#গল্পঃ_আমৃত্যু_ভালোবাসি_তোকে_
#পর্বঃ_১০১
#লেখিকাঃ_সালমা_চৌধুরী_
মাহমুদা খানের ধমক খেয়ে মেঘ কেঁপে ওঠে, ভয়ে সঙ্গে সঙ্গে কল কেটে দিয়েছে৷ মেঘ ভয় পেলেও আবিরের মনে কিঞ্চিৎ ভয় বলতে নেই। ফুপ্পির ঝা*ড়ি খেয়েও আবির কল দিয়েই যাচ্ছে। মেঘ ফোন সাইলেন্ট করে রেখেছে ঠিকই কিন্তু আবিরের অনাবশ্যক কলে বুকের ভেতরটা অবিচ্ছিন্নভাবে কম্পিত হচ্ছে। বাহির থেকে আলোকসজ্জার ঝলমলে আলো রুমে প্রবৃত্ত হচ্ছে। মেঘ ঘাড় ঘুরিয়ে বন্যার দিকে একপলক তাকালো, বন্যা গভীর ঘুমে নিমগ্ন পরপর তাকালো ফুপ্পির দিকে, ফুপ্পির ভারী নিঃশ্বাসের শব্দে বুঝা যাচ্ছে ওনিও ঘুমে। মেঘ বুকের উপর ফোন চেপে অতি সন্তর্পণে বন্যার পাশ দিয়ে নেমে উদগ্রীব পায়ে বারান্দায় গিয়ে কল রিসিভ করল। আবির তৎক্ষনাৎ অনচ্ছ কন্ঠে শুধালো,
” তোর কি আমার জন্য একটু মায়াও হয় না?”
আবিরের কথা শুনে মেঘ বিহ্বল, ভড়কে গেছে কিছুটা। কপাল কুঁচকে ভারী স্বরে বলল,
” আমি কি করলাম!”
” সন্ধ্যা থেকে কেউ আমাকে একটা কল পর্যন্ত দিল না। কেউ না দিলেও তুই তো একটা কল দিতে পারতি নাকি?”
” আমি তো আপনার কলের অপেক্ষায় ছিলাম। অপেক্ষা করতে করতে কখন ঘুমিয়ে পরেছি বুঝতেই পারি নি।”
“বাহ! কি দায়িত্বশীল বউ আমার। ”
মেঘ সহসা ঠোঁট বাঁকালো, সদাজাগ্রত চোখে আলোকসজ্জার লাল, নীল আলোর পানে তাকিয়ে মোলায়েম কন্ঠে শুধালো,
” বাসায় কখন আসছেন? খেয়েছেন?”
“কিছুক্ষণ আগে। আমার শ্বশুর বিয়েতে যে পরিমাণ জামাই আদর করেছে রাতে আর কিছু খেতে হবে না।”
“কোথায় গিয়েছিলেন?”
“এখন বলবো না। ”
“আচ্ছা, ঘুমান তাহলে। ”
“শুন”
“জ্বি”
“চল ছাদে যাই।”
“না।”
“কেনো?”
” আম্মুরা বলেছে বিয়ের রাতে বড় জামাইয়ের মুখ দেখতে নেই, এতে নাকি জামাইয়ের অমঙ্গল হয়।”
” ঠিক আছে, দেখলাম না মুখ। একটু কথা তো বলতে পারি। ”
“আব্বাজান নিষেধ করেছেন, দেখাসাক্ষাৎ ও করা যাবে না। ”
আবির ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে রাগান্বিত কন্ঠে বলল,
“কেউ আমাকে কিছু বলতে পারছে না তাই তোকে কুসংস্কার বুঝাচ্ছে আর তুইও বোকার মতো সেসব মানতেছিস।”
মেঘ নিশ্চুপ, আবির দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করে আহ্লাদী কন্ঠে বলল,
” চল না ছাদে।”
মেঘ অত্যন্ত ধীর কন্ঠে বলল,
” একটু বুঝার চেষ্টা করুন,আমি যেতে পারবো না। আপনি যেন রুমে না আসেন তারজন্য আব্বাজান ফুপ্পিকে আমার সাথে থাকতে বলেছেন। এখন আমি বের হলে খবরই আছে। আপনি ঘুমান, প্লিজ।”
আবির ঢোক গিলে ভ্রু বাঁকিয়ে আবেগতাড়িত কন্ঠে বলল,
“I miss you. I need you. Believe me, I badly want you, Sparrow.”
আবিরের কন্ঠে আবেগপ্রবণ, অস্বাচ্ছন্দ্যকর কথাগুলো শুনে মেঘের গা শিউরে উঠছে। এ যাবৎ কালে আবিরকে এতটা ব্যাকুল হতে কখনো দেখেনি সে। মেঘ নিস্পৃহায় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ঠোঁট কামড়ে বিড়বিড় করল,
“আমাকে তো খুব বলতেন সহিষ্ণু হতে হবে, ধৈর্যশীল হতে হবে তাহলে আজ আপনার এই অবস্থা কেনো?এত অধৈর্য হয়ে উঠেছেন কেনো আপনি?”
” আর কত ধৈর্য ধরবো? এতদিন যাবৎ অফিসিয়াল বিয়ের অপেক্ষায় ছিলাম, করলাম তো অফিসিয়াল বিয়ে। আত্মীয় স্বজন, এলাকাবাসী সবাই জানলো তো। তাহলে এখন আমার বউ আমাকে দিচ্ছে না কেনো? মানলাম কাল অনুষ্ঠান শেষে বাসর হবে। কিন্তু দেখা তো করতে দিবে! কথা তো বলতে দিবে! আমাদের মাঝে কংক্রিটের দেয়াল সৃষ্টির কি দরকার ছিল? ”
“জানি না। আমার ঘুম পাচ্ছে, ঘুমাবো। আপনিও ঘুমান।”
“বুকের ভেতর আগুন জ্বললে ঘুমাবো কিভাবে?”
