আমি তোমার দ্বিধায় বাঁচি পর্ব-০৩

0
99

#আমি_তোমার_দ্বিধায়_বাঁচি
#Part_3
#ইয়াসমিন_খন্দকার

“সামনে তোর আয়ুশ ভাইয়ার বিয়ে আর তুই ঘরে বসে আছিস। তুই তো ওর একমাত্র বোন। যা নিজের ভাইয়ের বিয়ে উপলক্ষে আনন্দ কর।”

ঐশীর রুমে এসে এই কথাগুলো বলতে থাকে জাহানারা বেগম। ঐশীকে এই কথাগুলো বলে ভীষণ মানসিক শান্তি পান। কৈশোরকালে একবার মজার ছলে ঐশী ওনাকে বলেছিলেন সে আয়ুশকে পছন্দ করে। জাহানারা বেগম ব্যাপারটাকে এতটা গুরুত্ব দেন নি। কিন্তু তার জহুরির চোখ। ঐশীর হাবভাব দেখেই তিনি একসময় বুঝে যান এই মেয়ের মনে তার ছেলের জন্য একটা সফট কর্নার আছে। ব্যাপারটা মোটেই ঠিকভাবে মেনে নেন নি জাহানারা বেগম। একেই তো ঐশীর পায়ের ঐ সমস্যা তার উপর জাহানারা বেগমের ধারণা এই মেয়েটা অপয়া। কারণ এই মেয়ের জন্মের পর থেকে তাদের পরিবারে একের পর এক বিপদ নেমে এসেছে। আলতাফ তালুকদারের ব্যবসায় বড় লস হয়েছিল এই মেয়ের জন্মের কিছুদিন পরই। যদিও কিছু বছরের মধ্যেই তাদের অবস্থা আবার আগের মতো হয় কিন্তু এরপরই ঐশীর মা-বাবার মৃত্যু। এসব ঘটনা পরপর ঘটায় ঐশীর প্রতি নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছিল তার মনে। তাছাড়া কয়েক বছর আগে ঐশীকে মেলায় ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার সময় আয়ুশের একটা বিরাট সড়ক দূর্ঘটনা হতে হতে সে বেঁচে যায়। এরপর থেকেই ঐশীকে তিনি একদম সহ্য করতে পারেন না। কিন্তু পরিবারের সবাই মেয়েটাকে এত মাথায় তুলে নাচে জন্য সবার সামনে কিছু বলতেও পারেন না। কিন্তু আজ সুযোগ পেয়ে তিনি কিছুতেই সেটা হাতছাড়া করবেন না। মানসিক যন্ত্রণায় শেষ করে দেবেন মেয়েটাকে।

শুধুমাত্র যাতে এই মেয়েটার থেকে নিজের ছেলেকে দূরে রাখা যায় সেজন্য তো শিক্ষাগত যোগত্যায় অনেক পিছিয়ে থাকা একটা মেয়েকে যখন আয়ুশ বিয়ে করতে চায় তখন তিনি বিনাবাক্যে মেনে নেন।

এদিকে ঐশীর মন মানসিকতা অন্যরকম ছিল। সে জাহানারা বেগমের মনের এত প্যাচ বুঝতে পারে না। সামান্য হেসে বলে,”আমার ভীষণ অসুস্থ বোধ হচ্ছে বড় আম্মু।”

জাহানারা বেগম আর কথা না বাড়িয়ে চলে এলেন। যাওয়ার আগে বললেন,”ঐশীর বোধহয় ঐ মেয়েটাকে খুব পছন্দ জানিস। আমরা তো চাইছিলাম বিয়েটা কয়েক মাস পর হোক কিন্তু আয়ুশই জেদ করে বলল এই মাসের মধ্যেই যেন বিয়েটা হয়। ছেলেটা আমার একেবারে বিয়ের জন্য পাগল হয়ে গেছে। এক সপ্তাহ পরেই আমার বাড়ির বউ ঘরে আসবে। ভেবেই আনন্দ হচ্ছে খুব।”

জাহানারা বেগমের এসব কথা ঐশীকে ভেতর থেকে শেষ করে দিচ্ছিল। ঐশীর চোখও আর বাঁধা মানে না। তার দুচোখের কার্নিশ বেয়ে পড়তে থাকে বিন্দু বিন্দু অশ্রুকণা। ভালোবাসায় এত কষ্ট কেন?

