#আমি_যে_কে_তোমার
(১২ তম পর্ব)
আমানকে বেডে দেয়া হয়েছে। কেবিনে আছে। আমানের মামা- মামী খবর পেয়ে দৌড়ে এসেছিলো। মামা চলে গেলেও আমানের মামী শামীমা জামান বেশ কিছুক্ষণ ছিলেন এবং বার বার কান্নাকাটি করছিলেন। আমানের মা শর্মিলীর সাথে উনার খুব ভালো সম্পর্ক ছিলো।
– তোমার উচিৎ ছিলো আমাকে একটা সংবাদ দেয়া। এতোদিন পরে জানলাম সেটাও তোমার মামা জেনেছে বলে। আমি কি তোমার কেউ না?
কাঁদতে কাঁদতে অনেকটা হেঁচকি তুলে শামীমা বলতে লাগলো।
– মামী, আপনি ভালো করেই জানেন যে আপনি আর মামা ছাড়া বলার মতো আপন আর কেউ নেই। বাবা তো তার নিজের দুনিয়া নিয়েই ব্যস্ত৷ কিন্তু আমার জ্ঞানই ফিরেছে কয়েকদিন পরে। এরপর ব্যথা বেদনায় আর ভালোই লাগছিলো না। আর আপনার শুনলে অযথা কষ্ট পাবেন, এটাও একটা কারণ।
– আমাদের আসলেই আপন মনে করলে এসব বলতে না। আমার আপন সন্তান হলে কি আর এমন ভাবতে?
– মামী, আমি আসলে দিন দিন কেমন ডিপ্রেশনে চলে যাচ্ছি মনে হয়। কারো সাথেই কথা বলতে ভালো লাগে না।
– সময় মতো বিয়ে না করলে এমনই হয় বাপ। এতো করে বললাম বিয়ে কর কিন্তু আমাদের কোন কথাই তুমি শোন না।
– মামি, মা চলে যাওয়ার পরে বাসাটাকে আমার নরক মনে হয়। সেখানে আর কাউকে আনতে ইচ্ছা করে না। আবার আলাদা কোথাও থাকার মতো অমানবিকও হতে পারি না।
– তুমি এভাবে ভাবো বলেই এমন মনে হয়। আমি তোমাকে আগেও বলেছি আমান, সব মানুষ এক রকম হয় না। তোমার মামা যেমন চিল্লাতে চিল্লাতে বাসায় ঢোকে। মেয়ে দুইটাকে না দেখলে তার নাকি মাথা ঠিক থাকে না। কিন্তু তারও বাপু একটু এদিক ওদিক হওয়ার উপায় নেই। তার খাবার দাবার, কাপড় সব টিপটপ ফিটফাট রাখতে হয়৷ আর না হলে চিৎকার করে, মারাত্মক বকা ঝকা করে। একদম পুলিশী মেজাজ দেখায়। এখন তার ভালো দিকটাকেই মনে রেখে অন্য দিক ভুলে থেকে সংসার করি। আমরা সবাই তাই করি৷ তোমার মাও তাই করেছেন। এখন উনি জীবিত নেই বলেই তোমার এসব মনে হয়। না হলে এগুলো জীবনের স্বাভাবিক ব্যাপার বলেই মনে হতো।
আমান আর কথা বাড়ায় না। চুপ করে থাকে। ক্লান্তও লাগছে কিছুটা।
মারিয়া কেবিনের দরজা ঠেলে ঢোকার পথেই কথা শুনে থমকে দাঁড়িয়েছিলো। শেষের কিছু টুকরো টুকরো কথা ওর কানে যায়৷ বুঝলো আমানের মনে কোন ট্রমা আছে। একই কথা ওর সিনিয়র স্যার বলেছেন। আমানের মানসিক সমস্যা আছে। তার বেঁচে থাকার ইচ্ছাও কম। কাউন্সেলিং করলে ভালো হয়। কিন্তু সমস্যা হলো এই টাইপ রোগীরা বিশেষ করে উনি যেহেতু বেশ ডাকসাইটে গোয়েন্দা, এসব মানসিক সমস্যা বা কাউন্সেলিং বিশ্বাস করবে না। অথচ এই মানসিক সমস্যার জন্যই ওর রিকভারি দেরি হচ্ছে।
মারিয়ার হাতে ফ্রেস জুস, এক স্লাইস ডিমের পুডিং। এগুলো মারিয়া নিজেই করেছে। হাসপাতালের ক্যান্টিন বা হোটেলের খাবার আমানকে দিতে মারিয়ার মন সায় দেয় না।
– হ্যালো স্যার, এখন কেমন বোধ করছেন?
