আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব-৫৯+৬০

0
4563

#গল্পঃ_আমৃত্যু_ভালোবাসি_তোকে_
#পর্বঃ_৫৯
#লেখিকাঃ_সালমা_চৌধুরী_

মেঘের অধিবিদ্যের ন্যায় কথা শুনে তানভির আশ্চর্য নয়নে তাকিয়ে শুধালো,

“বনু, তুই এভাবে কথা বলছিস কেন? কে তোকে প্রাধান্য দেয় নি বল শুধু! ”

মোজাম্মেল খান ভারী কন্ঠে বললেন,
” কেনো তাকে কি করবা?”

তানভির ধীর কন্ঠে বলল,
” কিছু করব না। ”

মেঘ তানভিরের দিকে তাকিয়ে তটস্থ হয়ে বলল,
“এমনি, মীমকে বুঝাচ্ছি। ”

আবিরের আঁখি জোড়া মেঘের পানে গভীরভাবে অনুবন্ধী হয়ে আছে। মেঘ তানভিরের থেকে নজর সরিয়ে মাথা নিচু করে ফেলল। মিনহাজের পরিকল্পনায় মেঘ এমন টা করছে যাতে আবিরের মনের ভাব বুঝতে পারে৷ খাবার টেবিলে যে যার মতো খাবার খাচ্ছে অথচ আবিরের দৃষ্টি মেঘেতে স্থির। মেঘ যে ইন্ডাইরেক্টলি আবিরকে খোঁচা দিচ্ছে এটা আবিরের বুঝতে বাকি নেই। মেঘ খাবার খেয়ে চুপচাপ উঠে গেছে। আবির কিছুক্ষণ নিবিড় চিন্তায় মগ্ন থেকে খাওয়া শেষ করে অফিসে চলে গেছে। আবির আজ অফিসের কাজে কোনোভাবেই মনোযোগ দিতে পারছে না। আবিরের বুকের ভেতর অধৃষ্য হাওয়া বইছে, হৃদয়ের তোলপাড় চলছে৷ এসিতে বসেও শরীর ঘামছে, দুশ্চিন্তায় আবিরের শ্যামবর্ণের চেহারা কালচে বর্ণ ধারণ করেছে। ফাইল এলোমেলো অবস্থায় ফেলে টেবিলের উপর মাথা রেখে শুয়ে আছে। রাকিব একটা ফাইল নিয়ে রুমে ঢুকে আবিরকে দেখেই তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে বলল,

“কি হয়ছে আবির? অসুস্থ লাগছে?”

আবির টেবিল থেকে মাথা তুলতেই আবিরের অসহায় মুখ দেখে রাকিব ভ্রু কুঁচকে বলল,
” কোনো কিছু নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছিস?”

“মেঘ ইদানীং কেমন জানি ব্যবহার করছে। ”

“কেমন করতেছে?”

” ডিরেক্ট কিছু বলে না তবে কেমন জানি ঠ্যাস দিয়ে কথা বলে।”

রাকিব মৃদু হেসে বলল,
“তোকে পরীক্ষা করছে হয়তো।”

“তা বুঝার বয়স আমার হয়ছে।”

“তাহলে দুশ্চিন্তা কি নিয়ে করছিস?”

“খোঁচাখোঁচি টা যদি সিরিয়াল রূপ নেয় তার জন্য ভয় হচ্ছে। আমি সেদিন ওর আইডি থেকে মিনহাজ ছেলেটা কে ব্লক করছি। ও তেমন কোনো রিয়াকশন দেখায় নি, আনব্লক ও করে নি। ঠিকই ভার্সিটিতে ঘন্টার পর ঘন্টা ঐ ছেলেগুলোর সাথে আড্ডা দেয়।”

রাকিব গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“তুই যে এই বিষয় কোনো না কোনোদিন দুশ্চিন্তায় পরবি সেটা আমার অজানা নয়। তোকে কম করে হলেও হাজার বার বলছি। তুই একবার ওদের সাথে পার্সোনাললি দেখা করলে এত কাহিনীর কিছুই হতো না। ”

“আমি রাগ কন্ট্রোল করতে পারি না জানিস তো। এখন পর্যন্ত যে কয়জনকে নিজের হাতে মেরেছি সব কয়টা ত্যাড়ামির জন্য মা*র খেয়েছে। ভালোভাবে কথা বলতে গেলে তারা মানতে চাই না, গায়ের জোর, এলাকার দাপট দেখায়। সহ্য করতে না পেরে আমার তাদের মা*রতে হয়। মিনহাজদের সাথে দেখা করতে গেলে তারা যে সেইম কাজটা করবে না তার কি গ্যারেন্টি আছে? তীব্র আক্রোশ থেকে দিব মাই-র। কোনো না কোনোভাবে সে কথা মেঘের কানে যাবে। আর মেঘ ভাববে আমি ইচ্ছেকৃত ওর বন্ধুদের মেরেছি আর তা নিয়ে তুলকালাম কান্ড ঘটাবে। এমনিতেই ওর সাথে রাগারাগির শেষ নেই এই ঘটনার জের ধরে দেখা যাবে কথা বলায় বন্ধ করে দিয়েছে৷ ”

“তানভির বা আমি তো বলতেই পারতাম৷ ”

“হ্যাঁ পারতি। কিন্তু মেঘ ঘুরেফিরে আমাকেই ভুল বুঝতো। কারণ প্রাইমারি স্কুলে থাকাকালীন জয় নামের ছেলেটার জন্য ও কে মে-রেছিলাম। এত বছর পর ভার্সিটিতে উঠে দুটা ছেলে বন্ধু হয়েছে এখন মেঘেকে না মেরে ওদেরকে মারা হয়েছে। মেঘ কি এতটায় বোকা যে কিছুই বুঝবে না! তোরা মারলে ছেলেগুলো মেঘকে ডিটেইলসে বলবে, আর কাউকে দিয়ে মারালে সেটাও বলবে। সবভাবেই দোষ গিয়ে আবির আর তানভিরের উপর ই পরবে। ”

“তোর এই সুদূর প্রসারি চিন্তা ভাবনার জন্যই নিজের মনোবল হারাচ্ছিস, দিনকে দিন বদমেজাজি হয়ে যাচ্ছিস, মেঘের সাথে কারণে অকারণে রাগ দেখাচ্ছিস আর এই সুযোগে ছেলেগুলোরও অতি বার বাড়তেছে।”

আবির কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে আড়চোখে রাকিবের দিকে তাকিয়ে শুধালো,
“কেনো আসছিলি?”

রাকিব সঙ্গে সঙ্গে ফাইল এগিয়ে দিল। বাড়তি কথা বাদ দিয়ে কাজে মনোযোগ দিল। অফিস শেষে আবির কিছু স্ট্রিট ফুড আর ২ টা আইসক্রিমের বক্স নিয়ে বাসায় আসছে৷ মেঘ সোফায় লম্বা হয়ে শুয়ে টিভি দেখছিল, আবিরকে ঢুকতে দেখে তাড়াতাড়ি উঠে বসতে বসতে কাকে কল দিল। অপর পাশে কল রিসিভ করা মাত্রই মেঘ হাসিমুখে রাজ্যের গল্প শুরু করেছে। আবির খাবার গুলো ডাইনিং এ রাখতেই মীম আর আদি ছুটে গেল। আবির তির্যকভাবে মেঘের দিকে তাকালো। আবির বাসায় আসছে বা খাবার নিয়ে আসছে সেদিকে মেঘের বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই। সে তার কথা বলায় এতটায় মগ্ন যে আশেপাশে তাকানোর সময় ই নেই। আবির কপাল গুটিয়ে সিঁড়ি কাছে চলে গেছে। বাসায় যে যায় আনুক না কেন প্রথম ডাক টা মেঘকেই দেয় আর মেঘ খাবার পরিবেশন করে মীম আর আদিকে নিয়ে খায়। আজ মেঘ কথা বলছে দেখে মীম মেঘের জন্য খাবার নিয়ে আসছে। মেঘের দিকে এগিয়ে দিয়ে কিছুটা উঁচু স্বরে বলল,

“আপু নাও।”

মেঘ অন্যদিকে তাকিয়ে ধমকের স্বরে বলল,
“দেখছিস না কথা বলছি। এখন আমার এসব খাওয়ার সময় নেই”

আবির সিঁড়ি থেকে সে দৃশ্য দেখে রাগে ধপাধপ পা ফেলে রুমে চলে গেছে। মেঘ ধমকটা মীম কে দিলেও সেটা যেন আবিরের হৃদয়ে গিয়ে লাগছে৷ মেঘ আজ পর্যন্ত এমন কাজ কখনও করে নি৷ বন্যারা কারো সাথে কথা বললেও আবির, তানভির আসলে কথা শেষ করে কল কেটে দিত অথচ আজ তার ভিন্ন রূপ। আবির চলে যেতেই মেঘ গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“ফোন রাখ, এখন খাবো আমি।”

মীম ধমক খেয়ে মন খারাপ করে মেঘের জন্য আনা খাবার আবার নিয়ে গেছে। মেঘ তপ্ত স্বরে বলল,

“এই মীম, আমার ভাগ আমায় দিয়ে যা। ”

মীম মন খারাপ করে বলল,
“তুমি না বললে, তোমার এসব খাওয়ার সময় না”

“সময় ছিল না। এখন আমার অফুরন্ত সময়, সবগুলো আমার কাছে নিয়ে আয়।”

মীম খাবার গুলো মেঘের কাছে গিয়ে চলে যেতে নিলে মেঘ মীমের হাতে টান দিয়ে মেঘের পাশে বসিয়ে হেসে বলল,
“রাগ করছিস? সরি বাবু ”

মীম কিছু বলছে না দেখে মেঘ দুহাতে মীমকে কাতুকুতু দেয়া শুরু করল। সহসা মীমের ছোট্ট দেহ কম্পিত হলো। নড়তে নড়তে বলল,
“আপু ছাড়ো।”

মেঘ হাসতে হাসতে বলল,
“তুই যতক্ষণ না হাসবি ততক্ষণ ছাড়বো না। ”

কাতুকুতু সহ্য করতে না পেরে মীম হাসতে শুরু করলো। মেঘ সঙ্গে সঙ্গে কাতুকুতু দেয়া থামিয়ে দিয়েছে। দু-বোন গল্প করতে করতে আবিরের আনা খাবার গুলো খেয়েছে। আদি নিজের ভাগের খাবার নিয়ে আগেই রুমে চলে গিয়েছিলো। কিছুক্ষণ পর গল্প করতে করতে মেঘ মীমের উরুতে মাথা রেখে শুয়ে পরেছে। মীম মেঘের চুলে হাত বুলিয়ে মৃদুস্বরে বলল,

“কি হলো আপু?”

