আয়ুর প্রহর পর্ব-০৩

0
2483

#আয়ুর_প্রহর
#পর্ব_০৩
#আয়িশা_নুর_তৃষ্ণা
___
মধ্যরাতে প্রচন্ড তেষ্টায় ঘুম থেকে উঠে রুমে পানি না পেয়ে ড্রয়িংরুমে যাচ্ছিলো অনিতা। লাইট জ্বালাতে গিয়ে কারো ফিসফিস আওয়াজ পেয়ে দাড়িয়ে পড়লো সে।ভালো করে লক্ষ্য করতেই বুঝলো,আওয়াজটা গেস্টরুম থেকে আসছে। কিন্তু এতোরাতে এভাবে কে কথা বলবে? বাসায় তো কোনো গেস্ট নেই।যারা এসেছিল,সবাই তো চলে গিয়েছে।তাহলে এখানে কে? সে ভাবলো,“দেখেই আসি কে এখানে”।এই ভেবে গুটিকয়েক পা এগুতেই কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে আঁতকে উঠে ভয় পেয়ে প্রায় চিৎকার দিয়ে উঠলো অনিতা।
__
মুখে হালকা পানির ঝাপটার উপস্থিতি অনুভব করে বন্ধ চোখ মুখ কুঁচকে ফেললো প্রহর।চোখ খুলে দেখতে পেলো সামনে আয়ুশ হাতে পানির বোতল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।প্রহর চোখ খুলেছে দেখে আয়ুশ বোতলের ক্যাপ লাগাতে লাগাতে বললো,
–“এতোক্ষণে ঘুম ভাঙলো আপনার!সেই কখন থেকে ডাকছি”!
প্রথমে আয়ুশের কথা বুঝতে না পারলেও খানিক বাদে চোখ কচলে প্রহর বুঝতে পারলো,সে গতরাতে গাড়িতেই ঘুমিয়ে পড়েছিল।সে ভাবলো আয়ুশকে জিজ্ঞেস করবে,গাড়ি ঠিক হয়েছে কি না। কিন্তু এই লোকটা কিছু জিজ্ঞাসা করলেই যা ধমক দেয়,তাই প্রশ্ন করতে গিয়েও চুপ রইলো প্রহর।

প্রহর কিছু বলছে না দেখে আয়ুশ নিজেই বলতে শুরু করলো।সে সারারাত অপেক্ষা করেছে সকাল হওয়ার জন্য।সকাল হওয়ার সাথে সাথে ও কয়েকজনের সাথে ফোনে যোগাযোগ করে, আশেপাশের লোকজনের সহায়তায় মেকানিক ডেকে এনে সে চাকার পাংচার সারায়।তারপর আরো কিছু বন্ধুকে ফোন করে বাসা ঠিক করে।আর এতোক্ষণ প্রহরকে ডাকছিল,সকালের নাস্তা করে নেওয়ার জন্য।

আয়ুশ প্রহরকে পানির বোতল দিয়ে বলল,হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হওয়ার জন্য।
আশেপাশে তেমন কোনো খাবারের দোকান নেই।তাই ওরা এখান থেকে চা-বিস্কুট আর পাউরুটি খেয়ে নতুন বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো। ওইখানে গিয়ে রুম পরিষ্কার করে দুজনে একসাথে মার্কেটে গিয়ে বাসার জিনিসপত্র কিনার জন্য মার্কেটে যাবে বলে ঠিক করলো আয়ুশ।প্রহর বলল,সে তো দ্রব্যাদির বিষয়ে এতোকিছু জানে না,সে না গেলেই নয় কি ?এটা শুনতেই আয়ুশ বললো,

“দেখুন,একটা বাসায় আমরা দু’জনে থাকবো।আর একজনের মতামত অন্যজনের ভালো নাও লাগতে পারে। একজনের পছন্দ অন্যজনের অপছন্দ হতেই পারে।তাই আমাদের এডজাস্ট করে একসাথে সব গুছিয়ে নিতে হবে।আশা করছি,এখন এর থেকে বেশি কিছু বলতে হবে না।”

