আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব-১০০

0
23

#গল্পঃ_আমৃত্যু_ভালোবাসি_তোকে_
#পর্বঃ_১০০
#লেখিকাঃ_সালমা_চৌধুরী_

মেঘ বিমোহিত নয়নে মুন্নি আপুর মুখের পানে চেয়ে আছে। রূপকথার গল্পের মুগ্ধতায় ডুবে নিজের মাথা ব্যথার কথা বেমালুম ভুলে গেছে। যেখানে দুই বছরের প্রণয়ের পূর্ণতা পেতে, আবিরের মুখ থেকে ভালোবাসি শুনতে মেঘ উন্মত্ত হয়ে উঠেছিল সেখানে আবির ১৫ বছর যাবৎ পাগলের মতো এক তরফা ভালোবেসে গেছে এটা ভেবেই আঁতকে উঠছে মেঘ। ছোটবেলার এত এত স্মৃতির ভিড়ে মেঘের মনে আবিরের স্মৃতি খুব কমই আছে। আবিরকে নিয়ে অতীত ভাবতে গেলে মেঘের সর্বপ্রথম মনে পড়ে জয়ের কারণে থাপ্পড় খাওয়ার ঘটনাটা যেখান থেকে আবিরের প্রতি ঘৃণা আর বিরক্তি জন্মেছিল যার দরুন এক বাসায় থেকেও আবিরের সাথে দুই বছরে একটা সামান্যতম কথাও বলে নি এমনকি আবির চলে যাওয়ার পর ৭ বছরে একবার হ্যালো পর্যন্ত বলে নি। অথচ আজ সেই কথাগুলো মনে করে আনমনে হেসে ফেললো, ভেতরে ভেতরে নিজের প্রতি বেশ ক্ষুব্ধও হচ্ছে। যেখানে এমপির মেয়ের দুই চারটা কমেন্টস সহ্য করতে পারে নি, আবিরের অনুমতি না নিয়েই ব্লক করে দিয়েছিল, মালার দুদিনের আলগা ভালোবাসা সহ্য করতে পারে নি সেখানে জয়ের সাথে বন্ধুত্বের কারণে আবিরের থাপ্পড় মারাটা মেঘের কাছে আজ অযৌক্তিক মনে হচ্ছে না। মুন্নি আপু আনমনে হেসে বললেন,

‘জানো মেঘ, তোমাকে যতবার আমি মেহেদী পড়িয়ে দেয় ঠিক ততবারই সাজ্জাদের কথা মনে পড়ে। হয়তো নাম খেয়াল ছিল না কিন্তু বাসার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা পিচ্চি ছেলেটার মুখটা সবসময় ভাসতো। অনেকবার তোমাকে জিজ্ঞেস করতে চেয়েছি কিন্তু সাজ্জাদের নিষেধ অমান্য করে জিজ্ঞেস করার সাহস করে উঠতে পারি নি। কাল যেহেতু তোমাদের বিয়ে তাই আজ নিশ্চিন্তমনে কথাগুলো বলতে পারছি। মেঘ, তুমি খুব ভাগ্যবতী যে সাজ্জাদের মতো একজন জীবনসঙ্গী পেতে যাচ্ছো। বড় বোন হিসেবে সাজেশন দিচ্ছি যাই হয়ে যাক না কেন, সবসময় ওর পাশে থেকো।”

মেঘ সদাশয় হেসে উত্তর দিল,
“ইনশাআল্লাহ আপু, আমি আমৃত্যু ওনার পাশে থাকবো একদম ওনার লক্ষ্মী বউ হয়ে।”

মুন্নি আপু নিঃশব্দে হেসে মেহেদী পড়াতে ব্যস্ত হয়ে গেছেন। এরমধ্যে আবির ভিডিও কল দিয়েছে, মেঘ কল রিসিভ করেই স্পষ্ট চোখে তাকালো, মুগ্ধতায় মেঘের দুচোখ চিকচিক করছে, ঠোঁটে লেগে আছে নিকষিত হাসি। মেঘের কোমলপ্রাণ হৃদয়ের প্রাণোচ্ছল হাসিতে আবির বরাবরের মতো মোহিত হলো, বুকের ভেতরটা নিখাদ ভালোলাগায় ছেয়ে গেছে। আবিরের হৃদয়ের গহীনে চলমান উত্তাল টেউ সামলে অনুষ্ণ কন্ঠে প্রশ্ন করল,
“মাথা ব্যথা কমেছে?”

” হুম, কিছুটা। ”

“মেহেদী দেয়া শেষ?”

“এক হাত বাকি।”

আবির কিছুটা তটস্থ হয়ে জানতে চাইল,
” নাম লিখে নি তো?”

“না।”

আবির মৃদু হেসে বলল,
” আচ্ছা, নাম কিন্তু আমি এসে লিখবো। কালকের জন্য দুটা শাড়ি পছন্দ করেছি কোনটা নিব বল।”

মেঘ ঠোঁট বেঁকিয়ে শক্ত কন্ঠে বলল,
” আপনার যেটা ভালো লাগে সেটায় নিন। ”

“আমার তো দুটায় ভালো লাগছে। আমি ভেবেছিলাম দুটায় নিয়ে নিব কিন্তু সাকিব বলতাছে বিয়ের শাড়ি নাকি একটায় নিতে হয়। এজন্য কনফিউশানে পড়ে গেছি৷”

মেঘ ভ্রু গুটিয়ে ধীর কন্ঠে জানতে চাইল,
“আপনি আবার কবে থেকে কুসংস্কার মানতে শুরু করেছেন?”

