আমি তোমার দ্বিধায় বাঁচি পর্ব-০২

0
114

#আমি_তোমার_দ্বিধায়_বাঁচি
#Part_2
#ইয়াসমিন_খন্দকার

“আমি আপনাকে কিছুতেই বিয়ে করব না। আমি ঐ বুড়োকে বিয়ে করতে রাজি আছি তবুও আপনাকে বিয়ে করব না।”

ঈশিতা আয়ুশের মুখের উপর বলে দেয়। আয়ুশ তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বলে,”তুমি যদি নিজের ভালো না বোঝো তাহলে আমার কিছু করার নেই। তবে আমি নিজের ভুল শুধরে নেবোই।”

ঈশিতা রেগে বলে,”কি করবেন আপনি? জোর করে আমায় বিয়ে করবেন?”

“প্রয়োজন হলে তাই করব।”

আয়ুশের স্পষ্ট জবাব। ঈশিতাও কম যায়না। সে বলে,”আমি মরে যাব তাও কবুল বলবো না। আপনার যা করার করুন।”

আয়ুশ আর কথা বাড়ালো না। ঈশিতাকে পাশ কা’টিয়ে নিচে চলে গেলো। ঈশিতা ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। আর ভাবতে লাগলো আয়ুশের পরবর্তী পদক্ষেপ কি হতে পারে।

~~~~~~~~~~~
তালুকদার বাড়ি। ঢাকা শহরের অন্যতম বনেদী পরিবার। এই পরিবারের মাথা হলেন বর্তমানে আলতাফ তালুকদার। আয়ুশের বাবা। তবে আরো একজন আছেন যাকে তিনি মান্য করেন যিনি হলেন তার মা তথা আয়ুশের দাদি গুলশেনারা বেগম। গুলশেনারা বেগম ঘরে বসে তসবিহ জবছিলেন। এমন সময় তার কক্ষে এলো তার ছোট ছেলে মহরুম আলামিন তালুকদারের একমাত্র মেয়ে ঐশী তালুকদার। ঐশী এসেই গুলশেনারা বেগমের কাছে এসে বলল,”পুরো বাড়ি ফাঁকা কেন দাদি? কাউকে কোথাও দেখছি না। আজ তো শুক্রবার। বড় আব্বু, বড় আম্মু, আয়ুশ ভাইয়া সবারই তো আজ বাসায় থাকার কথা।”

গুলশেনারা বেগম তাকালেন নিজের মাসুম নাতনির দিকে। মেয়েটা বড্ড হতভাগী। ঐশীর যখন পাঁচ বছর বয়স ছিল তখনই তার মা-বাবা এক সড়ক দূর্ঘটনায় মারা যায়। তবে ঘটনাচক্রে বেঁচে যায় ঐশী। তবে তখন থেকেই তার পায়ে সমস্যা। ক্রাচে ভড় করে হাঁটতে হয় সবসময়। গুলশেনারা বেগম বড্ড ভালোবাসেন তার এই নাতনীটিকে। মেয়েটা বড্ড সহজ সরল। গুলশেনারা বেগম মৃদু হেসে বলেন,”সবাই তো আজ তোর আয়ুশ ভাইয়ার জন্য মেয়ে দেখতে গেছে।”

কথাটা শুনে ঐশীর পায়ের তলার মাটি সরে যায়। সে ব্যাথাতুর কন্ঠে বলে,”মেয়ে দেখতে!”

গুলশেনারা বেগম বলেন,”হ্যাঁ রে, আয়ুশের তো বিয়ের বয়স হয়ে গেছে তাই না? এখন তো আবার ম্যাজিস্ট্রেটও হয়েছে। এতদিন তো বিয়ের কথা বলতেই ক্ষেপে যেত কিন্তু আজ নিজের উদ্যেগে ওর মা-বাবাকে নিয়ে মেয়ে দেখতে গেছে।”

ঐশী মলিন হেসে বলে,”ওহ। আচ্ছা ঠিক আছে। আমি রুমে যাই।”

“আচ্ছা, যা।”

ঐশী ক্রাচে ভড় করে চলতে থাকে। গুলশেনারা বেগমের রুম থেকে বেরিয়ে এসে কিছুদূর যাওয়ার পর হোঁচট খেয়ে পড়ে যায়। পায়ে চোট লেগে রক্তও বের হয়। কিন্তু ঐশীর সেদিকে খেয়াল নেই। তার দুচোখ ভিজে উঠেছে অশ্রুতে। সেই ছোটবেলা থেকে আয়ুশকে পছন্দ করে ঐশী। ঐশীর প্রতিবন্ধকতার জন্য আয়ুশও তাকে অন্য ভাবে ট্রিট করে। তাকে আগলে রাখে সবসময়। এই আগলে রাখাগুলোকে সে মনে করত আয়ুশের ভালোবাসা। কিন্তু আজ বুঝতে পারছে আয়ুশ তাকে ভালোবাসে না। তার প্রতি দয়া-মায়া থেকেই তাকে সবসময় আগলে রাখে। এমনটা ভাবতেই ঐশীর আরো বেশি করে কান্না পায়। ঐশী আর্তনাদ করে বল ওঠে,”আমায় কেন ভালোবাসলে না তুমি আয়ুশ ভাইয়া? আমি যে প্রতিনিয়ত তোমার দ্বিধায় বাঁচি, তোমার দ্বিধায় পুড়ে ছাই হয়ে যাই।”

