আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব-১২+১৩

0
28

গল্প- আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে
পর্ব- ১২
লেখিকা- সালমা চৌধুরী

আবির ভাইয়ের সাথে কথা বলেছে এই খুশিতে মেঘ সারাবাড়ি ছুটছে। কে বলবে এই মেয়েটায় এক সপ্তাহ রুম থেকে বের হয় নি, কারো সাথে কথা পর্যন্ত বলে নি। আজ সে মীম আর আদিকে নিয়ে দুষ্টামি, খুনসুটিতে মগ্ন৷ মীম আর আদিও যেনো আপুকে এভাবে পেয়ে বড্ড খুশি।

হঠাৎ জান্নাত আপু বাড়িতে ঢুকলো, মেঘকে এত হাসিখুশি দেখে জান্নাত আপুও খুশি হলো। এই ১ সপ্তাহে জান্নাত আপু যতদিন এসেছে৷ প্রতিদিন ই মেঘ মনমরা হয়ে বসে থাকে। পড়া ধরলে পারলে বলে, না পারলে চুপ থাকে, আপু বুঝালেও সারা নেই। বুঝছে কি না তাও বলে না। জান্নাত আপু কম করে হলেও ২০ বার জিজ্ঞেস করে,
“মেঘ তোমার কি হয়েছে বলো?”

মেঘ কিছুই বলে না। এতে জান্নাত আপুও চিন্তিত ছিল। ওনি নিজে থেকেই অনেক বুঝিয়েছেন, রেজাল্ট নিয়ে যেনো চিন্তা না করে, এডমিশন টেস্ট নিয়ে যেনো না ভাবে। কিন্তু মেঘ এসবে কোনো সাড়া দেয় নি। তাই আজ মেঘকে খুশি দেখে জান্নাত আপুর মুখে সহসা হাসি ফুটে উঠেছে।

জান্নাত আপু ডাকলে,

“মেঘ”

সোফায় বসা মেঘ পিছন ফিরে তাকিয়ে জান্নাত আপুকে দেখে ছুটে আসে।

মেঘ: আপু কেমন আছো?

জান্নাত: আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তুমি কেমন আছো?

মেঘ: আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপু তুমি একটু বসো , আমি রুম থেকে বই খাতা নিয়ে আসছি।

বলেই সিঁড়ি দিয়ে ছুটছে রুমের দিকে। জান্নাত হাস্যোজ্জ্বল মুখে তাকিয়ে আছে মেঘের দিকে। সত্যি বলতে ছটফটে স্বভাবের মেয়েরা হঠাৎ শান্ত হয়ে গেলে সবার নজরে পরে যায়। মেঘের ক্ষেত্রেও তেমনটায় হয়েছে৷

জান্নাত আপুর পড়ায় মেঘের সম্পূর্ণ মনোযোগ আছে আজ। পড়ানোর আগেই সব বুঝে ফেলছে। জান্নাত আপু পড়িয়ে যাওয়ার পর আরও ১-২ ঘন্টা মীম আর আদির সাথে আড্ডা দিয়েছে মেঘ। নিজেও পড়ছে না ওদের কেও পড়তে দিচ্ছে না।

এতে অবশ্য মা,কাকিয়া কিছুই বলছে না। মেয়েটা যে হাসিখুশি আছে এতেই সবার ভালো লাগছে।

মোজাম্মেল খান এবং আলী আহমদ খান বাসায় ফিরেছেন কিছুক্ষণ আগে। ফ্রেশ হয়ে খেতে বসেছেন। মেঘ ও আজ সবার সাথে খেতে বসেছে। আবির ভাইয়ের চেয়ারের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো।
মনে মনে বললো,
“মিস ইউ আবির ভাই”

আলী আহমদ খান মেঘকে জিজ্ঞেস করলেন,

“মেয়েটা ভালো পড়াচ্ছে তো আম্মু?”

মেঘ হাসিমুখে উত্তর দিলো,
“আপু অনেক ভালো পড়ায় বড় আব্বু!”

‘কোনো সমস্যা হলে জানাইয়ো’
স্বাভাবিক ভাবেই কথাটা বললেন আলী আহমদ খান।

মেঘও শান্ত স্বরে বললো,
“ঠিক আছে বড় আব্বু!”

মেঘ রুমে এসে শুয়ে পরেছে। আজ পড়তে একটুও ইচ্ছে করছে না৷ আবির ভাইয়ের সাথে কথা বলার খুশি, সাথে এটাও অনুভব করছে সে আবির ভাইকে ভালোবেসে ফেলেছে। এসব ভেবেই মেঘের ওষ্ঠ ছড়িয়ে আসে। সহসা ডাটা অন করে আবির ভাইয়ের আইডিতে ঢুকে। সেদিন রাগ করে ছবি ডিলিট করার পর আর ছবিগুলো ডাউনলোড করে নি। আজ আবার ইচ্ছে হলো ছবিগুলো সেইভ করার। এখন আর রা*গ, অভিমানে আবির ভাইয়ের ছবি ডিলিট করবে না এই প্রতিজ্ঞা করলো৷

আবির ভাইয়ের আইডিতে ঢুকতেই একটা পোস্ট চোখে পরে,

“আমার স্বপ্নগুলো হাতছানি দেয়,
সন্ধ্যাতারার মাঝে”
সাথে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে তুলা একটা ছবি।

২ ঘন্টা আগেই পোস্ট করেছেন।মেঘ সঙ্গে সঙ্গে ছবিতে কেয়ার রিয়েক্ট দিলো, একটা লাভ ইমুজিও কমেন্ট করলো। আবির ভাইয়ের ছবি দেখে মেঘেরও কক্সবাজার যেতে খুব ইচ্ছে করছে। কিন্তু চাইলেই তো সব ইচ্ছে পূরণ হয় না। এক দৃষ্টিতে ছবিটা কিছুক্ষণ দেখলো তারপর আস্তে আস্তে সব ছবি সেইভ করতে লাগলো৷

