আমি এক ভাগ্যবতী পর্ব-০১

0
2

#আমি_এক_ভাগ্যবতী (১)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি

মাঝরাতে মিলাকে ঘর থেকে বের হয়ে যেতে বলে শাওন। ঘন্টা দুয়েক ধরে তাদের মাঝে তুমুল ঝগড়া চলছে। কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে শাওন বলে,“আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যা। এই মূহুর্তে তুই আমার ঘর থেকে বের হবি। আমি তোর মুখও দেখতে চাই না।”

“শাওন!”
মিলা ভীষণ অবাক হয়ে শাওনের দিকে তাকিয়ে থাকে। শাওনের এসবে কোন ভাবান্তর দেখা গেল না। সে খুব স্বাভাবিকভাবেই বললো,“আমি তোর মতো বন্ধ্যা মেয়ের সাথে আর এক মূহুর্ত থাকতে চাই না। তুই এখনই আমার ঘর থেকে বের হয়ে যাবি।”

”তুমি এভাবে আমাকে ঘর থেকে বের করে দিতে পারো না শাওন।”
মিলা নিজেকে সামলে কথাটি বলে। শাওন জবাবে কঠিন গলায় বলে,“পারি। একশোবার পারি। এটা আমার বাড়ি। এই ফ্লাট আমার বাবা আমার জন্য কিনেছে তোর বাবা দিয়ে যায়নি। তাই আমি ঠিক করবো, এখানে কে থাকবে আর কে থাকবে না।”

“বাহ। পাঁচ বছর ধরে একটু একটু করে সংসারটা আমি গোছালাম আর এখন বাড়িটা তোমার হয়ে গেল। তোমার বাড়ি হওয়ায় আমাকে এখান থেকে বের করে দিতে একবার ভাবছোও না?”

“ভাবার কি আছে। তোরে আমার ভালো লাগে না। আমি তোর সাথে থাকবো না। যে স্ত্রী আমাকে সন্তান দিতে পারে না, রাত-দিন আমার সাথে ঝগড়া করে। আমার শান্তি নষ্ট করেছে, তার সাথে আমি সারাজীবন কাটাতে পারবো না। তার স্থান আমার বাড়িতে হবে না, এটাই তো স্বাভাবিক।”
মিলা এসব কথার প্রতিবাদ করতে গেলে শাওন তাকে অনেক তিক্ত ভাষায় অপমান করে। শাওনের প্রতিটা শব্দ, প্রতিটা বাক্য মিলাকে প্রতি সেকেন্ডে বুঝিয়ে দিচ্ছে, সে একজন মেয়ে। তার নিজের বলতে কোন বাড়ি নেই। তার কোন বাড়ি নেই বলেই আজ খুব সহজেই তার স্বামী তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিতে পারছে। শাওন মিলাকে এক প্রকার ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বের করে। মিলা তাকে এটা করতে বারণ করে। অনুরোধ করে বলে,“এই মধ্যরাতে তুমি আমাকে বের করে দিলে আমার কী হবে? এখন আমি কোথায় যাবো? প্লীজ বোঝার চেষ্টা করো শাওন।”

