আমি আছি পর্ব-৫২+৫৩+৫৪

0
914

উপন্যাসের নাম::#আমি_আছি
লেখনিতে:#সাদিয়া_আফরোজ
পর্ব: ৫২
,
,
,
,
,
,
,
শাড়ি চুড়ি পরে তৈরি তৃধা। সাজগোজ বলতে লিপস্টিক আর মাসকারা। এরমধ্যে ফরিদা হক একটা গহনার বাক্স তৃধার হাতে দিয়ে পুনরায় বেরিয়ে গেলেন। তৃধা বরাবরই স্বর্ন গহনার প্রতি উদাসীন। তাও শ্বাশুড়ির মন রক্ষা করার জন্য পেন্ডেন্ট সহ একটা চেইন গলায় পরে নিলো। এর মধ্যে আয়নায় দাড়িয়ে কতবার যে নিজেকে দেখেছে তার হিসেব নেই।
কাজ সেরে রুমে ঢুকলো নুসাইব। শাওয়ার নিয়ে তৈরি হতে হবে । কনের বড় ভাই বলে কথা, অনেক দায় দায়িত্ব পালন করতে হবে। বরযাত্রী আসার আগে সেখানে উপস্থিত হতে হবে। রুমে ঢুকতেই চোখ পড়লো তৃধার দিকে। ঘুরে ঘুরে আয়নার মাঝে নিজেকে দেখছে সে। তা দেখে নিভৃতে হাসলো নুসাইব। তৃধাকে আজ একটু বেশিই সুন্দর লাগছে । পরনে সোনালী রঙের শাড়ি, চুল গুলো একপাশ করে খোঁপা বাঁধা। তার মাঝে তিনটে গোলাপ গুঁজে দেওয়া। চেহারার মাঝে কৃত্তিমতার ছোঁয়া না থাকলেও ঠোঁটে লাল টকটকে লিপস্টিক লাগানো। নুসাইব মুগ্ধ চোখে তাকালো। বউটাকে ভীষণ মোহনীয় লাগছে।
এইদিকে তৃধা যতবারই আয়না দেখছে ততবারই মনে হচ্ছে কিছু একটা নেই। কোনো একটা কারণে সাজটা অসম্পূর্ণ লাগছে।

বউয়ের কুঁচকে রাখা ভ্রু দেখে নুসাইবের সমস্যা বুঝতে দেরী হলো না। দুই পা বাড়িয়ে গলা ঝেড়ে বললো,,” ঝুমকো জোড়া পরে নাও,এর জন্য অসম্পূর্ণ লাগছে।”

তৃধা ঘুরে তাকালো নুসাইবের দিকে। নুসাইব হাঁসি মুখে তাকিয়ে কথাটা বলছে। মাঝে মাঝে তৃধা ভেবে পায় না কি ভাবে এই লোকটা সব সমস্যার সমাধান দিয়ে দেয়। তাও কতটা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে।তৃধা মৃদু হেসে বলল,,” বুঝলেন কি করে?”

নুসাইব লম্বা কদম ফেলে তৃধার সমিপে দাঁড়িয়ে বললো,,” তুমি প্রাসঙ্গিক সব কিছুই আমি খুব তাড়াতাড়ি বুঝে যাই। কেন বলতো?”

নুসাইব বেশ ভাবুক হয়েই প্রশ্নটা করলো।তৃধা জানে লোকটা ইচ্ছে করেই এমন প্রশ্ন করেছে। যার দরুন সে নজর লুকাতে ব্যস্ত। নুসাইব মুখে হাত চেপে হাসছে। তৃধা ঝুমকো জোড়া হাতে নিয়ে তড়িঘড়ি করে পরতে শুরু করলো। যতক্ষণ এইখানে থাকবে ততক্ষণ ঘুরে ঘুরে লজ্জা দিবে এই লোক।

টাওয়েল কাঁধে ঝুলিয়ে নিঃশব্দে হেসে ওয়াশ রুমে ঢুকলো নুসাইব। আর কিছু সময় দাঁড়ালে বউটা লজ্জায় শেষ হয়ে যাবে। ভালোবাসা অপ্রকাশিত থাকলে সব কিছুতেই লজ্জাটা হানা দেয়। তৃধা ভালোবাসলেও সেই ভালোবাসাটা মুখে প্রকাশ করেনি। অপ্রকাশিত ভালোবাসায় লাজটা সব সময় তুলনামূলক বেশিই থাকে, সেটা নুসাইব জানে।

তৃধার গালের দুপাশ গরম হয়ে গেছে। বেচারি দুহাতে গাল চেপে ধরে ওয়াশ রুমের দিকে তাকিয়ে আছে।নিজে নিজে বিড়বিড় করে বললো,, “ধুরন্ধর সাংঘাতিক লোকতো আপনি। ইচ্ছে করেই লজ্জায় ফেলেছেন তাই না? হুহ!”

নুসাইবের চেহারা থেকে হাসিটা এখনো সরেনি। পুরোটা সময় হাসি ঝুলিয়ে শাওয়ার নিয়ে বেরুলো। বিছানায় সাজিয়ে রাখা প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দেখে হাসির রেখা প্রগাঢ় হলো আবার। নুসাইবের মতে তৃধা বোধহয় লক্ষী বউয়ের কাতারে পড়ে। যে বউ বলার আগেই প্রয়োজন বুঝে নেয়। বুক ফুলিয়ে নিঃশ্বাস নিয়ে তৈরি হতে লাগলো।
*
*
বউ সাজ নিয়ে বসে আছে নবনী। তার পাশে রিমি বসে বসে তমালের দোষ ধরছে। তিন্নি ঘুরে ঘুরে বোনকে দেখছে। ছোট পাখিটাকে বউ সাজে দারুন লাগছে। দেখতে দেখতে পাখিটা কত বড় হয়ে গেছে। আজকে আবার তার বিয়ে। সবটাই যেন অবিশ্বাস্য লাগছে। ফরিদা হক মেয়েকে দেখে গেছে বার কয়েক। কয়েক সেকেন্ডের বেশী মেয়েটার দিকে তাকাতে পারছে না। গলা ধরে আসছে, বুকটা ফেটে যাচ্ছে মনে হয়। তিনি নিজেকে অনেকটা শক্ত রেখে মেহমানদের দেখাশোনা করছে।
চিন্ময় আর তমাল ঘুরে ঘুরে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছে। নাবীব শেখ মাহাবুব ইসলামকে নিয়ে বসে আছেন। তারা তাদেরকার সময়ের কথা নিয়ে বসেছেন।

