আমি আছি পর্ব-৬+৭

0
1092

উপন্যাসের নাম::#আমি_আছি
লেখনিতে:#সাদিয়া_আফরোজ
পর্ব: ৬

তমাল আর নবনী মায়ের সামনে বসে আছে। নাবীব শেখ তখনো রকিং চেয়ারে বসে বইয়ে মুখ গুঁজে আছে। তার মতে ছেলে মেয়ে বড় হয়েছে এখন ওরা নিজের ভালো নিজেরাই বুঝে নিবে। খামোখা লাগাম টেনে লাভ নেই। যদিও ফরিদা হক তার বিপরীত। তার বাচ্চা দুটো খবর দেওয়া ছাড়া সকাল সকাল বাড়িতে এসে উঠেছে কেন সেটাই জানতে চাইছেন। নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে! এইদিকে তমাল আর নবনী বড় ভাইয়ের ঝাড়ি খেয়েছে। তাও দুজন মিলে নির্লজ্জের মত দুইপাটি দাত বের করে ছিল।খাবার টেবিলে তৃধার সাথে পরিচিত হওয়ার জন্য দুইজন যেভাবে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে তা দেখেই ক্ষেপেছিলো নুসাইব। হুট করে এসে একটা মেয়েকে এমন অপ্রস্তুত অবস্থায় ফেলে দেওয়া তার মোটেও পছন্দ হয়নি। তাছাড়া তমাল এইবার লাষ্ট সেমিস্টারে। এই মুহূর্তে তার আসা একদমই ঠিক হয়নি। নবনীর প্রথম বর্ষ শেষ হয়েছে ঠিকই কিন্তু হল বন্ধ দেওয়ার আগে বাড়িতে আসাটাও নুসাইব মেনে নিতে পারেনি। যার দরুন দুইজনের এক সাথে ক্লাস নিয়েছিল। অন্য সময় হলে তমাল আর নবনী মন খারাপ করে থাকতো। কিন্তু আজ ব্যাপারটা ভিন্ন। নুসাইব যত বকাই দিকনা কেন দুইটোর পুরো মনোযোগ তৃধার মধ্যেই ছিল। মন খারাপের সময়টা স্থায়ী হলো না। ফরিদা হক গলা ঝেড়ে কিছু জিজ্ঞেস করবে তার আগেই নবনী বলে বসলো,, আম্মু মেয়েটাকি ভাইয়ার বউ হবে? দেখো আমাদের আপত্তি নেই। মেয়েটা খুব মায়াবী তার উপর কেমন শান্ত। মেয়ের কথা শুনে নাবীব শেখ বই থেকে মনোযোগ সরিয়ে কান খাঁড়া করে রেখলেন। মেয়েটা বিবাহিত না হলে নাবীব শেখ নিজেই ছেলের জন্য দেখতো। কিন্তু এখন ব্যাপারটা ভিন্ন। সবাই সবকিছু মেনে নিবে এমটা তো নয়।

ফরিদা হক আচম্বিত চোখে তাকিয়ে বললো,, এই জন্যই দুইজন বাড়িতে এসে হাজির হয়েছিস?
তমাল মাথা নেড়ে দুই ধাপ এগিয়ে বললে উঠলো,, আম্মু আগে বলো এইটাকি ভাইয়ার সখের নারী?

তমালের কথা শেষ হতেই ফরিদা হক ধুম করে কি*ল তমালের পিঠেএকটা ঘু*সি বসিয়ে দিলেন। এইদিকে নবনী বিছানা ছেড়ে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে রইল। অবস্থার গতিবেগ বুঝে তবেই পালাবে। তমাল পিঠ ডলতে ডলতে উপুড় হয়ে রইলো। নাবীব শেখ তার এই ছেলে নিয়ে আগ থেকেই বিপাকে পড়ে আছে। এখন আবার এর ভাষার উন্নতি হয়েছে।
ফরিদা হক দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলো,, সখের নারী! মুখের কি ভাষা তার। এই এই তুই কিসের ডাক্তারি পড়িস? তোকে এইগুলো শেখায়?

