আমি মায়াবতী পর্ব-১৫+১৬

0
443

#আমি_মায়াবতী
#পর্ব_১৫
#লেখনীতে_তাহমিনা_মিনা

কবিতা ঘুমন্ত মায়ার কাছে গিয়ে বললো,”হ্যাঁ গো মায়া, তুমি তো বলেছিলে আমার বাসায় বেড়াতে আসতে তোমার বাবা-মায়ের পার্মিশন লাগবে। এখন তো কারো পার্মিশন না নিয়েই বিনা নোটিশ এ আমাদের বাড়িতে সারাজীবনের জন্য চলে আসলি।”
কাব্য অবাক হয়ে তার মা আর বোনের দিকে তাকিয়ে রইলো। তার বোন আসলেই তার মায়ের মতো হয়েছে। দুইজনই একইরকম। কোনোকিছু না জেনেশুনে একা একাই সবকিছু ভেবে নিয়েছে।
“ভাইয়া শোন, বিয়ে তোরা যেভাবেই করিস না কেন, তোদের কিন্তু আবার বিয়ে হবে। রিসিপশনের অনুষ্ঠানে আমি কিন্তু খুব করে সাজবো। আমাকে একদম ডানা কাটা পরির মতো লাগতেই হবে। গায়ে হলুদ এর দিন আমি শাড়ি পড়বো, বিয়ের দিন কুর্তি আর বৌভাতের দিন ল্যাহেঙা।আর শোন, তুই কিন্তু শেরোয়ানিটা মোটেও সাদা রঙের পড়বি না। বুঝলি?”
“হ্যাঁ রে কাব্য,বাবা আমার, ওর বাবা মাকে কষ্ট দিয়ে কিভাবে নিয়ে আসলি ওকে? তোর বাবাকে বলতে না পারলে আমাকে আগে বলতি৷ প্রয়োজন হলে আমি নিজে আজই তোকে বিয়ে করিয়ে আনতাম। এখন তোর বাবাকে আমি কিভাবে এতো সহজে মানিয়ে নিব?আর তোর নানী আর খালা? তোর খালা তো ভেবেই রেখেছে তার মেয়ের সাথে তোর বিয়ে দিবে। আমি অবশ্য ওকে কোনো কথা দিইনি। আর তোর কাকার মেয়ে সোনালী, সে তো তোকে স্বামী ভেবেই বসে আছে। আর তুই কাউকে কিছু না জানিয়ে হুট করে বিয়ে করে ফেললি। আমি কিভাবে যে এতোকিছু সামলাবো বুঝতে পারছিনা।”
“উফফ, মা। ওদের কথা রাখো তো। ফালতু একটা মেয়ে সোনালী। আমি মরে গেলেও ওকে নিজের ভাবী বলে মেনে নিব না। আর রইলো রিশা, তুমি জানো ওর বয়ফ্রেন্ড আছে? খালা বললো ওকে তোমার ছেলের বউ বানাবে, আর আমরা মানবো নাকি?”
কাব্য দুহাতে কান চেপে ধরলো। মা আর বোনের কথার অত্যাচারে সে এখানে টিকতে পারবে না সে বুঝতে পেরেছে। সে কিছু বলতেও পারবে না। বললেও এরা বুঝতে পারবে না। কাব্য বের হওয়ার পরেই ঘরে ঢুকলো কাব্যর বন্ধু নিবিড়। নিবিড়কে দেখেই কবিতা চুপ হয়ে যায়। এই ছেলেটাকে দেখলে তার কি হয় কে জানে। সে যেন কথা বলতে ভুলে যায়। থমকে যায় তার পৃথিবী। কবিতার মা এগিয়ে এসে নিবিড়কে বলে,”বাবা, তুমিও সব জানো নাকি? ও এইরকম একটা কাজ কিভাবে করলো?ও আমাকে না জানাক, তুমি তো আমাকে জানাবা। ”
“কি জানাবো আন্টি?”
“আরেহ, কাব্য যে বিয়ে করে এনেছে সেটা।”
“কাব্য?আর বিয়ে?কাকে?”
