আমি তোমার দ্বিধায় বাঁচি পর্ব-২৯

0
75

#আমি_তোমার_দ্বিধায়_বাঁচি
#Part_29
#ইয়াসমিন_খন্দকার

আয়ুশ ঝড়বৃষ্টি এর কারণে দীর্ঘ সময় আটকে থাকলো। রাত পেরিয়ে দিনের আলো এসে ধরা দিলো ধরিত্রীর বুকে। আকাশও পরিস্কার হলো ধীরে ধীরে। আটকে পড়া মানুষ জন যে যার গন্তব্যে বেরিয়ে পড়লো। আয়ুশও তার ব্যতিক্রম নয়। বেরিয়ে পড়লো চট্টগ্রামে নিজের প্রেয়সীর উদ্দ্যেশ্যে। কতদিন নিজের প্রিয়তমা স্ত্রীকে দেখে না আয়ুশ, কতদিন তাকে আদর করা হয়না। এবার তো সে ভেবে নিয়েছে তার স্ত্রীকে আগলে রাখবে। অনেক আদর করবে। আর কোন কষ্ট পেতে দেবে না।

অপেক্ষা যেন আর সহ্য হচ্ছিল না তার। যত পথ অতিক্রম করছিল বুকের ব্যাথা তত বাড়ছিল। অপেক্ষার শেষ হবে কবে একথা মনে হচ্ছিল বারংবার।

অবশেষে অপেক্ষার অবসান। আয়ুশ এসে থামলো ঈশিতার হাসপাতালের সামনে। অনেক আশা নিয়ে গাড়ি থেকে নামল আয়ুশ। হাসপাতালের দিকে তাকিয়ে বললো,”অনেক হয়েছে তোমার সাথে লুকোচুরি খেলা ঈশিতা। এবার তোমাকে আমার কাছে ধরা দিতেই হবে।”

বলেই হাসি মুখে হাসপাতালে প্রবেশ করল আয়ুশ। পথিমধ্যে একজন মহিলা ডাক্তারকে দেখতে পেয়ে তাকে থামিয়ে জানতে চাইল,”এক্স কিউজ মি! এখানে ডাঃমিসেস ঈশিতা কাজ করেন শুনেছি। আপনি চেনেন ওনাকে?”

ডাক্তার আয়ুশকে আপাদমস্তক পরখ করে নিয়ে বললো,”হ্যাঁ, চিনি৷ কিন্তু আপনি কে?”

আয়ুশ কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো। না জানি ঈশিতা তার কলিগদের কি বলেছে আয়ুশের সম্মন্ধে। যদি সবটা জানার পর তাকে না জানাতে চায়। এজন্য সত্যটা লুকিয়ে বলে,”আমি ওর রিলেটিভস। উনি কি এখন হাসপাতালে আছেন? ওনার সাথে দেখা করতে চাই।”

মহিলা ডাক্তার উত্তেজিত হয়ে পড়লেন হঠাৎ। বলে উঠলেন,”আপনি কিভাবে খবর পেলেন? ঈশিতার অবস্থা একদম ভালো নেই।”

সহসা আয়ুশের বুক কেপে উঠলো। আজ এতদিন পর নিজের স্ত্রীর সন্ধান পেলো। যখন তার আনন্দিত হবার কথা তখন কি অশুভ খবর ভেসে আসলো! আয়ুশ নিজেকে যথাসম্ভব শক্ত করে জানতে চাইল,”কি হয়েছে ঈশিতার?”

“কেন? আপনি জানেন না, ঈশিতা প্রেগন্যান্ট! আজ তো ওর ডেলিভারি হচ্ছে। এটা আর্লি টাইম ডেলিভারি। ওর চিকিৎসা করা ডাক্তার বলেছেন ওর অবস্থা অনেক ক্রিটিকাল। মা অথবা বাচ্চার মধ্যে যেকোন একজনকে বাঁচানো সম্ভব।”

আয়ুশ হতভম্ব হয়ে গেলো। এটা কোন সময় কোন খবর শুনল সে?! ঈশিতা প্রেগন্যান্ট মানে সে বাবা হতে চলেছে। অথচ ঈশিতা এতদিন ধরে এই সত্যটা লুকিয়ে রেখেছে তার থেকে। এত অভিমান মেয়েটার যে তাকে একবার বাবা হওয়ার খবরটা দেবার প্রয়োজন মনে করলো না। আয়ুশের দুচোখে অশ্রু জমতে লাগল। সে অশ্রু মুছে নিয়ে বলল,”আমাকে একটু ঈশিতার কাছে নিয়ে যাবেন।”

