আমি_মায়াবতী পর্ব-২৮+২৯

0
432

#আমি_মায়াবতী
#পর্ব_২৮
#লেখনীতে_তাহমিনা_মিনা

“বাবা, তুমি কিভাবে নৌকা চালাতে পারো? আমি তো পারিনা।”
“আমাকে কে নাও চালাইতে শিখাইছে জানো সাব্বির বাবা?”
সাব্বির বেশ উৎসাহ নিয়ে জিজ্ঞেস করে,”কে শিখিয়েছে মেজো কাকা?”
“তোমার বাবা।”
“কিহ? বাবা? বাবা, তোমাকে কে শিখিয়েছে?”
রিজভী হাসে। হাসতে হাসতে জবাবা দেয়,”তোমার দাদা।”
“তখন তুমি কার মতো ছিলে বাবা? আমার মতো?”
“নাহ। তোমার চাইতেও ছোট। আমরা নৌকা চালাতে চালাতে গান গাইতাম। আব্বা গঞ্জের হাটে যাইতো। আমরাও যেতাম। গঞ্জ থেকে সন্দেশ আনতো। কি যে স্বাদ ছিল সেগুলোর। এখনকার গুলোতে সেই স্বাদ পাওয়া যায় না। ”
মায়া প্রশ্ন করে,”তোমরা অনেক আনন্দ করতে ছোট বেলায় বাবা? আর এতোদিন পরেও কিভাবে মনে আছে নৌকা চালানো?”
রিজভী হাসে।হাসতে হাসতে বলে,” মানুষ যতোই আপডেট হোক না কেন মা, মানুষ কখনোই তার অতীত ভুলতে পারে না। এই সবকিছুই আমার বাম হাতের খেলা। বুঝলে?”
সাবিহা জিজ্ঞেস করে,” বাবা, তুমি কি গাছে উঠতে পারো? বাড়ির পাশে যে আম গাছটা আছে, ঐটাতে চড়তে পারবে? ঐটাতে চড়েছো কখনো?”
রিজভী শুধু হাসে আর আনমনে ভাবে পুরোনো কথা। বাড়ির পাশের আমগাছটা তার নিজের মায়ের হাতের লাগানো। বাড়িটায় তেমন গাছপালা ছিল না তখন। তার মা কত যত্ন করেই না তার সংসারটাকে গুছিয়ে নিয়েছিল। বাড়িটা রাস্তার চাইতে নিচু ছিল। তার মা আর দাদী মিলে মাটি কেটে কেটে এনে বাড়ি উঁচু করেছে। কত ধরনের গাছপালা লাগিয়েছে তার মা। অথচ এই সংসারে তার এখন কোনো অস্তিত্বই নেই। তার কথা মনে করার লোক নেই। তার সন্তানের জায়গা নেই। আহ দুনিয়া। কি আজব এই দুনিয়া।
সূর্য ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছে। পশ্চিম আকাশ লাল বর্ণ ধারণ করছে। রিজভী পাড়ের দিকে নৌকা নিয়ে যায়। হঠাৎ করেই মরিয়মের ভাই পানিতে ঝাঁপ দেয়। সাবিহা,সাব্বির আর মায়া চিৎকার করে উঠে। কিন্তু ছেলেটি কয়েকটি শাপলা ফুল তুলে এনে সাব্বির এর হাতে দেয়। ছেলেটি সাঁতরে পাড়ে উঠে গিয়ে দৌড় লাগায়। রিজভী হাসতে থাকে। তার ছেলেমেয়েরা যে ননীর পুতুল। সামান্য একটা ব্যাপারে চিৎকার দিয়ে উঠেছে। অথচ গ্রামের ছেলেমেয়েদের কাছে এইটা কোনো ব্যাপারই না।
★★★
“হ্যাঁ, বলো।”
মায়া মিনমিন করে বলে,” স্যার, আমি মায়া বলছিলাম।”
“জানি, মায়া। তোমার নাম্বার সেইভ আছে ফোনে। কি হয়েছে আজ আবার?কোনো সমস্যা? ”
“ঠিক সমস্যা না। আসলে কবিতাকে কল দিয়েছিলাম। ও ফোন ধরে শুধু কান্না করে কেটে দিল। কিছু কি হয়েছে ওর? ও তো কাল বলেছিল ওদের বাড়িতে যাবে। সেখানে কি গিয়েছে? কিছু হয়েছে?”