গ্যালারিতে একটা একটা এলবাম খুললো
নাম দিলো – Pawky Trample এখানে আবির ভাইয়ের সব ছবি একসাথে রাখলো৷

আবির ভাইকে দেখতে দেখতে কখন ঘুমিয়েছে কে জানে।

পেইজ: Salma Chowdhury – সালমা চৌধুরী
★★★★

কেটে গেলো আরও ২-৩ দিন। মেঘ নিজের রুটিন মতো খায়, গোসল করে, ঘুমাই, পড়াশোনা করে। মাঝখানে ৫/৭ দিন একদম ই পড়াশোনা করে নি। এই গ্যাপটাও এখন ফিলাপ করছে। ক্লান্ত লাগলে আবির ভাইয়ের ছবি দেখে৷

আজ কোচিং, টিউশন কিছু নেই। তাই দুপুরে খেয়ে ঘুমিয়েছে মেঘ। বিকেলে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নিচে আসে কফি খাওয়ার৷ নিচে আসতেই চোখে পরে মীম আর আদি অনেক গিফট ছড়িয়ে দেখছে।

মেঘকে দেখেই আদি ছুটে যায় মেঘের কাছে।

আদি: আপু দেখো ভাইয়া কত গিফট নিয়ে আসছে আমাদের জন্য। অনেকগুলো শামুক এনেছে সবার নাম লিখা। আসো আসো

এরমধ্যে মীম ২ টা শামুক নিয়ে এসেছে। দেখো আপু তোমার নামের একটা আমার নামের একটা।।

মেঘ এক পলক তাকালো শামুকের দিকে।

শামুক গুলোর উপর সুন্দর করে ভেসে আছে নামটা,

মেঘ উত্তেজিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

“আবির ভাই কখন এসেছে?”

মীম হাসিমুখে উত্তর দিলো,
“কিছুক্ষণ আগেই এসেছে । ”

মেঘ আর কিছু না বলে সিঁড়ি দিয়ে ব্যস্ত পায়ে উঠতে লাগলো।

মীম পিছন থেকে ডাকলো,
আপু কোথায় যাচ্ছো, আরও গিফট আনছে ভাইয়া, আসো দেখে যাও।

মেঘ গলা উঁচু করে বললো,
“একটু পরে আসছি। ”

হুটোপুটি করে উঠে, অন্তহীন ছুটে আবির ভাইয়ের রুমের দিকে, ঠিক দরজার সামনে এসে থামে, উত্তেজিত হাতের ধা*ক্কায় চাপানো দরজা সহসা খুলে গেলো,

আবির শাওয়ার শেষ করে কোমড়ে টাওয়েল জড়িয়ে উন্মুক্ত শরীরে ওয়াশরুম থেকে বের হয়েছে মাত্র। সারা শরীরে বিন্দু বিন্দু পানিতে চিকচিক করছে। প্রশস্ত বুকের লোমগুলোতেও পানি জমে আছে। চুল থেকে টুপ টুপ করে পানি পরছে।

মেঘের দিকে নির্বাক চোখে তাকিয়ে আছে আবির। মেয়েটার এলোমেলো চুলগুলো উড়ছে এদিকসেদিক। এই কয়দিনেই অষ্টাদশীর মুখটা মলিন হয়ে গেছে। গায়ের রঙও কিছুটা চেপে গেছে। গভীর দৃষ্টিতে তা পরখ করতে ব্যস্ত আবির।

এদিকে আবির ভাইয়ের আবেশিত, নেশা ভরা চোখের চাউনীতে অষ্টাদশীর কোমল মনে অশান্ত, অস্থির ঢেউ আঁচড়ে পরে৷ মনে হচ্ছে সিডর, আইলা, জলোচ্ছ্বাস সবকিছু একসাথে হানা দিয়েছে। এতদিন পর প্রিয় মানুষটাকে দেখছে তাও আবার এই অবস্থায়! আবির ভাইকে এই অবস্থায় দেখে মেঘের অন্তঃস্থলে শিহরণ জাগায়।

মেঘের মনে অকস্মাৎ গান বেজে উঠলো,

“দৃষ্টিতে যেন সে রাসপুতিন
খু*ন হয়ে যায় আমি প্রতিদিন
নামধাম জানি, সাথে তার সবকিছু
তবুও নিলাম আমি তার পিছু!’

টেনে হিঁচড়ে অনেক কষ্টে দৃষ্টি নামালো মেঘ। বক্ষস্পন্দন জোড়ালো হলো। অষ্টাদশীর ভেতরটা ভরে এলো, এ যেনো প্রশান্তির হাওয়া।

আবির তখনও দুর্বোধ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অষ্টাদশীর পানে।

মেঘ গলা খাকাড়ি দিয়ে, দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নিচু করে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললো,
“Sorry”

আবিরের এবার হুঁশ ফিরে।
অবাক চোখে তাকিয়ে কপাল কুঁচকে বললো,
“SORRY কেন?”

মেঘ কন্ঠ খাদে নামিয়ে জবাব দিল,
“অসময়ে চলে আসছি তাই,”

এটুকু বলেই চলে যেতে নেয় মেঘ।

আবির হঠাৎ ই গম্ভীর গলায় বলে উঠলো,
“দাঁড়া, কি বলতে এসেছিলি বল!”

মেঘ তৎক্ষনাৎ শীতল কন্ঠে বললো,
“ভুলে গেছি ”

আবির কয়েক সেকেন্ড থাকলো, ঠোঁটের কোণায় দুষ্টু হাসি, নিরুদ্বেগ কন্ঠে বললো,

“মনে করে বলে, তারপর যাবি”

আবির ভাইয়ের কথা শুনে মেঘের হাত পা কাঁপা কাঁপি শুরু হয়ে গেছে। আবির ভাই থা*প্পড় দিবে না তো!
মেঘ নরম স্বরে আস্তেধীরে আবারও বললো,।

“সরি আবির ভাই, এভাবে আর রুমে ঢুকবো না। সরি”

আবির কন্ঠ দ্বিগুণ ভারি করে, বিরক্তি নিয়ে বললো,

“এত ন্যাকামি করছিস কেনো মেঘ,
তুই কি চাচ্ছিস, এখন আমি চিৎকার দিয়ে বাড়ির সব মানুষ জড়ো করে বলি,

“”ওমা গো, ও বাবা গো, মেঘ আমার স*র্বনাশ করে ফেলছে, আমায় খালি গায়ে দেখে ফেলছে, এখন আমার কি হবে!””

