গল্প- আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে
পর্ব- ১৪
লেখিকা- সালমা চৌধুরী
আবির ভাইয়ের এত কঠিন কথাগুলো মেঘের মাথার তিনহাত উপর দিয়ে গেলো। কিছুই বুঝতে পারলো না সে। চিবুক নামিয়েছে গলায়। ওষ্ঠ উল্টে, গাল ফুলালো৷ আবির সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে দেখছে।
আবার রা*গান্বিত কন্ঠে আবির বলে উঠলো,
“এখন যে সময়টা কাটাচ্ছিস, সে সময় আর কখনো আসবে না, আ*জেবা*জে চিন্তাভাবনা বাদ দিয়ে পড়াশোনায় মনোযোগ দে। ”
মেঘ এবার বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিলো, ধীর কন্ঠে ডাকলো,
“আবির ভাই!”
সহসা আবিরের তীব্র রা*গ বিলীন হয়ে গেছে, ভ্রু কুঁচকে শান্ত চোখে তাকালো অষ্টাদশীর দিকে।
অতঃপর মৃদুগামী কন্ঠে শুধু বললো,
“হুমমমমমম”
“এই হুম তে যেনো এক আকাশ সম ভালোবাসা, আবেগ, অনুভূতি মিশে আছে। মেঘ অতর্কিতে তাকালো আবির ভাইয়ের অভিমুখে। এই মোহঘোর মেশানো হুমমম শুনার জন্য মেঘের আমৃত্যু আবির ভাইকে ডাকতে ইচ্ছে হচ্ছে৷ মেঘ সারাজীবন আবির ভাইয়ের কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করবে, আবির ভাই প্রতিত্তোরে শুধু হুমমমমম বললেই হবে। ”
এসব ভেবেই অষ্টাদশীর ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠেছে ।
আবির পুনরায় গম্ভীর কন্ঠে বললো,
“কিছু বলবি?”
আবির ভাইয়ের কন্ঠে মেঘের অনিন্দিত কল্পনাদের অবসান হলো। ১ সেকেন্ডেই গায়েব হলো ঠোঁটের কোণের মিষ্টি হাসি। চিবুক নামালো আবির ভাইয়ের মুখের থেকে।
ওষ্ঠপুট নেড়ে নম্রভাবে বললো,
“আবির ভাই আপনি একটু তাড়াতাড়ি বাসায় আসবেন, প্লিজ!”
অকস্মাৎ কথাটা বলে ফেললো মেঘ, কিন্তু এরপরই শুরু হলো কাঁপা কাঁপি, বুকের ধুকপুকানি বেড়ে যাচ্ছে। আল্লাহ জানেন আবির ভাই থা*প্পড় ই দেন কি না। সহসা দু হাত নিজের দুগালে রাখলো মেঘ।
আবির ধম*ক দিতে নিয়ে মেঘের এমন কান্ডে কপাল কুঁচকালো, ঢুক গিলে রাগ গিলে সহসা চাপা কন্ঠে বললো,
“কেনো?”
অষ্টাদশী গালে হাত রেখে কাঁপা-কাঁপা কন্ঠে বললো,
“আপনি বাসায় না ফিরলে আমার ঘুম আসে না! ”
কথাটা বলেই দুচোখ বন্ধ করে, কপাল কুঁচকে দাঁতে দাঁত চেপে ধরলো মেঘ।
আবির প্রশস্ত নেত্রে চাইলো অষ্টাদশী দিকে। মেঘের হালচাল দেখে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠে। কিন্তু অষ্টাদশীর চোখ বন্ধ থাকায় শব্দহীন সেই হাসি দেখতে পেলো না।
আবির নিগূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অষ্টাদশীর দিকে যেনো এই দৃষ্টি সহজে কাটানো সম্ভব না।
কয়েক মুহুর্ত চললো এভাবে। কিছুক্ষণ পর আবিরের ফোনে কল আসায় মনোযোগ নষ্ট হলো। পকেট থেকে ফোন বের করলো, অফিসের কল তৎক্ষনাৎ রিসিভ করলো, ৩০ সেকেন্ড হবে হয়তো, কথা বলে রেখে দিলো।
এতক্ষণে মেঘ অনেকটায় স্বাভাবিক হয়ে গেছে। কিন্তু গাল থেকে হাত নামায় নি এখনো।
আবির কল কেটে পুনরায় শক্ত কন্ঠে বললো,
“আমার তাড়াতাড়ি অফিসে যেতে হবে। আমার খাওয়া শেষ হওয়ার আগে তোকে যেনো খাবার টেবিলে দেখি। ”
এই বলে করিডোরের দিকে পা বাড়ালো আবির।
মেঘ পিছন থেকে কোমল কন্ঠে আবার ডেকে উঠলো,
“আবির ভাই”
আবির সহসা উত্তর দিলো,
“হুমমমম”
এই হুমম টা ছোট্ট মেঘের বুকে বারবার যেনো ধা*ক্কা লাগছে।কোমল কন্ঠে বললো,
“বললেন না তো তাড়াতাড়ি আসবেন কি না?”
আবির ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো, মেঘ সঙ্গে সঙ্গে মাথা নিচু করে ফেললো,
আবির কিছুটা গম্ভীর কন্ঠে বললো,
“আসতে পারি যদি তুই আমার কথা মানিস!”