“মায়া, ও একটা জটিল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তুমি সময় পেলে ওকে জিজ্ঞেস করো। সবচেয়ে ভালো হবে যদি ওর সাথে দেখা করে কথা বলো। বুঝলে? ফোনে আসলে সবকিছু বলা যায় না।”
“আমি বুঝেছি।আমি ওকেই জিজ্ঞেস করবো। ধন্যবাদ স্যার।”
“আর কিছু জিজ্ঞেস করবেনা?”
মায়া হকচকিয়ে উঠে বলে,”হ্যাঁ, অবশ্যই। স্যার ভালো আছেন?”
কাব্য মুচকি হেসে উত্তর দেয়, সে ভালো আছে।
★★★
বাসার ছাদে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে আনোয়ার। নিজেকে তার আজ একটা ব্যর্থ পিতা মনে হচ্ছে। সে কবিতার মাকে এতোটাই ভালোবেসেছিল যে তার কারণে তার আশেপাশে থাকা সবাইকে সে অবহেলা করেছে।।কবিতার মাকে ভালোবেসে বিয়ে না করলেও বিয়ের পর কেমন একটা মায়া জন্ম নিয়েছিল। অভাবের সংসারে শত কষ্টের মাঝেও সে সবসময়ই হাসিমুখে থাকতো। সামান্য একটা দর্জির দোকান ছিল তার। কবিতার মাও কাজ জানতো। নিজের বিয়ের সব গহনা বিক্রি করে দিয়ে একটা বড় দোকান কিনেছিল নিজের স্বামীর জন্য । সেই দোকানটাই আজ শো-রুমে রুপ নিয়েছে। এই বাড়িটা কত কষ্ট করে বানিয়েছিল তারা। সব লোন যখন শোধ হলো, তখন গয়না গড়িয়ে দিয়েছিল তাকে। কবিতা তখন পেটে। তখন সে পড়তো না। বলতো ছেলের বউয়ের জন্য রাখেন। নয়তো মেয়ের জন্য। সে হাসতো। বলতো বাচ্চা না হতেই কত দূরের চিন্তাভাবনা। বাচ্চাটাকে নিয়ে খুব আগ্রহ ছিল তার। কিন্তু বেচারি চোখের দেখাও দেখে যেতো পারলো না মেয়েটিকে। মেয়েটিকে দুনিয়ায় আনার জন্য নিজের প্রাণ বিসর্জন দিয়ে দিল। তখন আনোয়ারের মনে হয়েছিল সব দোষ বাচ্চাটার। মুখও দেখেনি তার। কোলেও নেয়নি। বৈরাগ্য জীবন নিয়েছিল। বড় আপাই তখন তার দেখাশোনা করছিল। হুট করেই একদিন সে শুনলো তার জন্য মেয়ে ঠিক করেছে। সে দেখতেও যায়নি পাত্রীকে। সে তো বিয়ে করতে চায়নি। বিয়ের রাতে দেখলো মেয়েটার শরীরে কবিতার মায়ের জন্য আনা গয়না। মাথায় রক্ত উঠে গিয়েছিল তার। বাসর রাতে সব গয়না খুলে তাকে দিয়ে দিতে বলেছিল। মেয়েটি ভয়ভয় চোখে তাকে দিয়েও দিয়েছিল। পরবর্তীতে হয়তো তাকে আরো অনেক গয়না কিনে দেওয়া হয়েছিল কিন্তু সেই রাতে কি সে কাজটা ঠিক করেছিল? তার কি উচিত ছিল না, তাকে বুঝিয়ে বলা?