গল্প- আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে
পর্ব- ০৬
লেখিকা- সালমা চৌধুরী
মেঘ বরাবর ই খুব অভিমানি। অল্পতেই কান্না করে দেয়।। রাত ১০ টা বেজে গেছে এখনও মুখ ফুলিয়ে রুমে বসে আছে মেয়েটা৷ সারাদিন খাওয়া নেই।
তড়িঘড়ি করে তানভির বাড়িতে ঢুকে৷ এসেই মাকে জিজ্ঞেস করে, “মেঘ খেয়েছে?”
হালিমা খান সহসা উত্তর দিলেন, ” সন্ধ্যার পর থেকে এত ডাকছি দরজায় তো খোলছে না।”
তানভির আর কথা বাড়ালো না তড়িৎগতিতে ছুটে গেলো বোনের দরজার সামনে, প্রথমে আস্তে করে ডাকলো৷ মেঘের সারা নেই, আচমকা চোয়াল শক্ত করে একপ্রকার চিৎকার দিলো,
‘মেঘ তুই এই মুহুর্তে দরজা না খুললে তোর কপালে শ*নি আছে বলে দিলাম।’
মেঘ শুয়া থেকে এক লাফে উঠে বসলো। কয়েক সেকেন্ডে দৌড়ে গিয়ে দরজা টা খুললো। চোখ তুলে তাকানোর সাহস নেই ভাইয়ের দিকে। আজ পর্যন্ত তানভির মেঘের গায়ে হাত তুলে নি শুধু ধ*মক ই দেয়৷
কিন্তু ভাইকে এক বিন্দু বিশ্বাস করে না মেঘ। কখন আবির ভাইয়ের মতো নাক মুখে মারবে থা*প্পড় বিশ্বাস নেই।
দরজা খুলতেই নরম স্বরে তানভির বললো, ‘খেতে যা’
“মেঘ তানভিরের এত নরম স্বর কোনোদিন শুনে নি,ভাবতেই পারছে ভাইয়া তাকে এত ভালোবেসে খেতে বলছে।”
তানভির: খাওয়া শেষ হলে তোর ফোন টা দিস, তোকে একটা ফেসবুক আইডি খুলে দিব।
তানভিরের এমন কথায় মেঘ আহাম্মক বনে গেলো । তানভির ভাই বরাবর ই এরকম। নিজেই ঝাড়বে তারপর নিজেই আদর করবে, এটা সেটা কিনে আনবে মেঘের জন্য। কিন্তু আজকের বিষয় টা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এত নরম স্বর কখনো শুনেনি এর আগে।
নিমিষেই মনটা খুশিতে ভরে গেলো মেঘের।
খাবার টেবিলে বসে আপন মনে খাচ্ছে মেঘ, আজকে তার পছন্দের অনেক রেসিপি আছে, একটু একটু করে সব চেক করছে। কিন্তু রাগে ফুঁসফুস করছে মেঘের আম্মু হালিমা খান।
হালিমা খান: “সন্ধ্যা থেকে যে তোকে এতবার ডাকতে গেলাম বের হলি না কেন? ঠিক ই ভাইয়ের ভয়ে বের হয়ে আসলি। আমাকে কেনো কষ্ট দেস। তোকে কে কি বলে দুই দিন পর পর না খেয়ে পরে থাকিস। কিছুদিন পরে যে এডমিশন৷ না খেলে পড়বি কিভাবে, আর না পড়লে ভর্তি হবি কিভাবে।
তুই ও তোর ভাইয়ের মতো হচ্ছিস, সে সারাদিন ভন্ডের মতো টুইটুই করে ঘুরে আর তুই ও এখন তার ভাব নিচ্ছিস। খেয়ে না খেয়ে রুমে পরে থাকিস।
আর শুন মেয়ে মানুষের এত রাগ জেদ ভালো না, তোর এই রাগ জেদ সামলানোর জন্য আমরা সারাজীবন তোর পাশে থাকবো না । ”
এতটুকু বলতেই চোখ পরে ড্রয়িং রুমে দাঁড়ানো আবিরের দিকে।
আবিরের চাউনিতে পরিষ্কার রু*ষ্টতা, শ্যামবর্ণের মুখমন্ডল কালো দেখাচ্ছে, ক*ড়া কন্ঠে মামনির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,
“কি হয়েছে?”
পুরুষালি কন্ঠে আঁতকে উঠে মেঘ।
হালিমা খান গলা নামিয়ে উত্তর দিলো, “খায় না ঠিক মতো, পড়াশোনা করে না কি করবো ওকে নিয়ে”
আবির পূর্বের অভিব্যক্তি বজায় রেখে উত্তর দিলো,
“ওকে কিছু বলো না, কাল থেকে মেঘ টাইম টু টাইম খাবে, একটু এদিক সেদিক হলে সেটা আমি দেখবো।”
আবিরের কথায় খুশি হয়ে গেলো হালিমা খান।।
কিন্তু মেঘ খুশি হবে নাকি ভয় পাবে তা বুঝে উঠতে পারলো না৷ এতবছরে অভিমান করে মাঝে মাঝে না খেয়ে থাকলে তানভির এসে ধমকে বা বুঝিয়ে খাওয়াতো এখন সেই দায়িত্ব নিতে যাচ্ছে আরও একজন। ২ জন মিলে মেঘ কে শাসন করবে ভাবতেই মেঘের বুক কেঁপে উঠে আবার মনের মধ্যে অন্য রকম প্রশান্তিও কাজ করে মেঘের।। আবির ভাই এর মূল্যবান সময়ের মধ্যে ৫ মিনিট সময় যে মেঘ কে নিয়ে ভাববে এতেই খুশি খুশি লাগছে মেঘের।
তৎক্ষণাৎ মনে হয়ে গেলো তানভির ভাইয়া বলেছে ফেসবুক আইডি খুলে দিবে, তাড়াতাড়ি খেয়ে রুমের দিকে ছুটলো মেঘ৷
রুম থেকে ফোন নিয়ে ছুটে গেলো তানভির ভাইয়ার রুমে কিন্তু তানভির ভাইয়া রুমে নেই।। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো কিন্তু কোথাও নেই।
মোবাইল নিয়ে নিজের রুমে ঢুকতে যাবে হঠাৎ শুনতে পেলো তানভিরের কন্ঠ। কিন্তু কোথায় আছে
বাধ্য হয়ে মেঘ জোরে ডাক দিলো, “ভাইয়া!”