মেঘ মুচকি হেসে বলল,
” এক বোতল ঠান্ডা পানি খেয়ে ঘুমিয়ে পরেন ।”
মেঘ কল কেটে রুমে চলে গেছে। আবির কপালে কয়েকস্তর ভাঁজ ফেলে বিড়বিড় করল,
” এত কাহিনী করবে জানলে কমিউনিটি সেন্টার থেকেই পালাতাম৷ ”
মেঘ ভোরবেলা উঠে আবারও ঘুমিয়েছে তাই সকালে ঘুম একটু দেরিতে ভেঙেছে। আশেপাশে বন্যা, ফুপ্পি কেউই নেই। আবিরের কথা মনে পড়তেই সঙ্গে সঙ্গে ফোন হাতে নিল। মেঘ আনমনেই নেট অন করে ফেসবুকে ঢুকলো। অকস্মাৎ আবিরের পোস্ট দেখে চমকে উঠল। গতকাল বিয়ের বেশকয়েকটা ছবি আবির রাতেই তার আইডি থেকে পোস্ট করে ক্যাপশন লিখেছে,
প্রিয় সহধর্মিণী,
আমার অলীক কল্পনার সঙ্গী তুমি, গোধূলি লগ্নে বাড়ি ফেরার একান্ত অভিপ্রায়। তুমি আমার স্নিগ্ধ সকালের সুললিত গন্ধরাজ, পড়ন্ত বিকেলের একগুচ্ছ বাগানবিলাস। আমার শূন্য হৃদয়ের পূর্ণতা তুমি, ব্যাকুল হৃদয়ের নির্জন নির্মলা। নীল দিগন্তের উড়ন্ত মেঘেরা জানে, কত স্বপ্ন উড়িয়েছি বেনামি খামে। তোমার মায়াবী মুখের পানে চেয়ে, ভুলেছি সব যাতনা আনমনে। তোমার ঠোঁটের ঐ স্নিগ্ধ হাসি দেখে, আমার হৃদয়ের অন্তরালে নিরবচ্ছিন্ন বিক্ষোভ চলে। তুমি আমার অবসন্ন মস্তিষ্কের প্রবলতা, নব্য স্বপ্ন দেখার অদম্য স্পৃহা। তোমাকে হাসাতে চেয়ে, বহুবার কেঁদেছি আড়ালে। তুমি আমার অপেক্ষার শেষ প্রহর, ১৬ বছরের প্রতীক্ষার অমূল্য পুরস্কার। তোমাকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেয় নি আমি, দিয়েছি আবিরের বউয়ের স্বীকৃতি। আমি তোমাকে ভালোবেসেছি, ভালোবাসি আর আমৃত্যু ভালোবেসে যাব।
ইতি,
তোমার আকাঙ্ক্ষিত স্বামী
মেঘ ক্যাপশন পড়ে ৫ মিনিটের জন্য নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। ৫ মিনিট পর মনোযোগ দিয়ে ছবিগুলো দেখতে লাগল। গতকাল পার্লার থেকে সেজে যাওয়ার পর থেকে নিজেকে কেমন লাগছে সেটা দেখার সুযোগ ই পায় নি, বিয়ের ছবি পর্যন্ত দেখে নি তবে কয়েক ঘন্টায় আবিরের মুখ থেকে হাজারখানেক প্রশংসা সহ আবিরের দুর্বৃত্ত কথা শুনতে হয়েছে। সুযোগ পেলেই মেঘের কানের কাছে ফিসফিস করে নিজের অব্যক্ত অনুভূতি জাহির করেছে আর মেঘ শুধু আবিরের পাগলামিই দেখে গেছে। এমনকি কবুল বলার সময় আবিরের অস্থিরতা দেখে মেঘ নির্বাক ছিল, নিষ্পলক চোখে কেবল তাকিয়েই ছিল। মিনিমাম লাজলজ্জা বিসর্জন দিয়ে আবির উচ্চশব্দে বলছিল,
“পৃথিবীর যা কিছুর বিনিময়েই হোক, আমি সবকিছু দিতে রাজি হয়েই মেঘকে বউ হিসেবে কবুল করলাম।
আলহামদুলিল্লাহ কবুল, কবুল কবুল।”
যেখানে একবার কবুল করলাম কিংবা আলহামদুলিল্লাহ কবুল বললেই বিয়ে সম্পন্ন হয়ে যায় সেখানে আবির বলেই যাচ্ছিলো। আবিরের কাণ্ড দেখে কাজী সাহেবও না হেসে পারলেন না। কাজীর মুখে হাসি দেখে আবির পরপর উদ্বিগ্ন কন্ঠে শুধালো,
” আমাদের বিয়ে হয়েছে তো?”
কাজী সাহেব উঠে যেতে যেতে বললেন,
” আলহামদুলিল্লাহ, এতদিনে পরিপূর্ণ হয়েছে।”
“আলহামদুলিল্লাহ। ”
কাজী চলে যেতেই আবির মেঘের দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে বলে উঠল,
“এই ভরাট মজলিসে সবাইকে সাক্ষী রেখে আমি আবির তার মেঘকে বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছি। মেঘ কি আবিরকে স্বামী হিসেবে কবুল করছে?”
মেঘ আবিরের ঝলমলে চোখের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট চেপে হেসে মোলায়েম কন্ঠে জবাব দিয়েছিল,
” কবুল করলাম, আলহামদুলিল্লাহ কবুল, কবুল কবুল।”
আবিরের পাগলামি সেখানেই থামেনি। গতকাল বাসায় ফেরার সময় আবির হঠাৎ ই মেঘের কানে ফিসফিস করে বলছিল,
” চিরদিনের জন্য শ্বশুর বাড়িতে চলে যাচ্ছিস এবার একটু কান্না কর। মানছি একই বাড়িতে যাচ্ছিস তাই বলে কাদঁবি না?”