” তোর সাথে মিশতে মিশতে আমিও কেমন যেন হয়ে যাচ্ছি। কথায় আছে না, সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে। ”

মেঘ ক্ষুদ্র চোখে তাকিয়ে আস্তে করে বলল,
” দেখান শাড়ি। ”

আবির ক্যামেরা ঘুরিয়ে শাড়ি দেখাচ্ছে। মুন্নি আপুর এক হাতে মেহেদী দেয়া শেষ। এরমধ্যে আকলিমা এসে খাওয়ার জন্য ডেকে নিয়ে গেছেন। এই সুযোগে মেঘ ঝটপট বিয়ের শাড়ি, বউভাতের লেহেঙ্গা পছন্দ করে দিয়েছে। মুন্নি আপু খাওয়া শেষ করে আসতেই মেঘ কল কেটে আরেক হাত বাড়ালো। দু’হাতে মেহেদী দেয়া শেষে মুন্নি আপু চলে গেছেন, আসিফ আর আরিফ ওনাকে বাসা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসছে। মীমের রুমে মেহেদী দেয়ার ধুম লেগেছে, বন্যা অল্পস্বল্প মেহেদী দিতে পারে তাই যত পিচ্চি ছিল সবাইকে এক নাগাড়ে মেহেদী দিয়ে দিচ্ছে। মীমকেও বন্যায় মেহেদী দিয়ে দিয়েছে। জান্নাত সহ ওর ২-৩ জন মেহেদী আর্টিস্ট ফ্রেন্ড আসছে যারা রিয়া, সোনিয়া আরও কয়েকজনকে মেহেদী দিয়ে দিচ্ছে। বন্যা মেহেদী দেয়ার ফাঁকে একবার মেঘের রুমে এসে দেখে গেছে, তখনও মেঘের মেহেদী দেয়া শেষ হয় নি। মেঘের মেহেদী দেয়া শেষ অনেকক্ষণ হলো, এক হাত পুরোপুরি শুকালেও অন্যহাত এখনও শুকায় নি। কথার কথা মানুষজন বলে, মেহেদীর রঙ যত গাঢ় হয় জামাই তত বেশি ভালোবাসে এছাড়া মুন্নি আপুও বলেছেন, মেহেদী যত বেশি সময় রাখবে রঙ তত গাঢ় হবে। এজন্য মেঘ চিন্তা করেছে আজ সারারাতেও মেহেদী তুলবে না। মেঘ ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আপন মনে ভাবছে, আবিরের দেশে ফেরা, প্রথম দেখা, গান গাওয়া, বাইকে উঠা, কাশবনে যাওয়া, আবিরের জন্মদিন পালন করা, মাইশা আপুর বিয়ে, নিউ ইয়ার, ভ্যালেনটাইন সহ প্রতিটা ঘটনায় মেঘের চোখে স্পষ্ট ভাবছে সেই সাথে বার বার মনে তোলপাড় চালাচ্ছে মুন্নি আপুর বলা রাজপুত্র আর রাজকন্যার কাহিনীটা। একটা মানুষের ভালোবাসা ঠিক কতটা নিখুঁত হলে ছোট বয়স থেকেই এত বিচক্ষণ চিন্তাভাবনা করতে পারে। এরমধ্যে আবির, তানভিররা শপিং শেষ করে বাসায় আসছে। আবির গেইট দিয়ে ঢুকে নিচ থেকেই কিছু সময়ের জন্য মেঘের দিকে তাকিয়ে রইলো। আলোকসজ্জার লাল,নীল, সবুজ, গোল্ডেন, বেগুনি রঙের আলোতে মেঘের মায়াবী আদলখানাও বারংবার রঙ পাল্টাচ্ছে তাই দেখেই আবির খেই হারালো। তানভির ডাকতেই মনোযোগ সরে গেছে, সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির ভেতরে ঢুকলো। ড্রয়িং রুমে বিয়ের কেনাকাটা দেখতে সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়েছে, বন্যা, জান্নাত, মীমরাও উপর থেকে ছুটে আসছে, কিন্তু মেঘের কোনো হদিস নেই। মালিহা খান প্রশ্ন করলেন,

” মেঘ কোথায়? যার জিনিসপত্র তার ই হদিস নেই। এই মীম, মেঘকে ডেকে নিয়ে আয়।”

আবির তৎক্ষনাৎ বলে উঠল,
” আমি যাচ্ছি।”

এত এত মুরুব্বিদের ভিড়ে আবিরের অনাকাঙ্ক্ষিত কথা শুনে মালিহা খান কপাল কুঁচকালেন, আবির কারো উত্তরের প্রতীক্ষা না করেই দ্রুত পায়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠছে৷ মেঘের মামীরা সহ আরও অনেকেই সেদিকে তাকিয়ে আছে৷ মালিহা খান তানভিরের দিকে তাকিয়ে চোখ রাঙালেন। তানভির সঙ্গে সঙ্গে বলল,

” এইযে বিয়ের শাড়ি খুলছি, সবাই শাড়ি দেখুন।”

এদিকে আবির মেঘের রুমে ঢুকে সরাসরি ব্যালকনিতে আসছে। আবিরের পায়ের শব্দেও মেঘের কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। আবির আচমকা মেঘকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো, মেঘের পড়নের জলপাই রঙের শাড়ির পাড় বিদীর্ণ করে আবিরের শক্তপোক্ত হাত মেঘের নিভাঁজ উদর আঁকড়ে ধরেছে, অন্যহাতে কানের পাশের চুলগুলো সরিয়ে ঘাড়ে মাথা রাখলো৷ আকস্মিক ঘটনায় মেঘ ভীতিগ্রস্ত হয়ে ঘাড় ঘুরালো, আবিরের উপস্থিতি টের পেরে পুনরায় মাথা সোজা করে ফেলেছে। আবিরের গাঢ় নিঃশ্বাস মেঘের ঘাড়ে পড়ছে। আবির মেঘের মসৃণ গলায় মৃদু চুমু খেয়ে অত্যন্ত নমনীয় কন্ঠে বলল,

“আড়াল থেকে অপেক্ষার দিন তোর ফুরিয়ে আসছে,
এখন সদর দরজায় দাঁড়িয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করার অনুমতি পেতে যাচ্ছিস।”

আবির শ্বাস ছেড়ে পুনরায় বলতে শুরু করল,
“গত দুই বছর তোকে দেখেও না দেখার মতো চলেছি, কথায় কথায় রাগ দেখিয়েছি, তোর অনুভূতি উপলব্ধি করার চেষ্টা করি নি, সবকিছুতেই ব্যস্ততা দেখিয়ে তোকে কষ্ট দিয়েছি। কিন্তু বিশ্বাস কর, আমি এই সবকিছু করেছি তোকে হারানোর ভয়ে। আমি এখনও আতঙ্কে আছি, কালকের দিন টা পার করার অপেক্ষায় আছি। অপ্রকাশিত আনন্দের অন্তরালে আমার এক নভস্থল ভয় জমে আছে, তোকে পূর্ণাঙ্গরূপে আমার করে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা আমার মস্তিষ্ককে স্থির হতে দিচ্ছে না। আমি তোকে বড্ড বেশি ভালোবাসি মেঘ। ছোটবেলা থেকে নিজেকে একটা কথায় সবসময় বলতাম,