মেঘ লাজুক হাসলো আর বলল,
“জানিস, আমি একজনের প্রেমে পরেছি!”

মীম উত্তেজিত কন্ঠে চেঁচিয়ে উঠল,
“সত্যি? কার?”

মেঘ দুহাতে মুখ লুকিয়ে বলল,
“বলা যাবে না।”

“প্লিজ আপু বলো। কে সে?”

“আছে কেউ একজন। ”

“পছন্দ করো?”

“না। ভালোবাসি”

“আপু বলো না প্লিজ।”

“খুব শীঘ্রই বলবো। দোয়া কর যেন খুব তাড়াতাড়ি সফল হতে পারি।”

“ফি আমানিল্লাহ। ”

আবির রুমে ঢুকে ডিরেক্ট ওয়াশরুমে চলে গেছে। প্রায় ১ ঘন্টা যাবৎ ওয়াশরুমের ঝরনার নিচে দাঁড়িয়ে আছে। ক্রোধে দু চোখ রক্তাভ হয়ে আছে, মনে হচ্ছে শরীরের রক্ত টগবগ করে ফুটছে, কপালের দুপাশের রগ দুটা অবিরাম কাঁপছে, মস্তিষ্কে রক্ত সঞ্চালন বেড়ে গেছে। ঘন্টাখানেক পর ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে ভেজা শরীরেই একটা টাওজার আর টিশার্ট পরে নিচে আসছে৷ মেঘ তখনও মীমের কোলে মাথা রেখে খুশগল্পে মেতে আছে। আবিরকে নামতে দেখে মেঘ তৎক্ষনাৎ উঠে বসলো। আবির নিচে এসে ওদের পাশের সোফায় বসেছে, আবিরকে দেখে মীম নড়েচড়ে বসল। আবির দুহাত দুদিকে ছড়িয়ে সোফায় হেলান দিয়ে বসলো। হাতের লোমের গুঁড়ায় এখনও বিন্দু বিন্দু পানি জমে আছে। ভেজা চুল গুলো কপাল ঢেকে ভ্রু থেকেও নেমে পরেছে, চুলের আগা থেকে অবিরত মুক্তার মতো পানির বিন্দু আবিরের টিশার্টে পরছে। মেঘ একপলকের জন্য তাকাতেই সর্বাঙ্গে কারেন্টের ন্যায় শক লাগলো, সঙ্গে সঙ্গে বুকের ভেতর ধুকপুক শুরু হয়ে গেছে। মেঘ চোখ সরিয়ে নিয়েছে। আবির মীমকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“রুম থেকে আমার ফোনটা নিয়ে আয় ”

কথাটা বলা মাত্র মীম উঠে গেছে৷ মেঘ সোফায় কর্ণারে গুটিসুটি মেরে বসে আছে। মীম যেতেই মেঘ তাড়াতাড়ি করে ফোন হাতে নিয়ে কি যেন করতে লাগলো। আবির নিরেট দৃষ্টিতে মেঘের পানে চেয়ে আছে। মেঘ ফোন চাপতে পারছে না, ভয়ে হাত কাঁপছে। আবির গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

” তোর কি মনে হচ্ছে না, তুই প্রাপ্ত স্বাধীনতার অপব্যবহার করছিস?”

মেঘ চিবুক নামিয়ে চুপচাপ বসে আছে। মেঘের নিস্তব্ধতা আবিরের রাগ দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। আবির রেগে বলল,
“কথা বলছিস না কেন?”

মেঘ কিছু না বলে উঠে যেতে নিলে আবির রাগান্বিত কন্ঠে হুংকার দিল,
“আমি তোকে কিছু জিজ্ঞেস করছি মেঘ! কথা কানে যায় না তোর?”

মেঘ কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল,
“আমার একটা ইম্পর্ট্যান্ট কল আসছে। ”

বলেই মেঘ কল রিসিভ করে কানে ধরতে ধরতে সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেছে৷ মেঘের কথাটা আবিরের মনে আগুনে ঘি ঢালার মতো কাজ করেছে। আবির ভ্রু যুগল নাকের গুঁড়ায় টেনে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মেঘের গমনপথে তাকিয়ে রইলো। অকস্মাৎ পাশে রাখা একটা ফুলদানি দেয়ালে একপ্রকার ছুড়ে মারল। শব্দে মেঘের পা সেকেন্ডের জন্য থমকে গেছে, তবুও তা বুঝতে না দিয়ে রুমের দিকে চলে গেছে। মীম ফোন নিয়ে নিচে আসছে, ফোন আবিরকে দিতে গিয়ে আবিরের রক্তলাল আঁখি যুগল দেখে ভয়ে ঢোক গিলল। কোনোরকমে ফোন দিয়ে দৌড়ে আম্মুর রুমে চলে গেছে। আবির সেই যে বেড়িয়েছে সারারাতেও বাসায় ফেরে নি । মেঘ অপেক্ষা করতে করতে বেলকনিতেই ঘুমিয়ে পরেছিল। ভোরবেলা হঠাৎ ঘুম ভাঙতে মেঘ থতমত খেয়ে উঠে। তাড়াতাড়ি রুম থেকে বেরিয়ে আবিরের রুমে গেল। আবির রুমে নেই দেখেই মেঘের বুক কেঁপে উঠেছে। ভোর বেলায় বাসার বাহিরের গিয়ে দেখে আসছে আবিরের বাইক আছে কি না! এত সকালে কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না।আবিরকে কল দেয়ার মতো সাহস ও পাচ্ছে না। সকাল ৭ টা থেকেই মেঘ খাবার টেবিলে বসে আছে, আবির ফিরলে যেন দেখতে পারে৷ কিন্তু আবিরের ফেরার নামগন্ধ নেই৷
সবাই খেতে বসছে, আবির নেই দেখে আলী আহমদ খান প্রশ্ন করলেন,
“আবির কোথায়? উঠে নি?”

তানভির গলা খাঁকারি দিয়ে ধীর কন্ঠে বলল,
“ভাইয়া রাকিব ভাইয়াদের বাসায়। ”

“কেন?”

“অফিসের কাজে গেছিলো, রাতে আর ফেরে নি।”

আলী আহমদ খান ভারী কন্ঠে বললেন,
“কাজ কাজের জায়গায় থাকবে তার সাথে বাসায় না ফেরার কি সম্পর্ক?”

তানভির আর কিছু বলল না। বড় আব্বুর সাথে যুক্তিতে সে কুলাতে পারবে না তার থেকে কথা না বলায় শ্রেয়। মেঘ নিস্তব্ধ আঁখিতে তানভিরের দিকে তাকিয়ে আছে৷ মেঘ স্পষ্ট বুঝতে পারছে আবির ভাই তারউপর রাগ করেই বাসা থেকে চলে গেছেন। বাসায় মানুষ যাতে চিন্তা না করে তারজন্য তানভির ভাইয়া কাজের কথা বলেছেন। মেঘ অল্প খেয়ে রেডি হয়ে ভার্সিটিতে চলে গেছে। রাতে ঠিকমতো ঘুম না হওয়ায় মেঘের চোখ ঘুমে টলছে। অর্ধ ঘুমে থেকেই ক্লাসগুলো শেষ করেছে। ক্লাস শেষ হতেই বন্যা শুধালো,

“কিরে তুই কি রাতে ঘুমাস নি? চোখ ফুলে আছে কেন?”

“ঘুমাইছি, অল্প।”

লিজা এসে উত্তেজিত কন্ঠে বলল,
“কিরে বান্ধবী কি অবস্থা? ”

“কি অবস্থা হবে?”

এরমধ্যে মিনহাজ, তামিম, সাদিয়া, মিষ্টিও আসছে। মেঘ নিরেট কন্ঠে জানালো,
“আমি তোদের কথা আর শুনতে পারবো না।”

সাদিয়া ভ্রু কুঁচকে বলল,
“কেন?”

মেঘ ধমকের স্বরে বলল,
“আজকে তোদের কথামতো কাজ করতে গিয়ে আমার আবির ভাই বাসা থেকে চলে গেছেন। সারা রাত বাসায় ফিরে নি, আমি বেলকনিতে বসে থাকতে থাকতে ওখানেই ঘুমিয়ে পরেছি। ”

বন্যা ধীর কন্ঠে বলল,
” মেঘ তোকে আগেই সাবধান করেছি। তুই আমার কথা কানেই তুলছিস না। আবির ভাইকে তুই চিনিস না? ওরা নাচতাছে আর তুই ও তাতে তাল দিচ্ছিস! এখনও সময় আছে এসব বাদ দে। ওনি মনের ভাব প্রকাশ করতে না চাইলে শুধু শুধু ওনাকে জোর করিস না, প্লিজ। পরে দেখবি ভালোর বদলে উল্টো খারাপ হবে। ”

মেঘ কিছু বলার আগে মিনহাজ গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

“এই বন্যা, তুই থামবি। মেঘ তুই একদম ঠিকঠাক রাস্তায় যাচ্ছিস। বন্যার কথায় কান দিস না। ওনি যদি তোকে পছন্দ করে তাহলে ওনি প্রকাশ করবে আর পছন্দ না করলে ডিরেক্ট চাপ্টার ক্লোজ। এভাবে ঝুলে থাকার কোনো মানে হয় না বুঝলি! ”

সাদিয়াও সঙ্গে তাল দিল,
“হ্যাঁ সত্যিই তো। মেঘ ওনাকে এত পছন্দ করে ওনি কি এসব বুঝে না? নাকি বুঝেও না বুঝার ভাব নেয়। সবটা ক্লিয়ার করা প্রয়োজন। ওনার মনে কি চলে তা জানলে মেঘ সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।”

বন্যা ভরা গলায় বলল,
” তোরা বুঝার চেষ্টা কর, মেঘ তোদের মতো এত বুঝদার আর স্ট্রং না। উল্টাপাল্টা আচরণ করলে আবির ভাই মেঘকে মে*রেই ফেলবে।”

মিনহাজ রাগী স্বরে বলল,
“কোন অধিকারে মারবে? কার এত সাহস যে মেঘের গায়ে হাত তুলবে ।মেঘ তোকে কিছু বললে তুই শুধু আমায় বলবি, বুঝলি।”

বন্যা উপহাসের স্বরে বলল,
” তোকে দাপট দেখাতে আগেই নিষেধ করেছিলাম। তুই আবির ভাইয়া সম্পর্কে জানিস না তাই দয়া করে চুপ থাক। মেঘ তুই তো ওনাকে চিনিস৷ প্লিজ আমার কথা মান, ওদের কথামতো এমন কাজ করিস না প্লিজ। ”

মেঘ নিরুপায় হয়ে সবার দিকে তাকালো। একদিকে বন্যা বারণ করছে। অন্যদিকে বাকি সবাই বলছে মেঘ যা করছে একদম ঠিক করছে। অন্যদিকে আবির ভাই রাগে বাসা থেকে চলে গেছেন৷ মেঘ এখন কি করবে!