রুমে ঢুকতে ঢুকতে মারিয়া জিজ্ঞাসা করে। মারিয়াকে দেখে আমানের নিস্প্রভ চেহারায় কিছুটা যেন আলো ফিরে আসে। ঝলমলে একটা ভাব দেখা যায়৷
– আরে মারিয়া আসো। বাহ তুমি তো একদম প্রফেশনাল কথা বার্তা বলছো। দামী বেসরকারি হাসপাতালে গেলে এমন করে বলে। আমাকে এতো স্যার স্যার করার কিছু নাই। নাম ধরেই ডাকতে পারো বিদেশে হলে তো মিস্টার আমানই বলতো!
মারিয়াকে ইজি করতে যেয়ে আরো বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দেয় আমান। শামীমা জামান কিছুটা অবাক হয়ে মারিয়ার দিকে তাকালো। বেশ মিষ্টি চেহারার একটা মেয়ে, ডাক্তারদের এপ্রোন পরা। শামীমা জামানের ভালো লাগে। মারিয়া খাবারের বক্স নিচে রেখে, আমানকে দেখতে লাগলো।
– আপনার প্রেসারটা আজও কিন্তু একটু হাই আছে। গত রাতেও কি ঘুম হয় নি?
– না ঘুম হয়েছে তবে ছাড়া ছাড়া মানে বার বার ঘুম ভেঙেছে। আর মাথার ব্যথাটা বেশ কষ্ট দিচ্ছে।
– আচ্ছা আমি নোট নিয়ে রাখছি। রাতে স্যার রাউন্ড দেবে তখন জানাবো। তবে আপ্পনি কোন কিছু নিতেই চিন্তা করবেন না।
শামীমা তখনো মারিয়াকে দেখে যাচ্ছে। ওদের মধ্যে ফরমাল নাকি ইনফরমাল সম্পর্ক সেটা বুঝতে পারছেন না।
– ওহ মারিয়া, উনি আমার মামী। আমার তো মা নেই, উনিই এখন আমার মা বলতে পারো। দেখো কেঁদে কেটে কেমন চোখ ফুলিয়েছে। আর মামী এ হলো ডাক্তার মারিয়া, আমাকে বলা যায় এই ডাক্তারই বাঁচিয়ে তুলেছে।
– আন্টি আসসালামু আলাইকুম। আপনাকে আগেই সালাম দেয়া উচিৎ ছিলো, আসলে আমি প্রথমেই কারো সাথে কথা বলতে পারি না। ক্ষমা করে দেবেন। আর আমান স্যার ভুল বলেছেন। উনিই বরং আমার জীবন বাঁচিয়েছেন।
মারিয়া তড়িঘড়ি করে উত্তর দেয়।
– আর তুমি বুঝি তার প্রতিদান দিচ্ছো?
আমানের মুখ ফুটে এই কথা বের হয়ে আসে৷ এই কথাটা গত কয়েকদিন ধরেই আমানের মাথায় ঘুরছিলো। আজ নিজের অজান্তেই মুখ ফসকে বের হয়ে গেছে৷ সাথে যে মামী আছে ভুলেই গেছে৷
মারিয়া কোন উত্তর দেয়ার আগেই আমানের মামী বলে উঠলেন – কে কার জীবন বাঁচাচ্ছে কিছুই বুঝলাম না!