হয়তো তাহলে সে বুঝতো। মেয়েটিকে সময় দিতো না সে মোটেও। নিজের মেয়েটিকেও যে সে ভালোবাসতো, তেমনটিও না। তার মা তার স্ত্রীর সাথে যে খারাপ ব্যবহার করতো, সেটা সে বুঝতো। কিন্তু কিছুই বলতো না। তখন তার কাজকে সে সঠিকই মনে করতো, কিন্তু আজ কেন এতো অনুতাপ হচ্ছে? কেন মনে হচ্ছে সবকিছুর জন্য সেই দায়ী? তার যে মা তার স্ত্রীর বাড়ির লোকদের সহ্যই করতে পারতো না গরীব বলে, হঠাৎ করেই তারা কিভাবে যেন তার কাছে প্রিয় হয়ে উঠেছিল। তারা বেশিরভাগ সময়ে এই বাড়িতে এসেই পড়ে থাকতো। মা কিছুই বলতো না। কিন্তু কবিতাকে বড় আপাকে দিয়ে দিয়েছিল। এমনকি মৃত্যুর আগে সে বলে গিয়েছিল তাদের বাড়িতে যেন তার শ্বশুরবাড়ির লোকের কোনো অসম্মান না হয়। তারা যেকোনো সময় এই বাড়িতে আসতো। সে কিংবা আনিকা দাওয়াত না দিলেও। এমনকি আনিকার বড় বোনের ছেলেটা এই বাড়িতেই থাকে বেশিরভাগ সময়ই। আর হয়তো পারবেনা তারা এই বাড়িতে বিনা দাওয়াতে আসতে। তাদের এই বাড়িতে আসার পথ যে তারা নিজেরাই নিজেদের কর্মদোষে বন্ধ করে দিয়েছে। তবে আজ নিজেকেই সবকিছুর জন্য দায়ী মনে হচ্ছে। সে যদি কবিতা আর আনিকাকে কিছুটা হলেও ভালোবাসতো, তবে হয়তো আজ এইরকম একটা দিন আসতো না। তার মেয়েটা এতো কষ্ট নিয়ে এই বাড়ি থেকে চলে যেতো না। এতো অনুতাপ নিয়ে সে বাঁচবে কিভাবে?
কায়রা আজ একটুও দুষ্টুমি করছেনা। হয়তো মায়ের কষ্ট হচ্ছে, সেটা বুঝতে পারছে। মায়ের পাশে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। আয়রাও চুপ করে আছে। আনিকা বুঝতে পেরে বলে,” তোমরা না ঘুমিয়ে কেন ঘুমের ভাণ করে আছো বলোতো?”
আয়রা আর কায়রা দুজনেই চোখ মেলে তাকিয়ে হেসে বলে,”আম্মু। তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”
“কি মা?”
কায়রা বলে,”কবিতা আপু কি আর আসবে না আম্মু? আমাদের সাথে কি রাগ করেছে আম্মু? আর আসবে না? আমাদের কে আদর করবে না? আপু তো বলেছিল এইবার আমাদের সাথে থাকবে। অনেকদিন থাকবে। চলে গেল কেন আম্মু?” বলতে বলতে কেঁদে দেয় দুজনেই। কান্না ব্যাপারটা যেন সংক্রামক। সেটা ছুঁয়ে যায় আনিকাকেও। সেও কান্না করতে করতে বলে,”কেন আসবে না মা? অবশ্যই আসবে। এইটা তো তারও বাড়ি। তার মায়ের বাড়ি। সে অবশ্যই আসবে।”
“সত্যি আসবে? কবে আসবে?”
“এখন আসবেনা মা। পরে আসবে। ”
“পরে কবে মা?”
“সেটা জানিনা। তোমরা কি কালকে কবিতা আপুর কাছে যাবে? ”
দুজনেই একসাথে বলে,”হ্যাঁ, কালকেই যাবো। তুমি কি নিয়ে যাবে আম্মু?”