“ওমা?তুমিও জানো না?হায় আল্লাহ, তোমাকেও জানায়নি। আমি মানছি ওরা হয়তো একে অন্যকে পছন্দ করে কিন্তু তাই বলে কি আমাদের না জানিয়েই এমন একটা কাজ করে ফেলবে? মেয়েটার বাবা-মাও নিশ্চয়ই এতোক্ষণে ওকে খোঁজাখুঁজি শুরু করে দিয়েছে। আমাদের উচিত এখন ওনাদের এখানে নিয়ে আসা। তোমার কাছে কি মায়ার বাবা-মায়ের নাম্বার আছে?তোমার কাছে থাকলে তুমি কল দাও। না হলে কাব্যকে দিতে বলো।”
“আন্টি, এইসব কি বলছেন?কাব্য মায়াকে বিয়ে করেনি। মায়াকে কিডন্যাপ করা হয়েছিল। আমরা উদ্ধার করে এনেছি।”
এতোক্ষণ কবিতা চুপ ছিল। কিন্তু সে হঠাৎ লাফিয়ে সামনে এসে বললো,”কিহ? মায়াকে ভাইয়া বিয়ে করেনি?তাহলে কি হবে?”
“কি হবে আবার?”
কবিতার ভীষণ আফসোস হলো। কেন ভাইয়া মায়াকে বিয়ে করে আনেনি। কিন্তু পরক্ষণেই মায়ার কিডন্যাপ এর কথা মনে হতেই বললো,”মায়াকে কারা কিডন্যাপ করেছিল? ও কি ঠিক আছে?”
“হুমম। এখন ঠিক আছে। হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলাম। ঘুমের মেডিসিন দিয়ে রেখেছে। কখন ঘুম ভাঙবে কে জানে।”
“ওর বাসার মানুষকে জানিয়েছো বাবা?” কবিতার মা বললো।
“হ্যাঁ। ওর কাছে ফোন ছিল। সেখানে ওর বাবা-মা অনেক কল করছিল।৷ ওদেরকে জানানো হয়েছে। ওরা কিছুক্ষণ পরেই হয়তো চলে আসবে।”
“ওহ।” হতাশ গলায় বললো কবিতার মা। সে কি কি না ভেবে বসেছিল। আচ্ছা, এই মিষ্টি মেয়েটাকে তার বাবা-মায়ের কাছে চাইলে কি তার ছেলের বউ হিসেবে দিবে না?
★★★
ঘুম ভাঙতেই দেখলাম, আমি একটা অচেনা রুমে শুয়ে আছি। রুমে কেউ নেই। রুমটা বেশ গোছালো। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর বুঝতে পারলাম,এইটা একটা ছেলের ঘর। আমি উঠার চেষ্টা করলাম। কিন্তু পারলাম না। মাথায় প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব করলাম। বুঝতে চেষ্টা করলাম আমার সাথে কি হয়েছিল। ধীরে ধীরে মস্তিষ্ক সচল হতে লাগলো। মনে পড়তে লাগলো কি হয়েছিল আমার সাথে। রিকশাওয়ালা, কিডন্যাপার, কাব্য স্যার। উফফ, আর ভাবতে পারছি না আমি।
হুট করে দরজা দিয়ে কবিতা ঢুকে পড়লো। আমাকে চোখ খোলা দেখে চিৎকার করে বললো,”মা, ভাইয়া মায়া চোখ খুলেছে। ওর জ্ঞান ফিরেছে। তোমরা কই?”তারপর আমালর কাছে এসে বললো,”ভালো আছিস মায়া? জানিস, আমাদের জীবনটা না অদ্ভুত। না হলে কি আজই আমি তোকে দাওয়াত দিলাম। আর আর তুই বললি পার্মিশন নিবি বাসা থেকে। আর আজই তুই আমার বাসায় আসলি। তাও আবার আমার ভাইয়ের কোলে চড়ে।”বলেই হাহাহা করে হাসতে লাগলো।
আমার মাথা অনেক ঝিমঝিম করছে। সাব্বিরের কথা মনে পড়লো। আমি কবিতাকে জমি করলাম,”কবিতা, আমি বাসায় যাব। আমার ফোন কোথায়?আম্মা কেমন আছে?আমার ভাই কেমন আছে? বাবাও তো বাসায় নেই। সিলেট গেছে।আমি বাসায় যাব কবিতা।”

