গল্প- আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে
পর্ব- ১৮
লেখিকা- সালমা চৌধুরী
জান্নাত হাসিমুখে উত্তর দিলো,
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আপনাকে তো বাসায় দেখিই না ভাইয়া। ”
আবির কিছুটা শক্ত কন্ঠে বললো,
“বাসায় ফিরতে একটু দেরি হয়ে যায়। তোমার পড়াতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো?”
জান্নাত শান্ত কন্ঠে বলল,
“না,না ভাইয়া৷ কোনো সমস্যা হচ্ছে না।”
আবির এক পলক মেঘের দিকে চেয়ে পুনরায় জান্নাতের দিকে তাকালো, নিরেট কন্ঠে শুধালো,
“ও পড়ে তো ঠিকমতো?”
জান্নাত এবার মেঘের দিকে চেয়ে হাসিমুখে বললো,
“হ্যাঁ ভাইয়া।মেঘ অনেক মনোযোগী এবং খুব মেধাবী । আপনি চিন্তা করবেন না প্লিজ”
আবির ছোট করে শুধালো,
“খেয়েছো কিছু? বসো খাবার খেয়ে যেয়ো। ”
জান্নাত তৎক্ষনাৎ বললেন,
“নাস্তা করেছি ভাইয়া, আর কিছু খাবো না। আসি তাহলে আজ ”
ওদের কথোপকথন শুনার জন্য মেঘ কিছুটা হেঁটে সামনের দিকে এগিয়ে আসলো।
আবির স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
“সাবধানে যেয়ো। ”
জান্নাত একগাল হেসে বললো,
“আপনি আমাদের বাসায় বেড়াতে যাইয়েন। ”
আবির হালকা হেসে উত্তর দিলো,
“সময় পেলে অবশ্যই যাবো। ”
প্রথমের কথা গুলো ঠিকমতো না শুনলেও শেষ কথাগুলো মেঘ স্পষ্ট শুনতে পেয়েছে। জান্নাত মেঘকে আল্লাহ হাফেজ বলে বেড়িয়ে গেছে বাসা থেকে৷ এদিকে মেঘের বুক কেঁ*পে উঠলো। মেঘ যেনো নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। আনমনে ভাবছে,
“জান্নাত আপু আবির ভাইকে বাসায় যেতে বলছেন? আবির ভাইও আবার হাসিমুখে বলছেন সময় পেলে যাবে। কই আবির ভাই তো আমার সাথে এত ভালো আচরণ করেন না, ওনি তো আমার সাথে আজ পর্যন্ত হাসিমুখে কথায় বলেন নি। তাছাড়া জান্নাত আপুকে তো তানভির ভাইয়া নিয়ে আসছিলেন। তাহলে আবির ভাই কিভাবে চিনেন?”
মেঘ আহ*ত চোখে তাকিয়ে রইলো আবির ভাইয়ের পানে।
আবির দরজা বন্ধ করে সিঁড়ির দিকে যেতে নিলে সহসা পথ আটকে সামনে দাঁড়ালো অষ্টাদশী। আজ আর তার শরীর কাঁপছে না, হাত-পা রিমরিম করছে না কারণ হাজারটা প্রশ্ন তার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে যেগুলোর উত্তর শুধু আবির ভাই জানেন৷ ড্রয়িং রুমের কোথাও কেউ নেই। জান্নাত পড়িয়ে গেলেই মূলত খাওয়াদাওয়ার পর্ব শুরু হয়। তাই এ সময় সবাই যে যার রুমেই থাকেন ।
অষ্টাদশীর পথ আটকানো দেখে আবির বিস্মিত চোখে চাইলো। মেঘের এলোমেলো চুল, চোখের কাজল কিছুটা লেপ্টে রয়েছে, শুষ্ক ওষ্ঠদ্বয় তিরতির করে কাঁপছে । এ অবস্থায় মেঘকে দেখে ঘোর লেগে যাচ্ছে আবিরের। হাজারও নিষিদ্ধ চিন্তা জেগে উঠছে আবিরের মনে ।
টেনে হিঁচড়ে কোনোরকমে নিজেকে সামলে ঢুক গিলে কিছুটা শক্ত কন্ঠে বললো,
“পথ আটকে দাঁড়িয়েছিস কেন?”
মেঘের সরু নাক ক্রমেক্রমে ফুঁসছে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে, ধৈর্যহীন কন্ঠে শুধালো ,
“আপনি জান্নাত আপুকে চিনেন?”
আবির উপর নিচ মাথা নাড়ে শুধু ।
মেঘ দ্বিতীয়বার গম্ভীর কন্ঠে বললো,
ওনাকে আপনি কিভাবে চিনেন?
আবির রাশভারি কন্ঠে বললো,
” পরিচিত…..! ”
মেঘ ভেতর ভেতর ক্ষিপ্ত হলো। অষ্টাদশীর চেহারার পরতে পরতে ঘনিয়ে আসে মেঘ। এক সমুদ্র অভিযোগ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। একে গায়ের রঙ ফর্সা তার উপর রাগে গালদুটো লাল হয়ে আছে মেঘের। দেখে মনে হচ্ছে টুকা দিলেই গাল বেয়ে রক্ত পরবে।
রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে মেঘ বললো,
” শুধু পরিচিত হলেই কি মানুষ নির্দ্বিধায় বাসায় যেতে বলে?”
“তুই আমার কাছে কৈফিয়ত চাচ্ছিস, মেঘ?”
চোয়াল শক্ত করে প্রশ্ন করলো আবির।
মেঘ আজ আবিরের শক্ত কন্ঠ শুনে আঁতকে উঠছে না। কারণ অষ্টাদশীর আজ মাত্রাতিরিক্ত রাগ হচ্ছে । অতিরিক্ত রাগলে মানুষের বোধশক্তি হারিয়ে যায়। তাছাড়া মেয়েমানুষের রাগ তো লিমিট ছাড়া, যখন রাগ হয় তখন দুনিয়ার কোনোকিছু দিয়েও শান্ত করানো যায় না,যতক্ষণ না নিজে থেকে শান্ত হয়৷
মেঘের নাকের ডগায় ঘাম জমে আছে। কপাল ঘামতে শুরু করেছে ধীরে ধীরে। নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো অষ্টাদশী ।
কয়েক মুহুর্ত পর নিরেট কন্ঠে শুধালো,
“আপনি ওনার বাসায় যাবেন?”
