#আমি_যে_কে_তোমার
(১৯ তম পর্ব)
আমান কাজ শেষ করে অফিস থেকে যখন বের হলো, তখন রাত নয়টা। অবশেষে রেপ কেসটার সুরাহা করা গেছে, একটা টিম যেয়ে আসামীদেরও ধরে ফেলেছে। অত্যন্ত দু:খজনক হলো আসামীরা মেয়েটির অপরিচিত কেউ নয়। ওর আপন চাচাতো ভাই আর তার বন্ধুরা। পাশাপাশি বাড়ি, যেমনটা গ্রামে থাকে। বাড়ির পেছনে একটু অন্ধকার মতো জায়গায় সন্ধ্যার পরে ঐ চাচাতো ভাই তার বন্ধুদের নিয়ে নেশা করছিলো। মেয়েটা ঐ চাচাতো ভাইদের দেখে ফেলে, বাপ চাচাকে বলে দেয়ার হুমকি দেয়। আর তাতেই তারা ক্ষিপ্ত হয়ে মেয়েটির মুখ চেপে ধরে এভাবেই সর্বনাশটা করে। শেষে যখন কিছুটা হুঁশ ফেরে তখন মেয়েটি প্রায় বেঁহুশ। এরপর এই হাসপাতালের সামনে ফেলে রেখে যায়। মেয়েটি মারা যাওয়াতে ভেবেছিলো কেউ কিছু জানতে পারবে না। কিন্তু ডিউটি ডাক্তার ডাক্তার মারিয়া এবং সাথে থাকা নার্স মিতা ও ওয়ার্ড বয় হাসান – তিনজনই একই কথা বলেছে যে রিয়াজ নামের একজনের নাম বার বার উচ্চারণ করেছে। এই রিয়াজই হলো হতভাগ্য মেয়েটির চাচাতো ভাই।
আমান আপাততঃ টেনশনমুক্ত বাকি কাজ দায়িত্বপ্রাপ্ত এস আই করে ফেলতে পারবে। মামলার টেনশন চলে যেতেই আরেকটা টেনশন ওর মাথায় আসলো – মারিয়া এখানে কিভাবে আসলো? ঢাকা থেকে যেমন দূরে তেমনি মারিয়ার বাড়ির এলাকা থেকেও দূরে। আবার মামলার তদন্তের নাম করে যা জানতে পারলো মারিয়া একাই থাকে এবং অবিবাহিত।
তাহলে? ঘটনা কি? এমন গায়েব কেন হলো?
দ্রুত নিজের নির্ধারিত কোয়ার্টারে ফিরে ড্রেস চেঞ্জ করে গোসল করে একটা সাদা পোলো টি শার্ট পরে বের হয়ে হলো। হাতে গাড়ির চাবি। ড্রাইভার গানম্যানকে আগেই ছুটি দিয়ে দিয়েছে৷ গাড়িতে উঠে কি হোলে চাবি ঢুকিয়ে স্টার্ট দিলো একটা নির্দিষ্ট ঠিকানার উদ্দেশ্যে।
মারিয়া ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে ছিলো। কিছুই ভালো লাগছে না। অন্যদিন হাসপাতাল থেকে এসে ভালো করে গোসল করে বাসার ড্রেস পরে এক কাপ চা কফি খায়। হালকা নাস্তা করে। আজ তার কিছুই করে নি। আমানের এমন অপরিচিতের মতো ব্যবহার সে মানতেই পারছে না। কেন যেন বহু দিন পরে হাউমাউ করে কান্না আসছে। ওর মনে হচ্ছে পৃথিবীতে আসলেই ও একা, বড্ড একা!
আমান রাস্তার পাশের এক চায়ের দোকানদারের কাছ থেকে ঠিকানাটা ঠিক আছে কিনা জেনে নিশ্চিত হলো। এরপর নতুন সেভ করা নাম্বারটাতে ফোন দিয়ে কিছুটা গম্ভীর কন্ঠে বললো – আমি আমান। তোমার বাসার সামনের রাস্তায় গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। যে কাপড় পরে যেভাবেই আছো, ঠিক সেই অবস্থায় চলো আসো!
একদম পুলিশী মেজাজের কথা! মোবাইলের অপর প্রান্তের ব্যক্তির কোনো উত্তর বা প্রতিক্রিয়া না শুনেই কট করে লাইন কেটে দিলো। ফোনের অপর পাশের ব্যক্তির প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে ভেবে আমানের ঠোঁটের কোণায় সামান্য হাসির রেখা দেখা দিলো।
এটা মারিয়ার নাম্বার। আজই হাসপাতাল থেকে যোগাড় করেছে, ঠিকানাটাও সেখান থেকে যোগাড় করা। মারিয়া কেন এমন উধাও হয়ে গিয়েছিলো এটা না জানা পর্যন্ত আমানের রাতে ঘুম হবে না। এজন্য মফস্বলের নীরব রাতেও মারিয়ার বাসার সামনে চলে এসেছে।
মারিয়া ফোনটা পাওয়ার পরে হতবিহ্বল হয়ে গেলো। আমান! এই রাতে? এইখানে ওর ঠিক বাসার সামনে? পাগল হয়ে গেছে নাকি? আমানের কন্ঠের মেজাজের কথা মনে হতেই অতি দ্রুত বাসার চাবি হাতে নিয়ে হাত ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে বের হয়ে পড়লো। মারিয়ার পরনে খুব সকালে পরা খয়েরি রঙের একটা থ্রি পিস। নিজেকে কেমন লাগছে সেটা না ভেবেই দ্রুত বের হয়ে গেলো।
ঠিকই আমান নিচে দাঁড়িয়ে আছে। আধো আলো আধো অন্ধকারে আমানের দীর্ঘকায় শরীরের ছায়া দেখা যাচ্ছে। মারিয়া যাওয়া মাত্র আমান দরজা খুলে দিলো। ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটে উঠে বসলো মারিয়া। আমান উঠেই গাড়ি স্টার্ট দিলো। আমান কোনো কথা বলে নি। পাথরের মতো মুখ করে বসে আছে। সেদিকে তাকিয়ে মারিয়াও কিছু বলতে সাহস পাচ্ছে না।
গাড়ি কিছুক্ষণ চলার পর রেল স্টেশনের পাশে থামলো। মারিয়া বুঝতে পারলো না আমান এখানে কেনো নিয়ে আসলো!
