আমি আছি পর্ব-৫৬ এবং শেষ পর্ব

0
1818

উপন্যাসের নাম::#আমি_আছি
লেখনিতে:#সাদিয়া_আফরোজ
৫৬(সমাপ্ত পর্ব)
,
,
,
,
সুখ দুঃখ মিলে ষড়ঋতু তৃতীয় পরিক্রমা অতিক্রম করলো। সুখের সময় নাকি খুব দ্রুত অতিবাহিত হয়। অথচ ঘড়ির কাঁটা কিংবা দিনপঞ্জীকার পাতা সুখ দুঃখে ভেদাভেদ করে না। তাও সুখ আর দুঃখ দুটি শব্দের সময়টা ভিন্ন ভাবেই কাটে। আসলে সময় সবার জন্য এক নিয়মেই চলে। ভিন্নতা তখন দেখা দেয় যখন মানুষের অনূভুতি প্রখর হয়। সুখের চাইতে দুঃখ মানুষকে প্রভাবিত করে বেশি। হয়তো এই কারণেই মানুষের কাছে দুঃখের সময়টা লম্বা হয়। সেই সুখ দুঃখ মিলে তিনটা বছর কম সময় নয়, এই তিন বছরে মধ্যে বদলে গেলো অনেক গুলো জীবন। যোগ হলো আরো কিছু মানুষ। যেমন তিহানের জীবনে ইশিকা ইমনিধাহ্ আর তার একবছর বয়সী ছেলে মাহিন, সমুদ্র আর নবনীর জীবনে তাদের মেয়ে নূর আর আজ তমালের জীবনে অবশেষে রিমি। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর দুজনের বিয়ে। রিমি বউ সেজে স্টেজে বসে আছে তার ঠিক পাশেই তমাল। তমাল বারবার রিমির দিকে তাকাচ্ছে। তমালের কারণে রিমিকে লজ্জায় পড়তে হচ্ছে ভীষণ। তমাল কপাল কুঁচকে রিমির কাছ ঘেঁষে বসে বলল,,” খোদার কসম, রিমান যদি না বলতো তুমি রিমি তাহলে এতক্ষনে গাড়ি ঘুরিয়ে সোজা তোমাদের বাড়ি চলে যেতাম।”

অবাক চিত্তে তাকালো রিমি। আশপাশে নজর বুলিয়ে কন্ঠ খাদে নামিয়ে বললো,,” রিমান বলল মানে? আপনার চোখ নেই?”

,,” চোখ সবারই আছে শুধু তুমিই ভেশ বদলে এসেছো। চেনা যাচ্ছে বলো? জীবনে শাড়িতে দেখেছি তোমায়? সব থেকে বড় কথা মেকাপ। মেকাপের জন্যই চেনা যাচ্ছে না। বিশ্বাস কর, হলে এসে স্টেজে তোমাকে বসা দেখেই কলিজা মুচড়ে উঠেছিলো। আমিতো ভেবেই নিয়েছি বউ ভেগে গেছে এই জন্য আরেকজনকে বউ সাজিয়ে বসিয়ে রেখেছে। তোমার এই মেকাপের কারণে একজন ডাক্তার মরে যাওয়ার জোগাড়। খবরদার আর কখনো মেকআপ করবে না। তোমাকে আমার এমনিতেই বেশি পছন্দ। মেকাপের কারনে মায়া মায়া চেহারাটাই দেখা যাচ্ছে না।”

তমালের কথায় রিমি আলতো হাসলো। যদিও এখন তার রেগে আগুন হওয়ার কথা ছিলো। রিমি রাগেনি বরং তমালের কথায় তার মনটা আরো এক ধাপ ভালো হয়ে গেছে। তিন বছরে তমালকে যতটুকু দেখেছে এতে রিমি একটা বিষয় খুব পরিষ্কার জানে তমাল ছলনা করে না। তার দ্বারা ছলনা হয়না। সে মিথ্যা আশ্বাস দিতে পারে না। যা সত্যি তাই বলে দিবে। এইবার হোক সেটা তিক্ত। রিমি মাথা নিচু করে বললো,,”ঠিক আছে, আর কখনো সাজবো না।”

,,” সাজবে না মানে? অবশ্যই সাজবে। তবে সেটা অল্প। যেমন ধর কাজল , লিপস্টিক এরপর জুয়েলারি পরবে। তুমি অবশ্যই সাজবে। আমি পুরুষ মানুষ আমারও তো ইচ্ছে করে বউটাকে সাজগোজে দেখতে।”

