আমীরা পর্ব-০৮ এবং শেষ পর্ব

0
38

#আমীরা
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ৮ /শেষ পর্ব

নির্ঝর আবারও উত্তেজিত হয়ে পড়েছে। আমার কাছে আসার অনেক চেষ্টা করছে। তুশবা এবং মান্দি মিলেও তাকে আটকাতে পারছে না। তার মুখ অবয়ভ ভয়ংকর হয়ে গিয়েছে। সে সাথে কণ্ঠস্বর ও পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। ভয়টা আমার বাড়তে লাগল। বেপরোয়াভাবে সে সবকিছু ভাঙচুর করতে শুরু করল। তুশবা আর মান্দি তাকে ধরে গাছের শিকড় দিয়ে বেঁধে ফেলল। নির্ঝর এ অবস্থায় আমাকে হুমকি দিয়ে বলল

“তুই যতই আমাকে এড়িয়ে যা। যতই তুই আমার থেকে দূরে থাক। তারপরও তোর পেটে আমার বাচ্চা আসবেই। এ পৃথিবী আমার হাতের মুঠোয় চলে আসবে। তোদের ছিন্ন ভিন্ন করে দিবে।”

নির্ঝরের মুখে এসব কথা শুনে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। অনেকটা নিজেকে সামলে নিতে চেয়েও পারছিলাম না। বুক চাপা কান্না আমাকে গ্রাস করতে লাগল। শরীর টা অসাড় লাগলেও নিজেকে শান্ত করলাম। তুশবা নির্ঝরকে নিয়ে তান্ত্রিকের কাছে যাচ্ছে। সাবিরা আমাকে সাথে নিল। কারণ আমাকেও সাথে যেতে হবে। নাহয় ভয়ংকর আমীরাকে আমার পেট থেকে ধ্বংস করা যাবে না৷

নির্ঝরকে সামলানো খুব কঠিন ছিল। তবুও তুশবা আর মান্দি ওকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। আমিও ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছি। সাবিরা আমাকে সাহস দিয়ে বলল

“ভাবী ভয় পাবেন না। যা হবে অনেক ভালো হবে। এ আতীরের আপ্যায়ন আপনি জীবনেও ভুলবেন না। নিজেকে সামলান। আতীর আপনার জন্য সমস্তটা উজার করে দিবে। আপনি প্লিজ ভেঙে পড়বেন না। আজকের মধ্যেই সব ঠিক হয়ে যাবে।”

এ অন্ধকার পথে আধো আধো আলোতে হাঁটা বেশ মুশকিল হয়ে যাচ্ছিল। তবুও শরীরের সকল শক্তি নিয়ে হাঁটছি। নিজেকে সামলাতে খুব কষ্ট হলেও সাবিরার কথায় নিজের মধ্যে শক্তি সঞ্চার করে নিচ্ছিলাম।

আধা ঘন্টা হাঁটার পর আমরা সেই গুহায় পৌঁছে গেলাম। সেখানে সে তান্ত্রিকটা কুরআনের আয়াত সামনে নিয়ে বসেছে। নির্ঝরকে একটা গোল বৃত্তের মধ্যে বসিয়ে তিনি কুরআন তিলওয়াত করে যাচ্ছেন। আর নির্ঝর ছটফট করতে লাগল। আমাদের সবাইকেই আলাদা আলাদা গোল বৃত্তে বসতে বলা হয়েছে। একা একটা বৃত্তে বসে থাকতে আমার বেশ ভয় লাগলেও কোনো উপায় ছিল না। নির্ঝর অনেকটা কৈ মাছের মতো ছটফট করছে। আর তুশবা ঝিম ধরে বসে আছে। সাবিরা, মান্দি আর আমি সবকিছু কেবল দেখে যাচ্ছি। হঠাৎ করে খেয়াল করলাম তান্ত্রিক তুশবাকে উদ্দেশ্য করে একটা কাঠের মতো কিছু ছুড়ে মেরেছে। সাথে সাথে তুশবা মাটিতে পরে গেল। তার গলা ও নাক দিয়ে ব্লাড বের হতে লাগল। আমি তুশবার দিকে উঠে যেতে নিলে, ঠিক তখন সাবিরা আমাকে আটকে দিয়ে বলল

“এখান থেকে বের হইও না। পাঁচ মিনিট সময় দাও।”