“তোমার বাবা কিছুক্ষণ পরেই আসবে মায়া। তোমার ভাই আর বোন হাসপাতালে ভর্তি। তোমার বোন ঠিকই আছে। কিন্তু তোমার ভাইয়ের হাত ভেঙে গেছে। তোমার আম্মাও সেখানে আছে।”
কবিতার কথার মাঝেই সেইখানে একজন মহিলা হাতে খাবার নিয়ে ঢুকলো। কবিতা বললো,”মায়া, উনি আমার মা।”
“মায়া, কেমন লাগছে এখন? জানি ভালো লাগছে না। মাথায় কি অনেক ব্যথা করছে?নাও,খাবারটা খেয়ে নাও। খেয়ে মেডিসিন নিতে হবে আবার।”
“আমি খাবো না আন্টি। আমি বাসায় যাব। আমার ভাই-বোনের কাছে যাব।”
“যাবে তো অবশ্যই। তোমার বাবা আসছে। বাবা আসলে তারপর যেও। এখন খাবার খেয়ে নাও।”
আমি অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও খাবার খেলাম। কিন্তু আমার মন পড়ে আছে আমার ভাই-বোনের কাছে।খাবার শেষ হলে কাব্য স্যার রুমে ঢুকলো মেডিসিন হাতে নিয়ে।উনাকে দেখেই আমার কেমন যেন লাগলো। উনি কি তখন সত্যিই ঐ কথা বলেছিল?নাকি আমিই ভুল শুনেছিলাম?কিজানি।
“ভাইয়া, মায়াকে তুই পেলি কিভাবে?আর মায়া যে কিডন্যাপ হয়েছে, সেটা কিভাবে বুঝলি?”
কাব্য একটা অপ্রস্তুত হয়ে গেল কবিতার কথা শুনে।কিন্তু দ্রুতই নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,”আসলে ওকে যে এলাকায় নিয়ে গিয়েছিল, তার কাছেই আমার এক ছাত্রের বাসা। আমি ওকে পড়াই। তখন দেখেছি। আর মায়াকে আমি সবসময় গাড়িতে আসা যাওয়া করতে দেখেছি। তাই ঐ রাস্তায় যেতে দেখলাম ওকে আবার রিকশা করে,ব্যাপারটা আমার স্বাভাবিক লাগছিল না। তাই পিছু নিয়েছিলাম।”
“ভালো করেছিস বাবা।”
“আমার বাবা কখন আসবে?”
কাব্য স্যার শান্ত গলায় বললো, “তোমার বাবা চলে আসবে মায়া। ততোক্ষণ শান্ত থাকো। মাথায় অনেক চোট পেয়েছো। আর এতো তাড়াতাড়ি করার কিছু নেই। তোমার বান্ধবীর বাসায়ই তো এইটা।”
★★★
হাসপাতালের করিডোরে বসে আছি আমি,সাবিহা আর আম্মা। বাবা আমাদের জন্য খাবার আনতে গেছে।সাবিহা আমার কাঁধে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেই চলেছে। আমরা সবাই চুপ করে আছি। কিন্তু সবার মনে একই কথাই ঘুরছে। গতবছর কক্সবাজারে গিয়েও এই একই কাহিনি ঘটেছে। আবার আজও। এই ঘটনাগুলো কি কাকতালীয়? নাহ, মোটেও কাকতালীয় নয়। কি হচ্ছে আমাদের সাথে আমরা বুঝতে পারছিনা। কিন্তু সেদিন শত দুঃখের পরও একটা বিষয় স্বাভাবিক হয়েছিল। সেটা হচ্ছে সাবিহা। ও আমাকে বোন হিসেবে হয়তো সেদিনই মেনে নিয়েছিল। কিন্তু সেদিন ঐ কিডন্যাপারদের হাতে রক্তাক্ত হয়েছিলাম। বাম হাতের কনুই এর নিচে কেটে গেছে অনেকটা। এখনও সেই দাগটা মিশে যায়নি। আবার এখন মাথায় আঘাত।
“আপু, সাব্বির কি ভালো হবে না?”
“হবে। অবশ্যই ভালো হবে। ”
“দেখো, আমার পা পায়ে ব্যথা পেয়েছি। অনেক ব্যথা করছে।”
আম্মা আমাদের কাছে এসে গভীর মমতায় দুজনকে আদর করে দিল। আম্মাও মাথায় আঘাত পেয়েছে। কিন্তু সন্তানের আঘাতটাই যেন তার কাছে বেশি বড়।
“আম্মা, তোমাদের এক্সিডেন্ট হলো কিভাবে?”