আবির ভাইয়ের মুখে এমন কথা শুনে মেঘ হা করে তাকালো আবির ভাইয়ের দিকে। আবির ভাইয়ে খালি গা দেখে মনের ভেতর পুনরায় উতালপাতাল শুরু হয়ে যাচ্ছে৷ মেঘের সমস্ত গায়ে স্রোতের মতো শীতল হাওয়া বয়ে যায়। তৎক্ষনাৎ মাথা নিচু করে ফেললো মেঘ৷

আবির শক্ত কন্ঠে আবার বললো,
“আমি মেয়ে না যে আমায় এই অবস্থায় দেখে ফেলছিস বলে মানসম্মান চলে যাবে। তুই কি বলতে আসছিলি সেটা বল। ”

মেঘ এবার মাথা নিচু করে কাঁপা কাঁপা গলায় আস্তে আস্তে বললো,
“আপনাকে দেখতে আসছিলাম”

আবির ভ্রু কুঁচকে তাকালো, তৎক্ষনাৎ বলে উঠলো,
“দেখতে আসছিস দেখ, খোঁজ নে আমার, এত ফরমালিটি করছিস কেনো?”

মেঘ নরম স্বরে বললো,
“দেখেছি এখন আসি!”

ঘুরে এক পা ফেলতেই, আবির ডাকলো,

“তোর সাথে কথা আছে, বস এসে”

মেঘ ঠায় দাঁড়িয়ে পরলো সেখানে। মেঘের এবার রক্ত সঞ্চালণ বন্ধ হওয়ার পরিস্থিতি হলো। মুখ তুলে তাকাতেও পারছে না। মনে মনে বলছে,
“আল্লাহ বাঁচাও ”

আবির আবার বললো,
“বসতে বললাম তো তোকে”

মেঘ ধীরস্থির পায়ে এগিয়ে এসে বিছানার কোণায় বসেছে৷ চিবুক নামিয়েছে গলায়। দৃষ্টি তার ফ্লোরে৷

আবির একটা টিশার্ট হাতে নিয়ে ঘুরে এসে মেঘের থেকে কিছুটা দূরে বসেছে।

আবির কঠিন স্বরে বললো,
“কি হয়েছে তোর?”

মেঘ আবারও কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললো,
আবির ভাই আপনি কিছু একটা পড়ুন, প্লিজ।

আবির মুচকি হেসে ভেজা শরীরেই হাতের গেঞ্জি টা পরে নিলো। আর বললো,
“এবার শান্তি হয়ছে? এখন বল কি হয়েছে তোর?”

মেঘ চিবুক নামিয়ে শীতল কন্ঠে উত্তর দিলো,
“কিছু হয় নি। ”

রাগান্বিত স্বরে আবির বললো,
“মেঘ, ভাবছি তোকে মেডিকেলে বিক্রি করে দিব!”

মেঘের সংকীর্ণ মুখটা আরও বেশি ছোট হলো, নিভু নিভু চোখে তাকালো আবির ভাইয়ের দিকে, পাতলা অধর নেড়ে বললো,

“কেনো? আমি কি করেছি?”

আবির অভিভূতের ন্যায় নিষ্পলক চেয়ে রইলো মেঘের দিকে, প্রখর তপ্ত স্বরে বললো,

“”এইযে তুই ঠিকমতো খাচ্ছিস না, দিনকে দিন কঙ্কাল হইতেছিস, তোকে এই বাড়িতে রাখার থেকেও মেডিকেলে রাখলে বেশি কাজে দিবে।””

কন্ঠ ভিজে এলো মেঘের, নেত্র দ্বয় টলমল করছে,
কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
“খাই তো আমি!”

আবির এবার সরু নেত্রে তাকালো মেঘের চোখের দিকে, নেত্র যুগল টইটম্বুর হয়ে আছে, পল্লব ফেললেই পানি গড়িয়ে পরবে গাল বেয়ে।

আবির দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলা শুরু করলো,
এই কয়দিনে না তুই ঠিক মতো খেয়েছিস আর না তুই ঠিক মতো কোনো কাজ করেছিস। খাওয়া আর ঘুম যে ঠিকমতো করিস নি তা তোকে দেখলেই বুঝা যাচ্ছে। চুল গুলো কতদিন আঁচড়াস না আল্লাহ জানে। এমনকি তুই পড়াশোনাও করিস না। কোচিং, টিউশনের প্রতিটা পরীক্ষায় কম নাম্বার পেয়েছিস

একটু থেমে রাগে কটমট করে বললো,

“তুই কি পড়াশোনা করতে চাচ্ছিস না? তুই পড়াশোনা না করলে বল আমি বাড়ির সবার সাথে কথা বলে নিবো। আজকের পর কোনোদিন তোর বই নিয়ে বসতে হবে না। এরজন্য তোকে কেউ কিচ্ছু বলবে না!”

মেঘের গাল বেয়ে অঝোরে পানি পরছে। কান্নারত কন্ঠে বললো,
“আমি পড়াশোনা করবো!”

আবির পুনরায় গুরুভার কন্ঠে বললো,
“১ সপ্তাহে কোচিং, টিউশনের পরীক্ষায় কম নাম্বার পাওয়ার কারণ কি?”

মেঘ ভণিতা ছাড়ায় বলে উঠলো,
কম পায় নি তো!

আবির দাঁতে দাঁত চেপে, কন্ঠ তিনগুণ ভারি করে বললো,
“আমার সামনে অন্ততপক্ষে মিথ্যা বলিস না। প্রতিটা ৩০ মার্কের পরীক্ষায় তুই ১২/১৫/২০ পেয়েছিস। এগুলো কি খারাপ মার্ক না? এই মার্ক পেলে তুই জীবনে চান্স পাবি?”

