আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে পর্ব-১০২ এবং শেষ পর্ব

0
25

#গল্পঃ_আমৃত্যু_ভালোবাসি_তোকে_
#পর্বঃ_১০২
#লেখিকাঃ_সালমা_চৌধুরী_

আবির ভ্রু গুটিয়ে সরাসরি তানভিরের চোখের দিকে তাকিয়ে কর্কশ গলায় বিড়বিড় করল,
” তুই না আমার সম্বন্ধী?”

তানভির নিঃশব্দে হেসে অত্যন্ত ধীর কন্ঠে বলল,
“তুমি না আমার ভাই? তাছাড়া পুরো পৃথিবী জানে তুমি আমার বন্ধু টাইপের ভাই তাই আমার সবদিক থেকে পারমিশন আছে।”

আবির দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
” জ্বি ভাই, বুঝতে পেরেছি। বলছিলাম কি ভাই আপনি পারমিশন দিলে আমি আপনার বোনের সাথে একান্তে কিছুটা সময় কাটাতাম। পারমিশন দিবেন, ভাই?”

“জ্বি ভাই, আপনার জন্যই এত আয়োজন। বেস্ট অফ লাক, বাই। ”

তানভির চলে যাচ্ছে, আবির মুচকি হেসে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। দরজা বন্ধের শব্দে মেঘের শরীর ঝাঁকি দিয়ে উঠেছে, মাথা নিচু করে জোরে নিঃশ্বাস ছাড়লো। আবির আড়চোখে মেঘের দিকে তাকালো, ঠোঁটে লেগে আছে দুষ্টু হাসি। ধীর পায়ে এগিয়ে গেল মেঘের কাছে, আবিরের তৃপ্ত দুচোখ চকচক করছে। উৎকণ্ঠায় মেঘের চিবুক নেমে গলায় ঠেকেছে, ক্ষীণ বক্ষের তীব্র কম্পনে শরীর ঘেমে একাকার অবস্থা। আবির আগপাছ না ভেবেই আচমকা মেঘের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পরেছে। অপ্রত্যাশিত ঘটনায় মেঘ চমকে উঠে, বুকের ভেতর পর্যন্ত স্তব্ধ হয়ে গেছে। মেঘ সঙ্গে সঙ্গে চোখ বন্ধ করে ফেলেছে, হাত-পা সহ সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে। আবির অকস্মাৎ জামা-কাপড়ের উপর দিয়ে মেঘকে জড়িয়ে ধরে পেটে মুখ গুঁজল। আবিরের অবাঞ্ছিত স্পর্শে মেঘের জোড়াল বক্ষস্পন্দন আরও বেশি জোড়ালো হতে শুরু করেছে, নিরবে ঢোক গিলে এলোমেলো নিঃশ্বাস ছাড়ছে। আবির ভয়ঙ্কর আবেশে আবদ্ধ, সুদীর্ঘ অবকাশের অস্ফুট প্রণয়ের অফিসিয়াল অনুমোদন পেয়েছে আজ। মেঘের শরীর থেকে আসা বিমুগ্ধকারী ঘ্রাণটা আবিরের নাসারন্ধ্রের সঙ্গে সঙ্গে হৃদয়ে তোলপাড় চালাচ্ছে, আবির এক মনে সেই ঘ্রাণটা উপলব্ধি করছে। মেঘের অভিমানে নাক ফুলানো, গায়ের তীব্র গন্ধ, দরদী স্পর্শ, আহ্লাদী কন্ঠের আবদার পূরণের পরিপূর্ণ অধিকার পেয়েছে আজ। এই মেঘ একান্ত আবিরের, পৃথিবীর আর কারো সাধ্য নেই যে আবিরের কাছ থেকে তার মেঘকে দূরে সরাবে। আজ ছোট্ট মেঘের আদুরে কন্ঠে বলা কথাগুলো আবিরের খুব মনে পড়ছে, অকস্মাৎ পেট থেকে মুখ সরিয়ে ঘাড় কিছুটা ঘুরিয়ে মেঘের অভিমুখে তাকালো। মেঘের বন্ধ চোখের পাতা আর কম্পিত অধর দেখে আবির আনমনে হেসে অত্যন্ত মোলায়েম কন্ঠে বলল,

” তুমি আমার বহু প্রতীক্ষিত একান্ত অভিলাষ,
হৃদয়ের মনিকোঠায় সঙ্গোপনে রাখার নির্মম প্রয়াস। আমার অবিচ্ছেদ্য প্রণয়ের উত্তাপ তুমি,
সকাল- সন্ধ্যা সর্বনাশের কারণটাও শুধু তুমি।”

মেঘের সংকোচ কোনোভাবেই কাটছে না, চোখ খুলে আবিরের দিকে তাকাতেও পারছে না। আবির মুচকি হেসে ডাকল,

“ওগো অপরূপা,
চেয়ে দেখো না মনোরমা। ”

মেঘ কিংকর্তব্যবিমুঢ়, আবিরের একের পর এক ভাবপ্রবণ কথা শুনে মেঘের অস্থিরতা বেড়েই চলেছে। বুকের ভেতরে চলমান ইতস্ততা কাটিয়ে চোখ পিটপিট করে তাকাল । আবিরের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই আবির অকস্মাৎ স্ব শব্দে হেসে উঠল। আবিরের প্রাণোচ্ছল হাসি দেখে মেঘ না হেসে পারল না। আবির হাসি থামিয়ে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে তপ্ত স্বরে শুধালো,
” আমাকে পেয়ে খুশি তো?”

মেঘ মাথা দুলিয়ে স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,
” আলহামদুলিল্লাহ, অনেক খুশি। আপনি?”