“অবশ্যই নিয়ে যাবো মা আমার। কিন্তু এখন যে ঘুমুতে হবে। না ঘুমুলে সকালে দেরি করে উঠবে আর দেরি করে উঠলে কবিতা আপুর কাছে যেতেও দেরি হবে।”
“ওকে, মা। আমরা ঘুমুবো এখনই। এই কায়রা চোখ বন্ধ কর।”
মেয়েদের ঘুমন্ত নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে আনিকা। ইশ, কি সুন্দর তারা। আরিয়ানও কত সুন্দর। তার প্রথম বাচ্চাটাও কি এতোটাই সুন্দর হতো? আচ্ছা, তার কি মেয়ে হতো নাকি ছেলে? আনিকা জানে বাচ্চা নষ্ট করা উচিত না। তাহলে আল্লাহ জীবনেও ক্ষমা করে না। মানুষ তো চাইলেও একটা প্রাণ সৃষ্টি করতে পারে না। তবে তার কোন অধিকার আছে যে একটা প্রাণকে হত্যা করার? আচ্ছা, আল্লাহ কি তাকে ক্ষমা করেনি? কিন্তু সে তো কিছু করেনি। সে তো কিছু জানতোই না। তার শাশুড়ীকে সে জীবনেও ক্ষমা করবে না। মরে গেলেও না। তবে, আজ তার বেশ হালকা লাগছে। তার স্বার্থপর মা বোনেরা আর আসবে না। আর আসারই কি বা দরকার? তারা যা চেয়েছিল তা তো তারা পেয়েছেই। বড় বোনটার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা যৌতুক চেয়েছিল, ছোট বোনটার বিয়ে হওয়ার দরকার ছিল। ভাইদের পড়াশোনার দরকার ছিল। কবিতার দাদী তাকে পছন্দ করায় তাকেই বলির পাঠা হতে হয়েছিল। আর কবিতার দাদীকে ব্ল্যাকমেইল করে এই বাড়িতে অবাধ যাতায়াতের সু্যোগ পেয়েছিল তারা। আজ সব সুযোগের পরিসমাপ্তি ঘটলো। তার প্রয়োজন নেই এমন পরিবারের৷ যে পরিবারের মানুষ তাকে ব্যবহার করে উপরে উঠেছে। আনিকা রুমে এসে চোখ বন্ধ করতেই ফোনটা বেজে উঠলো। সে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখলো মা ফোন দিয়েছে। সে মনেমনে ভাবে, এমন মা থাকার দরকার কি? এমন মা থাকার চেয়ে মরে যাওয়া অনেক ভালো।
চলবে…..

#আমি_মায়াবতী
#পর্ব_২৯
#লেখনীতে_তাহমিনা_মিনা

পড়ন্ত বিকেলের আলোতে মায়ার দিকে ভালোবাসাময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সোহাগ। দুটোদিন দূর থেকে দেখে এসেছে তাকে। কাছে যাওয়ার সাহস করেনি। আজ মায়া নিজে তার কাছে এসেছে। তার দিকে তাকিয়ে হেসেছে। ইশশ!কি সুন্দর তার হাসি। মায়ার ঘন কালো লম্বা চুল, চিকন চিবুক আর পাতলা ঠোঁট দেখে আকৃষ্ট হলেও সবচেয়ে বেশি ভালোলেগেছে ডাগর ডাগর চোখদুটো। এই চোখের দিকে তাকিয়ে সে নিজের জীবন দিতে পারবে। কিন্তু চোখের মালকিন কি তাকে সেই সুযোগ দিবে? মায়াকে কি বলা উচিত তার মনের কথা?
“ভাইয়া, আপনার চা।” মায়ার ডাকে ঘোর ভাঙে সোহাগের। ভ্রু কুঁচকে যায় অজান্তেই। ইশশ!কি বললো মেয়েটা? ভাইয়া? মানা যায় এইটা? সোহাগের ইচ্ছে করছে উঠে গিয়ে বলে, এই আমি তোমার কোন কালের ভাইয়া? কিন্তু সোহাগ সেটা বলতে পারে না। চক্ষুলজ্জা নাকি অধিকারবোধ না থাকা, সেটা বুঝতে পারে না সোহাগ।
চায়ের কাপ হাতে নিয়ে রিজভী বলে,”আমি যে দুইদিন ধরে আসছি, আগে আসোস নাই কেন?”
