#আমি_মায়াবতী
#পর্ব_১১
#লেখনীতে_তাহমিনা_মিনা
ভোররাত, পাখির কলকাকলিতে মুখরিত পরিবেশ। দূর থেকে ভেসে আসছে মুয়াজ্জিনের আজানের ধ্বনি। ধড়ফড়িয়ে উঠলাম আমি। জানালা টা খুলে দিলাম। শা শা করে ঠান্ডা বাতাস বইতে শুরু করলো পুরো রুম জুড়ে। পাশে তাকিয়ে দেখলাম সাবিহা হাত-পা ছড়িয়ে এখনও শুয়ে আছে। ওর শোয়া ভীষণ রকম বাজে। হুটহাট শরীরের উপর হাত পা তুলে দেয়। প্রথম প্রথম আমার ঘুম হতো না। ভেঙে যেতো ঘুম। এখন গা সওয়া হয়ে গেছে। আমি উঠে ফ্রেশ হয়ে অজু করে নিলাম। গতকাল রাতে সাবিহা পইপই করে বলে দিয়েছে যেন আজকে ওকে ডেকে দিই নামাজের জন্য। মেয়েটা ভীষণ ঘুমকাতুরে। সকালের নামাজটা প্রায়ই মিস করে। কিন্তু সে এইবার থেকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, এখন থেকে ফজরের নামাজটা পড়বেই পড়বে। যেকোনো ভাবে যেন আমি তার ঘুম ভাঙিয়ে দিই। দরকার পড়লে যেন তার শরীরে পানি ঢেলে দিই। কিন্তু আম্মা ওকে একটা বড়সড় ধমক দিয়েছে। আমাকে মানা করেছে এইরকম পাগলামি যেন না করি আমি। তাহলে তো বিছানা ভিজে যাবে। সেটা তো আম্মাকেই পরিষ্কার করতে হবে। আম্মার কথা শুনে মুখ গোমড়া করে সাবিহা বলেছিল,” আপু, তুমি তাহলে হালকা পানিরই ছিটা দিও। বেশি দিও না। তাহলে আবার একটুখানি ভিজলেও তো সমস্যা। ”
আমি সাবিহাকে ডাকলাম। ওর কোনো সাড়া নেই। ঘুমের মধ্যে বিড়বিড় করে কি যেন বললো৷ বুঝলাম না। ইচ্ছে হলো ওকে তুলে আছাড় মারি। কিন্তু উপায় নাই। উল্টো ওর কান্না শুনতে হবে। বাবা ওকে আদর না করা পর্যন্ত ওর কান্না থামবে না। কিন্তু এখন বাবা বাসায় নেই। ঢাকার বাইরে আছে। তাই হুট করে ওকে নিয়ে এইরকম সিদ্ধান্ত নেওয়াটা ঠিক হবে না। আবার ওকে ঘুম থেকে না ডেকে দিলেও ও অনেক রাগারাগি করবে। আমার সাথে, আম্মার সাথেও করবে। আম্মার একটা রামধমক না খাওয়া পর্যন্ত সেটা থামবে না। আমি সাবিহাকে আস্তে করে ডাকলাম,”সাবু, উঠে পড়। আম্মা না হলে কিন্তু তোকে অনেক বকা দিবেরে।”
কোনো নড়নচড়ন নেই। ও আজও বকা খাবে। আজকে ওকে ডেকে আমার মোড নষ্ট করতে ইচ্ছে হলো না। কারণ, আজকে আমার প্রথম কলেজে যেতে হবে। আজকের দিনে সকাল থেকে আমি ওর সাথে ঝগড়া করতে চাইছি না।আমি ধীর পায়ে উঠে নামাজ শেষ করে কিচেনের দিকে গেলাম। দেখলাম আম্মা ইতোমধ্যে চা বানিয়ে ফেলেছে। আমাকে দেখে মুচকি একটা হাসি দিয়ে বললো,” আজকেও উঠেনি?”