মিনহাজ ফটাফট বলা শুরু করল,
“দেখ মেঘ, ওনি তোর আচরণে রেগে বাসা থেকে চলে গেছে মানে ওনার মনে কিছু একটা আছে। এখন সেটা আমাদের প্রকাশ করাতে হবে। মাঝপথে ছেড়ে দিলে তুই জীবনেও তোর কাঙ্ক্ষিত কথা জানতে পারবি না। এখন তুই ভাব, বন্যার কথা মেনে এভাবেই চলবি নাকি আমাদের কথা মেনে তোর আবির ভাইয়ের মনের কথা শুনবি৷ ”

মেঘ বোকার মতো তাকিয়ে আছে। লিজা পুনরায় বলল,
“তোর প্রেম রোগের বছর হয়ে যাচ্ছে। আর কতদিন ওনার পিছুপিছু ঘুরবি বলতো? ওনি ভালো না বাসলে ওনার চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে অন্য কারো সাথে সম্পর্কে যাবি। প্রয়োজনে ছেলে আমরা ঠিক করে দিব তবুও ওনার মোহে এভাবে পরে থাকিস না।”

প্রায় ১ ঘন্টা সবাই মিলে মেঘকে জ্ঞান দিয়েছে৷ বন্যা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ডিরেক্ট না। মেঘ যাতে এমন কাজ কোনোভাবেই না করে। অথচ মেঘ বাকিদের কথা শুনে রাজি হয়ে গেছে।

বন্যা যেতে যেতে আরও কিছুক্ষণ মেঘকে বুঝালো কিন্তু মেঘের মাথায় কিছুই ঢুকলো না। মেঘের মনে- মস্তিষ্কে শুধু একটায় চিন্তা, আবির ভাইয়ের মুখে “ভালোবাসি” শব্দটা শুনা সেটা যেকোনো মূল্যেই হোক।

মেঘরা চলে যেতেই তামিম মিনহাজকে প্রশ্ন করল,
“তোর মনে কি চলছে বল তো!”

মিনহাজ উল্টো প্রশ্ন করল,
“কেন?”

“তুই মেঘকে উস্কাচ্ছিস যাতে আবির ভাইয়ার মনের ভাব জানতে পারে। কাহিনী কি?”

মিনহাজ গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“আমি মেঘকে পছন্দ করি, ওর প্রতি বেধক অনুভূতিও আছে কিন্তু ওর মনে আমার জন্য বিন্দুমাত্র কিছু নেই। ওর মস্তিষ্কে আবির ভাইয়া ছাড়া কিছুই নেই। এ অবস্থায় আমি যত চেষ্টায় করি ওর মনে আমার জায়গা করতে পারবো না। দেখলি তো আবির ভাইয়া আমায় ব্লক দিয়েছে এই খুশিতে সেদিন সবাইকে চকলেট দিল। এমতাবস্থায় আমি কোনোকিছু আশায় করতে পারি না।”

তামিম বিস্ময় সমেত তাকিয়ে বলল,
“তাহলে তুই তোর অনূভুতি কোরবান করে মেঘকে আবির ভাইয়ার সঙ্গে মিলিয়ে দিতে চাচ্ছিস?”

মিনহাজ রাশভারি কন্ঠে পুনরায় বলল,
“হতে পারে তাই আবার উল্টোটাও হতে পারে। ”

“যেমন?”

মিনহাজ লম্বা করে শ্বাস টেনে বলা শুরু করল,
“দেখ, মেঘ প্রায় ৯ মাস যাবৎ আবির ভাইয়াকে পছন্দ করে। আমাদের সাথে ওর বন্ধুত্ব প্রায় ৪-৫ মাসের। তারমানে আমাদের সাথে পরিচয়ের আরও ৪-৫ মাস আগে থেকে মেঘ ওনাকে পছন্দ করে। মেঘ যথেষ্ট কিউট আর লক্ষী একটা মেয়ে৷ যে কেউ এক দেখায় ওর প্রেমে পরবে। সেখানে ওনি তো এক বাড়িতে থাকেন। এই ৯ মাসেও কি ওনি মেঘকে খেয়াল করেন নি? অবশ্যই করেছেন এবং মেঘের অনুভূতিও বুঝেছেন। তবে প্রকাশ করছেন না! কেনো? হতে পারে ওনার জীবনে অন্য কেউ আছে। ওনি তার সাথে কমিটেড আবার মেঘের প্রতিও ওনার সফ্ট কর্নার আছে। এজন্য আমি মেঘের মাধ্যমে আবির ভাইয়াকে উস্কাচ্ছি। এই সুযোগে মেঘের সাথে আমার রেগুলার কথা হচ্ছে এবং সম্পর্ক গাঢ় হচ্ছে। বাই চান্স আবির ভাই রেগে মেঘের উপর রিয়েক্ট করলে মেঘ আমাকেই বলতে আসবে। তখন আমি ওকে বুঝিয়ে শুনিয়ে আমার দিকে আকৃষ্ট করবো।”

তামিম শুকনো ঢোক গিলে বলল,
“ভাবতে অবাক লাগছে তুই আমার বন্ধু! এত চিকন বুদ্ধি নিয়ে ঘুমাস কিভাবে? ”

মিনহাজ খিকখিক করে হেসে উঠলো, হাসতে হাসতে বলল,
“তুই ই বলছিলি ওনারা ইচ্ছেকৃত ওনাদের অবস্থান বুঝাতে আমাদের মেঘের বার্থডে তে ডেকেছিল। আবির ভাইয়া প্ল্যান করতে পারলে আমি কেন পারব না ”

“আর যদি আবির ভাই মেঘকে ভালোবাসি বলে দেন। তখন কি করবি?”

“তখন মেঘের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলবো। তবুও বিষয়টার সমাধান হওয়া দরকার। ”

(scsalma90)

★★★★★

সপ্তাহ কেটে যাচ্ছে অথচ মেঘের ব্যবহার অপরিবর্তিত। আবিরকে এড়িয়ে চলা, আবির কে দেখিয়ে দেখিয়ে ফোনে কথা বলা, ইচ্ছেকৃত খোঁচানো সবই চালাচ্ছে। আবির দু একবার মেঘের সঙ্গে কথাও বলতে চেয়েছে কিন্তু মেঘের ব্যস্ততা আর পাত্তা না দেয়ায় আবির আর কিছু বলে নি। মেঘকে মেঘের মতোই ছেড়ে দিয়েছে।

তানভির আজ এমপির সাথে একটা পোগ্রামে ব্যস্ত। সকালে না খেয়ে বেড়িয়েছিল। আবির দুপুর পর্যন্ত আব্বুর অফিসের কাজ শেষ করে বিকেলে নিজের অফিসে আসছে। গুরুত্বপূর্ণ একটা মিটিং আছে, সকালে থাকতে পারবে না বলে মিটিং বিকেলে রেখেছিল। ইদানীং মেঘের উড়নচণ্ডী চলাচলে আবিরের মনের সাথে সাথে কাজেও তার প্রভাব পরছে। মিটিং গত সপ্তাহে হওয়ার কথা ছিল আবির সেটা পেছাতে পেছাতে আজ পর্যন্ত টেনে এনেছে। আব্বু চাচ্চুর সামনে স্ট্রং ভাবে কাজ করলেও নিজের অফিসে এসেই সম্পূর্ণ ভেঙে পরে। আজ নিজেকে শক্ত রাখতে ফোন বন্ধ করে ড্রয়ারে রেখে দিয়েছে। নিজের রুম ছেড়ে ল্যাপটপ নিয়ে রাকিবের রুমে কাজ করছে৷ রাসেল দুপুর পর্যন্ত অফিস করেছে। আজ তার গার্লফ্রেন্ডের জন্মদিন তাই দুপুরের দিকে চলে গেছে। প্রায় ২ ঘন্টা আবিরদের মিটিং চলল। মিটিং শেষে রাকিব বের হতে হতে পকেটে থেকে ফোন বের করতেই দেখলো রাসেল ১০ বার কল দিয়েছে। রাকিব কল ব্যাক করতেই রাসেল আতঙ্কিত কন্ঠে বলল,

“ঐ আবির কই। আবির কে তাড়াতাড়ি নেটে আসতে বল। ”

“কেন কি হয়ছে। ”

“তুই আবিরকে বল”

বলেই রাসেল কল কেটে দিয়েছে। রাকিব আবিরকে বলা মাত্র আবির রুমে গিয়ে ফোন খুলে নেটে ঢুকতেই রাসেলের মেসেজ আসছে সাথে ছবিও । ছবিতে চাপ দিতেই দেখল, মিনহাজ বেশকয়েকটা লাল গোলাপ হাতে হাঁটু গেড়ে বসে মেঘের সামনে ফুল ধরে রেখেছে। মেঘ ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে। বন্যা, মিষ্টি, সাদিয়া, লিজা, তামিম সবাই পাশে দাঁড়ানো। ছবি টা দেখা মাত্র আবির ধপ করে চেয়ারে বসে পরেছে। রাকিব ক্লাইন্ডদের সাথে কথা বলায় ব্যস্ত। আবির কয়েক মুহুর্তের মধ্যে বাইকের চাবি নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। রাকিব পেছন থেকে ডেকে বলল,

“কোথায় যাচ্ছিস?”

আবির উত্তর না দিয়ে বেড়িয়ে গেছে। রাসেলকে কল দিয়ে জায়গা টা জেনে দ্রুত পৌঁছালো সেখানে। মেঘদের কাছাকাছি গিয়ে বাইকের ব্রেক কষল। মেঘরা সবাই গোল মিটিং করে বসে চা খাচ্ছিলো। মিনহাজের হাতে এখনও একগুচ্ছ লাল গোলাপ। রাসেল আর তার গার্লফ্রেন্ড কিছুটা দূরেই বসে ছিল। আবির মেঘদের কাছে আসতেই সবাই মাথা উঁচু তাকালো। চায়ের কাপ সাইডে রেখে সবাই একসঙ্গে দাঁড়ালো। মেঘ আবিরের শ্যামবর্ণের চেহারার পানে চেয়ে আছে, সহসা হৃদপিণ্ডের ধুকপুকানি বেড়ে গেছে সাথে মনের ভেতরের খুঁচখুঁচ লেগেই আছে। আবির চোখ বুঁজে দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে দু কদম এগিয়ে মেঘের ঠিক সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। মেঘ কিয়ৎক্ষণ আহাম্মকের মতো চেয়েই রইলো কিছুই বললো না। আবির প্রখর নেত্রে মেঘের চোখের দিকে তাকিয়ে বাজখাঁই কন্ঠে প্রশ্ন করল,
“এখানে কেন আসছিস?”

