#আমি_এক_ভাগ্যবতী (শেষ)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি
মধুবালা মুখে হাসি ধরে রেখে বলে,“আমার কাছেও একটি সন্তান অনেক বড়কিছু। কিন্তু ভাগ্যের উপর কারো হাত নেই। আমার সন্তান সুখ লাভ করার ভাগ্য ছিলো না, তাই সন্তান হয়নি।নিঃসন্তান হওয়ার মতো হতভাগী হয়েও আমি আজ বিনা সংকোচে বলতে পারি আমি এক ভাগ্যবতী, কেন জানো? তার কারণ আমার স্বামী। যে আমাকে আমার অপূর্ণতার সাথেই ভালোবেসেছে। ভাগ্যকে মেনে নিয়ে নিঃসন্তান আমরা আমাদের সুখ আমাদের মাঝে খুঁজে নিয়েছি।”
একটু থেমে মধুবালা আবারও বলে,“সন্তান হয় না বলে স্ত্রীকে ঘর থেকে বের করে দেওয়া কোন পুরুষত্ব হতে পারে না। পুরুষের পুরুষত্ব প্রমাণ পায় তার ব্যক্তিত্বে, তার নিষ্ঠায়, তার কর্মে। যে পুরুষের স্ত্রী তার চোখে চোখ রেখে বলতে পারে, আমি সুখে আছি। সেই পুরুষই পুরুষত্বের দৌঁড়ে এগিয়ে থাকবে।”
“আপনি আমার পুরুষত্ব নিয়ে কথা বলছেন?”
শাওন রাগান্বিত গলায় কথাটি বলে। শাওনের কথা শুনে মধুবালা মাথা নাড়ায়। সে মাথা নাড়িয়ে বলে,“হ্যাঁ। কারণ তুমি তাই। একটা কথা মনে রেখো, সন্তান না হওয়া কিন্তু শুধুমাত্র মেয়েরা বন্ধ্যা হলেই হয় না। আরও অনেক কারণ আছে। দোষটা তোমারও থাকতে পারে।”
মধুবালার এই কথায় শাওন চুপ হয়ে যায়। মধুবালা তাকে নানাভাবে বোঝায়। শাওনের উচিত তার স্ত্রীকে বোঝা, তার সাথে দুঃখের নয় সুখের স্মৃতি গড়া। সন্তানের জন্য অপেক্ষা করে। সব কথা শুনে শাওন মিলার উদ্দেশ্য বলে,“মিলা ঘরে চলো। এতরাতে তুমি কোথায় যাবে এটা ভেবে আমি তোমাকে নিতে আসছি। এখন দেখি থাকার ব্যবস্থাও করে ফেলছো। যাই হোক এবার ঘরে চলো।”
“ঘর? কোন ঘর? যে ঘরে আমার কোন অস্তিত্ব নেই। যেখান থেকে যখন খুশি তখন আমাকে বের করে দেওয়া যায়। সেটাকে ঘর বলছো?”
মিলার এই কথায় শাওন তার কাছে ক্ষমা চায়। সে বলে,”রাগের মাথায় ভুল করে ফেলেছি। স্যরি মিলা। এবার ঘরে চলো। রাগ করো না প্লীজ।”
“স্যরি। যে ঘর আমার নয় সেখানে আমি যেতে পারবো না। এই মাঝরাতে আমি কোথায় যাবো এই কথাটি তুমি একবারও না ভেবে আমাকে ঘর থেকে বের করে দিলে। আর এখন এসেছো ক্ষমা চাওয়ার নাটক করতে। তা তো হবে না।”
এই কথা বলে মিলা মুখ ঘুরিয়ে নেয়। শাওন তাকে ঘরে যাওয়ার জন্য জোর করে। এক পর্যায়ে বলে,“তুমি এত জেদ কাকে দেখাচ্ছো? সেই তো আমার ঘরেই ফিরতে হবে।”
“এত অহংকার ভালো না বাবা। তুমি ভুল করেছো কোথায় নরম হবে তা না করে রাগ করে উল্টাপাল্টা কথা বলছো?”