আমার কাছে এ পাঁচ মিনিট মনে হচ্ছিল অনেক বেশি সময়। সময় যেন কাটছিল না। শরীরটা আমার অসাড় হতে লাগল। নির্ঝর একদম স্বাভাবিক হয়ে গেল। মনে হচ্ছে ঘুমাচ্ছে। পাঁচ মিনিট পর সাবিরার দিকে লক্ষ্য করে দেখলাম সে কাঁদছে। তুশবা মাটিতেই নুইয়ে আছে। কোনো সাড়া শব্দ নেই। সাবিরা গোল বৃত্ত থেকে বের হয়ে জোরে কাঁদতে লাগল। চারদিকে হালকা আলো ফুটেছে। কখন যে এত সময় পার হয়ে গেল আমি বুঝতেই পারলাম না। নির্ঝরের কোনো সাড়া শব্দ নেই৷ ওর কাছে গিয়ে বুঝলাম সে দম নিচ্ছে। তার মানে বেঁচে আছে। এদিকে সাবিরা তুশবাকে ধরে জোরে চিৎকার দিয়ে কাঁদছে। মান্দিও কাঁদছে। আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না কী হয়েছে। আমি সাবিরার কাছে গিয়ে তাকে ধরে জিজ্ঞেস করলাম

“ভাইয়ার কী হয়েছে? আর কী থেকে কী হলো কিছুই তো বুঝতে পারছি না।”

এরপর সাবিরার মুখে যা শুনলাম তার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না৷ এরকম ভয়ানক ছক কেউ যে আঁকতে পারে এটা আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না। সাবিরা কাঁদতে কাঁদতে বলল

“এসব কিছুর পেছনে তুশবা ছিল। ঐদিন তোমাকে বলেছিলাম না নির্ঝর অসীম ক্ষমতার অধিকারি হতে চেয়েছিল। সেটা নির্ঝর ছিল না,ছিল তুশবা। তুশবা কালো জাদুতে আসক্ত হয়ে গিয়েছিল। সে চেয়েছিল নির্ঝরের মাধ্যমে তোমার গর্ভে সন্তান এনে নির্ঝরের প্রাণ নাশ করে অসীম ক্ষমতার অধিকারী হতে। আমি সেদিন নির্ঝরের কথা বলেছিলাম কারণ তুশবা যেন বুঝতে না পারে তাকে সন্দেহ করা হচ্ছে। কারণ সেটা বুঝলে সে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠত। আমাদের এখানে কালাজাদু করা নিষেধ। আমাদের এখানে কালো জাদু করলে আমরা মনে করি মোহশিয়া দেবীর অবমাননা। আর মোহশিয়া দেবীর পূজারী হয়ে আমরা কেউ এ অবমাননা মেনে নিব না। তাই তুশবার প্রাণ আমাদের কাছে কিছুই না। তবে তুশবা মারা যায় নি। তার শেষ জীবনটা আবদ্ধ জায়গায় প্যারালাইজড হয়ে কাটবে। কোনো ডাক্তারের দ্বারায় সে সুস্থ হবে না। এটা তার অন্যায়ের শাস্তি। কারণ সে তার উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য নির্ঝরকে নিজের আয়ত্ত্বে এনে আতীরে নিয়ে আসে৷ ভেবেছিল আমরা বুঝব না। সে মুহুর্ত পর্যন্ত সে তান্ত্রিকের সাথেও গেম খেলতে নিয়েছিল। কারণ কোনো কারণে ভুল পদক্ষেপ নিয়ে যদি তান্ত্রিক নির্ঝরকে আঘাত করত আর তার মৃত্যু হত তাহলে তার উদ্দেশ্য আরও দ্রূত সফল হয়ে যেত। তবে সে বুঝে নি সে নিজের ফাঁদে নিজে পা দিয়েছে। ভাবী নির্ঝরকে মান্দি নিয়ে যাবে। আপনি মান্দির সাথে যান। আমি তুশবাকে শুদ্ধি করে নিয়ে আসতেছি।”

সাবিরার কথা শুনে আমার চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। আমি সাবিরার মতো সাহসী নারী এ প্রথম দেখলাম। যে অন্যায়ের কাছে আপোস হয়নি৷ নিজের স্বামীকে বিসর্জন দিতেও দশবার ভাবেনি৷ অথচ আমি প্রথমে কতটা নেগেটিভ চিন্তা করেছিলাম এ আতীরকে নিয়ে। ওদের কে নিয়ে।