মেঘের অনিচ্ছা সত্বেও ঠোঁটে মিষ্টি হাসি রেখে স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
“আড্ডা দিতে।”

আবির পুনরায় প্রশ্ন করল,
“শুধুই আড্ডা দিতে?”

“জ্বি”
মেঘের কন্ঠস্বরে নিরুত্তাপ ভাব দেখে আবিরের মেজাজ চরম লেবেলের খারাপ হচ্ছে। বার বার চোখে সেই ছবিটা ভাসছে। আবির রাগান্বিত কন্ঠে বলল,

“সত্যি কথা বল মেঘ। ”

মেঘ নিরুত্তর। মিনহাজ স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
“ভাইয়া, মেঘ কিছু বলবেন না”

আবির ঘাড় ফিরিয়ে রক্তাভ চোখে তাকালো মিনহাজের দিকে। কন্ঠে অগ্নি ঢেলে হুঙ্কার দিয়ে উঠলো,
” Stop your mouth. আমি তোমার সঙ্গে কথা বলতে এখানে আসি নি। আজ আমার আর মেঘের মাঝে কেউ একটা টু শব্দ করলে তার লা*শ পরবে এখানে।”

আবিরের লাল চোঁখ জোড়া দেখে মিনহাজ দৃষ্টি নামিয়ে নিল। বন্যাসহ সবাই মাটির দিকে তাকিয়ে আছে। আবিরের হুঙ্কারে ভয়ে সবকটা কাঁপছে। ওদের অবস্থা দেখে আবির নিজেকে শান্ত করার ব্যর্থ চেষ্টা করল। কিন্তু ভেতরের ক্রোধের কাছে হার মানতো বাধ্য হলো। আবিরের এমন কান্ডে মেঘ অবাক চোখে তাকিয়ে আছে, তিরতির করে কাঁপছে ঠোঁট, বুকের ভেতর হৃদপিণ্ডটা দিগবিদিক ছুটছে, ভয়ে ঢোক গিলল। আবির মেঘের চোখে চোখ রেখে কন্ঠ চারগুণ ভারী করে শুধালো,

“তুই ঐ ছেলেকে পছন্দ করিস? হ্যাঁ কি না?”

মেঘ নিরেট দৃষ্টিতে আবিরের দিকে তাকিয়ে আছে। বার বার ঢোক গিলছে। কিছু বলতে পারছে না। মেঘ সহসা তাকালো ওদের দিকে। মিষ্টিরা চোখে ইশারা দিয়ে হ্যাঁ বলতে বলল। আবির ভাইয়ের মনের কথা জানার এর চেয়ে উত্তম উপায় আর নেই। মেঘের শ্বাস আঁটকে যাচ্ছে। শ্বাসনালীতে তুফান চলছে। কি করে বলবে এত বড় মিথ্যাটা৷

আবির মেঘের বাহুতে চেপে ধরে বাজখাঁই কন্ঠে চিৎকার করল,
“তাকা এদিকে।”

মেঘের দেহ আবারও কম্পিত হলো সঙ্গে সঙ্গে তাকালো আবিরের চোখের দিকে। রক্তাভ দু চোখ থেকে যেন আগুন বের হচ্ছে, সেই আগুনের মেঘের হৃদয় পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। মিনহাজদের শেখানো প্রতিটা কথা মেঘের মাথায় ঘুরছে। আবির ভাইয়ের মনের কথা জানতে হলে মিথ্যাটা বলতেই হবে। মেঘ ঢোক গিলে ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

“হ্যাঁ”

আবির সহসা মেঘের বাহু ছেড়ে দিয়েছে। কয়েক মুহুর্ত মেঘের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো। কপাল ঘামছে, আবির হাত দিয়ে কপালোর ঘাম মুছে ঘুরে গিয়ে বাইকে বসে বাইক স্টার্ট দিল। রাসেল আবিরকে থামানোর অনেক চেষ্টা করেছে কিন্তু আবির বাইক থামানোর অবস্থায় নেই। আবির চলে গেছে, মেঘ অকস্মাৎ মাথা ঘুরে পরতে নিলে বন্যা তাড়াতাড়ি মেঘ কে জড়িয়ে ধরে। আবিরের সামনে মেঘ যতই শক্ত কন্ঠে কথা বলুক না কেন ভেতরের কম্পনের কাছে সব হার মানতে বাধ্য। মেঘ অজ্ঞান হয়ে বন্যার কোলে শুয়ে আছে। মিষ্টিরা পানি এনে মেঘের চোখেমুখে পানি ছেটাচ্ছে। এরমধ্যে রাকিব আসছে, আবির কল না ধরায় রাকিব রাসেলকে কল দিয়েছিল রাসেল সবটা বলাতে রাকিব সঙ্গে সঙ্গে অফিস ছুটি দিয়ে রওনা দিয়েছে। তানভিরকেও সব জানিয়েছে। রাকিব বাইক থাকিয়ে আতঙ্কিত কন্ঠে শুধালো,
“আবির কোথায়?”

“আবির চলে গেছে।”

“কোথায়?”

“জানি না।”

রাকিব উদ্বিগ্ন কন্ঠে চেঁচিয়ে উঠল,
“তুই ওকে আটকাতে পারলি না।”

“ও কি আমার কথা শুনার মানুষ? চেষ্টা তো করেছি ”

ওদের কথোপকথনের মধ্যেই তানভির বাইক থেকে নেমে রাগান্বিত কন্ঠে বলল,
“ভাইয়া কোথায়?”

রাকিব মৃদু স্বরে বলল
“ও বাইক নিয়ে চলে গেছে। ”

তানভির আগপাছ না ভেবে মিনহাজকে এলোপাতাড়ি মাইর শুরু করলো। তামিম বাঁচাতে আসলে তামিমের গায়েও বেশ কিছু মাইর পরেছে। রাকিব, রাসেল তাড়াতাড়ি গিয়ে তানভিরকে টেনে হিঁচড়ে সরিয়ে আনলো। দুজনে মিলেও তানভির কে আঁটকে রাখতে পারছে না। মাইরের চুটে মিনহাজের হাতের ফুলগুলো মাটিতে পরে গেছে। মিনহাজের নাক দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। রাকিব আর রাসেল তানভিরকে শান্ত করে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“তুই মেঘকে নিয়ে বাসায় যা।”

তানভির মেঘকে ধমক দিতে গেলে রাকিব সঙ্গে সঙ্গে ভারী কন্ঠে বলল,
“তানভির, মেঘকে কিছু বলবি না।চুপচাপ বাসায় নিয়ে যা।”

তানভির দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বন্যার দিকে একপলক তাকালো। রাগ আর ক্রোধ যেন বেড়িয়ে আসতে চাইছে। ঘুরে যেতে নিলে ফুলগুলোর দিকে তানভিরের নজর পরে। সঙ্গে সঙ্গে পায়ের জুতা দিয়ে টকটকে গাল গোলাপ গুলো পিষে ফেলেছে। মিষ্টিরা চোখ নামিয়ে সেই দৃশ্য দেখলো। কেউ চোখ তুলে তানভিরের মুখের দিকে তাকাতে পারছে না কেউ। তানভির বাইকের কাছে যেতে যেতে মিনহাজদের দিকে তাকিয়ে রাগান্বিত কন্ঠে হুঙ্কার দিল,

” আমি এখন চলে যাচ্ছি ঠিকই কিন্তু আমার ভাইয়ের কিছু হলে তোদের খবর আছে বলে দিলাম।”

তানভির বাইকে স্টার্ট দিয়ে মেঘকে উদ্দেশ্য করে ভারী কন্ঠে বলল,
“উঠ।”

রাকিব আবারও বলল,
“মেঘকে চুপচাপ বাসায় নামাইয়া দিবি। রাগ দেখাবি না বললাম।”

তানভির মিনহাজদের দিকে একবার তাকালো। গম্ভীর কন্ঠে রাকিববের উপর চেঁচিয়ে উঠল,

“আমার ভাইকে তাড়াতাড়ি খোঁজে বের করো। না হয় লা*শ ঘোম করার ব্যবস্থা করো। আমি আসছি।”

(চলবে)

#গল্পঃ_আমৃত্যু_ভালোবাসি_তোকে_
#পর্বঃ_৬০
#লেখিকাঃ_সালমা_চৌধুরী_

আবিরকে, রাকিব আর রাসেল মিলে কলের পর কল দিচ্ছে কিন্তু আবির একবারের জন্যও কল ধরছে না। প্রথম দিকে আবিরের ফোনে কল ঢুকলেও কিছুক্ষণ পরই আবির ফোন বন্ধ করে ফেলেছে। মিষ্টি, সাদিয়া আর লিজা একে অপরের দিকে অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছে। বন্যা বিড়বিড় করে বলল,
” তোদের সাবধান করেছিলাম, একবারের জন্যও কথা শুনলি না। ”

ওরা একসঙ্গে বলল,
“সরি দোস্ত। ”

রাকিব, মিনহাজ আর তামিমের দিকে তাকিয়েই দেখছে না। পাবলিক প্লেসে মারছিল বলে বাধ্য হয় তানভিরকে তখন আঁটকিয়েছিল রাকিব। না হয় তানভিরের সাথে সাথে রাকিবও দুটাকে পিটাইতো।ওদের প্রতি প্রায় ৫ মাসের ক্ষোভ জমে আছে রাকিবের মনে । রাকিবের কলিজার বন্ধু আবির, আবিরের সবকিছুতে রাকিব যেমন সবার আগে এগিয়ে আসে তেমনি আবিরও তাই। ছোট বেলা থেকেই ওদের ফ্রেন্ডশিপ অনেক স্ট্রং। সচরাচর দেখা যায় এক বন্ধু ঝগড়া লাগলে আরেক বন্ধু থামায় অথচ ওদের মধ্যে এমন সম্পর্ক যে একজন ঝগড়া লাগলে আরেকজন সঙ্গ দেয়। দুজন মিলে ঐ ছেলেকে মারে। কলেজ জীবনে রাকিব টুকিটাকি রাজনীতি করতো, কিন্তু আবিরের সেসবে কোনো ইন্টারেস্ট ছিল না। তবে রাকিবের সাথে যে ই লাগতে আসতো দুই বন্ধু মিলে ঐটার অবস্থা খারাপ করে ফেলতো। পরবর্তীতে কলেজের পরীক্ষায় রাকিবের রেজাল্ট খারাপ হওয়ায় আবির বুঝিয়ে শুনিয়ে রাকিবকে রাজনীতি থেকে সরিয়ে এনেছিল৷ এখনও কলেজের অনেক বন্ধুরা রাকিবকে লিডার বলে ডাকে। রাকিব আবিরকে কল দিয়েই যাচ্ছে, এই সুযোগে রাসেল চোখের ইশারায় মিনহাজ আর তামিমকে চলে যেতে বলল। কারণ তানভির যদি বাই চান্স আবার এখানে আসে আর মিনহাজদের সামনে পায় তাহলে এবার আর ওদের বাঁচানো যাবে না। তামিম মিনহাজকে নিয়ে চলে গেছে। রাকিব কিছুক্ষণ পর বিষয়টা খেয়াল করেছে তবুও রাসেলকে কিছু বলে নি। রাকিবের সব টেনশন এখন আবিরকে নিয়ে। শহরের আশেপাশে যত বন্ধু আছে একে একে সবাইকে কল দিয়ে জানিয়েছে। যাদের বাইক আছে তারা বাইক নিয়ে বেরিয়ে পরেছে। রাকিব এগিয়ে গিয়ে একটা রিক্সা ঠিক করে বন্যাকে বললো,
“তুমি বাসায় চলে যাও”