রিমি মুচকি হেসে বলল,,”ঠিক আছে,ঠিক আছে এইবার চুপ করুন সবাই দেখছে।”

নবনী তমালের দিকে তাকিয়ে মুখ বেঁকিয়ে সমুদ্রকে উদ্দেশ্য করে খোঁচা মেরে বললো,,” আমার ভাইকে দেখো, এতো মানুষের মধ্যেও বউয়ের সাথে ঠিকই ফিসফিস করছে। আর তুমি? এইজন্যই লোকে বলে আর যাই পাপ করো কিন্তু কখনো মাস্টার মশাই বিয়ে করার মত পাপ করবে না। আমার পাগল ভাইটা পর্যন্ত বউ পাগল। আর তুমি?”

সমুদ্র তার মেয়ে নূরের গালে স্নেহের পরশ বুলিয়ে মুচকি হেসে বলল,,” তুমিকি চাও আমি এখন তোমার কানে কানে কথা বলি? শোনো, আমিও আমার বউকে কম ভালোবাসি না। শুধু বউয়ের চোখে পড়েনা, মনে হয় আমি সুন্দর নই এই জন্য।”

নবনী চোখ রাঙিয়ে বললো,,” খবরদার আমার শ্যামসুন্দর মানুষটাকে নিয়ে যা তা বলবেন না।সে আমার চোখে সবচেয়ে সুন্দরতম পুরুষ । তাকে কতটা ভালোবাসায় মুড়িয়ে রেখেছি সেটা আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না বুঝলেন? অবশ্য বুঝবেন কি করে , আপনি দার্শনিকদের চুলোচুলি নিয়ে পড়ে থাকা মাস্টার মশাই আপনার মাথায় প্রেম ভালোবাসা ঢুকবে না।”
নবনীর কথায় সুমদ্র মুচকি হাসলো । অতঃপর নবনীর আঙ্গুলে আঙ্গুল গলিয়ে হাতের বাঁধন শক্ত করে ফিসফিসিয়ে বললো,,” ভালোবাসি মিসেস,একটু বেশিই ভালোবাসি।”

উত্তরে মৌন রইলো নবনী। চকচক করা চোখ জোড়ায় সামনে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। এইখানেই তার সুখ। মানুষটা চাপা স্বভাবেরর হলেও তার ভালোবাসায় কমতি নেই।

অন্যদিকে তিহান তার ছেলের পিছু পিছু হাঁটছে। মাহিনের বয়স একবছর হলেও সে বেশ শক্ত পোক্ত বাচ্চা। এক বছর বয়সে তার হাঁটার গতি আর দৌড়ের সাথে পেরে ওঠা দায়। মাহিন হাঁটতে হাঁটতে তার মায়ের শাড়ির আঁচল টেনে ধরলো। ফুচকা স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে ফুচকা খাচ্ছে ইশিকা। হঠাৎ আঁচলে টান পড়ায় খেই হারালো । উঁচু জুতো পরায় বেসামাল হয়ে পড়ে যেতে নিলে তিহান দৌড়ে এসে শক্ত হাতে ধরলো তাকে। ইশিকা বুকে হাত দিয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে নিতে বলল,,” আজ মান ইজ্জত সব গেছিলো।”

তিহান ইশিকাকে দাড় করিয়ে মাহিনের মুখের দিকে তাকিয়ে আদুরে গলায় বলল,,” বাবা, তুমি বেশি দুষ্টুমি করছো। আর একটু হলে তোমার মা ব্যাথা পেতো। আর এমন করবে না ওকে? এমন করলে বাবা অনেক গুলো বকা দিবো।”

আদুরে গলায় শাসনটা যেন মাহিন ধরতে পারলো। মুখ ফুলিয়ে শব্দ করে কেঁদে উঠতেই মাহাবুব ইসলাম এক প্রকার দৌড়ে এসে নাতিকে কোলে তুলে নিলেন। তিহান ছেলের দিকে তাকিয়ে হতাশার নিঃশ্বাস ফেললো। মাহাবুব ইসলাম নিজের ছেলের দিকে তাকিয়ে চোখ রাঙিয়ে বললো,,” তোর তো সাহস কম নয়? তুই আমার নাতিকে ধমকাচ্ছিস? এই তোকে আমি এই ভাবে বড় করেছি? খবরদার আমার নাতিকে আর ধমকাবি তো।”
ইশিকা ফুচকা মুখে হেসে কুটি কুটি। যদিও তিহান হা করে তাকিয়ে আছে। মাহাবুব ইসলাম যাওয়ার আগে শক্ত গলায় বার কয়েক বেয়াদব বলে তবেই গেলেন। তিহান ইশিকার দিকে তাকিয়ে বলল,,” বাবা এইসব আমাকে বলেছে! শুনলে তুমি? কতগুলো কথা শোনালো।”

