#আমি_মায়াবতী
#পর্ব_২১
#লেখনীতে_তাহমিনা_মিনা
(মায়ার ভাষ্য পরিবর্তন করে সাবলীলভাবে লিখবো এখন থেকে গল্পটা।)
কবিতার বাসার ড্রয়িংরুমে দাঁড়িয়ে দাত দিয়ে নখ কামড়াচ্ছে মায়া। কবিতার উপর ভীষণ রাগ হচ্ছে তার। মেয়েটা এখন মাথা ব্যথার অজুহাত দিয়ে তাকে বাড়ি দিতে যেতে চাইছে না।মায়া ভালোভাবেই বুঝতে পারছে কবিতা কাব্য স্যার এর সাথে তাকে একা পাঠাতে চাইছে। মায়া যতোই কবিতাকে তার সাথে যেতে বলছে, কবিতা নিজের না থেকে সরছে না।
” কবিতা, বোঝার চেষ্টা কর। স্যার এর সাথে আমি কিভাবে বাইকে চড়ে যাবো? কেমন একটা লাগবে না? আর রাস্তায় পরিচিত কেউ দেখলে ভুলভাল ভাববে। চল না তুই।”
“বাহ! আমার ভাইয়ের বাইকে চড়ার কি শখ। তোকে কে বলেছে ভাইয়া তোকে বাইকে করে নিয়ে যাবে? গাড়ি আছে না? শোন, এতো কাছাকাছি বসতে হবে না তোকে। তুই চাইলে গাড়ির পিছনেও বসতে পারিস। কিছু মনে করবো না। কিন্তু তুই পিছনে বসলে আমার ভাইয়াকে মনে হবে গাড়ির ড্রাইভার। আমার ভাই কি তোর ড্রাইভার? তবে, ব্যক্তিগত ড্রাইভার বানাতে চাইলে অন্য কথা। আমি মানা করবো না।” বলেই চোখ টিপলো কবিতা।
মায়া অসহায় হয়ে তাকিয়ে রইলো। সে বুঝে গেছে তার কথার কোনো মূল্যই দিবে না এখন। অগত্যা কবিতার মায়ের থেকে বিদায় নিয়ে বাইরে বের হয়ে এলো গাড়ির উদ্দেশ্যে। ও বের হওয়া মাত্রই কবিতা ছুটে এলো ওর পিছুপিছু। মায়া চোখ সরু করে বললো,”তোর না মাথা ব্যথা? এলি কেন এইখানে?”
“আরেহ, তোকে নিয়ে এসেছি গাড়ি করে৷ নিজ দায়িত্বে গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে তবেই না ছুটি আমার। ”
“হুমম, বুঝলাম। কিন্তু তোর মতলব তো ভালো না। আমাদের একা ছাড়ছিস কেন?”
“কারণ তোকে আমার ভাইয়ের বউ বানাতে চাই। ”
“এইটা জীবনেও সম্ভব না। ”
“কেন সম্ভব না?”
“উনি আমার শিক্ষক।”
“তোকে কিন্তু আগেই শিক্ষক এর সঙা দিয়েছি। সেই হিসেবে দেখতে গেলে দুনিয়ার কাউকেই বিয়ে করা যাবে না।”
“তবুও।”
“কিসের তবুও?”
মায়া অধৈর্য হয়ে বললো,”তুই তো জানিস আমার সবকিছুই। আমার মায়ের জন্য কি কি হয়েছে। এখন আমি যদি তোর ভাইকে বিয়ে করতে চাই, তাহলে সবাই আমাকেও আমার মায়ের মতোই খারাপ ভাববে। সবাই বলবে শিক্ষক কে বিয়ে করলো।”
কবিতা কিছুটা দমে গেল। মায়া আবার বললো,”তাছাড়া আমি আমার পরিবারের একজন সদস্য এখন। সবাই আমাকে মেনে নিয়েছে৷ এখন আমি যদি এইরকম একটা কাজ করি, তাহলে আমি ওদের সামনে মুখ দেখাতে পারবো না।”
“আর যদি সবকিছু ওদের সম্মতি নিয়ে হয়? তাহলে?”