মধুবালার এই কথায় শাওন কিছুটা কঠিন গলায় বলে,“এটা আমাদের স্বামী, স্ত্রীর বিষয় আপনি মাঝে না ঢুকলেই হয়।”
“গলা নামিয়ে কথা বলো না শাওন। এটা ওনার ঘর। এখানে তুমি এভাবে কথা বলতে পারো না। এই অধিকারও তোমার নেই।”
এই কথা বলে শাওনকে এবার মিলা এই ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে বলে। শাওন বারবার ক্ষমা চায় কিন্তু মিলা তার কথা শোনে না। এক পর্যায়ে শাওন রাগ করে নিজেদের ঘরে চলে যায়। শাওন চলে গেলে মিলা কান্নায় ভেঙে পড়ে। মধুবালা তাকে বুকে জড়িয়ে নেয়। মিলা কান্নারত অবস্থায় বললো,“আমি ঠিক করছি তো?”
“হ্যাঁ। তোমার স্বামীর অনেক পরিবর্তন দরকার। সেই পরিবর্তন করে যদি সে তোমার কাছে আসে তখনই তোমার তাকে গ্রহণ করা উচিত। একটা কথা মনে রেখো, ভালোবাসার জন্য সব করা যায় ঠিকই কিন্তু আত্মসম্মান কোন অবস্থাতেই বিসর্জন দেওয়া উচিত নয়।”
মধুবালার এই কথা মিলা কিছুটা ভরসা পায়। শাওন তার সাথে যা করেছে তারপর মিলার কাজটা তো ঠিকই। মিলা শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করে,“আবার ও আসলে আমার কী করা উচিত?”
“বললাম না। তার পরিবর্তন দরকার। সে পরিবর্তন হয়ে আসুক তারপর গ্রহণ করো। তবে যদি দেখো সে পরিবর্তন হচ্ছে না তখন বুঝে নিও এই ঘরে তুমি কখনো ভাগ্যবতী হতে পারবে না। আর হ্যাঁ ভাগ্যবতী হতে রূপ গুন কিছুই লাগে না। শুধু লাগে নিজেকে ভাগ্যবতী অনুভব করানো এক মানুষ।”
সেই রাতে মিলা মধুবালার সাথে কাটিয়ে দেয়। সকালে উঠে মিলা তার বাবার বাড়ি চলে যায়। মধুবালা তাকে জীবন সম্পর্কে অনেককিছু বোঝায়। সন্তান নিয়ে আফসোস করতে বারণ করে। মিলা সব কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে বাবার বাড়ির উদ্দেশ্য বেরিয়ে পড়ে। মিলা বেরিয়ে যাওয়ার ঘন্টা খানেক পর শাওন আসে মিলার খোঁজে। মধুবালা শান্ত গলায় বলে,“চলে গেছে। এটা আমার বাড়ি, এখানে নিশ্চয় সে সবসময় থাকবে না।”
শাওন হতাশ হয়ে নিজের ফ্লাটের দিকে পা বাড়ায়। মধুবালা তাকে পিছু ডাকে। শাওন ঘুরলে মধুবালা শান্ত গলায় বলে,“আমার সাথে বসে এক কাপ চা খাবে?”
“এখন চা খাওয়ার মুডে নাই আমি আন্টি।”
শাওন বিরক্তি নিয়ে কথাগুলো বলে। মধুবালা তাকে অনুরোধ করে বলে,“প্লীজ এক কাপ খাও। দেখবে তোমার মুড ঠিক হয়ে যাবে।”
অতঃপর শাওন রাজি হয়। সে মধুবালার ঘরে আসে। মধুবালা দু’জনের জন্য চা বানিয়ে নিয়ে আসে। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে মধুবালা বলে,“শুধুমাত্র সন্তানই কি তোমাদের ঝামেলার কারণ নাকি ভেতরে অন্যকিছু আছে?”
“অন্যকিছু বলতে?”