ইশিকা মুচকি হেসে বলল,,” আপনাকেই বলেছে মেজর সাহেব। আপনি ওনার নাতিকে বকেছেন। তারজন্য এই তিরস্কার আপনার প্রাপ্য। তিহান শব্দ করে নিঃশ্বাস ফেলে ফুচকা স্টলের দিকে তাকিয়ে বলল,,” হলুদ অনুষ্ঠান ঠিক আছে কিন্তু এই ফুচকা স্টল বিয়েতে কি করছে?”

ইশিকা ফুচকার প্লেটটা রেখে তিহানে কোটের কোনা ধরে টেনে বললো,,” মনে আছে সমুদ্র ভাইয়ার বিয়ের সময়কার কথা? এমন ফুচকা স্টলের সামনেই আমাদের প্রথম দেখা।”

তিহান ইশিকার হাত ধরে বললো,,” জি আমার স্পষ্ট মনে আছে। ঝাল ঝাল ফুচকা আর এই সুন্দরী শাড়ি পরিহিতা রমনী ইশিকা ইমনিধাহ্।”
তিহানের চেহারার আদলে তাকিয়ে মুচকি হাসলো ইশিকা। তিহান ডান ব্রু উঁচিয়ে সুধোয় ,,”কি?”

ইশিকা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বললো,,” ভাগ্যিস দেখা হয়েছিলো।”

শেখ পরিবারের মধ্যে শেষ বিয়ে। তাই নাবীব শেখ দাওয়াত দেওয়াতে কোনো কমতি রাখেননি। গ্ৰাম থেকে শুরু করে শহরের আত্মীয় স্বজন আর পাড়া প্রতিবেশী তো আছেই। এর মধ্যে আছে তার ছেলে মেয়েদের শ্বশুর বাড়ির লোকজন।
নাবীব শেখ ডাক্তার জাকের সহ বেয়াইদের নিয়ে খেতে বসেছেন। ফরিদা হক তার শ্বাশুড়ি আর জা-দের খাবার টেবিলে বসিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। এই নিয়ে তিনবার সেতারা বেগম তৃধাকে নিয়ে কথা তুলেছেন। যদিও তিন বারই ফরিদা হকের কাছে ধরা খেয়েছে। এই মুহূর্তে ফরিদা হক কোনো প্রকার রিস্ক নিতে চাইছেন না। তাই শ্বাশুড়ি ভক্ত বউমার মত শ্বাশুড়ির সাথে সাথে থাকছেন। এমনিতেই চার জন চার কথা বলছে এর ভেতর সেতারা বেগম যদি কোনো কথা বলে তাহলে অন্যরা পেয়ে বসবে। তিন্নি ঘুরে ঘুরে চারপাশ দেখছে।অনেক্ষণ খোঁজার পরেও ভাইকে পাওয়া গেলো না। তিন্নি খেয়াল করে দেখলো ভাই নেই ভাইয়ের সাথে তার বউ আর বাচ্চাটাও নেই।

তিন্নিকে চিন্তিত দেখে চিন্ময় জিজ্ঞেস করল,,” কি সমস্যা কপাল কুঁচকে রেখেছো কেন?”

,,”আরে কোথাও ভাইয়াকে দেখছি না। এইজন্য চিন্তা হচ্ছে। এখন আবার তৃধা আর বাবুটাও নেই। তুমি একবার বাবার কাছে গিয়ে দেখোতো নুসাইবা ওইখানে আছে নাকি ওর মা-বাবার সাথে গায়েব হয়ে গেছে।”

চিন্ময় মুচকি হেসে বলল,,” এতো চিন্তা করার কিছু নেই। ভাইয়া আর ভাবী নুসাইবাকে নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে গেছে। মনে হয় নুসাইবা ওর ড্রেসে ময়লা লাগিয়ে ফেলেছে। ”

তিন্নি গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বললো,, মেয়েটা মা বাপ দুটোকে শিক্ষা দিয়ে ছাড়ছে। দুই শান্ত মা বাপের ঘর থেকে একটা অশান্ত ছোট পুতুল হয়েছে। তা তোমার ছেলে কই?”