তানভির পাশের রুম থেকে উত্তর দিলো, “আবির ভাইয়ার রুমে আমি, আয়।”
আবির ভাই নাম টা শুনেই মেঘের বুকটা হুহু করে উঠে চিন্তায়, নিজেকে নিজে সাহস দেয়ার চেষ্টা করলো । তারপর গুটিগুটি পায়ে হেঁটে দরজায় দাঁড়ালো।
তানভির: ভেতরে আয়
মেঘ: মেবাইল টা দিয়ে যায়, তুমি কাজ করো।
তানভির: আরে ভেতরে আয়। বস তুই, তোকেও দরকার লাগবে।
মেঘ আর কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ খাটের কর্ণারে বসলো।
আবির নেই রুমে, ওয়াশরুমে আছে মনে হয়৷
তানভির ফোন নিয়ে কি যেনো করছে, তখন ই ওয়াশরুম থেকে বের হলো আবির
মেঘের দৃষ্টি পরে সেদিকে,
একটা ছাই রঙের টিশার্ট আর একটা ব্ল্যাক টাওজার, ভেজা চুল গুলো থেকে টপটপ করে পানি পরছে। শরীরের টিশার্ট টা অনেকটায় ভিজে গেছে।৷
মেঘ টেনে হিঁচড়ে দৃষ্টি নামিয়ে আনলো, মনে মনে ভাবছে,
একটা মানুষ এত কিউট কিভাবে হয়,যদি পারতাম আমার পড়ার টেবিলে সাজিয়ে রাখতাম, সারাদিন পড়তাম আর দেখতাম। তাহলে আমার মন কখনোই খারাপ হতো না!লোকটা ফর্সা নন, শ্যামলা গায়ের রঙ কিন্তু দেখতে মারা*ত্মক সুন্দর। সবচেয়ে মারা*ত্মক ওনার লুক, তাকানোর স্টাইল।
উফ,যতবার দেখছি ততবার ই নতুন করে ক্রাশ খাচ্ছি!
আবির ভাই খাটের অপর পাশে মোবাইল হাতে নিয়ে বসেছেন।
তানভির ভাইয়া মোবাইলে ফেসবুক অপশনে ক্রিয়েট নিউ একাউন্ট এ ঢুকতেই তানভির ভাইয়ার ফোনে কল আসে। দাঁড়িয়ে পকেট থেকে ফোন বের করে রিসিভ করে কথা বলা শুরু করে। ওমনি মেঘের মেবাইলটা আবিরের হাতে দিয়ে বলে ভাইয়া তুমি ওরে একাউন্ট টা খুলে দাও আমার গুরুত্বপূর্ণ কল আসছে। এই বলে মোবাইল রেখে রুম থেকে বেরিয়ে চলে গেলেন।
মেঘ বসে আছে চুপচাপ, মুখ তুলে তাকাতে সাহস পাচ্ছে না। বুকটা এখনও ধুকপুক করছে।
আবির মেঘের মোবাইলে নিজের মতো করে ফেসবুক একাউন্ট খুলছে, জন্মতারিখ, সাল,নাম কিছু জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন মনে করছে না ওনি। সবকাজ শেষ করে ফোনটা এগিয়ে দিলেন মেঘের দিকে৷
তখনি রুমে ঢুকলো তানভির।
সহসা বলে উঠলো, শেষ?
এই বলে ফোন টা নিজের হাতে নিলো।।
ফেসবুকে ঢুকে তানভিরের আইডি টা খোঁজে রিকুয়েষ্ট পাঠালো,
আবিরের দিকে তাকিয়ে বললো, ” ভাইয়া তোমাকে রিকুয়েষ্ট দেয়, এক্সেপ্ট করো নাকি!”
আবির গম্ভীর কন্ঠে বললো, “আমায় রিকুয়েষ্ট দিতে হবে না। ”
তানভির কথায় পাত্তা না দিয়ে কয়েক সেকেন্ড পর বললো, “ভাইয়া তোমায় রিকুয়েষ্ট পাঠিয়েছি। Accept করে নিও৷ না হলে আমার ছোট্ট বোনটা কষ্ট পাবে।”
আবির তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তানভিরের দিকে।
মেঘ মনে মনে খুশিই হলো ভাইয়ের কথায়, মেঘের তো কখনো সাহস ই হতো না আবির ভাই কে রিকু*য়েষ্ট দেয়ার বা এক্সে*প্ট করার কথা বলার।
তানভির সেদিকে গুরুত্ব না দিয়ে, মেঘের হাতে ফোন দিয়ে বললো, তুই এখন যা, আমি আর ভাইয়া এক্সেপ্ট করে নিবো। তুই কি করিস না করিস সব নজরে রাখবো কিন্তু।
মেঘ কোনো কথা না বলে মাথা নিচু করেই রুমে চলে আসলো মোবাইল নিয়ে।
মেঘ রুমে এসে বিছানায় শুয়ে ফেসবুকে ঢুকতেই নজরে পরলো,
‘Sazzadul Khan Abir’ Accept your friend request.
মেঘ শুয়া থেকে উঠে বসে, মেঘের খুশি দেখে কে, Friendlist এ একমাত্র ফ্রেন্ড সেটায় আবির ভাই। তার একটা স্ক্রিনশট রেখে দিল মেঘ।
তার ৫ মিনিট পর এক্সে*প্ট করলো তানভির ভাই।
আবির ভাইয়ার আইডিতে ঢুকলো, প্রোফাইল পিকটা নতুন কেনা বাইকে বসা, “একদম ওয়াও।”
কভার ফটো সবুজ ঘাসের মাঝে বাইক টা রাখা তার সামনে বাইকে হেলান দিয়ে বসা আবির ভাই, ছবিটা “ওহ মাই গড, ওয়াও!”
সবগুলো ছবি দেখে দেখে ডাউনলোড করছে মেঘ। যত দেখছে ততই পাগ*ল হয়ে যাচ্ছে মেয়ে টা।মনে হয় পাবনা যেতে বেশিদিন লাগবে না। তারপর মোবাইল রেখে ঘুমানোর চেষ্টা করলো, চোখ বন্ধ করতেই চোখের সামনে ভেসে আসছে একটার পর একটা স্টাই*লিশ ছবি। কখন যেনো ঘুমিয়ে পরেছে মেয়েটা।
★★★
আজ শনিবার, আবিরের অফিসে যাওয়ার দিন। সকাল সকাল উঠে শাওয়ার নিয়ে ফিটফাট হয়ে রেডি হয়ে পরেছে আবির। ৭.৩০ বাজে মাত্র ।
নিজের রুম থেকে বের হয়ে করিডোর দিয়ে দ্রুত হাঁটছে হঠাৎ মেঘের দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে দরজায় ডাক দেয়,
২ বার ডাকতেই ঘুমন্ত মেঘ, ঘুমে টলতে টলতে দরজা খুলে, সামনে দাড়িয়ে আছে আবির ভাই। নিজের চোখকে যেনো বিশ্বাস ই করতে পারছে না, প্রথমে ভেবেছে এটা স্বপ্ন, তারপর এদিক সেদিক তাকিয়ে বুঝলো এটা বাস্তব। আচমকা এইভাবে আবিরকে দাঁড়ানো দেখে ভ্যাবাচেকা খেল মেয়েটা। মেঘের চেহারায় নিদ্রিত ভাবটা লেপ্টে আছে এখনও। আবির পূর্ণ দৃষ্টিতে পরখ করলো অষ্টাদশী রাঙা মুখবিবর তারপর চোখ সরিয়ে নিয়ে বললো,
” ৫ মিনিটের মধ্যে খেতে আয় ”
পুনরায় দ্রুতগতিতে হাঁটা দিলো।
আবিরের অযাচিত উপস্থিতি নাড়িয়ে দিয়েছে মেঘের মস্তিষ্ক। হঠাৎ মনে পরে গেলো ৫ মিনিটে নিচে যেতে হবে। তৎক্ষনাৎ ছুটলো ওয়াশরুমে।৷ ৫ মিনিটের মধ্যে নিচে উপস্থিত হলো মেঘ৷
এই সময় মেঘকে খাবার টেবিলে দেখে অবাক হলো সকলে, ২ বছর যাবৎ মেয়েটা সকালে সবার সাথে খায় না, প্রাইভেট থাকলে আগে খায় না হয় সবাই অফিস বা স্কুলে চলে গেলে তারপর খেয়ে কলেজে যায়।
হালিমা খান ছুটে আসলেন মেয়ের দিকে,” আয় আয় বস মা, কি খাবি বল!”
