আমি যে কে তোমার পর্ব-৬+৭

0
1

#আমি_যে_কে_তোমার

(৬ষ্ঠ পর্ব)

তোমাকে ভুলতে চেয়ে
আরো বেশি ভালোবেসে ফেলি
তোমাকে ছাড়াতে গিয়ে
আরো বেশি গভীরে জড়াই,
যতোই তোমাকে ছেড়ে যেতে চাই
দূরে
ততোই তোমার হাতে বন্দি হয়ে পড়ি,
তোমাকে এড়াতে গেলে এভাবেই
আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে যাই।

মারিয়ার সামনে যেন নতুন জগতের দরজা উন্মুক্ত হয়। একদম মফস্বল থেকে এমন ব্যস্ত শহরে এসে খাপ খাইয়ে নিতে কষ্ট হয়। এতো আলো, এতো মানুষ, এতো ব্যস্ততা!

ওর পোষাকে, চলনে লেগে আছে গ্রামের ছোঁয়া। অনেক মেয়েকেই দেখে কি সুন্দর চোখে কাজল এঁকে, হালকা লিপস্টিক দিয়ে ক্লাসে আসে। ওদের চেহারায়, কথায় যেন আলো ঝলমল করে। এসব দেখে মারিয়া যেন কুঁকড়ে যায়। কিন্তু মনের মধ্যে একটাই চিন্তা, পড়াশোনাটা ঠিকঠাক করতে হবে। ঘন্টার পর ঘন্টা লাইব্রেরিতে কাটায় মারিয়া। প্রথম থেকেই ও যেন সবার মধ্যে থেকেও নেই। অনুজ্জ্বল, চোখে পড়ার মতো কেউ না।

একটা নির্দিষ্ট জায়গায় প্রতিদিন বসে। চুপচাপ লেকচার শোনে, বের হয়ে যায়। একদিন হঠাৎ করেই ওর পাশে কেউ একজন বসে। না কোন মেয়ে না, একটা ছেলে।

– তোমার নাম কি?

– জি? আমাকে বলছেন?

– আরে ক্লাসমেট কে কেউ আপনি বলে?

– মারিয়া

– বাহ, খুব সুন্দর নাম। তুমি দেখতেও মা মেরির মতোই নিষ্পাপ। আমার নাম শোভন। তোমাকে দেখি একাই বসে থাকো।

– একা বসি, কারণ আমি এসেছি গ্রাম থেকে। আমার এখানে কোন গ্রুপ নেই। স্কুলের বা কলেজের কোন বন্ধু এখানে নেই৷

– বন্ধু তো বানিয়ে নিতে হয়। এ দেখো আমি তোমাকে বন্ধু বানিয়ে নিচ্ছি।

মারিয়ার মুখে মিষ্টি একটা হাসি ফুটে উঠে৷ মারিয়া মেডিকেল হোস্টেলেই থাকে। প্রথম বর্ষে একটু কষ্টই হয়। তার উপরে হোস্টেলে র্যাগিং এর যন্ত্রণা। মারিয়া কোন প্রতিবাদ করে না। চুপচাপ সব মেনে নেয়। ওর কাছে এতো দূর আসাটাই স্বপ্ন। এম বি বি এস শেষ করতে সব কষ্ট সহ্য করতে রাজী।

মারিয়ার একাকী জীবনে শোভনের উপস্থিতি ওর জীবনকে কিছুটা হলেও চঞ্চলতা এনে দেয়। একসাথে পড়া, প্রাকটিক্যাল ক্লাস সবকিছুতে একটু রঙের ছিঁটা আসে যেন। মারিয়া মনে হয় একটু একটু করে নিজেকে ভালোবাসতে শেখে। একটু যত্ন নেয়া, একটু পরিপাটি থাকা, মারিয়াও বুঝি চোখের নিচে কাজল টানে, কপালে ছোট্ট একটা টিপ দেয়।

পরীক্ষার রেজাল্টে মারিয়া সব সময় প্রথম দিকে। শোভন ভীষণ উচ্ছ্বসিত হয়। এখন মারিয়াকে অনেকেই চেনে, এগিয়ে এসে গল্প করে। মারিয়া তো ভাব নিতে জানে না। ও তো পল্লী গাঁয়ের মেয়ে, ঠিক তেমনি মায়া মায়া, সহজ সরলতা।

