আমি তোমার দ্বিধায় বাঁচি পর্ব-০১

0
124

#আমি_তোমার_দ্বিধায়_বাঁচি
#Part_1
#ইয়াসমিন_খন্দকার

নিজের হবু স্বামী হিসেবে মেট্রিক পরীক্ষায় কর্তব্যরত মেজিস্ট্রেটকে দেখে হতবাক হয়ে গেল ঈশিতা। নিজের বাবার দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল,”যেই লোকটা আমায় এক্সপেল করে দিল এখন আমায় কিনা তাকেই বিয়ে করতে হবে?”

ঈশিতার বাবা ইসমাইল হোসেন মেয়ের কথায় তেমন পাত্তা দিলো। তিনি তো ব্যস্ত তার বাড়িতে আসা অতিথিদের আপ্যায়ন করার জন্য। ঈশিতা ব্যাপারটা বুঝতে পেরে দমে গেল। তার ভীষণ কান্না পাচ্ছে এখন। ঈশিতা নিজের চোখের জল মুছে আড়চোখে তাকালো তার সম্মুখে বসে থাকা ২৮ বছর বয়সী সুদর্শন পুরুষটির দিকে। চোখে থাকা চশমা যাকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। এখন এই লোকটাকে কতটা ভদ্র,নম্র লাগছে। অথচ এই লোকটাই অবিবেচকের মতো ঈশিতার ভবিষ্যতটা নষ্ট করে দিলো। বিনা দোষেও কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হলো বেচারি মেয়েটা।

ঈশিতা যে তার দিকে তাকাচ্ছে এটা নজরে এলো আয়ুশেরও। আয়ুশ জানে এই মেয়েটার কাছে সে অনেক বড় অপরাধী। শুধুমাত্র তার নেওয়া একটা ভুল সিদ্ধান্তের জন্য এই মেয়েটার জীবনে আজ ঝড় নেম এসেছে। তাই তো মেয়েটাকে একপ্রকার বাঁচানোর জন্যই আজ সে নিরুপায় হয়ে নিজের পরিবারকে নিয়ে এই হাটুর বয়সী মেয়েকে বিয়ে করতে এসেছে৷

ঈশিতা ভীষণ হাসফাস করছিল৷ আয়ুশও বুঝতে পারে তার ঈশিতার সাথে কথা বলা দরকার। তাই আয়ুশ সবার কথার মাঝখানে নম্র গলায় বলে উঠল,”আমি ঈশিতার সাথে আলাদা ভাবে কথা বলতে চাই। যদি আপনাদের কোন আপত্তি না থাকে।”

কথাটা ইসমাইল হোসেনের দিকে তাকিয়ে বললো আয়ুশ। ইসমাইল হোসেন সামান্য হেসে বললেন,”কেন নয়? ঈশিতা তুমি ওনাকে ছাদে নিয়ে যাও। সেখানে গিয়ে তোমরা নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলো। বাকি জীবনটা তো তোমাদের একসাথে থাকতে হবে। তাই তোমাদের মধ্যে বোঝাপড়াটার তো দরকার।”

ঈশিতা নিজের বাবার কথার বিরোধিতা করল না। বাধ্য মেয়ের মতো বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। আয়ুশের দিকে একপলক তাকিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। অতঃপর ছাদের দিকে পা বাড়ালো। আয়ুশও ঈশিতার পিছন পিছন যেতে লাগল। ঈশিতা ছাদে পৌঁছে গিয়ে থেমে গেল। আয়ুশ তার পেছনেই দাঁড়িয়ে। ঈশিতা এবার আয়ুশের চোখে চোখ রেখে বলল,”বলুন কি বলতে চান।”

আয়ুশ বুকের উপর দুহাত ভাজ করে দাঁড়ালো। নিজের চশমায় ডান হাতের তর্জনী আঙুল ছোঁয়ালো স্বভাবগত কারণে। অতঃপর জোরে শ্বাস নিয়ে বললো,”আমি তোমার কথা ভেবেই এমন একটা সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছি। তাই তুমি আর বেশি কথা না বাড়িয়ে বিয়েটায় মত দিয়ে দাও।”

ঈশিতা হঠাৎ করে হো হো করে হেসে উঠল। যেন খুব মজা পেয়েছে তার কথাটা শুনে। কোনরকমে হাসি থামিয়ে বলল,”খুব মজা পেলাম আপনার কথা শুনে মিস্টার আয়ুশ। আমার জীবনটা নষ্ট করে এখন আপনি এসেছেন আমায় বাঁচাতে। হাস্যকর!”