টেবিলের কাছে আসতেই দেখলো একটা চেয়ার ই ফাঁকা আছে সেটা আবার আবির ভাইয়ের বিপরীতে। কিন্তু এখানে বসার বিন্দু পরিমাণ ইচ্ছে নেই তার। কারণ আবিরের আশেপাশে থাকলে মেঘ কেমন একটা ঘোরে থাকে। মন,মস্তিষ্ক সব যেনো আবিরের নিয়ন্ত্রণে থাকে। কিন্তু কিছু করার নেই। বাধ্য হয়ে বসতে হলো এই চেয়ারে।
আবির মাথা নিচু করে মনোযোগ দিয়ে খাচ্ছে, মেঘ তখন ঘুমে টলতে টলতে আবির কে দেখেছিল রাজপুত্রের মতো, কিন্তু এখন আর সে তাকাতে পারছে না। শীর্ণ বক্ষ ধরফর করছে মেঘের, মনে মনে খুব করে চাচ্ছে একটু তাকিয়ে আবিরকে দেখতে। কিন্তু মনে হচ্ছে কিছু একটা মাথায় চেপে বসে আছে, মুখ টায় তুলতে পারছে না।
আলী আহমদ খান হঠাৎ বলে উঠলেন, ‘মেঘ মা আজ থেকে তোমার নতুন টিউটর আসবে। সারাদিন তে তুমি বাহিরে থাকবে তাই তাকে সন্ধ্যার পর আসতে বলেছি। ”
মেঘ চুপচাপ খাবার খাওয়ার চেষ্টা করছে, বুকের ভেতর যে ঝড় তুফান চলছে তা যেনো কেউ বুঝতে না পারে।
আবির সবার আগে খাবার শেষ করে বাসা থেকে বের হয়ে গেলে। আবিরের পেছন পেছন আলী আহমদ খান, মোজাম্মেল খান ও ইকবাল খান ও চলে গেলেন।
ইকবাল খান আগেই অফিসে জানিয়ে দিয়েছে অফিস যেনো সাজিয়ে গুছিয়ে রাখে,
আবির অফিসের সামনে এসে বাইক পার্ক করে অফিসে ঢুকতে গেলে সিকিউ*রিটি গা*র্ড বলে উঠেন, স্যার আপনার একটু বসতে হবে, বড় স্যাররা না আসলে আপনি ভেতরে যেতে পারবেন না।
আবিরের পায়ের র*ক্ত মাথায় উঠে যাচ্ছে। রা*গে কটমট করতে করতে ওয়েটিং রুমে বসে আছে সে।
১০ মিনিটের মধ্যেই অফিসে ঢুকলেন তিন ভাই। আবির তখনও বসেই আছে।
কিছুক্ষণ পর সিকিউ*রিটি গা*র্ড এসে ডাকলেন,
“স্যার আপনাকে ভেতরে যেতে বলেছে!”
আবির নি*র্ভীক ভঙ্গিতে হেটে ভেতরে চলে গেলো।
অফিসের ভেতরে ফুল দিয়ে সাজানো, ঢুকতেই সবাই হাততালি দিয়ে কংগ্রাচুলেশন জানচ্ছে আবিরকে। দুএকজন ছবি তুলায় ব্যস্ত।
বাবা – চাচা তিন জন আর আবির মিলে একটা কেক ও কাটলো। তিন ভাইয়ের তো আজকে খুশির দিন। বংশের বড় ছেলে তাদের কোম্পানির হাল ধরতে যাচ্ছে। এর থেকে বড় পাওয়া আর কি আছে। তানভিরের মতে আবির যদি মুখের উপর বলে দিতো আমি ব্যবসা সামলাবো না তখন তো কিছুই করার ছিল না। আবির যেহেতু মেনে নিয়েছে এতেই হবে।
ঘন্টাখানেক হলো আবির অফিসে এসেছে। এরমধ্যে চাচ্চু ইকবাল খান ভাতিজাকে সব কাজ কর্ম বুঝিয়ে দিতে ব্যস্ত। অন্যদিকে আলী আহমদ খান এবং মোজাম্মেল খান আজ আড্ডায় মগ্ন।। তাদের মাথা থেকে সব চাপ চলে গেছে। দুই ভাই মিলে চা খাচ্ছে, খুনশুটি করছে। এত বছরের ব্যবসায়িক জীবনের অবসানের সময় এসেছে এবার।
সারাদিন আবিরের ব্যস্ততায় কাটে, প্রথম দিনের অফিস, দায়িত্ব বুঝে নেওয়া বিশাল চাপ। মাঝখানে একবার সময় করে বাবা চাচাদের সাথে তুলা একটা ছবি ফেস*বুকে শেয়ার ও করেছিল। ৬ টায় বাসায় ফিরেছে আবির। এসেই সোজা রুমে চলে গেছে, শাওয়ার নিয়ে রেস্ট নিচ্ছে। হয়তো ঘুমিয়ে পরেছিল।দূর স্বপ্নই দেখলো কি না আচমকা উঠে বসলো বিছানায়।
আবিরের চোখে-মুখে উদ্বেগ স্পষ্ট। তড়িঘড়ি করে রুম থেকে বের হয়ে নিচে আসলো।
পরিস্থিতি স্বাভাবিক, মালিহা খান এবং হালিমা খান কাজে ব্যস্ত। আদির আম্মু আদিকে নিয়ে পড়াতে বসেছেন। মীম ও হয়তো পড়ছে নিজের রুমে । কয়েক মুহুর্ত সোফায় বসে আবার উঠে রান্নাঘরের দিকে গেলো।
হালিমা খানের দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “মেঘ কোথায় মামনি?”