আর কিছু না বলে দ্রুত পায়ে নেমে গেলো নিচে। আবির ভাই এত সহজে মেনে নিয়েছে ভেবেই মেঘ খুশিতে আ*ত্মহারা হয়ে যাচ্ছে। দ্রুত ফ্রেশ হয়ে চুল গুলো ঠিকঠাক করে, হুটোপুটি করে নিচে নামতে লাগলো।
হাসিমুখেই এসে বসলো আবির ভাইয়ের বিপরীতে।একবার দেখলো আবির ভাইকে, প্লেটের দিকেও তাকালো, কিন্তু ততক্ষণে আবির ভাইয়ের খাওয়া শেষের দিকে। মেঘ খাওয়া শুরু করতে করতে আবির ভাই খাওয়া শেষ করে উঠে ফ্রেশ হয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে চলে যাচ্ছে।
মেঘ এক মুহুর্ত তাকিয়ে রইলো আবির ভাইয়ের দিকে তারপর স্বাভাবিক হয়ে খেতে শুরু করলো৷
আবির ভাইয়ের এত কথার মধ্যে “হুমমমমম” টায় যেনো বার বার কানে বাজছে মেঘের। সবগুলো কথায় মনে পরছে। খাওয়া শেষ করে রুমে গিয়ে শুয়ে শুয়ে আবির ভাইয়ের কথা ভাবছে।মেঘ মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন করছে, সেই প্রশ্নের উত্তর নিজেই দিচ্ছে।সবশেষে সব প্রশ্নের একটায় উত্তর পেলো।।
“আবির ভাই চান আমি ভালোভাবে পড়াশোনা করি তারমানে এতেই আবির ভাই খুশি হবেন। আজ থেকে আমি সিরিয়াসলি পড়াশোনা করবো। তারপর দেখবো আবির ভাই আমার সাথে ভালো ভাবে কথা বলে কি না। ”
কিছুক্ষণ শুয়ে থেকে সব ভেবে সহসা উঠে পড়তে বসলো। মেঘ সবসময় জোরে পড়ে৷ মেঘ পড়লে করিডোর থেকে তো শুনা যায় ই পাশাপাশি তানভির বা আবিরের রুম থেকেও মোটামুটি শুনা যায় ।গোসল,নামাজ, কোচিং, টিউশন সবকিছু সময়মতো করছে মেঘ যেনো আবির ভাই আর রা*গ দেখাতে না পারে। কি সব ধ্বং*সের কথা বললো এসব কথা কঠিন কথা যেনো আর না শুনতে হয়। আবির ভাই যেনো সর্বদা কোমল, ভালোবাসা মিশ্রিত কন্ঠে “হুমমমম” বলে৷ আর কিছুই বলতে হবে না।
পেইজ: Salma Chowdhury – সালমা চৌধুরী (scsalma90)
★★★★
এদিকে মনোনয়নের ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছে। তানভির দের এমপি দলীয় প্রতীকে মনোনীত হয়েছেন। পার্টি অফিস থেকে শুরু করে এমপির বাড়ি পর্যন্ত হৈচৈ শুরু হয়েছে। নি*ষেধা*জ্ঞা অমান্য করে সব গণহারে মিছিল দিচ্ছে। প্রথমবারের মতো মনোনীত হয়েছেন এমপি৷ তানভির সহ, সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, সাধারণ সদস্যরা মিষ্টি খাওয়াচ্ছেন সবাইকে। এক পর্যায়ে এমপির বাড়িতে গেলো তানভির সহ আরও দুজন -চারজন।।।
এমপির মেয়ে হাসিমুখে তানভিরের সামনে এসে দাঁড়ালো। বাবা মনোনয়ন পেয়েছে এতে মেয়ের খুশির সীমা নেই। কিন্তু তানভির মেয়েকে দেখে কিছুটা ঘাবড়ে গেছে। আবির ভাইয়া গতরাতে বুঝিয়ে গেলো তারপর ও যদি মেয়ে পা*গলামিই করে আর সেটা এমপির নজরে পরলে তানভির শেষ।
তানভির কিছুটা ভীতু গলায় বললো,
“কিছু বলবেন?”
এমপির মেয়ে হাসিমুখে উত্তর দিলো,
“হ্যাঁ ভাইয়া। ”
তানভির কপাল কুঁচকে বললো,
“কি?”
এমপির মেয়ে হাসি থামিয়ে কিছুটা গম্ভীর কন্ঠে বললো,
“I am Sorry Vaiya.. আমি আপনাকে এই কিছুদিন অনেক জ্বালিয়েছি। আপনি এতবার বলেছেন আবির ভাইয়ের গার্লফ্রেন্ড আছে কিন্তু আমি বিশ্বাস করি নি। গতকাল আবির ভাইয়াও বলে গেছেন ওনার জীবনে অন্য কেউ আছে। এজন্য আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আর কোনোদিন ওনার কথা জিজ্ঞেস করবো না আপনাকে। আপনাকেও আর বিরক্ত করবো না কখনো। আপনি অনেক ভালো। আমি চাই আপনি আব্বুর জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করুন, যাতে আব্বু এমপি হতে পারেন। ”
তানভিরের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো।মনে মনে বলছে,
“বাহ! ভাইয়া, তোমার ২ মিনিটের কথায় আমার ১৫ দিনের সমস্যা সমাধান করে দিলে। You are great bro”
হাসিমুখে বললো,
“তুমি যে বুঝতে পারছো এতেই খুশি। ”
এইটুকু বলে মেয়ের থেকে বিদায় নিয়ে এমপির সাথে দেখা করতে চলে গেলো।
পেইজ: Salma Chowdhury – সালমা চৌধুরী (scsalma90)
★★★★
বর্ষাকাল শুরু হয়ে গেছে কিন্তু এখনও বৃষ্টি শুরু হয় নি। আজ বিকেল থেকেই আকাশে মেঘের গর্জন৷ মেঘ কোচিং শেষে বাসায় এসেছে। মেঘের গর্জনের শব্দে পড়তে বসতে ইচ্ছে করছে না তাই বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে৷ গোধূলি বেলায় টিপটিপ বৃষ্টি পড়া শুরু হয়েছে। মেঘ বেলকনিতে দাঁড়িয়ে রাস্তায় মানুষের ছুটোছুটি দেখছে।। সবাই ছুটছে নিজস্ব গন্তব্যে। মেঘ বেলকনি থেকে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি ছোঁয়ার চেষ্টা করছে। বৃষ্টির ফোঁটার স্পর্শে মেঘের সমস্ত অনুভূতিরা যেনো অবশ হয়ে যাচ্ছে, হাত বৃষ্টিতে রেখেই কল্পনার জগতে বিচরণ করছে মেঘ। বৃষ্টি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টির ছিটে ফোটা মেঘের চোখে মুখে পরতেই হুঁশ ফিরলো অষ্টাদশীর। বেলকনি থেকে রুমে চলে গেলো। টাওয়েল দিয়ে হাত মুখ মুছে বিছানায় বসলো।
মোবাইলের ডাটা অন করতেই একটা নোটিফিকেশন আসছে। ফেসবুকে ঢুকতেই সামনে আসলো আবির ভাইয়ের পোস্ট। অফিসের বেলকনি থেকে তুলা হাতের ছবি। ফোঁটায় ফোঁটায় বৃষ্টির পানি জমে আছে হাতে।সাথে বৃষ্টি নিয়ে সুন্দর একটা ক্যাপশন ও দিয়েছেন। মেঘ মনোযোগ দিয়ে ছবিটা দেখছে। অনুভূতিরা যেনো নাড়াচাড়া দিয়ে উঠেছে মনের ভিতর৷
“আবির ভাইও বৃষ্টিতে হাত ভিজিয়েছে। তারমানে আবির ভাইয়েরও বৃষ্টি ভালোলাগে। ভাবতেই লাজুক হাসলো মেঘ। নিজের ভালোলাগা গুলো যদি ভালোবাসার মানুষের সাথে মিলে যায় তাহলে আর কি লাগে!”
