আমি তোমার দ্বিধায় বাঁচি পর্ব-০৭

0
97

#আমি_তোমার_দ্বিধায়_বাঁচি
#Part_7
#ইয়াসমিন_খন্দকার

ঈশিতার হাত ধরে তালুকদার বাড়িতে প্রবেশ করলো আয়ুশ। তার পরিবারের সবাই অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছে তাদের পানেই। যেই মেয়ে তাদের পরিবারের মান সম্মান সব ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে এভাবে পালিয়ে গেল তাকেই কিনা এবাড়িতে নিয়ে এসেছে আয়ুশ। এটা মেনে নিতে পারলেন না আয়ুশের দাদি গুলশেনারা বেগম। তিনি রাগী সুরে বলে উঠলেন,”খবরদার আয়ুশ, এই মেয়েকে এই বাড়িতে তুলবি না। ওকে যেখান থেকে নিয়ে এসেছিস সেখানেই ফিরিয়ে দিয়ে আয়। ওর জন্য আমাদের পরিবারের মুখে চুনকালি পড়েছে।”

আয়ুশের বাবা আলতাফ তালুকদারও নিজের মায়ের সুরে সুর মিলিয়ে বলে,”আম্মু ঠিক বলেছে আয়ুশ। এই মেয়ে যা করেছে তারপর আর এই বাড়িতে ওর ঠাঁই হবে না। আমরা কত সম্মান দিয়ে ওকে এই বাড়ির বউ করে আনতে চেয়েছিলাম অথচ ও আমাদের সব সম্মান ধূলিসাৎ করে দিলো।”

এসব কিছুর মাঝে জাহানারা বেগম চেয়েও কিছু করতে পারছেন না। তিনি তো চান ঈশিতার সাথে যেন আয়ুশের বিয়ে হোক। মেয়েটা নাহয় একটা ভুল করেছে তবুও তিনি চান এই মেয়েকে ছেলের বউ করতে। যাতে ঐশী কোনভাবেই তার ছেলের জীবনে প্রবেশ করার সুযোগ না পায়।

আয়ুশ ঈশিতার হাত শক্ত করে ধরে দৃঢ়তার সহিত বলে,”আমি ঈশিতাকে বিয়ে করেছি। ও স্ত্রী হয় আমার। তাই আমার স্ত্রী হিসেবে ওর সম্পূর্ণ অধিকার আছে এবাড়িতে থাকার।”

আয়ুশের কথা শুনে জাহানারা বেগম বাদে উপস্থিত সবার মুখ কালো হয়ে যায়। গুলশেনারা বেগম বলেন,”কি বলছিস তুই? তুই এই মেয়েটাকে বিয়ে..”

আয়ুশ বলে,”হ্যাঁ, করেছি ওকে বিয়ে।”

আলতাফ তালুকদার রেগে বললেন,”এভাবে কিভাবে তুই বিয়েটা করলি? আমাদের মতামতের কোন দাম নেই তোর কাছে। আম্মা, তুমি বলো তোমার কি সিদ্ধান্ত। তুমি অনুমতি না দিলে আমি এই মেয়েকে ছেলের বউ হিসেবে গ্রহণ করব না। কিছুতেই ওকে এবাড়িতে ঠাঁই দেব না।”

জাহানারা বেগম এবার আর চুপ থাকতে পারলেন না। আয়ুশ-ঈশিতার হয়ে বলে উঠলেন,”এটা তুমি কি বলছ আয়ুশের বাবা? ওদের বিয়েটা যখন হয়ে গেছে তখন আর এসব বলে কি হবে? মানছি, মেয়েটা একটু অন্যায় করে ফেলেছে কিন্তু তাই বলে তুমি নিজের ছেলের বউয়ের সাথে জুলুম করবে!”

আলতাফ তালুকদার চেঁচিয়ে বললেন,”তুমি চুপ থাকো! এই মেয়ের সাথে যাই করি সেটা জুলুমের পর্যায়ে যাবে না। যেই মেয়ে বিয়ে ছেড়ে পালিয়ে যায় তার চরিত্র কতোটা ভালো জানাই যায়।”

এপর্যায়ে আয়ুশ বলে ওঠে,”ক্ষমা করো বাবা, কিন্তু তুমি আমার স্ত্রীর সম্পর্কে এরকম কথা বলতে পারো না। ও তোমার বৌমা হয়।”

গুলশেনারা বেগম কিয়ংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে রইলেন। তার পরিবারে এত বড় সমস্যার উপদ্রব আগে কখনো হয়নি। তিনি এখনো বুঝতে পারছেন না এই সমস্যার মোকাবিলা কিভাবে করবেন। এমন সময় সবার মাঝে উপস্থিত হলো ঐশী। সে এসেই গুলশেনারা বেগমের উদ্দ্যেশ্যে বলল,”দাদি, তুমি এই অশান্তি থামাও। বিয়েটা যখন হয়ে গেছে তখন আর এসব বলে কি লাভ? তুমি মেনে নাও সবকিছু। আত্মীয়-স্বজন সব দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছে। এতে করে আমাদের পরিবারেরই মান-সম্মান নষ্ট হচ্ছে।”

“কিন্তু..”