“ওফফ, কবিতা। এমনভাবে বলছিস যেন আমি আর তোর ভাই দুইজন দুজনকে ছাড়া বাঁচবো না। বাদ দে তো। এমন তো না যে আমরা দুইজন দুইজনকে ভালোবাসি। চল তো। বেশি বকিস না।”
কবিতা মুখ গোমড়া করে মায়ার পিছনে হাটতে থাকে। বাইরে এসে দেখে কাব্য দাঁড়িয়ে আছে গাড়িতে হেলান দিয়ে। তাদের দেখেই বলে,”তাড়াতাড়ি করো দুজন। আমাকে আবার অন্য জায়গায় যেতে হবে।”
মায়া কবিতাকে বাই বলে গাড়ির পিছনের দরজা খুলতে গেলে কবিতা ধমক দিয়ে বলে,”এই মেয়ে, আমার ভাইকে কি তোর ড্রাইভার মনে হয়?আমার ভাই কেন তোকে ড্রাইভ করে নিয়ে যাবে এইভাবে?সামনে বস।”
কাব্য কবিতার দিকে তাকিয়ে বলে,”তুই বস না সামনে। সামনে তো মাত্র দুটো সিটই আছে।”
“আমি তো যাচ্ছি না ভাইয়া। ”
“কেন?তুই কেন যাবি না?”
“আমার মাথা ব্যথা করছে রে ভাইয়া। তুই যা না ওকে দিয়ে আয়।”
“তোর আবার মাথা ব্যথা? ব্যাঙের আবার সর্দি? মাথা আছে নাকি তোর?”
“আমাকে আমার বান্ধবীর সামনে অপমান করবি না বলে দিচ্ছি। মায়া, সামনে গিয়ে বস। আর মিস্টার কাব্য শুনেন একটা কথা বলে দিচ্ছি আপনাকে। আমার বান্ধবীকে সহিসালামতে বাসায় দিয়ে আসবেন। বুঝলেন? কথার যেন কোনো নড়নচড়ন না হয়। আমি যেন কালকে শুনি না যে কোনো কিছু হয়েছে।”
কাব্য একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ছাড়ে। এখানে কথা বলা মানে শুধুশুধু নিজের মাথা নিজে খাওয়া। মায়াকে গাড়িতে উঠতে বলে সেও উঠে বসে।
★★★
” তোমার জীবনের লক্ষ্য যেন কি?” গাড়ি চালাতে চালাতে প্রশ্ন করে কাব্য।
“চাইছি তো যাতে আল্লাহ ডাক্তার বানায়।”
“শুধু আল্লাহ বানালে তো হবে না। তোমাকে পরিশ্রমও করতে হবে।”
“সেটাতো অবশ্যই। ”
“তোমাকে দেখে কেন মনে হচ্ছে তুমি আমাকে কিছু বলতে চাইছো?”
মায়া হুট করেই কাব্যর দিকে তাকায়। সে কিভাবে বুঝলো? মায়া ঢোক গিলে বলে,”হ্যাঁ, কিছু বলতে চাই।”
“বলে ফেলো। পরে কিন্তু আবার সময় সুযোগ নাও পেতে পারো।”
“আসলে বিষয়টা কবিতাকে নিয়ে।”
“কবিতাকে নিয়ে?”
“হুমম। ”
“কি করেছে ও আবার?”
মায়া কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আমতা-আমতা করে বললো,”আসলে…আসলে ও প্রেমে পড়েছে। কিন্তু সেটা আপনার ভয়ে বলতে পারছে না।”
“আমাকে ও পাত্তা দেয় নাকি? আজকে তো দেখলেই আমাকে কিভাবে নাকানিচোবানি খাওয়ালো তোমার সামনে।”
“আসলে ও যেমনই হোক না কেন, ওর মনটা অনেক ভালো। কিন্তু জীবনের এইরকম একটা সিদ্ধান্ত আসলে ও একা নিতে পারছে না।”
“ওর পছন্দের মানুষটা কি আমার বন্ধু?”