মেঘের টিউটর এসেছে, পড়ার ঘরে পড়াচ্ছে।
আবিরঃ ওহ আচ্ছা। আমায় একটু কফি করে দিতে পারবে?
হালিমা খান: একটু অপেক্ষা করো বাবা এখনি দিচ্ছি।
আবির ছোট বেলা থেকেই নিজের মা মালিহা খানকে আম্মু, তানভিরের আম্মুকে মামনি আর আদির আম্মু কে কাকিয়া ডেকে অভ্যস্ত। এত বছরেও তার ডাকে পূর্বের ন্যায় মিষ্টতা মিশে আছে।
সোফায় বসে কফি খাচ্ছে আর মোবাইল ঘাটাঘাটি করছে। ২০ মিনিট পর পড়ার রুম থেকে বের হলো একটা ছেলে বয়স হয়তো ২২-২৩ হবে। ৫.৭-৮ হবে লম্বা, চোখে চশমা। হালিমা খানকে বললো,
“আন্টি আজ আসি আবার কাল আসবো”
হালিমা খান ও হাসি মুখে বললেন, “আচ্ছা ঠিক আছে।”
এদিকে আবিরের কোমলতা পাল্টে গেলো, চটে গেল ভীষণ, সবেগে ঘু*ষি বসাল সোফার পাশের দেয়ালে, আবিরের চোখ আগুনের মতো লাল হয়ে গেছে। একমুহূর্ত বসলে না, সোজা উঠে ধপধপ করে সিঁড়ি দিয়ে উঠে নিজের রুমে চলে গেলো।
(চলবে)
গল্প- আমৃত্যু ভালোবাসি তোকে
পর্ব- ০৭
লেখিকা- সালমা চৌধুরী
অতি*রিক্ত রা*গে আবিরের তামা*টে চেহারা র*ক্তবর্ণ ধারণ করেছে। চক্ষু যুগলে ক্রো*ধ স্পষ্ট প্রতীয়মান হচ্ছে। ৫-৭ মিনিটের মধ্যে ভীষণ তাড়াহুড়োতে তৈরি হয়ে নিচে নামছে আবির৷
মেঘ পড়ার রুম থেকে বই খাতা নিয়ে রুমে উদ্দেশ্যে রওনা দিল।
হঠাৎ সিঁড়ির নিচে সাইড হয়ে দাঁড়িয়ে পরে সে৷
আবির ভাই হুলস্থুল বাঁধিয়ে নামছে। মেঘ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, মান*সিক টা*নাপোড়নে ভুগছে মেয়েটা৷ আবিরের সামনে বা আশেপাশে কোথাও দাঁড়াতে পারে না মেঘ। আবিরকে দেখলেই যেনো খেই হারায় বারবার। হৃ*দয় কেঁ*পে উঠে অষ্টাদশীর। কেমন অস্থি*র অস্থি*র লাগে। যেমন মা*রাত্মক চাওনি, তেমনি মা*রাত্মক তার চলাফেরা ৷
মনে মনে এসব ভেবেই যেনো ঘোরের রাজ্যে চলে যায় মেঘ। আবির পাশ দিয়ে যাওয়াতে আবিরের শরীরের ঝাঁঝালো গন্ধ সাথে তীব্র স্প্রের গ*ন্ধ মস্তি*ষ্ক পর্যন্ত চলে যায়। সহসা ঘোর কাটে মেঘের, সিঁড়িতে আবির ভাই নেই৷
কয়েক কদমে আবির পৌঁছে গেলো মেইন গেইটের কাছে৷
হঠাৎ রান্নাঘর থেকে ‘মালিহা খান’ ডাকলেন,
“এই সময় কোথায় যাচ্ছিস বাবা?”
মেঘপেছন ফিরে তাকায় সেদিকে,
আবির চৌকাঠের বাহিরে পা রাখতে রাখতে ব্যস্ত আর ক্রো*ধিত কন্ঠে উত্তর দিলো,
বাহিরে একটু কাজ আছে৷, ফিরতে রাত হবে।
এক মুহুর্ত ও দাঁড়ায় নি সে। ক্ষি*প্রবেগে হেঁটে চলে যায়।
মেঘ ঠায় দাঁড়িয়ে আছে সিঁড়ির নিচে, কিছুই যেনো ঢুকছে না ছোট্ট মস্তিষ্কে। কয়েক মুহুর্ত পরে মেঘ ও যথারীতি বই খাতা নিয়ে রুমে চলে যায়। আজ তার অনেক পড়া৷ আগামীকাল রবিবার কোচিং এ পরীক্ষা , ক্লাস, নতুন টিউশন। সবমিলিয়ে পড়া শিখতে ব্যস্ত হয়ে পরে৷
(golpokotha70)
★★★
রাত ৯ টায় খেতে বসেছেন সবাই। খান বাড়ির খাবার টেবিল টা অনেকটায় লম্বা। টেবিলের একপাশের প্রস্থ বরাবর বসেন ‘আলী আহমদ খান’ খান বাড়ির বড় কর্তা। ওনার বিপরীতে কোন চেয়ার নেই কারণ ওনার মুখোমুখি বসার যোগ্যতা এই বাড়িতে কারোর নেই। একপাশে ৪ টা চেয়ার ইকবাল খান, আদি,তানভির ভাইয়া আর আবির ভাইয়ের চেয়ার একপাশে। আবির ভাই না থাকাকালীন ও চেয়ার সরানো হয় নি। অন্যপাশে তিনটা চেয়ার। মোজাম্মেল খান, মীম আর মেঘের। মেয়ে মানুষ গা ঘেঁ*ষে বসা পছন্দ করে না তাই একটা চেয়ার স্টোর রুমে রেখে ৩ টা চেয়ার দূরে দূরে রেখেছে।
যদিও মেহমান আসলে আরও ৩-৪ টা চেয়ার অনায়াসে ফেলা হয় ফেলা হয় এখানে। এতবছর আবির ভাই না থাকায় মেঘ একেবারে কর্ণারের চেয়ারটাতে বসেছে। আবির ভাই ফেরার পরও তাকে বাধ্য হয়ে এই চেয়ারটাতেই বসতে হয়।
আবির ভাইয়ের মুখোমুখি বসা আর প্রথম বি*শ্বযু*দ্ধে শহী*দ হওয়া দুটায় মেঘের কাছে সমান। রোজ দুবার চোখের সামনে নিজের মস্তি*ষ্কের র*ক্তক্ষ*রণ সহ্য করা, বুকের ভেতর উতালপাতাল ঢেউ সামলানো, সেই ধারা*লো চোখের চাউনী প্রতিবার যেনো পি*স পি*স করে কা*টে অষ্টাদশীর হৃদয়টা।।
এদিকে বোকা মেঘ এখনও অনুধাবন ই করতে পারছে না আবির ভাই কি তার শুধুই ক্রাশ নাকি সে তার প্রেমেও পরেছে।।
আচমকা আলী আহমদ খানের রাশভারি কন্ঠে মেঘের গাঢ় চিন্তার ব্যাঘাত ঘটলো
আলী আহমদ খানঃ আবির কোথায়?