আবির তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো, গুরুভার কন্ঠে বললো,
“প্রয়োজন হলে যাব ”
মেঘ চোখ গোল গোল করে চাইলো৷ মনের ভেতর হাজারটা প্রশ্ন ছুটছে এদিক সেদিক ।
মেঘের নিরবতা দেখে আবির গুরুভার কন্ঠে জবাব দিলো,
” তোকে আপাতত এসব নিয়ে ভাবতে হবে না।পড়াশোনায় মনোযোগ দে। তুই এখনও অনেক ছোট। সময় হলে সব জানতে পারবি ”
মেঘ দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাগান্বিত কন্ঠে বলা শুরু করলো,
“আপনারা যা খুশি করতে পারেন যা খুশি বলতে পারেন তাতে কিছু হয় না আমি কিছু বলতে গেলেই ছোট, বয়স হয় নি এরকম করেন।”
আবির দাঁতে দাঁত চেপে গম্ভীর কন্ঠে বললো,
“মেঘ, আস্তে কথা বল। বাড়ির মানুষ শুনবে। তাছাড়া জান্নাতের ব্যাপারে আমি আপাতত কোনো কথা বলতে চাচ্ছি না। ”
মেঘ রা*গে ফুঁস*তে ফুঁ*সতে বললো,
“তা কেনো বলবেন, আপনার যত রাগ আর তেজ তো শুধু আমার উপরই দেখান।৷ কোথাকার কোন রাস্তার মেয়ের জন্য আপনার এত দরদ। ”
আবিরের চোখ লাল হয়ে গেছে, দাঁত কটমট করছে, কন্ঠ তিনগুণ ভারি করে ধমকে উঠলো,
“জান্নাত কোথাকার কোন মেয়ে না । ওকে সম্মান দিয়ে কথা বলবি। ফারদার যদি তাকে রাস্তার মেয়ে বলিস তাহলে এর ফল ভালো হবে না বলে রাখলাম ”
তৎক্ষনাৎ মেঘের অভিব্যক্তি বদলে গেলো, সহসা মনে পরে গেলো আবির ভাইয়ের ফোনে দেখা ওয়ালপেপারের ছবিটার কথা। তারমানে কি আবির ভাইয়ের প্রিয়ত…….. আর কিছু ভাবতে পারছে না মেঘ। চোখে সর্ষে ফুল দেখছে। হৃদয় ভেঙে খন্ড খন্ড হয়ে যাচ্ছে ।
আবির কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই মেঘ শক্ত কন্ঠে বলে উঠলো,
“আপনি কি ওনাকে ভালোবা…..”
এতটুকু বলার পরই আবির ডান হাতে মেঘের বাম গালে শক্তপোক্ত চড় বসিয়ে দিলো। অকস্মাৎ মেঘের মুখ বন্ধ হয়ে গেলো, কথাটা শেষও করতে পারলো না। মেঘের সমগ্র পৃথিবী ঘুরছে, বিপুল চোখে চেয়ে আছে আবিরের দিকে। স্তব্ধ হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো সেখানে, একটা বারের জন্য গালে হাতও রাখলো না । অনুভূতিরা যেনো বিলীন হয়ে গেছে। রক্তাভ চক্ষুদ্বয় আবির ভাইয়ের চোখে নিবদ্ধ ।
আবির ভীষণ চটে গেছে, ডান হাতে নিজের চুল মুষ্টিবদ্ধ করে ধরলো, রাগান্বিত কন্ঠে বললো,
“যা বুঝার তা বুঝিস না, আজাইরা বিষয় নিয়ে পরে থাকিস৷ ”
মেঘ নির্বাক চোখে তাকিয়ে আছে আবির ভাইয়ের দিকে। আবির সঙ্গে সঙ্গে পা পিছিয়ে ঘুরে গেলো। দরজার পাশে দেয়ালে স্ব বেগে ঘুষি বসিয়ে দিলো। তা দেখে কেঁপে উঠে অষ্টাদশী। বাম হাত দিয়ে মেইন গেইট খুলে বেরিয়ে গেলো বাসা থেকে।
মেঘ ঠায় দাঁড়িয়ে আছে সেখানে, দীর্ঘ সময় পর চোখ বেয়ে গরিয়ে পরে দুফোঁটা অশ্রু । ততক্ষণে মালিহা খান বেড়িয়ে আসলেন রুম থেকে।
মালিহা মেঘকে দরজা মুখী দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে প্রশ্ন করলেন,
“কিরে এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো? ক্ষুধা লাগছে? ”
মেঘ কিছুটা নড়ে উঠলো, বড় আম্মুর দিকে না ঘুরেই
শীতল কন্ঠে বললো,
“না”
তারপর পড়ার রুমে থেকে বই গুলো নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগলো। আকলিমা খান মেঘকে যেতে দেখে ডাকলেন,
“মেঘ, খাবি না? ”
মেঘ গম্ভীর স্বরে বললো,
“ক্ষুধা নেই! ”
মেঘ রুমে এসে হাতের বই খাতাগুলো ছুঁড়ে ফেলে দেয় বিছানায়,তারপর দরজা আঁটকে নিজেও বিছানায় লুটিয়ে পরে।মেঘের বুক ভে*ঙে আসে আকাশ সম ক*ষ্টে। চোখ বেয়ে অনর্গল নোনাজল গড়িয়ে পরছে। নিজেকে সান্ত্বনা দেয়ার কোনো ভাষা নেই অষ্টাদশীর।
যেই আবির ভাইয়ের থাপ্পড়ের ভয়ে গত একটা মাস আবির ভাইয়ের চোখে চোখ রেখে কথা বলে নি, আবির ভাই যা বলেছে চুপচাপ মেনে নিয়েছে, নিজের রাগ, জেদ আর অভিমান আবির ভাইয়ের পদতলে চাপা দিয়ে দিয়েছিলো। সেই আবির ভাই কি না ১ মাস হওয়ার আগেই তাকে থাপ্প*ড় মা*রলো। তাও আবার কোথাকার কোন মেয়ের জন্য!
এত শক্তপোক্ত চড়ে এখনও মুখের বাম পাশে ব্যথা করছে মেঘের। শুয়া থেকে উঠে আয়নার সামনে দাঁড়ালো। বামগালে পাঁচ আঙুলের দাগ হয়ে আছে, রক্তবর্ণের সেই পাংশু। নিজের বিধ্বস্ত ধৃষ্টতা দেখে আঁ*তকে উঠে মেঘ। মুখমন্ডলের ন্যায় অষ্টাদশীর কোমল হৃদয় টাকেও চূর্ণবিচূর্ণ করে ফেলেছেন অনুভূতিহীন, কাটখোট্টা আবির ভাই। মেঘ আয়নার দিকে তাকিয়ে রইলো কয়েক মুহুর্ত, আনমনে কি ভাবছে কে জানে!
যে অষ্টাদশীর মনটাকে কাঁচের ভাঙা গ্লাসের মতো, হাজারও টুকরোতে পরিণত করেছে।
কোথায় সে দুরূহ পুরুষ?
পেইজঃ Salma Chowdhury – সালমা চৌধুরী (scsalma90)
★★★★
আবির বাসা থেকে বেরিয়ে বাইক স্টার্ট দিলো৷ কি কাগজ নিতে এসেছিল সেসব ভুলে গেলো। স্প্রীডে বাইক চালিয়ে আসলো নিজের অফিসে।
কোনোদিক না তাকিয়ে সোজা নিজের রুমে চলে গেলো।
কিছুক্ষণ পর রাসেল একজন স্টাফকে জিজ্ঞেস করলো,
“আবির স্যার কি এখনও আসে নি?”
স্টাফ সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলো,
“স্যার তো কিছুক্ষণ আগেই চলে এসেছেন। ”
“কি বলো, আবির আসছে অথচ আমায় ফাইল দিলো না!”