“জানিনা, মা। আমি ভালোভাবেই গাড়ি চালাচ্ছিলাম। কিন্তু কি থেকে কি হয়ে গেল জানি না।ওদের কিছু হয়ে গেলে আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারবোনা মা।”
“তোমার তো কোনো দোষ নেই মা। আমাকে যারা কিডন্যাপ করেছে, তারাই তোমাদের এক্সিডেন্ট করিয়েছে।”
আম্মা বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে বললো, “তুমি কিভাবে জানো?”
“ওরাই আমাকে বলেছে আপু।”
“কি বলছো এইসব?”
“হুমম। ”
“ওরা তো ধরা পড়েনি। পালিয়ে গিয়েছে। কোনো কিছুই জানতে পারবো না আমরা।” সাবিহা বললো।
“ওদের ধরেও কোনো লাভ নেই মা। ওরা শুধু গুটি মাত্র। এই সবকিছুর মাস্টারমাইন্ড অন্যকেউ। বুঝলে?”
“হুমম। ”
“আমরা কি পুলিশকে খবর দিব আম্মা?”
বাবা আমাদের কাছে এগিয়ে আসতে আসতে বললো,”না মায়া। বিষয়টা আরও ঘোলাটে হবে। আমি বাইরে গেলেই তোমাদের সাথে এইসব হয়। আমি আর কখনোই যাব না তোমাদের ছেড়ে অন্য শহরে।”
সাবিহা হুড়মুড়িয়ে বলে উঠে,”বাবা, আমি হয়তো জানি, এইসব কে করেছে।”
“কে করেছে?”
“মামী আর তার ভাইপো । আমি নিশ্চিত। ”

চলবে…

#আমি_মায়াবতী
#পর্ব_১৬
#লেখনীতে_তাহমিনা_মিনা

“সাবিহা, এইভাবে না জেনে না শুনে কাউকে দোষারোপ করা উচিত না। তোমাকে শিখাইনি আমি?”
“স্যরি,বাবা। কিন্তু আমার মনে হয়েছে ওরাই করেছে এইসব।”
“ওরা এইসব করেনি, সাবিহা।ওরা ওদের দেশের বাড়িতে ঘুরতে গেছে।”
“তুমি নিশ্চিত মা?”
“হুমম। একটু আগেই তোমার নানু কল দিয়েছিল। ওরা ওখানেই আছে।”
“আমি স্যরি মা। আমি ভেবেছিলাম ওরাই এইসব করেছে।”
“ব্যাপার না। আমাদের সামনে বলেছো ঠিক আছে। কিন্তু কখনোই আর অন্যের সামনে এইরকম অমূলক কথা বলবে না।”
“ওকে মা।”
“সাগরিকা, মেয়েদের নিয়ে তুমি বাসায় চলে যাও। আমি সাব্বির এর সাথে থাকি। তোমরা অনেক ক্লান্ত। ”
“তুমিও তো ক্লান্ত। ”
“তোমাদের মতো অসুস্থ তো আর না। কথা বাড়িও না। যাও,বাসায় যাও।”
★★★
“রাতের আকাশ কত সুন্দর হয়। তাইনা মায়া আপু?”
“হুমম। অনেক সুন্দর।”
“রিকশায় ঘুরতে আমার অনেক ভালো লাগে আপু। তোমার কেমন লাগে?”
“আমারও অনেক ভালো লাগে। অনেক। গাড়িতে বসে নিঃশ্বাস নিতে ভালো লাগে না আমার। তারচেয়ে রিকশায় বসে শান্তিতে নিঃশ্বাস নেওয়া যায়।”
“হ্যাঁ, খুব ভালো লাগে। যখন জ্যাম এর মধ্যে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকবে, তখন বুঝতে পারবে কত ভালো লাগে।”
আম্মার কথা শুনে আমি আর সাবিহা খিলখিল করে হেসে উঠলাম।
“আম্মা, সেটাও ঠিক। কিন্তু ভালো তো লাগে অনেক।”
“শোনো মেয়েরা, তোমাদের যে কাজগুলো করতে বেশি ভালোলাগে, সেগুলো বেশি বেশি করবে। কিন্তু তুমি যদি তোমার ভালোলাগার কাজগুলো সবসময়ই ভালো লাগাতে চাও, তাহলে বেশি বেশি করো না। ”
“মানে কি মা?আমার একটা কাজ ভালোলাগে। আমি সেটা ভালোলাগার জন্য বেশি বেশি করবো না?”