“উহু।”
“মেয়েটা বড্ড ঘুমকাতুরে। ওকে নিয়ে যে কি করি বুঝতে পারছি না। কিছুদিন পরেই পরীক্ষা দিবে। জানো, আমার মা আমার চুল টেনে ঘুম থেকে উঠাতো। আমাকে কেন, আমার সব ভাইবোনকে। না উঠলে কি কি যে করতো, বলার বাইরে। এখনকার বাচ্চাদের লাই দিতে দিতে মাথায় উঠায়ে ফেলছি আমরা। আগে থেকেই যদি এই অভ্যাস করতাম, তাহলে আজ আর এইরকম হতো না।”
“হুমম। তা অবশ্য ঠিক। তবে, আগেরদিনে তো মানুষ ঘুমাতোও আগে। তাই ঘুমও ভাঙতো তাড়াতাড়ি। এখন তো ঘুমায় ও পরে৷ তাই উঠেও পরে।”
“হুমম, তাই তো। আর এর কারণ টা কি?মোবাইল। হ্যাঁ… ঐটা পেলে তো আর দিন দুনিয়ার খবর থাকে না। রাতের পর তার জেগে মোবাইল টিপা শুধু। আর ফলাফল কী?চোখের নিচে কালি পড়া ছাড়া আর কি তেমন কোনো লাভ হয়?আমাকে বলো তো মায়া।”
আমি মিটিমিটি হাসতে থাকলাম। এইগুলো আম্মার প্রতিদিনের ভাষণ। এতো আমলে নেওয়ার কিছু হয়নি।
“আজই তোমার বাবাকে বলবো ওর থেকে মোবাইল টা নিয়ে নিতে। পড়ে তো মাত্র ক্লাস এইটে।আর এখনই কিসের মোবাইল?চোখের নিচে কালি জমে আছে। বেয়াদব একটা মেয়ে।”
আমার মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। কেন খারাপ হলো জানিনা।কিংবা হয়তো জানি। কিন্তু স্বীকার করতে চাইনা। আমি চা নিয়ে আমার রুমে চলে এলাম। ঘুমন্ত সাবিহার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। ওর মোবাইল যেদিন নিয়ে যায়, সেদিন কি কান্নাটাই না করে৷ পুরো বাসা মাথায় তুলে নেয়। বাবা না আসা পর্যন্ত আম্মা মোবাইল দেয় না। আমার কী ওর প্রতি হিংসা হচ্ছে? হিংসা কেন হচ্ছে?আমার তো ভালোই। আমি সারাদিন সারারাত মোবাইল টিপলেও তো আম্মা আমাকে কিছু বলে না। বড়জোর বলে যে ঘুমিয়ে পড়ো মায়া। বেশি রাত জাগা ভালো না।
আমি বাইরে তাকালাম। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখার অনুভূতিই আলাদা। আমি আজ কলেজে যাব। ভাবতেই ভালো লাগছে। ভালো রেজাল্ট করে স্কুল শেষ করেছি। ভালো কলেজে ভর্তি হয়েছি। মা কে ভীষণ মনে পড়ছে। গত ১ বছরে সবকিছুই পরিবর্তন হয়ে গেছে। আমি এখন এই পরিবারেরই একটা অংশ। আসলেই কি তাই? হয়তো। আমিও এখন বাবার আদরের মেয়ে। আম্মাও আমাকে ভালোবাসেন। সাব্বির আর সাবিহার চলার সাথী। আমাকে ছাড়া ওরা একটা দিনও এখন কল্পনা করতে পারে না। এসএসসি শেষে আমি আমার নানাবাড়ীতে গিয়েছিলাম। সাব্বিরের কান্নায় বাবা বাধ্য হয়েছিল তার পরদিনই ওকে নিয়ে আমার নানাবাড়ি যেতে। মাত্র ২ দিন থেকেছিলাম সেখানে। নানা-নানি আমাকে অনেকদিন পর কাছে পেয়েও এতো তাড়াতাড়ি আসতে দিয়েও খুশি ছিল। অনেক খুশি ছিল। কারণ, তারা বুঝেছিল, আমি ভালোই আছি। হ্যাঁ, আমি ভালোই আছি। অনেক ভালো আছি।