– মামী তুমি তো জানো মায়ের একটা ফাউন্ডেশন আছে। সেখান থেকেই কিছু হেল্প পেয়েছে মারিয়া। এজন্যই অতি কৃতজ্ঞতা বোধ থেকে এসব বলছে।
তড়িঘড়ি করে আমান বলে উঠে। আমান চায় না সেই হাজতখানার গল্প মারিয়া করুক। মারিয়া নির্দ্বিধায় সব জায়গায় এই গল্প করে কিন্তু আমান চায় না মারিয়া কারো কাছেই ছোট হোক।
– আর আমান স্যার ভাবছেন সেই ঋণ শোধ করতেই আমি উনার বাড়তি দেখাশোনা করি। আসলে ডাক্তার হিসেবে আমার তো এটুকু দায়িত্ব।
মারিয়া এবং আমান উভয়েই জানে দুইজনই পুরোটা সত্যি বলে নাই।
আর শামীমা জামানের অভিজ্ঞ চোখ অনেক কিছুই দেখলো এবং বুঝলো যা ওরা কেউই বোঝে নি।
(চলবে)
#আমি_যে_কে_তোমার
(১৩ তম পর্ব)
– স্যার বললো, আপনি ইচ্ছা করলে বাসায় যেতে পারবেন।
কমলালেবুর খোসা ছাড়িয়ে একটা পিরিচে রাখতে রাখতে মারিয়া এটা বলে।
আমান খুব মনোযোগ দিয়ে মারিয়ার এই লেবুর খোসা ছাড়ানো দেখছিলো। আজ দশ দিন হলো আমান এই কেবিনে। মাথার আঘাত মোটামুটি সেরে উঠেছে। কিন্তু হাত ও পায়ের ব্যান্ডেজ খুলতে আরো কমপক্ষে ১০/১৫ দিন। প্রথম পাঁচ দিন মারিয়া একদম ওর রুমেই বেশিরভাগ সময় থাকতো। রাতেও থাকতে চেয়েছিলো কিন্তু আমান অ্যালাউ করে নি। আমানের গানম্যান আছে, সেই রাতে থাকে৷ একজন ওয়ার্ডবয় আছে, সে ওয়াশরুমে যেতে আসতে হেল্প করে। কিন্তু খাবারের দায়িত্ব মারিয়া জোর করেই নিয়েছে। এখন মারিয়া অন্য সেকশনে ডিউটি করে কিন্তু সুযোগ পেলেই এখানে চলে আসে, আমানের ওষুধগুলো সময় মতো খাইয়ে দেয়। ওর রুম থেকে আলাদা করে খাবার রান্না করে আনে৷
– বাসায় তো যেতেই পারি। কিন্তু তাতে করে তোমার এতোদিনের পরিশ্রম সব বৃথা যাবে।
– মানে?
– এক, বাসায় এমন সেবা করার লোক নেই। আর দ্বিতীয়ত: সেখানে সারাক্ষণ থাকলে আমার আর বেঁচে থাকার ইচ্ছাই থাকবে না।
মারিয়া কমলালেবুর পিরিচটা আমানের কাছে দেয়। এরপর চটপট একটা টিস্যুতে হাত মুছে আমানের চোখের দিকে তাকিয়ে বলে
– আজ বিকালে আপনাকে ঘুরতে নিয়ে যাবো।
– এখানে? কোথায় আর কিভাবে?
– হুইলচেয়ার এনে নিয়ে যাবো। কোথায় সেটা গেলেই বুঝবেন।
দুইটা ট্যাবলেট আমানের হাতে দিয়ে খেতে বলে টিফিনবক্স গুছিয়ে বের হয়ে যায়।
আমানের কাজ নেই। মোবাইলে সময় কাটানোর তেমন অভ্যাস নেই। সব সময় কাজের মধ্যে থাকা অভ্যাস। এখন হঠাৎ করেই এতোটা সময় পেয়ে কি করবে বুঝে উঠতে পারে না। মারিয়া অবশ্য কিছু ভালো ভালো বই এনেছে৷ সেগুলোর পাতা উল্টায় দুই একবার। কিন্তু এখনো ভালোভাবে সুস্থ না হওয়ায় ঠিক মনোযোগ দিতে পারছে না।
কিন্তু মারিয়ার বিষয়ে আমান একটু সতর্ক হচ্ছে। কারণ আমানের মনে হচ্ছে মারিয়া আমানের প্রতি ভীষণ দূর্বল। সত্যি বলতে আমানও মারিয়ার প্রতি দূর্বল সেই পানাম নগরে দেখার সময় থেকেই। কিন্তু সেটা তো মারিয়াকে না জেনে। জানার পর থেকে নিজেকে সামলে নিয়েছে। মারিয়া আমানের চেয়ে বয়সে ৮/১০ বছরের ছোট, বলা যায় বাচ্চা একটা মেয়ে। এই বয়সের আবেগ, এখনো বাস্তবতা বোঝে নি। হাজতখানা থেকে মারিয়াকে বের করে পড়ার সুযোগ দেয়াতে মারিয়ার চোখে আমান হিরো। কিন্তু মারিয়ার জায়গায় যে কোন মেয়ে থাকলেই আমান তাকে এভাবেই সাহায্য করতো। এখানে মারিয়ার মনে যে ভালোবাসার অনুভূতি তার সাথে কৃতজ্ঞতা বোধ মেশানো। মারিয়া একটা ঘোরের মধ্যে আছে, আমান চায় না মারিয়ার এই অবস্থার কোন সুযোগ নিতে। মারিয়া মেধাবী, সামনে আরো ভালো ভবিষ্যৎ। ভালো জায়গায় যেতে পারলে যোগ্য জীবনসঙ্গীর অভাব হবে না। আর আমানের তো বিয়ে করারই ইচ্ছা নেই।