একটা বাজতেই দুটো গাড়ি এসে থামলো গেইটের সামনে। মহিলারা সবাই আসলেও পুরুষ কেউ এখনো উপস্থিত হয়নি। মাঝরাস্তা নামাজের জন্য গাড়ি থামিয়ে নেমে পড়েছে সবাই। এইদিকে তমাল, তিহান, নুসাইব , চিন্ময় মহিলাদের জন্য এগিয়ে এলো। ফরিদা হক তার বোন ফাতেমা হক আর বেয়ান মায়া জাহানকে নিয়ে শেফালী বেগমকে রিসিভ করতে এলেন। মেয়েরাও বসে নেই। সবাই সবার সাথে কুশলাদি বিনিময় করতে ব্যস্ত। মাইশার সাথে গাড়ি থেকে নামলো ইশিকা। চোরা চোখে চারপাশে তাকিয়ে তিহানকে খুঁজতে গিয়ে চোখে চোখ পড়লো। তিহানেরো সময় লাগলো না চিনতে। ইশিকা খেই হারিয়ে ভীড়ের মাঝে বসে পড়লো। ব্যাপারটা তিহানের বুঝতে দেরী হলো না। তিহান শব্দ করে হেসে উঠতেই নুসাইব সন্দিহান চোখে তাকিয়ে বললো,,” তোর আবার মনে রং লাগলো নাকি?”

তিহান হাঁসি চেপে বললো,,” ধুর বেটা, তেমন কিছু না।”

,,”তাহলে হাসছিস কেন?”

,,”সেটা পরে বলবো।”

ইশিকা লুকানোর চেষ্টা করলেও সবার ধাক্কায় ঠিকই তিহানের সামনে গিয়ে থামলো। বেচারি লজ্জায় লাল নীল হয়ে যাবার দশা। পারলে এক্ষুনি মাটি খুঁড়ে ভেতরে লুকিয়ে পড়ে। তিহান হাঁসি আটকে রাখতে ব্যর্থ। মেয়েটাকে এই পরিস্থিতিতে দেখে খারাপ লাগার সাথে হাসিটাও পাচ্ছে বেশ। যদিও এই মুহূর্তে হাসা মোটেও উচিত নয়। মেয়েটা নিশ্চিত অস্বস্তিতে। তিহান নিজেও চায় না এমনটা হোক।
মায়া জাহান ছেলের দৃষ্টি অনুসরণ করে ইশিকার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। ব্যাপারটা ফরিদা হকেরও নজর এড়ায়নি। তিনি ভেবেই রেখেছে আজ সমুদ্রের মায়ের সাথে এই বিষয় নিয়ে কথা বলবেন।

বর বরন থেকে শুরু করে বিয়ে,খাওয়া দাওয়া শেষ পর্যায়ে। এর মধ্যে সবাই মিলে ছবি তুলছে। তমাল অজানা কারণে রিমির দিকে তাকিয়ে আছে। হুট করে কিজানি কি হলো, তমাল রিমিকে দেখে মুচকি মুচকি হাসছে। হাত নেড়ে কথা বলার ব্যাপারটা বেশ গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। নবনী সবার ভীড়ে দুই ভাইকে চোখে হারাচ্ছে। নুসাইব তৃধাকে নিয়ে স্টেজের দিকে এগোতেই তমালের দিকে চোখ পড়লো। নুসাইব তৎক্ষণাৎ থেমে গেলো। তৃধাও নুসাইবের সঙ্গে দাঁড়িয়ে গেলো। নুসাইব কপাল কুঁচকে তৃধাকে উদ্দেশ্য করে বলল,,”ব্যাপারটাকি শুধু আমার চোখেই পড়ছে? তুমিকি কিছু দেখতে পাচ্ছো?”

তৃধা বুঝার চেষ্টা করছে কি নিয়ে কথা বলছে। নুসাইব তৃধাকে ইশারায় তমালের দিকে তাকাতে বললো। তৃধা সেই দিকে তাকিয়ে বলল,,” নবনীর বান্ধবী রিমিকে দেখছে। শুনলাম রিমি নাকি তমাল ভাইকে খুব পছন্দ করে। যদিও এই বাড়িতে পা রাখার পর তমাল ভাই শুধুই রিমির সাথে ঝগড়া করেছে। কিন্তু এই মুহূর্তে যা দেখছি তা দেখে ভিন্ন কিছু মনে হচ্ছে। আপনার কি মনে হয়?”

নুসাইব মুচকি হেসে বলল,,” তোমার যা মনে হচ্ছে সেটা আমারো মনে হচ্ছে।”

,,”হুম,,! তবে আজ তমাল ভাইকে কিছুটা আপনার মত লাগছে।”

,,” আজ? তাও আমার মত? কি ভাবে বলতো?”

,,”তাকিয়ে দেখুন, চোখে মুখে মুগ্ধতা উপচে পড়ছে। দেখলে যে কেউ বলতে পারবে এই চোখে সে তার ভালোবাসার মানুষটাকে দেখছে। আপনারো এমন হয়।”

নুসাইব বাঁকা হাসলো। আদুরে গলায় ফোঁড়ন কেটে বললো,,” সবইতো বোঝো দেখছি।এতোই যখন বুঝো তখন ভালোবাসলে না কেন?”

তৃধা মাথা নিচু করে হেসে পুনরায় নুসাইবের দিকে তাকিয়ে বলল,,”সেটা কখন বললাম?”