চিন্তিত স্বরে বললো রাসেল।
তৎক্ষনাৎ হাঁটা দেয় আবিরের রুমের দিকে। আবিরের রুমের দরজা ধাক্কা দিতেই চোখে পরলো বিধ্বস্ত রুম। যেনো কিছুক্ষণের মধ্যে ঘূর্ণিঝড় বয়ে গেছে এই রুমটার উপর দিয়ে। হেলমেট ভেঙে পরে আছে ফ্লোরে। কাগজপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরে আছে সম্পূর্ণ রুমে। সেগুলো এলোমেলো উড়ছে ফ্যানের বাতাসে,চেয়ার পরে আছে কাত হয়ে। আবিরকে দেখা গেলো না।আবিরকে দেখার জন্য রাসেল দরজায় দাঁড়িয়েই উঁকি দিলো ভেতরে।
জানালার পাশের দেয়ালে আবির অহিতেচ্ছা, অনবরত ডান হাতে ঘুষি দিয়েই যাচ্ছে। বিষ্ময় চোখে চাইলো রাসেল, এক সেকেন্ড দেরি না করে ছুটে গেলো আবিরের কাছে, চেষ্টা করলো আবিরকে থামানোর কিন্তু ব্য*র্থ হলো। ৬ ফুট লম্বা, শক্তিশালী, সুঠাম দেহি আবিরের সাথে ৫ ফিট ৭” লম্বা রাসেলের শক্তি কোনোমতেই কুলালো না। চেষ্টায় ব্য*র্থ হওয়ার দরজা পর্যন্ত দৌড়ে যায় রাসেল আর চিৎকার দিয়ে ডাকে,
“রাকিব,এদিকে আয়!”
ভয়ংকর সেই পুরুষালী চিৎকারের শব্দে রাকিব সহসা দৌড়ে আসে, সাথে ছুটে আসে অফিসের কিছু স্টাফ আর কিছু কর্মচারী ।
রাকিব আর রাসেল টেনে হিঁচড়ে আবিরকে দেয়াল থেকে দূরে সরিয়ে আনলো৷ আবিরের চোখে-মুখে ক্রো*ধ স্পষ্ট প্রতীয়মান হচ্ছে। শ্যামবর্ণের মুখবিবর পরিবর্তন হলো ঘুটঘুটে আঁধারে । উষ্কখুষ্ক চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে, ঘামে ভেজা কপালে লেপ্টে আছে সামনের দিকের চুলগুলো। পরনের সাদা শার্ট ঘামে ভিজে লেপ্টে আছে গায়ের সাথে। রুমে ফুল স্প্রীডে ফ্যান চলছে সাথে এসি অন থাকা স্বত্তেও আবিরকে দেখে মনে হচ্ছে সবেমাত্র ৪০°সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ফুটবল খেলে এসেছে।
রাকিব মাটিতে কাত করা চেয়ারটা এক হাতে তুলে আবিরকে জোর করে বসালো। আবিরের হাতের দিকে চাইলো,
নিরবচ্ছিন্ন ঘু*ষির কারণে আঙুলের, হাতের কয়েক জায়গায় কেটে র*ক্ত পরছে । রাকিব তৎক্ষনাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো দেয়ালে। সাদা রঙের দেয়ালের কিছুটা অংশ বেড়ে র*ক্ত গড়িয়ে পরেছে ফ্লোরে।
রাকিব আঁতকে উঠে, একপ্রকার চিৎকার দিয়ে বললো,
“রাসেল ফাস্ট এইড বক্স বের কর তাড়াতাড়ি। ”
আবির এখনও জোর করছে চেয়ার থেকে উঠার। কিন্তু রাকিব আবিরের পেট বরাবর শক্ত করে ঝাপ্টে ধরে পীতাভ কন্ঠে আর্তনাদ করে উঠলো৷
তপ্ত স্বরে শুধালো,
“কি হয়ছে তোর? এমন করছিস কেন আবির?”
আবির সহসা চিৎকার দিয়ে বললো,
“ছাড় আমাকে!”
আবিরের রুষ্ট কন্ঠের চিৎকারে কিছুটা নড়ে উঠলো রাকিব কিন্তু তারপরও ছাড়লো না।
পুনরায় শান্ত কন্ঠে বললো,
“কেনো পাগলামি করছিস আবির? রা*গটা একটু কমা প্লিজ। কি হয়েছে বল আমায়!”
আবির দ্বিতীয় বার চেয়ার থেকে উঠার চেষ্টা করে কিন্তু এবার রাকিব আর একটু শক্ত করে আবিরকে চেপে ধরে। নিরেট কন্ঠে বললো,
“মাথা ঠান্ডা কর আবির। ”
আবির ব্যর্থ হয়ে বসে পরলো চেয়ারে৷ আবিরের র*ক্তবর্ণের চোখ বেড়ে গরিয়ে পরলো ক্রো*ধ মিশ্রিত এক ফোটা জল।
রাসেল ফাস্ট এইড বক্স নিয়ে আসছে। দরজায় দাঁড়ানো দু একজন প্রশ্ন করছে,
“কি হয়ছে স্যার?”
“কি হয়েছে স্যারের?”
“কোনো সমস্যা, স্যার?”
আবির তাদের প্রশ্নে বিরক্ত হয়ে অগ্নিদৃষ্টিতে চাইলো। সঙ্গে সঙ্গে নিরব হয়ে গেলো জনতা। রাকিব রাসেলের দিকে চেয়ে শান্ত কন্ঠে বললো,
“তুই সবাইকে নিয়ে ঐদিকে যা। আমি আছি আবিরের কাছে। ”
রাসেল চিন্তিত স্বরে বললো,
“কোনো প্রয়োজন হলে ডাকিস আমায়”
রাকিব শুধু মাথা দুলালো।
রাসেল ১ সেকেন্ড দেরি না করে সবাইকে নিয়ে যার যার কাজে চলে গেলো।
আবির চলন্ত ফ্যানের দিকে মুখ তুলে চেয়ে আছে।
সবাই চলে যাওয়ার পর রাকিব গম্ভীর কন্ঠে বললো,
“দেখ হাতটার কি অবস্থা করেছিস!”
আবির এক পলক হাতের দিকে চেয়ে ক্রো*ধিত কন্ঠে বললো,
“আমি মস্ত বড় ভুল অপরাধ করে ফেলছি রাকিব, সেই অপরাধের কাছে আমার হাত কিছুই না। ”
রাকিব কিছুটা চিন্তিত কন্ঠে বললো,
“কি হয়ছে? কি করছিস তুই?”
আবিরের কন্ঠস্বর ভিজে আসছে, পুনরায় দুফোঁটা পানি গরিয়ে পরলো গাল বেয়ে, শীতল কন্ঠে জবাব দিলো,
“আমি একই ভুল পুনরায় করে ফেলছি। ”
রাকিব আঁতকে উঠে শুধালো,
“কি…? তুই মেঘকে মেরেছিস? ”
আবির দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুধু।
রাকিবের বুঝতে বাকি নেই যে, আবির মেঘকে মারার ক্রো*ধে নিজেকে আহ*ত করছে।
ভ্রু গুটিয়ে রাকিব বললো,
“কেনো মেরেছিস? ”
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবির বললো,
“আমায় জান্নাতের সাথে কথা বলতে দেখে মেঘের মাথায় র*ক্ত উঠে গেছে। যা তা উল্টা পাল্টা বলা শুরু করছে। আমি রাগ কন্ট্রোল করতে পারি নি। ”
“কি বলছিস আবির! জান্নাতের জন্য তুই মেঘকে মারলি?”
