আমি যে কে তোমার পর্ব-১৭+১৮

0
12

#আমি_যে_কে_তোমার

(১৭ তম পর্ব)

আমান পোস্টিং নিয়ে মফস্বলে চলে এসেছে। সেটাও আজ ছয় মাস হতে গেলো। ইদানীং মনে হয় নিরিবিলি থাকায় ভালো, একা দূরে, সবার থেকে একদম আড়ালে। ওর বাবা অবশ্য একটু বাঁধা দিয়েছিলো কিন্তু আমান অনঢ় সে আর এই শহরে থাকবে না। বাধ্য হয়ে আমানের বানা আবার আমানের মামী শামীমা জামানকে ধরেন।

– আমান, তোমার জন্য তো আমি আর পারি না। সংসার করলে না আবার বাবার সাথেও থাকছো না। কেউ শহর নগর ছেড়ে মফস্বলে যায়? তোমাকে না দেখলে তো সেটাই বুঝতাম না!

– মামী আমার ভালো লাগে না।

– সেটাই তো তোমার সমস্যা রে বাপ। কেন? মারিয়া ছাড়া কি এই দুনিয়ায় কোনো মেয়ে নেই? আর মেয়েটা যে একবার কি বললো না বললো ভালো করে পরে তো কথাই বললে না। সে যে কথাগুলো বলেছে তার জায়গা থেকে বলেছে। সে তার জায়গায় ঠিক আছে। তোমার বলা উচিৎ ছিলো মানে নিশ্চয়তা দেয়া উচিৎ ছিলো যে তুমি তার অতীত নিয়ে তার পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে মাথা ঘামাতে চাও না।

– আমি তো জোর দিয়ে সেটা বলতে পারি না মামী। আপনি আমার বাবাকে চেনেন। উনি কেমন জানেন। মারিয়াকে মেনে নেবে কিনা আমি নিজেই জানি না। সেক্ষেত্রে আমি মারিয়াকে কিভাবে নিশ্চয়তা দেবো?

– তোমরা কেন সরাসরি কথা বলতে পারো না বুঝি না বাপু। তোমার বাপই তো আমাকে ডেকে আনলো। তা আমাকে ডেকে না এনে ছেলেকে পাশের ঘর থেকে ডেকে আনলেই তো হয়। বললেই হয়, মারিয়াকে তার খুবই পছন্দ। আরে মারিয়ার জন্যই তো তোমাদের বাপ ছেলের অভিমান ভাঙলো। ঐ মেয়েটা যে ম্যাজিক জানে। সে তোমার বাবাকেও অনেক বুঝিয়েছে। যখন তুমি জ্ঞানহারা হয়ে হাসপাতালে ছিলে তোমার বাবা তখন যেতো তো, মারিয়াই তাকে সামলেছে। এমন মেয়েকে পছন্দ না করে পারা যায়, বলো? এখন যাও দয়া করে মারিয়ার সাথে কথা বলো।

– মামী, সে নেই!

– নেই মানে?

– মারিয়ার ইন্টার্নী শেষ। এরপর কোথায় গেছে জানি না। হোস্টেল থেকেও কেউ জানাতে পারলো না।

– ফোন নাম্বার আছে না?

– নাম্বার বন্ধ

– বন্ধ !

আমানের মামীও চুপ হয়ে যায়।

মেয়েটা এমন করলো কেন! আর আমানটাও গাধা। সময়মতো কিছু কাজ করতে হয়। তা না হলে এমনই হয়। শামীমা জামান রাগে গজ গজ করতে করতে চলে গেলেন।

আমানের মনে তবুও নানান প্রশ্ন। এভাবে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দেয়ার পরেও মারিয়া একদম নাই হয়ে গেলো! একটু তো বলেও যেতে পারতো। এটুকু সৌজন্যবোধ ওর থাকা উচিৎ ছিলো।

আমান কিন্তু কম চেষ্টা করে নি। খুঁজে খুঁজে শোভনের ঠিকানা বের করেছে। কিন্তু শোভন ইন্টার্নিই করে নি৷ তার আগেই দেশের বাইরে চলে গেছে। মারিয়াকে খুঁজে পাওয়ার আর কোন ক্লু পায় নি আমান। এমনকি ওর মোবাইলের লাস্ট লোকেশনও ট্রেস করেছে। সেটা সায়দাবাদ বাস টার্মিনাল। তার মানে কোথাও যাওয়ার আগে জেনে বুঝেই মারিয়া মোবাইল অফ করেছে।