সন্ধ্যার পর ঘন্টাদুয়েক পড়াশোনা করলো মেঘ বৃষ্টি বেশি থাকার কারণে জান্নাত আপু আসবেন না বলেছেন। বাড়ির কর্তারা বাড়ি ফিরে এসেছেন সেই বৃষ্টি শুরুর দিকে৷ গাড়িতে চলাচল করায় বৃষ্টি ছুঁতেই পারেন নি ওনাদের। তানভির ও হৈহল্লা করে বাড়ি ফিরেছে ঘন্টাখানেক আগে। আকলিমা খান ডাকছেন সবাইকে খাবার খাওয়ার জন্য। মেঘ নেমেই একবার দেখলো ডাইনিং টেবিলের দিকে, আবির ভাই এখনও ফিরেন নি বাকি সবাই আছেন। মেঘ পা বাড়ালো টেবিলের দিকে তখনই কাকভেজা হয়ে ফিরেছে আবির।
মাথা থেকে পা পর্যন্ত ভিজে একাকার অবস্থা। মেঘ চেয়ারের হাতল ধরে দাঁড়িয়ে পরলো,
আবিরের এই অবস্থা দেখে মোজাম্মেল খান বলে উঠলেন,
“কিরে, এই বৃষ্টির মধ্যে আসতে গেলি কেন,৷ বৃষ্টি কমলে আসতে পারতি ”
আবির চুল ঝাড়তে ঝাড়তে উত্তর দিলো,
“অফিসে বসে থাকতে ইচ্ছে করছিলো না। ”
সিঁড়ির দিকে যাচ্ছে। মালিহা খান ডেকে বললেন,
“তুই কি এখন খাবি, নাকি পরে খাবি বাবা?”
আবির সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে উত্তর দিলো,
“৫ মিনিটে আসছি আমি! ”
৫ মিনিটের মধ্যে ফ্রেশ হয়ে একটা হালকা গোলাপি রঙের, শর্ট হাতার ট্রিশার্ট সাথে কালো ট্রাউজার পরে নিচে নামলো। ততক্ষণে মোজাম্মেল খান, আলী আহমদ খান চলে গেছেন। তানভিরের খাওয়াও শেষের দিকে।
আবির চেয়ার টেনে বসতে নিলে মেঘের নজর পরে আবির ভাইয়ের দিকে। এই প্রথম বার আবির ভাই শর্ট হাতার ট্রিশার্ট পড়েছে৷ তাও আবার সাদা, কালো রঙ বাদে। মেঘ শব্দহীন হেসে উঠলো, দৃষ্টি তার আবির ভাইতে নিবদ্ধ ।
আবির বসে বললো,
“Congratulation Tanvir, Go ahead. Best of luck. ”
মেঘের দৃষ্টি এবার তানভির ভাইয়ার দিকে যায়। তানভির ভাইয়া খুশিতে গদগদ হয়ে উত্তর দিলো,
“Thank you so much Vaiya.”
আবির এবার কিছুটা চিন্তিত স্বরে বললো,
“ঐ বিষয়টা কি সমাধান হয়ছে?”
এবারও তানভির হাসিমুখে জবাব দিলো,
“জ্বী ভাইয়া। আমার কাছেও মাফ চেয়েছে। ”
মেঘ মনোযোগ দিয়ে দুই ভাইয়ের কথোপকথন শুনছিলো, সহসা উত্তেজিত কন্ঠে বলে উঠলো,
“কি হয়েছে?”
আবির মেঘের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলো,
“তানভিরদের নেতা দলীয় মনোনয়ন পেয়েছে!”
মেঘও এবার খুশিমনে ভাইকে অভিনন্দন জানায়,সাথে মীম আর আদিও অভিনন্দন জানায়।
মীম মজার ছলেই বলে উঠলো,
“ভাইয়া আমাদের ট্রিট দিবা না?”
তানভির বললো,
“কি ট্রিট চাস বল!”
মেঘ তৎক্ষনাৎ উত্তর দিলো,
“এখন ট্রিট লাগবে না, জিতলে পরে বড় করে ট্রিট খাবো। ”
তানভির বললো,
“ঠিক আছে, আজকে তাহলে আমার পক্ষ থেকে তোদের নুডলস ট্রিট দিব রাত ১০ টায়। ”
মীম বলে উঠলো,
“তুমি রান্না করবা ভাইয়া? ”
তানভির দাঁত বের করে হাসলো, আর বললো,
“হ্যাঁ, আমিই রান্না করবো সাথে ভাইয়া থাকবে!”
আবির অকস্মাৎ কপাল কুঁচকে, ঠাট্টার স্বরে জবাব দিলো,
“ইসসস, তুই ট্রিট দিবি আমি কেন হেল্প করবো? আনন্দ যেমন তুই করে আসছিস, এখন কষ্ট টাও তোকেই করতে হবে। ”
তানভির ভ্রু গুটিয়ে এক পলক তাকালো ভাইয়ার দিকে, তারপর বললো,
“ঠিক আছে, ঠিক আছে।৷ আমিই করবো। তোমাদের আমার রুমে দাওয়াত রাত ১০ টায়। ”
মেঘ,মীম আর আদি একসাথে বলে উঠে,
“ইয়াহু”
তানভির আঁতকে উঠে বলে,
‘এই থাম থাম, চুপ কর তোরা । বড় আব্বু আর আব্বু শুনলে সব আনন্দ মাটি চা*পা দিয়ে দিবে। ”
তিনজনই থেমে গেলো। তানভির খাওয়া শেষ করে উঠে গেলো। মেঘ খাচ্ছে সাথে আবির ভাইকেও একটু পর পর দেখছে। কয়েকবার দেখার পর হঠাৎ আবির চোখ তুলে তাকাতেই চোখাচোখি হলো দুজনের । মেঘ তখনও শান্ত চোখে তাকিয়ে আছে। মেঘের চাউনি দেখে আবির কপাল কুঁচকালো কিন্তু মেঘের সে দিকে নজর নেই। মীম আর আদি খাচ্ছে তাই আবির কোনো কথা না বলে টানা ২-৩ ভ্রু নাচালো, এতক্ষণে মেঘের আবেশ কাটে। লাজুক হেসে মাথা নিচু করে ফেলে। মেঘ মাথা নিচু করেই খাবার শেষ করলো।
রুমে গিয়ে আবারও পড়তে বসলো মেঘ। আবির খাওয়া শেষ করে কিছুক্ষণ মা, মামনি আর কাকিয়ার সাথে গল্প করলো। এত রাতে বাড়ি ফেরায় তাদের সাথে ঠিকমতো কথায় হয় না ছেলেটার। গল্প শেষে নিজের রুমে যাওয়ার পথে কানে ভেসে আসে মেঘের পড়ার শব্দ । মুচকি হেসে রুমে চলে গেলো।
পেইজ: Salma Chowdhury – সালমা চৌধুরী (scsalma90)
★★★★
রাত ১০ টার পর তানভিরের রুমে সামনে হাজির হলো মেঘ।বিছানার উপর বসে আছে মীম আর আদি। তানভির খাবার পরিবেশন করছে। মেঘ ঢুকতে নিলেই তানভির বলে উঠে,
“বনু বসার আগে ভাইয়াকে একটু ডেকে আসবি প্লিজ! আর হ্যাঁ জোরে ডাকিস না।৷ আব্বুর কানে গেলে খবর আছে আমার!”