মেঘ অকস্মাৎ আবির ভাইয়ের দিকে তাকায়,আওয়াজ বিহীন কান্নায় গাল বেয়ে গলায় এসেছে অশ্রুরা।

ভেজা কন্ঠে অবাক চোখে তাকিয়ে বললো,
“আপনি কিভাবে জানেন?”

আবির উদ্বেলিত ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে অষ্টাদশীর পানে, শক্ত কন্ঠে বললো,

“মেঘ আমি তোকে ছাড় দিয়েছি, ছেড়ে দেয় নি!
তুই কি ভাবছিস তোর কোনো খবর আমার কাছে নাই? তোর কোচিং এর পরিচালক আমার স্কুল ফ্রেন্ড। তাছাড়াও তোর নাম্বারের পাশে গার্ডিয়ানের যে নাম্বার টা দেয়া কোচিং এ সেটাও আমার নাম্বার। তুই পরীক্ষায় কত পাস, তোর কবে কি পরীক্ষা সব মেসেজ যেমন তোর কাছে যায়, তেমনি আমার কাছেও আসে। তোর টিউশনের স্যারও আমার পরিচিত। তুই যেদিকে পা দিবি সবটায় আমার দখলে। তাই মিথ্যা বলা, কোনোকিছু লুকানোর চেষ্টা কখনো করিস না!”

মেঘ আহাম্মকের মতো তাকিয়ে কথা গুলো শুনলো, দুরু দুরু বুক কা*পছে। উদগ্রীব চোখদুটো লম্বাচওড়া মানুষটার মুখের দিকে৷ কান্না থেমে গেছে। গালে পানির দাগ স্পষ্ট । উদ্বেগহীন চাউনী আবির ভাইয়ের।

কয়েক মুহুর্ত চোখাচোখি হলো দুজনের।শেষমেশ আবির ভাই দৃষ্টি ফেরালো।

মেঘ আর কিছু বলার ভাষা খোঁজে পাচ্ছে না। চুপচাপ পা বাড়ায় দরজার দিকে,

আবির সহসা ডাকে,

“দাঁড়া!”

মেঘের পা কাঁপছে,

আবির হাতে একটা শপিং ব্যাগ নিয়ে এগিয়ে আসলো মেঘের কাছে। আবির ভাই কাছাকাছি আসতেই নাকে লাগলো চিরচেনা, পরিচিত গতরের গন্ধ৷ মাত্র শাওয়ার নেয়ায় সে গন্ধটা যেনো অন্যরকম সুন্দর লাগছিলো।

আবির শপিং ব্যাগ এগিয়ে দিলো মেঘের দিকে। আর বললো,
“এগুলো তোর, আর আজকের পর পরীক্ষা, পড়াশোনা, নিজের যত্নে একটুখানি ত্রুটি যদি আমি দেখি তাহলে আর মুখে কিছু বলবো না। যা এখন”

আবির ভাইয়ের ঠান্ডা হুমকিতে কম্পিত হলো অষ্টাদশীর দেহ। আঙ্গুল শুদ্ধ কাঁপছে। কাঁপা হাতে শপিং ব্যাগ নিয়ে ছুটে পালালো রুম থেকে।

নিজের রুমের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো। শপিং ব্যাগটা বিছানার পাশে রেখে বিছানায় শুয়ে পরলো মেঘ। শপিং ব্যাগ টা খুলে দেখার ইচ্ছেও করছে না। ইচ্ছের থেকেও বড় বিষয় সেই শক্তিটায় পাচ্ছে না। বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করতেই চোখের সামনে ভেসে উঠলো আবির ভাইয়ের সেই উন্মুক্ত দেহ, গায়ে চিকচিক করতে থাকা বিন্দু বিন্দু পানি, সেই ধারালো চাউনী। অষ্টাদশীর হৃদয়ে লাগছে বসন্তের হাওয়া।। হৃদপিণ্ডের কম্পনের মাত্রা এতটায় তীব্র যা সহ্য করতে না পেরে মেঘ ডানহাত দিয়ে চেপে ধরেছে। কিন্তু তাতেও যেনো কম্পন থামছে না।
সহসা চোখ মেলে তাকালো মেঘ।

চোখের সামনে থেকে যেনো আবির ভাই সরছেই না। চোখ বন্ধ করলেও আবির ভাইকে দেখছে, চোখ মেলে তাকালেও আবির ভাইকেই দেখছে৷ আর বার বার মাথায় আসছে, আবির ভাইয়ের বলা কথা গুলো,
“মেঘ তোকে ছাড় দিয়েছি, ছেড়ে দেয় নি!”
আবার মনে হচ্ছে,
“তুই যেদিকে পা দিবি সবটায় আমার দখলে”

এসব ভেবেই বারবার কেঁপে উঠছে অষ্টাদশী সাথে এক অন্যরকম অনুভূতি কাজ করছে । প্রতিটা মেয়েই চাই তার প্রিয়জন তাকে আগলে রাখুন, চোখেচোখে রাখুক তেমনি মেঘের কাছে আবির ভাইও প্রিয়মানুষ৷৷ আবির ভাই যদি বোনের নজরেও দেখে তারপরও তে মেঘ কে নিয়ে ভাবে এটা ভেবেই মানসিক শান্তি পাচ্ছে মেয়েটা।
এভাবে চললো ৩০ মিনিটের উপরে৷ তারপর ঘুমের দেশে তলিয়ে গেলো মেঘ।

উঠলো ঠিক সন্ধ্যে নামার আগে। ফ্রেশ হয়ে এসে তৎক্ষনাৎ শপিং ব্যাগটা টেনে আনলো নিজের কাছে৷ শপিং ব্যাগটা উল্টে সবগুলো জিনিস বিছানার উপর ফেললো।