মায়া অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,”আপনি কিভাবে জানলেন?”
কাব্য একটা রহস্যময় হাসি দিয়ে বলে,”মায়া, তুমি বোধহয় ভুলে যাচ্ছো, আমি ওর ভাই। আমার কি এইটা বোঝার কথা না?”
“অহ। হ্যাঁ, আমিই আসলে বেশি বুঝেছিলাম।”
“কবিতা আমাদের বাড়িতে ৭ বছর বয়সে পার্মানেন্টলি এলেও আমার মা ই কিন্তু ওকে ছোট থেকে দেখাশুনা করেছে। তখন তো অনেক ছোট ছিল। মামী মারা যাওয়ার পর প্রথমে আমাদের বাড়িতেই এনেছিল হাসপাতাল থেকে। আমি ভেবেছিলাম মা হাসপাতাল থেকে বোন কিনে এনেছে। কিন্তু কয়েকমাস পর বুঝেছিলাম ও আমার বোন নয়। যখন নানু ওকে নিয়ে যেতে এসেছিল। আমি খুবই কান্না করেছিলাম সেদিন। জানো তো সেদিন আমি…” কথা অসমাপ্ত রেখেই কাব্য থেমে গেল।
ভেবেছে মায়া কিছুই জানে না হয়তো।
মায়া কাব্যকে বলে,”আমি সবকিছু জানি, স্যার। কবিতা আমায় বলেছে।”
সহসাই কাব্য মায়ার দিকে তাকায়। রাস্তার একপাশে গাড়ি থামিয়ে বলে,”তুমি জানো সবকিছু? ”
“হুমম। জানি।”
“ও তো কাউকেই কখনো বলে না এইসব। তোমাকে কিভাবে বললো?”
মায়া একটু মুচকি হেসে বলে,”আপনি যদি ওর ভাই হয়ে থাকেন, তাহলে আমিও কিন্তু ওর বেস্টফ্রেন্ড হই। কথাটা মাথায় রাখবেন।” বলেই চুপ করে গেলো মায়া। কি বললো সে এইটা? হাজার হোক, সে তো তার শিক্ষক।
কাব্য গাড়ি স্টার্ট দিল। সারারাস্তা আর কেউই তেমন কোনো কথা বললো না। কাব্য মায়াকে ভালোভাবে পড়াশুনা করতে বললো।
বাসার সামনে এসে গাড়ি থামলে মায়া গাড়ি থেকে নেমে কাব্যকে ধন্যবাদ দিয়ে বাসায় আসার জন্য অনুরোধ করলো। কিন্তু কাব্য কাজ আছে বলে চলে গেলো।
মায়া খুশিমনে বিল্ডিং এর ভেতরে ঢুকলো। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর লিফট আসলে লিফটে উঠার পর হঠাৎ তার মনে হলো,কাব্য স্যারকে সে একবারের জন্যও বলেনি এই এলাকায় তার বাসা। কিংবা এই বিল্ডিংয়ে সে থাকে। তবে স্যার কিভাবে জানলো সব?
★★★
“আপু, তোমার কাব্য স্যার কিন্তু খুবই সুন্দর। একদম হিরো হিরো।”
মায়া চুলে চিরুনি চালানো থামিয়ে সাবিহাকে বলে,”তুই কিভাবে জানিস?”
“ফেইসবুক থেকে।”
“ওনার একাউন্ট পেলি কই?”