শোভনের পরিবার বেশ ধনী। বাবা মায়ের যা আছে তাতে একটু হাল ধরে রাখলেই বাকি জীবনটা ফুরফুরা। কিন্তু ওর মায়ের কী খেয়াল, ছেলেকে ডাক্তার হতে হবে! শোভন মেধাবী সন্দেহ নেই কিন্তু এই সাবজেক্টে ওর ভালোবাসা নেই। ওর গিটার হাতে গান গাইতে ভালো লাগে, হুটহাট কোথাও ঘুরতে ভালো লাগে। মাঝে মাঝেই হাওয়া হয়ে যায়৷ কোথায় ছিলো জিজ্ঞেস করলেই অমুক জায়গায় ট্যুর গিয়েছিলাম বলে হো হো করে হাসি দেয়।

নেহায়েত মেধার জোর বেশি কিংবা ভাগ্যও খুব ভালো এজন্য ফেল করে না। পাশ করে যায়। আর মারিয়ার হেল্প তো আছেই।

ওদের ক্লাসমেট ফারহা শোভনকে পছন্দ করে। ওর এই উড়ো উড়ো ভাব, কেয়ার করি না টাইপ স্বভাব ফারহার ভীষণ রকম পছন্দ। কিন্তু শোভনের সাথে মারিয়া যেভাবে গ্লুর মতো আঁটকে থাকে ফারহার সহ্য হয় না। এজন্য সুযোগ পেলেই মারিয়াকে অপমান করে, অপদস্ত করে।

একবার কয়েকজন মিলে প্লান হলো ঘুরতে যাবে। খুব বেশি দূরে নয়, আশেপাশেই। শোভেন বড় উদ্যোগ নিয়েছে। শোভন আছে মানে ফারহা থাকবেই। গোল বাঁধলো মারিয়া যাবে না। মারিয়ার না যাওয়ার আসল কারণ এসব জায়গায় টাকা খরচ করা ওর জন্য বেশ কঠিন। যদিও আরো কিছু বৃত্তির টাকা পায় আর একটা টিউশনিও করে এখন ভালো অংকের অর্থ ওর একাউন্টে জমা হয় কিন্তু এভাবে খরচ করার মতো বিলাসিতা ওর সাজে না। শোভন এজন্য প্রস্তাব দিতেই মারিয়া না করে। দুর্ভাগ্যক্রমে সেখানে ফারহা ছিলো।

– বাদ দে শোভন, ও তো বৃত্তির টাকায় পড়ে। ওর জন্য এসব ঘোরাঘুরি করা কঠিন।

এই কথায় মারিয়ার মুখ এতোটুকু হয়ে যায়। কালো মেঘ এসে ওর মুখ ঢেকে ফেলে।

শোভন সেটা খেয়াল করে ঠিকই। রাগে ওর শরীর জ্বলতে থাকে।

– ওর মেধা আছে বলেই বৃত্তি পায়। আমাদের মতো ঘষামাজা রেজাল্ট ওর না। আর ওর টাকা আমি দেবো। আমরা বন্ধুরা আছি কি জন্য? তোর এতো মাথা না ঘামালেও চলবে।

শোভনকে আর রাগাতে চায় না ফারহা। এরপরে দেখা যাবে ওকেই বাদ দিয়ে দিয়েছে। মারিয়া না গেলে প্লানই ক্যান্সেল – এমন ভয় দেখিয়ে মারিয়াকে রাজী করায়। বাধ্য হয়ে মারিয়া রাজী হয়। তার আগে কিছু কেনাকাটা না করলেই নয়।

বেশ ভালো দাম দিয়ে একটা থ্রি পিস কেনে। সামান্য কিছু প্রসাধন আর এক ডজন কাঁচের চুড়ি। এক পাতা টিপ সাথে।

সবার সাথে বের হয়। রয়েল ব্লু কালারের ড্রেসে মারিয়াকে খুব সুন্দর লাগছে। খোলা চুল উড়ে পড়ছে নাকে মুখে। কপালের ছোট্ট টিপটা যেন সেই সৌন্দর্যকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে।

