আমি আছি পর্ব-৫৫

0
895

উপন্যাসের নাম::#আমি_আছি
লেখনিতে:#সাদিয়া_আফরোজ
পর্ব: ৫৫ পর্ব
,
,
বাংলা ক্যালেন্ডার মতে আজ আষাঢ় মাসের প্রথম দিন, প্রথম ভোর হলেও ঋতু বর্ষা যেন ক্রোশ ক্রোশ দূরে। ভোরের শুভ্রতা আজ ভাটা পড়লো নুসাইবের চোখে। পলক ঝাপটাতেই ভালোবাসা ময় সুন্দরতম রজনী পার করে ভোর হলেও চোখ জোড়ায় ঘুম লেগে আছে খুব। সেই ঘুম জড়ানো চোখ জোড়ায় পানির ছিটা পড়তেই কপাল কুঁচকে নিলো। কুঁচকে রাখা কপাল সিথিল করে তাকালো সামনে। তৃধা ভেজা চুল শুকাতে ব্যস্ত । শাড়ির আঁচল সামলে চুল মুছতে হিমশিম খাচ্ছে প্রায়। নতুন শাড়িতে তৃধাকে সদ্য বিবাহিত নতুন বউ লাগছে নুসাইবের কাছে। ভেজা চুলে এই রমনীর অগোছালো শাড়ির আঁচল তাকে ঢেকে রাখতে ব্যর্থ। মুচকি হেসে গভীর চোখে তাকালো নুসাইব। তার সেই দৃষ্টি তৃধাকে লজ্জায় ফেলার জন্য যথেষ্ট। এই স্নিগ্ধ রমনীর স্নিগ্ধাতার আবেশে জড়িয়ে পড়লো সে। আজকে ভোরের স্নিগ্ধতা দেখা হলোনা তার। সত্যি আজ ভোরের শুভ্রতা ভাটা পড়লো নুসাইবের চোখে।
*
*
অফিস মুখো হলো না নুসাইব। তিহান বিচক্ষণতার সাথে নুসাইবের চেহারার আদলে তাকিয়ে বলল,,”কাম কাজ নেই আজ? যাচ্ছিস না অফিসে?”

নুসাইব মুচকি হেসে বলল,,” বউয়ের বড় ভাই তাই কিছু বলছি না। বিয়ে কর এরপর বুঝবি কেন যাচ্ছি না। অবশ্য তোর তো বছরের তিনশত দিনই ঝগড়ায় যাবে, তোকে কি বলবো। শোন, বউ রাগলে চাকরিও ছাড়তে হয়। আমিতো শুধু অফিস মিস দিচ্ছি।”

,,”এইজন্যই বিয়ে করতে চাচ্ছি না। এতো ঝামেলা কে সয্য করবে?”

,,” ঝামেলা জানিস যখন প্রেম করেছিলি কেন?”

,,” সেটা পুরোনো কথা। বাদ দে।”

,,”দিলাম বাদ। এইবার মন মস্তিষ্ক স্থির করে নিন ভাই সাহেব। বিকেলে পাত্রী দেখা অভিযান আছে।”

,,”বিকেলে মানে? শুনলাম কাল যাবে। তাহলে আজ আবার কোথায়?”

,,” আমার শ্বাশুড়ি তার ছেলেকে এই ব্যাপারে রত্তিভর বিশ্বাস করে না। এই জন্য কালকের প্রোগ্রাম আজকে সেট করেছে। তা ফেশিয়াল টেশিয়াল কিছু করবি? মেকআপ টেকাপ? করলে এক্ষুনি বল। আমার আবার সময় নেই, এখন বউ আছে তার জন্য সময় বরাদ্দ করা। ”