মেঘ ভেঙচি কেটে বলেছিল,
“আপনার যদি এতই শখ থাকে তাহলে আপনি কান্না করেন।”
প্রতিত্তোরে আবির বলেছিল,
“তুই নববধূর মতো কান্নায় ভেঙে পড়বি, নতুন জামাইদের মতো আমি তোকে সান্ত্বনা দিব। এটা আমার জীবন থেকে মিস হয়ে গেল। এক কাজ করি, চল দুজন একসঙ্গে কান্না শুরু করি।”
গতকাল আবিরের আজগুবি কথা শুনে মেঘ কপাল কুঁচকালেও আজ কথাগুলো মনে করে আনমনে হেসে ফেলল। পুনরায় ছবি দেখায় মনোযোগ দিল। নিজের পড়নের মেরুন রঙের বিয়ের বেনারসি, গা ভর্তি ভারী গহনা, মাথায় ঘোমটা সহ চোখধাঁধানো আড়ম্বরপূর্ণ সাজসজ্জা দেখে মেঘ নিজেই লজ্জায় পড়ে যাচ্ছে। সেই সাথে রাজোচিত শেরওয়ানিতে আবিরকে যেন রাজপুত্রের মতো লাগছে। গতকাল আবিরের অযাচিত দুষ্টামির জন্য সামনাসামনি ঠিকমতো দেখতেই পারে নি তবে আজ ছবিগুলো খুব ভালো করে দেখছে। আয়নায় দু’জনের মুখ দেখা, মেঘের কপালে আবিরের চুমু দেয়া, একে অপরের চোখে চোখ রেখে নিগূঢ় ঘোরে বন্দি থাকা, বরণের ছবি সহ আরও ২-৩ টা ছবি আপলোড করেছে। মেঘ সবগুলো ছবি দেখা শেষে কৌতূহল বশত কমেন্টস দেখতে গেল। আবিরের বন্ধু, ছোট ভাই, বড় ভাই, রাকিব, সাকিব, তানভির, মাইশা আপু সহ সবাই নিজেদের মতো অভিনন্দন জানানোর পাশাপাশি উস্কানিমূলক মন্তব্যও করেছে। কারো কারো মন্তব্য দেখে মেঘ বেশ বিস্মিত হচ্ছে। এরমধ্যে বন্যা আসছে। মেঘের লাজুক হাসি দেখে মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করল,
“হাসছিস কেন? ভাইয়ার পোস্ট দেখে?”
মেঘ কপাল কুঁচকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” তুই কিভাবে জানিস?”
” শুধু আমি না বাড়ির সবাই এখন ভাইয়ার পোস্ট নিয়ে গবেষণা করছে, নিচে গেলেই বুঝতে পারবি।”
মেঘ শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
” তুই খেয়েছিস?”
“না। তোকে ডাকতেই আসছিলাম, তুই ফ্রেশ হয়ে আয় একসাথে খাব।”
“আচ্ছা। ”
বন্যা মীমের রুমে চলে গেছে। ইদানীং মেঘ ব্যস্ত থাকায় বন্যার মীম আর আইরিনের সাথে খুব ভালো সম্পর্ক হয়ে গেছে। দু’জনেই তানভিরের কথা জানে তাই তানভিরের হাত থেকে বন্যাকে সবসময় প্রটেক্ট করে। ড্রয়িং রুমে সোফায় হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে আছে আবির। রান্না ঘরে রান্নার আয়োজন চলছে, ইকবাল খান ছাদ থেকে নেমে আবিরকে এভাবে বসে থাকতে দেখে কিছুটা উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
“কিরে আবির, এভাবে বসে আছিস কেন?”
আবির চোখ খুলে কাকামনিকে একপলক দেখে পূর্বের অবস্থায় থেকে উত্তর দিল,
” আমার মনটা খুব খারাপ। ”
ইকবাল খান নেমে এসে আবিরের পাশে বসতে বসতে শুধালেন,
” মন খারাপ কেনো? বিয়ে তো সবাই মেনেই নিয়েছে। তাহলে মন খারাপ কেনো থাকবে?”
আবির তপ্ত স্বরে বলতে শুরু করল,
” মন খারাপ থাকবে না কেন? মানুষ এলাকা ছেড়ে দু-এক বছর বাহিরে থাকলেই কথা,আচরণ, চলাফেরা সব বদলে যায় সেখানে ২০-৩০ বছর ঢাকা শহরে থেকে এখনও গ্রামের কি সব আজগুবি নিয়মনীতি পালন করছে। বিয়ের পর বউ আলাদা কেনো থাকবে? এতবছর অপেক্ষা করে, নিজের সাথে নিজে যুদ্ধ করে, আল্লাহ র কাছে চাইতে চাইতে মেঘকে পেয়েছি, কেউ কি জানে সেটা? কিছুদিন যাবৎ এই বাড়ির প্রতিটা মানুষ আমার ইমোশন নিয়ে প্রতিনিয়ত খেলতেছে তারপরও আমি চুপ করে আছি। আমি যদি ঘুনাক্ষরেও এসব টের পেতাম তাহলে মেঘকে নিয়ে আগেই পালিয়ে যেতাম। তোমরা যা করছো তা আমি কখনো ভুলবো না৷ আমি এর তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি।”
ইকবাল খান শীতল কন্ঠে বললেন,
” এভাবে বলছিস কেনো, একেক এলাকার একেক রীতি। একটু আধটু মেনে নিতেই হবে।”
আবির কিছু বলার আগেই পেছন থেকে আলী আহমদ খান গুরুগম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলেন,
” তোমার নিন্দা জানানো শেষ হলে বাহিরে আসো, কাজ আছে।”
আলী আহমদ খানের কন্ঠ শুনে আবির চমকে উঠে পেছনে তাকালো। আব্বুর রাগী রাগী চোখমুখ দেখে নিজের মুখ চেপে ধরল। আলী আহমদ খান কখন এসেছে আর ঠিক কতটুকু কথা শুনেছে এটা ভেবেই আঁতকে উঠছে আবির। ইকবাল খানের সাথে আবিরের ফ্রেন্ডলি সম্পর্ক হওয়ায় যা ইচ্ছে বলে দিতে পারে কিন্তু আব্বুর সামনে সে যথাসাধ্য ভদ্র থাকার চেষ্টা করে। কিন্তু আজ এভাবে ধরা পড়ে যাবে সেটা কল্পনাও করতে পারে নি। আবির মাথা নিচু করে দাঁত দিয়ে জিভ কামড়ে বাসা থেকে বেড়িয়ে গেছে। ইকবাল খান আলী আহমদ খানের মুখের পানে চেয়ে মলিন হাসলেন আলী আহমদ খানও নিঃশব্দে হেসে বেড়িয়ে গেছেন।
কিছুক্ষণের মধ্যেই মেঘ নিচে নামলো। মেঘকে দেখেই রাকিব অকস্মাৎ বলে উঠল,
“এইযে ভাবি, আমার বন্ধুর ১৬ বছরের অব্যক্ত অনুভূতির বহিঃপ্রকাশে লেখা খোলা চিঠি পড়ে আপনার অনুভূতি কি?”