মেঘ মলিন হাসলো। মনের ভেতর ধুকপুক শুরু হয়ে যাচ্ছে মেঘের। গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গেলো আবির ভাইয়ের রুমের দিকে। দরজা খুলায় ছিল। মেঘ দরজা থেকে উঁকি দিলো ভিতরে। কিন্তু রুমে কেউ নেই। ধীর পায়ে ভিতরে ঢুকে বেলকনির দিকে পা বাড়ালো মেঘ। আবির ভাই গ্রিলে হাত রেখে তাকিয়ে আছে আকাশের পানে। বৃষ্টি কম তবে আকাশে মেঘের গর্জন হচ্ছে আর কিছুক্ষণ পর পর বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে ।
মেঘের খুব ইচ্ছে করছে আবির ভাইয়ের পাশে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি উপভোগ করবে। তাই চুপচাপ আবির ভাইয়ের পাশে দাঁড়িয়ে পরেছে। একটু পর পর বিদ্যুৎ চমকানো দেখে আঁতকে উঠছে মেঘ। দিনের বেলা বৃষ্টি তার যতই পছন্দ হোক না কেনো, রাতের বেলা বৃষ্টি হলে মেঘ কখনো বেলকনিতে বের হয় না।। শব্দের মাত্রা তীব্র হলে কানে আঙুল দিয়ে ঘুমায়। আজ সাহস করে রাত ১০ টায় আবির ভাইয়ের পাশে তো দাঁড়িয়েছে কিন্তু বিদ্যুৎ চমকানো দেখে বার বার বুক কাঁপছে অষ্টাদশীর,
আবির তখনও দুর্বোধ্য দৃষ্টিতে চেয়ে আছে অসীম দূরত্বে। সহসা বলে উঠলো,
“মনে জোর নেই তাহলে এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো?”
মেঘ আবির ভাইয়ের দিকে তাকালো কিন্তু আবির ভাইয়ের অভিব্যক্তি বুঝা গেলো না। তাকিয়ে আছে আকাশের পানে।
মেঘ ভাবছে, “আবির ভাইয়ের কি সব দিকে চোখ আছে? ”
মেঘ আস্তে আস্তে বললো,
“ভাইয়া ডাকতে বলছে আপনাকে। ”
আবির স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
“তুই যা, আমি আসছি!”
মেঘ রুমে ঢুকতে নিতেই ঠা*টার শব্দ হয় সাথে বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় চিৎকার দিয়ে উঠলো।
আবির দু কদম এগিয়ে সহসা মেঘের হাত ঝাপ্টে ধরে বলে,
“কি হয়ছে? ভয় পাইছিস?”
আবির পুনরায় বললো,
“তুই ভিতরে ঢুক আমি আছি, ভয় পাইস না।”
মেঘ দু’হাতে আঁকড়ে ধরলো আবির ভাইয়ের হাত, গুটি গুটি পায়ে ভেতরে ঢুকলো। আবির একহাতে বিছানার উপর থেকে ফোন টা নিয়ে ফ্ল্যাশ জ্বালালো।
মেঘ তখনও শক্ত করে ধরে আছে আবির ভাইয়ের হাত। ফোনের আলোতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে মেঘের ভ*য়ার্ত মুখমন্ডল, কপাল কুঁচকে চোখ বন্ধ করে রেখেছে।
আবির কোমল কন্ঠে বললো,
“কিছু হয় নি! তাকা”
মেঘ আস্তে আস্তে চোখ পিটপিট করে তাকালো। চোখ পরলো আবির ভাইয়ের হাতের দিকে। দুহাতে খামছে ধরে আছে আবির ভাইয়ের হাত। তৎক্ষনাৎ ছেড়ে দিলো হাত। ততক্ষণে বিদ্যুৎ চলে এসেছে। মেঘ আর আবির ভাইয়ের দিকে তাকালো না ছুটে চলে গেলো রুম থেকে। ধীরপায়ে ঢুকলো তানভির ভাইয়ার রুমে। বিছানার এককোনায় বসে পড়লো মাথা নিচু করে।
১ মিনিটের মধ্যে আবির ও রুমে ঢুকলো। তানভির সবাইকে খাবার দিতে ব্যস্ত হলো- নুডলস, চা,বিস্কুট, সাথে মুড়ি মাখিয়েছে।
আবির তানভিরের দিকে তাকিয়ে ঠাট্টার স্বরে বললো,
“বাহ! এত আয়োজন? সাবাশ!”
তানভির হাসিমুখে বললো,
“খেতে ভালো না হলে কেউ অভিযোগ করবা না!”
সবাই খাওয়া শুরু করলো। মেঘের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। কোনো ভাবেই খেতে পারছে না। কোনোরকমে চোখ তুলে তাকালো আবির ভাইয়ের হাতের দিকে, দেখার চেষ্টা করলো, খামছি টা কতটা লেগেছে। আবির ভাই হাত ঘুরাতেই চোখে পরলো সেই দাগ। তিন আঙুলের নখের চাপে চামড়া কেটে রক্ত জমাট বেঁধে গেছে। মেঘ আবির ভাইয়ের হাতের অবস্থা দেখে ভ্রু কুঁচকালো। টলমল করছে চোখ, নিজের প্রতি খুব রা*গ হচ্ছে, বার বার দীর্ঘশ্বাস ফেলছে।
আদি আবির ভাইয়ের হাত দেখে চিৎকার দিয়ে উঠলো,
“ভাইয়া তোমার হাতে কি হয়েছে?”
সবার নজর পরলো আবিরের হাতের দিকে।
আবির একপলক দেখলো মেঘকে, তারপর স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
“কিছু হয় নি! কোথায় লেগে কেটে গেছে!”
(চলবে)
গল্প- আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে
পর্ব- ১৫
লেখিকা- সালমা চৌধুরী
তানভিরের রুম থেকে খেয়ে আবির চলে গেছে নিজের রুমে। ১ মিনিটের মধ্যে মেঘও বের হয়ে গেছে, কোনো দিক না তাকিয়ে চলে গেলো আবির ভাইয়ের রুমে। দরজার বাহির থেকে ধীর কন্ঠে ডাকলো,
“আবির ভাই..”
