবি। সেই এলবামের ছবি গুলো বার বার ছুয়ে দেখছে মায়া জাহান । কখনো বুকে জড়িয়ে ধরছে,তো কখনো ছবি গুলোতে চুমু আঁকছে। মাহাবুব ইসলাম দরজা থেকে সরে স্টাডি রুমের দিকে রওনা দিলেন। তাকে দেখলে মায়া ছবি গুলো লুকিয়ে ফেলবে। বিগত আড়াই বছর ধরে এমনটাই দেখে এসেছে। ভয়ে কাউকে কিছু না বললেও লুকিয়ে চুরিয়ে মেয়ের ছবি দেখে কাঁদে মায়া। মাহাবুব ইসলাম পাথর নন ,তিনিও র*ক্তে মাং*সে গড়া মানুষ। মেয়ের জন্য তার মনটাও কাঁদে। মেয়েটা একবার এসে যদি বলতো,’বাবা আমার ভুল হয়ে গেছে মাফ করে দাও।’ তিনি দেরি করতেন না। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে তার সকল ভুল ক্ষমা করে দিতেন। সমাজ কি বলবে মানুষ কি বলবে এইসবের ধার ধারতেন না। কিন্তু এই আড়াই বছরে মেয়েটা একবারো এই বাড়ির চৌকাঠ মাড়ায়নি। তিনিও অদৃশ্য শেকলে বাধা পড়ে মেয়ের খোঁজ নেয়নি। বয়সের ভারের চাইতে কষ্টের ভার বাড়ছে বেশি। মেয়েটাকে দু’চোখ দেখার জন্য মনটা বেসামাল হয়ে পড়েছে।

চলবে,,

উপন্যাসের নাম::#আমি_আছি
লেখনিতে:#সাদিয়া_আফরোজ
পর্ব: ৩৫
,
,
,
,
,
,
,
রাত গভীর নিস্তব্ধ চারপাশ। বিছানার দিকে তাকিয়ে দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভুগছে তৃধা নুসাইব। কে কোথায় শোবে সে নিয়ে দুজনের মস্তিষ্কে একই প্রশ্ন। নুসাইব তৃধার দিকে তাকিয়ে বলল,,’ তুমি শুয়ে পড়ো আমি গেষ্ট রুমে চলে যাচ্ছি।’
নুসাইবের কথা কাজে বারংবার অবাক হয় তৃধা। এই মুহূর্তেও সে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। নুসাইব নামক মানুষটার কাজে কথায় অবাক হওয়ারই মত। তার ভালোবাসা নিখুঁত, তার ভালোবাসায় বিনিময় নেই। সে অনূভুতির বিনিময়ে অনুভূতি চাইছে না। তৃধার উপস্থিতিই যেন পূর্ন করছে তাকে। নবনী থেকে শুনেছে তার ভাই নিজের রুম ছাড়া বিছানা ছাড়া ঠিক মত ঘুমোতে পারে না। কিন্তু এখন? তৃধা তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে।লোকটা তার দিকে দশ কদম বাড়িয়েছে ,তার উচিৎ অন্তত সেই লোকটার দিকে দুকম বাড়ানো। তৃধা বাঁধ সেধে বলল,, প্রয়োজন নেই যাওয়ার। ওই রুমের চাবি নবনীর কাছে। আপনিও থাকুন সমস্যা হবে না। তাছাড়া আমরা হ্যাসবেন্ড ওয়াইফ।এক বিছানায় থাকাই যায়।

,,” তুমি আনইজি ফিল করবে না?”

তৃধা মৃদু হেসে বলল,” অপরিচিত কেউ হলে করতাম। এখন বিয়ে হয়ে গেছে জনাব। তাছাড়া মানুষটা পরিচিত।

তৃধার কথায় হাসলো নুসাইব। সম্পর্কটা এমন স্বভাবিক হলে মন্দ হয় না।বলল,,” তুমি বসো আমি এইসব সরিয়ে রাখি।”

নুসাইব ফুলে ছিঁড়তে নিলে তৃধা আঁটকে দিয়ে বলল,, থাক ছেড়ার দরকার নেই। সুন্দর লাগছে। তমাল ভাই, নবনী এর পেছনে অনেক পরিশ্রম করেছে। এক রাত থাকলে সমস্যা হবে না।

,”আমার তো সমস্যা হবে না। তোমার জন্যই তো ক্লিন করছি।”

,”দরকার নেই। আমি ঠিক আছি।”

,” মেহেদী কি করবে? ধুয়ে ফেলবে?”

,” ধুলে রং হবে না। শুকনোই তুলে ফেলবো। আপনি বরং ঘুমিয়ে পড়ুন।”

নুসাইব তাকিয়ে দেখে তৃধা সোফায় বসে মেহেদী তুলছে। এতো এতো মেহেদী দিয়েছে কখন তোলা শেষ হবে কে জানে! নুসাইব হাঁটু গেড়ে বসে বললো,, ‘যে ভাবে তুলছো দু’দিন লাগবে। দাও আমিও হেল্প করি।’

তৃধা হাত গুটিয়ে বসে আছে। কি বলবে বুঝে পাচ্ছে না। নুসাইব মুচকি হেসে তৃধার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে মেহেদী উঠাতে উঠাতে বলল,,” লম্বা শ্বাস নাও তৃধা।ভাবো সামনে বসা লোকটা তোমার একান্ত ব্যক্তিগত। তোমার সুবিধা অসুবিধা সবটা তার জানা উচিত। সে না চাইলেও তাকে জোর করে জানানো উচিৎ। তার উপর তোমার অধিকার বোধ তীব্র। তুমি চাও না চাও সে তোমার ভালো খারাপে জড়িয়ে গেছে। তাকে ভালোবাসতে না পারো সমস্যা নেই। কিন্তু অধিকার তো খাটাতে পারো। এই মুহূর্তে তোমার কি বলা উচিৎ ছিল জানো?