এই বাসাটা আর আগের মতো নিশ্চুপ থাকে না। স্কুলে যাওয়ার সময়ও গাড়িতে হৈ-হুল্লোড় হয়। আমি অবাক হয়ে দেখি, সাবিহা নামের যে মেয়েটার কাছে আমি একদিন উড়ে এসে জুড়ে বসা একটা ফালতু মেয়ে ছিলাম, সেই মেয়েটার কাছেই আমি এখন তার সেরা বন্ধু। সাব্বিরও আগের চাইতে বেশি রেস্পন্স করছে সবকিছুতে। আম্মা চাইলেই এখন আবার চাকরি করতে পারে, কিন্তু কেন যেন করে না। আর বাবা, আমি এখন তার চোখের মণি।
কিন্তু আসলেই কি আমি ভালো আছি? কিংবা তারাই কি আমাকে পরিবারের সদস্য হিসেবে মেনে নিয়েছেন? বাবার ভালোবাসাটা আমার কাছে কেন যেন অতিরিক্ত রকমের বাড়াবাড়ি মনে হয়। যেন মনে হয় আমাকে জোর করে ভালোবাসার চেষ্টা করছে। আর আম্মা? সে কী আসলেই আমাকে এখন নিজের সন্তানের মতো ভেবেছে? নাকি ভাবতে পেরেছে? আয়নায় নিজের চোখের দিকে তাকালাম। দেখলাম আমার চোখের নিচেও অনেক কালি জমেছে। পরীক্ষার জন্য রাত জেগে পড়েছি আর আম্মার বকা খাওয়ার জন্য মোবাইল টিপেছি। কই, আমাকে তো আম্মা বকে না? আমাকে কেন শুধু আদর করে? আমি তো এমন আদর চাইনা। আমি চাই আমাকেও সাব্বির আর সাবিহার মতো বকা দিক। আমাকেও বাকিদের মতোই দেখুক। আমি আম্মার শখের জিনিসটাও নষ্ট করলে আমাকে কিছুই বলবে না। কিন্তু ওরা দুইজন একটা সামান্য গ্লাস ভাঙলেও ওদের বকবে। আমরা ৩ ভাই বোন কোনো কিছুর জন্য পার্মিশন নিতে গেলে ওরা আমাকে পাঠায় আম্মার কাছে। কারণ, ওরা জানে আমি যাই চাই না কেন, আম্মা আমাকে দিবে।ওরা কি জানে, আমি এমনটা চাই না? আমি চাই আম্মা আমাকেও শাসন করুক। দরকার পড়লে মারুক। কিন্তু আমি এমন ভালোবাসা চাই না, যেখানে শাসন নেই।
“আমাকে ডাকো নি কেন আপু?”
বিছানার দিকে তাকিয়ে দেখলাম,সাবিহা উঠে চোখ ডলছে। আমি ওকে বললাম,” ডেকেছিলাম তোকে। তুইই জাগিস নি। সেটা কি আমার দোষ?”
“আম্মা এখন আমাকে মারবে।”
” মারবে না। যা, এখন ফ্রেশ হয়ে নে।”
ভাবা যায়, আমরা এখন একই রুমে,একই খাটে ঘুমুচ্ছি।অথচ আগে….
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে দেখলাম সেটা ঠান্ডা হয়ে গেছে। সেটা আর গরম করার ইচ্ছে নেই এখন। ঢকঢক করে পুরোটা খেয়ে নিলাম। এটাকে অবশ্য চা বলেনা। এইটাকে শরবত বলা চলে।
★★★
“আজকে থেকে তোমাকে তো আলাদা যেতে হবে, মায়া। আজকে অবশ্য তোমার সাথে আমি যাব। প্রতিদিন রিকশায় যেতে তোমার অসুবিধা হবে না তো?”
” হবে না আম্মা।”
” তোমাকে অনেক মিস করবো আপু।” পরোটা চিবুতে চিবুতে বললো সাব্বির।
“আমিও মিস করবো তোকে।”
“বাবা কবে আসবে মা?” সাবিহা বললো।
“মনে হয় কালকে বা পরশু। কথা না বলে খাবার খাও। বাবা আসলেই তো মজা, তাইনা?”
“ভয় লাগছে, মায়া?”
