উপন্যাসের নাম::#আমি_আছি
লেখনিতে:#সাদিয়া_আফরোজ
পর্ব: ৩৭
,
,
,
,
,
,
,
সকাল হতে না হতেই তোড়জোড় শুরু হলেও যাদের নিয়ে এতো আয়োজন তারা এখনও ঘুমিয়ে। ডাইনিং টেবিলে সেতারা বেগম এই নিয়ে ফোঁড়ন কাটলেও দরজা ঠেলে ঘুম থেকে তোলার সাহস তার নেই। রেবেকা মায়ের সাথে তাল মিলিয়ে বলল,,” এই স্বাভাবের কারনেই ছেড়েছে মনে হয়। তাও তো জমিদারি গেলো না আম্মা। সূর্য উঠে ডোবার সময় হয়ে যাচ্ছে,তাও রুম ছেড়ে বের হচ্ছে না।”
শেফালী মুখ বেঁকিয়ে বলল,,” কালে কালে কতো কি দেখবো আপা। ছেলেটার ফাটা বাঁশে পা আটকে গেছে। এখন বুঝতে না পারলেও সামনে ঠিকই পস্তাবে।”
ফরিদা হক বেশ কিছুক্ষণ ধৈর্য নিয়ে শুনলেও এইবার আর ধৈর্য্য ধরে রাখতে পারলেন না। টেবিলে শব্দ করে প্লেট রেখে বললো,,” দাওয়াত দিয়েছি এসেছেন খেয়ে চলে যাবেন। সেটা না করে আমার বাড়িতে এসে আমার ছেলের বউয়ের নামে বদনাম করতে তো বলিনি! বদনাম করার উদ্দেশ্য থাকলে ফার্দার আমার বাড়িতে আসার দরকার নেই। আমি শ্বাশুড়ি হয়ে যেখানে দোষ ধরছি না , সেখানে আপনারা তো তৃতীয়ও নয় বরং চতুর্থ ব্যাক্তি।
রেবেকা গলা উঁচিয়ে বলল,, ‘যা সত্যি তাই বললাম। এতে এতো রাগার কি আছে। ভালোর জন্যই তো বলেছি।’
,,” কিসের ভালোর জন্য বলেছেন আপা? আমার বউমাকে কিসের জন্য ছেড়েছে, কি ছাড়েনি সেটা নিয়ে কথা বলা কোন ধরনের ভালো? আপনি দেখেছিলেন কেন ছেড়েছে? আপনি ছিলেন সেখানে? না জেনে না বুঝে কথা বলে দিলেন। ওমনি জমিদার বলে কটাক্ষ করে কথা বলছেন। হ্যাঁ আমার ছেলের বউ জমিদার। ওদের জমিদারি না থাকলেও আমার ছেলের জমিদারির উপর খেয়ে যাবে। এতে আপনার সমস্যা কোথায়?
ফরিদা হক মেঝো জা শেফালীকে উদ্দেশ্য করে বলল,,” শেফালী তোমাকে বলছি। আমার ছেলের কিসে পা আটকেছে সেটা তোমার চিন্তার বিষয় নয়। তোমাকে বিয়ে করে আমার দেবরও কোনো নোবেল পুরস্কার জিতেনি। সুতরাং নিজের সীমানা বুঝে কথা বলবে। সেটা যদি না পারো তো আমার সাথে কথা বলার দরকার নেই, আমার পরিবার নিয়ে ভাবারও দরকার নেই। সবাই বিয়েতে এসেছো,পারলে দোয়া করবে ,না পারলে খাওয়া দাওয়া শেষে বাড়ি চলে যাবে। এইখানে থেকে অশান্তি করার দরকার নেই। যে আত্মীয়তা শান্তির চেয়ে অশান্তি বয়ে আনবে সেই আত্মীয়ের আত্মীয়তার দরকার নেই। সবাই সবার মত সবার নিজ নিজ জায়গায় ভালো থাকো।
ফরিদা হক কথা শেষ করে দাঁড়ালেন না। একপ্রকার রেগে ধুপধাপ পা ফেলে কিচেনে ঢুকলেন।