অফিসের কাজ তো সেই সন্ধ্যেবেলায় শেষ তাহলে এত রাতে কোথায় সে?
মালিহা খান তটস্থ ভঙ্গিতে বললেন, ও তো সন্ধ্যায় এসেছিল, রেস্ট নিয়ে কফি খেয়ে তারপর বের হলো!
আলী আহমদ খানঃ ছেলেদের নিষেধ করো রাতবিরেতে ঘুরাঘুরি করতে ।
ইকবাল খান সাবলীল ভঙ্গিতে বলে উঠলেন, “বড় ভাইয়া,তুমি চিন্তা করো না, ছেলেটা এতবছর পর দেশে ফিরেছে । বন্ধুদের তো একটু সময় দিতে হয়।
আলী আহমদ খান চুপচাপ খাওয়া শেষ করলেন উঠার আগ মুহুর্তে মেঘের দিকে তাকিয়ে বললেন, “শাহরিয়ার কেমন পড়িয়েছেন মা?”
মেঘ নরম স্বরে বললো,
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো পড়িয়েছেন । ”
আর কোনো কথা বললেন না উঠে বেসিন থেকে হাত ধৌয়ে নিজের রুমে চলে গেছে। তার কিছুসময় পর বাকি দুই ভাই ও যে যার রুমে চলে গেলো৷ খাবার টেবিলে বসে বসে খাচ্ছে খান বাড়ির তিন বাদ*ড়। মেঘ বড় বা*দর , মীম হলো মেজো বাদ*র, আর আদি হলো সবচেয়ে ছোট বাদ*র। তিনজনে রাজ্যের গল্পে মেতেছে।
হালিমা খান এসে ধমক দিলেন, এই মেঘ, তোর কি এখন বাঁদরামি করার সময়? দুদিন পর পরীক্ষা শুরু হয়ে যাবে, পড়াশোনা বাদ দিয়ে আড্ডায় মজে থাকিস সবসময়৷
মেঘের প্রফুল্ল মুখটা তৎক্ষনাৎ মলিন হয়ে গেলো, কোনো রকমে খাবার শেষ করে রুমে চলে গেলো৷ পড়াশোনায় মনোযোগ দিলো।
পেইজ: গল্প কথা
★★★★
আবির কত রাতে ফিরেছে, সে হদিস কেউ রাখে নি।৷
তানভির ফিরেছে ১১ টায় তখনও হালিমা খান অপেক্ষা করছিলেন৷ তানভির মাকে ঘুমিয়ে যেতে বললেন তারপরও হালিমা খান ১২ টা পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন আবির ফিরে নি তাই বাধ্য হয়ে ঘুমিয়ে পরেছেন।
আবির ফিরেছে রাত ২ টার দিকে। কোনোরকমে ফ্রেশ হয়ে বেলকনিতে পাতা চেয়ারে হেলান দিয়ে আকাশের পানে তাকিয়ে আছে৷ দৃষ্টি নিবদ্ধ দূরে ঐ চাঁদে কিছুক্ষণ পর পর মেঘে ঢেকে যায় আবারও আলোকিত হয়। আবির কি যেন ভাবে খানিকক্ষণ।
তারপর গম্ভীর কন্ঠে নিজেই নিজেকে শুধালো,
“তুই কি কোনোদিন শুধরাবি না?”
কেটে গেলো আবিরের নির্ঘুম, নিদ্রাহীন রাত।
পেইজ:গল্প কথা (golpokotha70)
★★★★
সকাল ৮ টায় খাবার টেবিলে বসে খাবার খাচ্ছে মীম, মেঘ,আদি, তানভির আর কাকামনি ইকবাল খান। বড় দুই ভাই ভোর সকালেই অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়ে দিয়েছেন। মেঘ মীমের সাথে ফিসফিস করে আড্ডায় ব্যস্ত। তানভির যেনো দেখেও না দেখার মতো খাচ্ছে। আগে হলে একটা ধ*মক দিয়ে বলতো, ‘ চুপ থাক ‘ আজ যেনো কিছুই করলেন না। তাই মেঘ আর মীম আপন মনে গল্প করে করে খাচ্ছে।
মেঘের মনোযোগ ভাঙলো কারো চেয়ার টানার শব্দে, মেঘ তৎক্ষণাৎ তাকালো। আবিরের নিখাদ দৃষ্টি মেঘের চোখে নিবদ্ধ । মেঘ এক পলক তাকিয়ে চোখ নামিয়ে ফেললো, বুকের ভেতর ধুকপুকেরর মাত্রা বাড়ছে তারসাথেই নিযুক্ত হলো চি*ন্তার ছাপ।
মাথা নিচু করে মনে মনে বললো, ” আবির ভাইয়া সারারাত ঘুমান নি? ফ্যাকাশে হয়ে আছে মুখটা। কি হয়েছে ওনার! এসব ভেবেই মেঘ আঁতকে উঠছে বার বার, গতকাল সন্ধ্যায় বের হলো চোখ অন্ধকার করে, রাতে কখন ফিরেছেন ওনি? কোথায় ছিলেন সারারাত! ”
এসব চিন্তায় মেঘের উৎফুল্ল মেজাজ টা খারাপ হয়ে গেলো।
মীমের ডাকে স্বাভাবিক হলো মেঘ,৷ মীমের খাওয়া শেষ ওঠে যাচ্ছে। এতক্ষণে তানভির আর ইকবাল খানও খেয়ে চলে গেছেন। খাবার টেবিলে এখন শুধু আদি, আবির আর মেঘ।
মেঘ প্লেটের ভাত গুলো তাড়াতাড়ি শেষ করলো । যেইনা উঠতে যাবে আবির ভাই মেঘের প্লেটে আরও দু চামচ ভাত দিলেন।।
মেঘ ছোট করে চিৎকার দিতে গিয়েও দিলো না, চোখ পড়লো আবিরের দিকে, আবিরের তা*মাটে মুখ টা দেখেই চোখ নামিয়ে নিলো।
আবির প্রখর তপ্ত স্বরে বললো, “এগুলো শেষ করে তারপর উঠবি!”