“কবিতা আপুর ফ্রেন্ডলিস্টে। যাই বলো না কেন, তোমার স্যার কিন্তু সেই।”
“এতোই যখন ভালোলেগেছে, তাহলে গিয়ে প্রোপোজ করে দে না।”
“আমার তো তোমার জন্য ভালো লেগেছে।”
“মাথা খাস না তো আমার। প্লিজ। আজকে সারাদিন কবিতা বকবক করেছে। এখন আবার তুই শুরু করিস না।”
“তুমি স্যরি বলেছো? কি কি বলেছো? আর কবিতা আপু বললো তুমি নাকি উনার সাথে এক গাড়িতে এসেছো। কি কি কথা হয়েছে তোমাদের মাঝে? আমাকে বলোনা প্লিজ। ”
“সাবিহা। আম্মাকে গিয়ে বলবো, অল্প বয়সে পেকেছিস তুই? তোকেই বিয়ে দিতে বলি? ”
“নাহ। নাহ আপু প্লিজ। এই আমি এখনই শুয়ে পড়ছি।”
মায়াও কিছুক্ষণ পর গিয়ে শুয়ে পড়লো সাবিহার পাশে। কিন্তু ঘুম আসছে না তার। কাব্য স্যার কি আসলেই অনেক সুন্দর? অনেক মেয়েরাই বুঝি এইভাবে ক্রাশ খায় উনার প্রতি? উফফ! অসহ্য লাগছে সবকিছু। মায়ার কেন যেন কিছুই আর ভালো লাগছে না। বারবার মনে হতে থাকে, জীবন তুমি এতো বিষাদ কেন?
চলবে…..
#আমি_মায়াবতী
#পর্ব_২২
#লেখনীতে_তাহমিনা_মিনা
“মায়া আপু, তুমি কখনো গ্রাম দেখেছো? আমি কখনোই দেখিনি।”
“আমিও দেখিনি সাব্বির। কিন্তু আমার অনেক ইচ্ছে ছিল আমি গ্রামে যাবো।”
“তুমি গ্রামে গিয়ে কি করবে আপু?”
“জানিনা। তুমি কি কি করবে?”
“আমি তো নদীতে নৌকা চালাবো। আমি অনেক গুলো কাগজের নৌকা বানিয়েছি। তোমার মনে আছে, আমি কক্সবাজার গিয়ে নৌকা ভাসিয়েছিলাম। কিন্তু একটাও আর ফিরে পেলাম না।”
“কিন্তু নদীতে তো হারাবে না।”
“সাবিহা আপু, তুমি কি কি করবে?”
“ফ্যাঁসফ্যাঁস করবি না তো। আমার গ্রাম ভালো লাগে না। বিরক্ত লাগছে। আমি কীভাবে কি করবো বুঝতে পারছিনা। বাবা যে কিসের জন্য যেতে চাইছে কে জানে। ”
“ওখানে আমাদের দাদা-দাদি আছেন। তারা বাবার মা-বা সাবিহা। তাদের প্রতি তো আমাদের দায়িত্ব কর্তব্য আছে৷ সেটা তো পালন করতে হবে।”
“ওনারা কি বাবার প্রতি দায়িত্ব পালন করেছে? তাহলে আমরা কেন করবো? বাবাকে তো বের করে দিয়েছিল। খাবারও খেতে দেয়নি ওরা। আমাদের কি দরকার ওদের দেখাশোনা করা?” রাগে গজগজ করতে করতে বললো সাবিহা।
“এইসব বলে না সাবিহা। ওনাদের এখন বয়স হয়েছে। এখন তাদের আমাদেরকে দরকার। আমরা না দেখলে কারা দেখবে বল?”
“আমি অতশত জানিনা, বুঝিনা। জানতে বা বুঝতে চাইও না। আমার ইচ্ছে করছে বাসায়ই থেকে যাই। কিন্তু সেটা সম্ভব না। মা বলেছে নানাবাড়িতে থাকতে। কিন্তু মামী যে কাহিনি করে গেছে, তারপর আর সেখানে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না।”
“আমার তো অনেক ভালো লাগছে। আমি সারাজীবন চার দেয়ালের মাঝে বন্দী ছিলাম। নানাবাড়ি দাদাবাড়ী কি জানিনা। এইবার একটা সুযোগ পেয়েছি। আমি তো আনন্দের সাথেই যাবো।”
সাবিহা আর কোনো কথা না বলে ভাজ না করেই ওর ব্যাগে টি-শার্ট ঢুকাচ্ছিল। সাগরিকা রুমে এসে ওকে একটা ধমক দিয়ে টি-শার্টগুলো বের করে থ্রি-পিস আর লং ফ্রক ওর হাতে ধরিয়ে দিল। মায়ার কাছে গিয়ে মায়াকেও দিল। সাবিহা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “এইসব দিচ্ছো কেন মা?”