মেঘ শাড়ির আঁচল টেনে মাথায় দিয়ে চিবুক নামিয়ে লাজুক হাসলো। রিয়া রাকিবকে উদ্দেশ্য করে বলল,
” ভাইয়া সবেত প্রকাশ করেছে, মেঘকে অনুভব করার সময় দাও। বিয়ের ঘোরটা আগে কাটুক তারপর জিজ্ঞেস করো।”
” ঠিক আছে জান। তুমি যা বলবে তাই হবে৷ ”
রিয়া ঠোঁট বেঁকিয়ে রাগী স্বরে বলল,
” হঠাৎ এত ভালোবাসা কোথা থেকে আসছে?”
“রাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের পানে তাকিয়ে কল্পনা করে আবির যেভাবে চিঠিটা লিখছিল সেটা দেখে আমারও খুব ইচ্ছে হয়েছিল তোমাকে নিয়ে একটা চিঠি লেখার। কিন্তু বিশ্বাস করো
‘তুমি ফাল্গুনের সেই রক্তিম শিমুল ফুল, আমার হৃদয়ের..’
এরপর আর কিছু ভেবেই পাচ্ছিলাম না। ৩০ মিনিট ভেবেছি, তানভিরকে নিয়ে গবেষণা করেছি কিন্তু লাইনটা আর সম্পূর্ণ করতে পারি নি। তারপর মনে হলো, কবিতা আর চিঠি লেখার থেকে সকাল সন্ধ্যা ‘বাবু খাইছো?’ জিজ্ঞেস করাটা খুব সহজ সমাধান। ”
রিয়া বিরক্ত হয়ে বলল,
” তুমি আসলেই একটা আনরোমান্টিক।”
রাকিব হেসে উত্তর দিল,
” বিয়ে করেছি ৬ মাস হতে চলল, এখনও আমি কত রোমান্টিক দেখেছো? তুমি বললে শিমুল ফুল না দিতে পারলেও কচুরিফুল ঠিকই দিতে পারবো। আর কি চাও? ”
রিয়া রাগান্বিত কন্ঠে হুঙ্কার দিল,
” তুমি আপাতত চোখের সামনে থেকে যাও।”
“আজকাল ভালোবাসার কোনো মূল্য নেই। নিজের বিয়ে করা বউও বলে আমি নাকি আনরোমান্টিক। ধিক্কার জানায়। ”
“কাকে ধিক্কার জানাচ্ছো?”
“নিজেকেই।”
রিয়া সহসা হাসতে শুরু করেছে, সেই সাথে মেঘও হাসছে। আবির এসে রাকিবের কাঁধে হাত রেখে ধীর কন্ঠে জানতে চাইল,
” কি হচ্ছে এখানে?”
আবিরের কন্ঠ শুনে মেঘ আড়চোখে তাকালো।আবিরকে এক পলক দেখেই লজ্জায় নুইয়ে পড়েছে। গতকালও এত লজ্জা পায় নি যতটা লজ্জা আজ পাচ্ছে, অবিলম্বে ঘোমটা টেনে মুখ ঢাকার চেষ্টা করল।
রাকিবের সাথে দু একটা কথা বলে, আবির মেঘের সামনে এসে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত কোমল কন্ঠে বলল,
“আসসালামু আলাইকুম। ”
লজ্জায় আড়ষ্ট মেঘ ঠান্ডা কন্ঠে বলল,
“ওয়ালাইকুম আসসালাম। ”
“শুভ সকাল, বউ।”
“শুভ সকাল। ”
রাকিব গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
” তোর বউ এটা আমরা সবাই জানি তাই বলে সারাদিন বউ বউ করবি?”
” ভাবছি, কিছুদিন দিনরাত এক করে শুধু বউ ই ডাকব।”
মাহমুদা খান মালিহা খানের রুম থেকে বেড়িয়ে আসতে আসতে ভারী কন্ঠে বললেন,
” আবির তোর কি কোনো কাজ নেই? সকাল সকাল মেঘকে জ্বালাচ্ছিস কেনো?”
আবির কপাল কুঁচকে, ঠোঁট বেঁকিয়ে শক্ত কন্ঠে বলল,
” আমি কোথায় জ্বালিয়েছি? এতক্ষণ কাজ করে কেবল ই আসলাম। ফুপ্পি তোমার আমার সাথে কিসের শত্রুতা বলো তো, আব্বুর সাথে তুমিও এমন আচরণ শুরু করেছো কেনো? তোমাদের থেকে তো আমার শ্বশুরই ভালো, মেয়ে খেয়েছে কি না দেখতে আমাকে জোর করে পাঠিয়েছেন। আর তোমরা?”