নুসাইব বিভ্রান্ত চোখে তাকিয়ে আছে তৃধার দিকে। তৃধা কথা বাড়ালো না। বরং আলতো করে নুসাইবের হাত ধরে বললো,,” চলুন নবনী খুঁজছে।”
*
*
বিয়ে শব্দটা ছেলে মেয়ের ক্ষেত্রে ভিন্ন হয়। বিয়েতে একটা ছেলের জীবনে তেমন কিছুই বদলায় না। তার জীবনে শুধু একজন নারী যোগ হয়। যাকে সে একান্ত ব্যক্তিগত বলে সম্বোধন করে। যদিও সেই মানুষটা তার জীবনটাকে খুব বেশি প্রভাবিত করে না। কিন্তু একটা মেয়ের জীবনে বিয়ে শব্দটার অর্থ ভিন্ন। তাকে তার চেনা পরিচিত জগৎ পেছনে ফেলে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা জগতে পা রাখতে হয়। সেই জগতে ভিন্ন মানুষের ভিন্ন চিন্তাধারার সাথে জীবনটাকে পুনরায় শূন্য থেকে শুরু করতে হয়। একটা মানুষের হাত ধরে অন্য একটা জগতে পদার্পণ করা কম কথা নয়। তেমনি নবনীও আজ সমুদ্রের হাত ধরে এগিয়ে যাচ্ছে। ফরিদা হক বারবার চোখ মুছলেও চোখজোড়া পুনরায় ভিজে উঠছে। নাবীব শেখ মেয়েকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। নবনী শব্দ করে কাঁদছে। মেয়ের সাথে তিনি নিজেও কাঁদছে।

তমাল মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কোঁকড়ানো চুল গুলো সামনে ঝুঁকে পড়াতে কাঁদছে কিনা সেটা বুঝা যাচ্ছে না।
শত ঝগড়া হলেও তমালের প্রতি রিমির অনূভুতি গুলো মিথ্যা নয়। রিমি লম্বা শ্বাস টেনে চোখ মুছে তমালের পাশে দাঁড়িয়ে টিস্যু এগিয়ে দিলো। মুখের সামনে টিস্যু দেখে পাশ ফিরে তাকালো। রিমি বিষন্ন চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
তমালের রক্তবর্ণ টইটুম্বুর চোখ জোড়া দেখে থমকালো রিমি‌। বার কয়েক পলক ফেলে দৃষ্টি স্থির করলো। তমালকে এই ভাবে দেখতে রিমির একটু ভালো লাগছে না। রিমি টিস্যু পেপার তমালের হাতে পুরে দিয়ে সরে দাঁড়ালো।

তমাল টিস্যু হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেও চোখটা মুছলো না। এই টিস্যু পেপার দ্বারা এতো পানি মোছা যাবে না। তমাল ঠোঁট কামড়ে নিজেকে ধাতস্থ করার চিন্তা করতে না করতেই নবনী এসে দুই হাতে জড়িয়ে ধরলো ভাইকে। তমাল সামলে উঠতে পারলো না। নবনীকে দুহাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। বাড়ি ফিরে বোনটাকে আর দেখতে পাবে না,তার সাথে ঝগড়াটাও আর হয়ে উঠবে না, বোনকে নিয়ে বাবার সাথে মনক্ষুণ্ণ হওয়াটাও আর হয়ে উঠবে না। ভাবতেই তমালের কলিজা ফেটে যাওয়ার জোগাড়। ভাই বোনের কান্না দেখে সবাই হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। তিন্নি আর তার ছেলে একসাথে কেঁদে ভাবাচ্ছে। চিন্ময় কাকে রেখে কাকে থামাবে সেটাই ভেবে পাচ্ছে না। ফরিদা হক ডুকরে কাঁদছে। মায়া জাহান তাকে সামলানোর চেষ্টা করছে।

এই দিকে সবাইকে দেখা গেলেও নুসাইব তৃধা কেউ নেই।
সবার পেছনে খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে নুসাইব। তার চোখ জোড়া ঈষৎ লাল।বার বার হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছে গভীর নিঃশ্বাস ফেলছে। তৃধা নুসাইবের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। নুসাইবকে তৃধাই ধরে নিয়ে এসেছে। নবনীর বিদায় শুনেই বাগানের এক কোনায় দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে চোখের জল ফেলছিলো সে। তৃধা অনেক জোর করে এই ওবদি আনলেও নবনীর গাড়ি পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারেনি। তমালের কান্নার আওয়াজ শুনতেই তৃধা ডুকরে কেঁদে উঠলো। নুসাইব শক্ত হাতে তৃধার হাত চেপে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। সে কিছুতেই চাইছে না কাঁদতে। কিন্তু সব চাওয়াতো আর নিজের অনূকুলে থাকে না। নবনী ব্যস্ত চঞ্চল চোখ জোড়া ঠিকই খুঁজে নিলো ভাইকে। সবার ভীড় ঠেলে ভাইয়ের কাছে যেতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি তার। নুসাইবের যেন বাধ ভাঙ্গলো। দুহাতে শক্ত হয়ে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করল। দুর থেকে দাঁড়িয়ে দেখছে সমুদ্র। লম্বা শ্বাস ফেলে এগিয়ে গেলো। সমুদ্র যানে এই পরিবার থেকে ঠিক কতটা মূল্যবান মানুষকে সে নিয়ে যাচ্ছে। চার ভাইবোন একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। অদ্ভুত সুন্দর এই দৃশ্য। উপস্থিত সবাই বেশ অদূরে চোখে দেখছে এই দৃশ্য। তিহান বারকয়েক পলক ফেলে সামলে নিলো নিজেকে।