অনেক ছোট ছোট জিনিস এলোমেলো হয়ে পরে আছে বিছানার উপর। কম করে হলেও ১৫-২০ টা হাতের ব্রেসলেট, মুক্তার মালা, কানের দুলের সংখ্যা অগণিত। দেখে মনে হচ্ছে ওনি বেছে দেখার সময় পান নি। যা পেয়েছেন সব নিয়ে নিয়েছেন। বড় একটা শামুকে লিখা, “My Pursuit” আরেকটা শামুকে লিখা, #মাহদিবা_খান_মেঘ এছাড়াও অসংখ্য ছোট ছোট শামুক একটা কাঁচের বয়ম ভরা যার সবগুলোই আবির নিজের হাতে কুড়িয়ে এনেছে। এগুলো বাদের আরও যা যা সাজার জিনিস ছিল, খাবার জিনিস যেগুলোর টেস্ট ভালো এগুলো দিয়েছে মেঘকে।

মেঘ বিস্ময়কর চোখে তাকিয়ে দেখছে সবগুলো জিনিস,
প্রিয়মানুষের নাম অথবা প্রিয়জনের কন্ঠ যেখানে আকাশ সম মন খারাপ দূর করতে সক্ষম সেখানে তার দেয়া সামান্যতম উপহারও অমূল্য সম্পদ ।

আবির ভাই যে তার কথা ভেবে আলাদা ভাবে জিনিস গুলো এনেছেন এতেই যেনো অষ্টাদশী খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেছে।। একটা মুক্তার মালা গলায় পরলো, দুহাতে দুটা ব্রেসলেট, কানেও দুল পরলো এক সেট। ঠোঁটে হালকা গোলাপি কালার লিপস্টিকও দিয়েছে।

উত্তেজিত পায়ে বাহিরে বের হলো নিজের রুম থেকে। সিঁড়ি দিয়ে নামতে যাবে তখন ই চোখ পরে আবির ভাই উঠতেছে সিঁড়ি দিয়ে। হয়তো কোথাও গিয়েছিলেন,

মেঘ সিঁড়ি দিয়ে আর নামে নি ঠায় দাড়িয়ে আছে সেখানে। বুকের ভেতর ধুকপুক করছে।
আবির ভাই কাছাকাছি আসতেই উত্তেজিত কন্ঠে বলে উঠলো,

“আবির ভাই, আমাকে কেমন লাগছে? ”

আবির সিঁড়ি থেকে চোখ তুলে মেঘের দিকে তাকালো, কয়েক সেকেন্ড পর চোখ নামিয়ে বললো,

“ভালো!”

এমন ভাবলেশহীন উত্তরে মেঘের উত্তেজনা মিলিয়ে গেছে, মলিন হয়ে গেলো মুখটা, তবুও কিছুটা স্বাভাবিক স্বরে বললো,

“Thank You Abir Vai”

আবির নিজের মতো রুমের দিকে চলে যায়।

মেঘ কিছুক্ষণ এখানেই দাঁড়িয়ে থাকে আর মনে মনে বলে,

“সুন্দর লাগছে বললে কি আপনার জাত চলে যেতো?
হি*টলার একটা”

(চলবে)

গল্প- আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে
পর্ব- ১৩
লেখিকা- সালমা চৌধুরী

মেঘ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে মনে মনে আবির ভাইকে খুব করে বক*লো। তারপর মন শান্ত করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে চলে গেলো মীমের রুমে। মীম এখনও নিচেই আছে৷ ২-৩ দিনের মধ্যে উপরের রুমে চলে আসবে।

মেঘ মীমের রুমের দরজায় দাঁড়াতেই মীম চোখ তুলে তাকালো। মেঘ কে দেখে উত্তে*জনায় চোখ বড় বড় করে তাকালো সহসা উঠে এলো কাছে,

মীম: আপু মাশাআল্লাহ তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে! মুক্তার মালাতে তোমার মুখ টা চকচক করছে।

মেঘ দাঁত বের করে হাসলো,

মীম তৎক্ষনাৎ ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার থেকে শপিং ব্যাগ বের করে মেঘের হাতে দিলো। মেঘ জিনিস গুলো বের না করেই দেখার চেষ্টা করলো, মীমের জন্য আনা জিনিস মেঘের তিনভাগের এক ভাগ হবে।

মেঘ স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
” সবগুলো সুন্দর হয়েছে । তুই একসেট পড় তারপর আমরা ছবি তুলবো নে”

মীম ও হাসি মুখে রাজি হয়ে গেলো। মীম হালকা সাজুগুজু করে নিলো। তারপর দুই বোন সোফায় বসে ছবি তুলায় ব্যস্ত হলো । ওদের হাসির শব্দ শুনে আদিও রুম থেকে ছুটে এসেছে। আদিকে সহ ৩ ভাই বোন বেশ কিছু ছবি তুললো, তারপর ছবি দেখে খুনসুটি করতে লাগলো, কাকে কোন ছবিতে কেমন লাগছে এসব নিয়ে৷

আবির সিঁড়ি দিয়ে ব্যস্ত পায়ে নামছে। মেঘের চোখে পরতেই অকস্মাৎ হাসি থেমে গেলো মেঘের ।
মাথা নিচু করে বিড়বিড় করে বললো,

“তোরা রুমে গিয়ে পড়তে বস, আমিও রুমে চলে যায়”

আবির দ্রুত পায়ে হেঁটে ডাইনিং টেবিলের কাছে এসে মাকে জিজ্ঞেস করলো,

“আম্মু, রান্না হয়েছে?”

মালিহা খান: হ্যাঁ রান্না শেষের দিকে। খেতে দিব তোকে?

আবির: হ্যাঁ।

ঐদিকে মেঘ চুপিচুপি সিঁড়ি দিয়ে উঠতে থাকে। বিকেলেই আবির ভাই পড়া নিয়ে কথা শুনাইছে।এখনও আড্ডা দিচ্ছে দেখলে নিশ্চিত মা*ইর দিবে। এই ভ*য়ে রুমে যেতে নেয় মেঘ।
৪-৫ টা সিঁড়ি উঠলো কি না!

