#আমীরা
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ৫
তুশবার ফোনের টর্চ বন্ধ হওয়ার সাথে সাথে আমাদের ফোনও বন্ধ হয়ে গেল। কারও ফোনেই যেন অন হচ্ছে না। বুঝতে পেরেছি আমাদের সবার ফোনের চার্জ একসাথেই শেষ হয়েছে। অনেকটা সময় পার হয়েছে এ সময় ফোনের চার্জ থাকবে না, এটাই স্বাভাবিক৷ আমার গা, হাত, পা কাঁপতে লাগল। মনে হচ্ছে কোনো ভূতের অন্ধকার গলিতে আমরা আটকে আছি। তুশবা আমাদের উদ্দেশ্য করে বলল
“অন্ধকার পথে হাঁটা ছাড়া কোনো উপায় নেই। আমরা একে অপরের কাঁধে হাত ধরে ধরে লাইন করব। সবার প্রথমে আমি মাঝখানে আপনারা দুজন। সবার শেষে সাবিরা। এভাবে লাইন করে আমরা এগুতে থাকব। আমার এ পথে অন্ধকারেও হেঁটে অভ্যাস আছে৷ সাবিরারও অভ্যাস আছে। আপনাদের দুজনের সমস্যা হতে পারে। তাই মাঝখানে রাখলাম। আর আরেকটা কথা। অনেক কিছুর আওয়াজ কানে আসতে পারে। যেহেতু গহীন জঙ্গল। সেহেতু জা/নোয়ারের হাক ডাক বেশি। ভয় পাবেন না আপনারা।”
তুশবার কথা মতো আমরা কাঁধে হাত রেখে সারিবদ্ধ হয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে হাঁটছি। হাঁটতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে তবুও হাঁটতে হচ্ছে। এমন ভয়ংকর, অস্বস্থিকর ট্রিপ আমার জীবনে এ প্রথম। নির্ঝরের জোরাজোরিতে এসেছি। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে কোনো শয়তান আমাদের বশ করছে। বেশ মাতাল মাতাল লাগছে। হঠাৎ করে মনে হলো কেউ আমার নিতম্বে সুচের মতো কিছু একটা দিয়ে গুতা দিয়েছে৷ আমি একটু চেঁচিয়ে উঠলাম। সাবিরা আমাকে বলে উঠল
“কী হয়েছে ভাবী? আপনার শরীর ঠিক তো? কষ্ট কী বেশি হচ্ছে?”
নির্ঝর আর তুশবাও একইসাথে জিজ্ঞেস করে উঠল কী হয়েছে? আমি কিছুটা চেপে গেলাম বিষয়টা। স্বাভাবিক গলায় বললাম
“মনে হলো কিছু একটা পায়ে লেগেছে। তেমন কিছু না। তবে আর কত পথ বাকি?”
তুশবা দম ছেড়ে জবাব দিল
“এই তো আর বেশি সময় না। ১০ মিনিটের মতো লাগবে।”
আমার কাছে এ ১০ মিনিট সময়ও অনেক বেশি লাগছে। মনে হচ্ছে এ সময় টা এত আস্তে যাচ্ছে কেন। মাতাল মাতাল লাগছে। অসাড় লাগছে। হাঁটতে হাঁটতেই কখন যে মাটিতে লুটিয়ে পড়লাম খেয়াল নেই। যখন জ্ঞান ফিরে তখন চারদিকে আলো ফুটেছে। আমি বাশের মাচায় শুয়ে আছি। মাটি থেকে একটু উঁচুতে বাশের মাচা করে দুটো ঘর করা এর সামনে বারান্দার মতো করে খোলা জায়গা। এখানে আমাকে শুইয়ে রাখা হয়েছে। আমার জ্ঞান ফিরতেই নির্ঝর বলে উঠল