‘মেঘ আবিরের হাসির কারণ,
মেঘকে কষ্ট দেয়া ভীষণ বারণ।’

অথচ দেখ, গত দুই বছরে অনিচ্ছা সত্ত্বেও তোকে কতবার কষ্ট দিয়েছি, কতভাবে কাঁদিয়েছি। যারজন্য আমি নিজেকে আজও ক্ষমা করতে পারি না। গত দুই বছরে যা ঘটেছে সব ভুলে যা, প্লিজ। আজ এই মুহুর্ত থেকে আমরা নতুন জীবন শুরু করতে যাচ্ছি, যেই জীবনে কেউ কাউকে ইচ্ছেকৃত কাঁদাবো না, কষ্ট দিব না। প্রতিনিয়ত নবরূপে একে অন্যের প্রেমে পড়বো আর নতুনভাবে ভালোবাসার সূচনা হবে। তুই রাজি তো?”

আবির থামতেই মেঘের নাক টানার শব্দ কানে বাজলো। মেঘ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে আর ঘন ঘন শ্বাস ফেলছে। আবির মেঘকে ছেড়ে আতঙ্কিত কন্ঠে বলে উঠল,

“এই মেঘ, কাঁদছিস কেনো?”

আবিরের হাত থেকে মুক্তি পেতেই মেঘ অকস্মাৎ আবিরের দিকে ঘুরে আবিরকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে করতে বলছে,
” আপনিও আমাকে মাফ করে দেন, প্লিজ। আমি জেনেবুঝে আপনাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি, স্বার্থপরের মতো সবসময় শুধু নিজের দিকটায় চিন্তা করেছি। একটা বারের জন্যও আপনার আবেগ, অনুভূতি, কষ্ট, খুশি নিয়ে ভাবি নি। আমি মাত্র দুই বছরেই আপনাকে পেতে পাগলপ্রায় হয়ে গিয়েছিলাম, অথচ আপনি ১৫ বছর আমার দেয়া কষ্ট নিরবে সহ্য করে গেছেন। আপনার নিগূঢ় প্রেমানুভূতির সামনে আমার দু বছরের ভালোবাসা আজ ফিকে হয়ে গেছে। আপনাকে যে পরিমাণ কষ্ট দিয়েছি সেই কষ্ট আমি আজীবন ভালোবেসেও পরিশোধ করতে পারবো না।
আমি আপনাকে ভালোবাসি, খুব ভালোবাসি কিন্তু সেটা আপনার ভালোবাসার কেবলমাত্র ১% আপনি আমাকে প্লিজ মাফ করে দেন।”

আবির মেঘকে আলতোভাবে জড়িয়ে ধরে মৃদুস্বরে বলল,
” আপু সব বলে দিয়েছে তোকে?”

“হ্যাঁ”

“এজন্যই বলি, মেয়েদের পেটে আসলেই কোনো কথা থাকে না। ”

মেঘ আর কিছু বলছে না, আবিরের বুকে মুখ গুঁজে একমনে কেঁদেই যাচ্ছে, মেঘের চোখের পানিতে আবিরের টিশার্ট ভিজে গায়ের সঙ্গে লেপ্টে গেছে। মেঘের দু’হাত আবিরের পিঠে থাকায় মেঘের মেহেদী রাঙা হাতের মেহেদী ডিজাইনের অল্পস্বল্প দাগ আবিরের পিঠে লেগে গেছে। মেঘকে কয়েকবার থামতে বলাতেও মেঘ যখন থামছে না তখন আবির বাধ্য হয়ে উষ্ণ স্বরে মেঘের কানে কানে বলতে শুরু করল,

” সমস্যা নেই, তোর ১% আর আমার ৯৯% ভালোবাসার ফলস্বরূপ আমাদের আহিয়ার আগমন ঘটবে। তবুও তুই এভাবে কাঁদিস না প্লিজ।”

আহিয়ার কথা শুনেই মেঘ লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে আবিরকে ছেড়ে দূরে সরে দাঁড়ালো। আবির তপ্ত স্বরে পুনরায় বলল,
” তুই বললে কাল থেকেই প্ল্যানিং শুরু করি? ”

মেঘ ফোঁস করে বলল,
“না।”

আবির সহাস্যে বলে উঠল,
“আজকের পর তুই কান্না করলে তোর কোলে আরেকটা কাঁদুনে বাবু ধরিয়ে দিব, তারপর দু’জনে মিলে কান্না করিস। ঠিক আছে? ”

মেঘ লজ্জায় চিবুক নামিয়ে গলায় ঠেকিয়েছে। আবির মেঘের চোখ মুছে মেঘকে নিয়ে নিচে আসছে। ততক্ষণে তানভির, সাকিব আর আসিফ মিলে মোটামুটি সব কিছু দেখিয়ে ফেলেছে। মেঘ আসতেই মেঘকে পুনরায় দেখানো শুরু করলো। আবির স্থির দৃষ্টিতে মেঘের দিকে তাকিয়ে আছে। আচমকা রিয়া এসে বিড়বিড় করে ডাকল,

“ভাইয়া..”