অকস্মাৎ আবির ডেকে উঠলো,
“মেঘ, এদিকে আয়”

আবির ভাইয়ের কথায় থমকে দাঁড়ায় মেঘ, মনে মনে আল্লাহ আল্লাহ করছে। ধীরগতিতে নিচে নেমে ডাইনিং টেবিলের কাছে আসলো।আবির পকেটে হাত দিয়ে টেবিলে হালকা ধাক্কা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

দাঁড়ানোর স্টাইল দেখে মেঘ পুরাই ফিদা!অষ্টাদশীর মনের ভেতর ধুকপুক শুরু হয়েছে। মাথা নিচু করে দাঁড়ালো মেঘ।

আবির গম্ভীর কন্ঠে বললো,
“খেতে বস!”

মেঘ ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে নরম স্বরে বললো,

“খিদে নেই,পরে… ”

এতটুকু বলতেই চোখ পরলো আবির ভাইয়ের চোখের দিকে,
চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে আছে।

মেঘের হাতপা কাঁপতে শুরু করেছে। আর কিছু বলার সাহস করলো না। চুপচাপ চেয়ার টেনে বসে পরলো।

আবিরও এবার টেবিল ঘুরে নিজের চেয়ার টেনে বসলো। মেঘ মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে আছে৷
আবির একবার মেঘের দিকে তাকাচ্ছে আবার ঘাড় ঘুরিয়ে রান্নাঘরে দেখছে।

মালিহা খান আর হালিমা খান টেবিলে খাবার রাখতে ব্যস্ত হলো।

আবির একটা প্লেটে ভাত দিয়ে এগিয়ে দিলো মেঘের দিকে।

ছোট করে বললো,
“নে খা”

মেঘ কোমল হাতে প্লেট ধরতে হাত বাড়ায় কিন্তু হাত পায়ের সাথে শরীরের কাঁপাকাঁপির তীব্রতায় প্লেট পড়ে যেতে নেয়। আবির ছেড়ে দিতে নিয়েও মেঘের এ অবস্থায় আবার প্লেট ধরতে ব্যস্ত হলো।

রাগান্বিত কন্ঠে বললো,
“তোর শরীরে কতটুকু শক্তি বুঝ এখন”

হাত বাড়িয়ে মেঘের সামনে প্লেট রেখে নিজে খাওয়াতে মনোযোগ দিলো৷

আবির ভাইয়ের কথায় মেঘ মাথা নিচু করে ছোট করে ভেঙছি কাটলো, আর বিড়বিড় করে বললো,

“আপনি সামনে আসলেই তো আমার সব শক্তি বিলীন হয়ে যায়! আমি কি করবো?”

আবির তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো মেঘের দিকে, কন্ঠ দ্বিগুণ ভারি করে বললো,

“তুই কি ভাত খাবি? নাকি থা*প্পড় খাবি?”

মেঘ আবির ভাইয়ের কথায় আঁতকে উঠে, আস্তে আস্তে খাওয়া শুর করে৷ মেঘের এই ধীরস্থির গতিতে খাওয়া দেখে আবির বেশ কয়েকবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়েছে কিন্তু কিছু বলছে না। নিজের খাওয়া শেষ করে বেসিন থেকে হাত ধৌয়ে এসে পুনরায় চেয়ারে বসলো৷

মেঘ তখনও আস্তে আস্তে খাচ্ছিলো কিন্তু আবির ভাইয়ের আবার বসা দেখে বুকটা কেঁ*পে উঠে, খাওয়ার গতিটা কিছুটা বাড়িয়ে দিয়েছে।

আবির বিস্ময়কর চোখে তাকিয়ে আছে অষ্টাদশীর দিকে। গলায় মুক্তার মালাতে জ্বলজ্বল করছে মুখটা । খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে মেঘের খাওয়া। মেঘ একপ্রকার নাকে মুখে খাবার শেষ করছে। কিন্তু শেষ হওয়ার আগেই আবির ভাই আবারও প্লেটে খাবার দিলো,

মেঘ থাপ্প*ড়ের ভয়ে বলতে চেয়েও কিছু বলতে পারছে না।

বাধ্য মেয়ের মতো চুপ করে খাচ্ছে, এদিকে আবির মেঘের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে।

হালিমা খান আর মালিহা খান রান্নাঘরে কাজ করছিলেন কিন্তু আবিরের এমন কর্মকাণ্ডে তারাও যেনো খুশিই হয়েছেন। মেঘ বাড়ির কারো কথা শুনে না। বড় আব্বুর সামনে একটু সম্মানার্থে লক্ষী মেয়ের মতো থাকে। তাছাড়া বাবা মা, কাকামনি, কাকিয়া কারো কথায় শুনে না। তানভির এত বছর ধ*মকে একটু আধটু খাওয়াতো কিন্তু সারাদিন মুখ ভোঁ*তা করে রাখতো। তানভির সারাদিন শেষে রাতের বেলা বোনের জন্য এটা সেটা কিনে এনে বোনের রাগ ভাঙাতো। এতবছর পর, আবির যেনো দ্বিতীয় ব্যক্তি যে মেঘকে শা*সন করে, জো*র করে খাওয়ায় আর মেঘ ও যেনো বাধ্য মেয়ের মতো সবকিছু মেনে নেয়। তানভির ভাইয়ার সামনে তে*জ দেখালেও আবির ভাইয়ের সামনে মেঘ একেবারে নিশ্চল হয়ে যায়।

মেঘের দূর্দ*শা দেখে মালিহা খান রান্নাঘর থেকেই বলছেন,

“মেয়েটাকে ছেড়ে দে বাবা, আর খেতে পারছে না তো!”