মারিয়া যদি ওর সাথে সম্পর্কে জড়াতে না চায়, আমান কি জোর করতো? আমান তো কারো উপরেই জোর করে না। মারিয়ার উপরে জোর করার তো প্রশ্নই উঠে না।

আমান হতাশ হয়। এই শহর ওর কাছে বিষময় লাগে, দূরে পালানোর জন্যই আমান পোস্টিং নেয়। বাবাকে এখানেই রেখে যাবে। বিশ্বস্ত লোকজন আছে, মামা মামীরা আছে সমস্যা হবে না। নিজে হারিয়ে যাবে জনস্রোতে, কাজের মধ্যে।

মফস্বল মানেই নীরব জায়গা কিন্তু কাজ কম নয়। প্রতিনিয়ত নানান রকম অপরাধ হচ্ছে, নতুন নিয়মে অপরাধীরা অপরাধ করছে। আমানের সুবিধা হলো বেশ কিছু সময় সি আই ডি তে থাকার সুবাদে অনেক তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার জানে। আধুনিক অনেক প্রযুক্তির ব্যাপারে ওর বেশ দখল আছে। সেটাই প্রয়োগের চেষ্টা করে। পুলিশের নানান স্তরে ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করে। এসপি পোস্টে যিনি আছেন উনি ভালো মানুষ। আন্তরিক এবং সৎ। আমানের মামাই বলেছিলো এখানে পোস্টিং নিতে। বস ভালো না হলে কাজ করা যায় না। আমান এখন ভীষণ রকম ব্যস্ত। অপরাধী ধরা, বিভিন্ন তদন্ত কার্যক্রম দেখভাল করা, প্রশাসনিক কাজ করা ছাড়াও আমানকে ট্রেনিং দিতে হচ্ছে। কখন সকাল হয় আর রাত হয় জানে না। রাতে বিভিন্ন অভিযানে আমানও যায়। ওর পরিবার নেই, পিছুটান নেই এটাই এখন বড় সুবিধা।

কিন্তু কাজের ফাঁকে আমানের বুক থেকে চাপা কষ্টের একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়। মারিয়া কেনো এভাবে গায়েব হয়ে গেলো আজও আমান বুঝতে পারে না। অভিমানে ওর বুকে ব্যথা করে। জীবনে একজনকেই পছন্দ করেছে, প্রেম নয় বিয়েরই প্রস্তাব দিয়েছে। আর সেখানেই এভাবে প্রত্যাখ্যাত হবে স্বপ্নেও কল্পনা করে নি।

এর মাঝেই একটা ঘটনা ঘটে যেটা নিয়ে সারা দেশ আলোড়িত হয়। একটা মেয়ে কিশোরিই বলা যায়, গ্যাং রেপের শিকার হয়ে মারা যায়। মৃত্যুর আগে একদিন হাসপাতালে ছিলো। সেখানেই প্রবল রক্তক্ষরণ হয়ে মারা যায়। স্থানীয় নিউজ থেকে জাতীয় নিউজ, ফেসবুকের বিভিন্ন অনলাইন নিউজে এই সংবাদ বার বার প্রচারিত হতে থাকে। উপর থেকে বিরাট চাপ, স্পেশাল টিম রেডি হয় যার দায়িত্বে থাকে আমান আহসান।

বিভিন্ন ইনফেরমেশন নিতে নিতে জানতে পারে মেয়েটার মৃত্যুর আগে জ্ঞান ছিলো। ওর পাশে যারা ছিলো তাদের সাথে টুকটাক কথাও বলেছে। কারা এই ঘটনার সাথে জড়িত কেউ জানে না। হতে পারে যারা ওর শেষ মুহূর্তে ওর পাশে ছিলো তারা কিছু জানে। মৃত্যুর আগে ভিকটিমরা অনেক কিছু বলার চেষ্টা করে। আমান সিদ্ধান্ত নেয় ঐ হাসপাতালে যেয়ে সেদিনের ডিউটিতে থাকা সবার সাথেই কথা বলবে। প্রয়োজনে জবানবন্দী নেবে। যে কোনো একটা ক্লু বের করতেই হবে। ক্লু’র খোঁজে বেসরকারি হাসপাতালের দিকে যায় আমান।

(চলবে)

#আমি_যে_কে_তোমার

(১৮ তম পর্ব)