আবির নড়েচড়ে উঠে উত্তর দিল,
“জ্বি ”

“ভাবি হিসেবে বলছি, আপনার বউয়ের ভালোবাসার নিশান আপনার পিঠে লেগে আছে। অন্য কেউ দেখার আগে টিশার্ট টা পাল্টিয়ে আসুন।”

আবির চোখ নামিয়ে ভীরু হেসে চটজলদি উপরে চলে গেছে। মেঘ সব জিনিসপত্র মোটামুটিভাবে দেখে নিয়েছে। অল্পস্বল্প মাথা ব্যথা নিয়ে আবার কান্না করায় মেঘের মাথা ব্যথা বাড়তে শুরু করেছে, ঘুমে চোখ টানছে। মেঘ তড়িঘড়ি করে ঘুমাতে চলে গেছে। আবির ফ্রেশ হয়ে টিশার্ট পাল্টিয়ে যেতে যেতে শুনে মেঘ ঘুমিয়ে পরেছে। মীম, আইরিন আর বন্যা মেঘের রুমের সামনে দাঁড়িয়ে গল্প করছে। আবির ভেতরে যেতে চাইলে ওরা শক্ত কন্ঠে বাঁধা দেয়। আবির নির্বাক চোখে তাকিয়ে ভাবছে কারণ তখনও মেঘের হাতে নিজের নাম লেখা বাকি। মীম আর আইরিন আবিরকে কোনোভাবেই রুমে ঢুকতে দিবে না। তাদের শর্ত একটায় আবির যদি মেঘের হতে নিজের নাম লিখে তাহলে আবিরের হাতেও তারা মেঘের নাম লিখে দিবে। আবিরের মেহেদী দেয়ার কোনো ইচ্ছে ছিল না কিন্তু মেঘের হাতে নাম লিখতে হবে শুধুমাত্র সেই কারণে তাদের শর্ত মেনে নিয়েছে। আবির ঘুমন্ত মেঘের দু’হাতে অতি সন্তর্পণে নিজের নাম লিখে দিয়েছে। তারপরই আইরিন আর বন্যা আবিরের দু’হাতে মেঘের নাম লিখতে শুরু করেছে। বিছানায় মেঘ ঘুমাচ্ছে তাই ওরা সবাই ফ্লোরে চাদর বিছিয়ে বসেছে। তানভির আবিরের রুমে যাচ্ছিল, আচমকা মেঘের রুম থেকে আবিরের কন্ঠস্বর শুনে থমকে দাঁড়ালো। দরজা থেকে উঁকি দিয়ে বলল,

“আমি কি আসতে পারি?”

আইরিন বন্যার দিকে একপলক তাকিয়ে হেসে বলল,
“কাউকে না জ্বালালে আসতে পারো।”

তানভির ভেতরে ঢুকেই আইরিনের মাথায় একটা গাট্টা দিল। আবিরের হাতের দিকে তাকিয়ে উদাস ভঙ্গিতে বলল,
“আজ আমার বিয়ে নয় বলে কেউ একবারের জন্যও মেহেদী দিব কি না জিজ্ঞেস করছে না। পোড়া কপাল আমার। ”

বন্যা মাথা নিচু করে মৃদু হাসলো। মীম পাশ থেকে আহ্লাদী কন্ঠে বলল,
“দেখো, বন্যা আপু দিয়ে দিয়েছে।”

তানভির ঠোঁট বেঁকিয়ে শক্ত কন্ঠে বলল,
” বুঝলাম না, যে কয়জনের হাত দেখলাম সবাই একজনের নাম ই বলছে। সেই একজন কি পুরো বাড়ির দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে নাকি। ঠিক আছে, দায়িত্ব যখন নিয়েছে আমাকেও দিয়ে দিতে হবে।”

বন্যা মাথা নিচু করে মনোযোগ দিয়ে মেহেদী দিচ্ছে, তানভিরের কথা শুনেও না শুনার মতো ভান করছে। আইরিন কপাল গুজিয়ে রাগী স্বরে বলল,
” তানভির ভাইয়া, তোমাকে আগেই সাবধান করেছি। কাউকে জ্বালাতে পারবে না।”

তানভির ভারী কন্ঠে বলল,
” আমি কি মেহেদী দিব না? আমাকে কি মেহেদী দিয়ে দিবে না?”

আবির অকস্মাৎ গুরুভার কন্ঠে বলে উঠল,
“এই আইরিন, তানভিরের হাতে একটা ব্যাঙের ছাতা এঁকে দে তো আর হ্যাঁ ছাতার নিচে একটা ব্যাঙ ও দিস।”

বন্যা, মীম, আইরিন তিনজন একসঙ্গে হেসে উঠল। তানভির মুখ ফুলিয়ে রাগী চোখে তাকিয়ে বলল,

” অভদ্র জামাই, বউ এর বড় ভাইকে যথাযথ সম্মান দেয় না।”

আবির শক্ত কন্ঠে বলল,
“পার্সোনালি দেখা করবেন ভাইজান, আপনাকে একদম সম্মানের চূড়ায় পৌঁছে দিব।”

আবিরের মেহেদী দেয়া শেষ আবির উঠে যেতে যেতে বন্যাকে উদ্দেশ্য করে বলল,

“এই অবুঝ ছেলেটাকে একটু মেহেদী দিয়ে দিও। ”

আবিরের কথাটা বলতে দেরি হলেও তানভিরের হাত বাড়াতে দেরি হলো না। বন্যা তপ্ত স্বরে জানতে চাইল,

” কি লিখবো?”

তানভির ভাবছে, মীম পাশ থেকে বলল,
“A B C D E পর্যন্ত লিখে দাও।”

তানভির চোখ ঘুরাতেই বন্যা আবারও জিজ্ঞেস করল,
” আপনার নাম লিখে দিব?”

“হাতে কেউ নিজের নাম লিখে?”

“তাহলে কি লিখবো?”

“তোমার ইচ্ছে। ”

জান্নাত আইরিনকে ডাকছে, আইরিন ওদের টা টা দিয়ে চলে গেছে। মীমের ঘুম পাচ্ছে তাই মীমও গিয়ে মেঘের পাশে শুয়ে পরেছে। বন্যা তানভিরের হাতে ছোটখাটো একটা ডিজাইন করে দিচ্ছে। প্রায় শেষদিকে তানভির হাতের একটা অংশ দেখিয়ে মোলায়েম কন্ঠে বলল,

“এখানে B লিখে দাও।”

বন্যা সঙ্গে সঙ্গে ভ্রু কুঁচকে স্পষ্ট দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,
” B কেনো লিখবো?”

“আমার ইচ্ছে তাই।”
“আমি পারব না।”
“কেনো পারবে না?”
“এমনি।”
“লিখতে বলেছি লেখো।”
“B মানে কি?”

“Busy.”

“What?”