“নাহ, করবে না।”
“কেন, আম্মা?”
“কেন? কারণ, ভালো জিনিস কম কমই ভালো। বুঝলে?”
“যেমন?”
“যেমন ধরো তোমাদের একটা পছন্দের গান। সেটা যদি তুমি সবসময়ই শুনতে থাকো, তাহলে সেটার উপর থেকে তোমার ভালোলাগা কমে যাবে। একসময় সেটার উপর গুরুত্ব কমে যাবে। বুঝলে?”
“হুমম। ”
“শুধু কোনো জিনিসই না। কোনো মানুষের প্রতিও এমনই ধারণা থাকা উচিত। যাকে বেশি ভালোলাগে, তাকে যত কম দেখবে, তার প্রতি ততো আগ্রহ থাকবে। যখনই তাকে নিজের খুব কাছে থেকে পাবে, তখন ধীরে ধীরে তার প্রতি ভালোলাগা হারিয়ে যাবে।”
“তুমি খুব দামী কথা বললে মা। খুব জ্ঞানী কথা বললে।”
“জানি। আর আমি সবসময়ই জ্ঞানী জ্ঞানী কথাই বলি।বুঝলে? কিন্তু তুমিই বুঝো না। আমি একটা কাজ করতে বললে করো আরেকটা। আমার কথার সবটাই উল্টো মানে বুঝো।”
“মা, আমরা রিকশায় যাচ্ছি। এখন আমাকে বকো না তো। তুমি বড্ড বকো।”
“হুমম, আমি সবসময়ই বকি।”
★★★
মেয়েদের ঘরের সামনের পর্দা ধরে দাঁড়িয়ে আছে সাগরিকা। সাবিহা আর মায়ার দিকে তাকিয়ে আছে। সাবিহা!কত সাধনার মেয়ে তাদের। নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর মতো অবস্থা ছিল সংসারে। তারমধ্যে আবার সে কনসিভ করেছে। একটু ভালো খাবার খেতে পারেনি সে। কত কষ্টই না করেছে তাকে পেটে ধরে। তার প্রিয় স্বামী নিজে না খেয়ে তাকে খাইয়েছে। অথচ ওর জন্মের পর সবকিছু বদলে গেছে। পরিবার থেকে মেনে নিয়েছে। রিজভীর ভালো চাকরি হলো। চারদিক থেকে শুধু সৌভাগ্য আসতে লাগলো।
আর মায়া! সাগরিকা আস্তে আস্তে যেভাবে মায়ার মায়ায় ডুবেছে, সেভাবে দায়িত্ববোধও বেড়েছে। মায়ার মৃত মায়ের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ সে, মায়াকে আগলে রাখতেই হবে তাকে। সাবিহার প্রতি যেমন তার দায়িত্ব পালন করতে হবে, তারচেয়ে অনেক বেশি খেয়াল রাখতে হবে মায়ার। কারণ তাকে শুধু ভালোবাসলেই হবে না, তার প্রতি দায়িত্ববোধও অন্যরকম। সাগরিকার মুখ থেকে আপনা আপনিই বের হলো,”আমার তিন সন্তানকে ভালো রেখো আল্লাহ।”
বলেই চমকালো সে। তাহলে কি সত্যিই মায়াকে নিজের সন্তান হিসেবে মেনে নিচ্ছে সে?তার ভীষণ ইচ্ছে হলো মায়ার মায়ের ডায়েরির লেখাগুলো আবার পড়া। শেষের লেখাগুলো পড়া হয়নি তার। তালাবদ্ধ বাক্সটার ভেতর থেকে ডায়েরিটা বের করলো সে। তার অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। মায়াকে সে ভালোবাসতে চায় না। শুধু দায়িত্বই পালন করতে চায়। কিন্তু পারছেনা সে।কিছুতেই পারছেনা। মায়াকে নিজের অস্তিত্বের সাথে মিশিয়ে নিচ্ছে সে।