তৃধা প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকালো।

,”বলা উচিৎ ছিলো’এখন ঘুমাবেন না নুসাইব। আপনার নামের মেহেদী দিয়েছি । এগুলো তুলে দেওয়া ছাড়া আপনার নিস্তার নেই। আসুন এই দিকে।’ অধিকার খাটাতে শেখো তৃধা। যা চুপিচুপি মন চাইবে তা বলতে শেখো। জড়তা কাটিয়ে মন খুলে কথা বলো। দেখো, এখনো কেমন চুপ করে আছো।

তৃধা আড়চোখে তাকিয়ে রিনরিনে গলায় বললো,, এতো তাড়া নেই এই জন্য। আজকেই এমন খবরদারি করলে চূড়ান্ত বে*য়া*দব মনে করতেন। এই জন্য চুপ করে আছি।

নুসাইব মুখ টিপে হেসে বলল,,” আমি ভদ্র , আমার কপালে চুড়ান্ত বে*য়া*দব বউই থাকার কথা ছিলো। কিন্তু কালে ক্রমে ভালো পেয়ে যাবো জানা ছিলো না। এখন আমাকে ডমিনেটিং হ্যাসবেন্ড হতে হবে।কি মুশকিল !

তৃধা চোখ জোড়া গোল গোল করে তাকিয়ে আছে। নুসাইবের ঠোঁটে দুষ্টু হাসি লক্ষনীয়। তৃধা মাথা কাত করে তাকালো। নুসাইব গলা ঝেড়ে বললো,,ওই ভাবে তাকালে আজকেই ভালোবেসে ফেলবে।
নুসাইবের কথায় বেকুব বনে গেলো তৃধা। লজ্জায় তৎক্ষণাৎ চোখ সরিয়ে নিল। তৃধাকে লজ্জা পেতে দেখে হাসছে নুসাইব। তৃধার রাগ লাগলো ভীষণ। সে হাত পা সরিয়ে নিয়ে বললো,, “আপনি একটা ধুরন্ধর লোক নুসাইব।”

__________

একমুঠো রোদ্দুর ছুঁয়ে দিচ্ছে তৃধাকে। রোজকার মত আজো মুখ লুকানোর চেষ্টা। পাশ ফিরে মুখ গুজেই থামকালো। বালিশেরও হৃদস্পন্দন আছে জানা ছিলো না। পিটপিট করে চোখ খুলতেই বালিশটা মানুষে রুপান্তরিত হলো। তৃধা চমকে উঠে তৎক্ষণাৎ সরে গেলো। বলা বাহুল্য বালিশে নয় বরং নুসাইবের বুকেই মুখ গুঁজে ছিলো তৃধা। ক্লান্ত নুসাইব তখনো গভীর তন্দ্রায় আচ্ছন্ন। ব্যাক্তিগত রমনীর সুমিষ্ট ভুলটা তার দেখা হলো না। তৃধা ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে। ভ্যাগিস ঘুমিয়ে আছে। নয়তো ভীষণ লজ্জা পড়তে হতো।

তৃধা চটজলদি উঠে পড়লো। অনেক বেলা হয়েছে গেছে। ফরিদা আন্টি চুপ থাকলেও দাদু সুযোগ পেলেই কথা শোনাবে। এই মুহূর্তে কথা শোনার মত অবস্থায় সে নেই।
______

সকাল হতে না হতেই বাড়ি ভর্তি মানুষ গিজগিজ করছে। নুসাইবের ফুফু -ফুফা আর তার দুই মেয়ে মিলি আর মালা এসেছে । ছোট চাচা-চাচি তাদের দুই ছেলে মেয়ে নিহাদ আর তুবাকে নিয়ে এসেছে।বড় চাচা -চাচি তাদের দুই মেয়ে আর এক ছেলে জুথি,প্রিয়া, শুভম এসেছে।দাদার পরিবারের প্রায় সব মানুষেরাই এসেছে আজ। তাদের দিয়ে পুরো ডায়নিং রুম আর ড্রয়িং রুম পূর্ণ।তৃধা ফ্রেশ হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি ওবদি এসে পুনরায় দৌড়ে রুমে ঢুকলো। নুসাইব আড়মোড়া ভেঙে উঠেছে সবে। তৃধাকে দৌড়ে রুমে ঢুকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। তৃধা দরজার পিঠ ঠেকিয়ে ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিয়ে বলে উঠল,,’অল্পের জন্য বেঁ*চে গেছি।’

নুসাইবের কপালে চিন্তার ভাঁজ। চিন্তিত গলায় বলল,, তৃধা!অল্পের জন্য বেঁ*চে গেছো মানে?কেউ কিছু বলেছে?

হঠাৎ করে তৃধার মনে হলো এই দুইদিনে যতবার চমকে উঠেছে এর মধ্যে ছোট খাট হার্ট অ্যাটাক হয়েই যেতো। নুসাইবকে ঘুমে রেখে বেরিয়েছিলো এর মধ্যে উঠে কথাও বলছে? ভুত দেখার মত চমকায় তৃধা। বুকে ফুঁ দিয়ে বলল,,’ আপনি কখন উঠলেন?’
,,”আগে বলো দৌড়ে কোথা থেকে এসেছো? কে ধাওয়া করছে।’

কি বলবে তৃধা? আপনার আত্মীয় দেখে দৌড়ে পালিয়েছি? নাকি বলবে প্রশ্ন থেকে পালিয়েছি? গ্ৰামের মানুষ তারা। নিশ্চয়ই চেপে ধরে জিজ্ঞেস করবে চুল শুকনো কেন?তার সাথে আরো কতকি ।এইসব উদ্ভট প্রশ্ন থেকে পালাতেই তো দৌড়ালো। এখন নুসাইবকে বুঝাবে কি করে?