” আমি খুব ব্যস্ত তাই হাতে Busy লিখতে রাখবো। তাতে তোমার কোনো সমস্যা? ডিজাইনারের কাজ ডিজাইন করা, এত কথা বলা নয়।”

বন্যা একদম ছোট করে B লিখে দিয়েছে যাতে স্পষ্ট না ভাসে। তানভির নিজের হাতটা ভালোভাবে দেখে আকুল কন্ঠে বলল,
“বাহ! তুমি তো খুব বুদ্ধিমতী।”

বন্যা মনে মনে আওড়ালো,
” নিজের নামের অক্ষর বড় করে লিখে নিজে ফাঁসার কোনো ইচ্ছে নেই আমার। ”

তানভির চলে গেছে। বন্যা দরজা বন্ধ করে মেঘের পাশে গিয়ে শুয়েছে।

আজ ৩রা ফেব্রুয়ারী, আবির মেঘের বিয়ের দিন। বিয়ে উপলক্ষে শহরের প্রথম সারির একটা কমিউনিটি সেন্টার বুকিং দেয়া হয়েছে। সকালের খাওয়াদাওয়া শেষে আবির মেঘকে পার্লারে নিয়ে গেছে। যদিও মোজাম্মেল খান চেয়েছিলেন তানভির যেন মেঘকে নিয়ে যায়। কিন্তু আবির সেসবে পাত্তা না দিয়ে নিজেই নিয়ে গেছে। মেঘ আজ তেমন কথা বলছে না, বার বার শুধু হাতের দিকে তাকাচ্ছে। একহাতে বাংলায় লেখা “আবিরের মেঘ”
আরেকহাতে লেখা ” Sazzadul Khan Abir”
আবির যেতে যেতে মেঘকে কিছু কাজ আর দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েছে। মেঘকে নামিয়ে দিয়ে বাসায় ফিরে শাওয়ার নিয়ে আবির রেডি হতে শুরু করলো। আবির কেবল শেরওয়ানিটা পড়েছে এরমধ্যে আইরিন আর মীম তাদের সাজুনি নিয়ে হাজির। গতকাল রাতের মতো আজও তারা আবিরকে সাজাতে চলে আসছে। নামাজের পরপর আবিররা রওনা দিয়েছে, এ পর্যায়ে এক বাড়ির মানুষজন দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। মেঘকে নিয়ে মোজাম্মেল খান, হালিমা খান, মেঘের মামা বাড়ির আত্মীয় স্বজন, তানভির, বন্যা, মীম এমনকি ফুপ্পিরাও কমিউনিটি সেন্টারে পৌঁছে গেছে। বিয়ের গেইটে দুপক্ষ মুখোমুখি হয়েছে। রাকিব, রাসেল, সাকিব, লিমনরা সবাই আবিরের পাশে। অন্যদিকে তানভিরের কয়েকজন বন্ধু, আরিফ, আসিফ, মীম, বন্যা,আইরিন ওরা গেইট আঁটকে দাঁড়িয়েছে । আইরিনদের ডিমান্ড শুনে রাকিব আবিরের দিকে তাকিয়ে মজার ছলে বলে উঠল,

” নিজের বউ নিজে নিবি তাও এত ডিমান্ড।”

আবির পাশ ফিরে রাকিবের দিকে ক্ষুদ্র চোখে তাকিয়ে অত্যন্ত মোলায়েম কন্ঠে বলল,

” ও চাইলে হাসিমুখে জীবনটাও দিয়ে দিতে পারবো সেখানে তাকে পাওয়ার জন্য এই সামান্য ডিমান্ড আর এমন কি!”

রাকিব তপ্ত স্বরে বলল,
” আবেগ ছেড়ে বিবেক দিয়ে কথা বলল। বুঝছি তুই বউ পাগল, বউয়ের জন্য যা খুশি করতে পারিস তাই বলে যে যা বলবে তাই?”

“ও শুধু আমার আবেগ না, আমার চিত্ত চাঞ্চল্যের এক ফালি সুখের আভাস।”

” হয়েছে, বুঝেছি। বজ্জাত ছেলে, তোর জন্য একটু মজাও করতে পারবো না। ”

আবির আড়চোখে তাকিয়ে মলিন হাসলো। আবির কানে কানে রাকিবকে কিছু বলতে চেয়েছে কিন্তু রাকিব সে কথা না শুনে আবিরের থেকে কিছুটা দূরে সরে রাগী স্বরে বলতে শুরু করল,

” তোর আর কোনো কথায় শুনছি না আমি…!”

তানভির মুচকি হেসে বলে উঠল,
“রাকিব ভাইয়া, তোমার যা মজা করার ইচ্ছে আমার বিয়েতে করো। তোমার বন্ধুর বিয়েতে মজা করার আশা ছেড়ে দেও।”

“তুইও যে তোর ভাইয়ের মতো আচরণ করবি না তার কি গ্যারেন্টি আছে? শত হোক তোদের রক্ত তো এক।”

আলী আহমদ খান ভেতর থেকে হুঙ্কার দিলেন,
” গেইট থেকে ভেতর পর্যন্ত আসতে এতক্ষণ সময় লাগে তোমাদের?”

আবির তৎক্ষনাৎ চোখে ইশারা দিল, রাকিব টাকা বের করেও দিতে চাচ্ছে না। আইরিন, মীম, রিয়ারা জোরজবরদস্তি করে নিয়েছে। আবিরকে মালা পড়িয়ে, সাদা গোলাপ দিয়ে ভেতরে নেয়া হয়েছে। আলী আহমদ খান, মোজাম্মেল খান সহ আরও কয়েকজন একসঙ্গে বসে আছেন। আবির ঢুকতেই আলী আহমদ খান ডাকলেন,
“আবির, একটু এদিকে আসো।”

আবির তটস্থ হয়ে বলল,
” জাস্ট এক মিনিট আব্বু। এখুনি আসছি।”

আবির সবাইকে ফেলে চটজলদি মেঘের সাথে দেখা করতে চলে গেছে। কমবেশি সবাই গেইটের কাছে ছিল তাই মেঘের আশেপাশে তেমন বড় কেউ নেই। আদি সহ আরও কয়েকটা পিচ্চি ছুটাছুটি করছে। আবির মেঘের কাছাকাছি এসে কোমল কন্ঠে সালাম দিল, মেঘও মোলায়েম কন্ঠে সালামের উত্তর দিল। আবির মেঘের সামনে এসে দুই হাঁটুতে ভর দিয়ে বসে কিছুটা ঝুঁকে ঘোমটার আড়ালে থাকা মেঘকে একপলক দেখে নিল। আবিরের অনভিপ্রেত কাণ্ড দেখে মেঘ অলক্ষিতভাবে হেসে ফেলল। আবির মেঘের মুখের পানে গভীর মনোযোগে চেয়ে ঠোঁট কামড়ে হেসে নেশাক্ত কন্ঠে বলল,

“একটু ভয়ে ছিলাম তাই দেখতে আসছি, কিছু মনে করিস না৷ কেমন!”

