#আমি_যে_কে_তোমার
(৮ম পর্ব)
দিন দিন ফারহার অত্যাচার বেড়েই চলেছে। ইদানীং মারিয়ার মনে হয় কবে না জানি ফারহা ওর বড় কোন ক্ষতি করে বসে।
তেমনি এক ভাবনা থেকে কলেজ ক্যান্টিনে ফারহাকে ডেকে আনে।
– ডেকেছো কেন? কোন কিছু দিতে পারবো না কিন্তু।
ভীষণ অহংকারের সাথে ফারহা বলে উঠে।
– তোমার কেন এমন মনে হয়, ফারহা? আগে তো বসো। দেখো চাওয়ার বদলে দিতেও তো পারি!
মারিয়ার এমন কথায় জ্বলে উঠে ফারহা।
– নিজের অবস্থান বোধ হয় ভুলে গিয়েছো মারিয়া। আমার বাড়ির কাজের লোকের পোষাক আশাক, চলাফেরাও তোমার চেয়ে ভালো।
– সে হতেই পারে ফারহা। তোমরা অনেক ধনী। কিন্তু তোমার কি মনে হয় তোমার বাড়ির কাজের লোকের সাথে শোভন বসবে? কাজের লোকের কথা বাদ দাও শোভন তো তোমার দিকেও ফিরে তাকায় না। তোমার এতো রাগ ক্ষোভের কারণ বোধ হয় এটাই। তাহলে তোমার এতো অর্থ বিত্ত, সৌন্দর্য – এসবের কি মূল্য থাকলো বলো?
– মা.. মা..মানে? কি বলতে চাচ্ছো মারিয়া?
ক্ষুব্ধ হয়ে যেন কথায় শেষ করতে পারলো না মারিয়া।
– দেখো ফারহা তোমাকে পরিস্কার করে দুইটি বিষয় জানাতে চাই। প্রথমতঃ শোভনের সাথে আমার কোনো প্রেমের সম্পর্ক নেই আর হওয়ার সম্ভাবনাও নেই। শোভনও সেটা ভালোই বোঝে। ওর কাছে আমি নিছকই খুব ভালো বন্ধু অনেকটা বোনের মতোই বলা চলে। তাহলে আমার এতো খেয়াল রাখার কারণ কি? এটাই তো তোমার প্রশ্ন, তাই না ? এই প্রশ্ন তোমার মনে জন্মাতোই না যদি তুমি তোমার মিথ্যা অহংকার দূর করে দিয়ে মানুষের মানবিক চোখ দিয়ে আমাকে দেখতে। আমার কেউ নেই, সত্যি কেউ নেই। এটা শোভন বোঝে বলেই আমার পাশে থাকে। শুধু ও না, ওর বাবা, মা, বড় বোন সবাই আমাকে ভীষণ স্নেহ করে পরিবারের একজন মনে করে তার কারণ তাঁরা সবাই ভীষণ মানবিক মানুষ। আর আমি এতোটাও খারাপ না যে তাদের এই ভালোবাসার সুযোগে তাদের পরিবারে প্রবেশ করার চেষ্টা করবো। তুমি তোমার চোখ থেকে হিংসা ঝেড়ে ফেলে দেখো আমার আর শোভনের সম্পর্ক একদম স্বাভাবিক। আমি একটা ছেলে হলে শোভন যেমন সম্পর্ক রাখতো ঠিক তেমনি। আমি জাস্ট মেয়ে বলে তোমার কাছে আমাদের সম্পর্ক অন্য রকম মনে হয়। আর কিছু না।
দ্বিতীয়ত তুমি যদি শোভনের মন জয় করতে চাও ৷ তাহলে তোমার এই অহংকার, হিংসা আর এই খারাপ ব্যবহার করার অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে। শোভন বা ওর পরিবারের কেউই তোমার মতো চরিত্রের মেয়েকে গ্রহণ করবে না। আমি যা বললাম সম্পূর্ণ সত্য এবং এটাই বাস্তব। এখন তুমি বিশ্বাস করবে কি করবে না, সেটা তোমার বিষয়।