°গত তিনদিন আগে আমার মেয়ের জন্ম হয়েছে। আল্লাহ, আমি তো একটা ছেলে চেয়েছিলাম। আল্লাহ, আমার মেয়েকে তুমি আমার মতো মা কেন দিলে?আমার জন্য কি ওর কোনো ক্ষতি হবে?ওর বাবা আসেনি।এখনও আসেনি। প্রসব বেদনা আমি একা সহ্য করেছি। বদ্ধ ঘরে আমি সন্তানকে জন্ম দিয়েছি। ভেবেছিলাম ছেলে হবে। মেয়ে হলে আমি নিজে হাতে ওর গলা টিপে খুন করবো। কিন্তু আমি পারছি না ওকে মারতে। কি এক অদ্ভুত মায়া জন্মাচ্ছে ওর প্রতি। হ্যাঁ, মায়া। আমি ওর নাম দিচ্ছি মায়া। ওর মায়াবী এই চেহারা দেখে কি ওর বাবার মন গলবে?হ্যাঁ, অবশ্যই। হয়তো আমাকে মেনে নিবে। তার সাথে হয়তো আমি সংসার করবো। হ্যাঁ, সংসার করবো। আমার মা মায়াকে ছুঁয়েও দেখেনা। আমাকেও ভালোবাসে না। আড়ালে বলে, জারজ সন্তান আমার মেয়ে। কিন্তু ও কিভাবে জারজ হলো? ওর মা আছে বাবা আছে। ও কিভাবে জারজ হয় আল্লাহ?°

°আজ ৭ দিন হয়েছে আমার মেয়ের। তাও ওর বাবা আসেনি। আমাকে না হয় ভালোবাসেনি। আমার গর্ভে থাকা অবস্থায় একটা ভ্রুণ কে না হয় ভালোবাসেনি। কিন্তু এখন তো এটা তার বাচ্চা। রক্ত মাংসে গড়া একটা শিশু। ওর আগমনের কথা শুনেও সে কিভাবে না এসে থাকতে পারে? আমার কত ইচ্ছে ছিল ৭ দিনের দিন আকিকা করবো আমার বাচ্চার। চুল ফেলে দিব। নখ কেটে দিব। কিছুই হলো না। সব স্বপ্নই বৃথা।°
°আজ আমার মেয়ের ১৪ তম দিন। আজ সে এসেছিল। সে একা আসেনি। এসেছিল কাজি নিয়ে। আমার মা আমার মেয়েকে নিয়ে অন্য ঘরে থেকেছে। কাজি সাহেব এলেন, বসলেন আমাদের কবুল বলতে বললেন। আমরা কবুল বলার পর আমার বাবা কাজি সাহেবকে কিছু টাকা দিয়ে বিদায় করে দিল। সে মেয়েকে কোলে নিল। মেয়ের হাতে কিছু টাকা দিয়ে চুমু খেল গালে। অভিমানী মেয়ে আমার বাবাকে পেয়ে ঝরঝর করে কেঁদে দিল। হয়তো বলতে চাইলো, এতোদিন কেন আসোনি?কিন্তু সে কথা আমার স্বামীর মনে গিয়ে গাঁথলো না। সে আমার এক টুকরো মায়াকে ছেড়ে চলে গেল। তার একটুও কষ্ট হলোনা। একটি বারের জন্যও তার আমার কথা জিজ্ঞেস করার একটুও সময় হলো না।°

°আমার মেয়ে আজ মা ডাক শিখেছে।আমাকে আধো আধো গলায় মা বলেছে। আমার কেমন যেন একটা অনুভুতি হচ্ছে, বলে বোঝাতে পারবো না। মনে হচ্ছে, আমার এই দুঃখের জীবনের সবটাই শেষ। অন্তত আমার বলে তো কেউ আছে।°
সাগরিকা দেখলো ডায়েরির পাতাগুলো জুড়ে শুধু মায়ার স্মৃতি। একটা লেখায় চোখ আটকে গেল তার।
°আজ মায়া আমাকে এসে বলেছে পাশের বাসার মেয়েটা তাকে মেরেছে। তার অন্যায় ছিল সে মেয়েটার সদ্য জন্ম নেওয়া ভাইকে আদর করেছে। আমার মায়ারও একটা ভাই চাই। আমি কি বলবো বুঝতে পারিনি। কি বলে সান্ত্বনা দিব আমার মেয়েকে? যেটা জীবনেও সম্ভব নয়, সেটা আমি কিভাবে বলবো?°
সাগরিকা ডায়েরিটা বন্ধ করে ফেললো। মায়ার জন্য সত্যিই তার খারাপ লাগছে। মায়া এখনও কষ্ট পাচ্ছে। এমনকি সারাজীবন পাবে। সেটা শুধু মাত্র তার মায়ের জন্য।
★★★
“অনেকদিন পর আসলি মায়া। এখন কেমন আছিস?”