আবির আবারও মৃদু হাসলো। মেঘের কোল থেকে উঠে মুখোমুখি বসল। লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে মেঘের হাতটা শক্ত করে ধরে কোমল কন্ঠে বলতে শুরু করল,

” আলহামদুলিল্লাহ আজ আমি খুব খুশি। কারণ আমার স্পেরোকে দেয়া কথা আজ পরিপূর্ণভাবে রাখতে পেরেছি। ছোট্ট স্পেরোর সেই আহ্লাদী কন্ঠে বলা কথাটা, “আমাকে ছেড়ে যেতে পারবে না” স্পেরো ভুলে গেলেও আমি ভুলতে পারি নি। গত ১৬ টা বছর আমি শুধু এই একটা কথার জোরেই সব বিপত্তিতে টিকে ছিলাম। আজ আমার স্পেরোকে আবারও বলতে চাই, আমি ছেড়ে যায় নি কোথাও যায় নি। তোমার আবির তোমারই আছে। তুমি সেদিন শুধু বলেছিলে, “ছেড়ে যেও না” অথচ আমি বুঝেছিলাম “তোমাকে ছেড়ে বাঁচতে পারবো না”। শেষ বিকেলে পাখিদের বাড়ি ফেরার তাড়া দেখে তুমি আবেগী কন্ঠে বলেছিলে, ” ওদের মতো আমারও যদি আলাদা একটা বাড়ি থাকতো৷” আর আমি ভেবেছিলাম, “যেকোনো মূল্যেই হোক তোমাকে তোমার স্বপ্নের বাড়ি উপহার দিব” একবার খেলতে গিয়ে পায়ে ব্যথা পেয়েছিলাম বলে তুমি শীতল কন্ঠে বলেছিলে, “খেলতে না গেলে তো ব্যথা পেতে না” আমি মনে মনে বলেছিলাম, ” আজকের পর খেলতে যাব না” । জ্বরের ঘোরে আমার হাতটা আঁকড়ে ধরে তুমি বলেছিলে, “আমার কাছে থাকো” “আমিও থেকে গেলাম”। কোনো একদিন কোনোকারণে বাসায় আমাকে বকা দিচ্ছিলো দেখে তুমি সবার সামনে আমার হাতটা শক্ত করে ধরে বলেছিলে, ” আবির ভাইয়া শুধু আমার তোমরা কেউ কিছু বলতে পারবে না।”
“আমি আবির সেদিনই তোমার হয়ে গিয়েছিলাম”
নিজের সাথে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম বাঁচলে তোমার সাথেই বাঁচবো। ”

মেঘ অবিশ্বাস্য চোখে আবিরের অভিমুখে চেয়ে আছে, অতর্কিতেই বেড়েছে বুকের ভেতরের ধুকপুক শব্দ। আবিরের কথাগুলো শুনে মেঘের চক্ষুদ্বয় কোটর ছেড়ে বেড়িয়ে আসতে চাইছে। ফর্সা,লাজুক আদল মুহুর্তেই পরিবর্তন হয়ে গেছে, নাকের ডগায় মুক্তোর মতো বিন্দু বিন্দু ঘাম চিকচিক করছে। মেঘের উদ্বেজিত মনোভাব চোখে মুখে ফুটে উঠছে। যেই আবিরের প্রণয়ে আসক্ত মেঘ, সেই আবির মেঘের কাছেই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিল এতগুলো বছর। এটা ভেবেই মেঘের মস্তিষ্কের নিউরনে অনুরণন শুরু হয়েছে। মেঘ অসহায় মুখ করে আবিরের চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,
” আমি আপনাকে এতকিছু বলেছিলাম?”

আবির মেঘের দু’হাত নিজের দু গালে রেখে নিঃশ্বাস টেনে বলল,
“হুমমমমমমম”

“আমার মনে নেই কেনো?”

” কারণ তখন তুমি অনেক ছোট ছিলে। ”

” আপনি কখনো বলেন নি কেনো?”

” ভালোবাসা মুখে বলে হয় না পাগলি, তোমাকে নিজ থেকে অনুভব করতে হতো। আর আমি সেই অপেক্ষাতেই ছিলাম। ”

মেঘ কপাল কুঁচকে প্রশ্ন করল,
” আপনি আমাকে তুমি করে বলছেন কেনো?”

” শুনতে খারাপ লাগছে?”

“কেমন যেন অস্বস্তি লাগছে। আপনার মুখে তুই টায় মানায়। ”

” অভ্যাস করো, এখন থেকে তুমিটায় বেশি শুনতে হবে।”

“কেনো?”

আবির মৃদুস্বরে বলল,
” আমার সম্বন্ধী আমাকে ভয়ঙ্করভাবে ওয়ার্নিং দিয়েছে, বিয়ের পর তোমার সাথে তুই তুকারি করলে আমার নামে মা*ম*লা দিবে। তানভিরের এসব তুই তুকারি একদম পছন্দ না, ওর সাথে কথা বললে সচরাচর তোমাকে তুই বলে সম্বোধন করি না তারপরও ভুলে যদি বলে ফেলি তখন দেখা যায় রাগে সারাদিন আমার সাথে কথায় বলে না। গতকাল রাতে আমাকে লাস্টবারের মতো ওয়ার্ন করেছে যেন কোনোভাবেই তুই না বলি। পার্সোনালি ঘরে দরজা বন্ধ করে তুই বললেও আমার সম্বন্ধী,বাবা মা, শ্বশুর- শ্বাশুড়ি কিংবা কোনো আত্মীয়ের সামনে কোনোভাবেই তুই বলতে পারবো না। ”

মেঘ অভিনিবিষ্টের ন্যায় চেয়ে থেকে শান্ত কন্ঠে শুধালো,
” আপনি ভাইয়াকে ভয় পান?”

“না। তোমাকে ভয় পায়। ”

“মানে?”

আবির মেঘের হাত গাল থেকে নামিয়ে বুকের উপর রেখে বলতে শুরু করল,
” তোমাকে হারানোর ভয়ে আমার এইযে এইখানটা বারংবার কেঁপে উঠে। আবিরকে ধ্বংসের একমাত্র অস্ত্রই মেঘ। তানভির সহ আমার কাছের মানুষজন খুব ভালোভাবে জানে আমার জীবনে তোমার অস্তিত্ব ঠিক কতোখানি জুড়ে। আমাকে কোনোকিছুতে রাজি করাতে ব্যর্থ হলেই ইচ্ছেকৃত তোমার নাম নেয়। কারণ তারা জানে, তুমি আমার একমাত্র দূর্বলতা। এইযে তুমি কতশত কুসংস্কার মানো, কিছু হবে না জেনেও আবেগে নাচো। আমিও ঠিক তেমন, তোমার নামে কিছু শুনলে বুঝে না বুঝে রিয়েক্ট করি, নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি। অন্ততপক্ষে তোমাকে নিয়ে তানভিরের সাথে আমি কোনোরকম অসদ্ভাবে জড়াতে চাই না তাই ও যা বলেছে আমি মেনে নিয়েছি।”

আবিরের উৎকণ্ঠা দেখে মেঘ প্রতিনিয়ত আশ্চর্যের চূড়ায় পৌছে যাচ্ছে। মেঘ নির্বাক চোখে তাকিয়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে আবিরকে দেখছে। আবির কয়েক মুহুর্ত মেঘের মায়াবী আদলে চেয়ে থেকে আনমনে হেসে বলল,
” ম্যাম, এভাবে তাকিয়ে আমাকে আগেভাগেই দূর্বল করে দিবেন না। আপনার সাথে আমার অনেক কথা আছে। ”

আবিরের কথায় মেঘের ভাবনার সুতো ছিঁড়েছে, কপালে ভাঁজ ফেলে মৃদুস্বরে বলল,
” কি কথা?”