“কোন কিন্তু নয় দাদি, তুমি তো আমার সব কথা মানো। তাহলে এই কথাটাও মেনে নাও। আপাতত এসব ঝামেলা বন্ধ হোক। তারপর আমরা পারিবারিক ভাবে বসে ঠান্ডা মাথায় সবকিছু মিটমাট করে নেব।”

জাহানারা বেগম কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলেন,”তুই ঠিকই বলেছিস ঐশী। এমনি আমাদের পরিবারের অনেক অপমান হয়েছে। এখন আরো হচ্ছে। এসব থামানো দরকার। আলতাফ, তুই তোর ছেলে আর ছেলের বউকে নিয়ে ঘরে আয়। বিয়েটা যখন হয়ে গেছে তখন আর এসব বলে লাভ নেই। যা কথা হবার পরে হবে।”

বলেই গুলশেনারা বেগম নিজের ঘরের দিকে রওনা দেন। আলতাফ তালুকদার রাগে গজগজ করতে করতে জাহানারা বেগমকে বলেন,”তুমি ওদের রুমে পৌঁছে দাও। আমার আর এত ঝামেলা ভালো লাগছে না। যা খুশি করো তোমরা!”

বলে তিনিও হনহন করে নিজের রুমের দিকে চলে যান। ঐশী একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আয়ুশ ও ঈশিতার দিকে। যদিও ঈশিতার বয়স কম তবুও মেয়েটার উচ্চতা যথেষ্ট। ঐশীর থেকেও লম্বা হবে হয়তো। দুজনকে পাশাপাশি অনেক সুন্দর মানিয়েছে। আয়ুশের জন্য একতরফা অনুভূতি মনে লুকিয়ে কষ্ট পাচ্ছিল ঐশী। তবুও সব সহ্য করে নিচ্ছিল। তার কষ্টের বিনিময়েও নাহয় সুখে থাক তার ভালোবাসার মানুষটা।

~~~~~~~~~~~~~~~~~
ঈশিতাকে আয়ুশের ঘরে পৌঁছে দিয়ে জাহানারা বেগমও রাগ দেখাতে শুরু করেন ঈশিতার উপর। বলেন,”এটা তুমি কি করলে ঈশিতা? তোমাকে আমার কত পছন্দ ছিল জানো? আমার ছেলেও তো তোমাকে কত পছন্দ করত। তুমি শুধু শুধু পালিয়ে গিয়ে আমাদের পরিবারের ফেস লস করালে। এজন্য তোমার শ্বশুর এবং দাদি-শাশুড়ী তোমার উপর চটে আছেন। আমারও রাগ হচ্ছে। শুধুমাত্র আয়ুশের মুখের দিকে তাকিয়ে আমি সবটা মেনে নিচ্ছি। আয়ুশ আমাকে সবটাই বলেছে তোমার ব্যাপারে। দেখো, মানুষের জন্ম-মৃত্যু সব আল্লাহর হাতে। তোমার মায়ের যতটুকু আয়ু ছিল তিনি ততটুকুই বেঁচে ছিলেন। হয়তো তার মৃত্যুর আগে যা ঘটেছিল সব উছিলা মাত্র। তুমি এরজন্য শুধু শুধু আমার ছেলেটাকে ভুল বুঝছ।”

ঈশিতা প্রতিত্তোরে কিছু বলে না। জাহানারা বেগম ঈশিতার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,”এখন থেকে আমি তোমার শাশুড়ী। শাশুড়ী কিন্তু মায়ের মতোই হয়৷ তুমি আমাকে নিজের মা মনে করতে পারো। আয়ুশের সাথে কোন ঝামেলা বাড়িও না। স্বাভাবিক স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক বজায় রেখো। আর একটা কথা, ঐ ঐশী মেয়েটা আছে না ওর থেকে দূরে থাকবে এবং আয়ুশকেও ওর থেকে দূরে রাখবে। ও একটা বিষাক্ত কালনাগিনী।”

জাহানারা বেগমের কথা শুনে কিছুটা অবাক হয়ে গেলো ঈশিতা। ঐশী মেয়েটাকে যতটা দেখেছে তার তো খারাপ মনে হয়নি। মেয়েটার পায়ে সমস্যা, ক্রাচ সাথে করে হাঁটে। ঐশীর কথা ভাবল ঈশিতা। সত্যিই কি মেয়েটা খারাপ নাকি? হতেও পারে। জাহানারা বেগম যখন বলছেন তখন এমনই হবে। এমনিতেও ঈশিতার সংসার করার কোন ইচ্ছা নেই। সে এই বিয়েটা শুধু নিজের মায়ের শেষ ইচ্ছা পূরণের জন্য করেছে। তবে তার সাথে কেউ বিনা কারণে কোন খারাপ কিছু করতে এলে ছেড়ে দেবে না একদম।

জাহানারা বেগম ঈশিতার কাছে ঐশীর নামে আরো অনেক খারাপ কথা বলতে থাকে। এতে করে ঐশীর প্রতি খারাপ ধারণা তৈরি হতে থাকে ঈশিতার।