,,” সে তার নানার সাথে খেতে বসেছে। তুমি বরং কে কে খাওয়ার বাকি আছে খুঁজে নি আসো। আমি এই দিকটা দেখছি।”
চিম্ময়ের কথা মত তিন্নি বাকি মেহমানদের খাওয়া দাওয়ার খোঁজ নিতে গেছে।

ওয়াশ রুমে দাড়িয়ে আছে তৃধা নুসাইব। তৃধার শাড়ির পিন খুলে গেছে। ব্যাপারটা নুসাইব খেয়াল করতেই তৃধাকে ওয়াশ রুমের দিকে ডেকে আনলো। তৃধা শাড়ির অবস্থা দেখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে চোখ রাঙ্গানি দিয়ে বললো,,” কতবার বলেছি দুষ্টুমি করবে না। তাও তুমি দুষ্টু করো। তুমি ভীষণ পঁচা হয়ে গেছো নুসাইবা!”

দুই বছর বয়সী নুসাইবা তার বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,,” বাবা মা বকা দেয়।”

নুসাইব রেগে যাওয়ার ভান করে বললো,,” তৃধা তুমি বড্ড পঁচা হয়ে গেছো। শুধু শুধু আমার মেয়েটাকে বকছো।”

বাবার কথায় নুসাইবা খিল খিল করে হেসে উঠলো। তৃধা হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বললো,,” বাপ বেটি দুটাই এক দলে।”

নুসাইব মেয়ের চুল ঠিক করতে করতে তৃধাকে দেখছে। আজ নীল রঙের কাতান শাড়ি পরেছে তৃধা। সাজসজ্জা বলতে খোঁপায় ফুল,ঠোঁটে লিপস্টিক আর শাড়ির সাথে ম্যাচিং করা চুড়ি আর ঝুমকো।বিয়ের তিনটা বছরেও নুসাইবের মুগ্ধতা কাটলো না। এখনো এই রমনীকে দেখে নুসাইব মুগ্ধ হয়, নতুন করে প্রেমে পড়ে। লোকে বলে বিয়ের পর নারীর ভালোবাসা বাড়লেও পুরুষের ভালোবাসা কমে। নুসাইবের মতে কথাটা পুরোপুরি সত্য নয়। অন্তত সে নিজেই তার উদাহরণ। বিয়ের পর তার ভালোবাসা এক বিন্দুও কমেনি বরং বেড়েই চলছে। রোজ রোজ কাউকে দেখে মুগ্ধ হওয়া কিংবা বিমোহিত হওয়া চারটে খানে কথা নয়। তাও নুসাইব মুগ্ধ হয়। প্রতি সকালে নতুন একটা তৃধাকে আবিষ্কার করে মুগ্ধ হয়। নুসাইব চায় এই মুগ্ধতা যেন বাকি জীবনও না কাটুক। এমন মায়া মুগ্ধতায় বাঁধা পড়ুক তারা।
তৃধা শাড়ির আঁচলে সেফটি পিন লাগানোর চেষ্টা করছে । নুসাইব তা দেখে মুচকি হেসে মেয়েকে রেখে তৃধার পেছনে দাঁড়িয়ে শাড়ির আঁচলে সেফটি পিন লাগিয়ে দিতে দিতে বলল,,” মাশাআল্লাহ খুব সুন্দর লাগছে তোমাকে।”

পেছন থেকে নুসাইবা ডাগর চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,, মা সুন্দর ।”

তৃধা মুচকি হেসে বলল,,” সাড়ে তিন বছর পেরুলো এখনো সুন্দর?”

নুসাইব ভাবুক হয়ে বললো,, শুধু তিন হবে ,সাড়ে টাড়ে ওইসব বাদ ওইগুলো কাউন্ট হবে না। ওই সাড়ে বলা সময়টা তোমাকে বাগে আনতে আনতে গেছে।”
তৃধা হেসে বলল,,” ঠিক আছে। এইবার দেখুন হয়েছে কিনা। কোথাও আর পিন লাগবে? ”
নুসাইব চারপাশে খুতিয়ে দেখতে দেখতে বললো,,” এতো গুলো পিন লাগালাম তাও খুলে যায় কিভাবে?”
,,”আপনার মেয়েকে কোলে নিলেই এই অবস্থা হয়।”

,,” তুমি আবার নিতে গেলে কেন? আমাকে ডাকতে?”