ফারহা সত্যিই হাঁ হয়ে যায়। এই মেয়ে যে এতো কথা বলতে পারে এবং এভাবে কথা বলতে পারে তা এখনো ওর বিশ্বাস হচ্ছে না। ফারহাকে ঘোরের মধ্যে রেখেই মারিয়া ক্যান্টিন থেকে বের হয়ে আসে। বাইরে থেকে একটা আইসক্রিম কিনে খেতে খেতে হোস্টেলের দিকে হাঁটতে থাকে। ফারহা কেন মারিয়ারও বিশ্বাস হচ্ছে না যে ও এমন করে বলতে পারে। কিন্তু দিনে দিনে মারিয়ার উপলব্ধি হচ্ছে, প্রতিবাদ না করলে একটু উঁচু স্বরে কথা না বললে সবাই পা দিয়ে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করে। শুধু দমিয়ে রাখাই নয়, দিন দিন নানা ভাবে নানা উপায়ে যন্ত্রণা দিতে থাকে এবং অত্যাচারও করতে থাকে। মারিয়ার তো সেই শৈশব থেকেই শুরু হয়েছে মাইর খাওয়া জীবন। একবার সৎ মা, তারপরে তো থানা পুলিশ, সেফ হোম ঘুরে এই হোস্টেল জীবন। সবখানেই মারিয়া বিনা দোষেই দোষী। এজন্য পরিস্থিতিই মারিয়াকে শিখাচ্ছে ঘুরে দাঁড়াও, নিজের পাশে নিজেই থাকো! সব জায়গায় তো আর আমানের মতো কেউ থাকবে না, নিজেকেই নিজের সারথি হতে হবে।
আমান! এই একটা নাম মারিয়া প্রতিনিয়ত জপ করে। জানে না আমান কোথায় আছে, কিভাবে আছে। হয়তো এতোদিনে বিয়ে করে বউ বাচ্চা নিয়ে সুখের সংসার করছে৷ কম দিন তো হলো না, চার বছর হয়েছে। চার সপ্তাহেই মানুষের জীবনে কতো কিছু ঘটে যায়, চার বছর তো দীর্ঘ সময়।
তবুও মারিয়া আমানের কথা ভুলতে পারে না। ওর বিপদের দিনে সম্পূর্ণ নি:স্বার্থভাবে পাশে দাঁড়িয়েছিলো। মারিয়ার পুরো জীবনটাই উলোটপালোট হয়ে যেতো যদি আমান সেদিন না থাকতো। ঠিক যেন ফেরেস্তার মতো আল্লাহর পক্ষ থেকে ঠিক সময়ে হাজির হয়েছিলো। মারিয়া যদি বাড়ি যেতে পারতো আমানের সাবেক অফিসে খোঁজ খবর করে হয়তো জানতে পারতো আমান এখন কোথায় আছে। কিন্তু বাড়ির দরজা তো সেদিনই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সেখানে ফেরা হয় না, আমানেরও খোঁজ নেয়া হয় না। জীবনে কি আরেকটাবার সুযোগ পাবে, শুধু একটু দেখা পাওয়ার?
ফারহা শুধু শুধুই শোভনকে মারিয়ার সাথে জড়িয়ে ভাবে। হয়তো আরো অনেকেই ভাবে। কিন্তু কেউই তো জানে না, মারিয়ার মনের মধ্যে শুধুমাত্র একটি নামই খোদাই করা আর তা হলো – আমান!