“আগে নামাজ পড়ে রবের কাছে শুকরিয়া আদায় করি তারপর বলবো। যাও, ফ্রেশ হয়ে ওজু করে আসো।”

আবির মেঘের হাত ছেড়ে বিছানা থেকে নামছে। এত কথোপকথনের ভিড়ে রিয়া আর জান্নাতের শিখিয়ে দেয়া নিয়মকানুনের কথা মেঘ ভুলেই গিয়েছিল। মেঘ ঝটপট বিছানা থেকে নেমে আবিরের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতে নিল কিন্তু সালাম করার আগেই আবির মেঘের দুই বাহু ধরে উঠিয়ে আলতোভাবে বুকে জড়িয়ে মোলায়েম কন্ঠে বলল,

“তোমার অবস্থান আমার পায়ে নয় হৃদয়ে। আজকের পর কোনোদিন পায়ে হাত দিয়ে সালাম করার চেষ্টাও করবে না। মনে থাকবে?”

“জ্বি।”

আবির মেঘকে ছেড়ে ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে ফোনটা হাতে নিয়ে ব্যালকনির দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে কিছু একটা করছে। এদিকে মেঘ মনে মনে হাবিজাবি ভাবছে আর ব্যস্ত হাতে গহনা খুলছে। গলার একটা গহনাকে খুলতে গিয়ে চুলে টান পড়তেই মেঘ ব্যথায় ‘উফফ’ করে উঠেছে। আবির সহসা ফোন টেবিলের উপর রেখে মেঘের কাছে এসে জিজ্ঞেস করল,
” কি হয়েছে?”

” চুলে টান লাগছে। ”

” হাত সরাও, আমি দেখছি। ”

মেঘ ভ্রু কুঁচকালো, তবে নিষেধ করল না। আবির খুব মনোযোগ দিয়ে মেঘের চুল সরিয়ে গহনা খুলে দিয়েছে। মাথায় লাগানো ক্লিপগুলো খুলতে খুলতে কর্কশ কন্ঠে বিড়বিড় করল,
” আগেই বলেছি রাতে এত সাজগোছ করতে হবে না তারপরও কেউ কথা শুনে না। ”

আবিরের ঠান্ডা কন্ঠের অভিযোগে সম্বিত ফিরল মেঘের। চোখ ঘুরিয়ে আবিরকে এক পলক দেখে হালকা করে কেশে শীতল কন্ঠে ডাকল,
” আবির ভাই..”

অকস্মাৎ আবিরের সুপ্ত ক্রোধ চোখে ভেসে উঠেছে, মেঘের দিকে তাকিয়ে চোখ রাঙাতেই মেঘ দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল,
” মজা করেছি। ”

আবির প্রতিত্তোরে কিছুই বলল না। মেঘ ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে আসতেই আবির চুপচাপ ওয়াশরুমে চলে গেছে। যথারীতি দু’জন একসঙ্গে দু রাকাত নফল নামাজ পড়ে নিয়েছে। নামাজ শেষ করে আবির মেঘের কপালে দীর্ঘ চুমু খেয়ে মেঘকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। আবিরের সারাদিনের সব দুষ্টামি, খুনসুটি হঠাৎ ই পরিবর্তন হয়ে গেছে। কেমন যেন নিশ্চুপ হয়ে গেছে। আবিরের বুকের উপর মাথা থাকায় মেঘ স্পষ্টভাবে আবিরের হৃৎস্পন্দন টের পাচ্ছিল। মেঘ হঠাৎ ই তটস্থ কন্ঠে শুধালো,

” কি হয়েছে আপনার? আপনি কি কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তিত?”

আবির ঘন ঘন ঢোক গিলছে, মেঘকে বিছানার পাশে বসিয়ে আবির ফ্লোরে বসল । মেঘ ব্যাকুল কন্ঠে বার বার প্রশ্ন করছে, আবির উত্তর না দিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলো। আবির আচমকা বসা থেকে উঠে ওয়ারড্রব থেকে একটা ছোট বক্স বের করল। ‘Abir’ নাম লেখা একটা ডিজাইনিং লকেট বের করে মেঘের গলায় পড়িয়ে দিতে দিতে মৃদু স্বরে বলল,

” এটা বাসর রাতের গিফট।”

মেঘ তৎক্ষনাৎ লাফিয়ে উঠে বালিশের নিচ থেকে একটা ঘড়ির বক্স বের করে আবিরকে দিয়ে বলল,
” এটা আপনার জন্য। ”

আবির কপাল কুঁচকে প্রশ্ন করল,
” বাসর রাতে গিফট দিতে হয় এটা তোমাকে কে বলেছে?”

“রিয়া আপু , জান্নাত আপু তাছাড়া আমার বান্ধবীরাও বলেছে। ”

“আর কি কি বলেছে? ”

” আরও অনেক কিছু ।”

আবির ভ্রু গুটিয়ে ধীর হস্তে কপাল চাপড়ে শক্ত কন্ঠে বলল,
” ইসস! আমার বউটাকে ওরাই নষ্ট করছে।”

মেঘ ঠোঁট কামড়ে বিড়বিড় করল,
” মোটেই না।”

আবির ঘড়িটা দেখে মুচকি হেসে বলল,
” পড়িয়ে দাও।”

“এখন?”

“হুমমমম।”

মেঘ ঘড়িটা পড়িয়ে দিয়ে আহ্লাদী কন্ঠে শুধালো,
“পছন্দ হয়েছে?”