মেঘ তপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ঠান্ডা কন্ঠে বলল,
” আপনাকে রেখে পালাবো না, আপনি নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন।”

আবির চটজলদি মেঘের হাতে আলতোভাবে চুমু খেয়ে তটস্থ কন্ঠে বলল,
” আব্বু ডাকছে, এখন যায়।”

আবির সামনে যেতেই আলী আহমদ খান জিজ্ঞেস করলেন,
” কোথায় গিয়েছিলে?”

আবির মাথা নিচু করে বিড়বিড় করল,
“মেঘকে দেখতে।”

“৫ মিনিট কথা বলার জন্য ডেকেছিলাম, এটাও সহ্য হয় নি তোমার?”

আবির নিরুদ্বেগ ভঙ্গিতে বলল,
“আসলাম তো, এখন বলুন।”

আবিরের নিরুদ্বেগ ভাবভঙ্গি দেখে মোজাম্মেল খান ঠোঁট চেপে হাসলেন, সাথে আবিরের বড় মামাও মৃদু হাসলেন। তবে আলী আহমদ খান ছেলের কর্মকাণ্ডে বেশ ক্ষুদ্ধ। আবির ২-৪ মিনিট কথা বলে আবারও মেঘের কাছে চলে গেছে কিন্তু ততক্ষণে মেঘের চারপাশে সবাই জড়ো হয়ে গেছে। আবিরের আব্বু, রাকিব, মেঘের আব্বু, তানভির কাজীর সাথে কথা বলে সবকিছু ঠিকঠাক করছে। মেঘ আবিরের উপস্থিতিতে, তাদের সম্মতি নিয়ে মৌখিকভাবে বিয়ের কাজ শেষ হয়েছে। বিয়ের যাবতীয় কাজ শেষে খাওয়াদাওয়ার পর্ব শুরু হয়েছে। মেঘ, আবির, বন্যা, তানভির, রাকিব, সাকিব সবাই একসঙ্গে বসেছে, খেতে খেতে টুকটাক খুনসুটি করছে। মিনহাজরা এসেছে অনেকক্ষণ হবে কিন্তু মেঘের জন্য বন্যা ওদের সাথে ঠিকমতো কথাও বলতে পারছে না। এর কিছুক্ষণ পরেই সিফাত আসছে, আলী আহমদ খান সিফাতকে দেখেই এগিয়ে গিয়ে হাসিমুখে কথা বলতে শুরু করেছেন। এদিকে মোজাম্মেল খান বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ চিন্তিত। সিফাত কিছুটা দূরে যেতেই মোজাম্মেল খান কিছুটা চিন্তিত স্বরে ডাকলেন,

“ভাইজান”

“হ্যাঁ, বল।”

“আবির আর মেঘের বিয়ের কাজ কি শেষ?”

“হ্যাঁ, কেনো?”

“না মানে কাবিনের কাজ টা বাকি রয়ে গেল না?”

আলী আহমদ খান গুরুভার কন্ঠে বললেন,
” ছেলে আমার মেয়ে তোর, সবচেয়ে বড় কথা তারা দু’জন দু’জনকে মন থেকে ভালোবাসে। তুই কাবিন দিয়ে কি করবি? তারপরও যদি তোর মনে হয় তাহলে ঘরোয়াভাবে বসে সেটার সমাধান করা যাবে। ”

” আমি ঐভাবে বলতে চাই নি।”

আলী আহমদ খান কপাল গুটিয়ে ধীর কন্ঠে বললেন,
“বিবাহ সম্পাদনের জন্য বা বিবাহ বৈধ হওয়ার জন্য ‘কাবিননামা’ অপরিহার্য না। কাবিননামা একটা আইনি বাধ্যবাধকতা মাত্র। প্রাপ্তবয়স্ক দুজন ছেলে মেয়ের সম্মতি নিয়ে, সব নিয়মকানুন মেনেই বিয়ে হয়েছে এতে দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই।”

আলী আহমদ খান একগাল হেসে ফের বললেন,
” এখন খেতে চল।”

“চলো।”

মেঘ আর আবিরের ফটোশুট চলছে। বন্যা কাছেই দাঁড়িয়ে আছে যেন মেঘের কোনো সমস্যা হলে ঝটপট যেতে পারে। বন্যার আব্বু, আম্মু, ভাই আর বোন এসেছিলো, খাওয়াদাওয়া করে মেঘ আবিরের সাথে কয়েকটা ছবি তুলে কিছুক্ষণ আগেই বেড়িয়েছে। ওনারা চলে যাওয়ার খানিক বাদে আচমকা তানভির এসে বন্যার পাশ ঘেঁষে দাঁড়ালো। তানভিরকে দেখেই বন্যা কিছুটা সরে যাওয়ার চেষ্টা করলো। তানভির সহসা শীতল কন্ঠে বলল,
” তারপর বলো, তুমি কবে বিয়ে করবে। ”

বন্যা ভ্রু কুঁচকে বলে উঠল,
“মানে?”

“বিয়ে করবে না?”

” আগে আপুর বিয়ে হোক তারপর ভেবে দেখবো।”

তানভির মনমরা হয়ে বলল,
” ওহ।”

বন্যা ভণিতা ছাড়াই প্রশ্ন করল,
“কেনো বলুন তো..”

“তোমার বেস্ট ফ্রেন্ডের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, তোমার খারাপ লাগছে না?”