বলা হয় মানুষ যেটা কায়মনোবাক্যে প্রার্থণা করে, একদম মন থেকে নিষ্পাপ মনে যা চায়, আল্লাহ সেই আশা পূরণ করেন। মারিয়ার আশাও পূরণ হয় কিন্তু এমনভাবে পূরণ হয় যা মারিয়া কিছুতেই প্রত্যাশা করে নি।
(চলমান)
#আমি_যে_কে_তোমার
(৯ম পর্ব)
ঘটনা আরো বছর খানিক পরে। এরমধ্যে মারিয়া এম বি বি এস শেষ করেছে। রেজাল্টের অপেক্ষা করা কালীন সময়ে দুইটা কোচিং ও পার্ট টাইম পড়ানো শুরু করে। পড়াশোনা শেষ করায় শিক্ষা বৃত্তি বন্ধ হয়ে গেছে যদিও আমানের বৃত্তি এখনো চলছে। আমানদের ফাউন্ডেশন, শর্মিলী আহসান ফাউন্ডেশন থেকে একটা ম্যাসেজে জানিয়েছে, মারিয়ার ইন্টার্নী শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই বৃত্তি চলবে।
এই বৃত্তির টাকায় চলা কঠিন। এজন্যই এই কোচিং এ ক্লাস নেয় আর আগের টিউশনিটা তো আছেই। আর তাছাড়া মারিয়া কোথায় যাবে? সবাই তো বাড়িতে গেছে। কিন্তু মারিয়ার তো যাওয়ার জায়গা নেই। হোস্টেলে বসে সময়ও কাটে না। এখন দিব্যি সময় কেটে যাচ্ছে। বই কেনার ঝামেলা না থাকায় কিছু টাকা জমাও হচ্ছে। একদিন ঘুরতে ঘুরতে শাড়ির দোকানে যায়। সবাই প্রায় অনুষ্ঠানে অকেশনে শাড়ি পরলেও মারিয়ার পরা হয় নি।
শাড়ির দোকানে যেয়ে হাত দিয়ে একটু নেড়ে দেখতে দেখতে একটা সুতির ব্লকের কাজ করা শাড়ি খুব পছন্দ হয়। টিয়া রঙের শাড়ি তার উপরে গাড় সবুজ রঙের ব্লক করা। বাজেটের মধ্যে থাকায় কিনে ফেলে। সাথে এক পাতা সবুজ টিপ আর কাঁচের চুড়ি।
সামনের বসন্ত উৎসবে এই শাড়িটা পরবে ভেবে তুলে রাখে। কখনোই এমন উৎসবে যাওয়া হয় না। বসন্ত উৎসব কিংবা পহেলা বৈশাখ এসবে যাওয়া হয় নি মারিয়ার। এক টাকা পয়সার সংকট, দ্বিতীয়ত: পড়াশোনাতে এতোটাই ডুবে ছিলো যে আর কিছুতে নজর দেয়ার ফুসরত মেলে নি।
এর মাঝেই এম বি বি এস এর রেজাল্ট হয়। মারিয়া পাশ করেছে। প্রথমেই মনে পড়ে আমানের কথা। কিন্তু তাকে জানানোর কোন রাস্তা বের করতে পারে না। এই না পারার কষ্ট মারিয়াকে যেন কুরে কুরে খায়। এম বি বি এস এর পরে আরেক কষ্ট শুরু হয়। ইন্টার্নি। এরা ডাক্তার বটে কিন্তু মানুষ কিনা সন্দেহ! এদের কেউই পাত্তা দেয় না, না রোগী, না সিনিয়র ডাক্তার এমনকি সিনিয়র নার্সরাও গোনে না যেন। অথচ একটা সরকারি হাসপাতাল অনেক সময় টিকেই থাকে ইন্টার্নদের উপরে। কিছু হলেই এই ডাক্তারদের উপরে চালাও হামলা, মেরে আহত করে দাও। অথচ ভীষণ পরিশ্রম সাথে অত্যন্ত কম সম্মানি।
মারিয়ার ডিউটি ছিলো আজ। সার্জারি ওয়ার্ডে ডিউটি। একজন রোগীকে নিয়ে সিনিয়র স্যারদের ছুটে আসতে দেখে মারিয়া বুঝতে পারে নিশ্চয় কোন প্রভাবশালী কেউ হবে। না হলে স্যারেদের এভাবে ছোটার কথা না। ইমার্জেন্সি ওটি হবে। দশ মিনিটের মধ্যে ড্রেস পরে ওটিতে ঢুকতে বলে।