,,”আপনি মেহমান সামলাবেন নাকি মেয়েকে? এতো ঝামেলার দরকার নেই চলুন।”

তৃধা মেয়েকে নিয়ে বের হতে গেলে নুসাইব মেয়েকে কোলে নিয়ে বললো,,” তুমি যাও আমি ওকে রাখবো। শাড়ি উঁচু জুতো এইসব পরে বাচ্চা সামলানো যায় না।”

,,” তা উঁচু জুতো কিনতে বলছে কে!”

,,” আমার বউ আমি কিনে দিয়েছি। শাড়ির সাথে উঁচু জুতো না হলে সুন্দর কম লাগে।”
তৃধা জানে এই লোকের সাথে কথা বলে পারা যাবে না। তাই আর কথা বাড়ালো না। নুসাইব তৃধার হাত ধরে স্টেজের দিকে নিয়ে যেতে যেতে বললো,, নবনীর কাছে যাও। এইদিকটায় দাদি আছে।”

,,”তৃধা মুচকি হেসে বলল সমস্যা নেই। আপনি আছেন আমার ভয় নেই।”

নুসাইব হাতের পাকড়াও শক্ত করে বললো,,” তুমি আমার উপর এতোটা নির্ভরশীল হয়ে থাকো বলেই এতো ভালোবাসা লুটাই। তবুও নিজেও কিছু বলো কখনো। দাদিকে জবাব দাও।দেখবে সে তোমাকে আর খুঁচিয়ে কথা বলার সাহস পাবে না ‌”

তৃধা সেতারা বেগমের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,,” মোটেও না। তাহলে ভালোবাসা কমে যাবে। এতো বড় রিস্ক আমি নিতে পারবো না।”

নুসাইব ঠোঁট টিপে হেসে বলল,,”বোকা মেয়ে , তোমার প্রতি আমার মায়া ভালোবাসা কখনোই কমবে না। খুব বেশি নির্ভরশীল হলেও না আবার সম্পূর্ন আত্মনির্ভরশীল হলেও না। তুমি যেই দিকেই যাওনা কেন পেছনে ফিরলে দেখবে আমি আছি।”
*
*
*
সময়ের সাথে সবার জীবন বদলালেও বদলায়নি রজবের জীবন। সে ভীষণ ছন্নছাড়া হয়ে ঘুরে বেড়ায়। না মৌহ, না মায়া কারো প্রতি কোনোটাই কাজ করে না এখন। উদ্দেশ্যহীন হয়ে ঘুরে বেড়ানো ছাড়া এখন আর তার কোনো কাজ নেই। আসলে এই উদ্দেশ্যহীন হয়ে থাকাটাই তার বড় কাজ এইটা সে ছাড়া কেউ বুঝে না। বছর খানেক আগে এমনই উদ্দেশ্যহীন হয়ে শহরতলীতে ঘুরে বেড়াচ্ছিল সে। তারিখ মনে না থাকলেও তার স্পষ্ট মনে আছে ওই সময়টা বসন্তকালের। আকাশি রঙের শাড়ি পরিহিতা তৃধার হাত ধরে বাচ্চা কোলে নিয়ে নুসাইব দাঁড়িয়ে। তৃধার নুসাইব দুজনই নিজেদের মধ্যে কথা বলে হাসাহাসি করছে। পৃথিবীতে খুব কম সংখ্যক মানুষ আছে যারা অন্যকে সুখী দেখে খুশি হয়। রজব চেয়েছিলো সেই কম সংখ্যক মানুষে মধ্যে থাকতে। যদিও সে ব্যর্থ। তৃধার পাশে দাঁড়ানো পুরুষের জায়গায় কয়েক সেকেন্ডের জন্য নিজেকে কল্পনা করতেই কেঁপে উঠলো। তার আর তৃধার কম সংখ্যক মানুষের কাতারে থাকা হলো না।
,
এখন প্রায় মধ্যরাত। জমজমাট বাড়িটা ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে এসেছে। তৃধা মেহমানদের খাবার খাইয়ে সবার ঘুমানোর ব্যবস্থা করে সবে রুমে ঢুকলো। নুসাইব মেয়েকে ঘুম পাড়াতে ব্যস্ত। তৃধা বাপ বেটিকে দেখে মুচকি হেসে নুসাইবকে ইশারায় জিজ্ঞেস করলো ঘুমিয়েছে কিনা। এতে নুসাইব মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বলতেই তৃধা প্রশান্তির নিঃশ্বাস ফেলে বিছানার উপর উঠে বসলো। পুরো দিনে এতোটা খারাপ লাগেনি এখন যতটা লাগছে। মনে হচ্ছে বালিশে মাথা রাখলেই ঘুম আসবে। নুসাইব মেয়েকে শুইয়ে তৃধার দিকে তাকায়। তৃধা কপাল কুঁচকে পা দেখছে। নুসাইব মাথা কাত করে পায়ের দিকে তাকালো। নতুন জুতোয় পা কাটা মেয়েদের জন্য স্বাভাবিক ব্যাপার হলেও তৃধার পা দেখে নুসাইব চমকে উঠলো। পায়ের পেছন দিকে অনেকটাই কেটে গেছে। নুসাইব হড়বড়িয়ে উঠে তৃধার পা জোড়া দেখতে লাগলো। ভীষণ ব্যতিব্যস্ত হয়ে দেখছে।