বন্যা “আচ্ছা” বলে চলে গেছে। রাকিব বাকিদের উদ্দেশ্যে রেগে বলল,

“তোমরা যাও এখন”

রাকিবের রাগী স্বর শুনে ওরাও মাথা নিচু করে চলে গেছে। পরিস্থিতি অস্বাভাবিক দেখে রাসেলের গার্লফ্রেন্ড চলে গেছে৷ রাকিব রাসেলকে নিয়ে বাইক স্টার্ট দিল। তানভির মেঘকে বাসার সামনে নামিয়ে দিয়েই চলে গেছে, একটা কথাও বলে নি। রাকিবরা প্রায় ১ ঘন্টা যাবৎ আনাচে কানাচে ঘুরছে অথচ আবির একেবারে নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে। কেউ আবিরের কোনো খোঁজ পাচ্ছে না।

বন্যা বাসায় গিয়েই মেঘকে কল দিল। মেঘ রিসিভ করতেই বলল,

“কিরে তুই ঠিক আছিস?”

মেঘ মৃদুস্বরে বলল,
“আমি ঠিক আছি কিন্তু আবির ভাইয়ের কোনো খোঁজ পাচ্ছি না। ”

“তুই আবির ভাইয়া কে কল দে”

“আমার ভয় লাগতেছে।”

“এখন ভয় লাগে কেন? এতদিন বারণ করার পরও তো একটু ভয় লাগলো না”

“আমি এখন কি করবো?”

” আবির ভাইয়াকে কল দে আর কিছু করতে হবে না। ”

” ওনি কি কল ধরবেন?”

“ধরবেন কি না সেটা দিলেই বুঝবি। তুই ওনাকে রাগাইছিস তোকেই শান্ত করতে হবে। ”

“আমি পারবো না। ভয় লাগতেছে। ”

“আর একটা কথা বললে তোর খবর আছে বলে দিলাম। মিনহাজ, মিষ্টিদের কথায় লাফানির সময় ভয় ডর কোথায় ছিল তোর?”

“আচ্ছা দিচ্ছি কল।”

বন্যার কল কেটেই মেঘ আবিরের নাম্বার বের করল। ভয়ে বুক কাঁপছে অবিরাম। ৫ মিনিট অপেক্ষার পর বুকে সাহস নিয়ে আবিরের নাম্বারে ডায়াল করল। আবিরের ফোন বন্ধ পেয়ে আঁতকে উঠলো মেঘ। বার বার কল দিতে লাগলো। ভয় আর দুশ্চিন্তা তিনগুণ বেড়ে গেছে। রাকিব, রাসেল, তানভির এদিকে মেঘ সবার একাধারে কল দেয়ার কারণে একবার নেটওয়ার্ক বিজি বলছে আবার বন্ধ বলছে। মেঘ আজ পর্যন্ত যতবার আবিরকে কল দিয়েছে কোনো সময় ফোন বন্ধ পায় নি আজই প্রথম আবিরের ফোন বন্ধ। মেঘ রাগের চোটে কান্না শুরু করে দিয়েছে। প্রায় ১৫ মিনিট একের পর এক কল করতে করতে অবশেষে একটু থামলো। ভয়ে ভয়ে কল করলো তানভিরকে। তানভির কল রিসিভ করতেই মেঘ উদ্বিগ্ন কন্ঠে শুধালো,
” আবির ভাইয়ের কোনো খোঁজ পেয়েছো ভাইয়া?”

তানভির ঢোক গিলে নিজেকে ধাতস্থ করে স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
” না, বাসায় আপাতত কিছু বলিস না।”

“আচ্ছা”

তানভির কল কেটে দিয়েছে। মেঘের টেনশনে হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে অথচ এখনও আবিরের কোনো খবর নেই৷ আজ বাসায় তেমন মানুষও নেই। মীমের নানু খুব অসুস্থ তাই মীমরা দুদিন হলো ওদের নানুবাড়িতে গেছে। ইকবাল খান মীমদের নিয়ে গেছেন এখনও বাসায় আসেন নি। হালিমা খান আর মালিহা খান বাসায় আছেন। আলী আহমদ খান অফিসে। মোজাম্মেল খান আজ সকালেই রাজশাহী গেছেন। মেঘ উপুড় হয়ে শুয়ে ফোনে আবিরের ছবি দেখছে আর অঝোরে কাঁদছে। মেঘের বর্তমান বয়সটায় দোষের৷ এই বয়সে এমন ঘটনা ঘটানো অস্বাভাবিক কিছু না। আবির ভাইয়ের প্রতি বেধক আবেগ, ভালোবাসি শুনার তীব্র আকাঙ্খায় যে যা বলেছে সব শুনেছে। নিজের করা ভুলের জন্য এখন খুব প্রস্তাচ্ছে। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হতে চললো কিন্তু আবিরের কোনো হদিস নেই। আলী আহমদ খান ৭ টার দিকে বাসায় ফিরেছেন। আলী আহমদ খান নিজেও আবিরকে ২-৩ বার কল দিয়েছেন। আবিরের ফোন বন্ধ পেয়ে বাসায় এসে মালিহা খানকে শুধালেন,

“আবির কি বাসায় আসছে?”

“এখনও আসে নি ”

“ওর ফোন বন্ধ কেন? তোমার সাথে কথা হয়েছে?”

“নাহ। হয়তো ফোনের চার্জ শেষ। তুমি দুশ্চিন্তা করো না”
আলী আহমদ খান অল্প নাস্তা করে শুয়ে পরেছেন। একটু পর মেঘের ফোনে আননোন নাম্বার থেকে কল আসলো। প্রথম বার রিসিভ করল না। দ্বিতীয় বার রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে রাকিব আতঙ্কিত কন্ঠে প্রশ্ন করল,
“আবির, কোথায় তুই?”

মেঘ স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
” আমি মেঘ৷ ”

“মেঘ আমি তোমার রাকিব ভাইয়া”

“জ্বি ভাইয়া, চিনতে পারছি। ”

রাকিব কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে জিজ্ঞেস করল,
“আবির কি বাসায় গেছে?”

মেঘ আকুল স্বরে বলল,
“এখনও আসে নি। ওনি কোথায় আছে ভাইয়া?”

রাকিব তটস্থ হয়ে বলল,
” আবির বাসায় যায় নি? তাহলে এই নাম্বার? ”

‘এটা আমার নাম্বার। ভাইয়া সীমটা আমায় দিয়েছিল ”

রাকিব শান্ত স্বরে বলল,
“ওহ আমি জানতাম না, সরি। আসলে এই সীম টা আগে আবির ইউজ করতো। দেশের বাহিরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত এটায় ওর নাম্বার ছিল। পরে নতুন সীম নিয়েছে। এত বছর যাবৎ নতুন সীম গুলোতেই যোগাযোগ করে আসছি। আজ ওর ফোন বন্ধ পেয়ে অনেক খোঁজে এই নাম্বার টা পেয়েছি৷ এই সীম তাহলে তোমায় দিয়ে দিছে!”

মেঘের মাথায় এবার আকাশ ভেঙে পরেছে। প্রায় ২-৩ বছর যাবৎ মেঘ এই সীম ইউজ করছে। ভেবেছে তানভিরের সীম তাই তেমন মাথাও ঘামায় নি। অথচ এই সীম আবির ভাইয়ের। এক মুহূর্তেই মেঘের চোখ অন্ধকার হয়ে আসছে। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। সামান্য ভালোবাসার কথা শুনার জন্য মেঘ এতটা উতলা হয়ে ছিল অথচ মেঘের সবকিছু জুড়েই আবিরের স্মৃতি জড়িয়ে আছে৷ আবির ভাই তাকে সবদিক থেকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে৷ মেঘ করুণ স্বরে বলল,
“ওনার খোঁজ পেলে আমায় জানাবেন, প্লিজ। ”

“অবশ্যই। রাখছি ”

রাকিব কল কেটে দিতেই মেঘ ফোন বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। নিজের উপর এত রাগ হচ্ছে যে কি করতে কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না। ফ্লোরে বসে দু’হাতে নিজের চুল মুষ্টিবদ্ধ করে ধরে অপরিচ্ছিন্নভাবে কেঁদেই চলেছে।

রাত প্রায় ৯ টার পর তানভির হঠাৎ হালিমা খানকে কল দিল। তানভিরের কথা শুনে হালিমা খান আর্তনাদ করে উঠলেন। তানভির কল কাটতেই হালিমা খান ছুটে গেলেন মালিহা খানের কাছে, মেঘকে অবিরত ডাকতে লাগলেন। মেঘ চোখ মুছে বেলকনিতে আসতেই দেখল বড় আব্বু, বড় আম্মু বাসা থেকে বেড়িয়ে যাচ্ছেন। হালিমা খান উদ্বিগ্ন কন্ঠে বললেন,

“মেঘ তাড়াতাড়ি আয়, আমাদের বের হতে হবে।”

“কোথায়?”

“তুই আয় আগে।”

মেঘ চিন্তিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“রেডি হতে হবে না? ”

“না। যেভাবে আছিস সেভাবেই চল।”

মেঘ দ্রুত নেমে আসলো। হালিমা খান বাসা তালা দিয়ে গাড়িতে বসলেন। মালিহা খান শীতল কণ্ঠে শুধালো,

“কে অসুস্থ? বললে না তো!”

মেঘ বুকটা ছ্যাত করে উঠল। বুকের ভেতরটা কেমন যেন মোচড় দিচ্ছে। ফোন টাও বাসায় ফেলে আসছে। আবির ভাইয়ের খোঁজ পায় নি এখনও। মেঘের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। কথা বের হচ্ছে না গলা দিয়ে। হালিমা খান স্বাভাবিক কন্ঠে বললেন,
” হাসপাতালে গিয়ে দেখি। ”

মালিহা খান আর্তনাদ করে উঠলেন,
“আমাদের কারো কিছু হয়েছে?”