” হুমমমমমমম। আমার একমাত্র বউয়ের দেয়া গিফট পছন্দ তো হবেই। ”

আবির তপ্ত স্বরে ফের বলল,
“তোমার জন্য আরও সারপ্রাইজ আছে।”

“কি?”

আবির একটা অ্যালবাম বের করে মেঘের হাতে দিল। অ্যালবামের সর্বপ্রথম ছবিটা আবির আর মেঘের বিয়ের। দু’জন পাশাপাশি বসা, মেঘ ঘাড় কাত করে আবিরের বাইসেপে রেখেছে আবির মেঘের মাথায় উপর নিজের মাথা কাত করে রেখেছে। দু’জনের এক হাত সামনের দিকে । আবিরের হাতের তালুতে মেহেদী দিয়ে লেখা ‘মেঘের আবির’ আর মেঘের হাতে লেখা ‘আবিরের মেঘ’। মেঘ ছবিটা দেখে মৃদু হেসে অ্যালবাম খুলেছে। মেঘের জন্মের পর আবিরের প্রথম কোলে নেয়ার ছবি, মেঘের ছয় মাস, এক বছর, দুই বছর বয়স থেকে শুরু করে বিয়ে পর্যন্ত আবিরের সাথে যতছবি ছিল সবই অ্যালবামে আছে। মেঘ মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে ছবিগুলো দেখছে, আবির পাশে দাঁড়িয়ে ছবিগুলোর বর্ণনা দিচ্ছে। ছোটবেলার ছবিগুলো ফ্যামিলি অ্যালবাম থেকে সংগ্রহ করা। কোন ছবি কখন, কি অবস্থায় কাকে দিয়ে উঠিয়েছিল সবই আজ নির্দ্বিধায় বলছে। মেঘ নিস্তব্ধ হয়ে ছবিগুলো দেখছে আর আবিরকে দেখছে। মাঝখানে ৯ বছরের একসাথে ছবি না থাকলেও লাস্ট ২ বছরের ছবিতেই তার উসুল তুলে ফেলেছে। যার মধ্যে হাতে গুনা কয়েকটা ছবি মেঘ নিজের ইচ্ছেতে তুলেছিল বাকি সব আবিরের পার্সোনাল ফটোগ্রাফার তুলে দিয়েছে। অ্যালবাম দেখা শেষ হতেই মেঘ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লো। আবির মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করল,

“রাগ করেছো?”

মেঘ ঠোঁট ফুলিয়ে চেয়ে আছে। আবির নিরেট কন্ঠে বলল,

” রাগ করো না, প্লিজ। এটা দেখে রেগে গেলে পরের গুলো তো বলতেই পারব না।”

” পরে কি?”

আবির একটা চাবির গোছা মেঘের হাতে দিয়ে বলতে শুরু করল,
” আজ থেকে এই চাবির গোছাটা তোমার। এখানে আমার রুমের প্রতিটা তালাবদ্ধ জিনিসের চাবির পাশাপাশি আমার অফিসের সব চাবি আছে। তুমি আমার অর্ধাঙ্গিনী তাই আজ থেকে আর কোনো লুকোচুরি নয়। আমার যা কিছু আছে সবকিছুতে তোমার অধিকার আছে।”

মেঘ আজ হতবিহ্বল। যে আবির নিজের জিনিসপত্র কখনো কাউকে ছুঁতে দেয় না, রুমে ঢুকতে দেয় না, সব কিছুতে তালা দিয়ে রাখে সে আজ নিজের হাতে সব দায়িত্ব মেঘকে দিয়ে দিচ্ছে। আবিরের এত পরিবর্তন মেঘ স্তব্ধ চোখে কেবল দেখেই যাচ্ছে। আবির অকস্মাৎ মেঘের মুখোমুখি দাঁড়ালো। আচমকা ধপ করে মেঘের পায়ের কাছে বসে পরেছে, আবিরের গায়ে যেন পা না লাগে তারজন্য মেঘ সঙ্গে সঙ্গে পা সরিয়ে থমথমে কন্ঠে শুধালো,

“কি হয়েছে আপনার?”

আবির পেছন থেকে একটা সুন্দর গিফট বক্স বের করে মেঘের হাতে দিল। মেঘ ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করল,

” কি এটাতে?”

“দেখো।”

বক্স খুলতেই ২ টা ব্যাংক চেক চোখে পরেছে, মেঘ এমাউন্টও ঠিকমতো খেয়াল করে নি। কৌতূহল বশত চেক তুলে বিস্ময় সমেত তাকালো । বক্সে স্বর্ণের বেশ কিছু গহনা। মেঘ বার বার আবিরের দিকে তাকাচ্ছে, আবিরের ঠোঁটে মলিন হাসি। মেঘ গহনা গুলো তুলে বিছানার পাশে রাখছে। কাগজের মতো কিছু লাল ফিতা দিয়ে প্যাঁচানো দেখে মেঘ স্বাভাবিকভাবে খুলতে নিল, খুলতেই দেখল এটা একটা দলিল। কিছুটা পড়ার পড় বুঝতে পারলো কোনো একটা জায়গা আবির মেঘের নামে করে দিয়েছে। মেঘ আশ্চর্য নয়নে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,

” এসবের মানে কি?”

আবির মুচকি হেসে বলল,
” Sparrow’s Dreamhouse তোমার বাড়ি, একান্তই তোমার। সেখানে আমার কোনো অধিকার নেই।”

মেঘ কিঞ্চিৎ রাগী স্বরে বলল,
” অধিকার যদি না ই থাকবে তাহলে আমার বাড়ি আপনি আমাকে না জানিয়ে কেনো করেছেন? আগে আমাকে বললেন না কেনো?”

” শুরুতে জানানোর মতো পরিস্থিতি ছিল না।”

“কেনো?”