তমাল বিছানার শেষ প্রান্তে গিয়ে বসলো।
,, কিছু বললেই পড়ালেখা টেনে আনো কেন? ওই বুচিও তো বলেছে। দোষ শুধু আমার কেন? ওকেও ঘু*সি দাও।

ফরিদা হক হাত উঠিয়েও থেমে গেলেন ‌। এই ছেলে আর যাই হোক মানুষ হবে। মে*রেও লাভ নেই।

এইদিকে নাবীব শেখ চশমা নাকের ডগায় এনে বললো,, আহ্হা ফরিদা এতো বড় ছেলের গায়ে কেউ হাত তোলে? তোমার যে ছেলে মেয়ে এতো সহযে প্রশ্নের ফোয়ারা শেষ হবে না। বলে বিদায় করো। তা না হলে বড় মেয়েটাকেও শান্তি দিবে না। উল্টো পাল্টা বলে টেনশনে ফেলবে।
নাবীব শেখের কথা শুনে চোখ পাকিয়ে নবনীর দিকে তাকালো ফরিদা হক।
নবনী আমতা আমতা করে বলল,, এইভাবে তাকাচ্ছো কেন?
,, সত্যি করে বল, তিন্নি এইসব জানে?

নবনী মিনমিন করে বলে উঠলো,, হুম, জানে। বলেছে বিয়ের শপিং সেই দেশ থেকেই করে আনবে। আমাদের শুধু শাড়ি , জামাকাপড় এইসব নিতে হবে।

ফরিদা হক রাগলেন না । বরং মস্তিষ্কের উপর জোর দিয়ে মনে করতে থাকলেন, এই দুইটা পেটে থাকা অবস্থায় তিনি এমন‌কি খেয়েছিলেন যার ফলে এইগুলো এমন হয়েছে।

নাবীব শেখ মৃদু হাসলো। তার ধারনাই ঠিক।

ফরিদা হক লম্বা শ্বাস টেনে,, শুরু থেকে শেষ ওবদি সবটুকু খুলে বললেন। সবটা শুনে তমাল আর নবনীর ভীষণ মন খারাপ হলো। আর যাই হোক কেউই এমন কিছু শুনলে ঠিক থাকবে না। সাথে দুই ভাই বোনের অপূর্ণ মনবাসনার দুঃখ। সব মিলিয়ে মন খারাপের উপর মন খারাপ।

নাবীব শেখ লম্বা শ্বাস টেনে বললো,, নুসাইব এইসব এখনো জানে না। তাছাড়া আমার ছেলেটা এতো কিছু নিয়ে পড়েও থাকে না। সুতরাং তাকে কিছু বলার দরকার নেই। যা জানে সেটা ওবদি থাক।এমনিতেই কাজের প্রেশার। পরে নাহয় সময় করে বলা যাবে।

নবনী আর তমাল মাথা নেড়ে বেরিয়ে পড়লো।

অন্যদিকে তৃধা রুমে ঘাপটি মেরে বসে আছে। কিছুক্ষণ আগে একটা ছেলে একটা মেয়ে হুমড়ি খেয়ে টেবিলের উপর পড়ে তার সাথে পরিচিত হতে চাইলো। যদিও পরে জানতে পেরেছে এরা এই বাড়ির তৃতীয় ও চতুর্থতম ছেলে মেয়ে। তবে আচমকা এমন কিছু হবে তৃধা ভাবতেই পারেনি। এমতাবস্থায় তৃধা হকচকিয়ে খৈই হারিয়ে ফেললো। কি বলতে কি বলবে সবটাই গুলিয়ে ফেলেছে। ভাগ্যিস সেখানে এই বাড়ির বড় ছেলেটা ছিল।
এখন তৃধার বাইরে বের হতে কেমন যেন লাগছে। বাড়ির সবাই একত্রিত হয়েছে। নিশ্চয়ই তাদের নিজেদের মধ্যে অনেক কথা অনেক গল্প থাকতে পারে। সে চায় না তাদের এমন পারিবারিক বিষয় কিংবা আড্ডা এইসবের মধ্যে ডুকতে। সব পরিবারেই নিজেদের মধ্যে একান্ত ব্যাক্তিগত সময় প্রয়োজন হয়। নিশ্চয়ই ওনাদেরও আছে।
তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলল তৃধা। এমন একটা সময় তাদের পরিবারেও ছিল। কর্ম বিরতি শেষে ভাই বাড়ি এলে এমন জমজমাট পরিবেশ তার বাড়িতেও হতো। তৃধা এখন বুঝতে পারে, সব কিছু সে নিজের হাতেই শেষ করে ফেলেছে। সময় থেমে নেই, ঠিক করারও সুযোগ নেই, ভুল গুলো সুধরে নেওয়ারও উপায় নেই। এক বুক হাতাশা গ্ৰাস করলো তৃধাকে। কাত হয়ে শুয়ে বালিশে মাথা এলিয়ে চোখ বুঝলো। চোখ জ্বলছে একটু পরেই নিশ্চয়ই চোখ জোড়া অশ্রুসিক্ত হবে। দুচারটা পুরোনো স্মৃতি আবারো ভেসে উঠবে চোখে।
তীব্র অনুশোচনা চোখের জল কপোল গড়িয়ে পড়বে। কষ্টের জোয়ারে ভাসবে বুক। ঘুমিয়ে থাকুক সব স্মৃতি ঘুমিয়ে কাটুক এই অশ্রুসিক্ত সময়। তাও এক ফোঁটা নোনা জল চোখের কোণ বেয়ে বালিশে এসে পড়লো।
__________