সেতারা বেগম রেগে নিজের রুমে চলে গেলেও রেবেকা আর শেফালী বসে বসে ফুঁসছে।
___________
তমাল বাইরের কাজ গুলো নিজে দাঁড়িয়ে থেকে দেখছে। এর মধ্যে জুথি আবারো তার পিছু নেয়। প্রিয়া সহ মালা ,মিলি সবাই একসাথে থাকলেও জুথি আলাদা। তাতে তমাল বেজায় বিরক্ত। তার চেহারায় বিরক্ত ফুটে উঠলেও জুথি যেন বুঝেও না বুঝার ভান ধরে আছে। জুথিকে তমালের পেছন পেছন ঘুর ঘুর করতে দেখে রাফি রিমান হেসে কুটিকুটি। রিমান তমালে পেটে কুনুই দিয়ে গুঁ*তো মে*রে বললো,,” শা*লা ভালো করে তাকিয়ে দেখ ,তোর কাজিন কিন্তু বেশ রূপবতী।”
রাফি মুখ বেঁকিয়ে বলে,, “এখন পাত্তা দিচ্ছিস না। পরে খুঁজলেও পাবি না।”
তমাল বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে রাফি রিমানের মাথায় টোকা মেরে বললো,,” তেমন হলে তোরা নিয়ে যা। এমন রেটেল স্নেক আমার দরকার নেই। এই প্রজাতির সাপের এন্টিভেনম নেই। পারলে তোরা গিয়ে কামড় খা।”
,,” রিমান দেখেছিস!এই শালা কি বলছে?”
রাফির কথায় রিমান দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলল,,” আমাদের মত সাহারা মরুভূমির জন্য এই রেটেল স্নেক পানির কাজ করবে। তোর পছন্দ না হলে আমার সাথে সেটিং করিয়ে দে।”
তমাল জুথির দিকে তাকিয়ে বলল,,”জুথি ,এই দিকে আয়।”
তমালের একশন দেখে রাফি রিমান অপ্রস্তুত হাসলো।
জুথি গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে আসলে তমাল ভরাট কন্ঠে বলে উঠলো,,” দুইটা অপশন দিচ্ছি। যে কোনো একটা বেছে নিবি।”
জুথি বুঝে পায় না কিসের কথা বলছে। সে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে।
তমাল রাফি রিমানের কলার ধরে সামনে টেনে আনলো। অতঃপর দুজনের কাঁধে হাত রেখে বলল,,” এই দুইটাকে ভালো করে দেখ। এরা আমার প্যান্ট নেই কালের বন্ধু। রাফি অর্থনীতি নিয়ে পড়ছে ,রিমান হিসাববিজ্ঞান নিয়ে। দুইজনেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্ট। কঠিন মাপের মেধাবী, এদের ফিউচার ব্রাইট। স্বভাব অত্যন্ত ভালো, চরিত্র ফুলের মত পবিত্র। দুজন লজ্জার কারনে জিবনে প্রেমে পড়েনি। খাঁটি হিরা যার জন্য একটু শ্যামলা। কথা সেটা না, কথা হচ্ছে এই এলিজ্যাবল ব্যাচেলর দুজনের তোকে ভীষণ পছন্দ। আমি বলেছি তোরা ভেনম ফ্যামিলি তাও পছন্দ। এখন তোর যদি দুজনের মধ্যে একজনকে পছন্দ হয় তাহলে আমি কথা আগে বাড়াবো। কি বলিস?