অবাক চোখে তাকিয়ে আছে রাকিব।
“আমি মেঘকে মারতে চাই নি বিশ্বাস কর। ও একপর্যায়ে প্রশ্ন করে বসলো আমি জান্নাতকে ভালোবাসি কি না। এই কথাটা সহ্য করতে পারি নি। ”
রাকিব তপ্ত দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো।
আবির বাম হাত দিয়ে কপাল থেকে চুল গুলো সরিয়ে মনোক*ষ্টে শুধালো,
“আমি এখন কি করবো রাকিব? ”
রাকিব দীর্ঘশ্বাস ফেলছে বার বার। কিছুটা ভেবে বললো,
“দেখ, এখন তো মেঘ আগের মতো নেই। এখন তো মেঘও তোর প্রতি পসেসিভ, এজন্যই তো আজকে এভাবে রিয়েক্ট করেছে। আমার মনে হয় না যে এই থাপ্পড়ের জন্য ও কথা বন্ধ করবে। ”
আবির খরখরে কন্ঠে উত্তর দিলো,
” তুই তো জানিস, মেঘ খুব জে*দি। এটায় আমার একমাত্র ভ*য়ের কারণ। ও যদি একবার জে*দ করে বলে,আমার সাথে কথা বলবে না তাহলে এই জীবনে আর কোনোদিন ও কথা বলবে না। ”
রাকিব কপাল গুটিয়ে প্রশ্ন করলো
“বাই দ্য ওয়ে, কয়টা থা*প্পড় দিছিস?”
আবির তপ্ত স্বরে বললো,
“১ টা”
রাকিব স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
“তুই চিন্তা করিস না। কিছু হবে না। জান্নাত কে নিয়ে কিছু ভাবছিস? মেঘ কি আর পড়তে চাইবে ওর কাছে?”
আবির গম্ভীর কন্ঠে জবাব দিলো,
“দুদিন পর পর ওর জন্য টিচার কোথা থেকে খোঁজবো আমি। ওকে জান্নাতের কাছেই পড়তে হবে। ”
রাকিব কোমল কন্ঠে বললো,
“আচ্ছা, সেসব পরে দেখা যাবে। এখন চল হাসপাতালে যাই একটু!”
আবির তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে বললো,
“হাসপাতালে যাব কেন?”
রাকিব স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
“এতটা কেটেছে। কোনো সমস্যা হয় যদি। ডাক্তার দেখালে ভালো হয়তো না?”
আবির সঙ্কটজনক স্বরে উত্তর দিলো,
“এটা আমার শাস্তি। ”
রাকিব খুব ভালো করে জানে আবিরকে জো*র করলে কোনো লাভ হবে না। তাই আর জো*র করে নি।
রাকিব চিন্তিত স্বরে বললো,
“এখন কি বাসায় যাবি? দিয়ে আসবো তোকে?”
আবির একপলক তাকালো দেয়ালে লাগানো ঘড়ির দিকে৷ ১০ টা বাজতেছে। গম্ভীর কন্ঠে জবাব দিলেন,
“কি করবো বুঝতে পারছি না। মেঘের মুখোমুখি হওয়ার মতো সা*হস পাচ্ছি না আমি। ”
রাকিব জানালার দিকে চেয়ে বললো,
“বাহিরে তো বৃষ্টি। একটু ওয়েট কর তাহলে। বৃষ্টি কমলে আমি দিয়ে আসবো নে। ”
আবির পকেট থেকে ফোন বের করে তানভির কে কল করলো। প্রথমবারেই রিসিভ হলো কল।
তানভির কল রিসিভ করে সালাম দিলো,
আবির সালামের উত্তর দিয়ে গম্ভীর কন্ঠে প্রশ্ন করলেন,
“কোথায় তুই?”
তানভির স্বাভাবিক ভাবে উত্তর দিলো,
“আমি তো পার্টি অফিসে। কেনো ভাইয়া?”
আবির নিরেট কন্ঠে জবাব দিলো,
“এমনি। ”
তানভির চিন্তিত স্বরে বললো,
“কোনো সমস্যা ভাইয়া? তোমার কন্ঠ এমন শুনাচ্ছে কেনো?”
আবির গলা খাঁকারি দিয়ে কিছুটা স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
“কোনো সমস্যা নেই। তুই কাজ কর। রাখছি। ”
কল কেটে মোবাইল পকেটে রেখে বাম হাত কপালের উপর রেখে চেয়ারে হেলান দিলো৷ রাকিবও আর কিছু বললো না। চুপচাপ রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।
পেইজঃ Salma Chowdhury – সালমা চৌধুরী ( scsalma90)
★★★★
এদিকে মেঘ কিছুক্ষণ আয়নার সামনে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকে৷ বাহিরে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে সাথে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে। বারান্দার দরজা দিয়ে আসা শীতল হাওয়ায় কেঁপে উঠলো অষ্টাদশী। আয়না থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বেলকনির দিকে তাকালো৷ ধীরগতিতে হেঁটে গেলো বেলকনিতে। গ্রিলে ধরে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে দূরের ল্যামপোস্টের আলোর দিকে।ক্ষণে ক্ষণে বৃষ্টির মাত্রা বাড়ছে। বাতাসের সাথে বৃষ্টির ছিটে ফোটা পরছে মেঘের চোখে মুখে। আজ আর হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি ছুঁয়ার চেষ্টা করে নি অষ্টাদশী।
বেশকিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো বেলকনিতে। হঠাৎ ভেতরটা ছটফটিয়ে উঠে। নিজের ভেতরে থাকা এক আকাশ সম অভিযোগ কাউকে বলতে ইচ্ছে করছে মেঘের। বৃষ্টির পানি আপন গতিতে পৃথিবীর বুকে লুটিয়ে পরছে। তা দেখে মেঘেরও ইচ্ছে করছে মনের মধ্যে পুষে রাখা চাপা কথাগুলো খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে সৃষ্টি কর্তাকে জানাতে। কষ্ট শেয়ার করলে নাকি মন হালকা হয় ।
যেই অষ্টাদশী গত ১৭ বছরে রাতের বেলা একা ছাদে যায় নি সেই অষ্টাদশী আজ রাত ৯ টার পর একা ছাদে চলে গেছে। ছাদে পা দিতেই ভারি বর্ষণে কয়েক সেকেন্ডে ভিজে যায় অষ্টাদশীর সর্বাঙ্গ। হাতখোপা করা চুলগুলো খুলে যায় সহসা। বৃষ্টির পানি তোপে ধীরে ধীরে কোমড় ছাড়িয়ে নিচে নামতে থাকে চুল। মেঘ আশেপাশে তাকাচ্ছে । দূর-দূরান্তের উঁচু উঁচু বিল্ডিং এর ছাদ থেকে হালকা আলো ভেসে আসছে মেঘদের ছাদে। লাইটের আলোর প্রভাবে গাছভর্তি ছাদের এদিক সেদিক গাছের ছায়া পরে আছে। কিছু কিছু জায়গা দেখে মনে হচ্ছে ভূ*তেরা বসে মিটিং করছে। মেঘের দৃষ্টি সেদিকে পরতেই কিছুটা কেঁপে উঠে। তবে ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকানোতে বুঝতে পারে এগুলো গাছের ছায়া।
বিদ্যু চমকানোর সঙ্গে সঙ্গে মেঘও সম্পূর্ণ ছাদে হাঁটছে। হাঁটতে হাঁটতে ছাদের একপাশে রাখা বেতের সোফাগুলোর একটাতে বসে পরলো। হেলান দিয়ে বসাতে চুলের কম অর্ধেক টা অংশ ছাদের ফ্লোরে পরে আছে। মেঘ আকাশের পানে তাকিয়ে বলা শুরু করলো,
“আল্লাহ! আমার জীবনে তো হি*টলার স্বভাবের ব্যক্তির কোনো অস্তিত্ব ছিলো না৷ তাহলে কেনো তুমি ওনাকে আমার সামনে নিয়ে আসলে?এই অনুভূতিহীন মানুষটা কেনো আমার জীবনের সাথে জরিয়েছে? ওনি যদি অন্য কাউকেই ভালোবাসেন, তাহলে আমায় কেনো ওনার প্রতি দূর্বল বানিয়েছো? আমি এখন কি করবো?”