“তোমার শরীর কী ঠিক হয়েছে? অন্ধকারে তোমাকে তিনজন মানুষ কোনোরকম কোলে করে এখানে নিয়ে এসেছি। এতক্ষণ তুমি ঘুমাচ্ছিলে৷ ডাক দিলে সারা দিচ্ছিলে কিন্তু চোখ খুলে উঠছিলে না৷ তুমি ঘুমের ঔষধ বা কিছু খেয়েছো? মাথা ব্যথার জন্য খেতেও পারো।”
আমি হালকা গলায় বললাম
“আমাকে আগে একটু পানি দাও।”
তুশবার ভাই মান্দি আমাকে একটা বিশেষ পাত্রে পানি এনে দিল। পাত্রটা দেখতে অনেকটা নৌকার মতো। পাত্রটা কাঠ দিয়ে বানানো। আমি পানিটা খেয়ে একটু নিঃশ্বাস নিয়ে উত্তর দিলাম
“কিছুই খাইনি৷ হয়তো শরীর দুর্বল তাই। এখন একটু ভালো লাগছে। আমার প্রচন্ড ক্ষুধা লেগেছে৷ কিছু খেতে চাই৷ ”
সাবিরা আমার কথা শুনার সাথে সাথে আমার জন্য একটা বিশেষ রকমের শুটকি ভর্তা, পাহাড়ি মুরগি, দিয়ে ভাত নিয়ে আসলো। তাদের রান্নায় কোনো ধরণের মসলা নেই। তবে আমি খেয়ে এটা বুঝেছি ভীষণ ঝাল। ভাতটা খাওয়ার পর আমার শরীরে একটু শক্তি পেতে লাগলো৷ চারপাশে তাকিয়ে আমার মনটা এবার জুড়িয়ে গেল। মনে হলো আমি এ জায়গায় এসে ভুল করিনি। এত নিরিবিলি সুশীতল বাতাস আমাকে যেন মুগ্ধই করছে। এবার অনেকটা ভালো লাগছে আমার। তুশবা আর সাবিরার প্রতি যে সন্দেহটা ছিল সেটাও কেটে গেছে কিছুটা। আমি চারপাশ তাকিয়ে দেখতে লাগলাম। সাবিরা আমার কাঁধে হাত দিয়ে বলল
“ভাবী আপনার তো অনেক কিছু নিয়ে নেগেটিভিটি মনে ছিল। সেটা কী এখন কেটেছে? আমাদের সংস্কৃতি ভিন্ন। তবে আমরা মানুষ। আমাদের মানবিকতা আছে। আমাদের আতীরের মানুষের আপ্যায়ন আপনি কোনোদিন ভুলবেন না। আমরা অতিথি আপ্যায়নে সেরা। আমার মোহশিয়া দেবীর পূজারি। আমাদের দেবীর কুটুম বাড়ি এ আতীর। তাই আতীরের মানুষ কুটুমদের অনেক যত্ন করে৷ আপনি আতীরকে আজীবন মনে রাখবেন। আমরা কারও ক্ষতি করি না। বরং সবার মঙ্গল হয় এমন কাজ করি৷ ”
আমি সাবিরাকে হালকা জড়িয়ে ধরে বললাম
“আমার এরকম দ্বিধা দ্বন্ধের জন্য আমি দুঃখিত।”
তুশবা তার মা, বাবার সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিল। যদিও তাদের কথা আমরা বুঝি না। তবুও হাসি মুখ দেখে বুঝেছিলাম আমরা আসাতে তারা খুশি। আমি কিছুটা উঠে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। ওদের একটা বদ্ধ জায়গায় আমাকে একটা মটকায় করে পানি আর মগ দিল গোসল করার জন্য। আমি সেখানে গেলাম ফ্রেশ হতে। কিন্তু আমার বার বার মনে হচ্ছিল কেউ আমাকে অনুসরণ করছে। বদ্ধ জায়গাটা নারিকেল পাতা দিয়ে বেতের মতো করে বুনে তৈরী করা হয়েছে। আমি সেটার ফাঁক দিয়ে বারবার তাকিয়ে খেয়াল করছিলাম কে লক্ষ্য করছে। কিন্তু কাউকে দেখতে পেলাম না। আমি তাড়াহুড়ো করে গোসল সেড়ে কাপড় পাল্টানোর সময় লক্ষ্য করলাম কেউ একজন পাশ থেকে সরে গেল। আমি এবার ফাঁকা দিয়ে তাকিয়ে লক্ষ্য করলাম একটা মেয়ে হেঁটে যাচ্ছে। ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলাম এটা সাবিরা। আমার মাথায় এবার প্রশ্ন জাগতে শুরু করল। সাবিরা এখানে কী করছিল? লুকিয়ে লুকিয়ে সে কী দেখছিল? আমার ভেতরে থাকা সন্দেহ যেন আরও ঝেঁকে বসলো।
আমি কাপড় পাল্টিয়ে তাড়াহুড়ো করে বের হলাম। তুশবাদের ঘরের সামনে এসে লক্ষ্য করলাম সাবিরা মাচায় বসে আছে। সে আমার সাথে এমন ভাব করছে যেন সে এতক্ষণ এখানেই বসে ছিল। বিষয়টি বুঝতে পেরেও আমি চুপ থাকলাম। এত সহজে এখানের কাউকে বিশ্বাস করা যাবে না৷ এতে আমার বিপদেই চলে আসতে পারে৷ তবে সন্দেহটাও প্রকাশ করা যাবে না। সাবিরাকে চোখে চোখে রাখতে হবে।
সে সময়ের পর থেকে সাবিরা শুধু আমার আশেপাশে থাকে। যত্নের নাম করে সে যে আমার বিষয়ে বেশি কৌতুহল দেখাচ্ছে এটা বুঝায় যাচ্ছে। আমি বিষয়টিতে বিরক্ত হলেও নিজেকে সংযত করলাম।
সারাদিন আমরা চারজন আশেপাশে ঘুরলাম। বেশ মনোরম পরিবেশ। এ সৌন্দর্যতায় যে কেউ মুগ্ধ হবে৷ তবে আমি যে পথ দিয়ে যাচ্ছিলাম সাবিরা বারবার নির্ঝর কে আমার কাছ থেকে সরিয়ে আমার সাথে হাঁটছিল। আমি স্পষ্ট নির্ঝর আর সাবিরার মধ্যে কিছু কানেক্ট করতে পারছিলাম। তবে সেটা কী বুঝতে পারছিলাম না।
সারাদিন ঘুরে আমরা যখন ঘরে আসি। তখন তুশবা আমাদের জন্য খাবার নিয়ে আসে। আমাদের সামনে থরে থরে সাজানোর হয় তাদের ঐতিহ্যবাহী খাবারগুলো৷ তুশবা আমাদের জানায় এখানে যা আছে আমাদের জন্য হালাল। সে আসার আগে মুসলিমদের জন্য হালাল কোনটা জেনেই এসেছে। তাই যে ঐতিহ্যবাহী খাবারগুলো আমাদের জন্য হালাল সেটাই রান্না করা হয়েছে। খাবারগুলো দিয়ে তুশবা নির্ঝর আর আমাকে বলল আমরা যেন নিজ হাতে নিয়ে খাই। তারাও আমাদের সাথে বসলো। আমরা খাওয়ার শুরু করলাম৷ প্রতিটা খাবার অনেক সুস্বাদু ছিল। নির্ঝর পাহাড়ি মুগির রানের পিসটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল
“এটা খাও। এ তরকারিটা অনেক অনেক মজা হয়েছে।”
আমার পাতে রানের পিসটা দেওয়ার সাথে সাথে সাবিরা সেটা আমার পাত থেকে নিয়ে বলল
“ভাবী এটার থেকে এ পুঁটি মাছের মারচা টা অনেক মজা। এটা খেয়ে দেখেন।”
তার এমন আচরণে আমরা তিনজনেই বেশ হতবাক। আর আমি এটা বুঝতে পারছিলাম সাবিরা আর নির্ঝরের মাঝে কিছু চলছে যেটা এতদিন আমার চোখ আড়াল করে গেছে৷ আর এ বিষয়টি আরও বেশি পরিষ্কার হয়েছিল পরদিনের একটা অদ্ভুত ঘটনায়।
চলবে।