কোনো সারা নেই। দ্বিতীয় বার আর একটু জোরে ডাকলো,
“আবির ভাই..”
আবির বললো,
“ভেতর আয়”
আবির আধশোয়া অবস্থায় ফোনে কি যেনো করছে। ফ্যানের বাতাসে আবিরের চুলগুলো এলোমেলো উড়ছে। মেঘ আবির ভাইয়ের পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে চুপচাপ চেয়ে আছে আবির ভাইয়ের হাতের পানে।
আবির অকস্মাৎ বলে উঠলো,
“কিছু বলবি?”
মেঘ কন্ঠ খাদে নামিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
“Sorry আবির ভাই, এতটা লেগে যাবে বুঝতে পারি নি। ”
আবির স্বাভাবিক কন্ঠেই উত্তর দিলো,
“আমি কি কিছু বলেছি তোকে?”
মেঘ পুনরায় বলে উঠলো,
“বেশি ব্যথা লাগছে? মলম লাগিয়েছেন?”
আবির গম্ভীর কন্ঠে উত্তর দিলো,
“না! কিছু লাগাতে হবে না।”
মেঘ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে, শক্ত কন্ঠে বলে উঠলো,
“লাগাতে হবে !”
মেঘের শক্ত কন্ঠের কথা শুনে আবির মোবাইল থেকে চোখ সরিয়ে অষ্টাদশীর পানে তাকালো৷ মেঘের চোখে মুখে অধিকারবোধ স্পষ্ট প্রতীয়মান হচ্ছে।
আবির নিরুদ্বেগ কন্ঠে বললো,
“তাহলে তুই ই লাগিয়ে দে!”
এতক্ষণ শক্ত থাকলেও এই কথা শুনার পর মেঘ আর শক্ত থাকতে পারলো না। বুকের ভেতর অনুভূতিরা ঢোল বাজিয়ে নৃত্য করছে। হাতপায়ের কম্পন তীব্র হতে শুরু করেছে৷ আবির ভাইকে মলম লাগিয়ে দিবে এটা ভাবতেই বার বার শিউরে উঠছে অষ্টাদশী।
আবির পুনরায় শক্ত কন্ঠে বললো,
“হয় নিজে লাগিয়ে দিয়ে যা, না হয় চুপচাপ ঘুমাতে যাহ! আমি লাগাতে পারবো না। ”
আশপাশে তাকাচ্ছে মেঘ। চোখ পরলো ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখা মলমের দিকে।মলম টা হাতে নিয়ে আবির ভাইয়ের কাছাকাছি বসলো৷ হৃদপিণ্ড ছুটছে এদিক সেদিক। আঙুল কাঁপছে অষ্টাদশীর। শীতল হস্তে, আলতোভাবে মলম ছুঁয়ালো আবির ভাইয়ের হাতের সেই কাটা অংশে। হালকা কাঁ*পলো আবিরের হাত।মেঘ পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে মলম লাগিয়ে দিচ্ছে।
আবির ভ্রু গুটিয়ে, শান্ত কন্ঠে বললো,
“ভাবিস না তোকে দিয়ে খাটাচ্ছি আমি!
যে ভুল করবে, শাস্তি তো তাকেই পেতে হবে!”
মেঘ মনে মনে ভাবছে,
“এরকম হাজারটা শা*স্তি পেতেও আমি রাজি!”
আবির অভিভূতের ন্যায় নিষ্পলক চেয়ে আছে মেঘের দিকে । আবির ভাইয়ের দৃষ্টি বুঝতে পেরে মেঘ চিবুক নামালো, কোনোদিকে না তাকিয়ে কোনোরকমে মলম লাগিয়ে, চুপচাপ রুম থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। যেনো আর কিছুক্ষণ আবির ভাইয়ের কাছাকাছি থাকলে, নিজেকে বাঁ*চাতে পারবে না।
আবির একবার হাতের দিকে দেখলো তারপর অষ্টাদশীর যাওয়ার পানে তাকিয়ে মৃদু হাসলো।
পেইজ: Salma Chowdhury – সালমা চৌধুরী
★★★★
সকাল বিকাল মেঘের নজর শুধু আবির ভাইয়ের হাতের দিকে। কেটে গেলো কয়েকদিন। খান বাড়ির প্রতিটা মানুষ ব্যস্ত নিজের কাজে। ইকবাল খান সিলেট থেকে রাতে ফিরেছেন। সেই খুশিতে সবাই জড়ো হয়েছে ড্রয়িং রুমে সাথে বাহারি খাবারের মেলা৷ সবাই আড্ডা আর খওয়ায় ব্যস্ত থাকলেও বরাবরের মতোই আবির ব্যস্ত ছিল নিজের কাজে। সামনের মাসের ১ তারিখ নিজের অফিস শুরু হবে, তাই সবকিছু গুছাতে হচ্ছে । সাথে আবিরের বেস্ট ফ্রেন্ড রাকিব আর রাসেল তো আছেই।
রাকিব আর আবির প্রাইমারি স্কুল থেকে বেস্ট ফ্রেন্ড তারপর তাদের জীবনে আসে রাসেল। বর্তমানে তারা ৩ জনের জীবন এক সুতোয় বাঁধা। তাই কোম্পানিও শুরু করছে একসাথে। এছাড়াও আরও ২ বন্ধু আছে আবিরের, মোবারক এবং লিমন৷ এই ৫ জন প্রতি শুক্রবার একসাথে আড্ডা দেয় মাঝে মাঝে তানভিরও যুক্ত হয় তাদের সাথে। তবে সব বন্ধুর মধ্যেও একজন স্পেশাল ফ্রেন্ড থাকে যে সবকিছু জানে, সেটা হলো রাকিব।
সবার মাঝে আবির নেই বলে ইকবাল খান কয়েকবার আবিরকে কল দিচ্ছেন কিন্তু আবির কল রিসিভ করছে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাসায় ঢুকলো আবির।
পকেট থেকে ফোন বের করতে করতে বললো,
“সরি,কাকামনি! বাইকে ছিলাম তাই রিসিভ করতে পারি নি।”
ইকবাল খান একগাল হেসে বললেন,
“সমস্যা নাই, আয় বোস এসে। ”
আবির ভাই আসতেই মেঘ সোফা থেকে উঠে জায়গা দেয় আবির ভাইকে। আবির এসে মেঘের জায়গায় বসে স্বাভাবিক কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
“কেমন আছো কাকামনি? কাজ ঠিকঠাক হয়েছে?”
ইকবাল খান হাসিমুখে উত্তর দিলেন,
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। সব ঠিকঠাক করে আসছি। আশা করি ২ মাসের মধ্যে আর সিলেটের পা দিতে হবে না।”
ইকবাল খান পুনরায় মজার ছলেই বললেন,
“তোর কোম্পানি কবে ওপেন করবি?আমাদেরকে দাওয়াত দিবি না?”