প্রহর বাধ্যগত মেয়ের মতো সব শুনে গেল।এমনিতে বকা ও ভালোই হজম করতে পারলেও এই লোকটার থেকে বকা শুনতে তার কেন যেন কেমন লজ্জা লজ্জা লাগে।তাই প্রহর চুপ করে রইলো।

নতুন বাসায় যাওয়ার পরই আয়ুশ প্রহরকে বলল, ফ্ল্যাটটা ঘুরে দেখতে যে কেমন হয়েছে।প্রহর দেখলো,তিনতলা বাসার দোতালায় দুইটা বেডরুম,একটা গেস্টরুম,দুইটা ব্যালকনি না একটা ছোট্ট স্টোররুম ,একটা মাঝারী ডাইনিং,দুইটা ওয়াশরুম, বন্ধ একটা মাঝারী সাইজের কিচেনরুমে ঘেরা ছিমছাম একটা ফ্ল্যাটে ওরা উঠেছে।সব মিলিয়ে বেশ ফ্ল্যাটটি বেশ লাগলো প্রহরের।লোকটা রুড হলে কি আছে,চয়েস বেশ ভালোই ভেবে আনমনেই মুচকি হাসলো প্রহর!

আশেপাশের গোছালো পরিবেশ দেখে বুঝাই যাচ্ছে আগে যারা এই ফ্ল্যাটে থাকতো,তারা বেশ পরিষ্কার আর মার্জিত স্বভাবের ছিল।সব গুছিয়ে সুন্দর করে রেখে গিয়েছে। এইজন্য আয়ুশ আর প্রহর মনে মনে ওদেরকে কয়েকবার ধন্যবাদ ও জানালো। তাদের গোছালো স্বভাবের জন্যই সব রুম পরিষ্কার করা তাদের জন্য খুব সহজ হয়ে গেলো।

আপাতত আশেপাশে তেমন দোকান না থাকায় বাড়িওয়ালার থেকে চেয়ে দুটি ঝাড়ু,বালতি ও কয়েকটা ছেঁড়া নেকড়া দু’জনে পরিষ্কারের কাজে লেগে গেল। তাদের বাড়িওয়ালা বেশ ভালোই।আয়ুশের গাড়ির জন্য নিজের গ্যারেজের পাশেই একটা পার্কিং স্পটের জায়গা করে দিয়েছেন। তাছাড়া উনি আরও বলে দিয়েছেন,কাজে সাহায্য জন্য লোক লাগলে তারা যেন উনাকে জানায়।উনি ম্যানেজ করে দিবেন।কিন্তু আয়ুশ বলে দিয়েছে,আপাতত লাগবে না।দুজনে মিলে ঠিক সামলে নিতে পারবে।

আয়ুশ প্রায় সব কাজেই পারদর্শী হওয়ায় নিজেই সব সাফ করে যাচ্ছে।আর প্রহর কম যায় না।এসব কাজ করেই বড় হয়েছে সে,তাই ও ও আয়ুশের সাথে সমান তালে কাজ করছে।দু’জনের লাগাতার পরিশ্রমে, ফ্ল্যাটের প্রাক্তন বাসিন্দাদের রুচির তারিফ করতে করতে দুপুরের আগেই সবক’টা রুম পরিষ্কার হয়ে গেল। পরিষ্কার শেষ হতেই দু’জনে একটা রিকশা করে সুপারমার্কেটের উদ্দেশ্য রওয়ানা দিল।

তারা রিকশায় করেই গেলো,কারণ গাড়ি বোঝাই করে তো এতো জিনিস নিয়ে আসতে পারবে না।আর কতোক্ষণ সময় লাগে কে জানে।তাছাড়া আসার সময় সব মাল-সামানা তো পিকআপে করেই নিয়ে আসতে হবে।ওরাও জিনিসপত্রের সাথে সাথেই আসবে।তাই সবদিক বিবেচনা করে তারা রিকশা করেই গেল।