রাফি রিমান তমালের বর্ননা শুনেই তমাল থেকে ছুটতে চেষ্টা করছে। তমাল ধরেছে তো ধরেছেই, ছাড়াছাড়ির নাম নেই। এই দিকে লজ্জায় জুথির চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে। সে পারলে এক্ষুনি মাটি খুঁড়ে ভেতরে ঢুকে যেতো।
তমাল তাড়া দিয়ে বললো,, কিরে চুপ করে আছিস কেন? তাড়াতাড়ি বল তা না হলে এই দুটো পালাবে।
জুথি মাথা নিচু করে বললো,, আমার তো আপনাকে পছন্দ তমাল ভাই। আপনার বন্ধুরা ভালো জানি।তাই বলেতো আর পছন্দ বদলাবে না।
তমালের হাত আলগা হয়ে আসলেও রাফি রিমান সরলো না। দুজন তমাল আর জুথির দিকে বার বার তাকাচ্ছে।
তমাল অবাক হলো না বরং বড়বড় চোখ করে বললো,,” ছিঃ জুথি তুই আমার বোনের মত। তোকে আমি নবনীর মত মনে করি। ছিঃ ছিঃ তুই আমার দিকে বদ নজরে তাকাস? এক্ষুনি চাচিকে বলবো তুই আমাকে তোর গুনাগার চোখে দেখিস তাছাড়া পাপী কথা বলেছিস। তোর এই সব অন্যায় আবদার চাচি আজকেই বের করবে। আমার তো শুনেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।
তমালের কথায় রাফি রিমানের অবাকতার চূড়ান্ত সীমায় পৌছে গেছে।
জুথি চোখ জোড়া ভিজে উঠেছে। তমাল ভাইকে সে অনেক আগ থেকেই পছন্দ করে। বলতে গেলে সেই ছোট্ট বেলা থেকে। তমালের সাথে দেখা না হলেও লুকিয়ে লুকিয়ে ঠিকই তমালের স্যোশাল মিডিয়া চেক করে। তমালের পোস্ট করা এমন কোনো ছবি নেই যেটা জুথি সেইভ করেনি। তমালের আইডির এমন কোনো পোস্ট নেই যেটা জুথির মুখাস্ত নেই। জুথির চোখ দুটো ভিজে উঠেছে। হয়তো এখনই কেঁদে ভাসাবে। রাফি রিমান তমালকে চোখ রাঙালো। মেয়েটা কাঁদছে দেখে দুজনেরই খারাপ লাগছে।
তমাল ভ্রু কুঁচকে বললো,, ঠিক আছে ঠিক আছে কাঁদতে হবে না। কিছু বলবো না। শুধু শুধরে গেলে হবে।
জুথি কাঁপা গলায় বললো,, কিন্তু তমাল ভাই,,।
তমাল জুথিকে থামিয়ে দিয়ে বলল,,” দেখ জুথি, তুই পছন্দ করিস সমস্যা নেই। পছন্দ হতেই পারে। কিন্তু আমি তোকে আমার বোনের মতই দেখি। নবনী আর তোর মধ্যে পার্থক্য করি না। সব বাদ দিলেও আমার জিবনে যে আছে তাকে তো ফেলে দিতে পারবো না।”
তমালের কথায় রাফি রিমান বিস্ময় নিয়ে তাকালো। জীবনে যে আছে মানে? জিবনে আবার কে এলো?
রাফি রিমান একে অপরের দিকে তাকালো। দুজনের মনেই একই প্রশ্ন।
জুথির চোখ বেয়ে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। জুথি নাক টেনে কান্নারত গলায় বলল,, খুব ভালোবাসো তাকে? সে কি আমার চেয়ে সুন্দর?
তমাল লম্বা শ্বাস টেনে বললো,,” হুম খুব ভালোবাসি। কার কাছে কেমন জানি না, কিন্তু আমার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর যদি কেউ থাকে তবে যেটা হচ্ছে আমার ভালোবাসার মানুষটা।”
জুথি দাঁড়ালো না। তমালের কথা শুনে চোখ মুছে দৌড়ে পালালো।
এইদিকে রাফি রিমান হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। দুই জোড়া চোখে বিস্ময় ছেয়ে আছে। তমাল দুজনকে উপেক্ষা করে যেতে নিবে তার আগে দুজন মিলে লাপটে ধরলো তমালকে। দুজনের সাথে পেরে উঠা দায়। রিমান তমালকে ঘাসের উপর ফেলে বুকের উপর বসে টিশার্টের কলার ধরে রাখলো। রাফি হাত দুটো ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,,” তোর কত বড় সাহস! এমন একটা ব্যাপার আমাদের থেকে চেপে গেছিস? তমাল মোচড়া মুচড়ি করছে অনবরত। বাগানের মধ্য দিয়ে যত জন যাচ্ছে ততজন এইতিন জনের হাতাপায়ি দেখে হাসছে। নাবীব শেখ ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে চলে গেলেন। তার কাছে এই ঘটনা নিতান্তই স্বভাবিক।
___________
তৃধা ওঠার আগেই নুসাইব উঠে পড়লো। তৃধার এলোমেলো জামা কাপড় ঠিক করে দিয়ে গায়ে চাদর টেনে দিয়ে ফ্রেশ হতে গেলো। নুসাইব যাওয়ার কয়েক মিনিট পর তৃধা জেগে উঠে। নিজের অবস্থান দেখে জানালার পর্দা সরিয়ে দিতেই চমকে উঠলো। তড়িঘড়ি করে দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে কপাল কুঁচকে ফেললো। ঘড়ির কাঁটা বরাবর দশটা। বাড়ি ভর্তি মেহমান এই দিকে বাড়ির বউ দশটায় ঘুম থেকে উঠেছে। ভাবতে ভাবতে গাঁয়ে কাটা দিয়ে উঠল তৃধার। তীব্র অপরাধ নিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠলো। নুসাইব ওয়াশ রুম থেকে বের হতেই তৃধাকে সামনে দেখে মুচকি হেসে বলল,,গুড মর্নিং তৃধা!