আবির মলিন হেসে উত্তর দিলো,
“ইনশাআল্লাহ আগামী মাসের ১ তারিখ! তোমাদের সবার জন্য কার্ড রেডি করছি খুব শীঘ্রই পেয়ে যাবে!”
ইকবাল খান অবাক চোখে তাকিয়ে বললেন,
“কার্ড? এত VIP আমি?”
আবির এবার স্ব শব্দে হেসো উত্তর দিলো,
“কার্ড স্পেশালি আব্বু আর চাচ্চুর জন্য , তুমি একা মিস যাবে কেনো তাই তোমাকেও দিবো!”
তারপর তারা দুজন ব্যস্ত হলো অফিসের আলোচনায়। এদিকে মেঘ বিমোহিত নয়নে আবির ভাইকে দেখছে আর ভাবছে,
“একটা মানুষ এত সুন্দর করে কিভাবে কথা বলে?”
আলী আহমদ খান ও মোজাম্মেল খান হাজির হলো এই আড্ডায় । তাই মেঘ নিজের রুমে গিয়ে পড়তে বসেছে।
পেইজ: Salma Chowdhury – সালমা চৌধুরী ( scsalma90)
★★★★
শুক্রবার মানেই খান বাড়িতে হৈচৈ শুরু হয়ে যায়। প্রতি শুক্রবারের মতো আজও বাড়িতে বেশ পদের রান্না করা হচ্ছে। মেঘ ঘুম থেকে উঠে নামাজ পড়ে ঘন্টা দুয়েক পড়াশোনা করেছে। নিচে নেমে মীম আর আদির সাথে আড্ডাও দিতে দিতে নাস্তাও করে এসেছে। কিন্তু আবির আর তানভিরের খবর নেই।
তানভিরদের এমপি মনোনয়ন পাওয়ার পর থেকে তানভিরের ব্যস্ততা বেড়ে গেছে তিনগুন। তানভির ছোট থেকেই ভালো ছবি তুলতে পারে। রাজনীতি যেমন তার পছন্দ তেমনি ছবি তুলাও তার পছন্দের একটা কাজ। এমপি যেই না শুনেছে তানভির ভালো ছবি তুলতে পারে সেই থেকে দায়িত্ব দিয়ে দিয়েছে তানভিরের উপর। মনোনয়ন পাওয়ার পর একটা নির্দিষ্ট তারিখ পর্যন্ত এমপি কোনে জনসমাবেশ করতে পারবে না৷ তাই এমপির পক্ষ থেকে সভাপতি, সহ সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, যুগ্ম সম্পাদক থেকে শুরু করে প্রত্যেকে মিলে নির্দিষ্ট জায়গায় জনসমাবেশের আয়োজন করে এবং এমপি বাড়ি থেকে ভিডিপ কনফারেন্সের মাধ্যমে তাদের সঙ্গে কথা বলেন। এই টোটাল দায়িত্ব পরে গেছে তানভিরের উপর। সারাদিন শেষে বাকিদের থেকে ছবি সংগ্রহ৷ ইডিটিং৷ ভিডিও ক্রিয়েট সকল দায়িত্ব তানভিরের। সব কাজ শেষ করে ফিরতে ফিরতে রাত ১২-১ টা বেজে যায়। মাঝে মাঝে সময় পেলে একটু আগে চলে আসে। পুরোটায় এখন এমপির মতামতের উপর নির্ভর । ইদানীং আবির ৮-৯ টার মধ্যে বাড়িতে ফিরে আসে, সময় সুযোগ মিললে তানভির বাসায় এসে খেয়ে আবিরের বাইক নিয়ে আবার বের হয়। রাত করে ফেরার কারণ সকালে উঠতে একটু দেরি হয়ে যায়। আজ যেহেতু শুক্রবার তাই রিলাক্সে ঘুমাচ্ছে দুই ভাই।
কিন্তু এদিকে মেঘ ছটফট করছে। ১০ টার উপরে বেজে গেছে এখনও আবির ভাই কেনো উঠছে না তা ভেবেই কুল কিনারা পাচ্ছে না। আবির যে বৃহস্পতিবার রাতে ঘুমায় না তা তো অষ্টাদশী জানেই না। বৃহস্পতিবার রাত শুধু আবিরের শোকের রাত৷ ভোরবেলা নামাজ পরে ঘুমায়, উঠে ১২ টার দিকে। তারপর গোসল করে নামাজে যায়।
অষ্টাদশীর কোমল মনকে কোনোভাবেই মানাতে পারছে না। তাই এতকিছু না ভেবে ছুটে গেলো আবির ভাইকে ডাকতে৷ শান্ত হস্তে দরজা ধাক্কা দিলো, সহসা খুলে গেলো দরজা। জানালার পর্দা টানা, রুমে আলোর পরিমাণ সীমিত, ফ্যানের বাতাসে পর্দা উড়ছে এদিক সেদিক। মেঘ প্রথমেই বিছানার দিকে তাকায়৷ বার বার পর্দা সরে যাওয়ায় বাহির থেকে আসা সূর্যের আলো চোখে মুখে পরছে আবিরের।
মেঘ আপাদমস্তক দেখলো। আবির গভীর ঘুমে মগ্ন, উন্মুক্ত শরীর, পেট পর্যন্ত পাতলা কাঁথা দিয়ে ঢাকা। চোখ সরালো মেঘ, দৃষ্টি পরলো আবির ভাইয়ের তামাটে চেহারায়। কি অপরূপ সেই মুখমণ্ডল!