মাহমুদা খান রাশভারি কন্ঠে বললেন,
” ভাইজান খুব সহজে মেনে নিয়েছে তো তাই কিছু বুঝতে পারছিস না, ভাইজানের ধমক না শুনা পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছিস না। তাই না? তোর আচরণে কোনো কারণে ভাইজান যদি রেগে যান, বাড়ি ভর্তি মেহমানের সামনে চিৎকার চেঁচামিচি করেন বিষয়টা কি ভালো লাগবে? তার থেকে ওনি শান্ত আছেন তুইও একটু শান্ত থাক। ”
“ঠিক আছে, থাকলাম শান্ত।”
আবির মুখ ফুলিয়ে শ্বাস ছেড়ে মেঘের দিকে তাকিয়ে ব্যস্ত কন্ঠে বলল,
” বউ তুমি খেয়ে নেও হ্যাঁ, তোমার ফুফু শ্বাশুড়িটা ভালো না। একদম মহিলা হি*টলা*রের মতো আচরণ করছেন। আমি এখন পালায়। ”
আবির এক দৌড়ে বাসা থেকে বেড়িয়ে গেছে, রাকিবও হাসতে হাসতে চলে গেছে। মাহমুদা খান হেসে বললেন,
” মেঘ, খেতে বস। আমি ওদের ডেকে নিয়ে আসি।”
একটু পরেই সবাই খেতে নেমেছে। মেঘকে দেখেই জান্নাত বলে উঠল,
“তুমি আমার স্নিগ্ধ সকালের সুললিত গন্ধরাজ, পড়ন্ত বিকেলের একগুচ্ছ বাগানবিলাস।”
পাশ থেকে আইরিন বলল,
” ভাবি এইটা না, আমার ঐ লাইনটা বেশি ভালো লেগেছে।
নীল দিগন্তের উড়ন্ত মেঘেরা জানে, কত স্বপ্ন উড়িয়েছি বেনামি খামে।”
রিয়া মৃদুহেসে বলল,
” তোমরা শুধু শুধু মেঘকে জ্বালিয়ো না। মেঘ আমি তোমাকে ভালোবেসেছি, ভালোবাসি আর আমৃত্যু ভালোবেসে যাব। তুমি একদম মন খারাপ করবে না কেমন!”
ওদের দুষ্টামিতে মেঘ চোখ তুলে তাকাতেই পারছে না। এরমধ্যে মালা এসে একটা চেয়ার টেনে বসলো। আইরিন মজার ছলে জিজ্ঞেস করল,
” মালা আপু, আপনার কোন ডায়লগ টা ভালো লেগেছে?”
“কিসের ডায়লগ?”
” আবির ভাইয়া মেঘ ভাবিকে নিয়ে ফেসবুকে খোলা চিঠি লিখেছে। আপনি দেখেন নি?”
মালা আইরিনকে দেখে পরপর মেঘের লজ্জামাখা আদলের পানে তাকালো। মনে মনে বিড়বিড় করল,
“আমাকে ব্লক করে রাখলে কিভাবে দেখবো।”
আইরিন আবার জিজ্ঞেস করল,
“দেখেন কি?”
মালা বিরক্ত হয়ে বলল,
” খেয়াল করি নি।”
আবারও মনে মনে বিড়বিড় করল,
” এসব আজাইরা ভালোবাসা দেখলেই শরীর টা জ্বলে। ”
বউভাত উপলক্ষে মেঘ আজ অফ হোয়াইট রঙের মধ্যে গোল্ডেন স্টোনের একটা গর্জিয়াছ লেহেঙ্গা পড়েছে। আবির মেঘের সাথে ম্যাচিং করে অফ হোয়াইট রঙের স্যুট পড়েছে। বাকিরাও যে যার মতো সেজেছে। মালা আজ হুট করে একটা গর্জিয়াছ শাড়ি পড়েছে। মালার সাজ দেখে সাকিব মেকি স্বরে বলল,
“ছ্যাঁকা খেয়ে মানুষকে ঘরের দরজা বন্ধ করে সপ্তাহব্যাপী বা মাসব্যাপী কাঁদতে দেখেছি অথচ তুই তা না করে নাচতে নাচতে বিয়ে খেতে চলে আসছিস। তোর কি মিনিমাম লজ্জা নেই?”
“লাজ লজ্জা ধুয়ে কি শরবত খাবো নাকি? আর একটা কথা শুনে রাখ, আমি চাইলেই আবির ভাইয়াকে বিয়ে করতে পারতাম কিন্তু আমি মেঘের মতো এত উন্মাদ না যে আমার আবির ভাইকেই লাগবে। ”
সাকিব ফিক করে হেসে বলল,
“কথায় আছে, পাগলের সুখ মনে মনে। আর কি কি বলে নিজেকে সান্ত্বনা দিচ্ছিস জানাইস আমাকে। প্রয়োজনে আমি আরও কিছু এড করে দিব। আর রইল বাকি মেঘবতীর পাগলামির কথা, আবির ভাইয়া দেশে আসছেই মেঘকে পাগল করতে। ১৪ বছর তো একায় পাগলামি করে গেল। ভাইয়ার কি ইচ্ছে হয়না মেঘবতী তার জন্য একটু পাগলামি করবে, বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় থাকবে, তাকে দেখার জন্য বা একটু কথা বলার জন্য উতলা হয়ে থাকবে, তার দিকে কেউ তাকালে অগ্নিকন্যার রূপ নিবে, মূল কথা ভাইয়াকে পাগলের মতো ভালোবাসবে। মেঘবতীর মনে প্রবল প্রমত্ততা জাগাতে ভাইয়া ই সব করেছে। তাই তোর চোখে মেঘবতী উন্মাদ হলে আবির ভাইয়া তার গুরু।”
মালা রাগে কটমট করে চলে যেতে নিলে অলক্ষিতভাবে লিমনের সাথে ধাক্কা খেল। মালা মাথায় হাত দিয়ে রাগান্বিত কন্ঠে হুঙ্কার দিল,
” আপনি কি চোখে দেখেন না?”