~~~~~~~~~~~~~
ঈশিতা সিঁড়ি বেয়ে যখন নিচে নামলো তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। কথা অনেক দূর এগিয়েছে। আয়ুশ নিচে এসে সবাইকে বলেছে ঈশিতা বিয়েতে রাজি। একথা শুনে সবাই বিয়ের তারিখ পর্যন্ত ঠিক করে নেয়। ইসমাইল হোসেনের মুখ থেকে তো হাসি যাচ্ছেই না। তিনি তো ঠিক করে নিয়েছেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঈশিতাকে বিদায় করে নিজেও আরেকটা বিয়ে করে নেবেন! এত বড় পরিবারে মেয়ের বিয়ে হলে তো ভালোই হয়।

ঈশিতা একবার ভাবলো সবার সামনে গিয়ে বলবে এই বিয়েটা সে করবে না। এই বিয়েতে তার কোন মত নেই। কিন্তু পারল না। থেমে গেল সে। এখন সে যাই বলুক তার বাবা ইসমাইল হোসেন যে ধরেবেঁধে তার বিয়েটা দিয়েই দেবে এটা সে একপ্রকার নিশ্চিত। তাই তর্ক করে লাভ নেই। তাই অন্য একটা ছক কষল ঈশিতা। বিয়ের দিন পালিয়ে যাবে। যেদিকে দুচোখ যায়, সেদিকে চলে যাবে। তবুও থাকবে না আর এখানে। এই আয়ুশ লোকটাকে তো সে কোনভাবেই বিয়ে করবে না। কারণ ঈশিতা মনে করে এই লোকটাই তার জীবনের সব সমস্যার একমাত্র কারণ।

ঈশিতাকে দেখেই আয়ুশের মা জাহানারা বেগম বলেন,”এদিকে এসো মা।”

ঈশিতা লক্ষী মেয়ের মতো এগিয়ে যায়। জাহানারা বেগম ঈশিতার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,”মাশাল্লাহ, মেয়ে তো ভারী সুন্দর। কারো নজর না লাগুক। আমার ছেলের জন্য তো এমন একটা মেয়েই খুঁজছিলাম আমি।”

বলেই তিনি নিজের হাতের সোনার বালা খুলে ঈশিতাকে পড়িয়ে দেন। ঈশিতার হাতে চুমু খেয়ে বলেন,”তোমাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে। এখন যত তাড়াতাড়ি তোমাকে আমি আমার ছেলের বউ করে নিয়ে যেতে পারবো তত তাড়াতাড়ি আমার শান্তি।”