হালিমা খান তানভিরকে কল দিয়ে হাসপাতালের ডিটেইলস নিয়েছে। মালিহা খানের কথার কোনো উত্তর দেন নি। জ্যাম পেরিয়ে হাসপাতালে আসতে আসতে ১০ টার উপরে বেজে গেছে। হাসপাতালের সামনেই রাকিব দাঁড়ানো ছিল৷ সবাই নামতেই রাকিব রাস্তা দেখিয়ে ভেতরে নিয়ে যাচ্ছে। মেঘ হাঁটছে ঠিকই তবে হাঁটায় কোনো গতি নেই। অক্লিষ্ট আঁখিতে মেঘ রাকিব ভাইয়াকে দেখছে। রাকিবের শার্টে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ লেগে আছে। দেখে বুঝা যাচ্ছে শার্ট টা ভেজা। মেঘের পা চলছে না, ভয়ে হাত-পা কাঁপছে। মাথা ঘুরছে, চোখে ঝাপসা দেখছে। কোনোরকমে ওদের পেছন পেছন একটা রুমের দরজা পর্যন্ত এসেই সবাই থমকে দাঁড়ালো। প্রাইভেট ক্লিনিকের একটা ছিমছাম রুমের বেডে বেহুঁশ অবস্থায় শুয়ে আছে আবির। মাথায় সাদা ব্যান্ডেজ, ডান হাতে, ডানপায়ে ব্যান্ডেজ করা। আবিরকে এ অবস্থায় দেখে ছুটে গিয়ে মালিহা খান আবিরকে ধরে বিলাপ শুরু করে দিয়েছেন। আলী আহমদ খান করুণ দৃষ্টিতে ছেলেকে কিছুক্ষণ দেখে আশপাশে নজর দিলেন৷ তারপর ভারী কন্ঠে রাকিবকে শুধালেন,
“কি হয়ছিল?”

“বাইক এক্সিডেন্ট করেছে।”

আলী আহমদ খান সঙ্গে সঙ্গে হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন,
” বাইক কিনার সময় ই বলছিলাম, এক বারের জন্যও আমার কথা মানলো না। ”

আলী আহমদ খান আবারও হুঙ্কার দিয়ে উঠল,
“তানভির কোথায়?”

রাকিব আস্তে করে বলল,
“ইম্পর্ট্যান্ট কাজে গেছে।চলে আসবে।”

“ওর কি এমন ইম্পর্ট্যান্ট কাজ? ”

রাকিব মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুই বলছে না। এদিকে মেঘ নিস্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে আছে, এক চুল নড়ছে না। মেঘের অবিক্ষিপ্ত আঁখি যুগল আবিরের পরিশ্রান্ত চেহারায় আঁটকে আছে। হালিমা খান, মালিহা খান অঝোরে কেঁদেই চলেছেন কিন্তু মেঘের চোখে এক ফোঁটা পানি নেই, পাথরের ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে, নেই কোনো অনুভূতি। তানভির হালিমা খানকে ফোন করে আগেই সবটা জানিয়েছিল,হালিমা খানকে শক্ত থেকে মেঘ সহ বড় আব্বু, বড় আম্মু কে নিয়ে আসতে বলছিল। তাই হালিমা খান বুকে পাথর চেপে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করেছেন। আবিরের জ্ঞান ফিরছে না, ডাক্তার বলেছেন মাথায় চাপ খাওয়ায় ঘন্টা কয়েক সময় লাগবে। আপাতত হাসপাতালেই রাখতে বলেছেন। এরমধ্যে তানভির আসছে। হালকা রঙের শার্ট টা রক্তের দাগে কালো খয়েরী রঙ ধারণ করেছে। দুহাতে, পায়ে, গায়েও রক্ত লেগে আছে৷ কিছু রক্তের দাগ শুকিয়ে গেছে আর কিছু দাগ এখনও ভেজা। এক্সিডেন্ট এর খবর শুনে তানভির সবার আগে আবিরের কাছে পৌছেছিল৷ রাস্তায় স্প্রীড ব্রেকারের কাছে আবিরের রক্তাক্ত দেহ নিথর হয়ে পরে ছিল৷ টকটকে লাল রক্তে অর্ধেক রাস্তা ভরে গিয়েছিলো। তানভির আবিরকে একায় এম্বুলেন্সে উঠিয়ে হাসপাতাল পর্যন্ত নিয়ে আসছে। হাসপাতালে রাকিব আর রাসেল আগে থেকেই উপস্থিত ছিল। রাকিব আর তানভির মিলে আবিরকে ইমার্জেন্সি ওয়ার্ডে নিয়ে গিয়েছিল। আবিরের চিকিৎসা শুরু করা মাত্র তানভির এই অবস্থাতেই হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে গেছে। আবিরকে রুমে দেয়ার পরপরই রাকিব রাসেলকে বাসায় পাঠিয়েছে, রাকিবের টিশার্ট আর অন্যান্য কিছু জিনিস নিয়ে আসছে। তানভির রুমে ঢুকতেই আলী আহমদ খান হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন,

“কোথায় ছিলে?”

তানভির শার্টের হাতার ফোল্ড খুলতে খুলতে গম্ভীর স্বরে বলল,
“কাজ ছিল।”

“তোমার ভাইকে একা ফেলে যাওয়ার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল?”

তানভির রাগী স্বরে বলল,
“হয়তো।”

তানভির হালিমা খানকে আগেই বাসা থেকে ড্রেস আনতে বলেছিল। তানভির ব্যাগ থেকে একটা টিশার্ট আর প্যান্ট বের করে ওয়াশরুমে চলে গেছে। আলী আহমদ খান পাশে একটা চেয়ারে দুহাতে মাথা চেপে ধরে বসে আছেন। একমাত্র ছেলে এক্সিডেন্ট করে হাসপাতালে অজ্ঞান অবস্থায় পরে থাকলে কোনো বাবা মা ই ঠিক থাকতে পারেন না। এরমধ্যে মোজাম্মেল খান কল দিয়েছেন। আলী আহমদ খান ফোন রিসিভ করতেই মোজাম্মেল খান স্বাভাবিক কন্ঠে বললেন,
“ভাইজান, কেমন আছো?”

“আলহামদুলিল্লাহ। তুই কেমন আছিস?”

“আলহামদুলিল্লাহ। বাসার সবাই কেমন আছে?”

“কেমন আর থাকবে। তোর ভাতিজা এক্সিডেন্ট করে হাসপাতালে পরে আছে। ”

“কে আবির?”

“হ্যাঁ”

“কবে? কিভাবে?”

“আজকেই,কিছুক্ষণ আগে। কিভাবে এক্সিডেন্ট করছে এটা ছেলের জ্ঞান ফিরলে বলতে পারবো। এখনও জ্ঞান ফিরে নি।”

“আমি রওনা দিব এখন?”

“নাহ। ডাক্তার বলছেন তেমন সমস্যা নেই। কয়েক ঘন্টার মধ্যে জ্ঞান ফিরবে। তাছাড়া কাল পরশু নাগাদ হয়তো বাসায় নিয়ে যেতে পারব। তুই কাজ শেষ করেই আয়।”

“আচ্ছা। তানভিরের কি অবস্থা? ”

“ওর অবস্থা আমি বলতে পারবো না। আবিরকে হাসপাতালে এনে কোথায় গেছিলো কে জানে মাত্র আসছে। ”

“তোমরা সাবধানে থেকো। আর আমি তানভিরের সাথে কথা বলে নিব।”

রাত ১২ টা বাজতে চললো আবিরের এখনও জ্ঞান ফিরে নি৷ তানভির আর রাকিব হাসপাতালের বেলকনিতে বসে আছে। মেঘ আবিরের পায়ের কাছে বসে আছে, হালিমা খান, মালিহা খান দুজনেই আবিরের পাশে বসে আছেন।তানভির রুমে এসে স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
“তোমাদের এখানে থাকতে হবে না। আমি আর রাকিব ভাইয়া আছি। কোনো সমস্যা হলে জানাবো।”

মালিহা খান সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন,
“আমি যাব না এখানেই থাকবো। আবিরের জ্ঞান ফিরবে কখন?”

“ডাক্তার বলছেন একটু সময় লাগবে৷ অপেক্ষা করা ছাড়া আমাদের হাতে আর কোনো উপায় নেই। ”

“জ্ঞান না ফিরলে আমি বাসায় যাব না। ”

“বড় আম্মু প্লিজ এমন করো না। তুমি অসুস্থ তাছাড়া বড় আব্বুরও পর্যাপ্ত রেস্ট নেয়া দরকার। তোমরা বাসায় গিয়ে ঘুমাও। সকালে রান্না করে খাবার নিয়ে এসো।”

মালিহা খানের আপত্তি স্বত্বেও তানভির হালিমা খানকে চোখের ইশারায় বুঝালো, ওনাদের নিয়ে যাওয়ার জন্য। মেঘ মাথা নিচু বসে আছে। তানভির মেঘকে উদ্দেশ্য করে ঠান্ডা কন্ঠে বলল,
“আম্মুরা বাসায় যাচ্ছে তুই ও বাসায় চলে যা। ”

মেঘ মাথা নিচু করেই উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলল,
“আমি কোথাও যাব না।”

” সমস্যা নেই, আমরা আছি, তুই বাসায় যা।”

“আমিও থাকবো।”

তানভির শক্ত কন্ঠে বলল,
“মেঘ”

মেঘের চোখ টলমল করছে, চোখ তুলে তাকালো তানভিরের দিকে৷ করুণ স্বরে বলল,
“প্লিজ ভাইয়া, আমি থাকি। ”

তানভির গম্ভীর কণ্ঠে মেঘকে বুঝানোর চেষ্টা করল৷ কিন্তু মেঘ যাবে না মানে যাবেই না। বাধ্য হয়ে তানভির আম্মু, বড় আম্মু আর বড় আব্বুকে বুঝিয়ে শুনিয়ে গাড়ি পর্যন্ত দিয়ে আসছে। হালিমা খান মেঘকে নিয়ে যেতে চাইলে তানভির স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,

“বনু থাকতে চাচ্ছে থাকুক। তাছাড়া তোমরা তো সকালে আসবেই। তুমি বড় আব্বু আর বড় আম্মুর খেয়াল রেখো৷ ”

“ঠিক আছে। সাবধানে থাকিস। আর মেঘকে দেখে রাখিস৷ ”

“আচ্ছা যাও তোমরা। ”

ওরা চলে যেতেই বন্যার নাম্বার থেকে তানভিরের ফোনে কল আসছে। তানভির কল রিসিভ করতে করতে ভেতরে গেল।

বন্যা উতলা হয়ে শুধালো,
“আবির ভাইয়া কেমন আছেন? ”

“আমার ভাইয়ের খবর নেয়ার কি দরকার। চিন্তা করো না, তোমাদের আশা পূরণ হয়েছে।”

“মানে?”