আমান গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে মারিয়ার দরজা খুলে দিলো। তারপর অনেকটা গট গট করে হেঁটে স্টেশনের একদম পাশের একটা চায়ের দোকানের একটু সাইডে রাখা প্লাস্টিকের একটা চেয়ার টেনে মারিয়াকে বসতে বলে নিজে একটা টেনে বসলো।
– এই লাল্টু, দুইটা রেগুলার চা দাও ভাই।
এরপর ঘাড় ঘুরিয়ে মারিয়ার দিকে ঘুরে বললো
– এই মফস্বলে একটু রাত হলেই একদম নীরব নিস্তব্ধ হয়ে যায়। কিন্তু স্টেশনের কাছে সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই জমজমাট থাকে। লোকজন আসছে যাচ্ছে, টেন আসছে, ফেরিওয়ালা হাঁক দিচ্ছে। এজন্যই এখানে আসা। এখন বলো তুমি কোথায় গায়েব হয়ে গিয়েছিলে? আর গায়েব হয়েছো ভালো কথা ফোন নাম্বারের কি হলো?
– আমি আমার বাড়িতে গিয়েছিলাম। সেখানেই প্রায় দেড় মাস ছিলাম।
– মানে? বলো কি?
– জি, আর যাওয়ার পথেই সায়দাবাদ থেকে আমার মোবাইল চুরি হয়ে যায়৷
– আচ্ছা।
– আসলে আব্বা অনেক অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে ছিলেন। আমার প্রতি অন্যায় করা হয়েছে ভেবে প্রায় সময় হাউমাউ করে কাঁদতেন। তার কান্নাকাটিতে অতিষ্ঠ হয়ে আমার সৎ ভায়েরা আমার খোঁজ লাগায়, এরপর যখন জানতে পারে আমি এখন একজন পাশ করা ডাক্তার তখন সৎ ভায়েরা নিজ গরজেই আমাকে খুঁজে বের করে।
দেখুন, আমার প্রতি অন্যায় করুক আর যাই করুক না কেন, আমার একমাত্র রক্তের সম্পর্কের আপনজন আমার আব্বা। তার এমন অসুস্থতার নিউজ পেয়ে স্থির থাকা কঠিন। এদিকে ইন্টার্নীও শেষ। জমানো সব টাকা তুলে বাড়ির দিকে রওনা দিই, ভেবেছিলাম আপনাকে ম্যাসেজ দেবো কিন্তু তার আগেই ফোন হারিয়ে গেলো! আমি বাড়ি যাওয়ার এক সপ্তাহ পরেই আব্বা আমাকে ছেড়ে চলে গেলেন, যেন আমাকে দেখার অপেক্ষাতেই ছিলেন! তারপর উনার শেষ বিদায় আরো নানাম বিষয় শেষ করতে করতে দেড় মাস কেটে গেলো। নামের আগে ডা: বসানোর রেজিষ্ট্রেশন পেলাম, এদিকে আব্বার চিকিৎসা আর মিলাদ বাবদ যা খরচ হলো তাতে আমার জমানো টাকা মোটামুটি শেষ। বাধ্য হয়ে তড়িঘড়ি করে বিজ্ঞপ্তি দেখে এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে এসে যোগদান করি।
অনেক কথা বলে থামলো মারিয়া।
আমান কী যেন ভাবলো কিছুক্ষণ। তারপরে হঠাৎ করেই উঠে দাঁড়িয়ে চা শেষ না করেই মারিয়ার হাত ধরে অনেকটা টেনে নিয়ে যেতে লাগলো।
আমানের হঠাৎ এই মুড চেঞ্জে মারিয়া কিছুটা ভয় পেয়ে গেলো।
– আ আ আপনি আমাকে এভাবে টেনে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?
– থানায়
– থানায়! কিন্তু কেনো?
– বিয়ে করতে!
– বিয়ে করতে থানায় কেন, আজব! আর এখন এভাবে বিয়ে? আপনার মাথা খারাপ হলো নাকি?
– আমার মাথা একদম ঠিক আছে। বরং এতোদিন ঠিক ছিলো না। খালি হারায় হারায় ভাব আর ভালো লাগে না। বিয়ে করে তবেই আমার শান্তি।
– কিন্তু থানায়!
– কারণ, থানাতেই তোমার সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎ
আর প্রধান কারণ হলো এই রাতে কাজীকে ধরে তুলে আনার মতো অদ্ভুত কাজ একজন পুলিশই ভালো পারবে। নিজের বিয়ের জন্য তো আর নিজেই এই কাজ করতে পারি না, এজন্য নিকটস্থ থানার হেল্প নিতে হচ্ছে!
আমান এমনভাবে বলছে যেন কোনো অ্যাডভেঞ্চারে বের হচ্ছে। কিন্তু মারিয়া তবুও হতবিহ্বল এবং স্তম্ভিত।
(চলবে)