“আমি কিছু বুঝতে চাই না। আমার ঘরে তোর কোন স্থান হবে না। আমি হাঁপিয়ে গিয়েছি তোর সাথে এই অসুস্থ সম্পর্কটা টেনে নিয়ে যেতে। আমি কোথাও যেতে পারি না, সবার এক কথা সুখবর কবে দিবি? তোর স্ত্রীর কি সমস্যা? এসব শুনতে শুনতে আমি ক্লান্ত হয়ে গিয়েছি। আমি আর তোর সাথে থাকতে পারবো না।”
কথাগুলো বলে শাওন মিলার কোন কথা না ভেবে তাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। এই মাঝরাতে মিলার স্থান কোথায় হবে, মিলা কিভাবে রাত পার করবে এই কথাগুলো না ভেবে শাওন নিষ্ঠুরের মতো তাকে বের করে দেয়। মিলাকে ঘর থেকে বের করে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দেয় শাওন। মিলা দরজার এপাশে বসে কান্নায় ভেঙে পড়ে। পাঁচ বছর ধরে একটু একটু করে যে বাড়িটা সে সাজিয়েছে। সে সংসার সে গড়েছে আজ সেখানেই তার জায়গা হচ্ছে না। বাড়ি বলতে এটা একটি ফ্লাট। এই ফ্লাটের মালিক শাওনের বাবা। সেই সূত্রে শাওন। বিয়ের পর শাওন এবং মিলা এই ফ্লাটেই নিজেদের ছোট্ট, সুন্দর সংসার গড়ে তোলে। মিলা তার বিবাহিত জীবনের প্রথম বছরের কথাগুলো ভাবে। সেই বছরই ছিলো তার জীবনে সবচেয়ে সুখের। শাওন এবং মিলার খুব সুন্দর সুন্দর মূহুর্তের সাক্ষী সেই বছর। মিলা সেই সময়ে নিজেকে সবার চেয়ে সুখী ভাবতো। কিন্তু তার সুখ বেশিদিন টেকেনি। এরপর থেকেই বাচ্চা না হওয়া নিয়ে তাদের সম্পর্কে দূরত্ব তৈরি হয়, যা ধীরে ধীরে তিক্ততায় রূপ। দরজার এপাশে বসে মিলা এসব ভাবছিলো আর কান্না করছিলো। মিলার মনে হচ্ছিলো, এই বুঝি শাওন সব ভুলে দরজা খুলে তাকে ভেতরে নিবে। কিন্তু না। তেমন কিছুই হয় না। কিছুটা সময় পর দরজা খোলার শব্দ পেয়ে মিলা খুব খুশি হয়। তার কান্নারত মুখে হাসি ফুটে উঠে। সে খুশি হয়ে বলে,“শাওন।”

মূহুর্তের মাঝে মিলার খুশি বিলীন হয়ে যায়। সে ভেবেছিলো শাওন দরজা খুলে তাকে নিতে এসেছে। কিন্তু না। তাদের ফ্লাটের দরজা খোলেনি, খুলেছে পাশের ফ্লাটের দরজা। যেখানে এক বৃদ্ধ মহিলা থাকেন। তিনি দরজা খুলে বের হয়েছেন। মিলা তাকে দেখে চোখের পানি মোছার চেষ্টা করে। এটা দেখে বৃদ্ধা মুচকি হাসে। অতঃপর শান্ত গলায় বলে,“তুমি রাতটা আমার ঘরে পার করতে পারো।”

মিলা প্রথমে সংকোচ বোধ করলেও বৃদ্ধার বারবার বলায় তার সাথে তার ফ্লাটে যায়। তাছাড়া প্রতিবেশী হিসাবে বৃদ্ধাকে কম বেশি মিলার জানা। তাই তার সাথে তার ফ্লাটে রাতটা পার করার চিন্তা করলো। এত রাতে সে অন্যকোথাও বা কিভাবে যাবে? তাই সবকিছু বিবেচনা করে কিছুটা সংকোচ নিয়ে বৃদ্ধার ঘরের দিকে এগোয় মিলা। তবে সেই ঘরে প্রবেশ করার আগেও সে নিজেদের ফ্লাটের দরজার দিকে তাকায়। এটা দেখে বৃদ্ধা বলে,”মনের মধ্যে এত আশা জাগিও না যে একটা সময় তোমার আশা তোমার গলার কাটা হয়ে গলায় বিধে যায়।”
বৃদ্ধার কথার ভাবার্থ বুঝতে পেরে মিলা কান্নায় ভেঙে পড়ে। বৃদ্ধা মহিলা তাকে নিয়ে ঘরের মধ্যে বসায়। এক গ্লাস পানি ঢেলে সেটা মিলার হাতে দেয়। মিলা পানি খেয়ে আফসোস করে বলে,“কী নেই আমার? রূপ, যৌবন সবই তো আছে। আপনি জানেন আমাদের গ্রামের আমি দশজন সুন্দরীর মাঝে একজন। আমাকে বিয়ে করার জন্য গ্রামের সব ছেলে পাগল ছিলো। আর সেই আমি কি-না পোড়া কপালি হলাম।”
একটু থেমে মিলা আবারও বলে,“একটা বাচ্চার জন্য ও রোজ আমার সাথে ঝগড়া করে। আরে বাচ্চা হওয়া না হওয়া কী আমার হাতে? এই সামান্য কথাটুকু বুঝতে চায় না। এই দুনিয়ায় মেয়ে হয়ে জন্মানোটাই বোধহয় পাপ। তাই তো মেয়েদের সারাজীবন অন্যের ঘরের দাসী হয়ে কাটাতে হয়। বাবার বাড়ি, শ্বশুড় বাড়ি, ভাইয়ের বাড়ি, স্বামীর বাড়ি যেই বাড়িগুলোর কোথাও মেয়েদের নিজের অস্তিত্ব নেই। বাড়িগুলো তাদের নয়। মেয়ে হয়ে জন্মালাম বলেই আজ মেয়েদের নিজের কোন বাড়ি নেই শুনতে হয়। একটা পরের বাড়িকে এত যত্ন ভালোবাসা দিয়ে সাজানোর পরও শুনতে হয় ঐ বাড়িতে তোমার কোন অধিকার নাই। এই নারী সত্তাটাকে আমি ঘৃণা করি। এত রূপবতী হয়ে লাভ কি হলো? সবসময় সবাই বলতো, তুই যা রূপবতী দেখবি তোর স্বামী তোকে সারাজীবন সোহাগ করবে। মাথায় তুলে নাচবে। কিন্তু কই?”