কপালে চিন্তার ভাঁজ তার সাথে ঠোঁট জোড়া ঈষৎ ফাঁক করা। তৃধা জানে নুসাইব তার পায়ের অবস্থা দেখে চিন্তিত। তৃধা চুপচাপ দেখছে নুসাইবকে। তিনটা বছরে সব বদলালেও নুসাইব বদলেনি। ভালোবাসা কিংবা মায়া বেড়ে যাওয়াকে যদি বদলানো বলে তবে হ্যাঁ নুসাইব বদলেছে। তার সেই বদল ভারী সুন্দর। তৃধা জানে না বাকি জীবন মানুষটা কেমন থাকবে। তবে যেমনই থাকুক এতো টুকু বিশ্বাস আছে এই মানুষটা তাকে কখনো ছেড়ে যাবে না। এই মানুষটার কাছে তার প্রয়োজন ফুরাবে না। এই মানষটা ভালো না লাগার দোহাই দিয়ে অন্য কোথাও ভালো লাগা খুঁজবে না। তৃধা মুচকি হেসে নুসাইবের কুঁচকে রাখা কপাল দু আঙ্গুলে সিথিল করে বললো,,”কপাল কুঁচকানোর মত কিছুই হয়নি, ছাড়ুন।”

নুসাইব এক ভ্রু উঁচিয়ে বললো,,” তোমার পা কে*টে গেছে। তাও দু’টো পা-ই কে*টেছে,আর তুমি বলছো কপাল কুঁচকানোর মত কিছু হয়নি। সিরিয়াসলি?”

,,” আরে নতুন জুতোয় অনেক সময় পা কাঁ*টে এইটা স্বাভাবিক। আরো পরেছি উঁচু জুতো। কিছু হবেনা দু একদিনের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে।”

নুসাইব তৃধার কথায় তোয়াক্কা না করে কাটা জায়গায়টা ক্লিন করতে করতে বললো,,” ওই জুতো পরার দরকার নেই।”

তৃধা কয়েক সেকেন্ড থেমে নরম গলায় শুধোয়,,” আচ্ছা আপনার কখনো অনুশোচনা হয়েছে?”

কাঁটা জায়গায় অ্যান্টিসেপটিক ক্রীম লাগাতে লাগাতে বললো,,” কোন বিষয়ে?”

,,” আমাকে বিয়ে করা নিয়ে।”

তৃধার কথা শোনা মাত্রই নুসাইব হাত থামিয়ে দিলো। বার কয়েক চোখের পলক ফেলে পুনরায় ক্রীম লাগিয়ে দিতে দিতে বলল,,” হ্যাঁ হয়ে ছিলো।”

তৃধা এতো দিন মনে মনে জানতো কখনো নুসাইব থেকে এমন কথা শুনলে তার কাছে খারাপ লাগবে না, কষ্ট পাবে না। সে ভেবেছিল এই কথাটা স্বভাবিক কথার মতই শোনাবে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ব্যাপারটা তার উল্টো। নুসাইবের কথা শোনা মাত্রই তৃধার হৃৎপিণ্ড ধক করে উঠল। মুখের ভাব ভঙ্গি স্বাভাবিক রাখলেও ভেতরে ভেতরে দম বন্ধ হতে শুরু করলো।