তিহান দাঁতে দাঁত চেপে নুসাইবের দিকে তাকালো। নুসাইব থোড়াইনা পাত্তা দেয় সেই তাকানো। চরম ভাবে উপেক্ষা করে কিচেনের দিকে উঁকি ঝুঁকি দিতে লাগল। বউটার দেখা যদি একটাবার মেলে। সকাল থেকে চোখে হারাচ্ছে খুব। শত দেখাও যেন কম পড়ছে আজ।
*
*
সমুদ্র নবনীকে নিয়ে ফাইনালি রাজশাহী শিফ্ট করবে। শেফালী বেগম খানিকটা নারাজ। যদিও তিনি চান নবনী তার ছেলের সাথে থাকুক কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি যাচ্ছে ব্যাপারটায় তিনি খুব মন খারাপ করে আছেন। নবনীকে নিয়ে সময় কাটানো হয়নি তার, নিজেদের মধ্যে সুন্দর একটা সম্পর্ক এখনো সেই ভাবে গড়ে ওঠেনি। তিনি চাইছেন নবনী আরো কিছুটা দিন থেকে তারপর যাক। সমুদ্র মায়ের মন খারাপ দেখে খানিকটা হেসে বলল,,” ছেলের জন্য মন খারাপ হচ্ছে না? ছেলের জন্য নারাজ হচ্ছো না। সব দেখছি ছেলের বউয়ের জন্য। কি ব্যাপার?”

কিবরিয়া সাহেব নবনীকে পাশে বসিয়ে টুকিটাকি বিষয় নিয়ে গল্প করছেন। মাঝে মাঝে স্ত্রী পুত্রের অভিমান অভিযোগটাও দেখছেন।

শেফালী বেগম গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলে উঠলো,,”তোকে দেখতে দেখতে বোর হয়ে গেছি। একটা মেয়ে সখ ছিল। এখন পূরণ হয়েছে দেখে তোকে পাত্তা দিচ্ছি কম।
কিবরিয়া সাহেব আর নবনী মিটমিট করে হাসছে। সমুদ্র মুচকি হেসে বললো,, “পর করে দিচ্ছ মা?”

শেফালী বেগম আলতো হাসলেন। ছেলে তার বড্ড বেশি আদরের। সব মমতা এই ছেলেটাতেই লুটানো। আদর স্নেহ দিয়ে লালিত এই কলিজার টুকরোটা।পর করে দেওয়ার প্রশ্নই আসে না।
সমুদ্র মুচকি হেসে মায়ের সমীপে বসে জড়িয়ে ধরলো মাকে। তার এই হাঁসি শত না বলা কথা বলছে। মুচকি হেসে মায়ের কপালে চুমু আটলো। শেফালী বেগম ছেলেকে জড়িয়ে ধরতেই সমুদ্র বলে উঠলো,,” নবনী এইখানে একমাস থাকবে মা। বাসাটা সম্পূর্ণ গুছানো ছাড়া ওকে নেওয়া যাবে না। যে চঞ্চল কি করতে কি করে ফেলে সেটার ঠিক নেই।”
শেফালী বেগম হাসলেন। ছেলের পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,,”সত্যি?”

,,”সত্যি কিনা সেটা তোমার বৌমাকে জিজ্ঞেস করো। আমি আসার পর থেকেই বলছে এখন কিছুতেই যাবে না। আরো কিছুদিন থাকবে। তোমাদের দুইজনের কথা ফেলার মত? দুজনই একটাইপের। আর আমি রাতেই বের হবো। সকালে ক্লাস আছে।”

,,” এতো তাড়া কিসের? কালকেই তো এসেছিস আবার রাতে বের হয়ে যাবি?”

,,” মা আমি পড়ি না ,পড়াই। তোমার বউমার মত আমি মিস দিতে পারবো না। যেতেই হবে। ”

কিবরিয়া সাহেব বললেন,,” তা কখন বের হবি? গাড়ি নিয়ে যাবি?”

,,” ভাবছি গাড়ি নিবো না।”

শেফালী বেগম দুজনকে থামিয়ে বললো,,” অবশ্যই গাড়ি নিবে। তুমি ড্রাইভারকে কল দাও। আমার ছেলেটা এতো দূর যাবে, সকালে আবার ক্লাসও করাবে। না না প্রচুর পরিশ্রম। তুমি ড্রাইভারকে এক্ষুনি কল দাও।”