মুড়ি চিবুতে চিবুতে আজগর আলী বলে,”আরেহ, আমি তো গঞ্জে গেছিলাম কামে। তোর ভাবী অবশ্য আইছিলো। তোর বউয়ের লগে কতা কইছে। কিন্তু তোরে তো আর চিনে না। তাই শরম পাইয়া আর সামনে আহে নাই।”
“তা, আজ কি গঞ্জ থেকে আইছোস? নাকি আমি আসার খবর পাইছোস?”
“না। আমার কাম শেষ হয়নাই। তোর কতা আমি আমার পোলা মাইয়ারে অনেক কইছি। আমার পোলা সোহাগ কাইলকে ফোন দিয়া কইলো যে তুই আইছোস। তাই আইজকা চইলা আইছি। তাড়াতাড়িই আইছি। যদি আবার চইলা যাস গা। ”
রিজভীর বুকের ভিতর আনন্দের ঝড় বইতে থাকে। যাক, এখানে আরো একজন তাকে মনে রেখেছে। সেই বা কম কিসে। তার ইচ্ছে করে বাল্যবন্ধুকে জড়িয়ে কান্না করা। কিন্তু সে করেনা। মুখে বলে,”তোর ছেলে কি করতেছে এখন?”
“আমি যেমন তেমন অইলে কি অইবো? আমার পোলা মাইয়া মাশাল্লাহ অনেক ভালা। আমার পোলাডা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে আর মাইয়াডা গঞ্জের কলেজে পড়ে। এইহানে তো আর ভালা কলেজ নাই। প্রতিদিন তো আর পাশের গ্রামের কলেজে যাওয়া আসা করা যায় না। মাইয়া মানুষ। বুঝোসই তো।”
রিজভীর ভীষণ ভালো লাগে বন্ধুর সাফল্যের কথা শুনে। কিন্তু রসিকতা করে বলে,”আমরা তো প্রায় সমবয়সী। তাহলে, তোর ছেলে এতো বড় কেন? আর আমার বড় মেয়েই তোর ছোট মেয়ের চাইতে ছোট কেন?”
আজগর আলী হাসেন। কিছুটা লজ্জাও পান। লজ্জামাখা চেহারায় বলেন,” আরেহ, তুই তো জানোসই আমাগো এলাকার মাইনষের কাম কারবার। কলেজে ভর্তি অইছিলাম। একদিন কলেজ থিক্যা আইসা হুনি আমার জন্য পাত্রী ঠিক। বাপের ধানের চাতালে তহন থিকা কামে গেলাম। পড়াশোনা বন্ধ। বিয়া কইরা বউ ঘরে নিয়া কি আর পড়াশোনা করন যায় নাকি? আর আমারও অতো ইচ্ছা আছিলোনা যে পড়াশোনা করুম। কিন্তু তোর ভাবীর অনেক ইচ্ছা আছিলো পড়ালেখা করনের। তাইতো নিজের ইচ্ছা পোলাপানগো দিয়া পূরণ করতাছে। এই সারা গেরামে আমার পোলাপানই পড়ালেখা করে ভালামতো।”
“হুমম। তা তো দেখতেই পাচ্ছি। ভালো লাগলো তোর গল্প শুনে। তুই তো ভালোই। অল্প বয়সে বিয়া করছিলি বইলা এখন বড় পোলার কামাই খাইতে পারবি। আমার তো আর সেই উপায় নাই।”
“শরম দিছ না তো হা*লা। দেখতাছোস না আমার পোলায় আছে এইহানে।” নিচুস্বরে বলে আজগর আলী।
রিজভী সোহাগের দিকে তাকিয়ে বলে,”সোহাগ, বাবা এইবার কোন ইয়ারে আছো?”
