আমি তোমার দ্বিধায় বাঁচি পর্ব-০৪

0
90

#আমি_তোমার_দ্বিধায়_বাঁচি
#Part_4
#ইয়াসমিন_খন্দকার

আয়ুশ-ঈশিতার বিয়ের ধুম লেগে গেছে চারিদিকে। তালুকদার বাড়িতে ইতিমধ্যেই সাজসজ্জা শুরু হয়ে গেছে। দেখতে দেখতে তাদের বিয়ের ডেইট একদম ঘনিয়ে আসছে। আগামীকালই আয়ুশ-ঈশিতার বিয়ে। আজকে রয়েছে নানারকম অনুষ্ঠান।

এদিকে যত দিন এগোচ্ছে ঐশীর দুঃখের পরিমাণ ঠিক ততোই বাড়ছে। আয়ুশের থেকে চিরতরে আলাদা হওয়ার কষ্ট তাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। আর মেয়েটা তো এতটাই হতভাগ্য যে নিজের মনের এই কথাগুলো বলার মতো কাউকে খুঁজেও পাচ্ছে না। বাড়ির কাউকে বলতে পারবেনা, আবার তার এমন কোন কাছের বন্ধুও নেই৷ ঐশী দীর্ঘ শ্বাস ফেলে, ভাগ্যকে তো সে একদম মেনে নিয়েছে। তাই আর এসব ভেবে লাভ নেই৷ ভাগ্যকে তো পরিবর্তন করা সম্ভব নয়৷ তার ভাগ্যে হয়তো এটাই লেখা ছিল যে কাছের মানুষটাকে এভাবে অন্য কারো হয়ে যেতে দেখতে হবে।

ঐশীর এসব ভাবনার মাঝেই আয়ুশ এসে দাঁড়ালো তার পাশে। ঐশী আয়ুশকে খেয়াল করেনি তখনো। আয়ুশ এসে ঐশীকে বলল,”এখানে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ওখানে তো সবাই আনন্দ করছে৷ তুইও যা।”

আয়ুশের কথায় ঐশীর ধ্যান ভাঙে৷ আয়ুশ আজ সাদা রঙের একটা কাতানের পাঞ্জাবি পড়েছে৷ ভীষণ সুন্দর কারুকাজ করা৷ এই পাঞ্জাবিতে একজন রাজপুত্রের মতো লাগছে আয়ুশকে। তাকে দেখামাত্রই ঐশীর মুখে হাসি ফুটে ওঠে। তবে আয়ুশ অন্য কারো হয়ে যাবে এটা ভাবতেই তার মুখের হাসি মিলিয়ে যায়। অতঃপর ধীরে বলে ওঠে,”আমি তো ওদের কাউকেই চিনি না তাই…”

আয়ুশ হেসে বললো,”ও এই ব্যাপার। চল আমি ওদের সবার সাথে তোদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি।”

এই বলে আয়ুশ ঐশীকে নিজের সাথে নিয়ে আসে। ঐশী ক্রাচে ভর করে সাবধানে এগিয়ে আসে। মূলত এখানে আয়ুশের মামাতো ভাইবোনেরা এবং বন্ধু-বান্ধবেরা এসেছে। আয়ুশের একমাত্র মামার দুই ছেলে এবং এক মেয়ে। তাদের মধ্যে বড় ছেলে আমেরিকায় থাকে। সে তো আসতে পারে নি। তবে তার ছোট ছেলে নাহিদ এবং মেয়ে নামিরা এসেছে। আয়ুশ নামিরাকে কাছে ডেকে ঐশীকে দেখিয়ে বলে,”নামিরা ঐশীকে একটু তোদের সাথে নে তো৷ বেচারি একা একা বসে বোর হচ্ছে।”

নামিরা ঐশীকে নিজের সাথে নিয়ে আসে। ঐশী আসতেই নাহিদ হা করে তাকিয়ে থাকে ঐশীর দিকে। তার গলায় ছিল একটা ডিএসআরএল ক্যামেরা। যেটা দিয়ে সে সবার ছবি তুলছিল৷ নামিরা নাহিদের উদ্দ্যেশ্যে বলে,”কি হলো নাহিদ? এভাবে হা করে তাকিয়ে আছিস কেন? আমার আর ঐশীর একসাথে একটা ছবি তুলে দে তো।”