“খারাপ কেনো লাগবে? মেঘ তার প্রিয়মানুষকে বিয়ে করতে পেরেছে, এতে আমি খুব খুশি। ”

” তোমার প্রিয়…” বলতেই মোজাম্মেল খান দূর থেকে উচ্চস্বরে ডাকলেন,

“তানভির”

তানভির ভয়ে আঁতকে উঠে,
” ও বাবা ”

বলে তড়িৎ বেগে বন্যার পাশ থেকে সরে গেছে। বন্যা উদ্বেগহীন চোখে তাকিয়ে আনমনে হাসলো। বাহিরে তানভির যতই রাগী রাগী ভাব নিয়ে থাকুক না কেনো, বাসার ভেতরে সে আপাদমস্তক ভীতু একটা ছেলে। মীম টেবিলে মাথা রেখে মুগ্ধ চোখে চেয়ে আবির আর মেঘকে দেখছে। মেঘের চোখে মুখে লজ্জা লজ্জা ভাব থাকলেও আবিরের চোখে লজ্জার ছিটেফোঁটাও নেই। নতুন জামাইয়ের যেসব গুণাবলি থাকা প্রয়োজন তার একটাও আবিরের মধ্যে নেই। এই একবার মেঘের সাথে দুষ্টামি করছে, আবার তানভির, রাকিবের সঙ্গে দুষ্টামি করছে, ছবি সুন্দর না হলে ফটোগ্রাফারের মাথায় গাট্টা দিয়ে স্টাইল শিখিয়ে দিচ্ছে। মীম সেগুলোই মনোযোগ দিয়ে দেখছে। আরিফ একটা আইসক্রিম মীমের সামনে রেখে মৃদুস্বরে বলল,
“খেয়ে নাও”

মীম মাথা তুলে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,
” আমি কেনো খাবো?”

” গরমের মধ্যে আইসক্রিম টা খেলে তোমার ভালো লাগবে তাই নিয়ে আসছি।”

মীম গম্ভীর মুখ করে বলে উঠল,
” আমার ভালো কবে থেকে চিন্তা করা শুরু করেছো তুমি?”

“যেভাবে এদিক সেদিক হোঁচট খাচ্ছো, চিন্তা না করে উপায় আছে?”

মীম মুচকি হেসে আস্তে করে বলল,
” তুমি ধাক্কা না মারলেই হলো।”

শেষ বিকেলের দিকে হালিমা খানরা বাসায় চলে আসছেন। মেঘ আর আবিরকে বরণ করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কাজের ফাঁকে মাহিলা খান অকস্মাৎ প্রশ্ন করে বসলেন,

” তোর মেয়ের বিয়েতে তুই খুশি তো বোন?”

হালিমা খান মুচকি হেসে বললেন,
“একটা কথা বলবো আফা?”

” বল।”

“আবিরের সাথে মেঘের বিয়ের ব্যাপারে আমি আরও অনেকদিন আগেই ভেবেছিলাম। ”

“সত্যি? আমাকে বলিস নি কেনো?”

“কিভাবে বলতাম বলো, এই বাড়ির পুরুষদের কিছু বলতে গেলে ভয় লাগে অন্ততপক্ষে বিয়ের বিষয়ে। প্রথমে মেঘের আব্বুকে বলতে চেয়েছি কিন্তু ওনার ছেলে দেখার তোরজোর দেখে আর বলতে পারি নি, তারপর একদিন আকলিমাকে কথার কথা এমনিতেই বললাম, সে তো ভয়ে শেষ। আমাকে সঙ্গে সঙ্গে বারণ করেছে যেন তোমাকে কিছু না বলি। আমি সব ভুলে একদিন তোমাকে বলে ফেলতে চেয়েছিলাম তৎক্ষনাৎ তোমার অতীতের ঘটনা মনে পড়ে গেছিলো। আমার উল্টাপাল্টা চিন্তার জন্য বাসায় যেন নতুন কোনো অশান্তি সৃষ্টি না হয় এজন্য আর কিছুই বলি নি৷ ”

আবিরের আম্মু শীতল কন্ঠে জানালেন,
” যা হয়েছে ভালোই হয়েছে। ছেলেমেয়ে পছন্দ করেছে, তারা ভাইয়ে ভাইয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে এতে আমাদের কোনো হাত নেই ”

মেঘের আম্মু মুখ ফুলিয়ে শ্বাস ছেড়ে মৃদুস্বরে বললেন,
” আমার মেয়েটার জন্য একটু ভয় হচ্ছে, আফা।”

“কেনো?”

” আমি জানি আবির মেঘকে অনেক পছন্দ করে, সারাজীবন আগলে রাখবে কিন্তু সবকিছুর পরেও আবিরের শরীরে ভাইজানের রক্তই বইছে তাছাড়া ওর রাগটাও বেশি। রাগের মাথায় মেঘের সাথে যদি খারাপ আচরণ করে। ”

মালিহা খান মলিন হেসে বললেন,
” এখনই এত ভয় পাচ্ছিস কেনো, ওরা তো আমাদের চোখের সামনেই থাকবে। যা হবে দেখা যাবে। ”

সন্ধ্যার আগে আগে আবির-মেঘ বাসায় আসছে। ওদের বরণ করে, দুধ, মিষ্টি খাইয়ে বাকি নিয়মকানুন শেষ করে মেঘকে নিয়ে মালিহা খান ভেতরে চলে যাচ্ছেন। এদিকে আবির ড্রয়িংরুমে দাঁড়িয়ে নির্বাক চোখে তাকিয়ে আছে। সবার পূর্ণ মনোযোগ মেঘের দিকে দেখে আবির ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করল,

” আমি এখন কি করবো?”

মালিহা খান তপ্ত স্বরে বললেন,
” তোর যা ইচ্ছে কর গিয়ে।”

আবির দাঁতে দাঁত চেপে বিড়বিড় করল,
“বউটাকে দিয়ে গেলে অন্তত দেখতে তো পারতাম। ”

বন্যারা পরের গাড়ি দিয়ে আসছে তাই একটু দেরি হয়েছে। মীম, আইরিন আর বন্যা গেইটের কাছে আসতেই তানভির গুরুভার কন্ঠে ডাকল,

” বন্যা। ”

বন্যা সহ আইরিন আর মীম স্পষ্ট চোখে তাকিয়েছে। তানভির তৎক্ষনাৎ বলে উঠল,
“আমি বন্যাকে ডেকেছি, তোদের নাম বন্যা?”

“না।”

“তাহলে এভাবে তাকিয়ে আছিস কেনো?”

বন্যা মৃদুস্বরে বলল,
“কিছু বলবেন?”