“না, আম্মা।”
“আজ হয়তো তোমাদের বরণ করে নিবে। ছোটখাটো একটা অনুষ্ঠান হবে হয়তো।”
“হুমম। আমারও তাই মনে হচ্ছে। ”
“আমাকে তো ভিতরে ঢুকতে দিবে না মায়া। তোমাকে একাই যেতে হবে।”
” আচ্ছা, তুমি তাহলে চলে যাও আম্মা। আমি ভিতরে ঢুকি।”
“আচ্ছা, ভয় পেও না। আমি ছুটির আগেই গাড়ি নিয়ে চলে আসবো। আমাকে না পেলে ভয় পেও না যেন আবার।”
“আচ্ছা, আম্মা।”
আমি ভিতরে না ঢুকা পর্যন্ত আম্মা গেল না। ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। আমার মায়ের কথা মনে পড়ে গেল। মাও হয়তো এইভাবে থাকতো আজ। তবে, সেটা হয়তো গভীর মমতা নিয়ে। আর আম্মা হয়তো নিজের দায়িত্ববোধের জন্য থেকেছে। কি-জানি, উনিও হয়তো আমাকে ভালোবাসেন।
আমি ভিতরে গিয়ে দেখলাম, ছোটখাটো না, বেশ ভালোই আয়োজন হচ্ছে। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম। কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। কাউকেই চিনি না এইখানে। হঠাৎ মনে হলো পেছনে থেকে কেউ আমাকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। আমি ভয়ে ভয়ে পিছনে ফিরতেই যাকে দেখলাম, তাতে আমার বুক কেঁপে উঠলো। এই মানুষটাকে দেখার জন্য আমি কতদিন ধরে অপেক্ষা করছি। কত কথা ভেবে রেখেছি। অথচ আজ তাকে এতোটা কাছে দেখেও যেন বিশ্বাস করতে পারছি না। কি বলবো সব যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। আচ্ছা, কথা এলোমেলো হচ্ছে, নাকি আমি নিজে?
চলবে….
#আমি_মায়াবতী
#পর্ব_১২
#লেখনীতে_তাহমিনা_মিনা
“এখানে কি করছো, মায়া?”
“জ্বি…না..মানে…আসলে আমি।”
“কি মানে মানে করছো, এখানে কেন এসেছো, সেই প্রশ্ন করেছি। কোনো কঠিন প্রশ্ন তো ধরিনি সেদিনের মতো যে আমতা-আমতা করবে।”
“আসলে আমি এই কলেজে ভর্তি হয়েছি।”
“এই কলেজে?”
“হুমম। আপনি এখানে কি করছেন? কোনো কাজে এসেছেন?”
সামনে থাকা মানুষটি আমার প্রশ্নের জবাব দিল না। আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো, ” সারা বাংলাদেশে কি তুমি আর কোনো কলেজ পাওনি ভর্তি হওয়ার জন্য? তোমাকে আমার ছাত্রীই হতে হলো?”
আমি থতমত খেয়ে বললাম, “মানে? আপনি এই কলেজের শিক্ষক?”
“হুমম। ”
“আমি আর আগের মতো বাজে স্টুডেন্ট নই, স্যার। আমার এসএসসির রেজাল্ট ভালোই এসেছে।”
সে চোখ বড় বড় করে বললো,” ও আল্লাহ তাই?আমাকে আগে বলবেন না? তাহলে আপনাকে সম্মান দিয়ে কথা বলতাম।”
আমার ভীষণ খারাপ লাগলো উনার কথা শুনে। শত হোক, উনি এখন আমার টিচার। আমি কাঁচুমাচু করে বললাম,”স্যরি স্যার, আমি আসলে বলতে চাইছিলাম যে আমি এখন আর….।”
“থাক, আর বলতে হবে না আপনাকে। আপনি ঐখানে গিয়ে বসুন। আপনাদের সাদরে বরণ করা হবে।”