ওদের গন্তব্য পানাম নগর। সেখানে পৌঁছে এস্থেটিক ছবি তোলায় সবাই ব্যস্ত। শোভনের এসবে হেলদোল নেই। সে শুধু পুরাতন বাড়ির ছবি তুলছে। কোন মানুষের ছবি সে তুলবে না। ফারহা কিছুক্ষণ ঘ্যানঘ্যান করে অন্যকে দিয়ে ছবি তোলাচ্ছে। আর মারিয়ার কেমন যেন নস্টালজিক লাগে। এসব নগর এক সময় কতো রমরমা ছিলো। কতো মানুষের প্রভাব প্রতিপত্তির ইতিহাস এখানে খোদিত। কত কান্না, হাসি আবার নির্যাতনের সাক্ষী প্রতিটা ইট, দরজা, জানালা।

সেই ইতিহাস বোঝার চেষ্টা করে মারিয়া। দেয়ালের গায়ে হাত বুলাতে থাকে। কিন্তু মারিয়া জানে না কেউ একজন তাকে দূর থেকে দেখছে, সেই দেখায় মুগ্ধতা, একইসাথে আশ্চর্যের অনুভূতি।

(চলমান)

#আমি_যে_কে_তোমার

(৭ম পর্ব)

আমানের দিন কাটছে ভীষণ রকম ব্যস্ততায়। এমন কিছুই তো চেয়েছিলো। কাজের মধ্যে এভাবে ডুবে গেছে যে কখন সকাল হয় আর কখন রাত হয়, বুঝে উঠতে পারে না। এমন জীবনই তো আমান চেয়েছিলো, ভীষণ ক্লান্ত হয়ে বাসায় ফিরবে তারপর সেই ক্লান্তিতেই ঘুমিয়ে যাবে। কোন চিন্তা, কোন একাকিত্ব সেখানে যেন বাসা বাঁধতে না পারে।

আচ্ছা, এভাবে কি একাকীত্ব ভোলা যায়? এভাবে কি এক জীবন পার করা যায়? হঠাৎ রাতে ঘুম ভেঙে কি মনে হয় না, আমার কেউ নেই, কোথাও কেউ নেই!

আমান জানে সে আসলে নিজেকেই এড়িয়ে চলে। নিজের আয়নায় নিজেই দাঁড়ায় না। যদি সে এক মুহূর্তের জন্য মনের আয়নার সামনে দাঁড়াতো, তাহলে ঠিকই দেখতে পেতো – একজন একাকী মানুষের প্রতিচ্ছবি, যে খুব ক্লান্ত, যার হৃদয় ভালোবাসা পাওয়ার জন্য ব্যাকুল কিন্তু কিভাবে পেতে হয় তা জানে না।

সি আই ডি সদর দপ্তরেই পোস্টিং হয়েছে আমানের। বড় বড় মামলার তদন্ত কাজে নানান জায়গায় ছুটে বেড়ায়৷ তেমনই এক কাজে নারায়ণগঞ্জ যাওয়া লাগলো। ওর টিমে নয়ন বলে একটা ছেলে আছে, এস আই। বেচারা ফ্যামিলির চাপে পুলিশে এসেছে। ওর আসলে কবি হওয়া উচিৎ ছিলো। একটু উদাসীন প্রকৃতির আর ঘোরাঘুরি পছন্দ করে। কোথাও তদন্তে গেলে তার দুইটা কাজ। কোন দর্শনীয় স্থান থাকলে দেখা আর ভরপেট খাওয়া।

আমান মাঝে মাঝে রসিকতা করে।

– নয়ন, তোমার জীবনের উদ্দেশ্য বোধ হয় একটাই। খাওয়া এবং খাওয়া।

– জি স্যার। ছোটবেলায় খুব কষ্টে বড় হইছি তো স্যার। পান্তা ভাত আবার কখনো পান্তা ভাতের পানিটুকু খেয়েই কেটেছে। হলে এসে ডালের পানি দিয়েই দুই প্লেট ভাত খেয়ে ফেলতাম। কি যে মজা লাগতো স্যার।

খুব সাবলীলভাবে বলে নয়ন। কিন্তু আমানের খুব কষ্ট হয়। আহা, ছেলেটাকে এভাবে না বললেই পারতো। তারপর থেকে আমান নিজেই খোঁজ নিয়ে ভালো ভালো রেস্টুরেন্টে যায়, নামকরা খাবার খোঁজে।

এভাবেই পানাম নগরে আসা। অন্যদের মতো ঘুরে ঘুরেই দেখছিলো। এই বাড়ি, সেই দেয়াল, দরজার কারুকার্য, নকশা কাটা জানালা।