“ভাইয়া এক্সিডেন্ট করে এখন হাসপাতালে ভর্তি আছে। ”

“কি বলছেন এসব!”

“তোমরা তো এটায় চাইছিলে।”

বন্যা মলিন স্বরে বলল,
“বিশ্বাস করুন আমি এমন কিছু চাই নি। ওরা মজা করছিল আর.. ”

তানভির হুঙ্কার দিল,
“তুমি ওখানে কি করছিলে? তুমি মেঘকে বারণ করতে পারলে না?”

“ও আমার কথা শুনে নি। আমি বারণ..”

“কিসের বেস্ট ফ্রেন্ড তুমি? বারণ করা স্বত্তেও বনু তোমার কথা অমান্য করে কিভাবে?”

বন্যা আস্তে করে বলল,
“মেঘ কোথায়?”

“আছে৷ ”

“ও কে একটু দেয়া যাবে?”

” কি দরকার? কথা যখন মানাতেই পারো নি তাহলে এখন আর কথা বলতে হবে না।”

“একটু দরকার ছিল। ”

“কি দরকার আমায় বলো।”

“মিনহাজ আর তামিমকে ফোনে পাচ্ছি না৷ ওদের সাথে মেঘের কথা হয়েছে কি না জানতাম।”

“মিনহাজ আর তামিম যেখানে থাকার সেখানেই আছে। বনুর সাথে কথা হয় নি। শান্তি?”

“মানে? কি করেছেন ওদের?”

“যা করার তাই করেছি। আগামী তিনদিন তাদের কোনো খোঁজ পাবে না। ”

“কি বলছেন কি এসব? কি করেছেন ওদের? ওরা কোথায়?”

“ওদের প্রতি ভীষণ দরদ দেখা যাচ্ছে! তোমার যদি দুদিনেই বন্ধুত্বের সম্পর্কের প্রতি দরদ উথলায় পড়ে তাহলে ভাবো ওদের জন্য আমার ভাই এক্সিডেন্ট করছে। যে ভাইয়ের সাথে আমার রক্তের সম্পর্ক, জন্মের পর ২৪ বছর যাবৎ ভাইয়ার ছায়ায় আমি বড় হয়েছি। ভাইয়া আমার জীবনে বন্ধুর থেকেও কয়েকগুণ বেশি কিছু৷ ফারদার যদি বন্ধুদের খোঁজ নিতে আমায় কল করেছো তাহলে তোমার খবর আছে বলে রাখলাম”

তানভির কল কেটে মেঘের কাছে আসছে৷ মেঘ তখনও আবিরের পায়ের কাছেই বসে ছিল। তানভির রুমে এসে তপ্ত স্বরে বলল,
“তুই ভাইয়ার কাছে থাক। আমি আর রাকিব ভাইয়া বাহিরে আছি। কোনো ধরনের সমস্যা হলে ডাকিস। ”

“আচ্ছা। ”

তানভির রুমের লাইট অফ করে একটা ড্রিম লাইট জ্বালিয়ে দিয়ে যেতে নিয়ে আবার পেছন ফিরে তাকিয়ে বলল,
“দরজা টা ভেতর থেকে বন্ধ করে দে।”

তানভির চলে যেতেই মেঘ এগিয়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল। হালকা সবুজ রঙের আলোতে আবিরের মুখের পানে তাকিয়ে রইলো মেঘ। নিস্তব্ধ পরিবেশে আবিরকে দেখে ভেতর ফেটে কান্না আসছে মেঘের। আচমকা আবিরের পাশে বসে আবিরের বুকের উপর মাথা রেখে কাঁদতে শুরু করেছে। দীর্ঘসময় ধরে অঝোরে কাঁদছে, মেঘের চোখের পানিতে আবিরের বুক ভিজে গেছে। কত সময় ব্যাপী মেঘের গভীর ক্রন্দন চললো তা জানা নেই। শ্বাস ছেড়ে কান্নারত অবস্থায় বলতে শুরু করল,

“আমি মিনহাজকে পছন্দ করি না। একটুও করি না। আপনাকে ছাড়া আমি কাউকে পছন্দ করি না। আপনি আমার জীবনের প্রথম এবং একমাত্র ভালোবাসা। আবির ভাই কে ছাড়া মেঘ একেবারে নিঃস্ব । বিশ্বাস করুন, আমি আপনাকে অনেক ভালোবাসি৷ আপনাকে আমি এভাবে দেখতে চাই নি। আমি শুধু আপনার মুখে ভালোবাসি শব্দটা শুনতে চেয়েছিলাম আর কিছুই চাই নি আমি। মিনহাজরা আমায় বুঝিয়েছিল আমি এমন আচরণ করলে আপনি আমায় ভালোবাসি বলবেন, আপনার মনের কথা আমায় জানাবেন৷ ওদের কথা মেনে আমি আপনার সাথে উল্টাপাল্টা আচরণ করছি। আমায় মাফ করে দেন প্লিজ৷ আমি আর জীবনেও কারো কথা শুনবো না৷ আপনি ভালো না বাসলেও আমি কোনোদিন বাড়াবাড়ি করবো না। আমি সারাজীবন আপনাকে এক তরফা ভালোবাসবো। কোনোদিন কোনো অধিকার দেখাবো না। আপনি সুস্থ হয়ে উঠুন প্লিজ। আপনি অসুস্থ থাকলে আপনার চড়ুই এর কি হবে!”

কিছুক্ষণ চুপ থেকে মেঘ আবার বলতে শুরু করলো,

“ছোট বেলা আপনি আমায় একটা থাপ্পড় দিয়েছিলেন বলে আমি আপনার সাথে দিনের পর দিন কথা বলি নি৷ আপনি অনেক চেষ্টা করেছেন তবুও আমি বলি নি। আপনি তারপরও আমায় নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসেই গেছেন। দেশে ফেরার সময় সবচেয়ে বেশি গিফট আমার জন্যই নিয়ে আসছেন৷ আপনি বাইক কিনে বাসায় আসার পর প্রথমবার আপনাকে দেখে আমার হৃৎস্পন্দন থেমে গেছিলো। সেদিন আমি প্রথমবারের মতো আপনার প্রতি দূর্বলতা অনুভব করেছিলাম। তারপর থেকে প্রতিদিন প্রতিক্ষণে আপনার প্রতি দূর্বল হতে শুরু করি। দেখতে দেখতে সেই দূর্বলতা কখন ভালোবাসায় পরিণত হয়ে গেছে আমি বুঝতেই পারি নি। আপনি আমার কাছাকাছি থাকলে আমার আকাশে রংধনু উঠে, মনটা প্রজাপতির মতো ঘুরে বেড়ায়৷ আপনি দূরে চলে গেলেই মনের উঠোনে বৃষ্টি নামে৷ ক্ষণে ক্ষণে আপনি নিজের অজান্তেই আমায় নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করেছেন। আপনি হয়তো জানেন ও না আপনাকে দেখার জন্য প্রতিদিন কত ঘন্টা বেলকনিতে অপেক্ষা করি, কত রাত নির্ঘুম কাটায়। আপনার এক ঝলক হাসি দেখার জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা আপনার অভিমুখে চেয়ে থাকি। আপনার প্রতি এতবছরের ক্রোধ কয়েক মাসেই কিভাবে যেন প্রণয়ে রূপ নিয়েছে। এখন রাগ করলেও সেই রাগ বেশিসময় স্থির হয় না। আপনার একটু যত্নেই সব ভুলে যায়। কিন্তু সব ভুলে গেলেও আপনার আশেপাশে কোনো মেয়ের ছায়া আমি কোনোভাবেই সহ্য করতে পারি না৷ মালা আপু,এমপির মেয়ের আচরণে আমায় যতটা রাগিয়েছিল তার থেকে কয়েকগুণ বেশি কষ্ট পেয়েছিলাম, যেদিন আপনি বলেছিলেন আপনি বিবাহিত, একটা বাচ্চা আছে। তখন ২ রাত আমি শুধু কেঁদেই ছিলাম। আপনার অনাদেয় কর্মকাণ্ড আর কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণে ক্ষুদ্ধ হয়ে মিনহাজদের তালে তাল মিলিয়েছিলাম। আপনার অধিকারবোধ আমায় বরাবরই আকৃষ্ট করে। তবে আজ কেন অধিকার দেখান নি? আমি আপনার কথায় “হ্যাঁ” বলেছিলাম যাতে আপনি আপনার মনের ভাব প্রকাশ করতে পারেন। আপনি তখন আমায় দুটা থাপ্পড় দিয়ে কেন কিছু বললেন না। কেন আপনি নিশ্চুপ থেকে নিজের ক্ষতি করেছেন?”

মেঘের কান্না ধীরে ধীরে কমে এসেছে তবে এখনও ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাদঁছে৷ আবিরের বুকে মাথা রেখেই দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
” আজকের পর আর কোনোদিন কোনোপ্রকার বাড়াবাড়ি করবো না। আপনি যেভাবে চান, আমি সেভাবেই চলবো। আপনার ভালোবাসা আদায় করতে আর উঠেপড়ে লাগবো না। আপনি ভালোবাসলেও আমি আপনার, আপনি ভালো না বাসলেও আমি আপনার। তবুও প্লিজ সুস্থ হয়ে উঠুন। ”

গভীর রাত পর্যন্ত মেঘ আবোলতাবোল বলেই গেছে, আর আবিরকে ডেকেছে। ধীরে ধীরে মেঘ শান্ত হয়ে গেছে। ক্লান্তিতে আবিরের বুকে মাথা রেখে, দু’হাতে জড়িয়ে ধরা অবস্থাতেই ঘুমিয়ে পরেছে। ১ মিনিট, ২ মিনিট, ৫ মিনিট পর ঘুমের মধ্যে মেঘের নিঃশ্বাস ভারী হয়ে গেছে। সহসা পিটপিট করে চোখ মেলল আবির। জ্ঞান ফিরেছে অনেকক্ষণ আগে, প্রেয়সীর আবেগজড়িত অনুদ্বিগ্ন অনুভূতি শুনতে ইচ্ছে করেই চোখ বন্ধ করে রেখেছিল৷ আবির চোখ নামিয়ে তাকালো মেঘের ক্রন্দিত মুখের পানে। মৃদু আলোতে আবিরের প্রেয়সীকে দেখলো খানিকক্ষণ। সহসা চোখ বন্ধ করে লম্বা করে শ্বাস ছাড়লো।