শাওন বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করে। মধুবালার শান্ত গলায় বলে,“তোমাকে কিছু বলতে হবে না। দুই মিনিট আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনো। পুরুষ মানুষের রোজ রাতে এসে বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া করার একটা কারণ হতে পারে সেই পুরুষ মানুষের জীবনে অন্য কারো আগমন ঘটেছে। এজন্য বউকে আর ভালো লাগে না। তোমার জীবনে যদি অন্য কেউ না থাকে, শুধুমাত্র সন্তানই এই ঝগড়ার কারণ। তাহলে আমি বলবো তুমি মিলার সাথে কিছুটা দূরত্ব বঝায় রাখো। দূরত্ব সবসময় সম্পর্কের অবনতির কাজ করে না। কিছু সময় সম্পর্ক ঠিকও করে। তার সাথে দূরে থাকলে হয়তো তোমরা দুজনেই তোমাদের শূন্যতা অনুভব করতে পারবে। তোমাদের স্মৃতিতে তোমার ভালো সময় গুলো ভেসে উঠবে।
তর্ক করলে তর্ক পারে। এতে তিক্ততা বাড়ে বয়ই কমে না। সেজন্য তোমাকে আগে ভাবতে হবে তুমি কি চাও? তুমি তার সাথে সারাজীবন কাটাতে চাও কি-না। যদি চাও তবে একটু পরিবর্তন হও। নিজের স্ত্রীকে ভালোবাসলে কেউ ছোট হয়ে যায়। লোকের কথা ভাবা বাদ দিয়ে স্ত্রীর সাথে একটু নির্লজ্জ হলে মান যায় না। আর রইলো সন্তান, তোমাদের জীবনের অনেকটা পড়ে আছে। যেহেতু মিলার সমস্যা নাই সেহেতু যেকোন সময় সন্তান হতে পারে। সেই সঠিক সময়ের অপেক্ষা করো। সৃষ্টিকর্তার কাছে চাও। দেওয়ার মালিক তিনি। এই যে সমাজের লোক যারা সন্তান সন্তান নিয়ে কথা শোনায়, তারা দেওয়ার মালিক নয়। তাই তাদের কথায় কান না দিয়ে নিজের মন যা চায় তাই করো। তোমার মন কি তোমার স্ত্রীর সাথে তর্ক করতে চায়? সেটা যদি না চায় তাহলে নিজেকে বদলাও। লোকের কথা বাদ দিয়ে নিজের মনের কথা শোনো। নিজেদের কথা ভাবো। নিজেদের সুন্দর ভবিষ্যতের কথা ভাবো।”
শাওন মধুবালার কথা প্রথমে গুরুত্ব দিয়ে না শুনলেও পরবর্তীতে শোনে। সে সব শুনে ঘরে চলে যায়। ঘরে এসে শাওন একটা গোটা দিন এসব নিয়েই ভাবে। যখন সে মিলার সাথে কাটানো তার সুন্দর মূহুর্তগুলোর কথা ভাবে তখনই তার মুখে হাসি ফুটে উঠে। শাওন নিজের ভুলগুলো এখন খুব ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারে।
অন্যদিকে মিলাও শাওনের থেকে দূরে গিয়ে তার শূন্যতা অনুভব করছে। সে শাওনকে প্রচুর ভালোবাসে। কিন্তু যখনই শাওনের তিক্ত কথাগুলো নিয়ে ভাবে তখনই তার মনটা বিষন্ন হয়ে যায়। এভাবে দুজন দুদিকে বসে দুজনার কথা ভাবে।
শাওন পরবর্তী দিন আবার মধুবালার সাথে চা খেতে বসে। সেখানে বসে শাওন সরাসরি মধুবালাকে বলে,“আমি আমার ভুলগুলো শুধরাতে কি করতে পারি?”