উনি আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই গটগট করে হেঁটে সামনে চলে গেল। আমি আশা করিনি যে প্রথম দিনেই এইরকম পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে যাব আমি। ধীর পায়ে আমি এগিয়ে গেলাম একটা চেয়ারের দিকে। ভাবতে লাগলাম, সেই দিনের কথা। ঢাকার শহরের ছেলেমেয়েরা যে আমাদের সেই ছোট্ট মফস্বল শহরের থেকে সবদিক থেকেই এগিয়ে, সেটা স্কুলে ভর্তি হওয়ার পরেই বুঝেছিলাম। আম্মা আমাকে বাসায় প্রাইভেট টিউটর দিয়েছিল। আমি বন্ধুদের কথায় বাইরেও কোচিং করতাম। কোচিং এ কয়েকদিন এক ভাইয়া অসুস্থ থাকায়, ভাইয়ার অনুপস্থিতিতে উনাকে পাঠিয়েছিল। উনি এসেই আমাকে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করলেও, আমি একটা প্রশ্নেরও জবাব দিতে পারিনি। যার কারণে আমাকে অনেক অপমান করেন তিনি। আমাকে বলেছিল ভবিষ্যতে কি হতে চাই। আমিও বলেছিলাম ডাক্তার। উনি শ্লেষাত্মক হাসি দিয়ে বলেছিল,”এই পড়াশোনায় ডাক্তার তো দূর,পাশই করতে পারবে না তুমি।”
উনার এই কয়েকটি কথাই আমাকে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করেছিল। আবেগ আর দুঃখকে সাইডে সরিয়ে পড়াশোনা করেছি শুধু। পরবর্তীতে আমি নিজেই বুঝেছিলাম উনি ঠিক কথাই বলেছিলেন। উনি সেইদিন যদি এইসব কথা না বলতেন, তাহলে হয়তো আমি আজ এই কলেজে পরীক্ষা দিয়ে ভর্তি হওয়া তো দূর, পরীক্ষা দেওয়ার মতো পয়েন্টও থাকতো না আমার। অনেক খুঁজেছিলাম আমি ওনাকে। কিন্তু পাইনি। আজ এতোদিন বাদে ওনাকে দেখলাম অথচ কি তিক্ততা ভরা কথা শুনিয়ে দিয়ে গেল আমাকে। কেমন মানুষ উনি? যেহেতু দেখলেন যে আজ আমার কলেজে প্রথম দিন, আজ কি অন্তত পক্ষে আমার সাথে একটু ভালো ব্যবহার করতে পারতেন না?
“এই মেয়ে, তুমি কি নতুন?”
আমি হকচকিয়ে উঠে দেখলাম আমার পাশে একটা মেয়ে বসে আছে। আমি তাড়াহুড়ো করে বললাম,”হ্যাঁ, আমি নতুন এসেছি।”
“আমিও নতুন এসেছি।কি নাম তোমার?”
“মায়া। তোমার নাম কি?”
“কবিতা।”
“বাহ, খুব সুন্দর নাম তো তোমার।”
“তোমার নামও খুব সুন্দর মায়া। তোমার চেহারায়ও মায়া মায়া ভাব আছে অনেক।”
“তোমার বাসায় কে কে আছেন কবিতা?”
“আমি,মা,বাবা আর ভাইয়া। তোমার বাসায় কে কে আছেন?”
আমার ঈশার কথা মনে পড়ে গেল। ও একদিন আমাকে এইভাবেই জিজ্ঞেস করেছিল। আমিও সরল মনে সব বলে দিয়েছিলাম। নাহ,এইবার আর ভুল করছি না আমি। এখন এইটা আমারও পরিবার। আমিও ওকে বললাম,”আমি,মা, বাব, আর দুটো ছোট ভাই-বোন। ”
“তুমি বড়?”
“হুমম। কেন বলো তো?”
“বড় হলে খুব সুবিধা তাইনা?”
“মানে?”
“আরেহ, জানোনা তুমি। আমার বড় ভাইয়াটা একদম বজ্জাত। ও যাই বলে, আমাকে তাই করতে হবে। বাবা-মাও সবসময়ই ওর সাপোর্ট নেয়। সবসময়ই। ও যা করে তাই ভালো, আর আমি যা করি, তাই ভুল।”
“তাহলে তো তুমি দেখছি সত্যিই অনেক ঝামেলায় আছো। ”
“হুমম। অনেক ঝামেলা।”
কবিতা নামের এই বাচাল মেয়েটার সাথে আমার কিছু সময়ের মধ্যেই ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেল। কিন্তু ওর অতিরিক্ত কথার জন্য আমি একটা সময় হাপিয়ে উঠলাম। তারপর ও যতো যাই বললো, আমি শুধু হা হু করেই উত্তর দিলাম।
★★★
“আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে বাজে মানুষ হচ্ছে এই টিচার।” ফিসফিস করে বললো কবিতা।
আমি ওর দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললাম,”কেন,উনি তোমাকে কি করেছে?”
“অনেক বাজে মানুষ উনি। অনেক বাজে।”
“বুঝলাম,কিন্তু উনি কি করেছেন তোমাকে? কি ক্ষতি করেছেন তোমার?”
“আমার অস্তিত্বকেই সে মানে না। বুঝলে?”