” সময় টা ছিল ডিসেম্বর মাস, মাইশা আপুর বিয়ে থেকে মালার কারণে তোমাকে জোর করে নিয়ে আসছিলাম। আমি অফিস থেকে এসে তোমাকে সময় নিয়ে বুঝাতে চেয়েছিলাম মালার সাথে আমার কিছুই নেই অথচ তুমি আমার আসা পর্যন্ত জাস্ট ১০ মিনিট অপেক্ষা করতে পারলে না। আমাকে গুরুত্ব না দিয়ে মিনহাজদের গুরুত্ব দিয়েছিলে। তারজন্য তোমার প্রতি অভিমান হয়েছিল। সেই অভিমান তোমার আব্বুর কথায় জেদে পরিণত হয়েছিল। ওনার মেয়েকে রাণীর মতো রাখতে গেলে আগে রাণীর স্বপ্নগুলো পূরণ করা জরুরি ছিল। সেই রাতেই ৩-৪ দিনের জন্য চলে গেলাম, দিনরাত এক করে সবকিছু রেডি করে আসছি। যেদিন বাসার কাজ শুরু করব তার আগের দিন থেকে আপনাকে এতমতে রিকুয়েষ্ট করলাম কিন্তু তুমি এতটায় জেদি যে কোনোভাবেই যেতে রাজি হলে না। তোমাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েও দিতে পারলাম না তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম বাসার কাজ পুরোপুরি শেষ করেই জানাবো।”

মেঘ শক্ত কন্ঠে বলল,
” ইশশ! মিস করলাম।”

“বাকিগুলো দেখে শেষ করো।”

মেঘ আবারও বক্স হাতে নিল। কিছু চিরকুট, আবিরের অফিসের কিছু ডকুমেন্টসের সাথে কয়েকটা ৫০০ আর ১০০০ টাকার বান্ডিল। এত এত টাকার বান্ডিল দেখে মেঘ আশ্চর্যান্বিত নয়নে তাকিয়ে উদ্বিগ্ন কন্ঠে শুধালো,

“এত টাকা কার?”

আবির মোলায়েম কন্ঠে বলল,
“তোমার। ”

“মানে? এত টাকা দিয়ে আমি কি করব?”

” এগুলো সব কাবিনের।”

মেঘ ধীর কন্ঠে বলতে শুরু করল,
” আমি যতদূর শুনেছি, কাবিন বউয়ের পরিবার অথবা বউয়ের ইচ্ছে অনুযায়ী দিতে হয়। আমি বউ হয়ে বলছি, আমার কাবিনের কোনো প্রয়োজন নেই। আমি আপনাকে চেয়েছি, আলহামদুলিল্লাহ আপনাকে পেয়ে গেছি। আমার আর কিছুই চাওয়ার নেই। আপনার এত এত গিফট, টাকা, ব্যাংক চেক এসবের কোনো কিছুই চাই না। বিয়েতে কাবিন যদি আবশ্যক হয় তবে আমি কাবিন হিসেবে আপনাকে চাইব, আমৃত্যু শুধু আপনাকেই চাইব।”

মেঘের দুচোখ ছলছল করছে, নিজেকে সংযত করতে তাড়িত শ্বাস টানলো। আবির দুর্বোধ্য নেত্রে মেঘের মায়াবী আননে চেয়ে আছে। অল্পতে লজ্জায় আড়ষ্ট হওয়া মেয়েটার অদম্য কন্ঠের আকাঙ্ক্ষা শুনে আবির শীতল চোখে চেয়ে মুচকি হাসলো। মেঘ এতক্ষণ কি বলেছে নিজেও জানে না, আবিরের অন্যরকম চাহনিতে কিছুটা লজ্জা পেয়েছে। আবির চোখমুখ গুটিয়ে শান্ত কন্ঠে শুধালো,

” যা দিয়েছি সবকিছু সহ আবির যদি তোমার হয় তাহলে কাবিন নিয়ে কি তোমার আর কোনো আপত্তি আছে?”

মেঘ সঙ্গে সঙ্গে আবিরের দিকে তাকিয়ে শ্বাস ছেড়ে ঠোঁট ফুলিয়ে নিষ্পাপ কন্ঠে বলে উঠল,
” আমার আবির হলেই হবে।”

আবির ভ্রু উঠাতেই মেঘ থতমত খেয়ে বলল,
” সরি সরি সরি, আপনাকে হলেই হবে। ”

“আমি তো তোমার ই। বাকি যা দিয়েছি ঐ সবও তোমার। এগুলোর পর কাবিন হিসেবে তোমার কি আমার কাছে আর কিছু চাওয়ার আছে? ”

মেঘ সাবলীল ভঙ্গিতে বলল,
” আমার আর কিছুই লাগবে না।”

“মনে কষ্ট থাকবে না তো?”

মেঘ একগাল হেসে বলল,
” আমার মনে কষ্টের ছিটেফোঁটাও নেই কারণ আপনাকে পেয়ে গেছি যে।”

আবির অনুগ্র হেসে টেবিলের উপরে রাখা একটা বই থেকে কাগজ এনে মেঘের হাতে দিল। তেমন একটা গুরুত্ব না দিয়েই মেঘ জিজ্ঞেস করল,

” কি এগুলো?”

“পড়ো।”

মেঘ বিড়বিড় করে পড়ছে, কিছুটা পড়তেই বুঝতে পারলো এটা কাবিননামার কপি। মেঘ সঙ্গে সঙ্গে নিচে তাকালো। বরের স্বাক্ষরের জায়গায় ‘সাজ্জাদুল খান আবির’ লেখা আর কন্যার স্বাক্ষরের জায়গায় ‘মাহদিবা খান মেঘ’ বিবাহ রেজিস্ট্রী করার তারিখ: ০৩/০২/২০– যা আজ থেকে আরও তিন বছর আগের। এটা দেখে মেঘ বিস্তীর্ণ চোখে তাকিয়ে এক হাতে নিজের মুখ চেপে ধরেছে। মেঘের হাত থরথর করে কাঁপছে, কান দিয়ে গরম হাওয়া বের হচ্ছে, মস্তিষ্কে বিদ্যমান স্নায়ুগুলো ধপধপ করে কাঁপছে, বুকের ভেতরটা দুরু দুরু কেঁপেই চলেছে, নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। মেঘ শশব্যস্ত চোখে আবিরের দিকে তাকালো। আবির নিরুদ্বেগ ভঙ্গিতে মেঘকে দেখছে আর নিজের বুকে হাত রেখে অনুচ্চ স্বরে দোয়া পড়ছে। মেঘের গলায় আটকানো নিঃশ্বাস টা অতি সন্তর্পণে বেড়িয়ে আসছে, মুখ ফুলিয়ে শ্বাস টেনে জিভ দিয়ে ঠোট ভিজিয়ে থমথমে কন্ঠে প্রশ্ন করল,

” এগুলো কি সত্যি? ”

আবির ঢোক গিলে ধীরস্থির কন্ঠে বলল,
“হুমমমমমমম। আইনের চোখে আমাদের বিয়ের তিনবছর পূর্ণ হয়ে গেছে, গতকাল চতুর্থ বছরে পদার্পণ করেছি। তোমাকে আগেই বলেছিলাম, তুমি আমারই। কেউ তোমাকে আমার থেকে আলাদা করতে পারবে না। কেউ যদি আমার সাথে ঝামেলা করতেও চাইতো, আমি সরাসরি কাবিননামা দেখিয়ে দিতাম।”

মেঘ ভাবনাচিন্তা ছাড়াই আচমকা বলে উঠল,
” এটা কিভাবে সম্ভব?”