সবাই ফর্সা ছেলেদের পিছনে ছুটে আর মেঘ যেনো এই তা*মাটে চেহারা,গুরু-গম্ভীর, অনুভূতিহীন, হি*ট লার স্বভাবের লোকটার প্রতি মাত্রাতিরিক্ত দূর্বল হয়ে যাচ্ছে৷ মেঘের হৃদপিণ্ডের পিটপিট শব্দ যেন জানান দিচ্ছে,
“সামনে আগালে তোর মৃ*ত্যু নিশ্চিত! ”
তবুও মেঘ পা টিপে টিপে আগাচ্ছে আবির ভাইয়ের কাছে যেনো নুপুরের শব্দ না হয়। আবির ভাইয়ের কাছাকাছি গিয়ে থামে। আবির অবসন্ন চেহারাটা গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখছে মেঘ৷ ঘুমন্ত অবস্থাতেও আবির ভাইয়ের সৌন্দর্য যেনো একটুখানিও কমে নি বরং তা বেড়ে গেছে বহুগুণ । গাল ভর্তি ছাপ দাঁড়ি, সামনের দিকের লম্বা চুলগুলো ফ্যানের বাতাসে বারবার কপালে এসে পরছে। মেঘের মনে হচ্ছে, “আবির ভাইয়ের থেকে সুদর্শন পুরুষ দ্বিতীয়টি নেই। ”
মেঘের হৃদপিণ্ড ছুটছে দ্বিকবিদিক । নিশ্বাসের শব্দ জোড়ালো হলো।ফ্যানের নিচে দাঁড়িয়েও ঘামতে শুরু করেছে মেঘ। ভাবছে চলে যাবে, কিন্তু এই শোভিত পুরুষকে রেখে যেতে পারছে না। মেঘের ইচ্ছে করছে সারাজীবন এভাবেই আবির ভাইকে দেখতে।
মেঘ দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি পাচ্ছে না। তাই আবির ভাইয়ের পাশে বিছানাতেই বসে পরেছে। আবির তখনও ঘুমের দেশে নিমজ্জিত। অষ্টাদশী অভিনিবিষ্টের ন্যায় চেয়ে আছে৷
সব বাঁধা পেরিয়ে, দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মেঘ আস্তে করে ডাকলো,
“আবির ভাই”
ঘুমন্ত আবিরের থেকে কোনো উত্তর আসে নি৷ মেঘের খুব ইচ্ছে করছে আবির ভাইকে ছুঁয়ে দিতে।
মেঘ আরেকটু এগিয়ে আবিরের কাছাকাছি বসলো। কাঁপা কাঁপা হাত ছুঁয়ালো আবির ভাইয়ের গাল ভর্তি ছোট ছোট দাঁড়িতে। সঙ্গে সঙ্গে শিউরে উঠলো সমস্ত শরীর। বোধশক্তি হওয়ার পর জীবনে প্রথমবার মেঘ নিজের ইচ্ছেতে কোনো পুরুষকে ছুঁয়েছে , যেই ছোঁয়ায় মিশে আছে ভালোবাসা, অন্যরকম অনুভূতি জাগিয়ে দিচ্ছে অষ্টাদশীর হৃদয়ে।
সহসা আবির ডান হাতে চেপে ধরলো নিজের গালে রাখা অষ্টাদশীর হাত।মেঘের হাত কাঁপছে, দুনিয়া ঘুরছে, বক্ষে উথাল- পাতাল ঢেউ। বরফের ন্যায় জমে যাচ্ছে সম্পূর্ণ শরীর৷
আবির ঘুমের মধ্যেই মেঘের আঙুলের ভাঁজে আঙুল ডোবায়। গাল থেকে তুলে নিজের হাতের মুঠোয় নেয়। আবিরের হাতের মধ্যে মেঘের আঙুলগুলো কাঁপছে দেখে আবির আর একটু শক্ত করে চেপে ধরলো।
মেঘের ভয়ে ভয়ে তাকিয়েছে আবির ভাইয়ের মুখের দিকে। আবির তখনও চোখ বন্ধ করেই শুয়ে আছে,
অকস্মাৎ আবির আধোঘুমন্ত কন্ঠে বলে উঠলো,
“আমি ছুঁয়ে দিলে সামলাতে পারবি তো মেঘ?”
মেঘ দুর্বোধ্য দৃষ্টিতে চেয়ে আছে আবির ভাইয়ের মুখবিবরে আর ভাবছে,
“এখনও আধোঘুমে আছে মানুষটা, কিভাবে বুঝলো আমি এটা?”
আবির একহাতে কাঁথাটা পেট থেকে টেনে বুকে তুললো। আরেকহাতে তখনও মেঘের হাত চেপে ধরে আছে৷
আবির পুনরায় কন্ঠ ভারী করে বললো,
“এভাবে হুটহাট আমার রুমে আসবি না, যা তা হয়ে যাবে তখন আমায় কিছু বলতে পারবি না!”
সঙ্গে সঙ্গে শক্ত করে ঝাপটে ধরা হাতটাও ছেড়ে দেয়।
“মেঘ নির্বোধের মতো চেয়ে আছে আবির ভাইয়ের দিকে। আবির ভাইয়ের কথাটা বুঝার চেষ্টা করছে কিন্তু মোটা মাথায় কিছুই ঢুকছে না। রুমে আসলে কি এমন হবে?”
আবির পুনরায় বললো,
“এভাবে চেয়ে থাকিস না, আমার শরম করে”
মেঘ সহসা চোখ গোল গোল করে তাকায়, কিন্তু আবির ভাইয়ের অভিব্যক্তি বুঝার ক্ষমতা তার এখনও হয় নি। মেঘ চুপচাপ রুম থেকে বের হয়ে গেছে।
পেইজ: Salma Chowdhury – সালমা চৌধুরী (scsalma90)
★★★★
ঘন্টাখানেক পর আবির উঠে শাওয়ার নিয়ে কালো পাঞ্জাবি সাথে সাদা প্যান্ট পরে নামাজের উদ্দেশ্যে নামছে। ইকবাল খানও রেডি হয়ে বেরিয়েছেন রুম থেকে।
ইকবাল খান আবিরকে দেখে ডাকলো,
“কিরে নামাজে যাচ্ছিস?”
আবির ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে উত্তর দিলো,
“হ্যাঁ, তুমি যাবে না?”
“হ্যাঁ যাবে তো, আদি আসছে ওকে নিয়ে যাই। দাঁড়া একটু! ” ইকবাল খান বললেন।
মেঘ সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে আবির ভাইকে দেখে ঠয় দাড়িয়ে পরে, সকালের ঘটনা মনে পরে যায় মেঘের। কালো পাঞ্জাবিতে মা*রাত্মক সুন্দর লাগছে আবির ভাইকে।
নিজেকে নিজে সান্ত্বনা দিলো,
“কিছু সুন্দর জিনিস দূর থেকে দেখায় শ্রেয়, কাছে গেলে জ্ব*লসে যাবি!”