বিকেলে মারিয়া আসে, সাথে হুইল চেয়ার। আমানকে নিয়ে হাসপাতালে ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়ায়৷ হাসপাতাল, থানা, আদালত – এইসব জায়গায় গেলে জীবন দেখা যায়৷ আমান পেশাগত জীবনে নানা রকম জীবন দেখে অভ্যস্ত। কিন্তু হাসপাতালের জীবন একদম ভিন্ন। এখানে মানুষ বাঁচতে আসে। সবার চোখে মুখে বেঁচে থাকার আকুতি।
এই চিপাচাপা, নানান করিডোর পার করে মারিয়া আমানকে একটা ওয়ার্ডে আনে। এখানে বেশিরভাগ রোগীর অবস্থা খারাপ। শুকিয়ে গেছে, স্যালাইন চলে কিংবা চুপচাপ নীরব হয়ে শুয়ে আছে৷
– ঐ মেয়েটার বয়স মাত্র ২০, ওর নাকি ইচ্ছা ছিলো ডাক্তার হবে। স্টেজ ৩ ক্যান্সার৷ ক্যান্সারের জীবানু ওর সারা শরীরে ছড়িয়ে গেছে৷ বাবা মা সব জমি জমা বিক্রি করে চিকিৎসা করাচ্ছে। শেষ সম্বল বাড়িটাও বন্দক রেখেছে। এখন আর কেমো নিতে পারে না। দূর্বল হয়ে গেছে, খেতেই পারে না। তবুও ক্ষীণ স্বরে যা বলে তার সারমর্ম হলো – বেঁচে থাকার খুব ইচ্ছা।
আমান খুব শক্ত মানুষ। ডাকসাইটে গোয়েন্দা। নার্ভ শক্ত মানুষ। কিন্তু আজ এখানে এসে এইসব মানুষগুলোকে দেখে ওর চোখ ভিজে যায়।
মারিয়া আমানকে নিয়ে সামনের খোলা মাঠে নিয়ে যায়। বড় সবুজ মাঠ, রোগীদের ও আত্মীয় স্বজনের ভীড় চারিদিকে। বেঁচে থাকা ও বাঁচিয়ে রাখার লড়াইতে সবাই ব্যস্ত৷
– স্যার আপনাকে এখানে নিয়ে আসার কারণ আছে। আপনার ভেতরে কোন এক কারণে হতাশা আছে। জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণা আছে৷ কিন্তু এখানে দেখেন বেঁচে থাকার জন্য মানুষের কী আপ্রাণ চেষ্টা, কি অপরিসীম আগ্রহ। আপনাকেও বেঁচে থাকতে হবে।
– বুঝি মারিয়া কিন্তু বেঁচে থাকার কারণ খুঁজে পাই না।
– আমি আপনাকে কারণ বের করে দিচ্ছি স্যার।
– কিভাবে?
মারিয়া ফোন বের করে কাকে যেন ফোন দিয়ে এই মাঠে আসতে বলে। আমান কিছুটা অবাক হয়। এর কিছুক্ষণ পরেই হঠাৎ একটা দম্পতি এসে আমানের পা জড়িয়ে কাঁদতে থাকে। আমান ভীষণ বিব্রত হয়। মারিয়া সেটা বুঝতে পেরে তাদের সরিয়ে আনে।
– এমন করে আমিও আপনার পা ছুঁয়েছিলাম স্যার। আমার জীবন বাঁচানোর জন্য। এই ছেলেটাকে তো আপনি চিনেন স্যার, আলম আপনাদের গাড়ির ড্রাইভার। আপনি অ্যাকসিডেন্টের সময় আলমকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে নিজে এগিয়ে গিয়েছিলেন। যার ফলে আলমের বড় কোন আঘাত বা ক্ষতি হয় নি। শুধু আলম না ওর পরিবারের ৫ জন লোক বেঁচে গেছে। আলম আর ওর বউ বেশ কয়েকদিন ধরেই আসতে চায়। আমিই নিষেধ করেছিলাম, আজ আসতে বলি। ওরা আসার জন্য মুখিয়ে ছিলো৷ এই আমি মারিয়া, আলম এসব মানুষের জন্যই আপনাকে বেঁচে থাকতে হবে স্যার৷
আমান আবেগাপ্লুত হয়। নাহ, মারিয়া মেয়েটা আজ কাঁদিয়েই ছাড়লো। এক অদ্ভুত ভালো লাগায় আমানের মন ভরে যায়।
(চলবে)