রাতের কথা কিছু সময়ের জন্য ভুলে বসলেও নুসাইবকে দেখা মাত্র তৎক্ষণাৎ মনে পড়লো সব। তৃধা যেন চোখ লুকাতে ব্যস্ত। নিজের বেহায়াপনার কথা মনে হতেই মাটিতে মিশে যাওয়ার জোগাড়।লজ্জা লাগছে তার , লজ্জায় চোখ তুলে তাকাতেও পারছে না।
তৃধার আচরণ নুসাইবের কাছে স্পষ্ট। জানতো এমন কিছুই হবে। তৃধাকে স্বাভাবিক করতে বলে উঠলো,,” ফ্রেশ হয়ে এসো। রাতেও তো তেমন কিছু খাওনি। নিশ্চয়ই ক্ষিদে লেগেছে। দুজন একসাথে নিচে যাবো।
তৃধা ছোট শ্বাস ফেলে মাথা নাড়ে ওয়াশ রুমে ঢুকে পড়লো। নুসাইব তৃধার যাওয়ার পানে তাকিয়ে আছে। কান্নার কারনে মুখটা কেমন চুপসে গেছে। দেখতে কেমন মায়া মায়া লাগছে।
_______________
বিয়ের আয়োজনে মানুষের সংখ্যা কম নয় বরং বেশিই হয়। আজো তার ব্যতিক্রম নয়। নুসাইব পঞ্চাশ জনের কথা বললেও প্রায় শ’ খানেক মানুষ উপস্থিত আছে। এর মধ্যে পুরুষের সংখ্যা তুলনামূলক বেশি।
বিয়ে হলেও নুসাইবকে জোর করেও শেরোয়ানি পরানো গেলো না। আজকেও তার ফরমাল লুক। তমাল কিছুটা বিরক্ত হলেও বড় ভাই বলে কথা। জোরজবরদস্তি তো আর করা যাবে না। নুসাইবের কপালে চিন্তার ভাঁজ, অনবরত মোবাইলে কাউকে কল করে যাচ্ছে। হয়তো ওপাশের মানুষটা কল রিসিভ করছে না কিংবা নাম্বারটাই বন্ধ। এর মধ্যে নাসিম আর রুমেল উপস্থিত হলো। নাসিম রুমেল দু’জনেই চারপাশে তাকিয়ে দেখছে। নাসিম গলা ঝেড়ে বললো,, বিয়ে কয়টা করছিস বেটা? ভাবী তো আছে দেখলাম তাহলে আবার কিসের বিয়ে?
নুসাইব তিহানের নাম্বারে কল দিয়ে বললো,, “তোর ভাবীর সাথেই বিয়ে হচ্ছে। আগে অনুষ্ঠান হয়নি তাই এখন হচ্ছে।”
রুমেল বুকে হাত দিয়ে সতর্কের সাথে নিঃশ্বাস ফেলে। উত্তর না পেলে এই মুহূর্তে স্যারকে নিয়ে কত শত জল্পনা কল্পনা করে ফেলতো তার হিসেব নেই।
নাসিম চারদিকে চোখ বুলিয়ে বললো,,” কিরে বেটা তিহান কই?