“ফাইনাল ইয়ারে, আংকেল।”
“কোন ডিপার্টমেন্টে?”
“পদার্থবিজ্ঞান। ”
“অহ, ভালো সাব্জেক্টই তো পেয়েছো। ভালোই তো। আমাদের গ্রামের গর্ব তুমি। আমাদের এই গণ্ডগ্রাম থেকে অতো দূরে গিয়েছো, সেই তো অনেক। ”
সোহাগ মাথা নিচু করে বিনয়ের সাথে বলে,”জ্বি, চাচা।দোয়া রাখবেন, যেন ভালো কিছু করতে পারি।”
“তা তো অবশ্যই করি বাবা। তা তুমি টিউশনি করাও না? আমাদের সময়ে তো আমি করাতাম।”
সোহাগ বেশি টিউশনি করায় না এখন। কারণ, ওর নিজেরই পড়াশোনার চাপ বেশি। কিন্তু মুখে বলে,”হ্যাঁ, চাচা। আমি টিউশনি করাই। ”
“তা তো ভালোই। নিজের খরচ নিজে এই বয়স থেকেই গুগাচ্ছো। ভবিষ্যতে কাজে লাগবে।”
আজগর আলী বলে,” আমি তো কই পোলাপান পড়ানোর কি ঠেহা তোর? আমি তো আছিই। টাকাপয়সাও তো আমার কম নাই।”
“আরেহ, সাবলম্বী ছেলে। তুই তো জানিস না, ঢাকার শহরে টিকে থাকার কি জ্বালা। আর ওদের মতো ছেলেরা তো ঢাকাতেই থাকতে চায়। এখন থেকেই যদি নিজেরটা নিজে করে খেতে পারে, তাহলে পরেও কিছু না কিছু একটা ব্যবস্থা হবেই।” সোহাগের দিকে তাকিয়ে বলে,” তোমার ক্যাম্পাস থেকে আমার বাসা খুব একটা দূরে না বাবা। বিশ মিনিটের মতো লাগবে হয়তো। যদি তোমার অসুবিধা না হয়, তাহলে কি তুমি আমার বড় মেয়ে মায়াকে পড়াতে পারবে? না মানে যদি তোমার সমস্যা না থাকে আর কি?”
সোহাগের দম আটকে আসছিলো। কি শুনছে সে? সে তো মায়ার কাছাকাছি যেতে চাইছিলো। কিন্তু এতো কাছে? এ তো মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। কিন্তু নিজেকে সংযত করলো সে। মাথা নিচু করে জবাব দিলো,” আমি চেষ্টা করবো চাচা। আপনাকে অবশ্যই জানাবো।”
“ঠিক আছে।”
সোহাগ উঠে দাড়ালো। মায়ার দিকে একবার তাকালো সে। মায়া উঠোনের মাটির চুলোর পাশে বসে আছে। সে বাড়ি থেকে বের হতেই যাচ্ছিলো কিন্তু তখনই সাব্বির এসে বাবার কাছে কেঁদেকেঁদে বলে,”বাবা, মেজো কাকী আমার শাপলা রান্না করে ফেলেছে। আমি এখন কি নিয়ে খেলবো? শাপলা কি খাওয়ার জিনিস নাকি?”
রিজভী হাসে। হাসতে হাসতে বলে,”শাপলা রান্না করে খাওয়া যায়। আমিও রান্না করতে পারি। এই যে তোমার এই আংকেল কে দেখছো, তার সাথে আমি কত রান্না করে খেয়েছি।জিজ্ঞেস করো। শাপলা খেতেও কিন্তু ভীষণ ভালো। ”
সাব্বির জলভরা চোখে আজগর আলীর দিকে তাকায়। আজগর আলী বলে,”তোমার বাপ তো মিয়া সেরা রাধুনি। কত মাইনষের মুরগী চুরি কইরা রাইন্দা খাইছে। হিসাব আছে নাকি?”