সঙ্গে সঙ্গে মীম, আইরিন একসঙ্গে বলে উঠলো,
“কিছু বলবা?”

তানভির মুখ ফুলিয়ে রাগী স্বরে বলল,
” না। ”

মীম আর আইরিন বন্যাকে নিয়ে চলে যাচ্ছে। তানভির কয়েক মুহুর্ত তাকিয়ে থেকে আবিরের কাছে গেল। তানভির কপাল কুঁচকে এক দৃষ্টিতে বন্যার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,

” ভাইয়া, তোমার বিয়ে টা তো শেষ হলোই এবার আমার টা নিয়ে একটু ভাবো।”

আবির চোখ ঘুরিয়ে তানভিরের দিকে তাকিয়ে রাশভারি কন্ঠে বলল,
” আগামী দু’বছর এই বাড়িতে আর কোনো বিয়ে হবে না। ”

“আমি চাকরি নিলেও না?”

“না”

“কোনো? ”

“আমার বউ অন্ততপক্ষে দু’বছর এই বাড়ির একমাত্র বউ হয়ে রাজত্ব করবে। তোর বোনের বউ বউ ফিল শেষ হলেই তার ভাবিকে নিয়ে আসবো ততদিনে তুই নিজেকে গুছা৷”

“তাই বলে দুই বছর?”

“দেখ তানভির, তুই আমার থেকে বয়সে দুই বছরের ছোট তাই বিয়েটাও দু’বছর পর করা উচিত । তাছাড়া আমি তোর বোনের মানসিক শান্তিতে ব্যাঘাত দিব না। তোকে ছয় মাসের মধ্যে বিয়ে করালাম সবকিছু ঠিকঠাক চললো। কোনো এক দিন, হয়তো আজ থেকে ১০ বছর পর মেঘ আমার কাছে এই অভিযোগটা করল তখন আমি কি করবো? ও কে কি এই দিনগুলো ফিরিয়ে দিতে পারবো?”

তানভির মন মরা হয়ে বলল,
” থাক, আমি আর কিছু বলব না।”

তানভির মন খারাপ করে চলে যাচ্ছে। আবির মৃদু হেসে ফের ডাকল, কিন্তু তানভির আর তাকালো না। অবশ্য তাকালেও বিশেষ কোনো লাভ হবে না কারণ আবির যা ভেবে রেখেছে তাই হবে, তানভির জোরপূর্বক কোনোকিছু পরিবর্তন করতে পারবে না আর করতে চাইও না। আগামীকাল আবিরদের বাসায় অনুষ্ঠান হবে, একেবারে কাছের মানুষজন ছাড়া অতিরিক্ত কোনো মানুষ থাকবে না৷ আবিরের আব্বু চেয়েছিলেন একদিনেই অনুষ্ঠান শেষ করতে কিন্তু মোজাম্মেল খানের এতে দ্বিমত ছিল। ওনি মেয়ের বিয়ের জন্য এত বছর যাবৎ স্বপ্ন দেখেছেন তাই আলী আহমদ খান ওনার স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করার সুযোগ দিয়েছেন।

আবির আর রাকিব সন্ধ্যার পর পর ই বেড়িয়েছে, ফিরেছে প্রায় ১১ টা নাগাদ। ততক্ষণে বাড়ি মোটামুটি শান্ত হয়ে গেছে। আবির নিজের রুমে যেতে যেতে মেঘের রুমটা দেখে গেছে, রুমের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। সন্ধ্যার পর থেকে মেঘের সাথে আবিরের আর কোনো কথায় হয় নি। আবির দু’তিনবার ডাকতেও গিয়েছে কিন্তু আজ কেনো জানি সাহস পাচ্ছে না তাই রুমে এসে মেঘের নাম্বারে কল দিল, সারাদিনের ক্লান্তিতে মেঘ গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে। আবিরের কল বেজেই যাচ্ছে। মেঘের পাশ থেকে মাহমুদা খান ঘুম ঘুম কন্ঠে মেঘকে ডেকে বললেন,

“মেঘ, ফোনটা সাইলেন্ট কর।”

মেঘ ঘুমের মধ্যেই নড়ে উঠলো কিন্তু ফোন ধরলো না।
গতকাল রাতে আবিরের রুমে আসার ঘটনা ছড়াতে ছড়াতে বড়দের কান পর্যন্ত চলে গিয়েছে। তাই মাহমুদা খান ইচ্ছে করেই আজ মেঘের রুমে শুয়েছেন। মেঘের একপাশে মাহমুদা খান অন্যপাশে বন্যা শুয়েছে। দু’বার কল কেটে পুনরায় কল বাজতে শুরু করেছে। বন্যা মেঘের পাশ থেকে ফোনটা একটু তুলতেই আবিরের ছবি ভেসে উঠেছে। বন্যা আস্তে করে বলল,

“ঐ মেঘ, ভাইয়া কল দিচ্ছে।”

ভাইয়া নামটা শুনতেই মেঘের গভীর ঘুম কেটে গেছে। ঘুম ঘুম চোখে পিট পিট করে কল রিসিভ করে কানে ধরল। ফোনের ওপাশ থেকে আবিরের মোলায়েম কন্ঠস্বর শুনা গেল,

“আমার বউটা এখন কি করছে?”

মেঘ ঘুম ঘুম কন্ঠে বলল,
“ঘুমাচ্ছে”

আবির মুচকি হেসে বলল,
” কিন্তু আমার যে তার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে।”

“সকালে বলব।”

“না, এখনি বলতে হবে। ”

মাহমুদা খান আস্তে করে বললেন,
” মেঘ, ফোনটা রেখে ঘুমা।”

মেঘ ফিসফিস করে রেখে দেয়ার কথা বলছে কিন্তু আবির নাছোড়বান্দা, কথা তার বলতেই হবে। আবির তপ্ত স্বরে বলল,

“চল ছাদে যায়।”

“কেনো?”

“আমার চাঁদটাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। ”

“এখন ছাদে যেতে পারবো না।”

ছাদের কথা শুনে মাহমুদা খান রাগী স্বরে বলে উঠলেন,

“এই আবির, ফোনটা রাখবি তুই? আর একটা রাত সহ্য করতে পারছিস না?”

#চলবে