নুসাইব কল লগ দেখিয়ে বললো,,” ওই বেটাকেই কল দিচ্ছি। কোনো খবর নেই। মেজর সাহেব ছুটিতেও ব্যস্ত। আজ যদি না আসে,আমিও ওর বিয়েতে যাবো না। ওই শালাকে বাদ দিয়ে দিবো।
নাসিম হাসতে হাসতে বলল,,”দুজন দুজনকে কয়েকশত বার বাদ দিয়েছিস হিসেব আছে? থাক তুই আমি আন্টি আংকেলের সাথে দেখা করে আসি।”
নাসিমের পিছু পিছু রুমেলও ছুটলো। একে একে সবাই আসলেও তিহান নেই। নুসাইবের ভীষণ মন খারাপ হলো। তার এমন একটা দিন যেখানে তার খুব কাছের বন্ধুটাই নেই।
নবনী আজ শাড়ি পরেছে। চুলে খোঁপা বেঁধে দুটো গোলাপ গুঁজে গুনগুন করে গান গাইছে। ছাই আর লালে মিশ্রিত শাড়িতে নবনীকে বেশ মানিয়েছে। তৃধা মুচকি হেসে বললো,, সমুদ্র এসেছে?
নবনী লাজুক হেসে বলে,,”জানি না। হয়তো এসেছে।’
,,” হয়তো কি? গিয়ে দেখে আসো।”
নবনী শাড়ির আঁচলে আঙ্গুল পেঁচিয়ে বলল,,” লজ্জা লাগছে। মনে হচ্ছে তাকালেই শেষ হয়ে যাবো।”
তৃধা মুচকি হেসে বলল,,” দেখো গিয়ে বেচারার চোখ দুটো তোমাকে দেখার জন্য ব্যস্ত হয়ে আছে। একবার দেখা দিয়ে আসো। সময়তো কম হয়নি। প্রায় দুটো বাজতে চললো। খাওয়া দাওয়া শেষে বসবে বলে মনে হয়না। হয়তো যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে।”
নবনী ঘড়ির কাঁটায় চোখ রেখে বলল,,” তোমাকে একা ছাড়লে ভাইয়া আমার আস্ত রাখবে না। বরের বাড়ি যাওয়ার আগে কবরস্থানের সফর করিয়ে আনবে।”
তৃধা আশ্বাস দিয়ে বলল,, তুমি যাও বাকি সব আমি সামলে নিবো। তোমাকে জিজ্ঞেস করলে বলবে তৃধা আপু পাঠিয়েছে। আমাকে জিজ্ঞেস করলে বলব আমি পাঠিয়েছি। দু’জনের কথা মিলে গেলে সমস্যা হবে না। দৌড় দাও তা না হলে প্রফেসরের দেখা পাবে না।”
,,”কিন্তু?”
,,”কোনো কিন্তু না। দৌড় দাও।”
নবনী ভরসা পেয়ে চঞ্চল পায়ে বের হলো। যদিও শেষ রক্ষা হলো না। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় নুসাইবের সামনে গিয়ে পড়ে। নুসাইব জিজ্ঞেস করার আগে হড়বড়িয়ে বললো,,”আমাকে তৃধা আপু পাঠিয়েছে। আমার দোষ নেই। একদম ধমকাবে না।”
নুসাইব কিছুই বললো না বরং ব্যস্ত পায়ে উপরে উঠে গেলো।
ড্রয়িং রুমে বসে আছে সমুদ্র তার কোলে নবনীর ছোট চাচার মেয়ে তুবা। তুবা আদো আদো গলায় কথা বলে। এর মধ্যে সমুদ্রের সাথে তার বেশ ভাব হয়েছে। মিলি আর মালা তুবাকে নিতে এসেছিল। তুবা যায়নি , বরং শক্ত করে সমুদ্রের গলা জড়িয়ে ধরে রাখে। সমুদ্রেরও ভীষণ আদুরে লাগলো তুবাকে। সেও তুবার সাথে বসে বসে সময় কাটাচ্ছে।
দুর থেকে সমুদ্রকে দেখলো নবনী। সমুদ্র মুচকি হেসে তুবার সাথে কথা বলছে। চারদিকে তাকিয়ে দেখলো প্রায় সবাই মেহমান নিয়ে ব্যস্ত। নবনী ঠোঁটে হাঁসি ঝুলিয়ে গুটি গুটি পায়ে একদম সমুদ্রের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।
সমুদ্র তুবা থেকে চোখ সরিয়ে সামনে তাকালো। নবনী ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে রেখে বলল,,” কেমন আছেন শ্যাম সুন্দর পুরুষ? ”