একসাথে প্রশ্নগুলো করে কয়েক মুহুর্ত নিরব থাকে। অক্ষি পল্লব বেয়ে অনর্গল নোনাজল গড়িয়ে পরছে, তার সাথে বৃষ্টি পানি মিশে কানের নিচ দিয়ে যাচ্ছে আপন গতিতে।
বেশখানিকটা সময় নিরব থেকে শীতল কন্ঠে শুধালো,
“আমি কি কখনো কারো প্রিয় হতে পারবো না?”
(চলবে)
গল্প- আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে
পর্ব- ১৯
লেখিকা- সালমা চৌধুরী
বেশখানিকটা সময় মেঘ নিস্তব্ধ হয়ে বসে রইলো। মনের যত কষ্ট, ক্ষো*ভ, অপ্রাপ্তি ছিলো সবই প্রকাশ করলো আপন মনে। ঘন্টাখানেক বসার পর সোফা থেকে উঠে হাঁটতে শুরু করলো। একপাশে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আপন মনে গুনগুন করে গান গাইছে,
“আমি কি তোমায় খুব বিরক্ত করছি
বলে দিতে পারো তা আমায়
হয়তো আমার কোনো প্রয়োজন নেই
তবুও লেগে থাকি একটা কোণায়
তুমি বলে দিতে পারো তা আমায়
চিঠি লিখবো না এই ঠিকানায়
আমার ও তো মন ভাঙে
চোখে জল আসে
আর অভিমান আমার ও তো হয়।
অভিমান আমার ও তো হয়”
পেইজঃ Salma Chowdhury – সালমা চৌধুরী (scsalma90)
★★★★
অন্য দিকে আবির এখনও চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে। ১১ টার দিকে মালিহা খান কল করলেন,
আবির কল রিসিভ করে সালাম দিলো।
মালিহা খান সালামের উত্তর দিয়ে কিছুটা তপ্ত স্বরে বললেন,
“তুই কি বাসায় আসবি না?”
আবির স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
“আসবো একটু পর। কেনো?”
রাগান্বিত কন্ঠে মালিহা খান বলে উঠলেন,
“তোরা ভাই বোন মিলে কি শুরু করছিস? তুই বাহিরে বাহিরে থাকিস, তানভির নির্বাচনের ভেজালে ১২ টার আগে বাসায় ই ফিরতে পারে না। এদিকে তোর বোনের এক- দু’দিন পর পর কি হয়ে যায়,খায় না কিছু না। তোরা যদি রাতে না ই খাবি তাহলে বলে রাখতে পারিস না! আমরাও তোদের জন্য আর রান্না করবো না । ”
আবির হেলান থেকে উঠে মেরুদণ্ড সোজা করে বসলো, নিরেট কন্ঠে শুধালো,
“মেঘ খায় নি?”
মালিহা খান সহসা উত্তর দিলেন,
“না”
আবির গম্ভীর কন্ঠে বললো,
“তুমি শুয়ে পরো আমি আসছি। ”
আর কিছু না বলেই উঠে পরলেন। আবিরকে রুম থেকে বের হতে দেখে রাকিব আর রাসেল দুজনই ছুটে আসে। অন্যান্য দিন কাজ শেষ করে ১০-১০.৩০ এর মধ্যেই চলে যায় সকলে। কিন্তু আজ আবিরের মুড অফ দেখে তারা কাজ শেষ করেও বসে আছে। আবিরকে কিছু বলার সাহসও পাচ্ছিলো না।
রাকিব স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
“চল আমি তোকে দিয়ে আসি। ”
আবির শক্ত কন্ঠে জবাব দিলো,
“আমি একা যেতে পারবো। ”
রাকিব পুনরায় বলে উঠলো,
“তোর হাতের অবস্থা দেখছিস তুই? এই অবস্থায় বাইক চালালে তো এক্সিডেন্ট করবি। তার থেকে আমার কথা মান, আমি দিয়ে আসি তোকে। ”
আবির শক্ত দৃষ্টিতে তাকালো রাকিবের দিকে, দাঁতে দাঁত চেপে ঘোষণা করলো,
“বললাম তো যেতে পারবো। ”
রাসেল ঠান্ডা কন্ঠে বললো,
“এত বৃষ্টিতে বাইক নিয়ে যেতে পারবি?”
আবির আর কিছুই বললো না। বড় বড় পা ফেলে অফিস থেকে বেরিয়ে গেলো। টানা ২ ঘন্টার উপরে ভারী বর্ষণ হচ্ছে, যার ফলে ঢাকার রাস্তাঘাটে পানি জমে একাকার অবস্থা। মাথায় হেলমেট পর্যন্ত নেই, চোখ মেলে দেখার অবস্থা নেই তবুও বাইক থামছে না এক সেকেন্ডের জন্য। বৃষ্টির পানি এতটায় ঠান্ডা, মনে হচ্ছে ফ্রিজ থেকে বের করে বরফের পানি ঢালছে কেউ । আপাদমস্তক ভিজিয়ে বাড়িতে ঢুকলো আবির।। ড্রয়িং রুমে কেউ নেই, সিঁড়ি দিয়ে উঠে সোজা নিজের রুমের দিকে হাঁটে। ৫ মিনিটে ফ্রেশ হয়ে একটা ধূসর রঙের টিশার্ট আর টাওজার পরে রুম থেকে বের হয়। সঙ্গে সঙ্গে হাঁটা দেয় মেঘের রুমের দিকে,
মেঘের দরজার সামনে এসেই বামহাতে দরজা ধাক্কা দিলো। অনবরত ঘু*ষির কারণে ডান হাতে তেমন শক্তি পাচ্ছে না, তারপর আবার হাতের উপর জোর দিয়ে বাইক চালিয়ে এসেছে। দরজা খুলতেই চোখ পরে ফাঁকা বিছানায়, কেনো জানি বুকটা ছ্যাঁত করে উঠলো। ভিতরের দিকে দেখার চেষ্টা করলো, টেবিলের উপর ফোন,ল্যাপটপ পরে আছে, কিন্তু অষ্টাদশী কোথাও নেই৷ আবির রুমে ঢুকে বারান্দা সহ সব জায়গায় খোঁজলো কোথাও নেই। রুম থেকে বেরিয়ে সারা বাড়িতে চক্কর দিলো তবে কোথাও মেঘকে পেলো না । মীমের রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আস্তে করে ডাকলো,
সঙ্গে সঙ্গে মীম দরজা খুললো। এক গাল হেসে বললো,
“ভাইয়া কিছু বলবেন?”