মধুবালা খুব সুন্দরভাবে শাওনকে বোঝায়। শাওন সেদিনই মিলাকে নিয়ে আসতে যায়। তার পায়ে ধরে ক্ষমা চায়। কিন্তু মিলা ক্ষমা করে না। এতে শাওন হতাশ হয় না। কারণ সে জানতো এত সহজে মিলা তাকে ক্ষমা করবে না। পরবর্তীতে এসব ঘটনা মধুবালাকে বলে তার পরের পদক্ষেপ সম্পর্ক জানে। এক কথায় শাওন মধুবালার থেকে নিজেকে একজন ভালো মানুষ, বলা যায় মধুবালার স্বামীর মতো চরিত্রের মানুষ কিভাবে হওয়া যায় তাই শিখছে। সেও চায় তার বউ তার চোখে চোখ রেখে বলুক, সে এই পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবতী নারী। এভাবে চলতে থাকে দিন। পুরো এক মাস শাওন মিলার বাড়িতে রোজ গিয়ে ক্ষমা চায়। তার সাথে ভালো আচরণ করে। নিজের পরিবর্তন তাকে বোঝানোর চেষ্টা করে। অবশেষে মিলা রাগ কমিয়ে শাওনের সাথে আসতে রাজি হয়। জীবনে দ্বিতীয় সুযোগ সবাই ডিজার্ভ করে। তাছাড়া শাওন সত্যি নিজেকে পরিবর্তন করছে, শাওনের মাঝে একজন ভালো মানুষ আছে বলেই সে নিজের এই পরিবর্তন করতে সক্ষম হচ্ছে। যতই মধুবালা বা যেকেউ তাকে বোঝাক না কেন সে যদি না চাইতো তাহলে কখনোই তাকে পরিবর্তন করা সম্ভব হতো না। এসব দিক ভেবে মিলা একটা সময় শাওনকে ক্ষমা করে দাও। তবে সেটা সেই সময়ে যখন সে উপলব্ধি করতে পারে শাওন তাকে খুব ভালোবাসে।
এসবের মাঝে শাওনের সাথে মধুবালার ভালো বন্ধুত্ব হয়ে যায়। শাওন এবং মিলাকে পেয়েও মধুবালার একটু হলেও সন্তানের অভাব দূর হয়। একটা সময় পর, তাদের সম্পর্ক এমন হয়ে গিয়েছে যে তারা প্রায়ই সময় এক বাসায় থাকে। এভাবে কেটে যায় আরও তিন বছর। এই তিন বছরে শাওন নিজেকে অনেক পরিবর্তন করেছে সে কখনো মিলাকে কষ্ট দেয়নি। অতঃপর তাদের সুখের সংসারে আর একটু সুখের ছোঁয়া দিতে মিলা গর্ভবতী হয়। সেদিন শাওন এবং মধুবালা খুব খুশি হয়েছিলো। মধুবালা এদের সাথে এমনভাবে মিশে গেছে যে তার মনে হচ্ছে তার নাতি/নাতনি আসতে চলেছে। এমনই ভাব। এভাবেই হাসি-খুশিতে তিনটা মানুষের জীবন কাটতে শুরু করে। এখন প্রায় সময় মিলা নিজের পেটে হাত রেখে মধুবালাকে বলে,“আমিও এক ভাগ্যবতী।”
মধুবালা মুচকি হাসে। সন্তান গর্ভে থাকাকালীন শাওন মিলার অনেক যত্ন নিয়েছে। তার এসব কর্মকান্ড মিলার সঙ্গে মধুবালাকেও মুগ্ধ করেছে। শাওন এবং মিলার এই সুখের দাম্পত্য দেখে মধুবালা চোখের কোনে অদ্ভুত এক সুখের পানি চলে আসে। এ এক অন্যরকম আনন্দ। মধুবালা নিজের এবং মাজেদের পুরনো স্মৃতিগুলো ভাবতে ভাবতে মনেমনে বলে,“আমি চাই পৃথিবীর সকল মেয়ে তোমার মতো স্বামী পাক।যাতে তারা সবাই গর্বের সাথে বলতে পারে আমি ভাগ্যবতী। সৃষ্টিকর্তার কাছে এটাই চাওয়া, মেয়েদের রূপ গুন দাও বা না দাও তাদের ভাগ্যটা সুন্দর করো। তাদের ভাগ্যবতী বানিয়ে দাও। তাহলে হয়তো কোন মেয়েকে আড়ালে আবডালে চোখের পানি বিসর্জন দিতে হবে না। পৃথিবীর সকল মেয়েকে আমি এক ভাগ্যবতী বলার সুযোগ দাও।”
মধুবালা নিজের এক জীবনে দুঃখ, সুখ সবটাই পেয়েছে। তবে তার দুঃখের চেয়ে সুখের পরিমান ব্যপ্তি অনেক বেশি ছিলো। তাই তো নিঃসন্তান হয়েও নিজেকে সে গর্বের সাথে ভাগ্যবতী বলতে পারে। তবে মনের কোনে কোথাও হয়তো সন্তান না হওয়ার যন্ত্রণা রয়ে গেছে। কিন্তু মাজেদের স্মৃতি এত সুন্দর সুখের যে সেই যন্ত্রণা মনের ভেতর খত করার সুযোগই পায় না। এমন এক ভাগ্য সবার হোক। যেখানে অপূর্ণতাও হার মানবে ভালোবাসার কাছে।
(সমাপ্ত)