জাহানারা বেগম ঐশীর চোখের অশ্রু দেখে পৈশাচিক আনন্দ পান। অতঃপর হাসিমুখে প্রস্থান করেন।

~~~~~~~
রাতে ডিনার টেবিলে ঐশী অনেক শান্ত হয়ে বসে ছিল। অন্যসময় আয়ুশ আসতেই সে তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি উপহার দিত৷ কিন্তু আজ একদম মাথা নিচু করে খাওয়ায় মনযোগী। আয়ুশ ব্যাপারটা খেয়াল করল। তবে বিষয়টা এত সিরিয়াসলি নিলো না। আয়ুশের মনে হলো, সে যেহেতু ঐশীকে ছাড়াই ঈশিতাকে দেখতে চলে গিয়েছিল তাই হয়তো ঈশিতা তার উপর অভিমান করেছে৷ পরে ওকে বুঝিয়ে ম্যানেজ করবে।

এদিকে খাবার টেবিলে গুলশেনারা বেগমও বেশ অভিমানী সুরে আলতাফ তালুকদারকে বলেন,”মানছি আমার বয়স হয়েছে কিন্তু তাই বলে তোরা আমার থেকে অনুমতি নেওয়ার তোয়াক্কা করবি না? এভাবে হুটহাট করে বিয়েটা ঠিক করে নিলি। আমার থেকে একবার অনুমতি তো নিবি। আমি তো মেয়েটাকে দেখলামও না।”

জাহানারা বেগম নিজের স্বামীর পাতে খাবার দিতে দিতে বলেন,”আমরা আর কি করব আম্মা? আপনার নাতিই তো নিজে থেকে মেয়েটাকে পছন্দ করেছে। সে-ই তো সেধে বিয়ে করতে চেয়েছে। আমাদের রাজি না হয়ে উপায় ছিল? আমার ছেলে যে বিয়ের কথা শুনেই প্রসঙ্গ বদলে দিত সে যখন নিজে থেকে বিয়ে করতে চেয়েছে তখন আমি আপত্তি জানাবো কেন?”

আলতাফ তালুকদার চোখের ইশারায় জাহানারা বেগমকে চুপ করতে বলেন। গুলশেনারা বেগম মুখটা গম্ভীর করে বললেন,”শুনলাম মেয়েটা নাকি আন্ডার মেট্রিক। এবার নাকি ওকে এক্সপেল করা হয়েছে। আমার সুশিক্ষিত নাতির পাশে এই মেয়ে কিভাবে যায়?”

আয়ুশ সাথে সাথেই বলে ওঠে,”ও আন্ডার মেট্রিক হলেও ভীষণ মেধাবী। তাছাড়া ওর এক্সপেলের ঘটনাটাও ছিল সম্পূর্ণ ভুল বোঝাবুঝি। ও একদম নির্দোষ। আর তুমি চিন্তা করো না দাদীজান। ওকে আমি একদম নিজের যোগ্য করে তুলব।”

ঐশী নিজের খাওয়া শেষ করে নীরবে ক্রাচে ভড় দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। এসব কথা শুনতে তার আর ভালো লাগছিল। বুক ফেটে কান্না পাচ্ছিল। যাকে এতগুলো বছর যাবৎ ভালোবেসে গেল তার কাছে ভালোবাসা প্রকাশ করার আগেই সে অন্য কারো হয়ে গেল। ঐশীর মাঝে মাঝে নিজের উপর অভিমান হয় খুব। যদি আজ তার পা ঠিক থাকতো তাহলে অনেক আগেই আয়ুশকে নিজের মনের কথা বলে দিত৷ কিন্তু নিজের এই প্রতিবন্ধকতার জন্য সবসময় হীন্যমনতায় ভুগতে হয়েছে তাকে। স্কুল-কলেজেও অনেক ছেলেকে বলতে শুনেছে তার সৌন্দর্য দেখে প্রেমে পড়লেও তার প্রতিবন্ধকতার জন্য তারা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এমতাবস্থায় কিভাবে নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে মনের কথা বলতো সে? যদি সেও একই কারণে ফিরিয়ে দিত তাহলে যে শেষ হয়ে যেত মেয়েটা।