নুসাইব বিছানা ছেড়ে উঠলো। হাত চালিয়ে চুল ঠিক করতে করতে বললো,, ‘ একটা কথাও বলছো না। দেখি সরো আমি দেখছি। তুমিতো বলবে না।’

তৃধা সরে দাড়ায়। দরজা খুলতেই মানুষের কথার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। নুসাইব কপাল কুঁচকে এগিয়ে গেলো। উপর থেকে দাদার পরিবার দেখে বুঝতে পারে তৃধা এমন হুটোপুটি করে কেন পালিয়েছে।
রুমে দাড়িয়ে দাঁত দিয়ে নখ কামড়াচ্ছে তৃধা। নুসাইব দরজা আটকে গম্ভীর গলায় বললো,, দাঁত না খেয়ে আমার জন্য শার্ট প্যান্ট বের করে দাও। দুজন একসাথে নিচে যাবো। একা গেলে অযথা প্রশ্ন করবে।

তৃধা নখ কামড়াতে কামড়াতে মাথা নাড়ায়। নুসাইব মুচকি হেসে তৃধার মাথায় আলতো করে হাত রেখে বলল,, ভয় পাওয়ার কিছু নেই আমি আছি। সবটা সামলে নিবো।

তৃধা চোখ জোড়া স্থির করে তাকিয়ে আছে। তার হাতের উষ্ণতায় মমের মত গলতে শুরু করলো চিন্তার পাহাড়। হুট হাট করে বুকের ভেতল একরাশ ভালো লাগা উত্তাল ঢেউ তুলছে বার বার। তৃধা চোখে পলক ফেলতে ভুলে গেছে। নুসাইব তৃধার মুখ থেকে হাত নামিয়ে মৃধু হেসে বিড় বিড় করে বলে উঠলো,,” পুরোই পা*গলী”

ধীমি আওয়াজে ‘পাগলী’ শব্দটা তৃধার কর্নকুহরে বেশ আদুরে শোনালো। তৃধার অবচেতন মন ভুলে বসলো সব। বিন্দু বিন্দু ভালো লাগা জমছে হৃদয়ে। তৃধা মৃধু হেসে মাথা নোয়ালো।
_______________________

সকাল সকাল বের হলেন মাহাবুব ইসলাম। বহু কষ্টে গ্ৰামের ঠিকানা জোগাড় করেছেন কাল রাতে। মেয়েটার জন্য মন ছুটেছে। একবার না দেখলে হয়তো ম*রন হবে। স্ত্রী মায়াকে বলেছে জরুরি কাজে যাচ্ছে। মায়া যেন এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিলো। স্বামীর উপস্থিতে মেয়ের রুমে ঢুকে পড়লো মায়া জাহান। আড়াই বছরের রুমের কিছুই বদলায়নি। বই গুলোও বদলে নি। রসয়ন বইটা বুক সেল্ফ থেকে যে ভাবে বের করে রাখা হয়েছিল এখনো ঠিক সে ভাবেই আছে। কলম দানির একটা কলম বইয়ের উপর রাখা। মায়া জাহান এই রুমে কাউকে ঢুকতে দেয় না। তিনি নিজে এই রুমের দেখভাল করলেও আসবাবপত্র পত্র নাড়েনি কখনো। যদি মেয়েটা হুট করে এসে দেখে রাগ করে বসে তখন? তখন কি উত্তর দিবে? মেয়েটা বড্ডো অভিমানি,বড্ডো জেদী। কথায় কথায় রেগে যাওয়ার স্বভাব । রুমের সব কিছুই তার পছন্দ করে কেনা। বদলে ফেললে ভীষণ রাগ করবে। মায়া জাহান ওয়াকিং ক্লজেট খুলে ভেতরে ঢুকলেন। জামাকাপড় সব সাজিয়ে রাখা। এক পাশে সারি সারি জুতো সাজানো। তার অন্য একটা পাশে জুয়েলারি। মায়া জাহান হাত বুলিয়ে দেখছে সে সব। মেয়েটাকে পুতুলের মত যত্ন করে বড় করেছে। সেই মেয়েটা গেলো আড়াই বছর হলো। মায়ের মন বেসামাল হয়ে পড়েছে এখন। তিনি আর পারছেন না। মেয়েটাকে বুকে জড়িয়ে ধরার তীব্র ইচ্ছা হচ্ছে তার। ফিকরে কেঁদে উঠলেন তিনি। মেয়ের জন্য মন পুড়ছে তার। মনে মনে কতোবার যে চেয়েছে মেয়েটা ফিরে আসুক। একবার ফিরে আসুক।
_____________

ওয়েডিং প্ল্যানারের কাজ গুলো বুঝে নিচ্ছে তমাল। সে ভীষণ গম্ভীর হয়ে কাজ করছে। এর মধ্যে তার বড় চাচা জাবির শেখের বড় কন্যা জুথি এসে হাজির। জুথি আর নবনীর বয়সে তিন মাসের তফাৎ। জুথির জন্মের তিন মাস পর নবনীর জন্ম হয়। তমাল খেয়াল করে দেখেছে জুথি তার পেছন পেছন ঘুর ঘুর করছে। তা দেখে বাকি লোক গুলো মিট মিট করে হাসছে। তাদের জন্য ব্যাপারটা স্বাভাবিক হলেও তমালের জন্য নয়। তমাল ঘুরে দাঁড়িয়ে ইশারায় ডাকলো জুথিকে। জুথি যেন এই অপেক্ষাতেই ছিলো। হাতে চাঁদ পাওয়ার মত ঠোঁট এলিয়ে হেসে এগিয়ে এলো। তমাল কোমরে হাত রেখে চিন্তিত গলায় বলল,, তোর নাম জুথি না?