আবির গম্ভীর কন্ঠে বললো,
“ও যদি ঠিকমতো খেতো তাহলে আমার এভাবে বসে থেকে ও কে খাওয়াতে হতো না। ”

কেউ আর কোনো কথা বললো না, মেঘ চুপচাপ খাওয়া শেষ করলো। মেঘের খাওয়া শেষ হওয়া মাত্রই আবির উঠে বের হয়ে গেলো বাড়ি থেকে।

মেঘ নিষ্পলক তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ দরজার দিকে। তারপর উঠে নিজের রুমে চলে গেলো। একটু রেস্ট নিয়ে পড়তে বসলো। রাত ১২ টার উপরে বাজে মেঘ পড়তেছে কিন্তু আবির ভাই এখনও আসছে না। চিন্তা লাগছে মেঘের, বারবার উঠে বারান্দায় যাচ্ছে মেঘ।

পেইজঃ Salma Chowdhury – সালমা চৌধুরী
★★★

তানভির ইদানীং খাওয়াদাওয়া বাদ দিয়ে কাজ করছে। মনোনয়নের ফলাফল ঘোষণা করবে আগামীকাল৷ কারো চোখে ঘুম নেই। দল থেকে মনোনয়ন পেয়ে গেলে আলহামদুলিল্লাহ। তারপর প্রচারণা চালাতে হবে। তারা কোনোভাবেই আজ রাতে তানভিরকে ছাড়ছিলো না, গো*পন মিটিং চলছে এমপির বাড়িতে । রাজনৈতিক মিটিং মিছিল থেকে ভাইকে আনতে বাধ্য হয়ে আবিরকেই যেতে হলো । এমপির বাড়ির হলরুমে মিটিং চলছিলো। আবির এমপির বাড়ির সামনে বাইক থামিয়ে হলরুমের দিকে যেতে নিলেই পথ আটকে দাঁড়ায় এমপির মেয়ে।

আবির চোখ গোল গোল করে তাকালো মেয়ের দিকে, রাশভারি কন্ঠে বললো,

“পথ আটকে দাঁড়িয়েছেন কেনো?”

মেয়ে হাসিমুখে উত্তর দিলো,
“আপনাকে আমার অনেক ভালো লাগে ভাইয়া! প্লিজ আপনার নাম্বার টা দিবেন?”

আবির কন্ঠ দ্বিগুণ ভারি করে বললো,
“আপনাকে তানভির বলে নি, আমি একজনকে ভালোবাসি? ”

মেয়ে এই কথা পাত্তায় দিলো না, হাসতে হাসতে উত্তর দিলো,
“আমি তো তানভির ভাইয়ার কথা বিশ্বাস করি নি। ওনি আমার সাথে মজা করছেন!”

আবির গম্ভীর কন্ঠে বললো,
“তানভির সত্যি কথা বলেছে”

মেয়ে এমনভাবে হাসছে যেনো মনে হচ্ছে আবির জোক বলছে।

আবির এবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাগান্বিত কন্ঠে বললো,

“শুনো মেয়ে, এই আমিময় আবির অন্য কারো মালিকানায় বন্দি। আমার জীবনের অস্তিত্ব জুড়ে শুধু তার রাজত্ব চলে। ”

এমপির মেয়ে অবিশ্বাস্য চোখে তাকালো আবিরের দিকে। কোমল কন্ঠে বললো,
“আপনি সত্যি সত্যি কাউকে পছন্দ করেন?”

আবির সহসা বলে উঠলো,

“সে আমার পছন্দ বা ভালো লাগা নয়, সে আমার ভালোবাসা৷ আমি আমৃত্যু ভালোবাসবো তাকে”

মেয়েটার চোখ টলমল করছে,

এটা দেখে আবির এবার বিরক্তি নিয়ে বললো,

“শুনো, আমি শুধুই তোমার মোহ। দুদিন পর সব মোহ কেটে যাবে। আর যে সত্যি সত্যি তোমার জন্য আসবে সে তোমাকে কখনো অজুহাত দিবে না। তার কাছে তোমার প্রায়োরিটি থাকবে সবার প্রথমে। যেমন আমার কাছে সর্বোচ্চ প্রায়োরিটি আমার প্রেয়সীর। আশা করি তুমি আমার কথাগুলো বুঝতে পেরেছো। তাই ভবিষ্যতে এমন কোনো কাজ করবা না বা এমন কোনো কথা বলবা না যে কারণে তোমার এই পা*গলামি গুলো নিয়ে আমার সিরিয়াস হতে হয়। ভালো থেকো।”

গম্ভীর কন্ঠে কথা গুলো বলেই হলরুমের দিকে পা বাড়ায় আবির।

পিছন থেকে এমপির মেয়ে ডেকে উঠলো,
“সরি ভাইয়া, আর কখনো এমন হবে না। প্লিজ আব্বুকে কিছু বলবেন না, প্লিজ!”

আবির মুচকি হাসলো, মেয়েটা যে তার কথা বুঝতে পেরেছে এতেই ভালো লাগলো আবিরের।

হলরুমে ঢুকেই সালাম দিলো এমপি কে। আবিরকে দেখে হ্যান্ডসেক করলেন এমপি।
হাসিমুখে জিজ্ঞেস করালেন,
“কেমন আছো, আবির?”

আবির স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
“জ্বী, আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি কেমন আছেন? ”

এমপি এবার চিন্তিত স্বরে বললেন,
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো তবে নির্বাচন নিয়ে একটু ঝামেলায় আছি। তা তোমার কোনো দরকার ছিল?”

আবির ঠান্ডা কন্ঠে বললো,
“আসলে তানভির কে নিতে এসেছিলাম। এত রাতে কিভাবে যাবে এজন্য। ”

এমপি আবারও হাসিমুখে বললেন,
“মিটিং শেষ, খাওয়াদাওয়া করে চলে যেয়ো! ”

আবির বললো,
“আমরা খাবো না, অনেক রাত হয়ে গেছে। অন্য কোনো সময় খাবো ”

এমপিও আর জোর করলেন না। আবির তানভিরকে নিয়ে বের হলো বাড়ি থেকে। বাইকে আবিরের পিছনে চুপচাপ বসে আছে তানভির ।।

অনেকটা পথ যাওয়ার পর তানভির ভয়ে ভয়ে বললো,

“ভাইয়া এমপির মেয়ের সাথে দেখা হয়ছিলো?”