স্ত্রীর কথার অমত করলো না। সাথে সাথে ড্রাইভারকে কল দিয়ে জানিয়ে দিলেন।
নবনী মুখ কথা নেই সে নিরবে দেখছে সবটা। কখনো ভাবেইনি এমন একটা সুন্দর পরিবারের সদস্য হবে যেখানে সবাই তাকে ভালোবাসবে কিংবা আগলে রাখবে।
*
*
রিমি উদাস হয়ে জানালার গ্ৰীল ধরে বসে আছে। যাকে মনে পড়ছে ক্ষনে ক্ষনে তার খোঁজ নেওয়া কিংবা তার সাথে দু’দন্ড কথা বলার সুযোগ নেই। প্রিয় মানুষটা বিরক্ত হবে,তার পড়ালেখায় সমস্যা হবে ভেবেই তার সাথে যোগাযোগের সব পথ বন্ধ করে দিয়েছে। মানুষটা তাকে ভালোবাসে এইতো অনেক। এর চেয়ে তার থেকে আর বেশি কিছু চাওয়ার নেই। রিমি ক্যালেন্ডারের পাতায় দাগ কাটলো। তিন বছর হতে এখনো অনেক দেরি। লাল কালির দাগ এগোচ্ছে না। এগোবে কি করে ? সেকেন্ড গুলো মিনিটের মত মনে হচ্ছে আর মিনিট গুলো ঘন্টার মত। দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে ডায়রি নিয়ে বসলো। আলতো হাতে ছোট করে লিখলো,,” আপনার ব্যস্ততম সময়ে একটু বিরক্তির কারণ হলে খুব বেশি কি ক্ষতি হবে?”

অন্যদিকে তমাল বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজে বসে আছে। কেউ দেখে বুঝবেই না এই ছেলের প্রেমের আজ পঞ্চম দিন চলছে। তমাল পড়া শেষ করে চোখ কচলাতে কচলাতে সোজা হয়ে বসলো। ইয়াসির পড়া রেখে তমালকে দেখছে। তমাল ভ্রু জোড়া কুঁচকে বললো,, “একটু রুম থেকে বেরহ তো ,কাজ আছে।”

ইয়াসির নড়াচড়া করার পাত্র নয়। দুমিনিট পর সে এমনিতেই উঠে যেত। তমাল তাকে রুম ছেড়ে বের হওয়ার কথা বলার পর সে নড়ে চড়ে গেড়ে বসলো। দুনিয়া উল্টে যাক তাও আজ রুম ছাড়বে না। মাথা নেড়ে বললো,,” হিউজ পরিমাণ পড়া আছে। এখন রুম ছাড়া যাবে না।”

তমাল চুলে আঙ্গুল চালাতে চালাতে ভাবুক হয়ে বললো,,” ঠিক আছে তোর যাওয়ার দরকার নেই। লাষ্ট দুটো ডিজিট কি যেন ? মনে পড়েছে না,মনে হয় 58 হবে। হ্যাঁ 58 অবশ্য সেইভ করাই আছে। ওই নাম্বারে কল দিয়ে 43র কথা বলে দিবো। 58 থাকার পরেও 43-র সাথে ফুচকা ডেট ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং না?
তেল মশলা লাগিয়ে আরো কিছু এড করবো। সাথে পিডিএফ ফাইলে এসাইনমেন্টের মত করে তোদের সাতাশটা ছবির পুরো ফাইল সাবমিট করে দিবো। ভাবতে পারছিস, কি হবে? মানে কোনো অকেশন ছাড়াই আতশবাজি দেখা হয়ে যাবে। পরিবেশ বান্ধব আতশবাজি। রুম থেকে যাওয়ার দরকার নেই। এই কাজ আমি ছাদে গিয়েও করতে পারবো।তুই বরং বসে থাক।”

ইয়াসিরের কপাল বেয়ে ঘাম পড়ছে। তমালকে বিশ্বাস নেই। এই শা*লা পুরাই পাগল। বলেছে যখন করতে দেরী হবে না। তখন মরার গার্লফ্রেন্ডকে কে বুঝাবে সেটা আর কেউ নয় বরং বোন সমতুল্য একমাত্র খালার একমাত্র মেয়ে। ইয়াসির দেরি করলো না। বই পত্র গুছিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বললো,,” এতো সিরিয়াস হওয়ার কি আছে,আমি তো শুধু মজা করলাম।”