লিমন মালার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল
” মাঝে মাঝে একটু কম ই দেখি। ”
মালা রাগে ফোঁস ফোঁস করে চলে গেছে। মাইশা আপু আর ওনার হাসবেন্ড আজ দুপুরেই আসছেন। আবির কল দিতে দিতে অনেক কষ্টে আপুকে রাজি করিয়েছে। মেঘ আপুকে দেখেই আহ্লাদী কন্ঠে বলল,
” আপু মনে আছে তো, বাবুকে কিন্তু সর্বপ্রথম আমার কোলে দিতে হবে।”
“হ্যাঁ গো মনে আছে। দোয়া করো, বাবু সুস্থভাবে হলে তোমার কোলেই প্রথমে দিব।”
মেঘ এক গাল হেসে বলল,
“ঠিক আছে।”
আবির মেঘের দিকে তাকিয়ে কিছু ভেবে আনমনে হাসলো। মেঘ বিষয়টা খেয়াল করে জিজ্ঞেস করল,
“হাসছেন কেন?”
” এমনিতেই। ”
“বলুন।”
“রাতে বলব।”
“না, এখনই বলুন।”
“I love you. I want to hug you. I wanna kiss you.”
মেঘ সঙ্গে সঙ্গে আবিরের হাতে চিমটি কেটে ব্যস্ত কন্ঠে বলল,
” চুপ করুন।”
” এখন তো চুপ করতেই বলবি। অফিসিয়াল বিয়ের ২৪ ঘন্টা পেরিয়ে গেছে অথচ এখনও অফিসিয়াল আলিঙ্গনটায় করতে পারলাম না।”
মেঘ নিজের কপাল চাপড়ে বিড়বিড় করল,
” এত নির্লজ্জ কবে হলেন আপনি?”
” তোকে বিয়ে করার পর । ”
সারাদিনের অনুষ্ঠান শেষে বিকেলের দিকে অনেক আত্মীয় স্বজনই চলে গেছেন। এশা পর্যন্ত সবাই মোটামুটি ব্যস্ত ছিল। এশার নামাজ পড়ে মোজাম্মেল খান আর আলী আহমদ খান একসাথে চা খেতে বসেছেন। কিছুক্ষণের মধ্যে আবির আর ইকবাল খানও এসেছেন। তানভির, সাকিব,রাকিব, আরিফ মিলে বাসরঘর সাজাচ্ছে। গতকাল তানভির বোনের পক্ষে থাকলেও আজ সে আবিরের পক্ষে। আবির নামাজ থেকে এসেই নিজের রুমে চলে গেছে। ভুল করেও কেউ যেন লাল গোলাপ না লাগায় তারজন্যই মূলত দেখতে গেছে। ফুল কিনতে যাওয়ার আগেই তানভিরদের বার বার বলে দিয়েছে ভুলেও যেন লাল গোলাপ না আনে। মিনহাজ মেঘকে লাল গোলাপ দেয়ার মতো বিশাল অপরাধের শাস্তিস্বরূপ আবির সেই রাগ মিনহাজের উপর না দেখিয়ে গোলাপের উপর দেখাচ্ছে। বিয়ে উপলক্ষে আবিরের রুম সম্পূর্ণ পরিষ্কার করা হয়েছে। আবিরের শৈশব-কৈশোরের যত স্মৃতি ছিল, সব সরিয়ে একদম ফাঁকা করে দিয়েছে৷ বিয়ের ঝামেলা মিটলে প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্র এনে রুম সাজানো হবে। গায়ে হলুদের দিন থেকে আবির আব্বু চাচ্চুর মুখোমুখি বসে নি। অবশেষে আজ আবির আব্বুর চাচ্চুর পাশে গিয়ে বসেছে।
মোজাম্মেল খান চিন্তিত স্বরে বললেন,
” কিছু বলবে?”
“জ্বি।”
“বলো।”
” আপনাদের পরিকল্পনার বাহিরে আমি যে কাজগুলো করতে বলেছিলাম সেগুলোর খরচ জানতে চাচ্ছিলাম। আমি পেমেন্ট দিয়ে দিচ্ছি সম্ভব হলে রাতে বা সকালের মধ্যে পরিশোধ করে দিবেন। ”
আলী আহমদ খান ঠান্ডা কন্ঠে বললেন,
” তোমার দিতে হবে না।”
” আব্বু, আমি আগেই বলে রেখেছিলাম। অন্ততপক্ষে আমার পরিকল্পনাগুলোর টোটাল পেমেন্ট আমি করব।”
মোজাম্মেল খান আস্তে করে বললেন,
” আচ্ছা তুমিই করো। কিন্তু এত তাড়াহুড়ো করার প্রয়োজন নেই। ইমারজেন্সি সবার পেমেন্ট করে ফেলেছি। আর যারা নেয় নি তাদের কাল পরশুর মধ্যে দিয়ে দিব।”
“আমি হিসাবটা দেখতে চাচ্ছিলাম, চাচ্চু।”
” আমার কি কপাল, মেয়ের জামাই কত সুন্দর করে চাচ্চু বলে ডাকছে।”
আবির মৃদু হেসে মেকি স্বরে বলল,
“মেঘের মতো আমিও কি আব্বাজান বলে ডাকবো?”