“মানে কি?”
“এই যে পিছনের দিকের দুই মিস। আপনাদেরকে বলছি। আপনাদের কি আনাকে টিচার টিচার মনে হচ্ছে না?”
আমি সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটির দিকে তাকালাম। আড়চোখে তাকিয়ে দেখলাম, ক্লাসের সব স্টুডেন্টই আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি মাথা নিচু করে বললাম,”স্যরি,স্যার।”
“এইটাই প্রথম আর শেষ ওয়ার্নিং দিচ্ছি তোমাদের। আমার ক্লাসে কেউ কোনো কথা বলবে না। না মানে না। আমি পড়ানোর পর কিছু না বুঝলে জিজ্ঞেস করবে। কিন্তু কানাকানি কথা আমি পছন্দ করি না। বুঝাতে পারলাম?”
“হুমম। ”
ক্লাস শেষে স্যার চলে যেতেই কবিতা স্যার এর যাওয়ার পানে তাকিয়ে একটা মুখ ভেঙচি দিল। আমি ওর মুখ আটকে ধরে বললাম,” আরেহ, করছো কি? মরবে নাকি তুমি? কেউ ওনাকে বলে দিলে কি হবে? নিজে তো মরবেই আমাকে সাথে নিয়ে মরবে।”
“আরেহ, এই টিচার আমার কি করতে পারবে? আমি দাদাকে বললেই দাদা আমাকে এর হাত থেকে বাঁচাবে। আর তুমি একদম চিন্তা করো না। আমি থাকতে এই বজ্জাত টা তোমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।”
“কি বলছো এইসব? উনাকে গালি দিচ্ছো কেন? উনি তো আমাদের শিক্ষক।”
“শিক্ষক না কচু, এই হচ্ছে আমার বজ্জাত বড় ভাই। কাব্য।”
আমি অবাক হয়ে রইলাম। এই জন্যই দুইজনের নামের মধ্যে এতো মিল? আমি কবিতার চেহারার দিকে তাকিয়ে দেখলাম, দুইজনের চেহারায়ও অনেক মিল আছে। আমি অবাক হয়ে দেখলাম, দুইজনের কর্মের মধ্যে পুরো আসমান-জমিন তফাত।
★★★
আজকের দিনেও যে এই ঝামেলা সহ্য করতে হবে,সেটা স্বপ্নেও ভাবিনি। আমি চুপ করে খাটের মধ্যে বসে আছি। সাবিহা মুখ গোমড়া করে আছে জানালার পাশে। ও একবার বারান্দায় যাচ্ছে আবার ঘরে আসছে। আর আমাকে বারবার বলছে,”তুমি ভুলেও ঘরের বাইরে যাবে না। বলে দিচ্ছি আমি।”
সাব্বির ঘরের মাঝে চেয়ারে বসে আমাদেরকে দেখছে। ও আগে বুঝতে না পারলেও এখন বুঝে এখানে কি হচ্ছে। ঘটনা হচ্ছে, সাবিহার মামী এসেছে। তবে সে একা আসেনি, সাথে নিয়ে এসেছে নিজের ভাইয়ের একমাত্র ছেলেকে। উদ্দেশ্য একটাই। আমার সাথে নাকি তার ভাইয়ের ছেলেকে খুব মানাবে। আমাকে তার ভাইয়ের ছেলের জন্য নিবে। তার ভাইয়ের ছেলের মতো নাকি ছেলেই হয়না। কিন্তু আমরা ভালো মতোই জানি সে কেমন ছেলে। এর আগেও একটা বিয়ে করেছিল। অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে সেই বউ চলে গেছে।এখন এসেছে আমার পিছনে। আজ বাবা বাসায় না থাকায়, সে সুযোগে এসেছে আমাকে মানাতে। আম্মা অবশ্য আমাদের তিনজনকেই এক রুমে থাকতে বলেছে। সাবিহা কিছুক্ষণ পরপর সাপের মতো ফুঁসছে। কোনো এক কারণে ও ওর নানাবাড়ির মানুষদের পছন্দ করে না। আগে থেকেই করে না। এরপর যখন আবার আমার বিয়ের কথা উঠেছে, ও যেন রণমুর্তি হয়ে উঠেছে। কিছুক্ষণ পরপর আমাকে বলছে যে বাবাকে কল দিতে। আমিই নিষেধ করেছি। বাবার কাজের ক্ষেত্রে আমি কোনো ঝামেলা করতে চাই না। বাবাকে জানালে হয়তো বাবা আজই কাজ রেখে চলে আসবে। আম্মা কিছুক্ষণ আগে বলেছে ওদেরকে কোনোভাবে আজকেই বিদেয় করবে।কিন্তু এখন এসে বললো,”মায়া, ওরা মনে হয় আজকে যাবে না। আমাদের বাসায় থাকবে। তোমরা রুমেই থাকো। আমি খাবার দিয়ে যাচ্ছি।”
রুমে খাবার দিলেও কোনো লাভ হলো না। একটু পর মামী এসে হাজির। কোনো কথা না বলে আমার কাছে এসে আমার চুলে হাত ডুবিয়ে দিয়ে বললো,”মাশাল্লাহ , তোমার চুল তো অনেক বড় হয়ে গেছে। একটু ডিম,দুধ ও খেয়ো। শরীরে শক্তি পাবে। যে শুকনা তুমি। হ্যাঁ রে সাগরিকা,খাওয়াস না মেয়েটাকে?”