তিন্নি তার মাকে ভয়েস ম্যাসেজে দিয়ে তৃধার কথা জিজ্ঞেস করেছে। তিনি কিছু বলেননি, ভয়েস ম্যাসেজ শুনে মোবাইল বিছানার শেষ প্রান্তে ফেলে গটগট করে হেঁটে বাইরে চলে গেলেন।
স্ত্রীর এই রুপ ব্যাবহার দেখে মুচকি হাসলো নাবীব শেখ। বয়স বাড়লেও রাগটা সেই আঠারো বছর বয়সী মেয়ের মতই আছে।
তিন্নি ফরিদা হক আর নাবীব শেখের দ্বিতীয় সন্তান। পড়ালেখা শেষ হতেই বিয়ের পিঁড়িতে বসে। এরপর স্বামী সহ ভিনদেশে পাড়ি জমায়। অবশ্য তিন্নি এখন একটা ছেলে সন্তানের মা।

তমাল মায়ের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলেও তৃধার প্রতি ভাইয়ের আচরন নিয়ে এখনো সন্দেহে আছে। এর আগে সে তার ভাইকে কখনো কোনো মেয়ের জন্য এতোটা চিন্তিত দেখেনি।
অন্যদিকে নবনীর মনে তৃধার জন্য একটা বিশেষ জায়গা তৈরি হয়েছে। জায়গাটা মায়ার বলা চলে। কারো দুঃখের কথা শুনলে মায়া হবে,ব্যাপারটা মানব জাতির জন্য নিতান্তই সাধারণ একটা বিষয়। মেয়েরা সেই মেয়ের জায়গায় নিজেকে বসিয়ে ভাবে কষ্টের গভীরতা কতটুকু। পুরুষের ব্যাপারটা সম্পূর্ণ আলাদা। তারা সেই মেয়ে/নারী জন্য শক্ত মাটি হতে চাইবে, কাঁধে মাথা রেখে কাঁদার জন্য বিশ্বস্ত কাঁধ হতে চাইবে। কখনো কখনো পুরুষের মায়া ভালোবাসা পর্যন্তও গাড়াবে।
__________

এই দুই দিন রজব বেশ ভালোই আছে নতুন বউ নতুন সংসার সব মিলিয়ে সে বেশ সুখেই আছে। যদিও বাড়িতে কারো সাথে তার সম্পর্কটা আগের মত নেই। এইদিকে শিমুল এসে রাজিয়া আর সাফিয়া খাতুনকে নিয়ে গেছে। এতোসব কিছুর পর শিমুল তাদের আর এই বাড়িতে রাখবে না। তাছাড়া
সাফিয়া খাতুন, রাজিয়া কেউই থাকতে চায়নি। দুইজন মানুষ থাকলেও ঘর সংসার বিরান হয়ে আছে। মানুষের শব্দ নেই আপন জনের হাসির আওয়াজ নেই। সব যেন নিরবে চলছে।
______

অফিস বিল্ডিংএর ছাদে দাঁড়িয়ে আছে নুসাইব। ব্যাস্ত শহরের দিকে তাকিয়ে উদাস হলো। সেই উদাস চোখ জাড়ায় রাতের আবছা আলো, আবছা অন্ধকারে কান্নারত তৃধার চেহারাটাই ভেসে উঠছে বারংবার। নুসাইবের মতে, যেই কান্না দেখলে লোকের মায়া হবে সেই কান্নাটাই বেশি ক*ষ্টের। কিসের কষ্ট তার? কি হয়েছে? কাকে জিজ্ঞেস করবে? প্রশ্ন থাকলে উত্তরের আশা কারো কাছেই করছে না। তবে রাতের ওই মূহুর্ত থেকে এই পর্যন্ত নুসাইবের মায়াই হচ্ছে বেশি।দেখতে পরিচিত মনে হওয়া সম্পূর্ণ অপরিচিত মেয়েটার জন্য তার একটু বেশিই মায়া হচ্ছে।