নুসাইব লম্বা শ্বাস টেনে তৃধার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,,” অনুশোচনা তখন হতো যখন দেখতাম তুমি লোক মুখের কথা শুনে লুকিয়ে কাঁদতে। চেনা পরিচিত জায়গা গুলোতে পা রাখতেই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে খেই হারাতে। সম্পূর্ণ দোষ নিজের ঘাড়ে নিয়ে যখন মুচকি হাসতে। তখন আমার তীব্র অনুশোচনা হতো। আজো হয়ে ছিলো ,হয়তো কালও হবে। আমার অনুশোচনা তোমার সাথে দেরীতে পরিচয়ের। আমার অনুশোচনা তোমার দেখা আরো আগে না পাওয়ার। আমার অনুশোচনা তোমাকে দেরি করে ভালোবাসার। হয়তো আমাদের আরো আগে দেখা হলে জীবনটা অন্য রকম হতো। তোমাকে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হতো না, মানুষের কথা শুনতে হতো না, কষ্ট পেতে হতো না।
তুমি না বললেও আমি বুঝতে পারি সবার মাঝে বসলে তুমি নিজেকে ভীষণ ভাবে গুটিয়ে রাখো। তুমি সব সময় ভয়ে থাকো কখনো কে কি প্রশ্ন করে বসে। তোমাকে ওইভাবে দেখলে আমার ভীষণ অনুশোচনা হয় তৃধা। তোমার ওই সময়কার চাহনি দেখলে মনে হয়,ইস কেন যে আরো আগে দেখা হলো না। দেখা হলে হয়তো তুমি সবার মাঝে দাঁড়িয়ে নির্দ্বিধায় কথা বলতে পারতে। ইভেন আমার সাথেও। আমি বুঝি তুমি আমার উপরও অধিকার খাটাতে দুবার চিন্তা করো। হয়তো ভাবো আমি বিরক্ত হয়ে তোমার অতীত টেনে আনবো কিংবা দুচারটা তিক্ত কথা শোনাবো। ট্রাস্ট মি তৃধা তখন আমার অনুশোচনা হয় কেন আমার জীবনে এমন কোনো ঘটনা নেই।থাকলে হয়তো এতো জড়তা আসতোই না। এইবার বুঝলে কতটা অনুশোচনা হয়?”

নুসাইবের কথার পৃষ্ঠে কথা খুঁজে পেলো না তৃধা। বরং সে দু’চোখ ভাসিয়ে কাঁদছে। নুসাইব ব্যতিব্যস্ত হয়ে চোখ মুছতে নিলেই তৃধা দু হাতে জাপটে ধরে তাকে। বেচারা ব্যালেন্স হারিয়ে পড়ে যেতে নিয়ে নিজেকে সামলে নেয় আবার। তৃধার সেই খেয়াল নেই। সে হেঁচকি তুলে কাঁদতে ব্যস্ত। নুসাইব তার পিঠে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,,” আর কখনো নিজেকে ছোট মনে করবে না। তোমার অতীত বর্তমান সবই আমি। আমি ছাড়া তোমার আর কোনো অতীত নেই। এই তিনটা বছরের আগে সেই দুটো বছর কিছুই না। এখনো পুরো জিবন বাকি, বাকি জীবন চিন্তা করলে ওই দুটো বছর খুব বেশি ফিকে পড়বে তৃধা।”

ধীরে ধীরে কান্না থামলেও তৃধা হাতের বাঁধন খুললো না। শক্ত করে গলা জড়িয়ে ধরে বসে রইল। নুসাইব লম্বা শ্বাস টেনে দুহাতে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো তাকে। নিরবে নিভৃতে ভালোবাসার লেনা দেনা হচ্ছে। নুসাইব চোখ বুজে মুচকি হাসলো আর মনে মনে বলে উঠলো,,” ভালোবাসা সুন্দর।”