নামিরার কথায় নাহিদের ধ্যান ভাঙে। সে তাদের ছবি তোলায় মনযোগী হয়। অনেক সুন্দর সুন্দর ছবি তুলে দেয়। বিশেষ করে ঐশীর। এই মেয়েটাকে কেন জানি ভীষণ ভালো লাগে নাহিদের। হঠাৎ করে আয়ুশ নাহিদের উদ্দ্যেশ্যে বলে,”কিরে নাহিদ? তুই তো দেখছি বেশ ভালোই ছবি তুলিস। মেডিকেলে এডমিশন না নিয়ে তো ফটোগ্রাফি নিয়ে ক্যারিয়ার গড়তে পারতি!”

নাহিদ হেসে বলে,
‘কি যে বলো না ভাইয়া, ডাক্তারি হলো আমার পেশা আর ফটোগ্রাফি হলো নেশা। দুটোর মাঝে তো ডিফারেন্স রয়েছেই।’

এই বলে সে আবার ঐশীর দিকে তাকায়। মেয়েটার মুখ কেন জানি ভীষণ মলিন লাগছে। ঐশীর এই মলিন মুখ একদম ভালো লাগে না নাহিদের। বর্তমানে মেডিকেলে তৃতীয় বর্ষে পড়াশোনা করছে ছেলেটা। তবে জীবনে কখনো প্রেম ভালোবাসা আসে নি। কারণ সে নীরবে মন দিয়ে বসে আছে অন্য কাউকে। এডমিশনের সময় আয়ুশদের বাড়িতে এসে কিছুদিন ছিল সে। আর এই ক”দিনের মধ্যেই একজনের উপর মন আটকে যায়। মেয়েটা তার এক বছরের জুনিয়র। সেই যে মেয়েটার উপর মুগ্ধ হয়েছে তারপর আর কারো দিকে তাকায় নি। কিন্তু মেয়েটা নিজের মনের কথা বলে দেওয়া হয়নি। জানে না কবে বলতে পারবে। তবে বলবেই একদিন না একদিন।

~~~~~~~~~~~~~~~
ঈশিতার একদম ভালো লাগছে না বিয়ে নিয়ে এত আদিখ্যেতা। তার ফুফু-খালা-মামিরা সবাই এসে উপস্থিত হয়েছে। সবাই বিয়ে নিয়ে তাকে নানারকম কথাবার্তা বলছে৷ ঠাট্টা ইয়ার্কি করেও অনেক কিছু বলছে। এসব কিছু শুনে তার গা জ্বলে উঠছে। ইচ্ছা করছে এখনই দৌড়ে পালিয়ে যেতে। কিন্তু তার উপায় নেই। তাই দাঁতে দাঁত চেপে সবকিছু সহ্য করছে। এরমধ্যে তার সাত বছর বয়সী মামাতো বোন তার ড্রয়ার খুলে একটা খাম বের করে ঈশিতার কাছে এসে বলে,”আপু এই খামটা কিসের?”

ঈশিতা দ্রুত সেই খামটা তার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে ঝাড়ি দিয়ে বলে,”না বলে কারো জিনিসে হাত দিতে নেই জানিস না? এত অভদ্র কেন তুই?”

“এভাবে বলছ কেন আপু? আমি তো…”

“চুপ। একদম চুপ। আমি তোর কোন কথা শুনতে চাই না। যা তো আমার রুম থেকে।”

ঈশিতার কথা শুনে তার মামাতো বোন উদাস মনে বের হয়ে যাচ্ছিল এমন সময় তার মামি এসে বলে,”তুই এত অভদ্র কেন ঈশিতা। ওতো ছোট বাচ্চা, না বুঝেই করে ফেলেছে। তাই বল ওকে এভাবে বলবি?”

ঈশিতা বলে,”আমার জিনিসে কেউ না বলে হাত দিলে আমার মাথা গরম হয়ে যায়।”

“তা কি এমন অমূল্য ধন আছে ঐ খামের মধ্যে? দেখি তো একটু।”

ঈশিতা খামটা সরিয়ে বলে,”এটা কনশিয়াল।”

ঈশিতার মামি মুখ বাকিয়ে বলে,”ঢং। মামনী এসো তো আমার সাথে।”

ঈশিতা হাফ ছেড়ে বাঁচে। আরেকটু হলেই তার সব পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়ে যেত।