তমালের প্রশ্নে জুথির কিঞ্চিৎ মন খারাপ হলেও মাথা নেড়ে বললো,, হ্যাঁ। তমাল ভাই তুমি আমার নামটাও ভুলে গেছো? আমি ভীষণ রাগ করেছি।

জুথির কথা শুনে তমালের চোখ জোড়া রসগোল্লার মত হয়ে গেছে। এই মেয়ে বলে কি? রাগ ! রাগ করেছে? তমাল বিরক্ত হলেও সেটা প্রকাশ না করে গম্ভীর গলায় বললো,, রেগে আছিস ভালো কথা। রাগ ধরে রাখ ধৈর্য বাড়বে। আমি আবার এইসব রাগটাগ ভাঙ্গাই না। আমি ভবিষ্যৎ ডাক্তার,এইসব ফাউ কাজে সময় নষ্ট করলে আমার রোগী ম*রে যাবে। তুই এক কাজ কর। বিয়েতে এসেছিস এনজয় কর। আর হ্যাঁ, বাড়ি যাওয়ার আগ পর্যন্ত রাগটা ধরে রাখ। রেগে আমার আশ পাশেও আসবি না। দূরত্ব বজায় রাখবি ,কারন তুই রেগে আছিস। মনে কর তুই থাকাকালীন আমি যদি ছাদে যাই, তাহলে তুই দূরত্ব বজায় রাখতে ছাঁদ থেকে লাফ দিবি। কারন তুই রেগে আছি। ওকে?

তমালের কথা শুনে জুথি বেয়াক্কেলের মত তাকিয়ে আছে। ছাঁদ থেকে লা*ফ দিবো? জুথির মাথা ঝিমঝিম করছে। তমালকে নয় বরং নিজেকেই পা*গল পা*গল মনে হচ্ছে।

তমালের ভাবাবেগ নেই। সে আগের মত হেঁটে হেঁটে চার পাশের সাজানোর কাজ দেখছে।
___________

ডায়নিং টেবিলে পাশাপাশি বসে আছে তৃধা নুসাইব। সবাই ঘুরে ঘুরে তৃধাকে দেখছে। বিশেষ করতে নুসাইবের বড় চাচি শেফালী আর ফুফু রুবেকা। তার সাথে তাদের ছেলে মেরেরা তো আছেই। তাদের কৌতুহলের শেষ নেই। একজন একেক রকম কথা বলছে । তাও আবার ফিসফিস করে। তৃধার তীব্র অস্বস্তি হচ্ছে। পারলে এক্ষুনি শামুকের মত খোলসের ভেতর ঢুকে বসে থাকতো। তৃধাকে এমন গুটিসুটি হয়ে বসতে দেখে নুসাইব গলা ঝেড়ে বললো,,” সবাই এইভাবে ঘুর ঘুর করছো কেন?দেখতে হলো এক জায়গায় গিয়ে বসো। এইভাবে ঘুর ঘুর করে দেখে কানে কানে কথা বলা বেড মেনার্স। ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে ,যাও সবাই। শান্তি মত নাস্তাটা তো করতে দাও।”

নুসাইবের ফুফু রুবেকা ফোড়ন কেটে বললো,,”দেখছি খেয়ে ফেলবো না। তোর বউ তোরই থাকবে।”

নুসাইব তৃধার দিকে চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে বলল,, কেউ কাউকে খেয়ে ফেলে না ফুফু। যে ভাবে দেখছো এতে তৃধার কাছে অস্বস্তি লাগতে পারে। লাগতে পারে কি বলছি অবশ্যই লাগছে। তোমাদের তাকানোতে আমার নিজেরই অস্বস্তি হচ্ছে।
নুসাইব আর কিছু বলতে নিবে তার আগে তৃধা নুসাইবকে ইশারায় চুপ করতে বলে।

সায়রা বানু সময়ের খবর সময়ে পৌছে দিচ্ছে ফরিদা হক-কে। জা আর ননদ তার বউমাকে কি কি বলছে তা শুনে তিনি রেগে ফেটে পড়ছেন।

নুসাইবের ছোট চাচি শুভা স্বভাবত সুস্পষ্টভাষী। তিনি তার ছোট মেয়ে তুবা কে কোলে নিয়ে তৃধার পাশে দাঁড়িয়ে বললো,, এই সবে মাথা ঘামিও না বউমা। তোমার বেলায় তো কম আছে। আমার সময় একঝাঁক বন মানুষ এসেছিলো আমাকে দেখতে। যেন তারা জীবনে মানুষ দেখেনি। তুমি তোমার মত খাওয়া দাওয়া করো। দুইদিনের ঝামেলার দিকে নজর না দিলেও চলবে।

শুভার কথায় রুবেকা আর মেঝো জা শেফালী রেগে একাকার। শুভা যে তাদের বন মানুষ বলেছে এতে কোনো সন্দেহ নেই।
এরমধ্যে নবনী চেয়ার টেনে তৃধার পাশে বসে বললো,, বাহ্ মেহেদীতে সুন্দর রং ধরেছে তো। নাটকিয় ভাবে বললে,বলা যায় ,,’ভাইয়ার ভালোবাসার রং।’