আবির উদ্বিগ্ন কন্ঠে শুধালো,
“মেঘ কোথায়?”
মীম স্বাভাবিক ভাবেই উত্তর দিলো,
“আপু তো রুমেই৷ সেই যে খাবে না বলে রুমে গেলো আর তো বের ই হতে দেখি নি। ”
আবিরের চোখে মুখে চিন্তার ছাপ পরলো, গম্ভীর কন্ঠে শুধু বললো,
“ঠিক আছে ”
আবির আবারও মেঘের রুমে গেলো, সব জায়গা পুনরায় দেখলো কোথাও নেই। মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে আবিরের। চোখে মুখে উদ্বেগের মাত্রা বাড়ছে। রুম থেকে বের হয়ে নিজের রুমের দিকে যাচ্ছে, ফোন রেখে এসেছে নিজের রুমে। হঠাৎ চোখ পরে সিঁড়ির দিকে।
মনের অজান্তেই বলে উঠে,
“ও ছাদে যায় নি তো?”
কোনো কিছু না ভেবে ছুটে যায় ছাঁদের দিকে। ছাদের দরজা বাতাসে একবার খুলছে, একবার বন্ধ হচ্ছে । আবির দরজা ধাক্কা দিয়ে ঘাড় ডানে বামে ঘুরিয়ে ছাদ দেখার চেষ্টা করছে। ভারী বর্ষণের ফলে ছাদেও পানি জমে আছে অনেকটা, পাইপ দিয়ে গিয়েও যেনো কুলাতে পারছে না সাথে বৃষ্টির ছিটে ফোটা পরছে আবিরের শরীরে। কোথাও কাউকে চোখে পরছে না। আবির বৃষ্টির মধ্যে পা বাড়ালো ছাদে, কিছুক্ষণ পরপর বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। আবির ছাদের চারপাশ দেখছে ঘুরে ফিরে। হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকানোতে আবিরের দৃষ্টিতে পরে, রেলিং ঘেঁষে ছাদের ফ্লোরে পরে আছে অষ্টাদশী । ছাদের সাইড দিয়ে যাওয়া পাইপের উপরে পরে আছে মাথা শরীরের বাকি অংশ ছাদের ফ্লোরে জমা পানির মধ্যে পরে আছে।
আবির অকস্মাৎ চিৎকার দিয়ে উঠলো,
“মেঘ…….”
এক মুহুর্তে দৌড়ে গেলো মেঘের কাছে। অজ্ঞান হয়ে পরে আছে আবিরের প্রণয়িনী । আবিরের হাত কাঁপছে তবুও ঝাপটে ধরলো মেঘের পিট বরাবর, সহসা অষ্টাদশীর ঘাড় থেকে মাথা পর্যন্ত আঁকড়ে ধরলো নিজের প্রশস্ত বুকে । মেঘের শরীর বরফের ন্যায় শীতল হয়ে আছে, শুধু মাথাটা একটু একটু গরম। আবির কয়েকবার আকুল স্বরে মেঘকে ডাকলো, কিন্তু মেঘ নিস্তেজ হয়ে পরে আছে। মেঘের এই অবস্থা দেখে আবিরের সমগ্র পৃথিবী ঘুরছে।
বৃষ্টির পানি বরাবর ই মানুষের উপকারে আসে। সাধারণত বৃষ্টিতে ভিজলে কেউ বেহুঁশ হয় না তবে যদি সেই মানুষটা অতিরিক্ত চিন্তা বা মানসিক চাপে থাকে তবে শরীরের তাপমাত্রা কমে একটা সময় অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে৷ মেঘের ক্ষেত্রে ঠিক এই ঘটনাটায় ঘটেছে। এক আকাশ অভিমান জমে ছিল মনে তার প্রতিফলন ঘটলো এইভাবে।
আবির সহসা দু’ হাতে কোলে তুলে নিলো মেঘকে, সিঁড়ি দিয়ে হাঁটছে ঠিকই কিন্তু দৃষ্টি তার অষ্টাদশীর মলিন মুখের পানে।আবিরের চোখ বেয়ে দুফোঁটা অশ্রু গরিয়ে পরলো অষ্টাদশীর গালে। দুজনের শরীর বেয়ে অঝরে পানি পরছে। দীর্ঘ পা ফেলে করিডোর দিয়ে হেঁটে মেঘের রুমে ঢুকলো।
ফ্লোরে বিছানার সাথে হেলান দিয়ে মেঘকে বসিয়ে দিলো। টাওয়েল এনে হাত মুখ আর মাথাটা কিছুটা মুছে দিলো। সঙ্গে সঙ্গে রুম থেকে বের হয়ে নিজের রুমে গিয়ে বাইকের চাবি আর হেলমেট নিয়ে ছুটে গেলো নিচে। হালিমা খানের দরজার সামনে ভেজা শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে ডাকছে। ২ বার ডাকার পরই হালিমা খান দরজা খুললেন,
আবিরের জলসিক্ত শরীর দেখে চিন্তিত স্বরে শুধালেন,
“ভিজে আসছিস?”
আবির তপ্ত স্বরে বললো,
“মামনি তুমি একটু মেঘের রুমে যাও, ওর অবস্থা ভালো না, আপাতত বাড়ির মানুষকে ডেকো না, আমি ডাক্তার নিয়ে আসছি ”
একদমে কথাগুলো বললো আবির, হালিমা খান আঁতকে উঠে বললেন,
“কি হয়ছে?”
আবির চলে যেতে নিয়ে দ্বিতীয় বার ঘাড় ঘুরিয়ে বললো,
“আর হ্যাঁ৷ ওর শরীরটা একটু ধৌয়ে দিও। ”
আবির ছুটলো দরজার দিকে। হালিমা খান দ্রুত পায়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে ব্যস্ত হলেন, চোখে তার পানি টলমল করছে। একমাত্র মেয়ে বলে কথা, মেয়ের মুখ গোমড়া থাকলেই যেখানে চিন্তায় পরে যান হালিমা খান, সেখানে মেয়ে অসুস্থ মানে হালিমা খানের মাথায় আকাশ ভে*ঙে পরা।।
২০ মিনিটের মধ্যে আবির ডাক্তার নিয়ে চলে আসছে। ডাক্তারকে রেনকোট দিয়েছে ঠিক ই কিন্তু আবিরের সর্বাঙ্গ ভেজা। মেঘের রুমের সামনে দাঁড়িয়ে গলা খাঁকারি দিলো আবির, নরম স্বরে বললো,
“আসবো?”
হালিমা খান কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললেন,
“আয়”
আবির ঢুকলো আবিরের পিছনে ডাক্তার ও মেঘের রুমে ঢুকলো। আবিরের গা থেকে পানি পরছে ফ্লোরে কিন্তু সেদিকে তার ভ্রুক্ষেপ নেই। তার দৃষ্টি অষ্টাদশীর মুখের পানে। ডাক্তার ১০ সেকেন্ড মেঘকে দেখলো কি না,
আবির উদ্বিগ্ন কন্ঠে শুধালো,
“ওর কিছু হবে না তো?”