গাড়িতে ওঠার আগে নবনী তৃধাকে কাছে ডেকে দুহাতে আগলে নিয়ে বললো,,” আমার ভাইকে ভালোবাসবে কিন্তু।”
তৃধা নবনীর কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো,,” বাসি কিন্তু ।”
কান্নার মাঝে হেসে উঠলো নবনী। নবনীর হাসিটা সবার বোধগম্য হলো না। সবাই কৌতুহলী চোখে তাকিয়ে আছে। তৃধা চোখ মুছে নুসাইবের কাছ ঘেঁষে দাঁড়ালো। বিদায়ের ঘন্টা বেজে গেছে। সবাই গাড়িতে উঠে বসলেও সমুদ্র এখনো গাড়িতে উঠলো না। সে নাবীব শেখকে জড়িয়ে ধরে বললো,,”আপনার সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ নিয়ে যাচ্ছি। হয়তো তার মূল্যটা আমি আপনার মত বুঝবো না। কিন্তু বাবা আপনি ভরসা রাখুন,আমি কখনোই তার অযত্ন করবো না। সব সময় আগলে রাখবো তাকে।
সবার থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠে পড়লো সমুদ্র। ধীরে ধীরে গাড়ি গুলো চোখের সামনে থেকে দূরে যেতে শুরু করল।
নবনী পেছন ফিরে তাকালো। গভীর নিঃশ্বাস ফেলে আপন জনদের পেছনে ফেলে যাওয়াটা দেখছে। এই মুহূর্তে যদি নবনীকে কেউ জিজ্ঞেস করতো বিয়ে কি?’ তবে নবনীর এক সেকেন্ড দেরি না করে বলতো,’চেনা পরিচিত একটা ঘর শূন্য করে , অচেনা আরেকটা ঘর পূর্ণ করাকেই বিয়ে বলে।

চলবে,,,

উপন্যাসের নাম::#আমি_আছি
লেখনিতে:#সাদিয়া_আফরোজ
পর্ব: ৫৪ (১ম খন্ড)
,
,
,
,
,
,
,
ফরিদা হক আর মায়া জাহানের বিস্তার আলাপ শেষে তৃধা জানতে পেলো তার ভাইয়ের জন্য পাত্রী খোঁজার ব্যাপারটা অনেকটাই এগিয়ে গেছে। পাত্রী আর কেউ নয় সমুদ্রের খালাতো বোন ইশিকা ইমনিদাহ্ । তৃধা তাকে খুব ভালো করেই চেনে। বউভাতের দিন ইশিকা মেয়েটা তার আর নুসাইবের একসাথে অনেক গুলো ছবি তুলে দিয়েছিলো। তার চেয়ে বড় কথা তৃধাও মনে মনে মেয়েটাকে তার ভাইয়ের জন্য পছন্দ করেছিল। কিন্তু আজ তার সম্পর্কে অনেক গুলো ইনফরমেশন পেলো। মেয়েটা সবে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করেছে। তৃধার মতে এই মেয়েটা তার ভাইকে বুঝবে। অন্যদিন হলে এমন খবরের পর তৃধা ভাইয়ের পেছন পেছন ঘুর ঘুর করে ইশিকা ইমনিদাহ্ নাম জপ করতো। কিন্তু আজকের পরিস্থিতি ভিন্ন। চাইলেও হাসা যাচ্ছে না কথা বলা যাচ্ছে না। সব কিছু থেকে যেন আগ্ৰহটা হারিয়ে ফেলেছে। মায়া জাহান টেবিলে খাবার সাজিয়ে সবাইকে ডাকলেও তৃধা গেলো না। তিহান ঘড়ি দেখে বললো,,” সাড়ে এগারোটা বেজে গেছে। খাবি না নাকি? আয় একসাথে খাই।”

তৃধা ভাইয়ের দিকে একবার তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো। মোবাইলখানা নেড়েচেড়ে বললো,,” ইচ্ছে করছে না। পরে খাবো।”

মায়া জাহান মুচকি মুচকি হাসছে। মাহাবুব ইসলাম মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,,” শরীর খারাপ লাগছে? বাবাকে বল কি হয়েছে?”

মায়া জাহান হতাশা হলেন। এই পুরুষজাতি কখনোই নারীর দুঃখ বুঝবে না। মন খারাপকে পেট খারাপ আর পেট খারাপ কে মনখারাপের উপাধি দেওয়ার পর বলবে নারীকে বুঝা দায়। এতো বছরে যাকে মন খারাপ আর শরীর খারাপের মধ্যে পার্থক্য বুঝাতে পারেনি তাকে আজো যে বুঝাতে পারবেন না সেটা তিনি ভালো করেই জানেন। তাই ধমকে বললো,,” মেয়েটাকে বিরক্ত করো না। চলে এসো। ”

তমাল বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে পুনরায় বললো,,” নুসাইব কখন আসবে?কল দিয়েছিস?”

মাহাবুব ইসলাম চিন্তিত গলায় বলল,,” হ্যাঁ রে মা, একটা কল দিয়ে দেখতো। ছেলেটা দুপুর কি খেয়েছে ,নাকি না খেয়ে আছে কিছুই তো জানি না। এখন আবার এতো দেরি হচ্ছে। একটা কল দে।”

মায়া জাহান স্বামীর উপর ভীষণ বিরক্ত।

তৃধা সকাল থেকে রাগটাকে পুষলেও এতোটা রাগ হয়নি, এখন যতটা হচ্ছে। তাও রাগটা প্রকাশ করলো না । কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে শান্ত শিতল গলায় বলল,,”এতো চিন্তা হলে তোমরা কল দিয়ে খোঁজ নাও। আমাকে কেন বলছো? সে কি ছোট বাচ্চা নাকি , তাকে কল দিয়ে দিয়ে খাওয়া দাওয়ার খোঁজ নিতে হবে! এতো দূর যখন যেতে পেরেছে খেতেও পারবে। কল দিয়ে বিরক্ত করার কারণ দেখছি না।”

তীব্র রাগ অভিমান যুক্ত কথা শুনে মাহাবুব ইসলাম অবাক হলেও মায়া জাহান মৃদু হাসলেন।
এইদিকে নুসাইবের অবস্থার কথা ভেবে তিহান মুখে হাত চেপে হাঁসি কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছে। মাহাবুব ইসলাম বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে।
তৃধা বসা থেকে উঠে সোজা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলো । মায়া জাহান প্লেটে ভাত বেড়ে বললো,,” আর কিছু শুনতে চাইলে মেয়ের পিছু পিছু যাও।”

,,”মায়া,! তোমার মেয়েটাতো দেখছি পুরাই তোমার মত। তুমিও এইভাবে কথা বলো।”

মায়া জাহান ভাব নিয়ে বললেন,,” আমার পেট থেকে হয়েছে , অবশ্যই আমার মত হবে।”