হঠাৎ করেই একটা চেহারা সামনে পড়ে। মনে হয় খুব পরিচিত কিন্তু কোথায় দেখেছে মনে করতে পারে না। গাড় ব্লু রঙের থ্রি পিস পরা। খোলা চুলগুলো উড়ছে, হাতে কাঁচের চুড়ি আর কপালে ছোট্ট একটা টিপ। মনে হচ্ছে এই পুরাতন নগরীতে সেই কবেকার কোন পাতালপুরীর রাজকন্যার আগমন হয়েছে। হঠাৎ করেই নিজেকে মর্ত্যের এই মাটির পৃথিবীতে এসে বড় অবাক হয়ে গেছে। তার বড় বড় চোখ ভরা বিস্ময়, কৌতুহল। হাত দিয়ে সব ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছে। মেয়েটার চোখে মুখে শিশুদের মতো নিষ্পাপ অভিব্যক্তি।

কতোক্ষণ তাকিয়ে ছিলো জানে না। হঠাৎ মেয়েটাকে সঙ্গের কেউ ডাক দিলো। আমান বুঝলো কোন স্টুডেন্ট গ্রুপ স্টাডি ট্যুর বা নিছকই ঘুরতে বের হয়েছে। এভাবে ওর তাকিয়ে থাকা মোটেও ভদ্রতার মধ্যে পড়ে না। কিন্তু আমানের যেন কাজী নজরুলের মতো বলতে ইচ্ছে করছে-

তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয়
সে কী মোর অপরাধ!

নয়নের হাক ডাকে আমানকে ফিরে যেতে হলো। ওদের আরো কিছু কাজ বাকি আছে। কিন্তু আমানের মনের মধ্যে ব্যাপক প্রশ্ন এবং কৌতুহল – মেয়েটাকে এতো চেনা চেনা লাগছে কেন? কোথায় দেখেছে?

আপাততঃ মাথা থেকে এসব ঝেড়ে কাজে মন দিলো আমান। কিন্তু ভ্যাজাল বাঁধলো রাতের বেলা ঠিক ঘুমাতে যাওয়ার আগে।

আমান ওর জীবনে কোন মেয়েকে প্রবেশ করতে দেয় নি। কী এক অপ্রতিরোধ্য প্রাচীর দিয়ে রেখেছিলো। আজ অবধি সেখানে কেউ প্রবেশ করে নি। কিন্তু আজ, সেখানে যেন চেনা মুখের অচেনা কারো আনাগোনা। কে মেয়েটি? এই একই প্রশ্ন মাথায় ঘুর ঘুর করছে। সেই সাথে সেই চোখ, ছোট্ট টিপ আর এলোমেলো চুলের মুখটি বার বার চোখের সামনে ভেসে উঠছে।

অন্য দিনের মতো আজও ক্লান্ত ছিলো আমান। কিন্তু অন্য দিনের মতো বালিশে মাথা দেয়া মাত্র ঘুম আসলো না। হাজার রকম কথা আর চিন্তা মাথার ভেতর কাঠ ঠোকরার মতো ঠোঁকরাতে লাগলো।

আমানের আজ রাতে ঘুম হলো না। ঘুম আসলো একদম শেষ রাতে যখন সে মিষ্টি একটা স্বপ্ন দেখলো। বিরাট বড় কৃষ্ণচুড়া গাছ যার গায়ে আগুন লাগানোর মতোই কৃষ্ণচুড়া ফুল। বাতাসে সেই ফুল টুপ টুপ করে ঝরে পড়ছে গাছের নিচে দাঁড়ানো এক নারীর উপর। সেই নারীটি আমানের দিকে ঘুরে দাঁড়ানো মুখ দেখা যাচ্ছে না। দুই হাত দুই দিকে ছড়িয়ে ঝরে পড়া ফুলের আদর নিচ্ছে যেন।

হঠাৎ মেয়েটা আমানের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে হাসে। হাত বাড়িয়ে কাছে যেতে বলে। আমান অবাক হয়ে দেখে পানাম নগরে দেখা সেই মেয়েটা।

তারপর আমানের ঘুম ভেঙে যায়।
ভালোলাগা এবং কষ্ট দুই অনুভূতির এক অদ্ভুত সংমিশ্রণ টের পায়।

কোথায় তাকে পাবো – বিড় বিড় করে নিজেকে এটাই যেন বলে।

(চলমান)