বর্ষা ঋতুর প্রথম বর্ষন। এক পশলা বৃষ্টি শেষে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করলো। জানালার কাচ ভেদ করে পর্দার ফাঁক দিয়ে একরত্তি সূর্য কিরণ এসে পড়লো তৃধার চোখে। ঘুমে ব্যাঘাত ঘটায় খানিকটা বিরক্ত হলেও চোখ জোড়া খুলে তাকালো। পর্দার ওইটুকু ফাঁক দিয়ে সূর্যটা শুধু তাকেই ছুঁয়ে দিচ্ছে। এই নিয়ে রাগ করার কথা না থাকলেও তৃধা সূর্যের ওপর খানিকটা রাগ করলো। সেই রাগ পুষে আড়মোড়া ভাঙ্গতেই আটকা পড়লো কারো হাতের বাঁধনে। তৃধা মেয়েকে ছেড়ে মুচকি ফিরে তাকালো। ঘুমে বিভোর নুসাইব। তৃধা বুঝতে পারে না ঘুমিয়ে থাকলে হাতের বাঁধন এতোটা শক্ত পোক্ত হয় কি করে। তৃধা নুসাইবের কপোলে আলতো করে হাত ছোঁয়ালো। এর মধ্যে নুসাইব নড়ে চড়ে পুনরায় ঘুমিয়ে পড়লো। সেটা দেখে তৃধা মৃদু হেসে দুজনকে রেখে উঠে পড়লো।

বিয়ে বউভাত সব একসাথে হয়ে যাওয়াতে ঝামেলা অনেকটাই কমে গেছে। বাড়ির পরিবেশ কিছুটা শান্ত হলেও মেহমান এখনো আছে। তৃধা সবার হাতে হাতে চা দিয়ে সেতারা বেগমের কাছে যেতেই তিনি ফোঁড়ন কে*টে বলে উঠলো,,” সবার আগে গুরুজনদের দিতে সেটা জানো না? প্রথম হলে বুঝতাম হয়তো এইসব জানো না।”

সেতারা বেগমের কথাটা শুনা মাত্রই তৃধা ট্রে মুঠ করে ধরলো। সে জানে এর পরের বাক্য কি হবে।তাই তিক্ততা হযম করার জন্য নিজেকে খানিকটা প্রস্তুত করে নিলো ।

সেতারা বেগম তাচ্ছিল্য করে হেসে পুনরায় বললো,, কিন্তু তোমার তো এইটা,, সেতারা বেগমকে বলতে না দিয়ে পেছন থেকে নুসাইব বলে উঠলো,,” ওর এইটা বলতে কি বুঝাতে চাইছো?”

নুসাইবের কন্ঠস্বর শোনা মাত্রই তৃধা ঘুরে তাকালো। নুসাইব তৃধার ওই মায়া ভরা চেহারায় অপ্রস্তুত ভাবটা দেখে ব্যথিত হলেও চোখ দিয়ে ইশারা করে বলল”আমি আছি।”

তৃধা সেই ইশারা দেখে গভীর নিঃশ্বাস ফেলে মুচকি হাসলো। তৃধার মতে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরতম শব্দ হচ্ছে ‘ ভালোবাসি’। এটি এমন একটা শব্দ যাকে হাজার হাজার শব্দ দিয়ে বিশ্লেষন করা যায় না। তেমনি যদি কোনো সুন্দরতম বাক্য থাকে তবে তা হচ্ছে ‘আমি আছি’। ‘আমি আছি’ দুটি শব্দের একটি বাক্য, যার ক্ষমতা অপরিসীম। “আমি আছি” তে অধিকারবোধ, ভরসা তার সাথে অগাধ ভালোবাসা আর বিশ্বাস মিশে থাকে। ‘আমি আছি’ বাক্যের মত ভরসা পূর্ণ, শক্তপোক্ত বাক্য বোধহয় আর দুটো নেই। ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাওয়া তৃধার পেছনে দাঁড়িয়ে নুসাইব যখন মুচকি হেসে চোখে ইশারা করে বলে ‘আমি আছি’। তখন তৃধার মনে হয় ‘ভালোবাসি’ শব্দের পর সুন্দরতম যদি কোনো বাক্য হয় তবে তা হচ্ছে ‘আমি আছি’। আর এই বাক্য নুসাইব অসংখ্য বার বলেছে। আজও বলছে হয়তো ভবিষ্যতেও বলবে।

তৃধা দাঁড়ালো না ট্রে হাতে নিয়ে ধীর পায়ে কিচেনের দিকে এগিয়ে গেল। বুক ফুলিয়ে শ্বাস টেনে ঠোঁট জোড়া প্রশস্ত করে হাসলো। জীবনের পূর্ণতা বোধহয় এখানেই। যেখানে একজন নারীর পেছনে একজন ভরসা পূর্ণ পুরুষ দাঁড়িয়ে বলবে আমি আছি । এর থেকে বেশী কিছু বোধহয় কোনো নারী চায় না, তেমনি তৃধাও চায় না। এইখানে তার জীবন পূর্ণ, তৃপ্ত।

——সমাপ্ত——