হাসপাতালে যখন পৌঁছালো তখন শেষ বিকেল। ভিকটিমকে কেন বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করালো আমান বুঝতে পারলো না। এসব ক্ষেত্রে সরকারি হাসপাতালেই সাধারণত ভর্তি করানো হয়। গাড়ি থেকে নেমে সরাসরি হাসপাতালের প্রশাসনিক রুমে চলে গেলো। এই কেস নিয়ে বেশ প্রেসারে আছে। আজ একদম পুরো পুলিশের ড্রেস পরেই এসেছে। যার যা পেশা, তার সেই বেশ আর সেভাবেই মানুষ দেখতে অভ্যস্ত।

ম্যানেজার আমানকে দেখে একদম চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। আমান তাকে থামিয়ে দিয়ে সামনের চেয়ার টেনে আরাম করে বসে আসার কারণ জানালো।

– বেসরকারি কোনো হাসপাতাল তো এই ধরণের কেস নিতে চায় না, তারা সরকারি হাসপাতাল দেখিয়ে দেয়। আপনারা যে এই ভিকটিমকে ভর্তি করিয়েছেন, আমি ভীষণ অবাক হয়েছি।

– স্যার একদম সত্যটা বলি। আমাদের একজন মেডিক্যাল অফিসারের জিদের কারণে এই মেয়েটাকে ভর্তি নিতে হয়েছিলো। কে বা কারা মেয়েটাকে একদম ভোরে হাসপাতালের সামনে রেখে যায়। ব্লিডিং এ মেয়েটা ভেসে যাচ্ছিলো, অবস্থা এমন যে দ্রুত ট্রিটমেন্ট না করলেই নয়। তবুও আমাদের হাসপাতালের লোকজন রাজী হচ্ছিলো না কিন্তু ডিউটি ডাক্তার সবার আপত্তিকে অগ্রাহ্য করে নার্সদের সাথে নিয়ে ভর্তি করায়। চিকিৎসার পুরোটা সময় সেই সাথে ছিলো। এটা নিয়ে ম্যানেজমেন্ট ডিউটি ডাক্তারের সাথে বেশ ঝামেলাও করে। ডিউটি ডাক্তার একজন লেডি উনি চাকরি ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন কিন্তু তখন ম্যানেজমেন্ট নরম হয়। কারণ এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে কোনো লেডি ডাক্তার সহজে পাওয়া যায় না, তার উপরে উনি খুব আন্তরিক। উনি আসার পর থেকে আমাদের রোগীর সংখ্যা বিশেষ করে মহিলা রোগীর সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। এজন্য ম্যানেজমেন্ট একটু সতর্ক করে ছেড়ে দিয়েছে। উনি এখন ডিউটিতেই আছেন। একটু পরেই উনার শিফট শেষ হবে। আমি উনাকে আর সাথে থাকা নার্সদের ডেকে দিচ্ছি।

ম্যানেজার বেল টিপে ডিউটি ডাক্তার আর কয়েকজন নার্সকে আসতে বললো।

এই ডিউটি ডাক্তারের কথা শুনে আমানের নিজের মায়ের কথা মনে পড়লো। ওর মা এমন মানবিক মানুষ ছিলেন। আল্লাহর কি ইচ্ছা তিনি জানেন, চোখের পলকে উঠিয়ে নিলেন!

আরেকজনের নাম আমানের মনের দরজায় উঁকি মারছিলো। আমান সে নাম ভুলে যেতে চায়, কিন্তু কিছু নাম ইচ্ছা করলেই ভোলা যায় না। ঠিক তেমনি হাজার চেষ্টা করেও এই নামটি সে ভুলতে পারছে না।

পুলিশের মোটা কাপড়ের ইউনিফর্মের নিচে আমান ওর আবেগ লুকিয়ে রেখে কাজ করে যাচ্ছে।

পায়ের শব্দে আমান মুখ তুলে একটু ঘাড় ঘুরিয়ে কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকায় এবং তখনই মনে হয় ওর হার্ট রক্ত পাম্প করা বন্ধ করে দিয়েছে!

– মারিয়া!

ফিসফিসিয়ে আমান এই নামটা এতোই নিচু স্বরে উচ্চারণ করে ওর নিজের কান অবধি যেন পৌঁছায় না।

– স্যার উনারাই মেয়েটার সাথে সব সময় ছিলো।

– আমি প্রত্যেকের সাথে আলাদা আলাদা করে কথা বলতে চাই। আপনি একটু অন্য রুমে যান।

ম্যানেজারের উদ্দেশ্যে বললো আমান।

ম্যানেজার দ্রুত রুম ছেড়ে বের হয়ে গেলো। মারিয়া বাদে অন্যেরা বাইরে গেলো।

– বলেন মৃত মেয়েটাকে কোথায় কিভাবে পেলেন? আর সে কারো নাম বা কোনো কিছু বলেছে কিনা?