মেঘ কিছু বলতে গিয়েও থেকে গেলো।
আবির আবারও বলে উঠলো, “তোর নামে সারাক্ষণ শুধু অভিযোগ শুনি, খাস না, খাস না! এখন চুপচাপ খা, একটা কথা বলবি তো এক চামচ ভাত দিব”
মেঘ চিবুক গলায় ঠেকাল অল্প অল্প করে ভাত খাচ্ছে। হঠাৎ আদি উৎফুল্ল মেজাজে বললো,
“মেঘাপু , আমার খাওয়া শেষ, তুমি লাস্ট! হা হা হা”
মেঘের মুখটা আরও ছোট হয়ে গেলো। কিছুক্ষণ আগেই ৩ ভাই বোন মিলে চ্যালে*ঞ্জ নিয়েছিল যে আগে খেয়ে ফাস্ট হবে তাকে একটা কিটকেট দেওয়া হবে।
মেঘ ই ফাস্ট হতো কিন্তু আচমকা আবির বসাতে মেঘের মনোযোগ ন*ষ্ট হয়ে যায়, খাওয়া বন্ধ হয়ে যায়, তাই মীম ফাস্ট হয়ে গেছে। আদির আগে খাওয়া শেষ করলে তো অন্ততপক্ষে ২য় থাকতো। আবির ভাই এর উপর কিছুটা ক্ষি*প্ত হলো মেঘ৷ সঙ্গে সঙ্গে মনোযোগে বিঘ্ন ঘটলো,
মনে মনে বললো,আবির ভাই কে কি জিজ্ঞেস করবো “কি হয়েছে?”
ততক্ষণে প্লেটের ভাত জোর করে খেয়ে শেষ করেছে।
মেঘের জিজ্ঞাসু নেত্র যুগল আবিরের মুখের পানে,
মেঘের হা*ত -পা কাঁ*পছে । গলা শুকিয়ে আসছে। কি জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিল সব এলোমেলো হয়ে গেছে,আবির ভাইকে দেখলে প্রতিবার যেমন বুকের ভেতর কেউ ঢোল বাজিয়ে নৃত্য করে। আজও তার ব্য*তিক্রম হলো না। মুখ দিয়ে টু শব্দ টা বের করতে পারছে না। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। চোখ নামিয়ে গ্লাস টেনে ঢকঢক করে পুরো গ্লাসের পানি টা শেষ করলো।
আবিরের এদিকে কোনো মনোযোগ নেই। সে তার খাওয়াতে মগ্ন।
মেঘ বসে থাকতে পারছে না আবির ভাইয়ের সামনে তাই কোনোরকমে কাঁপা কাঁপা পায়ে বেসিনে চলে গেলো। আবির চোখ তুলে এক পলক দেখলো প্লেট টা, খাওয়া শেষ তাই আর কথা বাড়ায় নি।।
হাত ধৌয়ে কোনোরকমে রুমের উদ্দেশ্যে ছুটলো মেঘ। সিঁড়িতে এমন ভাবে ছুটেছে যেনো থামলেই পায়ের শিরশিরে গরিয়ে পরবে নিচে।
Page: golpokotha70
★★★★★
৯.৩০/৪০ বাজে আবির বাসা থেকে বের হচ্ছে । আব্বু আর চাচ্চু সেই সকালে অফিসে চলে গেছেন তাই আবির একটু পরে গেলেও সমস্যা নাই। আবিরের কিছুটা পিছনে মেঘ ও বের হলো। আজ রবিবার কোচিং খোলা৷ মেইন গেইটের সামনে গিয়ে থমকে দাঁড়ালো মেঘ। আবির ভাই বাইক ঘুরাচ্ছে।
মেঘ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেদিকে। সেদিন প্রথম এখানেই দেখেছিল আবির ভাইকে। সেই থেকে অষ্টাদশীর ছোট্ট পৃথি*বীটা এলোমেলো হয়ে গেছে। ধ্যা*নে জ্ঞানে শুধুই আবির ভাই।
অষ্টাদশীর খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো বাইকে করে কোচিং যেতে । আজ পর্যন্ত মেঘ বাইকে উঠে নি৷ শুধু মেঘ কেন, মীম আদি কেউ ই উঠে নি। মেঘের খুব ইচ্ছে করে খুলা আকাশের নিচে বাইকে ঘুরবে প্রকৃতির সৌন্দর্য, বাতাস উপভোগ করবে৷
মনে মনে ভাবলো, “আবির ভাই কি আমায় নিয়ে যাবেন?”
হঠাৎ আবিরের কন্ঠ কানে বাজলো,
“মেঘ”
নিজের নামটা আবির ভাইয়ের মুখে শুনে, মনের মধ্যে বসন্তের হাওয়া লেগেছে, মনে হচ্ছে তরোয়াল দিয়ে ফালা ফালা হয়ে গেছে হৃদয় টা। মনের মধ্যে হাজারপ পাখির কল রব, তারা যেনো বলে বেড়াচ্ছে, তোর ক্রাশ তোকে ডাকছে!”
আবিরের গম্ভীর কন্ঠ ভেসে আসলো আবারও,
“ডাকছি তো?”
মেঘ চুপসে গেলো, চোখ নামিয়ে কাঁ*পাকাঁ*পা পায়ে এগিয়ে গেলো আবিরের দিকে, মনে মনে ভাবলো
“আবির ভাই কি সত্যিই আমায় বাইকে করে নিয়ে যাবেন..?”
আবির চোখে মুখে বিরক্তি নিয়ে বললো,
“তুই চুল খোলে ঘুরিস কেন? ”
মেঘ যেন আহাম্মক হয়ে রইলো,
আবির কন্ঠ দ্বিগুণ ভারি করে বললো,
“আজকের পর থেকে যেনো তোকে বাহিরে কোথাও চুল খোলা না দেখি। যদি আর একদিন তোকে এভাবে দেখি তাহলে এমন থা*প্পড় দিবো তোর গাল থেকে থা*প্পড়ের দাগ এক মাসেও যাবে না। ছোট বেলার মাই*র টা আশা করি ভুলিস নাই!”
এতটুকুন বলেই আবির হেলমেট পরে বাইক স্টার্ট দিয়ে চলে গেলো।
মেঘের মাথায় আকাশ ভেঙে পরলো, কয়েক মুহুর্ত নিস্তব্ধ হয়ে রইলো। মেঘ নিজের প্রতি নি*স্পৃহায় শ্বাস ফেললো। আবির ফিরে আসার পর থেকে মেঘ উদ্বেলিত, ক্রাশ খাওয়া, প্রেম প্রেম অনুভূতি সবেতে যেনো পানি আরে না না বরফ ঢেলে দিয়ে গেলো আবির ভাই৷ যেই মেঘ আবিরের প্রেমে হা*বুডুবু খাবে ভাবছিল তাকে যেনো গভীর খা*দে চুবিয়ে মা*রলো। মনে পরে গেলো ছোট বেলার আবিরের মা*রের কালো অধ্যায়। ছোটবেলায় আবির ই মে*রেছিল শুধু তাকে। আজ পর্যন্ত মা বাবা এমন কি তানভির এত ধমকায় সেও কোনোদিন মেঘের গায়ে হা*ত তুলে নি। এতবছর পর আবির ভাই ফিরলো। আবির ভাইকে দেখে মেঘ পুরোনো সবকিছু ভুলে নতুন ভাবে আবির ভাইকে নিয়ে ভাবনা শুরু করেছিল সবে মাত্র। সেই ভাবনায় আ*গুন জ্বা*লিয়ে চলে গেলো ব্যাটায়।
আহত চোখে তাকিয়ে রইলো কতক্ষণ আচমকা রক্তজবার ন্যায় ঠোঁটদুটো ভে*ঙে হুহু করে কেঁদে উঠলো মেঘ। এই কা*ন্না কতক্ষণ স্থায়ী হলো তা জানা নেই৷
হঠাৎ বন্যার কলে কিছুটা কেঁপে উঠলো মেঘ। ফোন রিসিভ করতেই বন্যা বললো,
“কিরে কই তুই, আসবি না?”