“আজাইরা কথা কইস না আজগর আলী। আমার দোষ নাই। তুই মুরগী চুরি করছোস। আমি শুধু রানছি। দোষ কার বেশি?”
মায়া খিলখিল করে হেসে উঠে। মেয়ের সামনে খানিকটা লজ্জা পায় দুজনেই। সাব্বিরও হাসে। আজগর আলী কথা ঘুরানোর জন্য বলে, “ঐ সোহাগ, ওরে নিয়া বিল থিকা শাপলা নিয়া আয় যা। এহনই যা।”
“এখন কিভাবে যাবে? সন্ধ্যা হয়ে গেছে তো প্রায়। কালকে নাহয় এনে দিবোনে ওকে।”
“আরেহ, কিসের সন্ধ্যা? যা তো ওরে নিয়া।”
“আমি একা যাবো না বাবা। মায়া আপুকেও যেতে বলো আমার সাথে।”
“এখন তো প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেছে সাব্বির। মায়া আপু যেতে পারবে না।”
“আরেহ, কিসের সন্ধ্যা? মায়া মা, যাও তো ওদের সাথে। রিজা কই রে? রিজাও যা।”
মায়া কিছু বলতেই যাচ্ছিলো কিন্তু তার আগেই রিজা মাথায় ওড়না টেনে বের হয়ে আসে। সাব্বির এর কাছে গিয়ে ওর হাত ধরে সোহাগ এর কাছে গিয়ে বলে,”মায়া আপু, তুমিও এসো। ”
অগত্যা মায়া হাত ধুয়ে ওদের পিছনে যায়। সোহাগ কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। মায়া আর রিজা পাশাপাশি হাটছে। সে সাব্বির কে সাথে নিয়ে হাটছে। সাব্বির এটাসেটা জিজ্ঞেস করছে। ও উত্তর দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কিছুই করার নেই। আর তাছাড়া এই ছেলের জন্যই এখন সে এখানে। তাই কিছুই বলারও নেই। রিজা হঠাৎ করে বলে উঠে,”সোহাগ ভাই, ঢাকার শহর কি অনেক সুন্দর? তুমি না কইছিলা একবার ঘুরতে নিয়া যাইবা? জানো, আমিও এইবার মায়াদের সাথে যামু। তুমি কি ওদের বাড়ি চিনো?”
“তুই ঢাকায় যাবি মানে?”
“হুমম। যামু তো। বড় মামা কইছে আমারে নিয়া যাইবো। মারেও নিয়া যাইবো। আমারে ঐহানে নিয়া যাইবো। ঐহানের স্কুলে পড়মু আমি। তুমি কি মায়া আপুগো বাসা চিনো?মাঝে মাঝে কি আমারে দেখতে যাবা?”
“আমি তো ওদের বাসা চিনি না। কিন্তু ওর বাবা বললো ওকে পড়াতে। হয়তো পড়াতে যাবো ওকে। তখন তোকেও দেখে আসবো।”
“তুমি মায়া আপুরে পড়াবা? তাহলে আমারেও পড়াইও?”
“আরেহ বোকা, তুই তো মানবিক বিভাগ নিয়েছিস। আমরা তো সাইন্সের। তোকে তো পড়াতে পারবো না আমি। পড়ালে শুধু সাধারণ গনিত হয়তো। আর তাছাড়া আমি কলেজের বাচ্চা ছাড়া পড়াই না।”
“কেন? তুমি আমারে পড়াইবা না কেন? আমি কি করছি?”