ওটিতে ঢুকে মারিয়ার জ্ঞান হারানোর অবস্থা। কারণ রোগী হিসেবে ওটির টেবিলে শুয়ে আছে – আমান! রোড অ্যাক্সিডেন্টে ভীষণ রকম আহত হয়েছে৷ প্রথমে তো মারিয়ার বুক ধড়ফড় করতে থাকে, তার সাথে হাত পা কাঁপতে থাকে। কিন্তু মারিয়া সামলে নেয়। ও এখানে একজন ডাক্তার। আর ডাক্তার হিসেবে মারিয়ার প্রধান কর্তব্য রোগীকে ভালো করে তোলার ব্যবস্থা করা। আর আমানের কাছে তো মারিয়া এক জীবন পরিমাণ ঋণী। সেখানে ভেঙে পড়লে হবে না।
প্রায় চার ঘন্টা ধরে সার্জারী চলে। এক হাত এবং পায়ের হাড় ভেঙেছে। বুকে ব্যথা পেয়েছে তবে এক্স রে নরমাল সেখানে কোন ফ্রাকচার নেই। কিন্তু স্কাল মানে মাথার খুলিতে ফ্রাকচার আছে তবে আশার কথা হলো ইন্টারনাল হেমোরেজ নেই।
ডাক্তাররা বলাবলি করছে – রোগী অনেক লাকি। ব্রেনে কোন ক্ষতি এখনো পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। সার্জারির পরে আমানকে আইসিইউতেই রাখা হয়েছে। মারিয়া সেখানে একটু ঘুরে আসে। বন্ধ চোখের নিচে রাত জাগার কালি। চেহারায় কিসের যেন অব্যক্ত বেদনা। মাথায় ব্যান্ডেজ, হাতে পায়েও ব্যান্ডেজ। দেখলে খুব কষ্ট লাগে।
মারিয়ার যেন হাত পা খুলে আসতে চায়। ক্লান্তি এবং মানসিক ধকল যেন নিতে পারছে না। আইসিইউ এর স্পেশাল ড্রেস খুলে বের হয়ে আসে।
– আপনি কি প্যাশেন্টের পরিবারের কেউ?
আইসিইউ এর বাইরে বেশ সুন্দর চেহারার একটা মেয়ে বসে আছে। তবে চেহারায় বিষন্নতা ছাড়াও একটু কাঠিন্যের ছাপ আছে৷ পরনে নীল কুর্তি টাইপ ড্রেস আর সাথে সাদা ফরমাল প্যান্ট। একটা সাদা ওড়না গলার দুই পাশ দিয়ে ঝুলানো। মাথার চুল পেছনে পনিটেইল করা। এটাই কি আমানের স্ত্রী? বুকের মধ্যে তীব্র ব্যথায় কেমন টন টন করে উঠে।
– আমাকে বলতে পারেন। স্যারের কি অবস্থা এখন?
মারিয়া যেন হোঁচট খায়। স্যার বললো মানে স্ত্রী নয়। কলিগ হবে। এজন্যই এমন কাঠিন্য মাখা চেহারা। পুলিশ বলে কথা!
– স্টাবল। কিন্তু আগামী ২৪ ঘন্টা অবজারভেশনে থাকবেন। উনার পরিবারের কেউ আসেন নি?
– অন্য একজন ডাক্তারও তাই বললেন। জানি না স্যারের কি হবে। এতো ভালো একজন মানুষ। আসলে স্যারের পরিবারে উনার বৃদ্ধ পিতা ছাড়া আর কেউই নেই। আমরাই মানে কলিগরাই স্যারের পরিবার।
এই কথাগুলো শুনে মারিয়ার খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু কেন যেন আরো কষ্ট লাগে। আপনজন ছাড়া জীবন যে কষ্টের তা মারিয়ার চেয়ে আর কে ভালো বোঝে?
আচ্ছা, আমান কেন বিয়ে করে নি? নাকি কাউকে ভালোবেসে ছ্যাঁকা খেলো? এসব নানান কথা মারিয়ার মাথায় ঘুরতে থাকে। সেই প্রশ্নগুলো আপাততঃ একটা সিন্দুকে তালাবদ্ধ করে মারিয়া। আমানকে আগে সুস্থ হতে হবে। এজন্য মারিয়া তার সর্বোচ্চটুকু করবে। প্রথমেই আইসিইউতে ডিউটি নিতে হবে। আমানের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকার তীব্র ইচ্ছা থেকে মারিয়া কিছুতেই নিজেকে নিবৃত্ত করতে পারে না।
(চলবে)