ইয়াসির বেরিয়ে যেতেই তমাল রুমের দরজা আটকে ধবধবে একটা সাদা কাগজ নিলো।সেই কাগজের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। দু আঙ্গুলে কলম ঘুরিয়ে কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করে গোটা গোটা অক্ষরে লিখলো,,”
শোনো মেয়ে,
আমি জানি অপেক্ষা বড্ড বেশি পীড়াদায়ক। কিন্তু তোমার চেয়ে এই শব্দটা আমাকে পীড়া দিচ্ছে বেশি। নব্বই দশকের প্রেমিকা বলায় তুমিযে এমন ছলনা করবে সেটা জানা ছিলো না। আমি বললেই কি সব মেনে নিতে হবে? কল নেই, মেসেজ নেই, নব্বই দশকের প্রেমিকার মত চিঠিও নেই। এই দিকে আমি পোস্ট অফিস খুঁজে চোখ মুখ অন্ধকার দেখছি। রোজ দরজা খুলে পিয়ন খুঁজছি। দু একজন পাগল বলে ক্ষেপাচ্ছে রোজ। তোমার জন্য আমার মত একজন ডাক্তার তার ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলছে। লোক মুখে পাগল ডাক শুনছে। তোমার উচিৎ জটিল ধরনের বন্দোবস্ত করে চিঠি লেখা। যে চিঠি লম্বা হবে। যেন চিঠি পড়তে পড়তে বিরক্ত হয়ে বই পত্র নিয়ে বসতে হয় এমন চিঠি। সেটা না করে তুমি ডুব দিয়ে কোথায় হারালে? প্রেমিকা হয়ে বউয়ের মত ব্যবহার করছো। দেখো এইখানে সুন্দরীদের অভাব নেই। তোমার অভাব ওদের দিয়ে পূরণ করার আগেই সুধরে যাও। পরে দেখা যাবে তুমি ফরজ হতে হতে তিনটা সুন্নাতের একটা হয়ে গেছো। আবারো বলছি সুন্দরীদের অভাব নেই।

ইতি
তমাল শেখ।

চিঠি লেখা শেষ করে বেরিয়ে পড়লো তমাল। নাহ্ মেয়েটাকে ছাড় দেয়া চলবে না। এই মেয়ে বড্ড বাড় বেড়েছে। আমার মত ডাক্তারকে পাগল বানিয়ে ছাড়ছে। চিঠির উত্তর না দিলে তো খবরই আছে।

*
সবার জীবনে পূর্ণতা আসে না। কেউ পূর্ণতা পায় কেউ আবার সারাজীবন অপূর্ণতা নিয়েই কাটায়। আবার কেউ কেউ আছে যারা পূর্ণতা পায়ে ঠেলে দিয়ে অনুশোচনা নিয়ে জীবন কাটায়। তার মধ্যে রজব একজন। সকাল হতে না হতেই সুমনা ডিভোর্স পেপার পাঠায়। সেখানে সুমনার স্বাক্ষর দেখে রজব খুব একটা অবাক হলো না। সে যেন জানতো এমনটা হওয়ার ছিল। সুমনা থেকে বিচ্ছেদ ব্যাপারটা রজবকে পীড়া দিচ্ছে না। রজবের সমস্ত কায়া জুড়ে এখনো তৃধার বিচরন। যেখানে সুমনা একটুও নেই। কাগজে স্বাক্ষর করার সময় রজব তাচ্ছিল্য করে হাসলো। কাগজ কলমের বিয়ে তাদের কাগজে কলমেই শেষ। কিন্তু তৃধার সাথে বিয়েটা কোনো কাগজ কলমের বিয়ে ছিল না। এই আধুনিক যুগে বিয়েটা খুব সাবলীল ভাবে হুজুর দিয়ে হয়েছিলো। ধর্মীয় রীতি নীতি মেনে হলেও কিছুটা কমতি তো ছিলোই। তাও সেটাই যেন বিয়ে ছিল। যেখানে মনের মিল,মায়া , ভালোবাসা সবটাই যেন পরিপূর্ণ ছিল। ভাবতেই রজবের চোখ জোড়া ভিজে উঠলো।
সাফিয়া খাতুন আড়ালে দাঁড়িয়ে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। তিনি জানেন ছেলের এই অবস্থার জন্য ছেলে নিজেই দায়ী। কিন্তু মায়ের মন বলের কথা। সন্তানের ব্যথায় ব্যথিত হওয়া স্বাভাবিক। ভেজা চোখ জোড়া মুছে আড়াল হলেন। তিনি আদৌ জানেন না এই অনুশোচনা কবে শেষ হবে। হয়তো ছেলের সম্পূর্ণ জীবন যাবে এই অনুশোচনায়।