মেঘ কথা না বলেই কে*টে দেয় কল, মেঘের গাল চুপচুপে ভিজে আছে। তারপর হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চোখ দুটো মুছে গাড়ির দিকে যায়।
বেশ কিছুক্ষণ পর কিছুটা স্বাভাবিক হলো মেঘ। মনে মনে ক্ষু*ব্ধ হলো,গাড়িতে বসে বসে ফুঁসছে রাগে। এসির মধ্যে বসেও যেনো কপালে ঘাম ঝরছে মেয়েটার, রাগে ক্ষো*ভে ওষ্ঠ উল্টালো। মনে মনে স্থির করলো,
আর কখনো আবির ভাইকে নিয়ে ভাববে না। আবির ভাই সত্যি ই হিট*লার তা না হলে আমার মতো নিষ্পাপ মেয়েটাকে শুধু শুধু মা*রার চিন্তা করতে পারে, আমি ওনার কোন পাকা ধানে মই দিয়েছি । অভিমানি কন্ঠে মনে মনে ভাবলো মেঘ।
এসব ভাবতে ভাবতে কোচিং এ পৌছে গেলো। ক্লাস শুরু হয়ে গেছে ১০ মিনিট আগে। বন্যা জায়গা রেখেছিল তাই বন্যার পাশেই বসলো।
একটা ক্লাস শেষ হওয়ার পর আরেকটা ক্লাসের স্যার আসতে আসতে বন্যা মেঘকে ফিসফিস করে বললো,
“কিরে আসতে এত দেরি হলো কেনো? আর তুই না আমাকে তোর ক্রাশ বয় আবির ভাইয়ের ছবি দেখাবি বলছিলি, কই দেখা।”
মেঘ করুণ দৃষ্টিতে তাকালো বন্যার দিকে তারপর গম্ভীর কন্ঠে উত্তর দিলো,
“প্রথমত ওনার জন্য আমার আসতে দেরি হয়েছে। দ্বিতীয়ত ক্রাশ শব্দ টা মনের মধ্যে চাপা পরে ম*রে গেছে। শুধু শুধু আমার জীবন থেকে তিনটা দিন নষ্ট করলাম৷ এখন থেকে আমি শুধু পড়াশোনা করবো। অন্য কিছু ভাববো না”
মেঘের কথাগুলো বন্যা মনোযোগ দিয়ে শুনলো তারপর স্ব শব্দে হেসে উঠলো বন্যা,
মেঘ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বন্যার দিকে,
বন্যা আবার আস্তে আস্তে ধীর কন্ঠে বললো,
আমি সেদিনই বলেছিলাম এসব ক্রাশ টাশ কিছু না, পড়াশোনায় মনোযোগ দে । ঠিক হলো তো আমার কথা।
এরমধ্যে স্যার ক্লাসে আসছেন৷ দুজনেই ক্লাসে মনোযোগ দিলো
পেইজ: গল্প কথা (golpokoth70)
★★★
মেঘ বাসায় ফিরে চুপচাপ নিজের রুমে চলে গেলো, মনটা তার ভীষণ খারাপ। ফ্রেশ নিচে এসে খাবার খেয়ে কোনোদিক না তাকি নিজের রুমে গিয়ে পড়তে বসেছে। সন্ধ্যার পর টিউটর আসবে পড়া মুখস্থ করতে হবে৷ সকালের শা*সন ভুলার চেষ্টায় ম*গ্ন মেয়েটা৷
প্রতিদিন সন্ধ্যার দিকে নিচে আসে মেঘ, ছোট ভাই বোনের সাথে আড্ডা আর খেলায় মগ্ন হয়। কিন্তু আজ তার ব্যতি*ক্রম হলো। দুপুরের পর থেকে একবারের জন্যও নিচে নামলো না মেঘ৷ মীম আর আদি কয়েকবার ডাকতেও গিয়েছিল। দরজা লাগিয়ে পড়ছে মেঘ, আসবে না বলেছে।
সন্ধ্যার পর পর বাড়িতে ফেরে আবির। চোখে মুখে উ*জ্জ্বলতা ফুটে উঠছে। চোখ পরে রান্নাঘরে মা কাকিয়া দের দিকে।৷ কাকিয়াকে ডেকে উৎফুল্ল কন্ঠে বললো,
“কাকিয়া, চিকেন পাকোড়া বানাবে প্লিজ!”
মা কাকিয়া তিনজনই যেনো অবাক চোখে তাকিয়ে আছে আবিরের দিকে। ছেলেটা মুখ ফোটে কিছুই চাই না কখনো, খাওয়া নিয়েও কখনো নাক সিটকায় না। পছন্দের খাবারের নাম ও জানে না কেউ। আজ হঠাৎ নিজে থেকে কিছু খেতে চেয়েছে।
কাকিয়া হাসিমুখে বললো,
তুমি ফ্রেশ হয়ে আসো আমি রেডি করছি।
আবির স্বাভাবিক ভাবে রুমের দিকে চলে গেলো, করিডোরে যাওয়ার পথে কানে আসলো মেঘের পড়ার শব্দ, অনর্গল পড়ছে মেয়েটা শ্বাসও নিচ্ছে না মনে হচ্ছে৷ আবিরের ঠোঁট বেকিয়ে কিছুটা হাসলো তারপর সবেগে রুমে চলে গেলো৷
আবির বেশ সময় নিয়ে শাওয়ার নিলো, ১০ মিনিট রেস্ট ও নিলো। তারপর কালো টিশার্ট আর টাউজার পরে রুম থেকে বের হয়, একটু সামনে আসতেই চোখ পরলো মেঘের রুমের দরজা খোলা, মেঘ নেই৷
আবির নিজের মতো এসে সোফায় বসলো, ভাইকে দেখে মীম আর আদি আগেই ছুটে পালালো। না হয় এসেই বলবে “পড়াশোনা নাই!”