আবির শক্ত কন্ঠে বলতে শুরু করল,
” আমি দেশ ছাড়ার মাসখানেক আগে তানভিরকে তোমার ব্যাপারে সব বলেছিলাম। সে আমার আবেগ, অনুভূতি দেখে প্রথমদিকে মেনে নিলেও পরবর্তীতে ওর মনে কিছুটা খটকা সৃষ্টি হয়েছিল কারণ শত হলেও সে তোমার আপন ভাই। তোমার প্রতি তার দায়িত্ব, ভালোবাসা অন্য লেবেলের যেটা আমার প্রতি হাজার থাকলেও তোমার সমান নয়। বলতে গেলে তানভির, আমি দুজনেই তখন অপ্রাপ্তবয়স্ক। মজার ছলেই হোক কিংবা গভীর চিন্তা থেকেই, তানভির একদিন হুট করে বলে বসে,

” ভাইয়া, তুমি বনুকে এখন পছন্দ করো মানলাম, আমি ওকে দেখেও রাখলাম কিন্তু ৭ বছর পর তোমার মন মানসিকতা যে এরকম থাকবে তার কি গ্যারেন্টি আছে? তখন যদি বনুর প্রতি এখনকার মতো অনুভূতি না থাকে?”

তানভিরের কথা শুনে আমার মনে চিন্তন জাগে৷ আমি নিজেও কখনো সেভাবে ভেবে দেখি নি তাই ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিলাম তোমাকে বিয়ে করব। কেনো সেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমি নিজেও জানি না শুধু মনে হয়েছিল তানভির যা বলেছে একদম ঠিক বলেছে। তানভির মজার ছলে বললেও আমি দুশ্চিন্তায় ঘুমাতে পারছিলাম না। তানভিরকে জানানোর পর সে খুব রিকুয়েষ্ট করেছে যেন বিয়ের ঝামেলা না করি, ও এমনিতেই এসব বলেছিল আরও অনেককিছু। আমার মাথায় তখন কিছুই ঢুকছিল না, আমার কাছের বন্ধুর বাবা কাজী তাই তৎক্ষনাৎ খোঁজ নিলাম। তোমার বয়স অনেক কম ছিল, তখন তোমার আমার প্রতি তীব্র ঘৃণাও ছিল সব মিলিয়ে তখন বিয়ে সম্ভব ছিল না৷ তাছাড়াও কিছু নিয়মনীতি ছিল যার কারণে আংকেল কোনোভাবেই রাজি হয়তেছিল না৷ কিন্তু তখন আমার একটায় জেদ ছিল যেভাবেই হোক বিয়ে আমার করতেই হবে। আংকেলকে বিস্তারিত বুঝিয়ে খুব কষ্টে রাজি করিয়ে, রাকিব, তানভির আর সুজনের উপস্থিতিতে বিয়ের কাজ সম্পন্ন করে দেশ ছাড়ি।”

আবির দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে পুনরায় বলতে শুরু করল,
” বিশ্বাস করো, আমি তখন কোনোকিছু ভাবি নি, এতকিছু বুঝি নি। শুধু বুঝেছিলাম তোমাকে আমার লাগবে সেটা যেকোনো মূল্যেই হোক। মস্তিষ্কে শুধু একটা চিন্তায় ঘুরপাক খাচ্ছিল, তোমাকে বৈধতার চাদরে মোড়ানো। পাওয়া না পাওয়ার মাঝে আমি তখন বাস্তবিক জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম, ভবিষ্যতে কি হবে বা হতে পারে সব ভুলে গিয়েছিলাম। বিয়ে পরিপূর্ণ হবে না জেনেও আবেগের তাড়নায় বিয়ে করেছিলাম৷”

নিশ্চুপ মেঘ এবার মুখ খুলল। কিছুটা বিস্মিত হয়ে জানতে চাইল,
” আমার সাইন কে দিয়েছিল?”

“তুমি। ”

“কিভাবে? আমি তো এসবের কিছুই জানতাম না।”

“মনে আছে তানভির একদিন ঘুরতে নিয়ে তোমাকে বিয়ের কথা বলেছিল?”

“হ্যাঁ, মনে আছে৷ আমাকে এমন ই একটা কাগজে সাইন করতে বলেছিল। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম এটা কিসের কাগজ? ভাইয়া বলেছিল বিয়ের। আমি তখন সেভাবে গুরুত্ব ই দেয় নি, ভেবেছিলাম ভাইয়া মজা করছে।”

আবির কপাল গুটিয়ে জানতে চাইল,
” কেনো আমার নাম বলেছিল মনে নেই?”