নবনীর কথায় বিষম খেলো তৃধা। একে তো এমন পরিস্থিতি তার উপর নবনীর কথা । নুসাইব ব্যাস্ত হয়ে গ্লাসে পানি ঢেলে দিয়ে নবনীকে শাসিয়ে বলল,,’ খাওয়ার সময় উল্টো পাল্টা কথা একদম বলবি না।”

নবনী দূর্বল গলায় বলল,,”ঠিক আছে ভাইয়া।”

সেতারা বেগম সময় সুযোগের অভাবে ঘটে যাওয়া ঘটনা রটাতে পারছেন না। যার কারনে বিরক্ত ভঙ্গিতে পান খাচ্ছে।

সোয়েব শেখ মেজো ছেলে মাজহার আর ,ছোট ছেলে শাখাওয়াত সহ বাগানে বসে আছেন। তার সাথে যোগ হয়েছে একমাত্র মেয়ে জামাই মাসুদ। বড় ছেলে আর তার পরিবার নিয়ে গর্বের সাথে আলাপ আলোচনা করছেন তিনি।
অন্য দিকে নাবীব শেখ গম্ভীর মুখে বাড়িতে ঢোকে। কোনো দিকে না তাকিয়ে সোজা কিচেনে ঢুকে ফরিদা হককে জুরুরী তলব করলেন। ফরিদা হক কোমরে গুজে রাখা শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে নাবীব শেখের পেছন পেছন ছুটলে।

নাবীব শেখকে ভীষণ চিন্তিত দেখাচ্ছে। ফরিদা হক জিজ্ঞেস করতেই বলে উঠলেন,, পাড়ার লোক নানান রকম কথা বলছে। মায়ের এমন চিৎকার চেঁচামেচির কি দরকার ছিলো ? এখন দাওয়াত দেওয়াও মুশকিল। বাড়িতে ঢুকে মেয়েটাকে খারাপ চারটে কথা শোনাবে। এইগুলো সহ্য করা যাবে? ভাগ্যিস মতি আমাকে জানিয়েছে। এখন কি করবো বলো?

ফরিদা হক সোজা উত্তর,,’ আগ বাড়িয়ে দাওয়াত দেওয়ার প্রয়োজন নেই। আমার বাড়িতে এসে খাবে আবার আমার ছেলে,ছেলের বউয়ের বদনাম করবে এতো মহান আমি নই। যাদের দাওয়াত দিতে চাইছো তাদের ঘর থেকে শুধু একজন করে দাওয়াত দিবে কালকে দুপুরের জন্য। সব যেন পুরুষ হয়। কোনো মহিলাকে আমার বাড়ির চৌকাঠে যেন না দেখি।
আর হ্যাঁ, দুইদিনের জন্য আমেনা আর আমেনার মাকে নিয়ে আসো। এতো এতো মেহমান আমি একা হাতে সামলাতে পারবো না।

স্ত্রীর কথায় নাবীব শেখ বললো,, ঠিক আছে। আমি বলবো আসতে। শুধু নাস্তা ঘরে তৈরি করলে হবে। বাকি সব বাইরে লোক আছে ওরা রান্না করবে। এতো সময় দাঁড়িয়ে কাজ করার দরকার নেই। তাছাড়া তৃধাকেও তো চোখে চোখে রাখতে হবে। মা কোন সময় কি বলে দেয়।

ফরিদা হক তড়িঘড়ি করে দরজা খুলে বেরোতে বেরোতে বললো,, সেটা আমি দেখছি। আপাতত তুমি দাওয়াত করে এসো।
__________

ঘরোয়া ভাবে হলুদের অনুষ্ঠান করার কথা থাকলেও তমাল বাগানে বড় করে আয়োজন করেছে। বর বউ দুজনকে বসিয়ে হুলুদ ছোঁয়াতে ব্যাস্ত সব। তৃধা চুপচাপ বসে আছে। সবাই কেমন হই হই করছে। সেজেগুজে নিজেদের মধ্যে আনন্দে মেতে আছে। আক্ষেপে বুক ভারি হলো তৃধার। মা বাবা ভাই সমেত তার পরিবারটা থাকলে মনে হয় মন্দ হতো না।

নুসাইব তৃধার দিকে তাকিয়ে আছে। বাসন্তী রঙের শাড়ির সাথে খয়েরী জারবেরা ফুলে সেজেছে তৃধা। বেনী করা চুলে রজনীগন্ধা আর জারবেরা ফুল মুড়িয়ে রেখেছে। চোখে কাজল ঠোঁটে খয়েরী লিপস্টিকে তৃধাকে অনন্য লাগছে। এতো সৌন্দর্যের মাঝেও কিছু একটা যেন নেই। এতো এতো সাজ আজ ফিকে পড়ছে খুব। তৃধার কাজল কালো টইটুম্বুর চোখ জোড়া বিষাদের ছায়া স্পষ্ট। নুসাইব হাত বাড়িয়ে তৃধার হাতটা নিজের হাতের আজলে নিয়ে বললো,,” তৃধা, মা বাবাকে মিস করছো?”
তৃধা নুসাইবের হাতটা শক্ত করে ধরে কম্পিত গলায় বলল,, “দেখতে ইচ্ছে করছে।”

নুসাইব চোখের ইশারায় বলে উঠলো,” এখন যাবে? চলো তাহলে।”