আমি, আম্মা সবাই চুপ করে রইলাম। মামী আবার বললো,” তোমার এই বাড়িতে সমস্যা হয় বুঝতে পারছি। শুনো, আমার ভাইয়ের ছেলেটা কিন্তু মানুষ হিসেবে খারাপ না। ও তোমাকে অনেক পছন্দ করেছে। না হলে তোমার চাইতেও কত সুন্দরী মেয়ে ওর পিছে পিছে ঘুরে। নেহাৎ তোমাকে মনে ধরেছে, তাই তোমাকেই চাইছে। আমি বলি কি মা, তুমি বিয়েতে রাজি হয়ে যাও। আমার ভাইপুও রাজি। মিয়া বিবি রাজি,তো কিয়া কারেগা কাজি?” বলেই হোহো করে হাসতে লাগলো।
সাবিহা ধরাম করে বললো,” আপনার মেয়েও তো মাশাল্লাহ অনেক সুন্দরী মামী। আপনার ভাইপুর মতো এতো গুনধর ছেলেকে কেন হাতছাড়া করছেন? আমার বোনকে প্রয়োজন হলে রিকশাওয়ালার কাছে বিয়ে দিব। তাও আপনার ভাইপুর কাছে না।”
“আহ,সাবিহা। কি হচ্ছে? মামী হয় না তোমার?” আম্মা ধমকে উঠে সাবিহাকে।
মামী অপমানবোধ করলে সেখান থেকে উঠে চলে যায়।আম্মা আমাকে বলে,” মায়া। আজ তিন ভাই-বোন একসাথে থাকো। কোনো কিছু লাগলে ঘর থেকে বের হয়ো না। ওনারা কিন্তু বাসায়ই থাকবেন।”
★★★
আমার কখনোই রাতে পানি পিপাসা পায় না। কিন্তু আজকে পাচ্ছে। আম্মা বলে গেছে বের না হতে। আম্মাকে ডাকতে। আম্মাকে জোরে জোরে ডাকলেও আম্মার সাড়া না পেয়ে একাই বের হলাম পানি নিতে। ডাইনিং রুমে পুরোই অন্ধকার।আমি ভয়ে ভয়ে টেবিলে হাতড়ে জগ খুঁজলাম। গ্লাসে পানি ভরে যখন পানি মুখে নিতে যাবো, তখনই কোনো একজন লোকের বলিষ্ঠ হাত আমাকে দুহাতে আঁকড়ে ধরলো। আর সাথে সাথেই লাইট জ্বলে উঠলো। মামী লাইট জ্বালিয়েছে।মামীকে দেখলাম কেমন করে হাসছে। আম্মাও নিজের ঘর থেকে বের হয়ে এসেছে। আম্মাকে দেখে মামী খুব বাজেভাবে হেসে বললো,”কিরে, তোর সতীনের মেয়ের না আমার ভাইপুকে পছন্দ না? তাহলে রাতের আঁধারে এইসব কি করছে?”
আমি ভয়ে জমে গেলাম। আম্মা কি আমাকে ভুল বুঝবে এইবার? আমি কিভাবে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করবো?
চলবে…..