আমান এমনভাবে মারিয়ার সাথে কথা বললো যেন তাকে চেনেই না, আজই প্রথম সাক্ষাৎ!

মারিয়া একটু অবাক হলেও নিজেকে সামলে নিলো। যে অপরিচিত থাকতে চায়, তার সাথে অপরিচিতই থাকা ভালো!

– আমি নাইট শিফট শেষ করে ডক্টর’স রুমে এসে বসেছি ঠিক তখনই আমাদের নাইটগার্ড রমজান আলীর চিৎকার। সে ডিউটি শেষে বাড়ি ফিরছিলো। বের হতেই মেয়েটাকে দেখে। আমি আর সিস্টার মিতা দৌড়ে যাই। মেয়েটা রক্তে ভেসে যাচ্ছে৷ সারা শরীর জুড়ে ক্ষত, দেখে সহ্য করা কঠিন।

আমি আর সিস্টার ধরাধরি করে হাসপাতালের ভেতরে আনতে গেলে হাসপাতালের অন্য স্টাফরা বাঁধা দেয়, আমি সেগুলোর তোয়াক্কা না করে ভর্তি করি। ইমিডিয়েট যা যা করার দরকার সবই করি। কিন্তু মেয়েটার এতো রক্তক্ষরণ হয়েছিলো যে শকে চলে যায়। আমাদের সর্বাত্মক চেষ্টা সফল হয় নি।

আর নাম বলতে খালি বিড়বিড় করে বলতো – রিয়াজ ভাই কাজটা ঠিক করলা না, তুমি ভাই হও না? এটুকুই।

মারিয়া থেমে যায়। আমান জবানবন্দি নিয়ে মারিয়াকে যেতে বলে। সিস্টার মিতা এরপর ঢোকে। মারিয়া আমানের এই আচরণের কারণ কিছুটা বোঝে আবার বোঝে না। মারিয়া না বলে চলে এসেছে, এই কারণে ক্ষুব্ধ হয়েছে ঠিক আছে৷ কিন্তু কেন চলে এসেছে, কোথায় কিভাবে ছিলো সেই বিষয়ে তো জিজ্ঞাসা করতে পারতো!

মারিয়ার ডিউটি টাইম শেষ। জিজ্ঞাসাবাদ শেষ হতেই বের হয়ে চলে যায়। এখানে ছোট্ট একটা বাসা নিয়ে থাকে। একদম একার সংসার। সত্যি বলতে এখন আর একা থাকতে ভালো লাগে না। একটা ভরা সংসার, বাচ্চাদের হুটোপুটির খুব অভাব বোধ করে। কিন্তু তেমন কেউ জীবনে আসলো না ভরসা করে যার হাত ধরতে পারবে। যা দুই একজন চেষ্টা করে তাদের সেই চেষ্টাকে ইতিবাচক মনে হয় না। একাকী নারীর একাকিত্বের সুবিধা নেয়ার চেষ্টা মনে হয়। এজন্য যতোই একাকী লাগুক, কারো সাথে জড়াতে মন চায় না।

আর সত্যি বলতে আমানকে মারিয়া ভুলতেই পারে নি, পারেও না, সম্ভবও না। সেদিন আমান প্রস্তাব দিলে মারিয়ার মন আনন্দে প্রজাপতির মতো নেচে উঠেছিলো। যে কথাগুলো বলেছিলো সেগুলো বলার দরকার ছিলো, প্রয়োজনীয়তা ছিলো। মারিয়া ভেবেছিলো আমান এরপরে ওর সাথে যোগাযোগ করবে, মারিয়াকে আশ্বস্ত করবে। মারিয়ার সব ভয়, দ্বিধা যে অমূলক সেটাই জানাবে।

কিন্তু এক দিন, দুই দিন, সাত দিন, পনেরো দিন – নাহ আমানের আর খোঁজ ছিলো না। তারপরে তো মারিয়াকেও অন্য পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। আজ আমানের আচরণ বুঝিয়ে দেয় – মারিয়া আমানের কেউ তো নয়ই, পরিচিতই নয়!

(চলবে)