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। তুই কেমন আছিস?”
“আলহামদুলিল্লাহ। ”
“তোর মা ভালো আছেন? উনি কিন্তু খুব চমৎকার একজন মানুষ। ”
“হুমম। অবশ্যই। তা, আমার ভাই কেমন?”
“মানে?”
“না মানে আমার ভাইকে তোর কেমন লাগে?মানুষ হিসেবে?”
“উনিও ভালো মানুষ। উনি না থাকলে আমার যে আজ কি হতো।”
“হুমম। সেটাই। আমি অনেক আশা নিয়ে ছিলাম। জানিস?”
“কিসের আশা?”
“তুই আমার ভাবি হবি। ভেবেছিলাম ভাইয়া তোকে বিয়ে করে বাসায় নিয়ে গিয়েছে। আমি তো সেই খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু আমার সব আশা শেষ। ”
“মাথা খারাপ কবিতা? উনি তো আমার শিক্ষক। ”
“তাতে কি? শিক্ষকরা কি জীবনে বিয়ে করেনা?”
“তবুও তো।”
“শোন, কথা হচ্ছে কারো কাছ থেকে কোনো একটা শব্দও যদি তুমি শিখো, তবে সে তোমার শিক্ষক। তাহলে?”
“আরেহ, কি বলছিস? বাদ দে তো।”
“শোন, আমার ভাই কিন্তু লাখে একটা। তুই কিন্তু জিতবি।”
“কথা বন্ধ করবি?”
“ওকে। কিন্তু তুই একটু ভেবে দেখিস।”
“কবিতা।”
★★★
বাসায় আসার পর আম্মা ডেকে বললো,”মায়া, কালকে তোমার নানা-নানি আসবে। আমাদের বাসায়। তোমাকে দেখতে।”
“কালকে?”
“হুমম। ”
“কেন? কিছু বলেছে?”
“নাহ। তোমার বাবাকে কল দিয়েছিল। তোমার বাবাকেই বলেছে হয়তো।”
“অহহ।”
আমি ঘরে এসে ফোন হাতে নিয়ে দেখলাম নানী আমাকেও কল দিয়েছিল। ফোন সাইলেন্ট থাকার কারণে আমি বুঝিনি। আমি কয়েকবার ট্রাই করলাম ফোনে। কিন্তু ঐপাশ থেকে কেউ ধরলো না।
“মায়া আপু, তুমি কি ফুসকা খাবে?”
“সাবু, আমি এখন কিন্তু আম্মার কাছে যাবো না। তোর বকা খাওয়ার ইচ্ছে হলে তুই যা। ”
“শেষবারের জন্য আপু। প্লিজ প্লিজ প্লিজ। ”
“সাবিহা।”
“প্লিজ আপু।”
“ওকে। বাট বেশি সময় কিন্তু থাকবো না আমরা। ”
“ওকে। আরেহ, সামনেই তো যাবো। বেশি সময় লাগবে না।”
“যাব তো ঠিক আছে। তোর কাছে টাকা আছে তো?”
“তুমি তো বড় আপু। তুমিই খাওয়াবে।”
“নো। আমি কেন খাওয়াবো? আমি কি প্রোপোজাল দিয়েছি?”
“ওকে। আমিই দিবনে।” মুখ ভোঁতা করে জবাব দিল সাবিহা।
★★★
“আপু,ফুসকার টক টা সেই। তাইনা?”
“হুমম। খাওয়ার সময় কথা বলিস না তো। ”
“তুমিও প্লিজ মায়ের মতো করো না। এতো কড়াকড়ি নিয়ম আমার একদমই ভালো লাগেনা। ”
“হুমম। জানি।আমার ও ভালো লাগেনা।”
“আপু, ঐদিন তোমাকে যে ভাইয়াটা বাঁচিয়েছিলেন, তার সাথে কথা বলেছো?”