মাহাবুব ইসলাম কথা বাড়ালেন না। এতো বছর ধরে যার কাছে হেরে এসেছে,আজ নতুন করে জেতার ইচ্ছে নেই। তিনি চুপচাপ বসে খাওয়া শুরু করলেন।

তিহান খাবার খাওয়া রেখে মোবাইল নিয়ে বসেছে। দুই হাতে খুব দ্রুত টাইপিং চলছে। মায়া জাহান দেখেও ব্যাপারটা এড়িয়ে গেলেন। তিনি জানেন তিহানের মোবাইলের অপর প্রান্তে থাকা ব্যাক্তিটা নুসাইব ছাড়া কেউ নয়। এক বন্ধু আরেক বন্ধুর পিঠ বাঁচানোর চেষ্টা করছে।

তিহান গোটা গোটা অক্ষরে লিখলো,,” ডিয়ার বোনের জামাই, আপনার অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, আপনার স্ত্রী এখনো ডিনার করেনি। আপনার জন্য অ*স্ত্র স*স্ত্র নিয়ে অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছে। তার রাগের তোপের মুখে পড়লে হয়তো পু*ড়ে টু*ড়ে যেতে পারেন। তাই বাড়ি ফেরার সময় অবশ্যই ফায়ার সার্ভিসে কল দিয়ে আসবেন। আমি সাহায্য করবো এমন চিন্তা ভুলেও মাথায় আনবেন না। বাড়িতে আমার মেজর পদ বড়ই নগন্য।
ইতি আপনার বউয়ের বড় ভাই,
নিরিহ মেজর তিহান বিন মাহাবুব।

মেসেজ সেন্ড করে খাওয়ায় মনোনিবেশ করলো। মায়া জাহান তিহানের পাতে সবজি দিতে দিতে বলল,,” ছুটি তো বেশি নেই বোধহয়?”

,,”না। আটদিনের মত আছে।কেন বলোতো?”

,,” চলবে। শোন পরশু তোর জন্য মেয়ে দেখতে যাবো। পছন্দ হলেই বিয়েটা সেরে ফেলব।”

তিহান ভাত মুখে দিতে ভুলে গেছে। মাহাবুব ইসলাম ব্যাপারটা প্রথম থেকেই জানেন তাই তার কোনো রিয়েশন দেখা গেলো না। তিনি চুপচাপ খাচ্ছেন। তিহান খাওয়া বাদ দিয়ে বললো,,” হঠাৎ? তাও এতো তাড়াতাড়ি?”

ছেলের কপালে ভাঁজ দেখে মায়া জাহান প্রশ্ন করলেন,,” কেন?তোর কোনো পছন্দ আছে নাকি? থাকলে বল। আর হ্যাঁ এতো তাড়াতাড়ি মানে? তোর সাথেরটা তোর বোনকে বিয়ে করে সংসার করে ফেলছে আর তুই ? দা গ্ৰেট মেজর তিহান এখনো বসে বসে বলছে এতো তাড়াতাড়ি! লজ্জা লাগে না তোর জুনিয়র সবাই বিবাহিত অথচ তোর জিবনে কেউ নেই। কোথাও পছন্দ না থাকলে,কোনো কথা হবে না। ভালো ভদ্র ছেলের মত আমার সাথে যাবি।”

তিহান হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে বললো,,”মাআআ!”

মায়া জাহান ধমকে উঠে বললো,,” একদম ছাগলের বাচ্চার মত ম্যা ম্যা করবি না।”

মাহাবুব ইসলাম চাঁপা হাসছে।

,,”শোন,মেয়েটা ভীষণ ভালো তোর সাথে দারুন মানিয়েছে। আমার তো দেখেই চোখ জুড়িয়ে গেছিলো। তৃধার শ্বাশুড়িরও পছন্দ হয়েছে।”

তিহান বিভ্রান্ত হয়ে বললো,,”আমার সাথে মানানোর জন্য দেখলে কই? তাছাড়া ফরিদা আন্টিও জানে?”

,,”আরে হলুদের দিন তোরা দাঁড়িয়ে কথা বলছিলি না? মনে নেই? ফুচকা স্টলের সামনে ওই মেয়েটা আরকি। মেয়ের নাম ইশিকা ইমনিধাহ্। যেমন সুন্দর নাম তেমনই ভালো। এইবার গ্ৰাজুয়েশন কমপ্লিট করেছে। ”

ইশিকা ইমনিদাহ্ শুনে তিহান বিষম খেলো। হলুদ থেকে শুরু করে বউভাত পর্যন্ত অনেক বার চোখাচোখি হয়েছে তাদের। কিন্তু এখন পাত্রী হিসেবে তার কথা শুনে কি বলবে সেটাই ভেবে পাচ্ছে না। গভীর চিন্তায় পড়ে গেলো তিহান। মেয়েটা ঠিকই বলেছিলো,বিয়ে বাড়িতে ছেলে পক্ষ মেয়ে পক্ষের অবিবাহিত ছেলে মেয়ে নিয়ে যেমন আলোচনা করে, তেমনি মেয়ে পক্ষও ছেলে পক্ষের অবিবাহিত ছেলে মেয়ে নিয়ে আলোচনা করে।’ আজ সেটা সত্যি প্রমাণ হলো। আলোচনা বাদ দিয়ে সোজা বিয়ে পর্যন্ত পৌঁছে গেছে।
*
*
মেসেজ টোনের শব্দ শোনা মাত্রই গাড়িটা থামালো নুসাইব। বধুয়া বোধহয় একটু বেশিই রেগে আছে। পুরোদিনে কল মেসেজ কিছুই দেয়নি। দেওয়া তো দূরের কথা কল রিসিভ পর্যন্ত করেনি। এখন হঠাৎ মেসেজ টোন শুনে নুসাইব ভাবলো হয়তো তৃধা দিয়েছে। নিভৃতে যত্নে সেই মেসেজ পড়ার জন্য মাঝ পথে গাড়ি থামিয়ে মোবাইল হাতে নিলো। ব্যাপারটা নিছক পাগলামী হলেও নুসাইব তোয়াক্কা করলো না। যে ভালোবাসা নিয়ম ভাঙ্গে না সেটা বোধহয় ভালোবাসাই নয়।
লকস্ক্রিনের ছবিটার দিকে তাকলো নুসাইব। এই ছবিটা বেশ আদুরে লাগে। ছবিটা নবনীর বিয়ের দিন তোলা। ক্যামেরাম্যান তমালের পরিচিত ছিল, সে প্রায় একপ্রকার জোর করেই ছবিটা তুলেছিলো। যদিও ক্যামেরাম্যান নিজে সব শিখিয়ে পড়িয়ে দিয়েছে।
ছবিটাতে তৃধা আর নুসাইব প্রায় মুখামুখি দাঁড়িয়ে আছে। নুসাইব তৃধার কোমরে হাত রেখে গভীর চোখে তাকিয়ে আছে তৃধার দিকে। তৃধা তার ডান হাতটা নুসাইবের বুকের উপর রাখে তার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে।। মূহুর্তটা তখনই ক্যামরা বন্দি করা হলো। এই ছবিটার দিকে যত সময় তাকিয়ে থাকুক না কেন তাও যেন দেখা শেষ হয় না। মোবাইল আনলক করে কপাল কুচকালো নুসাইব। কাঙ্ক্ষিত ব্যাক্তি বাদে এই মুহূর্তে সবাইকেই বিরক্ত লাগছে তার। সেই তালিকায় তিহানো আছে। নুসাইব বিরক্তি নিয়ে মেসেজ সিন করলেও মেসেজ পড়ার পর একপ্রকার শব্দ করেই হেসে উঠলো। তাৎক্ষণিক মোবাইল পেসেঞ্জার সিটে রেখে গাড়ি স্টার্ট করলো। ভালোবাসা না হোক তবে রাগটা ফুটে উঠুক।