“মেয়েদের রূপবতী হওয়ার চেয়ে ভাগ্যবতী হওয়া জরুরি।”
বৃদ্ধার এই কথাটি শুনে মিলা থমকে যায়। বৃদ্ধা একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,“বাচ্চা না হওয়ার যন্ত্রণা আমি বুঝি। তোমাদের মাঝে যে রোজ রাতে তর্ক যায় সেটা মাঝে মাঝেই আমি টের পাই। এক্ষেত্রে সত্যি তোমার কোন দোষ নেই। কিন্তু কি করার। যুগ বদলাচ্ছে, সময়ের সাথে সব উন্নত হচ্ছে কিন্তু মানুষের মানসিকতার পরিবর্তন হচ্ছে না। চিরচেনা সেই একই বাক্য সবাইকে শুনতে হয়, যাই ভুল হোক সব দোষ নারীর। তবে এসবের মাঝেও কিছু মানুষ থাকে, কিছু পুরুষ থাকে যারা নারীকে বুঝে। সমস্যা বুঝে, ভালোবাসা বুঝে। যারা জানে কিভাবে তার শখের নারীকে যত্ন করতে হয়। একজনকে ভালোবেসে তার সাথে কিভাবে সারাজীবন কাটিয়ে দেওয়া যায়। আর এই পুরুষগুলোকে যারা পায় তারাই ভাগ্যবতী।”

“আদো এমন কোন পুরুষ আছে? আমার মতো রূপবতী একজনকে কাছে পেয়েও আমার স্বামী আমার মূল্য দিতে পারলো না। আমার রূপ তাকে আমার প্রতি মুগ্ধ করে রাখতে পারলো না। সেখানে একজন পুরুষ যে একজনকে ভালোবেসে সারাজীবন কাটাতে পারে এই কথাটি আমার কাছে অবিশ্বাসযোগ্য।”
মিলার এই কথায় বৃদ্ধা ম্লান হাসে। তার হাসি দেখে মিলা বলে,”আদো আপনি এমন কোন ভাগ্যবতী নারীকে দেখেছেন, যে সন্তান জন্ম দিতে অক্ষম জেনেও তার স্বামী তাকে ভালোবেসে তার সাথে সারাজীবন সুখে ছিলো।”

“দেখেছি।”
বৃদ্ধার এই কথায় মিলা অনেকটা অবাক হয়। সে বিশ্বাস করতে পারে না। আসলে শাওন তার সাথে একটি বাচ্চার জন্য এত ঝামেলা করেছে যে সে মানতেই পারছে না, কোন বন্ধ্যা মেয়ের সাথে কোন পুরুষ সারাজীবন কাটাতে পারে। বিষয়টি বুঝতে পেরে বৃদ্ধা মুচকি হেসে বলে,“তুমিও তেমন এক ভাগ্যবতী নারীকে দেখেছো।”

মিলা ভীষণ বিষ্মিত হয়। সে অবাক চোখে বৃদ্ধার দিকে তাকালে বৃদ্ধা মাথা নাড়ায়। তারপর বলে,“আমি এক ভাগ্যবতী।”


চলবে,