চলবে,,,

উপন্যাসের নাম::#আমি_আছি
লেখনিতে:#সাদিয়া_আফরোজ
পর্ব: ৭

দুপুরে তৃধা টেবিলে বসতে চাইলো না। পারিবারিক আলাপচারিতায় সে নিতান্তই বাইরের মানুষ।

নবনী জেদ ধরে রয়। সে তৃধাকে ছাড়া টেবিলে বসবে না। এইদিকে তমালও তাই একজন মানুষ বাড়িতে এসেছে,সে আলাদা খাবে কেন! তাকে সবার সাথে বসেই খেতে হবে। দুই ভাই বোনের কাজে ফরিদা হক,নাবীব শেখ দুজনেই বেশ খুশি। এই দিকে তৃধা দুইজনের আচরনে ভীষণ অবাক হলো। অবশ্য ভালো গাছের ফল তো ভালো হবেই। যাদের মা বাবা ভালো তাদের সন্তানরাও ভালো হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। অগত্যা তৃধাকে সবার সাথে বসেই লাঞ্চ করতে হলো। সবাই থাকলেও খাবার টেবিলে নুসাইব অনুপস্থিত।তার কাজের ভীষণ তাড়া।
____________

পাড়াজুড়ে খবর ছড়িয়ে গেছে, শেখ ভিলায় নতুন মেহমান এসেছে,তার সাথেই ওই বাড়ির বড় ছেলের বিয়ে হবে। কেউ কেউ বলছে বিয়ে হয়ে গেছে। আবার কেউ কেউ বলছে এই মেয়ের সাথে তাদের ছেলের আগ থেকেই সম্পর্ক আছে যা এখন বিয়ে ওবদি গড়িয়েছে। এই ব্যাপারে বাড়ির সবাই না জানলেও তমালের কানে খবরটা আগেই পৌঁছে গেছে। তমাল কপালে আঙ্গুল ঘষতে ঘষতে পুরো ঘটনা আবারো রিভাইন করতে লাগলো। ঘরের কথা নিউজ চ্যানেলে কিভাবে যাচ্ছে সেটাই বের করতে চাইছে। যদিও এইটা খুব একটা কঠিন কাজ নয়।
__

নবনী তৃধার সাথে গল্প জুড়ে দিয়েছে। তার গল্পের বিষয়বস্তু ভীষণ ঘোলাটে। একটা টপিক থেকে আরেকটা,সেইটা থেকে অন্যটা। তৃধা বুঝতে পারছে নবনী তার সাথে মিশতে চাইছে। তৃধা মুচকি হেসে বলল,,, তুমি করে বললে কোনো সমস্যা হবে?
ঘন ঘন মাথা নাড়ল নবনী। তার সমস্যা নেই বরং সে খুব খুশি।
,, তুমি করেই বলো আপু। আমি তোমার বয়সে ছোট হবো।
,, ঠিক আছে।

,,কিসে পড় তুমি?

,, অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে। আপু তুমি কতটুকু পড়েছো?

তৃধা ভারি নিঃশ্বাস ফেলে মুচকি হেসে মাথা নিচু করে বললো,, পড়ার তো অনেক ইচ্ছে ছিলো। ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে আর পড়া হয়নি। এইচএসসি পরীক্ষার দুইদিন আগেই বাড়ি ছেড়েছিলাম।
নবনীর চোখ জোড়া কাতর হলো। লম্বা শ্বাস টেনে তৃধার হাত ধরে বললো,, বাদ দাও। চলো আমার সাথে।

,, আরে আরে কই যাবো?