~~~~~~~~~
রাতে তালুকদার বাড়িতে সবাই মিলে আয়ুশের বিয়ে উপলক্ষে গানের আসর বসিয়েছে। তাতে একের পর এক সবাই গান বলছে। ঐশী শুকনো মুখে বসে ছিল সেখান থেকে। এরমধ্যে নাহিদ ঐশীর উদ্দ্যেশ্যে বলে,”ঐশী, আপনি একটা গান বলুন না। আপনি তো অনেক সুন্দর গান বলেন। গতবার শুনেছিলাম।”

ঐশী কিছুটা ঘাবড়ে বলে,”আ..আমি?”

নামিরা বলে,”তাই নাকি? তাহলে ঐশীর গান শুনতে হচ্ছে তো।”

আয়ুশ সেই সময় ওখান দিয়েই যাচ্ছিল। সকলের কথা শুনে সে এসে বলে,”হ্যাঁ, ঐশী সত্যিই দারুণ গান শোনায়। ঐশী একটা গান বলে শোনা না সবাইকে।”

আয়ুশের এই আবেদন ফেলতে পারে না ঐশী। তাই নিজের সব দুঃখের বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর সিদ্ধান্ত নেয় গানের মাধ্যমে। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বলতে শুরু করে,
❝মায়াবণ বিহারিণী হরিণী
গহন স্বপন সঞ্চারিণী
কেন তারে ধরিবারে করি পণ অকারণ
মায়াব বিহারিণী।
থাক থাক নিজ মনে দূরেতে
আমি শুধু বাশরীর সুরেতে…(2)

পরশ করিব ওর প্রাণমন অকারণ মায়াবণ বিহারিণী….

চমকিবে ফাগুনেরও পবনে
পশিবে আকাশ বাণী শ্রবণে
চমকিবে ফাগুনেরও পবনে

চিত্ত আকুল হবে অনুখন, অকারণ..

দূর হতে আমি তারে সাঁধিব
গোপনে বিরহ ডোরে বাঁধিব..❞

গান গাইতে গাইতে ঐশীর চোখের কার্নিশ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। যা সে সবার আড়ালে মুছে নেয়। কিন্তু তার দিকে মুগ্ধচোখে তাকিয়ে থাকা নাহিদের ঠিকই এটা চোখে পড়ে। সাথে ঐশীর গলা শুনে সে বুঝে যায় এই গানের মাধ্যমে সে নিজের অনুভুতি ব্যক্ত করেছে।

গান শেষে ঐশী ঘুমের বাহানা দিয়ে সবার মাঝ খান থেকে উঠে ছাদে চলে যায়। গিয়ে নীরবে অশ্রু বিসর্জন দিতে থাকে। এমন সময় কেউ পেছন থেকে তাকে স্পর্শ করে। ঐশী পিছন ফিরে তাকাতেই দেখতে পায় নাহিদকে। নাহিদ ঐশীকে এভাবে কাঁদতে দেখে বিচলিত হয়ে বলে,”আপনি কাঁদছেন কেন ঐশী?”

ঐশী দ্রুত নিজের চোখ জল মুছে বলে,”কই নাতো।”

“আপনি সবার থেকে লুকাতে পারলেও আমার থেকে পারবেন না। আমি সবার অলক্ষ্যে দেখে ফেলেছি।”

ঐশী মলিন হেসে বলে,”কিছু কান্না দুঃখের বহিঃপ্রকাশ। কিছু কান্না মন ভাঙার।”

“কে ভাঙল আপনার মন?”

“আমার ভাগ্য। দেখছেন না, আমি একটা পঙ্গু মেয়ে। আমার মতো আমার ভাগ্যটাও..যাইহোক একটা অনুরোধ করি রাখবেন? দয়া করে কাউকে জানাবেন না আমি কাঁদছিলাম।”

নাহিদ বলে,”ঠিক আছে। আমি আপনার কথা রাখব। বিনিময়ে আপনাকেও আমার কথা রাখতে হবে।”

“কি কথা?”

“আর কখনো কাঁদবেন না। আপনার এই সুন্দর চোখে কান্না মানায় না।”

বলেই প্রাণখোলা হাসে। যেই হাসি দেখে ঐশীও সামান্য হাসার চেষ্টা করে।
to be continue….