ঐশী নিজের কক্ষে এসে একটা এলবামে আয়ুশের সাথে নিজের কিছু ছবি দেখে কাঁদছিল। মনে করছিল কিছু পুরানো স্মৃতি। আয়ুশের করা কেয়ারগুলো। তারপর হঠাৎই গুণগুণ করে গাইতে শুরু করে,
❝কেন রোদের মতো হাসলে না
আমায় ভালোবাসলে না
আমার কাছে দিন ফুরালেও আসলে না
এই মন কেমনের জন্মদিন
চুপ করে থাকা কঠিন
তোমার কাছে খরস্রোতাও গতিহীন
নতুন সকাল গুলো কপাল ছুলো তোমারই
দূরে গেলেও এটাই সত্যি তুমি আমারই
শুধু আমারই..❞

এমন সময় ঘরে কারো আসার শব্দ শুনেই ঐশী নিজের চোখের জল মুছে এলবামটা বালিশের নিচে লুকিয়ে রাখে। আয়ুশ ঐশীর রুমে প্রবেশ করেই বলে,”গান থামালি কেন? বেশ সুন্দরীই তো গাইছিলি৷ তোর গানের গলা কিন্তু দারুণ। চাইলেই ভালো সংগীতশিল্পী হতে পারবি।”

ঐশী বিনিময়ে জোরপূর্বক হাসে। অতঃপর বলে,”ভাইয়া তুমি হঠাৎ?”

“তুই কি আমার উপর রাগ করেছিস ঐশী?”

“রাগ করব কেন ভাইয়া?”

আয়ুশ ঐশীর পাশে বসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,”তোকে আমার বউ দেখতে নিয়ে যাইনি জন্য। আসলে সবটা এত তাড়াহুড়োয় হয়ে গেল যে..”

“তুমি ভুল ভাবছ। আমি মোটেই রাগ করিনি।”

“তাহলে এসেছি থেকে আমার সাথে কোন কথা বলছিস না কেন? কেনই বা আমায় এভাবে এড়িয়ে চলছিস?”

“তেমন কিছু না। আসলে সামনে ফাইনাল এক্সাম তো। তাই একটু ব্যস্ত ছিলাম।”

অতঃপর প্রসঙ্গ বদলে বলে,”তবে একটা কথা ঠিক। আমার তোমার হবু বউকে দেখার খুব ইচ্ছা। আমি জানতে চাই কে সেই ভাগ্যবতী যে আমার শখের পুরুষকে না চাইতেই পেয়ে যাবে।”

শেষের কথাটা মনে মনেই বলে ঐশী। যা আয়ুশের কান অব্দি যায়না। আয়ুশ ভীষণ আগ্রহের সাথে ঈশিতার ছবি ঐশীকে দেখায়। ঐশী ভালো ভাবে তাকায় ঈশিতার দিকে। অতঃপর নিজের সাথে মেয়েটার তুলনা শুরু করে। উজ্জ্বল শ্যামলা রঙের মেয়েটির মুখশ্রী ভীষণ সুন্দর, বড় বড় পদ্মআঁখি তার সৌন্দর্য যেন বাড়িয়ে তুলেছে। তবুও ঐশীর সৌন্দর্যের কাছে নিদ্বিধায় হার মেনে যাবে মেয়েটা। ফর্সা, সুশ্রী ঐশী রূপে, শিক্ষাগত যোগ্যতায় মেয়েটার থেকে এগিয়ে থাকলেও পিছিয়ে গেল শারীরিক প্রতিবন্ধকতার জন্য। একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলল,”ভাবি আমার খুব পছন্দ হয়েছে। একটু বয়স কম তবে এটা কোন ব্যাপার না। তোমার সাথে ভালোই মানাবে।”

এটা বলে পুনরায় জোরপূর্বক হাসে। কিন্তু তার ভেতরে কি চলছে সেটা একমাত্র ঐশীই জানে।

~~~~~~~~~
ঈশিতা আজ দেরি করে সন্ধ্যার কিছুক্ষণ পর বাড়ি ফেরায় তার বাবা তার উপর অনেক চিল্লাপাল্লা করছিল। কিন্তু তার উপর এসবের কোন প্রভাবই পড়ছিল না। সে নিজের ওড়নার ফাঁকে লুকিয়ে রাখা একটা খাম বের করে সেখান থেকে একটা টিকিট বের করে সন্তুষ্টির হাসি হেসে বলে,”পেয়ে গেছি আমার কাঙখিত জিনিস। এখন আমার মতের বিরুদ্ধে কেউ কিছু করতে পারবে না।”
to be continue….