“ওকে তো ওটিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আসুন আমার সাথে।”

আয়ুশকে অটির সামনে নিয়ে আসা হয়। ভেতরে তার অপারেশন চলছে। আয়ুশ আসতেই দেখল অটি থেকে একজন ডক্টর বেরিয়ে আসছেন। আয়ুশ উদ্ভ্রান্তের মতো ওনার সামনে গিয়ে বললেন,”ঈশিতা আর আমাদের বেবি কেমন আছে ডাক্তার?”

ডাক্তার অবাক হয়ে বললেন,”আপনাদের বেবি মানে? আপনি কি ঈশিতার হাসবেন্ড?”

আয়ুশ মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জানায়। ডাক্তার রেগে বলেন,”কতটা দায়িত্বজ্ঞানহীন মানুষ আপনি! আপনার স্ত্রীর এই অবস্থা আর আপনি এখন এলেন! যাক গে, আপনার সাথে কিছু জরুরি কথা ছিল৷ ঈশিতার অবস্থা বেশি ভালো না। আমাদের ইমিডিয়েটলি একটা জরুরি ডিশিসন নিতে হবে।”

“কি ডিশিসন?”

“দেখুন, ওনার যা কন্ডিশন, আমার মা এবং বাচ্চা দুজনকে কিছুতেই বাঁচাতে পারব না। একজনের লাইফকে আমাদের সেক্রিফাইজ করতেই হবে। ঈশিতার জ্ঞান নেই, তাই আমরা সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিলাম যে কি করব। এখন যখন আপনি এসে গেছেন তখন অনেকটা নিশ্চিত লাগছে। আপনি বলুন, আপনি কি চান? কাকে বাঁচাব আমরা? বাচ্চাকে নাকি ঈশিতাকে?”

আয়ুশ স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল ডাক্তারের দিকে। ভাগ্য আজ তাকে এ কোন অগ্নিপরীক্ষার মধ্যে ফেলল?! কি করবে এখন সে? কাকে বাঁচাবে? নিজের প্রিয়তমা স্ত্রী নাকি অনাগত সন্তান। নিজের বিবেকের কাছে যে অপরাধী হতে হচ্ছে তাকে। এখন যেকোন সিদ্ধান্ত নেয়া মানে নিজের প্রিয় কাউকে বলিদান দেওয়া! যদি সে নিজের সন্তানকে বেছে নেয় তাহলে নিজের প্রিয়তমা স্ত্রীকে বিসর্জন দিতে হবে যাকে সে নিজের থেকেও ভালোবাসে। আর যদি নিজের স্ত্রীকে বেছে নেয় তাহলে বিসর্জন দিতে হবে নিজের অংশ, নিজের সন্তানকে, যার আগামীতে তাকে বাবা বলে ডাকার কথা। যেই নিষ্পাপ শিশুটা এখনো এই পৃথিবীর আলোই দেখে নি।

আয়ুশকে চুপ থাকতে দেখে ডাক্তার বলে উঠলেন,”চুপ করে থাকবেন না। আমাদের হাতে বেশি সময় নেই। যেই ডিশিসন নেওয়ার খুব তাড়াতাড়ি করতে হবে!”

আয়ুশ মলিন কন্ঠে বললো,”নিজের স্ত্রী বা সন্তানকে মেরে ফেলার ডিশিসন নেওয়া কি এতই সহজ ডাক্তার বাবু!”

“আমি বুঝতে পারছি আপনার উপর দিয়ে এখন কি ঝড় যাচ্ছে। কিন্তু এখন তো আমাদের যেকোন একজনকে বাঁচাতে হবে। নাহলে যে দুজনকেই মরতে হবে।”

আয়ুশ আচমকা ডাক্তারের পায়ের কাছে বসে বলে,”আপনি তো একজন ডাক্তার। আপনি তো অসাধ্যসাধন করতে পারেন। আপনি পারবেন না আমার স্ত্রী এবং সন্তান দুজনকেই আমার বুকে এনে দিতে?”