জাহানারা বেগমকে খুশি লাগলেও আলতাফ তালুকদার যেন তেমন একটা খুশি নন এটা তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। সেদিনকার মতো কথাবার্তা শেষ করে ওনারা বিদায় নেন। যাওয়ার আগে আয়ুশ আবারো ঈশিতাকে বলে,”আমি যা করছি সব তোমার ভালোর জন্য। তুমি বড় হয়েছ, আশা করি নিজের ভালোটা বুঝবে৷ কোন ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলো না।”

ঈশিতা কোন প্রতিক্রিয়া দেখায় না। তার যেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সেটা সে নিয়ে ফেলেছে। আর কারো কথাই তাকে কোনভাবে প্রভাবিত করতে পারবে না। আয়ুশেরা চলে যাবার পর ইসমাইল হোসেন ঈশিতাকে বলে,”এখানে দাঁড়িয়ে না থেকে নিজের রুমে যাও। আর হ্যাঁ, একদম এই বিয়েতে কোন বেংড়া দেওয়ার চেষ্টা করবে না। আমি ভালোই বুঝেছি তোমার মত নেই এই বিয়েতে। কিন্তু বিয়েটা তোমাকে করতেই হবে। তোমার মতো আপদ আমি বেশিদিন পালতে পারো না। এইট পাশে পরই তো তোমায় বিয়ে দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু তোমার মার জন্য পারিনি। এবার আমায় কেউ আটকাতে পারবে না।”

ঈশিতা এবারও কোন প্রতিক্রিয়া দেখায় না। কারণ তার পরিকল্পনা যে ঠিক করা। আপাতত সে চুপ থাকবে। যা হচ্ছে মেনে নেবে। একশন দেখাবে বিয়ের দিন।

~~~~~
আয়ুশ নিজের আলাদা গাড়িতে করে কাজে বেরিয়ে পড়ে। আর তার মা-বাবা গাড়ি নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দেয়। জাহানারা বেগম তো ঈশিতার প্রশংসায় একদম পঞ্চমুখ। কিন্তু আলতাফ তালুকদার মুখে কুলুপ এঁটেছেন। কিছুই বলছেন না। জাহানারা বেগম ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বলেন,”তুমি মুখটা এমন বাংলার পাঁচের মতো করে রেখেছ কেন?”

আলতাফ তালুকদার মলিন মুখে বলেন,”আমি ভেবে রেখেছিলাম ঐশীর সাথে আয়ুশের বিয়ে দেব। মেয়েটাকে নিয়ে যে বড্ড ভয় হয়। সবসময় চোখের সামনে থাকলে শান্তিতে থাকতে পারতাম।”

জাহানারা বেগম তেঁতে ওঠেন। রাগে তার সর্বাঙ্গ কেপে ওঠে। দাঁতে দাঁত পিষে বলে,”তোমার আর বুদ্ধি হলো না তালুকদার সাহেব! ঐ খোড়া মেয়েটাকে কিনা করবে নিজের একমাত্র ছেলের বউ?! আমার ছেলে হলো হিরের টুকরো। আর তোমাকে এত চিন্তা করতে হবে না ঐ খোড়া মেয়েটাকে এমনিতেই কেউ বিয়ে করবে না, সারাজীবন নিজের চোখের সামনেই রাখতে পারবে। আর হ্যাঁ, এমন অলুক্ষণে কথা আর বলবে না আমার সামনে।”

“জাহানারা, এমন বলছ কেন তুমি? মেয়েটার তো শুধু পায়েই একটু সমস্যা। রূপ-গুণের তো অভাব নেই৷ এইজন্য তুমি ওর ব্যাপারে এমন কথা বলবে?”

“ঘাট হয়েছে আমার। এখন এসব বাদ দাও। আয়ুশ নিজে থেকে এত ভালো একটা মেয়ে পছন্দ করেছে আমি তাতেই খুশি। নাহলে তো তুমি নিজের ঐ খোড়া ভাতিজিকেই আমার ছেলের গলায় ঝুলিয়ে দিতে। যাইহোক, আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। এখন আমি শুধু ঈশিতাকে নিজের বাড়ির বউ হিসেবে বরণ করার জন্য অপেক্ষা করছি।”

to be continue….