ডাক্তার স্বাভাবিক কন্ঠে বললেন,
“তেমন কোনো সমস্যা নেই। বেশিক্ষণ বৃষ্টিতে ভিজেছে মনে হয়। তাছাড়াও হয়তো কোনো মানসিক চাপে আছে তারজন্য এমনটা হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই জ্ঞান ফিরে আসবে। আমি কিছু মেডিসিন লিখে দিচ্ছি জ্ঞান ফিরলে খাইয়ে দিও। যদি জ্ঞান না ফিরে তাহলে পরবর্তীতে জানিয়ো একটা স্যালাইন করতে হবে। জ্ঞান ফিরলেও কিছুদিন একটু রেস্টে রাখবা, কোনো প্রকার মানসিক চাপ দিও না। ”
ডাক্তার প্রেসক্রিপশন লিখে আবিরের হাতে দিলো। আবির ঔষধ গুলোর নাম পড়ে টেবিলের উপর প্রেসক্রিপশন রেখে ডাক্তারকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো। ভেজা শরীরে পুনরায় বাইক দিয়ে ডাক্তারকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে ঔষধ গুলো কিনে নিয়ে আসলো। নিজের রুমে গিয়ে ১ মিনিটে ড্রেস পাল্টে শুকনো কাপড় পড়ে মেঘের রুমে আসছে। মেঘ তখনও অজ্ঞান অবস্থায় শুয়ে আছে। হালিমা খান মেঘের হাতে পায়ে তেল মালিশ করে দিচ্ছেন, কান্না করছেন আর বারবার মেঘকে ডাকছেন। মেঘের মাথার নিচে একটা টাওয়েল দিয়ে রেখেছেন।
আবির ঔষধ গুলো টেবিলের উপর রেখে, মেঘের ওয়ারড্রবের একটা ড্রয়ার খুললো, এটাতে জামাকাপড়, দ্বিতীয় ড্রয়ার খুলতেই চোখে পরলো সকল ইলেক্ট্রনিক জিনিসপত্র। সেখান থেকে হেয়ার ড্রায়ার বের করে নিলো আবির।
মেঘের কাছে দাঁড়িয়ে হালিমা খানকে বললেন,
“”মামনি তুমি ওকে একটু ধরে বসো। ”
আবির নিজেই হেয়ার ড্রায়ার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চুল শুকাচ্ছে মেঘের । কোমড় ছাড়ানো চুল গুলো ভাগ ভাগ করে শুকাতে কিছুটা সময় লাগলো। পুনরায় মেঘকে শুইয়ে হাতে পায়ে তেল মালিশ করতে লাগলো দুজনে। হালিমা খান আবিরকে শীতল কন্ঠে বললেন,
“বাবা, তুই একটু বস আমি তোর চাচ্চুকে বলে আসি। মাঝরাতে ঘুম ভাঙলে তো ওনি আবার চিন্তায় পরে যাবেন। ”
আবির গম্ভীর কন্ঠে বললেন,
“মেঘের এই অবস্থার কথা বলো না। শুধু শুধু চিন্তা করে শরীর খারাপ হবে। ”
হালিমা খান “ঠিক আছে ” বলে চলে গেলেন।
হালিমা খান রুম থেকে বেরিয়ে যেতেই আবির মেঘের সন্নিকটে বসলো,
মেঘের বাম হাত আবিরের বুকের সাথে মিশিয়ে , ওষ্ঠ এগিয়ে নিলো মেঘের কানের কাছে, গুনগুন করে বললো,
“”Main sirf tera rahunga
Tujhse hai waada yeh mera
Tu maang le muskura ke
Mera pyar haq hai tera””
তারপর অষ্টাদশীর কপালে আলতোভাবে একটা চুমু দিয়েই বিছানা থেকে উঠে পরলো। চেয়ার টেনে বসলো বিছানার পাশে তারপর হাতে তেল নিয়ে মালিশ করতে লাগলো মেঘের হাতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই হালিমা খান ফিরে আসলেন। হালিমা খানও মেয়ের ডান হাতে, দুপায়ে মালিশ করে দিচ্ছেন আর একটু পর পর মেঘকে ডাকছেন,
বেশ খানিকক্ষণ পর মেঘের জ্ঞান ফিরেছে৷ সঙ্গে সঙ্গে আবির মেঘের হাত ছেড়ে দিয়েছে। হালিমা খান কান্না করতে করতে মেঘকে ডাকছে,
“মেঘ, এই মেঘ, কি হয়েছে তোর?”
মেঘ কয়েকবার পিটপিট করে চাইলো মায়ের দিকে, বুঝে উঠতে পারছে না তার সাথে এতক্ষণ কি ঘটেছে। মায়ের প্রশ্নের উত্তর দেয়ার মতো শক্তি তার নেই। চোখ ঘুরিয়ে নিজের অস্তিত্ব বুঝার চেষ্টা করছে। নিজের রুমটা পরখ করতে লাগলো মেঘ,হঠাৎ দৃষ্টি পরে বামপাশে চেয়ারে বসা আবির ভাইয়ের দিকে। মায়াভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেঘের পানে। মেঘও কয়েক মুহুর্ত তাকিয়ে রইলো আবির ভাইয়ের দিকে। মনে পরতে লাগলো সন্ধ্যার পর থেকে ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলো। তৎক্ষনাৎ দৃষ্টি সরিয়ে নিলো আবির ভাইয়ের দিকে থেকে।
পুনরায় চোখ বন্ধ করে ফেললো মেঘ । হালিমা খান মেঘের কপালে হাত রেখে আঁতকে উঠলেন, সঙ্গে একবার গলাতেও হাত রাখলেন। সহসা বলে উঠলেন,
“মেঘের তো জ্বর উঠতেছে।”
আবির গম্ভীর কন্ঠে বললো,
“তুমি ওকে উঠাও, আমি খাবার নিয়ে আসছি।
ঔষধ খাইয়ে দিলে যদি একটু কমে!”
হালিমা খান চিন্তিত স্বরে বললেন,
“তানভির কোথায় আছে?”