“আমরা গ্রামে যাচ্ছি সাবিহা। ঐটা শহর না। আমাদের মন মানসিকতার সাথে ওখানের মানুষের মন মানসিকতা মিলবে না। তোমরা ঐখানে টি-শার্ট পড়ে থাকতে পারবে না। অনেকে অনেক কথা বলবে। চুপচাপ এগুলো নিয়ে নাও। আর হ্যাঁ, সাথে দুটো বইও নিবে। শুধু ওখানে গিয়ে ঢ্যাংঢ্যাং করে নাচলেই হবে না। পড়তেও হবে।”
“কিহ? আমি ওখানে গিয়ে নাচবো? আমি রুম থেকেই বের হবো না দেখে নিও। আবার তো নাচানাচি।”
“ওখানে গিয়েই সেটা দেখা যাবে।” একটা রহস্যময় হাসি দিয়ে বলে সাগরিকা।
সাবিহা তেজ দেখিয়ে সবকিছু রেখে বারান্দায় চলে যায়। সাগরিকা হতাশ হয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকলে মায়া তাকে আশ্বস্ত করে। সবার এইসব কর্মকাণ্ড দেখে সাব্বির চোখ গোলগোল করে সাগরিকাকে বলে,
“মা, আমিও কি শার্ট পড়তে পারবো না? আমি টিভিতে দেখেছি গ্রামে ছোট বাচ্চা ছেলেরাও লুঙি পড়ে। আমিও কি লুঙি পড়বো ওখানে গিয়ে? আমার জন্য লুঙি আনোনি?”
সাব্বিরের কথা শুনে মায়া আর সাগরিকা হাহা করে হাসতে থাকে। এমনকি বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা সাবিহাও।
★★★
“তাহলে গ্রামের ছুটিটা তুই গ্রামেই কাটাবি? ” কফির কাপে চুমুক দিয়ে কবিতা মায়াকে জিজ্ঞেস করলো।
“হুমম। আমি অনেক এক্সাইটেড। জীবনে এই প্রথম দাদাবাড়ি যাচ্ছি।”
“কখন রওনা দিবি আজকে?”
“রাতে।”
“কতক্ষণ লাগবে পৌছুতে?”
“সকালের দিকেই চলে যাবো। জ্যামে পড়লে হয়তো আরো সময় লাগবে।”
“আমি ভেবেছিলাম ঢাকার শহর দাপিয়ে বেড়াবো দুজনে মিলে।”
“নেক্সট টাইম। তোরা কোথাও যাবি না? তোদের গ্রামের বাড়ি নেই?”
“নাহ। আমাদের গ্রামের বাড়ি নেই। আমার বাপ দাদা চৌদ্দ পুরুষ ঢাকার শহরেই থেকেছে। আর আমার নানাবাড়ি মানে তো আমার নিজেরই বাড়ি। যদিও বাবাকে বাবা বলে ডাকতে আমার কম্ফর্টেবল লাগে না মোটেই।”
“কিন্তু যতো যাই হোক, সে তোর বাবা। তোর তাকে বাবা বলে ডাকা উচিত। ”
“জানি। কিন্তু তার প্রতি আমার সেইরকম মায়া-মমতা কাজ করে না। তবে, আমার ৩ টা ভাই-বোনের জন্য খুব খারাপ লাগে। সবচেয়ে বড় টাকে আমি অনেক আদর করতাম। কত ছোট ছিল। একদম পিচ্চি। আমি যখন হাসপাতালে দেখতে যাই, তখন আমাকে দেখেই ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে দিল৷ আমিই তখন ছোট। চার কি পাঁচ বছর