ডাক্তার আয়ুশকে টেনে তুলে অসহায় কন্ঠে বলে উঠল,”আমার যে কিছুই করার নেই। আপনাকে যেকোন একজনকে বেছে নিতেই হবে।”

আয়ুশ চোখ বন্ধ করে দীর্ঘ শ্বাস ফেললো।

“আমি জানি ঈশিতা, আজ আমি যেই ডিশিসনটা নেব তার জন্য হয়তো তুমি আমায় ক্ষমা করতে পারবে না কিন্তু এছাড়া আমার যে আর কিছু করার নেই। আমার কাছে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ তোমার জীবন। রাজ্যে রাণী থাকলে আবারো রাজপুত্র/রাজকন্যার আগমন ঘটবে। কিন্তু রাণীকে একবার হারিয়ে ফেললে তার অভাব সে কোন কিছু দিয়েই পূরণ করা যাবে না। আর তুইও তোর এই অসহায় বাবাকে ক্ষমা করে দিস, তার যে কিছু করার ছিল না৷ তোকে মাতৃহীনা করে বড় করতে পারবে না সে। তার থেকে ভালো, তোর মা বেঁচে থাকুক। এরপর নাহয় আমরা দুজনে মিলে আবার তোকে এই পৃথিবীতে আনব।”

মনে মনে এই কথাগুলো ভেবে আয়ুশ বলে,”আমি চাই….আমি চাই যে…আপনারা আমার স্ত্রীকে বাঁচান..”

কথাটা বলতে গিয়ে বারবার আয়ুশের গলা কেপে উঠছিল। নিজেকে নিজের সন্তানের খু**নি মনে হচ্ছিল। তবুও সে বললো কথাটা। ডাক্তার আয়ুশের কাঁধে হাত রেখে অটিতে প্রবেশ করলেন। আয়ুশ ধপ করে মেঝেতে বসে পড়লো। ভেঙে পড়লো কান্নায়।

“কেন, কেন? কেন বারবার আমার সাথেই এমন হয়, আল্লাহ? এত কষ্ট আমি কিভাবে সইব?”

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
ঈশিতার জ্ঞান ফিরলে সে নিজেকে কেবিনে আবিষ্কার করে। পিটপিট করে চোখ মেলে এদিক ওদিক তাকায় ঈশিতা। দায়িত্বরত নার্স তার জ্ঞান ফিরতে দেখে ডাক্তারকে ডেকে পাঠায়। ডাক্তার এসে দেখলেন, ঈশিতা এদিক ওদিক তাকিয়ে কাকে যেন খুঁজছে। ডাক্তার ঈশিতাকে জিজ্ঞেস করলেন,”আপনি কি কাউকে খুঁজছেন মিসেস ঈশিতা?”

“বাচ্চা..আমার বাচ্চা কোথায়? কোথায় আমার বাচ্চা।”

“দেখুন, আপনি শান্ত হন।”

” আমার বাচ্চা নেই কেন ডাক্তার? জন্মের পর তো বাচ্চাকে তার মায়ের কাছেই রাখা হয়। তাহলে আমার বাচ্চা কোথায়?”

ডাক্তার নীরবে মাথা নিচু করে রইলেন। কি বলবেন এখন তিনি? যদিও এটা তার পেশা, অনেক কঠিন কথা শোনাতে হয় রোগীর স্বজনদের। কিন্তু সে নিজেও তো একজন বাবা। তাই সন্তান হারানোর বেদনা বুঝতে পারে। একজন মা কত কষ্টে দশমাস সন্তানকে লালন করেন নিজ গর্ভে। সেই সন্তানের মৃত্যু কি এত সহজে মানা যায়। কিন্তু তাকে যে তার দায়িত্ব পালন করতেই হবে। তাই তিনি বলে উঠলেন,”সরি,কিন্তু আমরা আপনার বাচ্চাটাকে বাঁচাতে পারিনি।”

ঈশিতা স্তব্ধ হয়ে গেল ওনার কথা শুনে। তার নিজের কানকেও বিশ্বাস হচ্ছিল না। এই সন্তানকে সে এই দশমাস এত কষ্টে লালন করেছে, যাকে ঘিরে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখেছে তাকে এভাবে হারিয়ে ফেলল! তাকে মা বলে ডাকার আগেই বিদায় নিলো এই দুনিয়া থেকে। ঈশিতা এত বড় ধাক্কাটা মেনে নিতে পারল না। আবারও জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়লো।

to be continue…..