“আরেহ, আমি স্কুলের বাচ্চা পড়াই না। ”
“না পড়াইলা। আমারে পড়াইবা। মায়া আপুরে পড়াইলে আমারেও পড়াইতেই হইবো।”
সোহাগের ইচ্ছে করছে রিজাকে ধরে একটা আছাড় মারতে। কিন্তু মায়া থাকায় একটা ধমক ও দিতে পারছে না। সোহাগ বিরক্ত হয়ে বলে,” আচ্ছা, ঠিক আছে। পড়াবো।”
মায়া লক্ষ্য করলো রিজা সোহাগকে নিয়ে কতোটা বেশি ভাবছে। সামনেই শাপলা বিল। মৃদুমন্দ হাওয়া সবাই উপভোগ করছে। বিলের কাছে যেতেই রিজা মায়া আর সাব্বিরকে পাড়ে দাড় করিয়ে রেখে, “সোহাগ ভাই, তুমি আসো। আমরা নিয়ে আসি। ওরা দুজন থাক।”
সোহাগ আর এইবার কন্ট্রোল করতে পারলো না। রুক্ষ গলায় বললো,”কয়েকটি শাপলাই তো আনবি। একা গেলেই তো হয়। গেলে যা। না গেলে আমাকে একা যেতে দে।”
কিন্তু ওকে একা যেতে দিলো না সাব্বির। সে একা উঠে এসে নৌকার মাঝখানে বসে। রিজা মুখ গোমড়া করে বসে নৌকা বাইতে থাকে।
“ওকে এমনভাবে না বললেও কিন্তু পারতেন। বেচারি কষ্ট পেলো।” রিনরিনে গলায় বলে মায়া।
“আমি বলতে চাইনি। কিন্তু ও অতিরিক্ত কথা বলে। আমার মাঝেমাঝে সহ্য হয়না। কিভাবে বলে ফেলেছি জানিনা। স্যরি,মায়া।”
“আরেহ, আমাকে কেন স্যরি বলছেন? আর ও আসলেই একটু বেশি কথা বলে।” কথাটা বলেই চুপ করে যায় মায়া। নাহ, রিজা বেশি কথা বলে না। অন্যের সংসারে আশ্রিতা মেয়েদের বেশি কথা বলতে নেই। রিজাও বলেনা। কিন্তু সোহাগের কাছে যেন কথার ফুলঝুরি খুলে বসেছিলো। তবে কী রিজা সোহাগ ভাইকে ভালোবাসে? এটা কি সত্যি? যদি এটা সত্যি হয়, তবে রিজাকে অনেক কষ্ট সহ্য করতে হবে। রিজার প্রতি কোনো আকর্ষণই নেই সোহাগ ভাইয়ের। তাছাড়া, আর্থিকভাবে সোহাগ ভাইয়েরা অনেক ভালো। আর রিজারা তো তাদের কাছেপিঠেও নেই। কি হবে এই ভালোবাসার পরিনতি?
গোধুলির পড়ন্ত আলোতে মায়া দেখলো নৌকায় বসে শাপলা তুলতে তুলতে রিজা অভিমানী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সোহাগের দিকে। কিন্তু মায়া এটা দেখলো না সোহাগ নামের যুবকটাও তার প্রেয়সীর দিকে তাকিয়ে আছে নিষ্পলক দৃষ্টিতে।
★★★
“তুমি কি আর যাবে না আমাদের বাড়িতে আপু?” কায়রা জিজ্ঞেস করে কবিতাকে।
কবিতা উদাস নয়নে তাকায় তার দিকে। জীবনটাকে বিষাদ মনে হচ্ছে।কেন সে জন্মেছিল? সে দুনিয়ায় আছে বলেই তার মা মারা গেছে। সে দুনিয়ায় আছে বলেই নতুন মায়ের জীবনটা শেষ হয়ে গিয়েছে। সে দুনিয়াতে আছে বলেই একটা নিষ্পাপ প্রান দুনিয়ার আলো দেখেনি। অতিরিক্ত ডিপ্রেশনে ভুগছে সে। অসহ্য লাগছে সবকিছু। যদি মরে যেতে পারতো, তবেই হয়তো শান্তি পেতো। যদি দুনিয়া থেকে নিজের অস্তিত্ব মুছে ফেলতে পারতো, তবেই হয়তো মুক্তি পেতো। এতোগুলো মানুষের দীর্ঘশ্বাস এর কারণ সে।কিভাবে বাঁচবে সে বাকি জীবন?

চলবে…..