আলী আহমদ খান, মোজাম্মেল খান এবং ইকবাল খান তিনজনেই একসঙ্গে হেসে উঠলেন। প্রায় এক ঘন্টা যাবৎ চারজন মিলে হিসাব করছে। এদিকে জান্নাত আর রিয়া মিলে মেঘকে সাজাচ্ছে আর বাসরের নিয়মকানুন শিখিয়ে দিচ্ছে। মেঘের মনে ভয়, লজ্জা, আতঙ্কের সাথে সাথে এক অজানা ভালোলাগাও কাজ করছে। রাত ১০ টার পর পর ওদের সাজানো শেষ হয়েছে। আবিরের নিষেধাজ্ঞা থাকায় লাল গোলাপ ছুঁয়েও দেখেনি। গাদা, বেলি, কাঠগোলাপ, ৩-৪ রঙের জারবেরা, জিনিয়া সহ যে যে ফুল পেয়েছে সব দিয়েই সাজিয়েছে। সাজানো শেষেই মেঘকে নিয়ে বিছানার মাঝ বরাবর বসিয়েছে। মেঘের সামনে ফুলের পাঁপড়ি দিয়ে একটা লাভ এঁকে তাতে A আর M লিখেছে। তারপর শুরু হয়েছে দল ভাগাভাগি, কয়েকজন আবিরের পক্ষে থাকলেও বেশিরভাগই মেঘের পক্ষে। তানভির আজ আবিরের পক্ষে শুনে বন্যা রাগী রাগী মুখ করে বলল,
” আপনি দু’মুখো সাপের মতো আচরণ করছেন কেনো?”
তানভির হেসে বলল,
” বোনের বিয়ের পর স্বাভাবিকভাবেই বোন শ্বশুরবাড়িতে চলে যায়। ভাগ্য ভালো আমার বোন আমার চোখের সামনে আছে। বনুর শ্বশুর বাড়ি অন্য কোথাও হলে আজকের বাসরঘর সাজানো অসম্ভব ছিল। তাছাড়া বড় ভাই হয়ে ছোট বোনের বাসর আটকানো টা তেমন শোভা পায় না।”
বন্যা আর কিছু বলে নি। এদিকে আবিরদের হিসাব নিকাশের এক পর্যায়ে মোজাম্মেল খান বললেন,
” অনেক তো হিসেব দেখলে এখন বরং যাও তুমি। ”
আবির ঘাড় ঘুরিয়ে মালিহা খানকে উদ্দেশ্য করে বলল,
” আম্মু, তোমাদের যা যা নিয়মকানুন আছে তাড়াতাড়ি শেষ করো। আমার ঘুম পাচ্ছে। ”
মোজাম্মেল খান অকস্মাৎ কাশতে শুরু করলেন।
ইকবাল খান আবিরের হাত চেপে বিড়বিড় করে বলল,
“বাবা-চাচারা আছে, কথাবার্তা একটু সাবধানে বল।”
আবির ভ্রু কুঁচকে মনে মনে বিড়বিড় করল,
” গত দু’রাতে একফোঁটাও ঘুমাতে পারি নি। এখন বিয়ে করেছি বলে কি ঘুম পেলেও বলা যাবে না?”
আবির নিশ্চুপ দেখে মোজাম্মেল খান স্বাভাবিক কন্ঠে বললেন,
” বাকিগুলো সকালে দেখে নিও।”
আবির তপ্ত স্বরে বলল,
“আর কিছু দেখতে হবে না। যা লাগবে তানভিরকে বললেই হবে। ”
মাহমুদা খান এসে মৃদুস্বরে বললেন,
” আবির, তুই এখন রুমে যেতে পারিস।”
আবির হঠাৎ ই কেমন যেন লজ্জা পাচ্ছে। লজ্জায় উঠে যেতে পারছে না। আলী আহমদ খান অকস্মাৎ বকে উঠলেন,
” এত লজ্জা পেতে হবে না, যাও। ”
আবির মাথা নিচু করে উঠে রুমের দিকে চলে গেছে। রুমের সামনে যথারীতি দু’দল মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। তানভির আবিরের দলের হওয়া স্বত্তেও ওরা জোরপূর্বক তানভিরকে রুমের ভেতরে রেখেছে। আবির দরজা থেকে উঁকি দিয়ে বিছানাটা দেখে নিল। মাথায় ঘোমটা দিয়ে নববধূ বিছানায় বসে আছে। আবির বাকিদের উদ্দেশ্যে স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
“কি চাই?”
“তেমন কিছু না। ”
রাকিব আবিরের পাশ থেকে বলে উঠল,
” আজ যত ইচ্ছে দে আমি বারণ করব না। কারণ, বাসর আমিও সাজিয়েছি তাই ভাগ আমিও পাবো। ”
আবির রাকিবের দিকে তাকিয়ে হাসলো। আইরিন অকস্মাৎ বলে উঠল,
” ভাইয়া তাড়াতাড়ি টাকা দিয়ে আমাদের বিদায় করো।”
আবির শান্ত কন্ঠে বলল,
“তোরা কত চাস সিদ্ধান্ত নিয়ে তানভিরের কানে কানে বল।”
আইরিন, জান্নাত, রিয়া, মীম, বন্যা ফিসফিস করে কিছুক্ষণ ভেবে চিন্তে তানভিরকে জানালো। আবির সঙ্গে সঙ্গে বলল,
” সিদ্ধান্ত ফাইনাল?”
“হ্যাঁ।”
“এখন সামনে থেকে সরো।”
” কেনো সরবো? আগে টাকা দিবে তারপর যাব।”
আবির তপ্ত স্বরে বলল,
“আমি যেতে বলি নি আপু, সরতে বলেছি। বউ না দেখে আমি তোমাদের কিছু দিতে পারছি না ।”
“বউ দেখে ফেললে তো শেষ ই।”
“তোমরা যেমন আমাকে বিশ্বাস করতে পারছো না তেমন আমিও পারছি না। আমার বউ এর জায়গায় অন্য কাউকে যে বসিয়ে রাখো নি তার কি গ্যারেন্টি আছে? তোমাদের সহজ সমাধান দিয়েছি, তোমাদের এমাউন্ট আমি না জানলেও তানভির জানে। আমার বউ ঠিকঠাক থাকলে তোমরা তোমাদের প্রাপ্য পেয়ে যাবে। আগে বউ দেখব তারপর টাকা দিব। এখন তোমরা ভেবে দেখো। ”
“ঠকাবে না তো?”