একপা একপা করে পিছন দিকে উঠছে। আবিরের দৃষ্টি পরে সিঁড়িতে থাকা অষ্টাদশীর দিকে। মেঘের কান্ডে আবির কপাল কুঁচকালো , তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে বুঝার চেষ্টা করলো।। আবির ভাইয়ের তাকানো দেখে মেঘ সহসা ছুটে রুমে চলে যায়।
আবির, আদি আর ইকবাল খানও নামাজের জন্য চলে গেছেন। তানভিরও রেডি হয়ে দ্রুত বেরিয়ে যায়। এই সুযোগে মেঘ খেতে আসে।
পেইজ: Salma Chowdhury – সালমা চৌধুরী (scsalma90)
★★★★
৩ টায় মেঘের পরীক্ষা আছে টিউশনে। তাই রেডি হয়ে একেবারে বের হয়েছে রুম থেকে। পার্কিং এ গাড়ি আছে কিন্তু ড্রাইভার আংকেল নেই দেখে ফোন বের করলো কল দেয়ার জন্য। তখনি আবির আঙুলে চাবি ঘুরাতে ঘুরাতে বের হলো।
মেঘ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে আছে আবির ভাইয়ের দিকে।
আবির বাইকের দিকে যেতে যেতে বললো,
“আংকেল ছুটিতে আছে৷ কল দিয়ে লাভ নেই। ”
মেঘ নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কি করবে বুঝতে পারছে না, রিক্সা দিয়ে চলে যাবে নাকি আবির ভাই নিয়ে যাবে কিছুই বুঝতে পারছে না।
আবির বাইক টেনে মেঘের সামনে এসে থামলো,
ছোট করে বললো,
“উঠ”
মেঘ লাজুক হেসে বাইকে উঠলো, আজ আর তাকে দ্বিতীয় বার বলতে হলো না, বাইকে বসেই আবির ভাইয়ের কাঁধে হাত রাখলো।
বাইক থামলো টিউশনের সামনে মেঘ নেমেই ভেতরে ঢুকে গেলো, আসার পথে একটা কথাও বলে নি কেউ। কে ই বা বলবে, মেঘ তে সকালের ঘটনা নিয়েই এখনও আপসেট আর অন্যদিকে আবির তো স্ব ইচ্ছেতে কখনো কথায় বলে না।
মেঘ ভিতরে ঢুকে বন্যর পাশে বসলো। দুই বান্ধবীর ২-১ টা কথা বলতে বলতে আবির ঢুকলো ভিতরে। স্যারকে সালাম দিতেই স্যার তাকালো আবিরের দিকে,
কয়েক মুহুর্ত পর স্যার বলে উঠলেন,
“তুই আবির না?”
আবির হাসিমুখে উত্তর দিলো,
“জ্বী৷ কেমন আছেন স্যার?”
স্যার হাসিমুখে উত্তর দিলো,
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। তোকে কতবছর পর দেখলাম৷ দেশে আসলি কবে?”
“২০-২২ দিন হবে, বাসার সবাই কেমন আছে স্যার?”
“আলহামদুলিল্লাহ সবাই ভালো আছে। মেঘ ই তো তোর বোন? ”
“জ্বি স্যার, চাচাতো বোন!” আবির উত্তর দিলো।
স্যার হাসিমুখে বললেন,
“ও তো পড়াশোনায় খুব ভালো, মনোযোগী কিন্তু মাঝে মাঝে একটু ফাঁকি দেয়। তুই একটু নজর রাখিস। ”
“জ্বি স্যার, আমি আসি তাহলে । আসসালামু আলাইকুম স্যার।”
মেঘ আর বন্যা এতক্ষণ অবাক চোখে তাকিয়ে আবির ভাই আর স্যারের কথোপকথন শুনছিলো। এক বান্ধবী আরেক বান্ধবীর দিকে তাকাচ্ছে বার বার৷ এরমধ্যে স্যার পরীক্ষা শুরু করে দিয়েছেন।
১ ঘন্টা পরীক্ষা দিয়ে বের হলো দুই বান্ধবী। আবির ভাই রাস্তার পাশে বাইকে বসে ফোন চাপতেছিলেন। মেঘকে দেখেই বাইক থেকে নেমে দাঁড়ালেন। মেঘ বন্যার থেকে বিদায় নিয়ে আবির ভাইয়ের কাছে এসে প্রশ্ন করলো,
“আপনি যান নি?”
আবির সবসময়ের মতো গম্ভীর কন্ঠে উত্তর দিলো,
“না”
আবির পুনরায় স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
“কিছু খাবি?”
মেঘ মাথা দিয়ে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালো৷
আবির বললো,
“কি?”
মেঘ ভয়ে ভয়ে বললো,
“বক*বেন না তো?”
আবির গুরুভার কন্ঠে বললো,
“কি খাবি বল”
মেঘ কন্ঠ খাদে নামিয়ে বললো,
“ফুচকা”
আবির সহসা বললো,
“উঠ ”
বাইক স্টার্ট দিলো থামালো এসে একটা ফুচকার দোকানের সামনে। মেঘ নেমে সাইডে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। আবির বাইক থেকে নেমে হেলমেট খুলতেই, দূর থেকে রাকিব দৌড়ে এসে ঝাপটে ধরে আবিরকে।
আকস্মিক ঘটনায় কিছুটা নড়ে উঠে আবির৷
রাকিব ঠাট্টার স্বরে বললো,
“কিরে বন্ধু, এই জীবনে তো তোকে ফুচকার দোকানে দেখি নি৷ তা হঠাৎ এখানে কেনো? সে আসবে নাকি?”
আবির চোখে ইশারা দিতেই রাকিবের চোখ পরে মেঘের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে আবিরকে ছেড়ে কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড়ায় ।
রাকিব হাসিমুখে জিজ্ঞেস করে,
“কেমন আছেন ভা… সরি আপু?”
মেঘ আবির ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক কন্ঠে উত্তর দিলো,
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো,আপনি কেমন আছেন?”
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আমি রাকিব। তোমার আবির ভাইয়ের ছোটবেলার বেস্ট ফ্রেন্ড। তুমি মেঘ তাই তো?”
মেঘ উত্তর দিলো,” জ্বি”
” ফুচকা খেতে এসেছো?” প্রশ্ন করলো রাকিব ভাইয়া।
মেঘ পুনরায় ছোট করে বললো,
“জ্বি।”
রাকিব এবার হাসিমুখে বললো,
“আজ আমার পক্ষ থেকে তোমার জন্য ফুচকা ট্রিট। আনলিমিটেড ফুচকা খেতে পারো!”
মেঘ কিছু বলার আগেই আবির রাগান্বিত কন্ঠে বললো,
“তোর ট্রিট দিতে হবে না। আনলিমিটেড ফুচকা খাওয়ানোর ক্ষ*মতা আমার আছে। ”
রাকিব স্ব শব্দে হেসে বললো,
“আরে বন্ধু রা*গ করছিস কেন, তুই তো খাওয়াবিই সারা….”
এতটুকু বলতেই আবির রাকিবের মুখ চেপে ধরে। রা*গে ফুঁসতে ফুঁসতে বলে,
“নিজের কাজে যা৷ আমার টা আমাকে বুঝে নিতে দে!”
রাকিব কিছুটা আহত হলো৷ মেঘের থেকে বিদায় নিয়ে যাওয়ার সময় আবিরের দিকে তাকিয়ে বললো,
“সন্ধ্যার পর চলে আসিস ”
আবির সহসা বলে উঠলো, ‘ঠিক আছে”।
(চলবে)