আয়ুশ নিশ্চুপ। জীবনে কখনো সে কারো কাছে এভাবে অপরাধী হয়নি যেমনটা ঈশিতার কাছে হয়েছে। ঈশিতা অনেক মেধাবী একজন ছাত্রী। যার ইচ্ছা ছিল পড়াশোনা করে ডাক্তার হওয়া। ঈশিতার বাবা গ্রামের বনেদী লোক। তার চিন্তা-ভাবনা উন্নত নয়। তিনি মেয়েকে এতদূর পড়াতে চান নি। ঈশিতা নিজের মায়ের সমর্থনেই এতদূর পড়াশোনা করছিল। ঈশিতার মা হুসনে আরা নিজের বাপের বাড়ি থেকে পাওয়া সম্পদ দিয়েই ঈশিতার পড়াশোনার খরচ চালিয়েছেন। তিনি নিজে এক মূর্খ-সুক্ষ মহিলা হলেও নিজের মেয়েকে সুশিক্ষিত দেখতে চেয়েছেন৷ কিন্তু ভাগ্যে অন্য কিছু ছিল। ঈশিতার ইংরেজি পরীক্ষার দিন তার পাশে বসে থাকা একটা মেয়ে অসৎ উপায় অবলম্বন করছিল। সে নকল করছিল। আয়ুশ সেদিন ঐ মেয়েটাকে পাকড়াও করে। তবে মেয়েটি শুধু নিজেই ফাঁসে না ঈশিতাকেও ফাঁসিয়ে দেয়। সব দোষ ঈশিতার কাঁধে দেওয়ার জন্য সে আগে থেকে ঈশিতার সিটের কাছে কয়েকটা পেপার রেখে দিয়েছিল। ঈশিতা লেখায় এত ব্যস্ত ছিল যে খেয়াল করে নি। ফলে যা হবার তাই হয়েছে। ঈশিতাকে এক্সপেল করে দেয় আয়ুশ। সেদিন ঈশিতা অনেক বার বলেছিল তাকে ফাঁসানো হচ্ছে। সে নকল করে নি। কিন্তু আয়ুশ তার কোন কথায় বিশ্বাস করে না। এই ঘটনাই ঈশিতার পুরো জীবন বদলে দেয়৷ তার সব সাজানো স্বপ্ন শেষ হয়ে যায়। ক্লাস এইটে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পাওয়া মেয়েটি যে ক্লাসে সবসময় প্রথম হতো তাকে কিনা নকল করার অপরাধে এক্সপেল করা হলো। কেউই এটা মানতে পারছিল না। ঈশিতার মা হুসনে আরা মেনে নিতে পারেন নি এটা। যেই মেয়েকে নিয়ে অহংকার করতেন, যাকে নিয়ে এত স্বপ্ন দেখেছিলেন সেসব শেষ হয়ে যায়। ইসমাইল হোসেনও এই সুযোগ পেয়ে তাকে অনেক কথা শোনায়। হুসনে আরা মেয়ের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেন। এর কিছুদিন পরেই তিনি হার্ট অ্যাটাক করে মারা যান। ঈশিতার জীবনে ঝড় যেন থামেই না। হুসনে আরার মৃত্যুর পর ইসমাইল হোসেন আরো সুযোগ পেয়ে যান। তিনি এই সুযোগে ঈশিতার সাথে একজন বয়স্ক লোকের বিয়ে ঠিক করেন। বলা বাহুল্য, সেই বয়স্ক লোক ইসমাইল হোসেনকে অনেক টাকার প্রলোভন দেখান।

এরমধ্যে যেই মেয়েটি ঈশিতাকে ফাঁসিয়েছিল সে অপরাধবোধে ভুগতে থাকে। ঈশিতার বর্তমান পরিস্থিতি জেনে সে দ্রুত আয়ুশের ঠিকানা জোগাড় করে তার সাথে যোগাযোগ করে। আয়ুশের সামনে নিজের সব দোষ স্বীকার করে এবং জানায় ঈশিতা নির্দোষ। ঈশিতার সাথে ঘটে যাওয়া সব ঘটনাও সে জানায় আয়ুশকে।