চলবে,,,

উপন্যাসের নাম::#আমি_আছি
লেখনিতে:#সাদিয়া_আফরোজ
পর্ব: ৫৪ (২য় খন্ড❣️)
,
,
,
,
,
,
,
ঘড়ির কাঁটা বারোটা ছুঁই ছুঁই। তৃধা গুছানো রুমটা আবারো গুছালো। সময় কাটছেনা তার। মোবাইলটাও দেখার ইচ্ছে নেই। অপেক্ষা যে এতো তিক্ত হয় সেটা মনে হয় আজই হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।
নুসাইব বাড়িতে পৌঁছাতেই তিহানকে কল করলো। তিহান দরজা খুলে দিতে দিতে বলল,,” রেগে থাকলে খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দেয় আপনার মিসেস। আর হ্যাঁ এই রাগের উপর পানি না ঢেলে রাগ বাড়াতে যাবেন না,পরে রুমের বাইরে ঘুমাতে হবে। রুম থেকে বের করে দিলে আমিও কিন্তু আমার রুমে জায়গা দিবো না।”

,,” বাপরে এতো রাগ? অবশ্য আমার সাথে এতো রাগবেনা। তোর বোনটা আমায় ভালোবাসেরে।”

তিহান কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল,,” তোর লজ্জা লাগে না আমার সামনে আমার বোনের কথা বলছিস? সম্পর্কে আমি তোর বড় ভাই।”

নুসাইব মুচকি হেসে বলল,,” রাখ তোর সম্পর্ক। আমি ম*রি আমার টেনশনে।”

তিহান পকেটে হাত গুঁজে ভাবলেশহীন ভাবে বলল,,” খাবার গরম করার জন্য খালাকে ডেকে দিবো? নাকি তুই করে নিবি?”

,,” অদ্ভুত! তুই আছিস কেন? তোর বাড়ির জামাই আমি। তুই গরম কর।”

তিহান ভ্রু কুঁচকে কয়েক তাকিয়ে বলল,,”আমার ঠেকা পড়েনি। বউ আছে তাকে গিয়ে বল। টেবিলের উপর হেলমেট আছে ওইটা পরে রুমে যা। বাকি হাত পা যা ভাং*বে সেটা সকালে দেখা যাবে। মাথা ইম্পর্ট্যান্ট।”

নুসাইব ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে তিহানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। ভাই বোন দু’টোকেই আজ অপরিচিত লাগছে।
তিহান মুচকি হাসতে হাসতে সিঁড়ি বেয়ে নিজের রুমের দিকে গেছে।

নুসাইব আস্তে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে রুমের দিকে অগ্রসর হলো। আজ দরজা নক করলো না। বরং আলতো হাতে দরজার লক খুলে ভেতরে ঢুকলো। তৃধা তখন তার ক্লজেটটা গুছিয়ে বেরিয়েছে মাত্র। নুসাইব তৃধার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তৃধাও নুসাইবের দিকে তাকিয়ে আছে। দুজনের চোখাচোখি হলেও তৃধা চোখ সরালো খুব দ্রুত। নুসাইব ছোট করে নিঃশ্বাস ফেলে মোবাইল ফোন রেখে ঘড়ি খুলতে খুলতে বলল,,” মুখটা এতো শুকনো লাগছে কেন? খাওয়া হয়নি?”
তৃধার রাগটা আরেকধাপ বাড়লো। সে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বললো,,” খেয়ে এসেছেন? না খেলে খাবার গরম করতাম।”

নুসাইব কোট খুলে ডিভানের উপর রেখে বললো,,” প্রিয়তাকে রেখে একবেলা খাওয়াটা যেখানে অনেক কষ্টের সেখানে দুবেলার কথা তো প্রশ্নই উঠে না।”

উত্তর শুনে চুপ থাকলেও তৃধা জানে এই উত্তরে তার রাগটা উবে যাওয়ার জোগাড়। তাই দ্রুত নুসাইবের টিশার্ট ট্রাউজার রেখে রুম ছেড়ে বের হয়।

তৃধার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে হাসলো নুসাইব। বধুয়া রেগে নেই বরং অভিমান করে আছে। রাগ পড়লেও অভিমান বড্ড খারাপ জিনিস। সম্পর্কের মধ্যে ধীরে ধীরে দূরত্ব তৈরির কারন এই অভিমান। নুসাইব দেরি করলো না। চটজলদি শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে টাওয়েল দিয়ে চুল মুছতে মুছতে নিচে নেমে এলো।
তৃধা এক প্লেটে খাবার বেড়ে দাঁড়িয়ে আছে। মায়ের হাতের রান্না অসাধারণ হলেও আজ সব কিছুই বিস্বাদ মনে হচ্ছে। নুসাইব চেয়ার টেনে বসে বললো,,” দাঁড়িয়ে আছো কেন?তোমার প্লেট কই?”