“উহুম, না।”
“কেন? একটা ধন্যবাদ কি তার প্রাপ্য না?”
“আসলেই। আমার উনাকে ধন্যবাদ দেওয়া উচিত। ”
“কালকেই উনার সাথে কথা বলবে। ওকে?”
“ওকে ম্যাডাম।”
“হাহাহা…জানো তো, আমার অনেক ইচ্ছে আমিও একদিন এইরকম একটা বিপদে পড়বো। কোনো একটা হিরো আমাকে বাঁচানোর জন্য চলে আসবে। ঢিশুম ঢিশুম গুন্ডাদের সাথে ফাইট করে আমাকে উদ্ধার করবে।আহা,কি ফিলিংস। ”
আমি অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। বলে কি এই মেয়ে।
“এইভাবে তাকিয়ে আছো কেন?”
“আল্লাহ আল্লাহ কর যেন তোর সাথে এইরকম কিছু না হয়।হলে তারপর বুঝবি। মূর্খ।”
বাড়ি ফেরার পথে রাস্তার অপরপাশে আমার চোখ আটকে গেল। সারাগায়ে কাঁপুনি শুরু হয়ে গেল। রাস্তার অপরপাশে একজন মহিলা একটা ছোট বাচ্চাকে কোলে নিয়ে ভিক্ষা করছে। উনি তো সেই মহিলা। যার স্বামী আমাকে তুলে নিয়েছিল। আমার কি হলো আমি জানিনা। কিন্তু হুট করেই রাস্তার অপরপাশে গিয়ে উনার বাচ্চাকে উনার কোল থেকে কেড়ে নিলাম। উনিও আমাকে দেখে চমকালেন। অনেকটা চিৎকার করে বললেন,”আমার বাচ্চা দাও।”
“ভুলেও চিৎকার করো না। এইটা তোমার নোংরা এলাকা না। এইখানে তোমার চিৎকারে কেউ এগিয়ে আসবে না। কিন্তু আমার একটা ডাকই যথেষ্ট।”
উনি অনেকটা ভয় পেয়ে গেল। কাঁদোকাঁদো গলায় বললো,”আফা, আমরা গরীব মানুষ। প্যাটের দায়ে এই কাম করি। যহন যা কাম পাই, তাই করি। না পাইলে ভিক্ষে করি। আমার গ্যাদাডারে দিয়া দেন আফা।”
আমার কিছুটা খারাপ লাগলো। আমি জানি এই খানে আমি কিছুই করতে পারবোনা৷ কারণ এইটা আমার এলাকা না। আমাকে কেউ চিনে না এইখানে।আর এখন অনেকটা সন্ধ্যা হয়ে গেছে। উনার গ্যাং এর লোকেরা হয়তো আশেপাশেই আছে। তাই চাইছিলাম শুধু আমাকে তুলে নেওয়ার জন্য উনাদের টাকা কে দিয়েছে, সেটা জানতে।
“তোমাদেরকে টাকা কে দিয়েছিল বলোতো, আমাকে উঠানোর জন্য? ”
“লম্বা, ফর্সা এক বেডায়।”
“বয়স কত হবে উনার?”
“৪০ এর মতো। বা তারও কম।”
“এমন কি কিছু দেখেছো, যার কারণে উনাকে খুব সহজেই চিনতে পারবো?”
“আমার কাছে ছবি আছে আফা।”
“ছবি কিভাবে আছে তোমার কাছে?”
“আমরা আড়াল থেকে তুলছি। যাতে পরে আমরা ফাঁসলে উনারেও ফাঁসাইতে পারি।”
“দেখি উনার ছবি।”
এতোক্ষণে সাবিহাও আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। আমাদের কথায় হয়তো বুঝেছে আমরা কি নিয়ে কথা বলছি।আমরা দুজনেই অপেক্ষা করছি কে হতে পারে সেই মানুষ। মহিলাটি নিজের ব্লাউজের ভিতর থেকে একটা দামী ফোন বের করলো। হয়তো এইটাও চুরির মোবাইল। সে গ্যালারি থেকে এমন একজন মানুষের ছবি বের করলো, আমি স্বপ্নেও তার কথা মাথায়ও আনিনি। আনমনে আমার মুখ থেকে অস্ফুটস্বরে বের হলো,”মামা?”

চলবে…..