“হ্যাঁ, এটাও মনে আছে। বিয়ের কথা বলায় আমি যখন হাসছিলাম তখন ভাইয়া জিজ্ঞেস করছিল আমাকে যার তার কাছে বিয়ে দিলে আমার আপত্তি আছে কি না। আমিও সুন্দর করে বলেছিলাম, কোনো আপত্তি নেই তুমি যাকে বলবা তাকেই বিয়ে করে নিব। আমার সত্যি ই তখন কোনো আপত্তি ছিল না কারণ তখন আমার জীবনে আপনি ছিলেন না। আমার চোখে আমার ভাই ই সবার সেরা ছিল, সে যা বলতো আমি সবকিছু মেনে নিতাম। ভাইয়া তখন আপনাকে বিয়ে করার কথা বলেছিল আর আমি ভাইয়ার কথায় আপনাকে বিয়ে করতেও রাজি হয়ে গিয়েছিলাম। আমি ভেবেছিলাম ভাইয়া মজা করছে তাই যা বলেছিল সবেতেই হ্যাঁ হ্যাঁ করে সাইনও করে দিয়েছিলাম। তারপর ভাইয়ার সাথে এ বিষয়ে আমার আর কোনোদিন কথা হয় নি। ভাইয়া কিছু বলে নি আর আমি তো সেই ঘটনা বেমালুম ভুলেই গিয়েছিলাম। ”

আবির মলিন হেসে বলল,
” ঐদিন ই তোমার আমার সাথে বিয়ে হয়ে গিয়েছিল। তানভিরের সাথে সাথে সেখানে কাজী সাহেব, সুজনরাও উপস্থিত ছিল তাছাড়া ফোনে আমিও ছিলাম।”

মেঘ হা হয়ে আবিরের দিকে তাকিয়ে আছে। আবির গলা খাঁকারি দিয়ে আবারও বলতে শুরু করল,

” আমি সাইন করায় দিনই তোমাকে বউ হিসেবে কবুল করেছিলাম কিন্তু তোমারটা বাকি ছিল। তোমাকে বিস্তারিত বুঝানোর পরিস্থিতি ছিল না তাই তানভির যেভাবে পেরেছে ম্যানেজ করেছে। আমার কথা ছিল, যেহেতু তোমার সাথে তখন মানসিক বা শারীরিক কোনো সম্পর্কে আমি জড়াবো না তাই শুধু আইনী কাজ টা সম্পন্ন করে রাখবো। বাসায় এসে যেভাবেই হোক তোমাকে পটিয়ে, বাসার সবার অনুমতি নিয়ে তোমাকে বিয়ে করব। আমি নির্বোধ ছিলাম কারণ আমি তখনও আবেগে গা ভাসাচ্ছিলাম। আমাদের বিয়ে আইনী ভাবে নিবন্ধিত হয়ে গিয়েছিল, আমার এত বছরের ভালোবাসাকে আইনী স্বীকৃতি দিতে পেরে মনে সুখের হাওয়া বইছিল। আমার আকাশে বাতাসে বিয়ের আমেজ ছিল কিন্তু সেই আমেজ বেশিদিন থাকলো না। মাস তিনেকের মধ্যে ফুপ্পির কথা জানতে পারি আর তখনই আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। তানভিরের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনায় ভীত হয়ে আমি আইনী স্বীকৃতির জন্য জোরাজোরি করেছিলাম কিন্তু ফুপ্পির কথা শুনে সম্পূর্ণ নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। যেখানে ফুপ্পির প্রেমের সম্পর্ক জেনেও মানে নি সেখানে আমি কাউকে না জানিয়ে বিয়ে করে ফেলেছি। আমার বিয়েটা কোন লেবেলের অপরাধের কাতারে পড়বে সেটা ভেবেই আঁতকে উঠছিলাম। এত বছরে নিজের মনে জমে থাকা স্বপ্নগুলোকে পিণ্ডীভূত করে যে কাঁচের বাড়িটা বানিয়েছিলাম সেই বাড়িটা মনের ভেতরে ঘটে যাওয়া আকস্মিক ভূমিকম্পে তছনছ হয়ে গিয়েছিল। নিজের সাজানো স্বপ্ন ভাঙার সাথে সাথে ভেঙেছিল তোমাকে দেখার সব আকাঙ্ক্ষা। নিজের আক্ষেপে নিজেই পুড়ছিলাম। কিছু সময়ের জন্য মনে হয়েছিল পৃথিবী ছেড়ে চলে যায় কিন্তু শেষ সময়েও তোমাকে দেয়া কথাটা আমার কানে বাজছিলো, “আমাকে ছেড়ে যেতে পারবে না” সেই আদুরে আনন আমাকে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্ত থেকে টেনে এনেছিল। শুধুমাত্র তোমার কথা ভেবে নতুনভাবে নিজেকে তৈরি করছিলাম, কিন্তু বুকে ছিল আকাশ সমান ভয়। বাসায় বিয়ের কথা জানলে তোলপাড় শুরু হবে এটা খুব ভালোই বুঝেছিলাম, তোমাকে নিয়ে আলাদা থাকার যোগ্যতাও আমার ছিল কিন্তু তুমিই যে আমার ছিলে না। তুমি এমনিতেই ৭-৮ বছর যাবৎ আমার সাথে কথা বলছিলে না। ঐ অবস্থায় কোনোক্রমে যদি শুনতে পারতে যে তোমার সাথে আমার বিয়ে হয়ে গেছে তখন আব্বু চাচ্চু কি করতো জানি না কিন্তু তুমি হয় আমাকে খু*ন করতে, নয়তো নিজে সু*ই*সাই*ড করতে আর না হয় লাস্ট অপশন ছিল ডি*ভো*র্স। তোমার জেদকে আমি বরাবর ই ভয় পায়, তখনও খুব ভয় পেয়েছিলাম। তুমি ভুলক্রমে কিছু বললেও সেটা তুমি করেই ছাড়তে৷ বাসায় ফিরে ৩ মাস কিংবা ৬ মাসের মধ্যে বিয়ে করার স্বপ্ন আড়ালেই হারিয়ে গেল। সেই থেকে আমার আতঙ্ক শুরু হলো, তানভির, রাকিব দু’জনকে খুব জোর করে বললাম ভুল করেও যেন বিয়ের টপিক না উঠায়, বিয়ের কথা যেন মন থেকে ভুলে যায়। অনাকাঙ্ক্ষিত কারণে ৬ মাস আগে দেশে ফিরলাম, তখন সব ভুলে তোমাকে আমার প্রেমে পড়তে বাধ্য করলাম। প্রতিনিয়ত নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করে তোমাকে অনুভব করাতে লাগলাম। আলহামদুলিল্লাহ বছরখানেকের মধ্যে আমি সফলও হয়ে গেলাম। আমার এক্সিডেন্টের পর তোমার আবেগ জড়ানো কথাগুলো শুনে তোমার ভালোবাসার পুরোপুরি নিশ্চয়তা পেয়েছিলাম। বাসার পরিস্থিতি, তোমার পরিস্থিতি দেখে তখন দ্বিতীয়বার উপলব্ধি করেছিলাম আমি আবেগের বশে ঠিক কত বড় ভুলটা করেছিলাম। আম্মুর বার বার জানতে চাওয়া, আমার কোনো পছন্দ আছে কি না, আব্বুর একই প্রশ্ন পরোক্ষভাবে জিজ্ঞেস করা সেই সাথে তোমার অতিরিক্ত যত্নে আমি পাগলপ্রায় হয়ে উঠেছিলাম৷ তখন বুঝেছিলাম, আমার বাবা মা আমাকে খুব ভালোবাসে, তাদের ইচ্ছাশক্তি এতটায় প্রবল যে আমি চাইলে তারা পৃথিবীর সবকিছু আমার সামনে হাজির করতে পারে সেখানে তোমাকে আমার সাথে বিয়ে দেয়া তেমন কোনো বিষয় ই না। বরং তোমাকে চাইলে আব্বু আম্মু খুশিই হতো। কিন্তু ওনারা তো জানতো না যে আমি ওনাদের হৃদয় আগেই ভেঙে ফেলেছি আর না তুমি কিছু জানতে। ঐ পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আমার বিয়ের কথা বলাটা কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না আর না সম্ভব ছিল বিয়ের ঘটনা লুকিয়ে নতুন করে বিয়ে করা। তাছাড়া তখনও তোমার স্বপ্নের বাড়ি গিফট করা বাকি, তোমাকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করাটাও বাকি ছিল। গত রমজানের আগে হুট সবার সামনে একদিন আমার বিয়ের কথা উঠল, তোমার আব্বু আগুনে ঘি ঢালার মতো কোথাকার কোন মেয়ের কথা বলল। আমি মেজাজ হারিয়ে বললাম ১ বছর বিয়েই করব না। আমি তাদের কিভাবে বুঝাতাম আমি যে তোমাকে বিয়ে করে ফেলেছি। তারপর রাকিবের বিয়ে ঠিক হলো, তখনও আব্বু আমাকে কথা শুনালো। এমনকি আমার নিজেরও খারাপ লাগছিল কারণ আমি যখন থেকে তোমাকে ভালোবাসি তারপর থেকেই বলছিলাম আমি যেভাবেই হোক রাকিবের আগে বিয়ে করব৷ বিয়ে করেও ছিলাম কিন্তু কাউকে বলতে পারছিলাম। আবেগ আর কষ্টগুলো নিজের ভেতর চাপিয়ে রাখতে রাখতে আর পারছিলাম না। রাকিবের গায়ে হলুদের রাতে ফুপ্পিকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে শুধু একটা কথায় বলছিলাম,