,,” আমি খেয়েছি। শুধু আপনি বাকি আছেন।”

নুসাইব কথা বাড়ালো না। একটা চেয়ার টেনে তৃধার হাত ধরে বললো,,” বসো এইখানে।”

তৃধা বিনা বাক্যব্যয়ে বসে পড়লো। তৃধা সমেত চেয়ারটা টেনে নিজের একদম কাছে নিয়ে এলো নুসাইব। তৃধা চমকালেও প্রকাশ করলো না। নুসাইব ভাত মেখে তৃধার মুখের সামনে ধরলো। তৃধা তৎক্ষণাৎ মুখ ফিরিয়ে বললো,,”আমি খেয়েছিতো।”

নুসাইব মৃদু হেসে বলল,,” তুমি বলেছো আর আমি বিশ্বাস করেছি? মোটেও না। তোমার চোখ মুখ বলছে তোমার খাওয়া হয়নি। তাছাড়া আমি বাড়ি ফিরবো না বলার পর খেয়ে নিলে অবাক হতাম না। এমন কখনো হয়নি যেখানে আমি দেরী করে ফেরার কারণে তুমি ডিনার কমপ্লিট করে ঘুমিয়ে গেছো। আমি জানি তুমি আমার অপেক্ষায় আছো। বিয়ের পর থেকে দেখছি তোমাকে তৃধা। দুপুর না হোক রাতের খাবারটা তোমার সাথে খেয়ে অভ্যস্ত আমি। নিয়মটা না তুমি বদলেছো না আমি, কখনো বদলাবেও না। হা করো।

তৃধা মাথা নিচু করে চুপচাপ নুসাইবের কথা শুনছে। নুসাইব মুচকি হেসে তৃধার মুখে ভাত পুরে দিয়ে, নিজেও খেতে লাগলো তৃধাকেও খাওয়াতে লাগলো। তৃধার চোখ জোড়া ভিজে উঠেছে অনেক আগেই। সেই ভেজা চোখের কোন বেঁয়ে দুফোঁটা নোনা জল গড়িয়ে পড়লো।

তিহান পানির জন্য রুম ছেঁড়ে বের হলেও পানি পান করা আর হয়ে উঠলো না। নুসাইব আর তৃধার এই সুন্দর মূহুর্তটা নষ্ট না করে মুচকি হেসে খালি জগটা নিয়ে আবারো রুমে ফিরে গেলো।

নুসাইব তৃধার ভেজা চোখ দেখেও মৌন রইলো।তৃধা হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছে চুপচাপ বসে আছে। হাজারটা অভিযোগ যেন কম পড়ছে।সেই অভিযোগ গুলো মনে মনে থাকলেও মুখ দিয়ে একটা শব্দ বের হচ্ছে না। নিজেই নিজের সাথে বেইমানি করছে মনে হয়।

নুসাইব খাওয়া দাওয়া শেষ করে বসে আছে। তৃধার সব গুছানো হয়ে গেছে দেখে রুমের দিকে অগ্রসর হলো। তৃধা কিচেনে দাঁড়িয়ে আছে। বুঝতে পারছে না কার উপর রাগছে সে। নুসাইবের উপর নাকি নিজের উপর। কান্না পাচ্ছে তার ভীষণ কান্না পাচ্ছে। লোকটা তাকে বুঝেও বুঝতে পারছে না দেখেই ভীষণ কান্না পাচ্ছে।

নুসাইব রুম জুড়ে পায়চারি করছে। মেয়েটা নিজে কেঁদে তো কষ্ট পাচ্ছেই তার সাথে তাকেও কষ্ট দিচ্ছে। তৃধা রুমে ঢুকে বিছানায় বসতেই নুসাইব হাত ধরে টেনে দাঁড় করিয়ে বললো,,” কেন রাগ করলে বলো? এমন লাগছে কেন? কাঁদছ কেন?”
তৃধার গলা ধরে আসছে। ঠোঁট জোড়া কাঁপছে তার।
নুসাইব তৃধার দুগালে হাত রেখে নরম গলায় বলল,,”রেগেছো যখন রাগ দেখাও। কেন শুধু শুধু কষ্ট পাচ্ছো?”
তৃধা নুসাইবের হাত সরিয়ে তীব্র অভিমান নিয়ে বললো,,” আমার রাগ দেখার সময় আপনার আছে? এখন আবার চলে যান অফিসে। দরকার নেই রাগ দেখানোর, দরকার নেই রাগ সয্য করার। আমার রাগ সয্য করার ঠ্যাকা পড়েনি আপনার। আমার ভাগের সময়টাও কাজকে দিয়ে দিন। এইখানেও থাকার দরকার নেই, কাজের অসুবিধা হচ্ছে আপনার। ব্যাগ পত্র গুছাতে সময় লাগবে না। সকালেই চলে যাবো সমস্যা নেই।”