বয়স তখন। বাবা আমাকে ওকে আমার কোলে দিলে অদ্ভুতভাবে ওর কান্না থেমে গেলো। ও অনেক রোগা হয়েছিল। নতুন মা এর গর্ভাবস্থায় মা যথেষ্ট খাবার বা বিশ্রাম কিছুই পায়নি। তাই হয়তো এমন হয়েছিল। ভাইয়ের জন্মতে আমি বাবা খুশি হলেও দাদী খুশি হয়নি। আমাকে সবসময়ই বলতো তোর কপাল পুড়েছে রে। তোর কপাল পুড়েছে। বাবুকে বাসায় আনার পরও ওকে আদরও করেনি। নতুন মাকেও অনেক কাজ করতে হতো। বাবুটা অবশ্য আমার কাছেই থাকতো। আমি ওকে কোলে নিয়ে বসে থাকতাম। একবার জানিস কি হলো, বাবুটার বয়স তখন ২ মনে হয়, খেলতে খেলতে পড়ে গেলো খাট থেকে। মুহুর্তেই মাথা ফেটে গলগল করে রক্ত পড়তে লাগলো। আমিও ছুটে গেলাম। কিন্তু খাটের কাছে যাওয়ার আগেই ওর ফেলে রাখা খেলনায় হোঁচট খেয়ে আমিও পড়ে গিয়ে ব্যথা পেলাম। আমি ভয়ে আর ব্যথায় চিৎকার করতে লাগলাম। নতুন মা আর দাদী এসে আমাদের এভাবে দেখে মা কে বললো আমাকে কোলে নিতে। আদর করতে। দাদী আমাদের কাউকে না ধরে বাবুর খেলনাগুলো লাথি দিয়ে সরাতে সরাতে নতুন মাকে বকাঝকা করছিল। জানিস, নতুন মা তখন কি করেছিল? আমাকে আর বাবুকে দুহাতে আগলে নিয়ে ছুটে গিয়েছিল হাসপাতালে। তারপর ফোন দিল আমার ফুপিকে। বিচার -সভা সবই বসল।দাদীর বিরুদ্ধে মা হাজারটা অভিযোগ পেশ করলো। দাদীও কম যায় না। সেও আমাদের এই অবস্থার জন্য মায়ের খামখেয়ালিকে দায়ী করলো। মা যদি সব কিছু গুছিয়ে রাখতো, তাহলে নাকি কারো কিছু হতো না। মা সেদিন তার উপর হওয়া সব অন্যায়ের জবাব দিল। ফুপি আর এই ঝামেলা সহ্য করতে পারছিল না। বাধ্য হয়েই আমাকে তার বাসায় নিয়ে এসেছিল। দাদী তবুও থামছিল না। শেষপর্যন্ত আমাকে দত্তকই নিয়ে নিলো। দাদীও বিছানায় পড়ে মাস সাতেক ভুগে উপরে চলে গেল। আমাকে বাবা ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিল, আমি যাইনি। কেন যাইনি আমি জানিনা। তবে, আমার ভাই আর বোনদের জন্য আমার সেখানে যেতে ইচ্ছে করে। আমার খুনশুটি করতে ইচ্ছে করে। তাইতো কাব্য ভাইয়া এতো বড় হয়েও আমার সাথে ঝগড়াঝাটি মারামারি করে।” কথাগুলো বলতে বলতে প্রায় কেঁদেই দিল কবিতা।
মায়া ওকে কাঁদতে দিল। সে জানে কাঁদলে মন হালকা হয়। তাই সে বাঁধা দিল না। প্রসঙ্গ ঘুরানোর জন্য মায়া বললো,”তোর জমজ বোনেরা কি একই রকম দেখতে?”