চলবে,,,,,

উপন্যাসের নাম::#আমি_আছি
লেখনিতে:#সাদিয়া_আফরোজ
পর্ব: ৩৬
,
,
,
,
,
,
,
তৃধা থেকে উত্তর না পেয়ে কথা বাড়ালো না নুসাইব। এই মুহূর্তে তৃধার উপর তার অধিকার বেশি হলেও, কিছু কিছু ব্যাপারে অধিকার খাটানো যায় না। ঠিক তেমনি তৃধার মা-বাবার ব্যাপারে তৃধার উপর অধিকার খাটিয়ে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া অশোভনীয়। যতক্ষণ না তৃধা নিজ থেকে চাইবে, ততক্ষন নুসাইবের দুহাত বাঁধা। তাছাড়া তৃধা কখনো তাদের ঠিকানা দেয়নি। সেটা জানলে অনেক আগেই সমস্যার সমাধান করে ফেলতো। এতে করে তৃধারও কষ্ট কম হতো।
নুসাইবের বলা কথার পর তৃধা আর প্রতুত্তোর করলো না। কিছু কিছু ইচ্ছে চাইলেও পূরন করা যায় না।যে বাড়ির দরজা নিজ হাতে বন্ধ করে এসেছে। সেই বাড়ির দরজায় পুনরায় গিয়ে দাঁড়ানোর সাহস কিংবা ক্ষমতা কোনোটাই তার নেই। তৃধা রিক্ত শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামনে।

নুসাইব সবার সাথে হেসে কথা বললেও তার মস্তিষ্ক জুড়ে তৃধার বিচরণ। ব্যাক্তিগত রমনীকে নিয়ে ভীষণ চিন্তিত সে।
_________________
সেই সাত সকালে বেরিয়েছিলো মাহাবুব ইসলাম। রাত প্রায় পনে এগারোটা। এখনো ফেরার নাম নেই। মায়া জাহান তার অপেক্ষায় পথ চেয়ে বসে আছে সোফায়। চোখ জোড়া বিষণ্ণ দেখালেও কপালে চিন্তার ভাঁজ স্পষ্ট। মাহাবুব ইসলাম ফিরলেন যখন ঘড়ির কাঁটা বরাবর বারোটায়। ধীর পায়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলেন। উস্কো খুস্কো চুল, চোখ জোড়া ফুলে আছে, মনে হচ্ছে কেঁদেছেন।মাহাবুব ইসলামকে বি*ধ্বস্ত অবস্থায় দেখে মায়া জাহানের বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। কি হলো তার? হঠাৎ এমন লাগছে কেন লোকটাকে? মনে মনে এমন হাজার প্রশ্ন করলেও মুখে কিছুই বললেন না। বরং ব্যতিব্যস্ত পায়ে ছুটে গেলেন স্বামীর কাছে। মাহাবুব ইসলামের দূর্বল পা দুটো দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি হারিয়েছে বোধহয়। তিনি পড়ে যেতেই মায়া জাহান তৎক্ষণাৎ ধরে ফেলেন। মায়া জাহান ডুকরে কেঁ*দে উঠে বললো, কি হয়েছে তোমার? কোথায় ছিলে সারাদিন? এই অবস্থা কেন?

স্ত্রীর প্রশ্নে দুচোখ ভিজে উঠলো তার। স্ত্রী মায়াকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলেন তিনি।মায়া স্বামীকে কাঁদতে দেখে খেই হারালেন।কি করবে বুঝে উঠতে পারছেন না।এর আগে মাহাবুব কখনো এতোটা ভেঙে পড়েনি । ছেলে এ*ক্সিডে*ন্ট হওয়ার পরও কাঁদেনি ,এমনকি আদরের মেয়েটা বাড়ি ছাড়ার পরেও তাকে এইভাবে কাঁ*দতে দেখা যায়নি। তাহলে আজ হঠাৎ কি হলো? মায়া আর কিছুই ভাবতে পারছেন না। তিনি নিজেও কাঁদছেন।
অদ্ভুত এক পরিবেশ তৈরি হলো এই শূন্য বাড়িটাতে। কা*ন্নার আওয়াজে পুরো বাড়ি বিষাদে ছেয়ে গেছে। মনে হচ্ছে মানুষের সাথে সাথে বাড়িটাও কাঁদছে।

মাহাবুব ইসলাম কান্না আটকে বলে উঠলো,’ মায়া আমার মেয়েটাকে খুঁজে পাচ্ছি না। ওই বাড়িতে আমার মেয়েটা নেই। আমার মেয়েটাকে ঘর ছাড়া করেছে তারা। ওই চরি*ত্রহী*ন ছেলেটা আরেক বিয়ে করে আমার মেয়েটাকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছে। আমার কলিজাটাকে কোথায় খুঁজবো এখন? আমার অভিমানীকে কই পাবো মায়া? বলতে বলতে ফ্লোরে বসে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন তিনি।
স্বামীর বলা কথায় থম ধরে দাঁড়িয়ে আছেন মায়া জাহান। যেচে প্রশ্ন করতে চেয়েও পারছেন না। বাকশক্তি হারিয়েছে মনে হয়। শব্দ গুলো গলায় দলা পাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে কেউ খুব জোরে গ*লা চে*পে ধরে রেখেছে। স্বামীর বলা প্রতিটা কথা শুনে মনে হলো কলি*জায় কেউ ছু*রি চালিয়ে ক্ষ*ত*বি*ক্ষ*ত করছে তাকে। এরমধ্যে কত শত খারাপ চিন্তা মাথায় আসছে তার ইয়াত্তা নেই। শূন্য বুকটা আরো বেশি শূন্যতায় ছেয়ে গেছে। মুখ থেকে শব্দ না বেরুলেও চোখ জোড়া বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে নোনা জল। বুকের ভেতরের অ*সহ্য যন্ত্র*ণা ক্রমশ গ্ৰাস করছে তাকে। সেই অসহনীয় যন্ত্র*ণা মাতৃ হৃদয় যেন সহ্য করতে পারলো না। মায়া জাহান লুটিয়ে পড়লো ফ্লোরে।
________________