এসব শুনে আয়ুশ ভীষণ অপরাধবোধ অনুভব করে। তার একটা ভুল সিদ্ধান্তের জন্য আজ এত মেধাবী একটা মেয়ের জীবনে এত দূর্ভোগ নামতে চলেছে সেটা সে মেনে নিতে পারে নি।

আয়ুশ এটা আটকানোর জন্য প্রথমে পুলিশের সাহায্য নেয়ার কথা ভাবে। আয়ুশ ভেবেছিল ঈশিতাকে বাল্যবিবাহ দেওয়া হচ্ছে এটা দেখিয়ে বিয়ে বন্ধ করা যাবে। কিন্তু ইসমাইল হোসেন এইজন্য আগে থেকেই চাল চেলে রেখেছিলেন। তিনি ঈশিতার জন্ম নিবন্ধনে আগে থেকেই কারসাজি করে বয়স বাড়িয়ে রেখেছিলেন। যার ফলে ঈশিতার বয়স বর্তমানে ১৮(জন্ম নিবন্ধন অনুসারে) তাই বিয়েতে আইনত কোন বাঁধা থাকে না।

তার উপর ঈশিতা নিজের মায়ের পর অনেক ভেঙে পড়ে। তার নিজেকেই এসবের জন্য দায়ী মনে হয়। তাই সেও বিয়েতে মত দিয়ে ফেলে। আয়ুশের হাতে তখন আর কোন উপায় ছিল না। সে শহরের সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলে এবং সরকারি চাকরিও করে। তাই সে স্থানীয় একজন ঘটকের সাথে যোগাযোগ করে ইসমাইল হোসেনের সাথে কথা বলে। নিজের পরিবারকেও রাজি করায়। আর আজ সে এখানে চলে এসেছে। আয়ুশের এখন ইচ্ছা ঈশিতার দায়িত্ব নেওয়া। ঈশিতার স্বপ্ন পূরণে তাকে সহায়তা করা।

এসব ভাবনা থেকে বেরিয়ে আয়ুশ ঈশিতাকে বলে,”আমি এই বিয়েটা শুধু নিজেকে অপরাধবোধ থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্যই করছি। তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে পারো। আমি তোমার জীবন পরিবর্তন করার চেষ্টা করব।”

ঈশিতা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। হাসি থামিয়ে বলে,”আপনি আমার জীবন পরিবর্তন করতে পারবেন? পারবেন আমার মাকে আবার ফিরিয়ে আনতে?”

আয়ুশ মাথা নিচু করে নেয়। ঈশিতা বলে,”পারবেন না। আপনাকে কিছু করতে হবে না। আপনি শুধু আমার চোখের সামনে থেকে যান। আপনাকে আমার সহ্য হচ্ছে না।”

আয়ুশ বলে,”দেখো ঈশিতা, তোমার বয়স কম। এই বয়সে আবেগ বেশি কাজ করে। আমি জানি, আমার একটা ভুল সিদ্ধান্তের জন্য তোমার জীবনের পুরো গতিপথ পরিবর্তন হয়ে গেছে কিন্তু তাই বলে তুমি আমাকে সম্পূর্ণরূপে দোষ দিতে পারো না। এটা তো আমার দায়িত্ব ছিল তাই না?”

“হ্যাঁ, এটা আপনার দায়িত্ব ছিল। যেটা আপনি অনেক সুন্দর করে পালন করেছেন। আপনাকে আর কোন দায়িত্ব পালন করতে হবে না। আমার জীবনকে নিজের গতিতে চলতে দিন। আমি ভাগ্যকে মেনে নিয়েছি।”

এটা বলে ঈশিতা চলে যেতে নিতেই আয়ুশ তার হাত ধরে আটকে বলে,”তোমার মাকে হয়তো আমি ফিরিয়ে আনতে পারবো না কিন্তু তোমার স্বপ্ন আমি অবশ্যই পূরণ করাব। তোমাকে জীবনে আমি প্রতিষ্ঠিত করাবোই। এটা আমার ওয়াদা।”

ইশাতা ঠায় তাকিয়ে রয় আয়ুশের দিকে।

to be continue….