~~~~~~~~~~~~
নামিরা, নাহিদ বসে বসে আয়ুশ-ঈশিতার বিয়ে নিয়েই কথা বলছিল। নামিরা তো ঈশিতাকে এক হাত নিচ্ছিল। বলছিল,”ঐ ঈশিতা মেয়েটাকে আমার একদম সুবিধার মনে হয় না। কিভাবে বিয়ের দিন পালিয়ে গেলো। আয়ুশ ভাইয়া যেন কেন ওকে বিয়ে করতে গেল আমি বুঝলাম না।”

সেই সময় ঐশী সেখানে এসে পড়ে। নামিরার কথা তার কর্ণগোচর হয়। সে বলে ওঠে,”কারো সম্পর্কে না জেনে এমন কথা বলা উচিৎ নয় আপু। হতেও পারে মেয়েটা কোন সমস্যায় পড়েছিল।”

ঐশীর কথা শুনে ভীষণ ভালো লাগে নাহিদের। ঐশীর ব্যবহার দেখে সে যেন আরো বেশি করে ঐশীর প্রতি দূর্বল হচ্ছে। এই ক’দিনে নাহিদ বুঝে গেছে ঐশী ভীষণ বুঝদার এবং ম্যাচিউর একটা মেয়ে। যা তার প্রতি মুগ্ধতা বাড়িয়ে দিচ্ছে।

এরইমাঝে আয়ুশ বসার ঘর অতিক্রম করে নিজের রুমের দিকে যাচ্ছিল। তাকে যেতে দেখেই নাহিদ উঠে গিয়ে পথ আটকে বলল,”কোথায় যাচ্ছ ব্রো?”

“কোথায় আবার? রুমে যাচ্ছি।”

“ও হ্যাঁ, আজ তো তোমাদের বাসর। যাইহোক, বিয়ের সাক্ষী তো হতে পারলাম না কিন্তু বাসর ঘরে যাওয়ার আগে আমাদের হাদিয়া তো দিয়ে যাও।”

“হাদিয়া মানে?”

“বেশি কিছু না। আমরা তিনজন আছি। তিনজনকে ৫ হাজার করে মোট ১৫ হাজার টাকা দাও।”

নামিরা বলে ওঠে,”নাহিদ কি করছিস? তুই কি ছোট বাচ্চা হয়ে গেলি নাকি?”

আয়ুশ বলে,”কোন ব্যাপার না। এই নে নাহিদ ১৫ হাজার টাকা। তিনজনে মিলে ভাগ করে নিস।”

বলেই আয়ুশ চলে যায় নিজের রুমের দিকে। আয়ুশ তো টাকা পেয়ে মহা খুশি৷ ঐশীর হাতে ৫ হাজার টাকা দিয়ে বলে,”এই নাও তোমার ভাগ।”

বলেই সে বাকি ১০ হাজার টাকা নিজের পকেটে ঢোকায়। নামিরা এসে বলে,”আমার ভাগ কোথায়?”

“তোর ভাগ নেই। খুব তো বলছিলি আমি বাচ্চামো করছি তো এখন টাকা নিতে এসেছিস কেন।”

এই নিয়ে দুই ভাই-বোনের মাঝে খুনশুটি শুরু হয়। এদিকে ঐশী টলমল চোখে আয়ুশের যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকে। তার প্রিয় মানুষটা আজ সম্পূর্ণরূপে অন্য কারো হয়ে যাবে। এটা মেনে নেওয়া যে ভীষণ কষ্টকর।

to be continue….