ঠিক বারোটায় হলুদের অনুষ্ঠান শেষ হলো। যদিও সবাই চাইছিল আরো কিছু সময় থাকতে ,কিন্তু নুসাইব এতে বাধ সাধল। ফরিদা হক তৃধাকে দেখে নিজে তৃধাকে ঘরে দিয়ে আসলেন। সাজ সমেত বসে আছে তৃধা। নুসাইব ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে দেখলো তৃধার কোনো হেলদোল নেই। লম্বা শ্বাস টেনে আলতো করে হাত রাখলো তৃধার মাথায়। হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,, “কান্না পাচ্ছে!কাঁদো। ইচ্ছে হলে শব্দ করে কাঁদো তৃধা। এইভাবে কান্না চেপে রাখতে নেই।”

তৃধা তখনো চুপ করে আছে। নুসাইব দু’হাঁটু গেড়ে বসলো। তৃধার দুহাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে আদুরে গলায় সুধালো,,” কষ্ট লাগছে তৃধা? বেশি খারাপ লাগছে?খারাপ লাগলে বলো আমাকে। ”

তৃধা অশ্রুসিক্ত চোখে মাথা নেড়ে বললো,”না।”

,” মা-বাবার কথা বেশি মনে পড়ছে?”
টপটপ করে দুফোঁটা জল নুসাইবের হাতে এসে পড়লো। তৃধার কষ্ট খানিকটা হলেও উপলদ্ধি করছে নুসাইব। নুসাইব উঠে দাঁড়ালেও পুনরায় ঝুকে আলগোছে তৃধার মাথা বুকে জড়িয়ে ধরে বললো,, “চলো তৃধা একবার যাই। দেখবে তারা মোটেও রাগ করে নেই। জানি তোমার খারাপ লাগছে। চলো না যাই। দরকার হলে দুর থেকে দেখে এসো।”

নুসাইবের কথায় তৃধার চোখ জুড়ে ভীড় করা অশ্রু কনারা যেন বাদ ভাংলো। ডুকরে কেঁদে উঠে দুহাতে আকড়ে ধরলো নুসাইবকে। টিশার্ট খামচে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছে তৃধা। কান্নার আওয়াজ বাড়ছে ব-ই কমছে না। হুট করে নুসাইব কখন এতোটা আপন হলো তৃধার জানা নেই। শুধু জানে এই মুহূর্তে লোকটা ভীষন কাছের ,ভীষণ আপন।

দুহাতের বাধন শক্ত করলো নুসাইব। অদ্ভুত এক বেদনাময় অনুভূতি হচ্ছে তার। বিষাদে ছেয়ে গেছে বুকটা। তৃধার কান্নায় নুসাইবের চোখ জোড়া ভিজে উঠলো। গভীর নিঃশ্বাস ফেলে তৃধার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকল।

নুসাইবকে অনেক কথাই বলার ছিলো তৃধার। যদিও এই মুহূর্তে সব গলায় দলা পাকিয়ে আছে। তৃধা হেঁচকি ওঠা গলায় কিছু বলতে নিবে তার আগেই নুসাইব থামিয়ে দিয়ে বলল,,যা বলার পরে বলো।এতো কষ্ট করে বলতে হবে না তৃধা।

নুসাইবের কথা শুনলো না সে। হেঁচকি ওঠা গলায় বলল,,” আমি কি করে যাবো ওবাড়ি? কি করে যাবো? কত কষ্ট দিয়েছি তাদের। কি করে তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়াবো? পুরো পরিবারের সম্মান নষ্ট করে এসেছি। তাদের সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর মুখ নেই আমার। কি করবো আমি?”

তৃধার কথার উত্তর করলো না নুসাইব। বরং প্রিয়তমার মুখের আদল দুহাতের আজলে নিয়ে লেপ্টে যাওয়া কাজল আলতো হাতে মুছে দিতে দিতে বলল,,” এখন যাওয়ার দরকার নেই তৃধা। আরেকটু সময় হোক। নিজেকে আরেকটু সামলে নাও। এরপর তোমার যখন মনে হবে তাদের সাথে দেখা করা উচিৎ, তখন না হয় আমি নিজে তোমাকে নিয়ে যাবো। মাফ না করলে পা ধরে বসে থাকবো। যতক্ষণ মাফ না করবে ততক্ষণ ছাড়বো না। একটু সময় নাও তৃধা। সময় নিয়ে জানিও আমাকে। ওকে?