আমি আর মান্দি চলে আসলাম৷ নির্ঝরকে মাচায় শুইয়ে রাখা হয়েছে। সাবিরা আসলো ১ ঘন্টা পর। তুশবাকে নিয়ে সে ঘরে গেল। তুশবার জ্ঞান ফিরেছে। কিন্তু সে কথা বলতে পারছে না। সাড়া শব্দ করতে পারছে না। এক পলকে কেবল উপরের দিকে তাকিয়ে আছে৷

এদিকে নির্ঝরের জ্ঞান ফিরেছে সকাল ১০ টায়। নির্ঝরের জ্ঞান ফেরার পর নির্ঝর যেন সব ভুলে গেছে৷ স্বাভাবিক গলায় আমাকে জিজ্ঞেস করল

“আমি কি সারারাত এখানে ছিলাম?”

আমি জাবাব দিতে যাব এসময় সাবিরা ঘর থেকে জবাব দিল

“তুশবা রাতে অসুস্থ হয়ে পরে। আপনি তুশবাকে নিয়ে যাওয়ার পথে পরে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন তাই আপনাকে মাচায় শুইয়ে রাখা হয়েছে৷ আর তুশবা প্যারালাইজড হয়ে গেছে। ভাইয়া আপনারা আজকেই চলে যান। আতীরে খারাপ বাতাস বইছে৷ তুশবার মতো আপনাদের শরীরে খারাপ বাতাস লাগুক চাই না। তাই বলব মান্দি আপনাদের গাড়ি পর্যন্ত দিয়ে আসবে। চলে যান। আমি আর ঢাকায় ফিরব না। ঢাকায় ফেরার মতো কোনো পিছুটান আমার নেই। তুশবা সুস্থ হলে কোনো একদিন আপনাদের সাথে দেখা হবে।”

নির্ঝর আর কিছু বলল না। সে বুঝতে পারল এখানে থাকা আমাদের জন্য উচিত হবে না। তাই ঘরে গিয়ে তুশবার কপালে হাত বুলিয়ে দিয়ে বিদায় নিয়ে সব গুছিয়ে নিল। আমি সাবিরার কাছে যেতেই সে বলল

“নির্ঝরকে এসব ব্যাপারে বলার কোনো দরকার নেই। এসব বিষয় যত গোপন থাকবে ততই মঙ্গল। আর নিশিতা তুমি সত্যিই প্র্যাগন্যান্ট। তোমার ভেতরে সত্যিই একটা প্রাণ আছে। তবে সে প্রাণে ক্ষতিকর কিছু নেই। তোমার কাছে আমার আবদার যে প্রাণটা আসবে সে মেয়ে হলে নাম রাখবে আমীরা আর ছেলে হলে নাম রাখবে আমীর। আমীরা নামটা আমার মেয়ের নাম ছিল। আমার প্রথম সন্তান পেটে থাকা অবস্থায় মারা যায়। এর কারণও তুশবা ছিল। সে আমীরাকে নিজের হাতিয়ার বানানোর জন্যই এ কাজ করেছিল। পরবর্তী সে চেয়েছিল আবার আমীরাকে ভয়ংকর রুপে ফিরিয়ে এনে নিজের উদ্দেশ্য হাসিল করতে। কিন্তু আমার জন্য সেটা পারেনি। তুশবা তার শাস্তি পয়েছে। আর ভাবী এ আতীর কখনও কারও সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে না।”

আমি একটা দম নিয়ে তা পরক্ষণে ছেড়ে উত্তর দিলাম

“আমি সত্যিই আতীরের আপ্যায়ন কখনও ভুলব না। ভালো থেকো। আজীবন তোমাদের কথা আমাদের মনে থাকবে। আমার সন্তানের নাম তোমার পছন্দ মতেই হবে।”

সেদিন আমরা বিদায় নিয়ে আতীর থেকে শহরে চলে আসি। শহরের আসার পর থেকে আতীরের সব ভুলার চেষ্টা করেও পারেনি। এর মধ্যে আমার কোল জুড়ে একটা কন্যা সন্তানেই আসলো। যার নাম আমি রেখেছি #আমীরা।

সমাপ্ত…..