আবিরকে মালিহা খান কফি দিলেন, আবির কফি খেতে খেতে তানভির কে কল দিলো,
“কই তুই?”
তানভির: আমি তো পার্টি অফিসে ভাইয়া, কোনো দরকার?
আবির: কাজ না থাকলে তাড়াতাড়ি বাসায় আয়।
তানভির ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কিছু হয়েছে ভাইয়া?”
আবির স্ব শব্দে হেসে বললো,
“দূর কিছু হয় নি, চিকেন পাকোড়া বানাচ্ছে কাকিয়া, খেলে তাড়াতাড়ি আয়!”
তানভির: আচ্ছা আসছি৷
কথাগুলো না শুনলেও আবিরের হাসির শব্দ ঠিকই কানে এসেছে পড়ার রুমের বসা অষ্টাদশীর। বুকটা সঙ্গে সঙ্গে কেঁপে উঠলো, নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলো,
“আবির ভাইয়া হাসছেন? ওনি বাসার ফিরেছেন? ”
তৎক্ষনাৎ মনে পরে গেলো সকালের ঘটনা, সাথে সাথে মুখটা কালো করে পড়া রিভিশন দেয়ায় ব্য*স্ত হলো মেঘ।
তানভির ফিরেছে ৫-৭ মিনিট হবে৷ ফ্রেশ হয়ে নিচে এসেছে। এতক্ষণে চিকেন পাকোড়া হাজির হলো সামনে। ফ্রিজ থেকে বের করে কিছু রান্না করা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার তা তাদের জানাই আছে। এজন্য ধৈর্য নিয়েই বসে বসে ফোন ঘাঁটছিল আবির।
দুই ভাই আপন মনে গল্প করে পাকোড়া খেতে ব্যস্ত। এদিকে মেঘ অপেক্ষা করছে টিউটরের আসার জন্য। ৪০ মিনিট লেইট । এখনও আসছে না কি করবে বুঝতে পারছে না। পড়ছে কিছুক্ষণ হাবিজাবি ভাবছে আবার পড়ছে।
তানভির হঠাৎ ডাকলো,
“মেঘ, এদিকে আয়!”
মেঘ ভাইয়ের ডাক শুনেই কিছুটা কেঁপে উঠলো, তারপর পড়ার রুমের দরজায় দাঁড়ালো, হালকা গোলাপি রঙের জামা পরেছে, মাথায় ওড়না দেয়া। পেট পিঠ সবটায় ওড়না দিয়ে ঢাকা,অনেক স্নিগ্ধ লাগছে মেঘকে।।
আবির তখনও স্ব শব্দে হাসছে। তানভির ভাইয়া আর আবির ভাই নিজেদের মধ্যে মসকরায় ব্যস্ত।।মেঘ দরজায় দাঁড়িয়ে আবির ভাইয়ের হাসিতে ম*গ্ন। তিনদিনেও এই মানুষটাকে এতটা প্রফুল্ল দেখেনি সে৷ বরাবরই যেনো গম্ভীর । সেই বাইক কেনার দিন একটু হেসে হেসে কথা বলার চেষ্টা করেছিল সেই হাসিতেই ক্রাশ খেয়েছিল মেঘ। আজকের হাসি ঘা*য়েল করে দিলো মেঘকে। চোখ সরাতে চেয়েও সরাতে পারছে না।
আবিরের চোখ পরে দূরে দরজায় দাঁড়ানো মেঘের দিকে, কয়েক সেকেন্ড পরেই হাসি থাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলো আবির৷
তানভির তৎক্ষনাৎ বলে উঠলো, “মেঘ পাকোড়া খাবি? আয় খেয়ে যা!”
মেঘ যেনো বড় সড় টাশকি খেলো,
“ভাইয়া তাকে খাবার খেতে ডাকছে, এতগুলো বছরে এরকম ঘটনা তার সাথে কখনো ঘটেনি! ”
তানভির আবার ডাকলো,
‘আয় খেয়ে যা, পরে পড়তে বসবি নে’
মেঘ দু পা এগুলো কি যেনো ভেবে ঠায় দাঁড়িয়ে পরলো,
কিছুটা অভিমানি কন্ঠে উত্তর দিলো, “তোমরা খাও, আমি খাবো না!”
আবারও পড়ার রুমে চলে গেলো মেঘ। তানভির আর আবিরও আর বেশি কথা বললো না। খাওয়া শেষ করে আবির নিজের রুমে গেলো, তানভির পুনরায় পার্টি অফিসে ছুটলো, মিটিং আছে তার৷ ভাই ডেকেছে বিধায় মিটিং রেখে ছুটে এসেছিল সে।
মেঘ টিউটরের জন্য অপেক্ষা করলো আরও ৩০ মিনিট। পড়তে পড়তে খিদা পেয়েছে তার।
মাত্র খাবার হয়েছে ৮ টাও বাজে নি। মেঘ খেতে বসেছে। বার বার তাকাচ্ছে দরজার দিকে, টিউটর আসলে পড়তে বসতে হবে।।
খাওয়া শেষ হলো কিন্তু টিউটর আসলো না। তাই মেঘ বই খাতা নিয়ে উপরে যাচ্ছে আর আম্মুকে বলে গেলো, টিউটর আসলে ঢেকে দিতে।
রাত ৯ টায় খেতে বসলেন সবাই। তানভিরও মিটিং শেষ করে বাসায় এসেছে। খাবার টেবিলে সবাই থাকলেও মেঘের কোনে হদিশ নেই৷
তানভির কাকিয়া কে জিজ্ঞেস করলো,
“মেঘ খাবে না?”
কাকিয়া স্বাভাবিক ভাবেই উত্তর দিলো,” ও তো সন্ধ্যা বেলায় খেয়ে উপরে চলে গেছে, বললো খিদে পেয়েছে’
তেমন কথা নেই কারো মুখে, আবির কোনোরকমে অল্প খেয়ে রুমে চলে গেলো, গতরাতে ঘুমায় নি ছেলেটা। সারাদিনের ক্লান্তিতে ঘুম পাচ্ছে খুব। তাই রুমে গিয়ে শুয়ে পরেছে।
এদিকে মেঘ পড়ছে আর ক্ষ*ণে ক্ষ*ণে ঠোঁট উল্টে কান্না করছে। আবারও নিজেকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। যেভাবেই হোক চান্স পেতে হবে। অভিমানি স্বরে বলছে, দূরের ভার্সিটি হলে ভালোই হবে৷ এই বাড়ি থেকে চলে যাবো অনেক দূরে। ভাইয়া৷ আবির ভাই আমায় পাবেই না বক*বে কিভাবে আর মা*রবে কিভাবে? তৎক্ষনাৎ মায়ের কথা ভেঙে কা*ন্না করে দেয়। মাকে ছাড়া থাকবে কিভাবে সে!”
(চলবে)