আবির বললো,
“হ্যাঁ”

তানভির আস্তে আস্তে বললো,
” তাকে কি বুঝাতে পারছো?”

আবির গম্ভীর কন্ঠে বললো,
“আমার বুঝানো তো বুঝিয়েছি কিন্তু সে কতটা বুঝেছে এটায় এখন মূল বিষয় “‘

তানভির এবার অভিযোগের স্বরে বললো,

“”আমি কি করবো বলো ভাইয়া, কোনো দরকারে এমপির সাথে দেখা করা, গুরুত্বপূর্ণ মিটিং সবকিছু এমপির বাড়িতে হয়। আমার দেখা যায় প্রতিদিন অন্ততপক্ষে ২-১ বার এমপির বাড়িতে আসতেই হয়। আর এই মেয়ে যেনো বসেই থাকে কখন আমি আসবো। দেখলেই ছুটে আসে, তোমার কথা জিজ্ঞেস করে শুধু । আমি কতবার বলেছি তুমি একজনকে পছন্দ করো, বিয়ে ঠিক, মেয়ে কোনো কথায় পাত্তা দেয় না। আমি এড়িয়ে গেলেও মেয়ে পথ আটকে দাঁড়ায়। এমপির চোখে এটা পড়লে তো আমাকে কালারিং বানাবে। ভাববে মেয়ের সাথে আমার কিছু চলে। তখন তো ঝামে*লায় আমি ফাঁ*সবো তাই তোমাকে বলেছি। “”

একদমে কথাগুলো বললো তানভির।

আবির স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,

“সমস্যা নাই মেয়ে আশা করি আর কিছু বলবে না তোকে৷ তুই তোর কাজে মনোযোগ দিস। ”

এরমধ্যে বাসায় চলে আসছে দুজন। প্রায় রাত দেড় টায় আবির ভাই বাড়িতে ঢুকলো বাইক নিয়ে পিছনে তানভির ভাইয়া। আবির ভাইকে দেখে মেঘের চিন্তিত মলিন মুখটা তৎক্ষনাৎ জ্বলজ্বল করে উঠেছে। সেই ১২ টা থেকে অপেক্ষা করছে আবির ভাইয়ের জন্য। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের তারা গুনে শেষ করে ফেলছে মনে হয় কিন্তু আবির ভাই আসছিল না। মেঘ দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রফুল্ল মেজাজে দেখতে লাগলো আবির ভাইকে, বাসায় ঢুকার আগ পর্যন্ত যতটা দেখা যাচ্ছিলো৷ তারপর চুপচাপ শুয়ে ঘুমিয়ে পরলো।

★★★★

সকালে আবির রুম থেকে বের হয়ে করিডোর থেকে নিচে তাকালো ডাইনিং টেবিলে মেঘ নেই। এত রাত করে ঘুমানোর জন্য মেঘ সকালে ঘুম থেকে উঠতে পারে নি। আবির মেঘের দরজায় টুকা দিলো। ২ বার শব্দ হতেই ঘুমের মধ্যে টলতে টলতে এসে দরজা খুলে দিলো মেঘ। হাত দিয়ে চোখ কচলাতে কচলাতে তাকালো, সহসা অক্ষি যুগল বিপুল হলো মেঘের,

আবির বিমোহিত লোচনে চেয়ে আছে অষ্টাদশীর মুখের পানে। সদ্য ফুটে উঠা পদ্ম ফুলের ন্যায় সুন্দর লাগছে মেঘকে। খুব করে চাইছে দৃষ্টিতে সরাতে কিন্তু পারছে না।

আবির ভাইকে দেখে মেঘের বুকের ভেতর সেই টিপটিপ আওয়াজ স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। মেঘ মুখ ফঁ*সকে ডেকে উঠলো,

“আবির ভাই”

তৎক্ষনাৎ ঘোর কাটলো আবিরের, কিছুটা নড়েচড়ে উঠলো৷

আবির ঠান্ডা কন্ঠে শুধালো,
“এত রাতে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে ছিলি কেনো?”

আবির ভাইয়ের প্রশ্ন শুনে আঁতকে উঠে মেঘ, অকস্মাৎ চিরচেনা গতরের কাঁপা কাঁপি তীব্র হয়ে উঠে। বুকের ভেতর হাঁ*সফাঁ*স শুরু হয়েছে। হৃদস্পন্দন অনেক বেশি জোড়ালো হলো।

চিবুক নামিয়ে চাপা কন্ঠে বললো,
“রাতে ঘুম ভেঙে গেছিলো! ”

আবির ভ্রু কুঁচকে তাকালো, সহসা গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো,
“ঘুম ভেঙেছিল নাকি ঘুমাইতেই যাস নি, সত্যি করে বল!”

আবির ভাইয়ের সামনে দাঁড়িয়ে মিথ্যা কথা বলার সাহস অষ্টাদশীর এখনও হয়নি।

ভ*য়ে ভ*য়ে বললো,
“ঘুম আসছিলো না!”

আবির এবার ভ্রু নাচিয়ে শুধালো,
“কেনো?”

“মেঘ আর কিছু বলতে পারছে না। মনে হচ্ছে কথা আটকে আসছে গলায়। কোনো আওয়াজ বের হচ্ছে না মুখ থেকে। ”

আবির শ্বাস ঝাড়ে, ভারি স্বরে বললো,
“কি হলো?”

আবির ভাইয়ের ভারি কন্ঠে চুপসে গেলো মেঘ, বিড়বিড় করে বললো,

“আপনার জন্য! ”

আবির তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়, কয়েক মুহুর্ত নিরব থেকে, কন্ঠ তিনগুণ ভারি করে বললো,

“কেনো মেতেছিস ধ্বং*সের খেলায়,
মেঘ, কখনো অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পিছনে ছুটবি না। নিজের লক্ষ্য স্থির না করলে, জীবনে কখনো সফল হতে পারবি না। ”

(চলবে)