“নাহ। ওরা আলাদা। একটাকে দেখতে আমার মতো কিছুটা। আরেকটা ওর মায়ের মতো হয়েছে। ওরাও আমাকে অনেক পছন্দ করে। ঐ বাড়িতে গেলে আমাকে আসতে দিতে চায় না। ফুপির বাসায় আসলেও আর যেতে চায় না আমাকে রেখে৷ তাই আমি চাই যতো দূরে দূরে থাকা যায়, ততোই ভালো। কারণ, এই মায়াটা মোটেই ভালো নয়।”
“গ্রামে নেটওয়ার্ক কম থাকে কিন্তু কবিতা। আমাকে মেসেজ দিলে মাঝেমধ্যে নাও পেতে পারিস।”
“কল দিব।”
“অবশ্যই। ”
“এখানে কি হচ্ছে কি না হচ্ছে তোকে না জানানো পর্যন্ত আর তোর ওখানে কি কি হলো সেটা না জানা পর্যন্ত আমার পেটের ভাত হজম হবে না।”
“আসল কথা বল যে বকবক না করলে তোর পেটের ভাত হজম হবে না। “বলেই মায়া আর কবিতা খিলখিল করে হেসে উঠে।
★★★
রিজভী আহমেদ ভেবেছিল ট্রেনের টিকিট পাবে না। কিন্তু শেষ মুহুর্তে একজন টিকিট বাতিল করায় সে কেবিন পেয়েছে। তাও আবার ৪ টা বেডের৷ উপরে দুটো নিচে দুটো বেড। স্ত্রী,কন্যা,পুত্র নিয়ে আরামসে রাতে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে যেতে পারবে সেই কথা ভাবতেই সে খুশি হলো।সাবিহা এখনও মেজাজ গরম করে আছে। সাব্বির আর মায়া ভীষণ খুশি। সাবিহা রাগে গজগজ করতে করতে কেবিন এর উপরের বেডে গিয়ে শুয়ে পড়লো। সাব্বির বায়না ধরলে মায়া আর সাব্বিরকে উঠিয়ে দিয়ে মায়াকে বললো,” বেড শেয়ার করতে কষ্ট হবে না তো মায়া? ও ঘুমিয়ে গেলে ওকে আমাদের কাছে নিয়ে আসবো তাহলে।”
“আমি উপরে মায়া আপুর কাছেই শুবো বাবা।”
“আচ্ছা ঠিক আছে। আপুর কাছেই শোও।”
কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্রেন ছেড়ে দিল। হেলতে দুলতে ট্রেনটি চলতে শুরু করলো। একসময় গতি বাড়িয়ে দিল। সাগরিকা দোয়া পড়ে সবার বুকে ফু দিয়ে দিল। একসময় নিজেও শুয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে কাঁদা হয়ে গেল।
ঘুম নেই মায়ার চোখে। সে জেগে আছে। কবিতার কথা মনে পড়ছে তার। মায়া গতবারের কক্সবাজার ভ্রমনের কথা মনে করলো। তখন বাসে ভ্রমন করলেও কোনো আনন্দ পায়নি সে। সাবিহা তার প্রতি বিরক্ত ছিল। যাওয়ার সময় একটা কথাও বলেনি। বরং তাকে নিয়ে যাওয়ায় সবার সাথে রাগ করেছিল। আর এইবার? এইবার তাকে অনুরোধ করেছিল তারা দুজন যেন বাসায় থাকে। ভাবা যায়? জীবন কখন কাকে কোন জায়গায় দাড় করায়? আজ মায়ার সবই আছে। সবই আছে। মায়ের কথা মনে পড়লো তার। যদি মা আজ থাকতো? নাহ, সে ভাবতে চায় না। কিছু কিছু মৃত্যু অনেকের জন্য সৌভাগ্য হয়ে আসে। যেমনটা তার মায়ের মৃত্যু তাকে একটা নতুন জীবন, একটা নতুন পরিবার দিয়েছে। তার বাবাকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আশঙ্কা থেকে বাঁচিয়েছে। নানা-নানিকে কতশত গ্লানি থেকে বাঁচিয়েছে। মামার মতো মানুষের কাছে দুনিয়া থেকে একটা পাপ দূর হয়েছে। ভালোই হয়েছে মা মরে গেছে।নিজেকে বোঝায় মায়া। না হলে সে কি আজ এখানে থাকতো? তবুও, মা তো। কিভাবে ঘৃণা করবে সে?সাব্বিরকে একহাতে আঁকড়ে ধরে আরেক হাতে নিজের চোখের জল মোছার ব্যর্থ চেষ্টা করে সে।
চলবে….