,, এইখানে আসার পর নিশ্চয়ই রুম থেকে বের হওনি।চলো বাড়ি ঘুরে দেখবে। তোমাকে আমার প্রিয় জায়গা গুলো দেখাবো।
তৃধা অমত করলো না। নবনীর পেছন পেছন যেতে থাকলো।

নবনী সিঁড়ি বেয়ে দুতলায় উঠলো। দুটো রুম ছাপিয়ে তৃতীয় রুমে পা টিপে টিপে ঢুকলো। তৃধা প্রশ্নবিদ্ধ চোখে চেয়ে আছে। দুটো রুম ছেড়ে এইখানে এলো কেন,এসেছে ভালো কথা কিন্তু লুকিয়ে ঢুকছে কেন?
নবনী পেছনে তাকিয়ে তৃধাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে হাত ধরে টেনে রুমের ভেতর নিয়ে গেল। রুমটা বেশ বড় চারপাশ বেশ খোলামেলা। পুরোনো স্মৃতি তাজা হওয়ার মত অনূভুতি হলো তৃধার। আদুরে চোখে তাকিয়ে দেখছে সবটা। দু’বছর আগে এমনই একটা রুম জুড়ে তার বিচরণ ছিলো।

পরিপাটি বিছানা এলোমেলো করে ধপ করে শুয়ে পড়লো নবনী। পুরো বিছানায় গড়াগড়ি দিয়ে বলল,, এই রুমটা আমার ভীষণ প্রিয়। দেখো আপু কত্তো বড় বিছানা কত্তো বড় রুম। ওই পাশে দেখো, দেয়াল নেই সব কাঁচ ‌। তৃধা ফিরে চায়, সত্যি দেয়াল নেই। পুরোটাই কাঁচ। সেই কাঁচের দেয়ালের অপর পাশে ছোট একটা বেলকনি। রুমটা মন্দ নয় আসলেই বেশ সুন্দর।

,, রুমটা আমাকে দিয়ে দিলে কি হতো?

তৃধা কিছুটা অবাক হয়ে বললো,, কেন এইটা তোমার রুম না?

নবনী বিছানায় পুনরায় গড়াগড়ি দিয়ে বললো,, না। বড় ভাইয়ার রুম। এইতো এমন গড়াগড়ি খাচ্ছি। আমার রুম হলে থোড়াইনা তোমাকে নিয়ে আসতাম। বললাম না প্রিয় জায়গা দেখাবো।

তৃধা চমকায়। এইভাবে কারো রুমে আসা তার মোটেও ঠিক হয়নি। তৃধা ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে বললো,, চলো আমরা বেরিয়ে যাই। এইভাবে কারো রুমে আসা আমার মোটেও ঠিক হয়নি।

নবনী উঠে বসলো। বাতাসে মাছি তাড়ানোর মত করে হাত নেড়ে বলল,, ধুর রাখোতো। ভাইয়া আসতে দেরি হবে। তখন এই রুমে নো এন্ট্রি লেখা থাকবে। এখনই সুযোগ, বসো বসো।
তৃধা নাকোচ করে রুমের দরজা খুলে বাইরে বের হতেই নুসাইবের মুখামুখি পড়লো। নুসাইব ভ্রু জোড়া গুটিয়ে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ নুসাইবকে সামনে দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল তৃধা। কান্না পাচ্ছে তার, নিজেকে কেমন জানি চোর চোর মনে হচ্ছে। তৃধা একহাতে অন্য হাত মোচড়াচ্ছে। কি বলবে বুঝতে পারছে না। নবনীর কথা বললে যদি ভাই বোনের মধ্যে সমস্যা হয়!

এইদিকে নুসাইব ভেবেছে তৃধা হয়তো ভুল করে এই রুমে ঢুকে পড়েছে। যদিও তার এই ধারনা ভুল প্রমাণ করলো তার আদরের ছোট বোন।

নবনী দরজা খুলতে খুলতে বললো,, আরে আসো আপু। ভাইয়া আসার আগেই কেটে পড়বো। কাক পক্ষিও টের পাবে না।

নুসাইব তৃধা থেকে চোখ সরিয়ে নবনীর দিকে তাকিয়ে বলল,, এই বুচি বেরিয়ে আয় রুম থেকে। নিজেতো বে*য়া*দব হয়েছিস। এখন আরেক জনকে বিগড়ানোর পয়তারা করছিস?
নুসাইবের কথায় চোখ তুলে তাকায় তৃধা।

নবনী নিঃশব্দে বেরিয়ে এলো। দুইপাটি দাঁত বের করে বোকার মত হেঁসে বললো,, আরে ভাইয়া তুমি কখন এলে? আমিতো তৃধা আপুকে বাড়ি ঘুরিয়ে দেখাচ্ছি।
নুসাইব রাশ ভারী কন্ঠে তৃধার দিকে তাকিয়ে সুধোয় ,, সত্যি?

