আমি যে কে তোমার পর্ব-০২

0
1

#আমি_যে_কে_তোমার

(২য় পর্ব)

আমানের ঝাড়ি খেয়ে ওসি মাসুদ মারিয়াকে হাজতখানা থেকে বের করে আনে। মেয়েটার মনে হয় বোধ শক্তি কমে গেছে। কোন রিএ্যাকশন নাই। স্থির চোখে চুপচাপ বের হয়ে আসে।

– আপনার নাম কি?

যথা সম্ভব কোমল গলায় জিজ্ঞাসা করে আমান।

– ম ম মারিয়া

– আপনার বাড়িতে কেউ নাই?

– আছে। আব্বা আছে।

– তাহলে ফোন ধরে না কেন? নাকি থানা থেকে ফোনই দেয় নি!

সরু চোখে মাসুদের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে আমান।

– না, ফোন করেছিলো। কিন্তু বাবা ইচ্ছা করেই ফোন ধরে নি। কারণ আমার নিজের মা বহু আগেই মারা গেছেন। সৎ মায়ের ইচ্ছায় এই বিয়ে। আমাকে বলেই দিয়েছেন, বিয়ে দিয়েছেন এখন উনাদের কোন দায় নেই। আমি যেন মরে যাই তবুও ভালো কিন্তু ঐ বাড়িতে ফিরে যাওয়ার চিন্তা না করি।

নিস্পৃহ কন্ঠে কথাগুলো বললো মারিয়া। আমানের কষ্ট লাগলো। আহা, মেয়েটার কতোইবা বয়স বড় জোর ১৯ বছর। এই বয়সেই এতোটা দু:খ কষ্ট সহ্য করে কেমন আবেগ অনুভূতিহীন হয়ে গেছে!

– স্যার আগেই কইছিলাম মাইয়াটা জেলেই ভালো আছে, নিরাপদ। এখন কই যাইবো? সইন্দ্যাও লাইগ্যা আসছে।

আমান মাসুদের দিকে কটমট চোখে তাকালে মাসুদ চুপ হয়ে যায়। মাসুদ কিন্তু মনে মনে হাসতে থাকে। এইসব ভালো ঘরের পোলা, দিন দুনিয়া কিছুই বুঝে না আইছে পুলিশের চাকরি করতে। এইহানে যে কতো রকম প্যাঁচ আছে, তুমি বাছাধন টের পাইবা।

আমান মোবাইল বের করে। এখানে একটা এনজিও নারী ও শিশুদের নিয়ে কাজ করে। আমানের সাথে ভালো পরিচয় আছে। তাদের পরিচালককে ফোন দেয়। ভদ্রলোক খুব আন্তরিক মানুষ। দ্রুত উনাদের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে পাঠিয়ে দিচ্ছেন বলে জানান।

– এই আপনার মহিলা কনস্টেবলকে বাজারে পাঠান। মেয়েটার জন্য রেডিমেট একটা ড্রেস নিয়ে আসুক। আর কিছু খাবার দিতে বলেন। নিশ্চয় কিছু খায় নি। আর আপনি এবার আপনার অফিসে চলুন খাতা পত্র রেজিস্ট্রারগুলো দেখি।

মাসুদ বুঝতে পারে আমানকে সে পাত্তা না দিয়ে ভুলই করেছে। নতুন চাকরিতে ঢুকলেও আমান আসলে এতোটা কাঁচা না। উফফ আগে থেকে জানা থাকলে সব ঠিকঠাক করে রাখতো। এখন রেজিস্ট্রারগুলো তো ঠিক নেই!

আমানকে ওর রুমে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে সেকেন্ড অফিসারকে এক দিকে টেনে আনে।

– কাহিনী কী? বয়সে কাঁচা কিন্তু কাম তো করছে পাকা মালের মতো!