এটা প্রথমবার নয়৷ মেঘ আবিরের জন্য প্রথমবার যখন কেঁদেছিল তারপর ১ সপ্তাহ গলা দিয়ে কথা বের হয় নি মেঘের। তখন মেঘের বয়স ৫ কি ৬ আর আবিরের বয়স ১২ কি ১৩ চলে। আবির তখন হঠাৎ করে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পরেছিল। টানা ১৫ দিনে উপরে অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি ছিল। অবুঝ মেঘের জীবনে আবির তখন একমাত্র খেলার সঙ্গী ছিল। আবির আর তানভিরের বয়সের পার্থক্য ২ বছর হওয়ায় তানভিরের স্মৃতি আবিরের মাথায় ছিল না। তবে মেঘ জন্মের সময় আবির ৭-৮ বছরের ছিল বিদায় মোটামুটি বুঝতো৷ প্রথম বোন হওয়ায় মেঘকে সর্বোচ্চ আদরে রেখেছে আবির৷ মেঘের আদো আদো কন্ঠের ডাক এড়িয়ে খেলতে যাওয়ার সাধ্যি ছিল না আবিরের। সারাক্ষণ বাড়িতেই মেঘের সঙ্গে খেলতো। মেঘ ঘুমালে খেলতে বের হতো ৷ ৭-৮ বছর বয়সের ছেলের চোখে মেঘ তখন বোন মানে বোন ই ছিল৷ মেঘকে বোন ব্যতীত অন্য কোনো নজরে দেখে নি আবির। ধীরে ধীরে আবির, মেঘ বড় হতে শুরু করেছে। আবিরের যত্নে মেঘ তখন থেকেই আবিরের প্রতি উন্মাদ ছিল। শিশুদের যারা বেশি আদর করে তারা তাদের সঙ্গেই বেশি সাচ্ছন্দ্য বোধ করে। হঠাৎ আবিরের অসুস্থতা ছোট্ট মেঘের মনেও গভীর আঘাত দিয়েছিল। আবির হাসপাতালে থাকাকালীন মেঘকে কেউ নিয়ে যায় নি ৷ ১৫ দিন পর আবিরের শারীরিক অবস্থা এতটায় দূর্বল হয়ে পরেছিল যে ডাক্তার চিকিৎসা চালাতেও হিমসিম খাচ্ছিলো। আবির কোনোকিছুতেই রেসপন্স করছিল না৷ হার্টবিট একেবারে কমে গেছিলো। কোনোকারণে ব্রেইনে প্রেশার পরেছিল। মৃত্যুর সময় অতি সন্নিকটে চলে আসছিলো৷ ডাক্তার সঠিক রোগ ধরতে পারছিল না, কোনো চিকিৎসা চলছিল না। নিরুপায় হয়ে ডাক্তার বাড়িতে জানিয়েছিল,
” আবির যদি নিজ থেকে রেসপন্স না করে তবে তাকে বাঁচানো সম্ভব হবে না।”

এই কথা শুনে বাড়ির সবাই হাসপাতালে হাজির হয়েছিল৷ সেদিন প্রথমবারের মতো ছোট্ট মেঘ আবিরের উপর উপুড় হয়ে পরে কেঁদেছিল। কাঁদতে কাঁদতে মেঘ বলছিল,

“ভাইয়া উঠো, আমার সাথে খেলবে না?”

মালিহা খান কেঁদে বলেছিলেন,
“তোর ভাই হয়তো আর কোনোদিন তোর সাথে খেলতে পারবে না”

ছোট্ট মেঘ তখনই হুঙ্কার দিয়ে উঠেছিল,
“চুপ করো, ভাইয়ার কিছু হবে না।”

আবিরকে শক্ত করে ঝাপ্টে ধরে আর্তনাদ করে বলেছিল,
“তোমার কিছু হলে আমার কি হবে! তুমি মরে গেলে কিন্তু আমিও মরে যাব। ভাইয়া উঠো। কথা বলো আমার সাথে।”

সবাই টেনেও মেঘকে আবিরের বুকের উপর থেকে উঠাতে পারে নি। মেঘ কাঁদতে কাঁদতে একটা কথায় বার বার বলছিল,
” তুমি মরলে আমায় নিয়ে মরবা। আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না। আমিও মরে যাব।”

মেঘের নিরন্তর কান্নায় হঠাৎ আবিরের জ্ঞান ফিরে, দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে পিটপিট করে তাকাতেই একে একে চোখে পরে বাবা, মা, চাচ্চু, মামনির কান্নারত মুখমণ্ডল সেই সাথে অনুভব করে পিচ্চি দুই হাতের স্পর্শ। আবিরের জ্ঞান ফেরায় সবাই যখন আবির কে ডাকছিল মেঘও দু’হাতে আবিরের দু গালে আলতোভাবে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলছি,

“ভাইয়া, কথা বলো। ওরা বলছে তুমি নাকি মরে যাবে। তুমি একবার বলো তোমার কিছু হবে না। ”

আবিরের কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল তবুও মেঘের কান্না দেখে মেঘের হাতে স্পর্শ করে অনেক কষ্টে বলেছিল,
“আমার কিছু হবে না।”

আলী আহমদ খান দ্রুত গিয়ে ডাক্তার নিয়ে আসছিলেন। ডাক্তার আবারও পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু করেন। আবিরের হার্টবিট আগের তুলনায় বেড়েছে দেখে ডাক্তার পুনরায় চিকিৎসা শুরু করেছেন। সেই থেকে আরও প্রায় ৭ দিন আবির হাসপাতালে ভর্তি ছিল। মেঘ একবারের জন্যও বাসায় যায় নি। সারাক্ষণ আবিরের মাথার কাছে বসে থাকতো।মেঘ ঘুমালে বাসায় নিয়ে যাবে বলে আবিরকে জরিয়ে ধরে ই ঘুমাতো। ৭ দিন পর আবিরকে বাসায় নিয়ে আসছে। আবির আগের তুলনায় অনেকটায় সুস্থ হয়ে গিয়েছিল। বাসায় আসার পরও মেঘের আহ্লাদের কমতি ছিল না সারাক্ষণ আবিরকে দেখতো, আবির খেয়েছে কি না, ঔষধ খেয়েছে কি না, ঠিকমতো ঘুমাচ্ছে কি না সব নজর রাখায় যেন মেঘের একমাত্র দায়িত্ব ছিল। ১২-১৩ বছর বয়সের কিশোরের মনে হঠাৎ করেই মেঘের প্রতি অন্যরকম অনুভূতি জন্মাতে শুরু করল। জন্মের পর থেকে ৬-৭ বছর বয়স পর্যন্ত যাকে বোনের নজরে দেখে এসেছে হুট করেই তার প্রতি ভিন্ন এক টান অনুভব করতে শুরু করল। মেঘের আহ্লাদী কন্ঠে বলা প্রতিটা কথা আবিরের হৃদয় ছুঁয়ে যেতো। কিছুদিন পর আবির মোটামুটি সুস্থ হওয়ার পর একদিন সোফায় বসে টিভি দেখছিল। তখন মেঘ ছুটে এসে আবিরের পাশে বসতে বসতে বলছিল,

” ভাইয়া তুমি জানো তুমি সুস্থ হয়েছো কেন?”

“কেন?”

“আম্মুরা বলছে, তুমি শুধু আমার জন্য সুস্থ হয়েছো। আমি কান্না করছিলাম বলেই আল্লাহ তোমাকে সুস্থ করে দিয়েছেন৷ বুঝলা?”

আবির মলিন হেসে বলেছিল,
“এখন আমার কি করতে হবে?”

“তুমি সবসময় আমার সাথে খেলবা, আমায় ঘুরতে নিয়ে যাবে, আমাকে অনেক আদর করবা, আর কখনো আমায় ছেড়ে যেতে পারবা না। ”

আবির সেদিন মেঘের হাতে হাত রেখে গুরুতরভাবে বলেছিল,
“আজ,এই মুহুর্তে আবির মেঘকে কথা দিচ্ছে, আবির কোনোদিন তার মেঘকে ছাড়বে না। যাই হয়ে যাক না কেন, আবিরের প্রাণ মেঘেতেই সীমাবদ্ধ থাকবে।”

মেঘ বলেছিল,
“মনে থাকে যেন!”

আবির হেসে বলেছিল,
“তুই ভুলে গেলেও আমি কখনো ভুলবো না।”

সেদিন থেকে আবিরের মন মেঘেতে আঁটকে গেছে। আবির মেঘের টানে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছিল। মেঘের আহ্লাদী আবদার আবিরকে মেঘের প্রতি সিরিয়াস করেছিল৷ ধীরে ধীরে আবির বড় হতে শুরু করেছে সেই সাথে মেঘের সাথে দূরত্ব বেড়েছে। মেঘও তার ছোটবেলার স্মৃতি ভুলতে শুরু করেছে৷

এত বছর পর আবিরের মেঘ দ্বিতীয়বারের মতো আবিরের অসুস্থতায় এভাবে কাঁদছে। আবির গভীর ভাবনা শেষে চোখ মেলে তাকিয়ে আছে মেঘের অভিমুখে৷ মেঘ গভীর ঘুমে বিভোর হয়ে আছে। চোখের পানি এখনও গাল বেয়ে গড়িয়ে পরছে৷ আবির বামহাতে মেঘের গাল মুছে, আলতো হাতে চুলগুলো ঠিক করে দিল৷ বাকি রাত আবিরের নির্ঘুম কেটেছে। আবিরের বুকে শুয়ে আছে আবিরের কাদম্বিনী, আবির অপলক দৃষ্টিতে ক্ষুদ্র আলোতে তার কাদম্বিনীকে দেখেই রাত কাটিয়ে দিয়েছে । ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে এমন সময় আবির ঘুমিয়েছে। তার ঘন্টাখানেক পর আচমকা মেঘের ঘুম ভাঙে। নিজেকে আবিষ্কার করে আবির ভাইয়ে প্রশস্ত বুকে। চোখ তুলে তাকায় আবিরের মুখের পানে। আবিরকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে উঠতে নিলে পিঠে ভারী কিছু অনুভব করে। ঘুমের মধ্যে চুলের খোঁপা খুলে এলোমেলো হয়ে গেছিলো, চুলের কারণে কিছু বুঝতে পারছে না। ঘাড় ঘুরিয়ে আড়চোখে তাকাতেই খেয়াল করলো, আবির বামহাতে মেঘের পিঠ বরাবর শক্ত করে ধরে রেখেছে যাতে ঘুমের মধ্যে মেঘ পড়ে না যায়। মেঘ বিপুল চোখে আবিরের হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। নিজের অজান্তেই মেঘের ঠোঁটে হাসি ফুটলো।

(চলবে)