তৃধা মাথা নাড়ায়। যার অর্থ নবনী সত্যি বলছে।

,, দেখে তো মনে হচ্ছে জোর করে রুমে ঢুকিয়েছিস।

নবনী আমতা আমতা করে বলল,, তুমি জানলে কি করে?।

তৃধাকে পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে বললো ,, যাকে সাথে নিয়ে এসেছিস তার চেহারা দেখলেই বুঝা যায়।

নুসাইবের কথা শুনে পেছন ফিরে তাকালো তৃধা। ভাইয়ের কথা শুনে নবনীও তৃধার চেহারার দিকে ভালো করে তাকিয়ে বলল,, কই নাতো।

তৃধা নিজেও নিজের গাল ছুঁয়ে দেখলো।

এমন সময় নুসাইব চি*ৎ*কার দিয়ে নবনীকে ডেকে উঠলো। সেই ডাকে চমকে উঠলো তৃধা আর নবনী।
তৃধা না বুঝলেও নবনী জানে নুসাইব চি*ৎকার করছে কেন। জানের ভ*য় সবারই আছে‌। নবনীও সেই সবার মধ্যেই পড়ে। তাইতো দেরি করলো না,তৃধার হাত ধরেই দৌড়ালো।

নুসাইব গোছানো স্বভাবের ছেলে। তার সাথে জড়িয়ে থাকা সব কিছুই সে পরিপাটি রাখতে পছন্দ করে। এইবার হোক সেটা বিছানা কিংবা মানুষ। তার এই পরিপাটি স্বভাবের কারণে ফরিদা হক তার রুমে কাউকে এলাও করে না। গোছানো জিনিসপত্র অগোছালো দেখলে শান্ত স্বভাবের ছেলেটা ভীষণ অশান্ত হয়ে পড়ে। আজকেও তার ব্যাতিক্রম হলো না। নবনী তার গুছিয়ে রাখা বিছানার হাল বেহাল করে দিয়েছে। এতেই নুসাইব রে*গে একাকার।

অন্যদিকে নবনী তৃধাকে নিয়ে একেবারে ছাদে উঠে গেছে। দুইজনই বেশ হাঁপাচ্ছে। তৃধা ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলে বললো,, উনি হঠাৎ এমন রে*গে গেলো কেন?
নবনী ছাঁদে রাখা বেঞ্চের উপর ধপ করে বসে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,,, আমাদের নবাব নুসাইবউদ্দৌলা অগোছালো জিনিস পছন্দ করেনা। এইদিকে আমি তার বিছানায় গড়াগড়ি দিয়ে পুরো উলোট পালোট করে ফেলেছি। তাইতো নুসাইবউদ্দৌলা রে*গে গেছে। আজ আমি সামনে যাবো না। তোমার সাথে সাথে থাকবো। তুমি আছো বলে ভাইয়া বেশি রে*গে নেই। তা না হলে রুম থেকে বের হওয়ার সময়ই কেল্লা ফতে।

তৃধা ভ*য়ে ঢোক গিললো। মিনমিনে গলায় বললো,, এইটা একটু বেশি হয়ে গেলো না? আমাকে দেখাতেইতো গেলে। এখন যদি ঘরে অশান্তি হয়?

নবনী মুচকি হেসে বলল,, চিন্তা করো না। ভাইয়া রাগ বেশিক্ষণ টিকবে না। আমাকে সবার চেয়ে একটু বেশিই আদর করে। বাড়িতে থাকতে সব সময় এলোমেলো করতাম। এখনো যখনই আসি তখনই এমন করি। তুমি না থাকলেও আমি যেতাম।