‘আমি ভুল করেছি, খুব বড় ভুল করেছি। সেই ভুলের শাস্তিস্বরূপ মেঘকে আমার থেকে কেড়ে নিও না। আমি মেঘকে ছাড়া বাঁচতে পারবো না।’

ফুপ্পি নিরূপায় ছিল, আমার কান্না দেখে তবুও কয়েকবার আব্বুকে বলার চেষ্টা করেছে কিন্তু সাহস করে বলে উঠতে পারে নি। তারপর শুরু হলো তোমার আব্বুর ছেলে দেখা, বাধ্য হয়ে বাসায় রাগারাগি করলাম। তোমার বাসার কাজ শেষ করতে প্রজেক্টের দায়িত্ব নিয়ে দেশের বাহিরে গেলাম। বিয়ের কথা বাসায় বলার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। আমার পুরোপুরি টার্গেট ছিল ১ তারিখ তোমাকে প্রপোজ করবো, রাতে বাসায় বিয়ের কথা বলব, বাসায় মানলে ২ তারিখ ধুমধাম করে গায়ে হলুদ হবে, না মানলে তোমাকে নিয়ে বাড়ি ছাড়বো। মাঝখান থেকে তুমি ৩ দিন আগে প্রপোজ করতে বের হয়ে সবকিছু এলোমেলো করে দিয়েছিলে। তবে যাই হোক রবের কাছে হাজারো শুকরিয়া যে কোনো ঝামেলা ছাড়ায় তোমাকে পেয়ে গেছি।”

মেঘ হতবিহবল, পাথরের মতো বসে আবিরের মুখের পানে চেয়ে আছে। কিছু জিজ্ঞেস করা বা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। আবির দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখল। মেঘের হাত থেকে কাগজ নিতে নিতে মেঘের মসৃণ গালে চুমু খেয়ে হঠাৎ ই পুরু কন্ঠে বলে উঠল,

” বউ, আমি তোমাকে ৫ মিনিট দিচ্ছি। এরমধ্যে টাশকি খাওয়া মুড থেকে বেড়িয়ে রোমান্টিক মুডে আসো। আমার বুকের ভেতর প্রেম ভালোবাসা ফুটন্ত গরম পানির মতো টগবগ করতেছে। তুমি রোমান্টিক মুডে না আসলে আমার অন্তর পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে। তুমি কি তাই চাও?”

মেঘ নির্বাক চোখে আবিরের দিকে তাকালো। আবির নিঃশব্দে হেসে চোখ টিপলো। আবিরের নির্লজ্জ মার্কা কথা আর কাণ্ড দেখে মেঘ না পারতেও কিঞ্চিৎ হাসল।

সকালে নাস্তার টেবিলে আবির আর মেঘ ব্যতীত সকলেই উপস্থিত, বন্যাও আজ সবার সাথে খেতে বসেছে। ইকবাল খান ধীর কন্ঠে শুধালো,
“আবির আর মেঘ কি এখনও উঠে নি?”

মালিহা খান মীমকে উদ্দেশ্য করে বলল,
” মীম, দেখে আয় তো।”

মীম সঙ্গে সঙ্গে উঠে গেল। আবিরের রুমের দরজায় ডাকতে গিয়ে খেয়াল করল দরজা খোলা, রুমে মেঘ আবির কেউ নেই। মীম রুমের ভেতরে ঢুকে ভালোভাবে দেখল। সহসা বাহিরে এসে উচ্চস্বরে বলল,
” ভাইয়া, আপু কেউ ই রুমে নেই।”

আলী আহমদ খান সঙ্গে সঙ্গে তানভিরের দিকে তাকালেন। তানভির আতঙ্কিত কন্ঠে বলল,

” আমি সত্যিই কিছু জানি না। ”

#চলবে

#বি_দ্রঃ ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।😊