সমুদ্র লম্বা শ্বাস টেনে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে হাসলো। বললো,,” প্রিয়তমা যেমন রেখেছে।”
_____
তৃধার পরনে লাল রঙের বেনারসী।তার সাথে ম্যাচিং করে গহনা পরা। সাজসজ্জা তুলনা মূলক কম হলেও দেখতে সুন্দর লাগছে তৃধাকে। নুসাইবের মানা করার সত্বেও নবনী খুব হাল্কা মেকাপ করে দিয়েছে। বেনারসী শাড়ির সাথে না সাজলে বউ বউ ভাবটা আসেনা বলে নবনীর ধারনা। তাইতো খুব যত্ন করে সাজিয়েছে তৃধাকে। খোঁপায় গুনে গুনে দশটা ফুটন্ত গোলাপ গুঁজে ওড়নাখানা সেট করে দিয়েছে। তৃধা লম্বা শ্বাস টেনে আয়নার দিকে তাকিয়ে আছে। লাল রঙের বেনারসী মানেই নতুন বউ। আজ তৃধার কাছে নিজেকে লাল রঙের বেনারসীতে মোড়ানো টুকটুকে বউ মনে হচ্ছে। যদিও মনে হওয়ার মত কিছুই ছিলো না,সে সত্যিই আজ কারো বউ। তবে এই লাল বেনারসী তার জীবনে সুন্দর স্মৃতি বহন করে। তৃধার এখনো মনে আছে ছোট বেলায় আলমিরা খুলে মায়ের বিয়ের বেনারসী জড়িয়ে বউ সাজতো তৃধা। তখন মা বলতো ,,’ মা এইটা পরীর জন্য তুলে রাখবো। ছোট্ট পরী বড় হলে এই শাড়ি পরিয়ে বরের বাড়ি পাঠাবো’ । কথাটা মনে পড়ায় মুচকি হেসে বিড়বিড় করে বললো,,” অথচ মা তার ছোট পরীকে দেখলোই না “।
দরজায় কড়া নেড়ে দাঁড়িয়ে আছে নুসাইব।যদিও রুমটা তার, তবুও দরজা নক করে ভেতরে ঢোকা জরুরি। আগে সে একা থাকলে এখান ওইঘরটা তার একা নয়। খুব বেশি প্রিয় মানুষের সাথে রুমটা ভাগ করে নিয়েছে। তাই রুমটাতে ঢুকতে হলে একটু রয়ে সয়ে ঢুকতে হয়।
দরজায় টোকা পড়ার শব্দ শুনে আয়নার সামনে থেকে সরে দাঁড়ালো তৃধা। গলা ঝেড়ে জিজ্ঞেস করল,,” কে?”
নুসাইবের খুব ইচ্ছে হলো বলতে বউ আমি তোমার হাসবেন্ড। যদিও সেটা এই মুহূর্তে বলা শোভনীয় নয়। এখন বললে তৃধা লজ্জায় পড়বে। তারচেয়ে বড় কথা মেয়েটা ঠিক করে তাকাতেও পারবে না। লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যাবে। নুসাইব গলা ঝেড়ে বললো,,” আমি নুসাইব।”
তৃধা মহা বিপাকে পড়েছে। এক দিকে কাল রাতের কাহিনী অন্য দিকে বউ সাজ। দুটো মিলে লজ্জা লাগছে তার। যদিও এই মুহূর্তে কিছু করার নেই তাই বলে উঠলো,” ভেতরে আসুন।”
অপেক্ষা করার প্রশ্নই আসে না। তৃধা বলার সাথে সাথে দরজা খুলে ঢুকলো নুসাইব। তার ভেতরেও বউ সাজে তৃধাকে দেখার ভীষণ তাড়া। রুমে ঢুকে ব্যতিব্যস্ত ভাব দেখালেও একপলক তাকিয়ে মুগ্ধ হয়েছে ভীষণ। তৃধা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। নুসাইব আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল ঠিক করতে করতে বললো,,” সুন্দর লাগছে তোমাকে।
তৃধা মুখ তুলে তাকালো আয়নার দিকে। আয়নায় দৃশ্যমান প্রতিবিম্ব তার দিকে তাকিয়ে। তৃধা চোখ সরিয়ে নিলো।
মুখ টিপে হাসলো নুসাইব। হুটহাট করে লজ্জায় ফেলতে তার দারুন লাগে। এখন থেকে মাঝে মাঝেই কাজটা করবে বলে ঠিক করলো।
ইনশাআল্লাহ চলবে,,,