তৃধা হেঁচকি তোলা গলায় মাথা নাড়ায়। নুসাইব মৃধু হেসে তৃধার চুল ঠিক করে দিয়ে আলতো হাতে ফুলের গহনা গুলো খুলে দিতে দিতে বলল,, ফ্রেশ হয়ে এসে শুয়ে পড়ো। নয়তো শরীর খারাপ করবে।

তৃধাকে রেখে রুম ছেড়ে বেরোলো নুসাইব।
তৃধা ঠায় বসে আছে। মনের সাথে শরীরটাও দূর্বল লাগছে।মাথাটাও প্রচন্ড ব্যাথা করছে, মাত্রাতিরিক্ত কান্নার ফলে হেঁচকিও বন্ধ হচ্ছে না। চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। তারপর রয়েসয়ে উঠে ওয়াশ রুমের দিকে পা বাড়ালো।
_________

নুসাইব ব্যস্ত পায়ে কিচেনের দিকে এগিয়ে গেলো। ফরিদা হক কিচেন গোছাতে ব্যস্ত। ছেলেকে কিচেনে ঢুকতে দেখে জিজ্ঞেস করলো,, “কিছু লাগবে বাবা ?
নুসাইব কয়েক সেকেন্ড থেমে বললো,, মাথা ব্যাথা হলে একটা স্পেশাল চা বানিয়ে দিতে যে ওইটা লাগবে। হাতে কাজ না থাকলে বানিয়ে দিবে প্লিজ?

ফরিদা হক ছেলের আবদারের ধরন দেখে মুচকি হেসে বলল,,” তৃধার মাথা ব্যাথ্যা তাই না?”

,,” হ্যাঁ”

,,”ঠিক আছে তুই ডায়নিং টেবিলে গিয়ে বস। আমি নিয়ে আসছি।”

নুসাইব বাধ্য ছেলের মত ডায়নিং টেবিলে গিয়ে বসলো।

ছেলেমেয়েরা সবাই সবার রুমে গেলেও রয়ে গেছে মুরুব্বিরা। ড্রয়িং রুমে বসে গোল মিটিং করছে সবাই। সেই মিটিং এর মধ্যমনি সেতারা বেগম।

নুসাইব খেয়াল করে দেখলো এই সবার মধ্যে তার বাবা আর দাদা নেই। তার চেয়ে বড় কথা সবাই প্রায় ফিসফিসিয়ে কথা বলছে। বুঝতে বাকি নেই কি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। তাচ্ছিল্য করে হাসলো নুসাইব।

হুট করে কি হলো কে যানে।সবার মধ্য থেকে উঠে পড়লো শুভা। কোনো একটা ব্যাপার নিয়ে হয়তো ভিষন বিরক্ত । বিরক্ত নিয়ে উঠে আসতেই নুসাইবের চোখে পড়লো । তিনি কারো তোয়াক্কা করে লম্বা শ্বাস টেনে নুসাইবের সামনে দাঁড়িয়ে বললো,,” প্রিয় অপ্রিয় হতে দেরী হয় না নুসাইব। এই মুহূর্ত থেকে তোমার স্ত্রী অনেকেরই অপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সাবধানে থেকো। কথার তীরের আ*ঘাত বড় আঘা*ত। এই আঘা*তের ঔষধ নেই।

শুভা দাঁড়ালো না ।সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলো। এই সংসারের মানুষ গুলোকে ভালো করেই চেনে সে। কে কার ভালো চায় সেটা শুভা প্রথম দিন থেকেই বুঝতে পারে। এও বুঝতে পারে এই সংসারে তার বড় জা কে কেউ পছন্দ করে না। সবাই আড়ালে আড়ালে তার খারাপ চায়। শুভা বুঝে পায় না কেন সবাই তাকে এতোটা অপছন্দ করে। বিয়ের এতো বছরেও ফরিদার খারাপ দিক শুভার চোখে পড়েনি। ফরিদাকে শুভার পছন্দ হলেও তার সাথে কথা বলা কিংবা মেশা তার শ্বাশুড়ি সেতারা বেগম পছন্দ করে না। তাও শুভা লুকিয়ে চুরিয়ে ফরিদার সাথে যোগাযোগ রেখেছে।

ফরিদা হক চা নিয়ে নুসাইবের সামনে রেখে বললো,,” তৃধার মনে হয় মন খারাপ। ওর মা-বাবার কথা মনে পড়ছে বোধহয়। খেয়াল রাখিস বাবা।

নুসাইব মলিন হয়ে ইশারায় তার দাদিকে দেখিয়ে বললো,, আমি খেয়াল রাখলেও অনেক জন কষ্ট দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে আম্মু। এতো এতো মানুষের ভীড়ে খেয়াল রাখা কষ্টদায়ক। তুমি বরং কাল বিকেলে সবার যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিও। আমি আমার সংসার জিবনে কারো হস্তক্ষেপ পছন্দ করি না,সামনেও করবো না।

নুসাইব চলে গেলেও ফরিদা হক ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন। তিনি সেতারা বেগমের দিকে তাকিয়ে আছেন। মাঝে মাঝে তাকে দেখে অবাক হন। একটা মহিলা ঠিক কতটা খারাপ হলে এমন হতে পারে। ফরিদা হক মনে করেন,সেতারা বেগমকে দিয়ে যদি ‘খারাপ’ শব্দটাকে সংজ্ঞায়িত করা হয়,তবে ‘খারাপ’ শব্দটাকে অপমান করা হবে।
________

বিছানার এককোণে গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে আছে তৃধা। কান্নার কারনে চোখ জোড়া ফুলে আছে। এতো তাড়াতাড়ি কি করে ঘুমালো কে জানে। হয়তো কান্নার কারনে ঘুমিয়ে পড়েছে। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে চায়ের কাপ টেবিলে রেখে তৃধার মাথার পাশে বসলো নুসাইব। আলগোছে তৃধার মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে গাঢ় চুমু আটলো। এই মেয়েটাকে বড্ড বেশি ভালোবেসে ফেলেছে নুসাইব। তাকে কষ্ট দেওয়া তো দূরের কথা, কেউ কষ্ট দিবে ভাবতেই তার নিজের কষ্ট হয়।

চলবে,,,,,