– আপনি কিছু জানেন না? উনি তো ডি আই জি স্যারের ভাগ্নে। যেমন মেধাবী তেমন রাগী। আমি তো শুনলাম এস পি অফিসের সবাই উনাকে সমঝে চলে।

মাসুদ এবার ঢোক গেলে। এসপি স্যারকে তেমন একটা ভয় পায় না মাসুদ। স্থানীয় এক নেতার সাথে মাসুদের ভালো লিংক আছে। কিন্তু ডি আই জি স্যার ভিন্ন ধাতুর লোক। উনাকে ভয় পায় না এমন পুলিশ এই রেঞ্জে নেই। এক টাকাও উনাকে দেয়া যায় না। তার উপরে কাজ ছাড়া কিছু বোঝে না। উনার ভাগ্নে মানে খবর আছে!

– এই স্যার মনে হয় সমাজ সেবা করতে ভালোবাসে। আপনি মেয়েটার ভালো খাবার আর কাপড় চোপড়ের ব্যবস্থা করে। দেখেন এন জিও এর লোক কত দূর। স্যারের চিন্তা এই দিকে সরিয়ে আনেন।

সেকেন্ড অফিসার বুদ্ধিমান। তার আইডিয়া মাসুদের মনে ধরে। মহিলা কনস্টেবল ফাতেমাকে আগেই বাজারে পাঠিয়েছিলো। ফোন দিয়ে দুই সেট কাপড় আনতে বলে। আরেক কনস্টেবল গিয়েছিলো খাবার আনতে, আসতে দেরি হচ্ছে দেখে ফোনে কিছুক্ষণ গালাগালি করে।

আমানের ছোট বেলাটা বলা যায় একটা শৃঙ্খলার মধ্য দিয়েই কেটেছে। বাবা আর্মি অফিসার ছিলেন। বাসায়ও কঠিন নিয়ম চলেছে। মা ছিলেন ডাক্তার। ভীষণ মানবিক একজন মানুষ ছিলেন। আমান হওয়ার পরে আর কোন বাচ্চা হয় নি। তাতে তাদের খুব একটা আক্ষেপ ছিলো না। আমানের মা শর্মিলী আহসানের বাচ্চা কাচ্চার অভাব ছিলো না। কয়েকটা ইয়াতীমখানা, এনজিও এর সাথে যুক্ত ছিলেন। নিজের আয়ের সিংহভাগ ব্যয় করতেই সেখানেই। আমানরা পৈত্রিকভাবেই ধনী, তার উপরে বাবা মায়ের উপার্জনও কম না।

এক ছেলে হলেও বাবার শাসনে আমান একদম নিয়মের মধ্যে চলেছে। একটু এদিক ওদিক চলার সুযোগ পায় নি। তবে বাবার মতো আর্মি অফিসার না হয়ে তার ইচ্ছা হলো মামার মতো পুলিশে আসার। এই নিয়ে শালা দুলাভাই কম কাঁদা ছোঁড়াছুড়ি হয় নি!

দুনিয়াতে বেশি ভালো মানুষেরা কেন যেন বেশিদিন বাঁচে না। শর্মিলী আহসানও যেন সেই কাতারে পড়ে দ্রুতই দুনিয়া থেকে বিদায় নিলেন। মারা গেলেন সড়ক দূর্ঘটনায়। আমান তখন সবে এস এস সি পাশ করেছে। এই ঘটনায় ওর জীবন পুরোটাই বদলে গেলো। সেই সময়ে মামা রাশেদুজ্জামান ও মামী শামীমা জামান ভীষণ রকম সাপোর্ট দিয়েছেন। আর বাবা কেন যেন সরে গেলেন। আগে থেকেই কিছুটা গ্যাপ ছিলো, শর্মিলী আহসান বাবা ছেলের মাঝে সেতু হয়ে ছিলেন। সেই সেতুটা না থাকায় দুই জন দুই পৃথিবীর বাসিন্দা হয়ে গেলো।

(চলবে)