তৃধার কথা শুনে নুসাইব স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কি বলবে বুঝতে পারছে না। অভিযোগের ঢালি সাজিয়ে তীব্র অভিমান নিয়ে বসে আছে মেয়েটা। কি করে ভাঙ্গাবে এই অভিমান? নুসাইব জানে এই অভিমানী অভিমান করার যথেষ্ট কারণ আছে। তৃধা তার দায়িত্বের সাথে সময় সবটাই তাকে দিয়েছে, কিন্তু সে নিজেই তো তৃধাকে সময় দিতে পারছে না। বিয়ের পর একটা মেয়ে প্রথম বাবার বাড়িতে বেড়াতে এসেছে। সেখানে তাকে একা রেখে তার বর কাজে চলে যাচ্ছে। একটা ঘন্টা সময় তাকে দিচ্ছে না। তৃধার অভিমান করাটা নিতান্তই স্বাভাবিক ব্যাপার।
তৃধার দুচোখ ভিজে উঠছে বার বার। সে চোখ মুছে দ্রুত বারান্দায় চলে গেলো। ভীষণ কান্না পাচ্ছে তার।
নুসাইব অপরাধ বোধ নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ। এর মধ্যে তৃধার কান্নার শব্দ ভেসে আসতেই উদ্বিগ্ন হলে ছুটে গেল বারান্দায়। দুহাতে মুখ ঢেকে কাঁদছে তৃধা। কান্নার কারনে পুরো শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে । সেই কান্নার আওয়াজে নুসাইব বুকটা বারবার কেঁপে উঠছে। কিছু একটা নেই নেই মনে হচ্ছে। পূর্ন একটা বুক ভীষণ রিক্ত শূন্য মনে হচ্ছে। নুসাইব অপেক্ষা করলো না। রিক্ত শূন্য বুক পূর্ণ করতে দুহাতে জড়িয়ে ধরলো কান্নারত একান্ত ব্যক্তিগত রমনীকে। কান্নার বেগ বাড়লো বই কমলো না। তৃধা দুহাতে নুসাইবের টিশার্ট খামচে ধরে শব্দ করে কাঁদতে লাগলো।
নুসাইব তৃধার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,,” সরি সরি আর হবে না। সত্যি সরি আর কখনো এমন হবে না।প্লিজ তৃধা কেঁদো না।”

কে শোনে কার কথা। যার উপর অভিমান করে আছে তার বুকে মাথা রেখে কেঁদে কেটে একাকার এই অভিমানী। লম্বা সময় পর থামলো তৃধা। হাতে ঘড়ি নেই বলে নুসাইব সময়ের হিসেব করতে পারলো না। তবে অনুমান করে বলতে পারে এক ঘন্টা যাবত কেউ একজন কেঁদে কেঁদে তার টিশার্ট ভিজিয়ে ফেলেছে। নুসাইব আলতো হাতে মাথায় হাত বুলিয়ে বার কয়েক চুমু আটলো। তৃধা থেকে থেকে হেঁচকি দিয়ে কেঁপে উঠছে। এই হেঁচকি ওঠা নিরবতা ভেঙ্গে নুসাইব নিবিড়ভাবে জড়ালো বধুয়াকে। তৃধাও চুপচাপ নুসাইবের পিঠ জড়িয়ে।

নিরবতা ভেঙ্গে নুসাইব বলে উঠলো,,”তুমি যে আমায় ভালোবাসো সেটা তুমি জানো? জানো না হয়তো, জানলেও বলবে না মনে হয়। অবশ্য ভালোবাসি বলাটা প্রয়োজন নয় তৃধা। তুমি আমায় ভালোবাসো সত্য। নিরবে নিভৃতে ভালোবাসো। তোমার অপেক্ষা বলে ভালোবাসো, তোমার অশ্রুসিক্ত চোখ বলে ভালোবাসো, তোমার অভিমানে আবৃত মুখশ্রী বলে ভালোবাসো, আমার অপেক্ষায় তোমার কপালে পড়া ওই চিন্তার ভাঁজ বলে তুমি আমায় ভালোবাসো, তিক্ত প্রশ্ন এড়িয়ে যখন কোমল চোখে আমায় দেখো তখন বুঝতে পারি ভালোবাসো,পরিচিত মুখ গুলো এড়িয়ে চঞ্চল চোখ জোড়া যখন আমাকে খুঁজো তখন আমি বুঝতে পারি তুমি আমায় ভালোবাসো। ভালোবাসো তৃধা তুমি আমায় ভালবাসো। তোমার অপরিমাপযোগ্য ভালোবাসা বলে তুমি আমায় ভালোবাসো। সত্যি ভালোবাসো।

নুসাইবের কথায় মুখ তুলে চাইলো তৃধা। নুসাইব মৃদু হেসে কপালে কপাল ঠেকালো। তৃধা চোখ বুজে নিলো তখন। মৌনতা ভেঙে কাঁপা গলায় সুধালো,,” তবুও ভালোবাসি বলা চাই?”

নুসাইব ঠোঁট জোড়া প্রশস্ত করে হাসলো। ব্যাক্তিগত রমনীর দুচোখের পাতায় অধর ছুঁইয়ে আদুরে গলায় বলল,,” উঁহু! প্রয়োজন নেই,আমি বুঝে নিবো। তোমার চোখ পড়ে নিবো। যখন বয়স বাড়বে, গায়ের চামড়া কুঁচকে যাবে, চোখে দৃষ্টি শক্তি কমে যাবে তখন বলবে। এখন প্রয়োজন নেই।”

তৃধা চোখ বুজে মুচকি হাসলো। অতঃপর নুসাইবের চোখে চোখ রেখে বলল,,” ভালোবাসি নুসাইব, পরিমাপ করা গেলে হয়তো আমার ভালোবাসা আপনার ভালোবাসার আগে ফিকে পড়বে, তবুও ভালোবাসি নুসাইব।”

নুসাইব শব্দহীন তাকিয়ে আছে তৃধার দিকে।তার চোখ জোড়ায় বিস্ময় দেখে তৃধা চোখে হাসলো। বধুয়ার সেই হাসি নুসাইবের কাছে মোহনীয় ঠেকলো ভীষণ। ভালোবাসায় আবৃত এই মৌহনীয় রমনীকে তার খুব প্রয়োজন। নুসাইবের চোখে চোখ রাখা দায়। তৃধা আলগোছে মুখ লুকালো তার বুকে। দুজনের অনূভুতিরা রঙিন প্রজাপতি আজ।
তারা ভরা আকাশ, ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক তার সাথে অন্ধকার কাটিয়ে উঠার ব্যর্থ চেষ্টায় মেঘের আড়ালে থাকা একফালি চাঁদ। এই অদ্ভুত সুন্দর নিঝুম রাতে নীরব শহরের কেউ গভীর তন্দ্রায়, তো কেউ অপেক্ষা, কেউবা ভালোবাসায়, কেউ আবার নীলছে বেদনায়।

চলবে

(ভুল গুলো সংশোধন করে দিবেন। রেসপন্স নেই কেন!)