তৃধা মৃদু হেসে নবনীর পাশে বসলো।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। হেমন্ত ঋতু শেষ প্রায়। মৃদুমন্দ বাতাসে শীত শীত সুবাস পাওয়া যাচ্ছে। ছাদে লাগানো শিউলি ফুল গাছে তখন কলিতে ভরে আছে। গাছটা খুব বেশি বড় না হলেও সকাল হতে হতে এক আঁজলা ফুল কুড়িয়ে নেওয়া যাবে। তার পাশে লাগানো বাগান বিলাসের পাতা ঝরছে খুব। হয়তো ফুল দিবে শীতে। তৃধার সেই দিকে তাকিয়ে বলল। ,, ভাই-বোনের মধ্যে এই মুহূর্ত গুলো একটু বেশি সুন্দর। বড্ডো সুন্দর অনুভূতি। সময় ফুরালেও এই অনূভুতি গুলো স্মৃতির পাতায় লেখা থাকবে। তখন ইচ্ছে করবে এই সময়ে আবার ফিরে যেতে।
নবনী তৃধার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তার চেহারায় স্পষ্ট প্রতিফলিত হচ্ছে এমন সময় তার জিবনেও ছিল। এখন হয়তো স্মৃতি হয়ে গেছে।

তৃধা নবনীর দিকে তাকিয়ে চোখে চোখ রেখে বললো,, সময়টাকে লুফে নাও নবনী।
নবনী মুচকি হেসে বলল,, এমন সময় কি তোমারো ছিল আপু?

প্রশ্নের উত্তরে মুচকি হাসলো তৃধা। তার সাথে ভারী হলো বুক। টেনে নিঃশ্বাস নিয়ে আকাশের দিকে চোখ রাখলো। আকাশ দেখলে নাকি মন হালকা হয়।
নবনী তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে তৃধার মত করে আকাশের দিকে তাকালো। নবনী ভুল বলেনি। তৃধারো এমন মূহুর্ত ছিল। অসংখ্য মূহূর্ত যা গুনে শেষ করা যাবে না।

_______
নাবীব শেখ বিকেলে বেরিয়েছেন। উদ্দেশ্যে মোড়ের দোকানে বসে সমবয়সীদের সাথে চায়ের আড্ডা। যদিও বাড়িতে শুধু আড্ডার কথাই বলে এসেছে। ডায়বেটিস ধরা খাওয়ার পর থেকে চায়ের নাম নিলেই পাপ হয়। নাবীব শেখের মতে বয়স বাড়ার পর সবকিছুতে বাঁধা ধরা নিময় মানেই নিচক মূর্খতা। ছেলে মেয়ে বড় হয়ে গেছে,বয়স বেড়ে গেছে,এক পা কবরে ঢুকে গেছে ,ডাক পড়লেই উপরে যেতে হবে। এমন সময় এই সব কনট্রোল ফনট্রোল মূর্খতা নয় কি। বরং এখন সব সময় আল্লাহর ভরসা করে করা উচিত। কনট্রোলে যেহেতু হায়াতের ডেভেলপ হবে না,সেহেতু কন্ট্রোল করার দরকার নেই।
যদিও নাবীব শেখের এই যুক্তি তার বাড়ির গেইটের বাইরে থাকে। গেইটের ভেতরে তার এইসব যুক্তি তর্ক চলে না। তখন তিনি কেবল অবলা স্বামী এবং চার সন্তানের পিতা যার সব স্বাধীনতা স্ত্রীর হাতে গচ্ছিত।

দোকানে বসতে না বসতেই একজন বলে বসলো,,

” কি ব্যাপার শেখ? নতুন বউ ঘরে আসতে না আসতেই ঘর মুখো হয়ে গেলি। কালকেও এলিনা ঘটনা কি?”

মনসুর আহমেদ এর কথা শুনে নাবীব শেখ নড়েচড়ে বসল।

পাশ থেকে জয়নুল বলে উঠলো, বাড়িতে এখন সময় কাটানোর মানুষ আছে। নতুন বউমা চিনি ছাড়া চা করে দিচ্ছে এইখানে আসবে কেন?

নাবীব শেখ হতভম্ব হয়ে গেছেন। তারা কি বলছে কিছুই বুঝতে পারছে না। একদম ধরাকে সরা জ্ঞান যাকে বলে।

এমন সময় হাতে জুস নিয়ে দোকানে ঢুকলো তমাল। এতক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়ে সবটাই শুনছে। বাবার রিয়েকশন দেখেই বুঝে গেছে বাবা এই কাহিনী সবে শুনেছে। তার চেয়ে বড় কথা এই লোক পাল্টা উত্তর কখনোই দেয়নি দিতেও পারে না।

তমাল গলা খাঁকিয়ে বলে উঠলো,, যার বিয়ে তার খবর নাই পাড়াপড়শীর ঘুম নাই । কি আংকেল ঠিকতো?