” তোমরা আমাকে না ঠকালে আমিও তোমাদের ঠকাবো না। ”
“ঠিক আছে। ”
ওরা এক প্রকার বাধ্য হয়েই আবিরকে রুমে ঢুকতে দিয়েছে। আবির রুমে ঢুকেই মেঘকে উদ্দেশ্য করে সালাম দিলো। মেঘ কাঁপা কাঁপা গলায় সালামের উত্তর দিয়েছে। এতক্ষণ যাবৎ মেঘ শান্ত থাকলেও এখন আর শান্ত থাকতে পারছে না, আবির যত কাছাকাছি আসছে মেঘের শরীরের প্রতিটা শিরা-উপশিরার রক্ত সঞ্চালন তত বেড়ে যাচ্ছে, ঢোক গিলে বার বার নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছে। আবির কিছুটা ঝুঁকে খুব যত্নসহকারে আস্তেধীরে মেঘের ঘোমটা উঠালো, লজ্জায় রাঙা মেঘের নামানো চিবুক দেখে কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকালো। আবির সহসা দু’আঙুলে মেঘের চিবুক উঠালো। আবিরের শক্ত হাতের কোমল স্পর্শে মেঘের শীর্ণ অধর থরথর করে কাঁপছে, হৃদয়ের তোলপাড়ে নিঃশ্বাস এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে, ঘন ঘন পল্লব ঝাপ্টে নিভু নিভু চোখে আবিরের দিকে তাকাতেই আবির সহসা বুকের বা পাশে হাত রেখে নেশাক্ত কন্ঠে বলল,
“হায়! মাশাআল্লাহ। ”
সঙ্গে সঙ্গে বিছানার উপর লাভ লেখা অংশে ধপ করে পড়ে গেছে। মীম, আদি,আইরিন কিছুটা আতঙ্কিত হলেও বাকিরা আবিরের কাণ্ড দেখে মুচকি মুচকি হাসছে। মেঘ কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকে আবিরের মুখের দিকে তাকালো। আবির আচমকা কাত হয়ে মেঘের দিকে ঘুরে হাতের উপর মাথা রেখে মৃদুগামী কন্ঠে বলল,
“অবশেষে, আবিরের একান্ত চাঁদ
আবিরের রুমে দীপ্তি ছড়াচ্ছে।”
মেঘ লজ্জায় চোখ সরিয়ে করে ফেলেছে। আবির পকেটে হাত দিয়ে যতগুলো ৫০০ আর ১০০০ টাকার নোট পেয়েছে সব মেঘের হাতে মুষ্টিবদ্ধ করে দিয়েছে। রিয়া হাসিমুখে বলল,
” ভাইয়া আপনার চাঁদকে সারাজীবনের জন্য আপনার রুমে রেখে গেলাম। আপাতত আমাদের দিক টা একটু ভাবুন।”
আবির মেঘের দিকে তাকিয়ে মোলায়েম কন্ঠে বলল,
” ওরা কিছু চাচ্ছে, দিব?”
মেঘ কিছুই বলছে না, চুপচাপ বসে নিজের হৃৎস্পন্দন গুনছে। আইরিন সঙ্গে সঙ্গে বলল,
” এটা কিন্তু কথা ছিল না। তুমি বলেছো ভাবিকে দেখেই দিয়ে দিবে। ”
আবির মেঘের দিকে তাকিয়ে থেকেই ঠান্ডা কন্ঠে বলে উঠল,
” আমি আমার বউয়ের অনুমতি ব্যতীত কিছু দিতে পারছি না, সরি। ”
সবাই মেঘকে রিকুয়েষ্ট করছে কিন্তু মেঘ মুখ ফুটে কিছু বলতেই পারছে না। আবির মৃদু হেসে পুনরায় প্রশ্ন করল,
” কি হলো? দিয়ে দিব?”
মেঘ ঘাড় কাত করে সম্মতি জানালো। আবির সঙ্গে সঙ্গে বিছানা থেকে উঠে স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
” তোমাদের এমাউন্ট কত ছিল আমি জানি না আর জানতেও চাই না। আমার বউ যেহেতু সম্মতি দিয়েছে তাই তোমরা যা চেয়েছো তার ডাবল পাবে। ”
তানভিরের দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বলল,
” তানভির, ওদের এমাউন্ট বুঝিয়ে দিবি।”
“জ্বি ভাইয়া।”
জান্নাত, রিয়া একসঙ্গে বলে উঠল,
“ইসস, এত বড় মিস্টেক কিভাবে করলাম। আগে জানলে আরও বেশি চাইতাম। ”
আইরিন বলল,
” আমরা এখন নতুন করে এমাউন্ট চাইবো।”
আবির মুচকি হেসে বলল,
” সুযোগ একবার ই দিয়েছি সেই সুযোগ আর পাবে না। এখন সবাই যাও এখান থেকে।”
রাকিব আবিরের কানে কানে ফিসফিস করে কিছু বলেই দৌড়ে বেড়িয়ে গেছে। বাকিরাও যে যার মতো চলে গেছে। বন্যা মেঘের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বেড়িয়েছে। তানভির আগেই বেড়িয়ে গিয়েছিল, আবির দরজা বন্ধ করতে যাবে অকস্মাৎ তানভির হাজির হলো। আবির শক্ত কন্ঠে বলল,
“আবার কি?”
তানভির মেঘকে এক পলক দেখে নিল। মেঘ মাথা নিচু করে নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে। তানভির গলা খাঁকারি দিয়ে অত্যন্ত কোমল কন্ঠে বলল,
” ভাইয়া, আমার বোনটা কিন্তু এখনও ছোট। তোমার অনাবশ্যক ভালোবাসাকে একটু কন্ট্রোলে রেখো, প্লিজ।”
#চলবে