আবির শক্ত কন্ঠে জবাব দিলো,
“ওকে জানিয়েছি, আসতেছে। ”
মেঘ নিস্তেজ অবস্থায় শুয়ে আছে। চোখ খুলে আবির ভাইকে দেখার শক্তিটুকু যেনো পাচ্ছে না, কথা বলা তো বহুদূরের বিষয় ।
আবির নিচে গিয়ে একটা প্লেটে অল্প ভাত আর একটু তরকারি নিয়ে আসলো। হালিমা খান মেঘকে কোনোরকমে উঠিয়ে খাটের সাথে হেলান দিয়ে বসিয়ে নিজে ধরে রেখেছেন।
আবির ভাত মাখিয়ে মুখে সামনে ধরে ছোট করে বললো,
“হা কর”
পুরুষালী কন্ঠে কিছুটা কেঁপে উঠে মেঘ। তৎক্ষনাৎ ছোট করে হা করলো । আবির ভাই অষ্টাদশীকে নিজের হাতে খাইতে দিচ্ছে কিন্তু অষ্টাদশীর মনের ভেতর আনন্দ নেই, নেই কোনো উত্তেজনা। যেই আবির ভাই তার মনের ভেতর সারাক্ষণ এক্কা দোক্কা খেলতো সেই আবির ভাইকে চোখে মেলে দেখার সাধ্যি তার হচ্ছে না। কয়েক লোকমা ভাত কোনোরকমে গিললো পরের বার দিতে গেলে আসতে করে বামে ডানে ঘাড় ঘুরালো। আবিরও বুঝতে পারলো মেঘের অভিব্যক্তি। জোর করলো না আর। হাত ধৌয়ে নিজের হাতেই মেঘের মুখ মুছে দিলো। তারপর ঔষধ খাইয়ে একবার মেঘের কপালে হাত রাখলো। জ্বরের মাত্রা বাড়ছে।
আবির শীতল কন্ঠে বললো,
“মামনি তুমি থাকো ওর কাছে। কোনো সমস্যা হলে আমায় ডেকো, আমি সজাগ আছি। ”
আবির প্লেট হাতে নিয়ে চুপচাপ বেড়িয়ে গেলো রুম থেকে।
১০-১৫ মিনিট পর তানভির দৌড়ে বাড়িতে ঢুকে। এমপির গাড়ি করে ড্রাইভার এসে দিয়ে গেছে তানভিরকে। মেঘের রুমে গিয়ে কোমল কন্ঠে মাকে শুধালো,
“কি হয়ছে মেঘের?”
মেঘের পাশে বসে কপালে হাত রাখলো । থার্মোমিটার এনে জ্বর মাপলো ১০০° F তাপমাত্রা । মেঘ জ্বরে কাঁপতেছে। তানভির ছুটে গিয়ে নিজের রুমের কেবিনেট থেকে আর একটা কম্বল এনে বোনের গায়ে ছড়িয়ে দিলো৷ তারপর একটা ছোট রুমাল ভিজিয়ে কিছুক্ষণ জলপট্টি দিলো।
হালিমা খান এখনও ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছেন।
তানভির মায়ের দিকে চেয়ে মোলায়েম কন্ঠে বললো,
“ডাক্তার কি বলছে?”
হালিমা খান কান্নারত কন্ঠে বললেন,
“”বলছেন সিরিয়াস কোনো সমস্যা না। রেস্ট নিতে আর চিন্তা কম করতে। ঔষধ দিয়ে গেছেন””
“ঔষধ খাওয়ানো হয়ছে?”
হালিমা খান কোমল কন্ঠে বললেন,
“হ্যাঁ, আবির খাইয়ে দিয়ে গেছে!”
তানভির নমনীয় কন্ঠে মাকে প্রশ্ন করলো,
“ভাইয়া কোথায়?”
“কিছুক্ষণ হলো গেলো এখান থেকে। ”
তানভির আর কিছু বললো না। চুপচাপ কিছুক্ষণ জলপট্টি দিলো বোনের কপালে। তবে জ্বর কমার কোনো নাম গন্ধ নেই।
পেইজঃ Salma Chowdhury – সালমা চৌধুরী (scsalma90)
★★★★★
এদিকে আবির রুমে এসে বেলকনিতে পায়চারি করতে লাগলো৷ বাহিরে এখনও বৃষ্টি হচ্ছে। মাঝে মাঝে কিছুক্ষণ বিরতি নেয় আর ভারী বর্ষণ শুরু হয়। তাপমাত্রা কম থাকার পরও আবিরের শরীর ঘামছে। স্থির হতে পারছে না কোনোভাবেই। তামাটে চেহারা কুচকুচে কালো বর্ণের হয়ে আছে। দুপুরে খাবার খেয়েছিলো তারপর সন্ধ্যায় শুধু এককাপ কফি খেয়েছে। মধ্যরাত হয়ে গেছে, খায় নি এখনও তাই মুখটা মলিন হয়ে আছে। হাতের অবস্থাও করুন, বাসায় ফেরার পথে ব্যান্ডেজ খুলে ফেলেছিলো। বৃষ্টির পানিতে কাটা অংশ গুলো ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।
কিছুক্ষণ পর আবির বড় বড় পা ফেলে ছাদে চলে গেলো। সম্পূর্ণ শরীর ভিজতে বেশি সময় লাগলো না। ছাদের কর্ণার থেকে সিঙ্গেল সোফা টেনে মাঝ বরাবর রেখে সেখানে বসে পরলো।
অসীম দূরত্বে চেয়ে থাকে অনেকটা সময় ধরে। পরপর চোখ বন্ধ করে শ্বাস টেনে নিজেকে প্রশ্ন করলো,
“”আমি কি এখন ফিরে ভুল করে ফেললাম?””
আবিরের মনে পরছে পুরোনো স্মৃতি,
এক প্রণয়িনীর ২ বছরের নিরবতা কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিলো তাকে। প্রিয়মানুষের উপস্থিতি যেমন বক্ষস্পন্দন বাড়াতে সক্ষম তারথেকেও বেশি কষ্টদায়ক নিজের প্রেয়সিকে গুরুগম্ভীর থাকতে দেখা আর যার কারণ সে নিজেই। একটা সামান্য ভুলের কারণে গতদু’টি বছরে প্রেয়সী তার চোখে চোখ রাখে নি, এক টেবিলে, এক সাথে খেতেও বসে নি। মুখ ফোটে একটা কথা পর্যন্ত বলেনি। এর বেশি সহ্য করার ক্ষমতা একটা ১৮ বছরের যুবকের পক্ষে কখনো সম্ভব ছিল না। প্রেয়সীর প্রতি অনুভূতি তার অতলস্পর্শী বিশালতার সমুদ্রের ন্যায় যা কখনো পরিমাণ করা সম্ভব না৷
যখন তার সহ্যের সীমা শেষ হতে চললো, তখন তার সামনে দুটি রাস্তা ভেসে উঠেছিল। এক, স্কলারশিপে বিদেশ যাওয়া, দ্বিতীয় হলো ঢাকা ভার্সিটিতে পড়াশোনা। আবির বাড়ির প্রতিটা সদস্যের থেকে মতামত নিয়েছিল সেদিন। এমনকি তার হৃদয়হরনীর কাছেও সেদিন আকুল মিনতি করে জিজ্ঞেস করেছিল সে কি চাই৷ ছোট্ট হৃদয়হরনীর অভিমানের মাত্রা এতটায় তীব্র ছিল যে সেদিনও আবিরের চোখে চোখ রাখে নি, আবিরের কোনো কথার উত্তর ও দেয় নি।
২ বছর যে ললনার অভিমান ভাঙাতে অক্ষম সেই ললনার অভিমান কয়েক মাসে ভাঙানো সম্ভব ছিল না। তারপরও আবির শেষ বার যাওয়ার আগে অভিভূতের ন্যায় নিষ্পলক চেয়ে ছিল তার সেই ললনার দিকে, যদি একবার বলতো ‘ভাইয়া তুমি যেয়ো না’ কিন্তু না শেষদিনও মুখ ফোটে কিছু বলে নি তার প্রেয়সী৷
আবির পারি জমালো ভিনদেশে, পার্থিব জগতের মাঝে অপার্থিব সৌন্দর্যের অধিকারী তার সেই ছোট্ট ললনাকে ফেলে চলে গিয়েছিল বহুদূর।
(চলবে)