দুইজনেই তমালের কথা শুনে নাখোশ নজরে তাকালেন।

,,বিয়েশাদী যখন দিয়েই দিয়েছেন তখন বাবাকে জিজ্ঞেস করছেন কেন? আপনাদের দুইজনের মেয়ে আমার বন্ধু সাদাফের সঙ্গে প্রেম করে বেড়াচ্ছে সেটা কি আমার বাবা জিজ্ঞেস করেছে কখনো? কখনো কি বলেছে ” জয়নুল মনসুর তোদের দুইটা মেয়ে মিলে একটা ছেলেকে কেন পছন্দ করেছে? কেন পার্কে এক ঘন্টা আগপিছ করে দুইজনেই বাদাম ভাজা খাচ্ছে ?” বিশ্বাস করুন আংকেল।আমার বাবা এইসবে নেই। তিনি ভীষণ শান্তি প্রিয় মানুষ।আমি এতোবার বললাম , প্রমান পর্যন্ত এনে দিলাম তাও তিনি কিছুই বলেনি। কারণ বেহুদা আলোচনা সমালোচনা তার দ্বারা হয় না। উনি সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে চায়। বাঁচাল না, ধরাকে সরা জ্ঞান করার স্বভাব নেই।

তমালের কথা শেষ হওয়ার আগেই জয়নুল আর মনসুর আহামেদ উঠে হন হন করে দোকান থেকে বেরিয়ে গেলেন। যাওয়ার আগে কটাক্ষ করে বেয়াদব শব্দটার স্পষ্ট উচ্চারণ বার কয়েক করে গেলেন।

এইদিকে দোকানী আর নাবীব শেখ দুইজনেরই কাঁশি উঠে গেছে। কে কাকে পানি দিবে সেটাই বুঝতে পারছে না।

তমাল ভ্রু কুঁচকে দুইজনের দিকে দুটো গ্লাস এগিয়ে দিতে দিতে বললো,, কি কোলি যুগ এলোরে সত্য কথা কারোই হযম হচ্ছে না। চলো বাবা সামনের গলি থেকে ঘুরে আসি। সাদাফ এসেছে মনসুর আংকেলের মেয়ের সাথে দেখা করতে। দেরি করলে কিন্তু পরের গলিতে যেতে হবে ওখানে জয়নুল আংকেলের মেয়ের সাথে দেখা করবে।

রাতের শেষ তৃতীয়াংশে উঠে বসলো তৃধা। সে ঘুমোয়নি, চোখ জোড়ায় ঘুম নেই বললেই চলে। আজ নবনী তার সাথে শুয়েছে। মেয়েটা গল্প করতে করতে হাঁপিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। তৃধাও তার পাশে শুয়ে ছিল। চোখ জ্বলছে তার ,রাত বাড়ার সাথে সাথে বুকের ব্যাথ্যাটাও বাড়তে শুরু করে। চেপে রাখা কান্নায় নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। বড় করে নিঃশ্বাস ফেলেও লাভ হয় না। মনে হচ্ছে ফুসফুস ওবদি অক্সিজেন পৌঁছাচ্ছে না।
গায়ে ওড়না জড়িয়ে রুম ছেড়ে বের হলো।দম বন্ধ লাগছে ,তাই আর দেরি করলো না । সিঁড়ি বেয়ে সোজা ছাদে উঠে গেলো। ছাদের দরজা হাট করে খুলে রাখা দেখে কিছুটা অবাক হলেও ব্যাপারটাকে বেশি ঘাটালো না। পশ্চিম পাশে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে গভীর নিঃশ্বাস ফেলল। বাইরে অন্ধকার কেটে গেছে। মৃদু বাতাস বইছে ,সেই বাতাসে শীতের আভাস। গায়ে পেঁচিয়ে রাখা ওড়নাটাকে আরেকটু জড়িয়ে নিলো। সময় আর জায়গাটাকে তৃধা একান্ত নিজের মনে করলেও সে একা নেই। এই সময়টার ভাগীদার আরো একজন আছে। জায়গাটাতে আরো একজন বিরাজমান। তৃধা ফিকরে কেঁদে উঠতেই ছায়ামানবটা স্পষ্ট হলো। তৃধা থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়ালো নুসাইব। রেলিংএ হাত রেখে মাথা কাত করে তৃধার মুখের দিকে চাইলো।

চলবে,,

(ভুল গুলো শুধরে দিবেন।)