সুপারমার্কেটে যাওয়ার আগে আয়ুশ ব্যাংকে গিয়ে নিজের একাউন্ট থেকে টাকা উঠালো।ব্যাংকে প্রায় লাখ’দশেক টাকার মতো সেভিংস আছে তার।হোস্টেলে থাকাকালীন স্টুডেন্ট জীবনে বাবা যত টাকা দিতো এক টাকাও বেহুদা খরচ করতো না আয়ুশ।সব জমিয়েছে সে।
তাছাড়া গতরাতে হাতে নগদ ক্যাশ ছিল ত্রিশ হাজারের মতো।সবসময় এতো টাকা সাথেই রাখে সে।নিজেকে প্রোটেক্ট করার কৌশল তার আয়ত্তে আছে।আয়ুশ ভাবে,যদি নিজেকে যে প্রোটেক্ট করতে পারে,তাহলে এই কয়েক হাজার টাকা আহামরি কিছুই নয়।

আজ ফ্ল্যাট ভাড়া এডভান্স দিতে হয়েছে ১৪ হাজার টাকা।তার এক বন্ধুর আত্মীয় বলে নিজে থেকেই একটু কমিয়ে বলেছিল তারা।ওরা কম না বলে নির্ধারিত টাকা বলে বাড়িয়ে বললে ওই পরিমাণ টাকাই দিতো আয়ুশ।প্রখর আত্নসম্মানবোধ আয়ুশের।যেখানে তার আত্নসম্মানে কেউ একচুল অসম্মান করবে,সেখানে যে ফিরে তাকাতেও রাজি নয়।

আয়ুশ দেখলো,এখন হাতে আছে ১৬ হাজার টাকা।মনে মনে কিছু হিসেব কষে ব্যাংক থেকে আরো ৩০ হাজার টাকা উঠালো আয়ুশ।আরো কিছু টাকা উঠাতো, কিন্তু বেশি সময় লাগবে ভেহবে আপাতত ১৬ হাজারই নিলো আয়ুশ।

সব জিনিসপত্র কিনতে ঠিক কতো টাকা লাগবে সে সম্পর্কে সঠিক ধারণা না করতে পেরে একটু বেশি টাকা নিল আয়ুশ।সে ভাবলো,যদি টাকা কম পরে,তাহলে তো আবার ব্যাংকে আসা-যাওয়ায় উটকো ঝামেলা হবে।তাই একটু বেশিই নিল সে।মোট ৪৬ হাজার টাকা নিয়ে সুপার মার্কেটের উদ্দেশ্য রওয়ানা দিল দুজন।

একটি সংসারের জন্য কি কি লাগে সে সম্পর্কে দু’জনের একটু একটু ধারণা থাকলেও সম্পুর্ন জ্ঞান কারোরই নেই।তাই তারা সিদ্ধান্ত নিল কাউকে জিজ্ঞেস করার।দেখে দেখে এক বয়স্ক দোকানীর কাছে গিয়ে আয়ুশ জিজ্ঞেস করলো,
–“আঙ্কেল একটা কথা বলতাম”।
–“হ্যাঁ বাবা বলো।”
–“আঙ্কেল বলছিলাম,একটা সংসারের জন্য কি কি লাগে তার যদি একটা লিস্ট করে দিতেন,ভালো হতো!”

আয়ুশের এমন কথা শুনে লোকটা মুখের ভিতর পান দিয়ে চিবোতে চিবোতে তাদের দু’জনের মাথা থেকে পা পর্যন্ত একবার দেখলেন।তারপর তাদের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলতে লাগলেন,
–“কি ব্যাপার বাছা!পালিয়ে এসেছো নাকি?তবে যাই হোক, তোমাদের দু’জনকে কিন্তু বেশ মানিয়েছে।তবে পালিয়ে তোমরা ঠিক কাজ করোনি কিন্তু।এতে তোমাদের পরিবার কষ্ট পাবে।কখনো মেনে নাও নিতে পারে।তবে যদি বাচ্চাকাচ্চা হয়,তাহলে মেনে নিতে পারে ।তাই একটা কাজ করো, তাড়াতাড়ি বাচ্চা নিয়ে নিয়ো। কিন্তু মেয়েটাকে দেখে তো খুব অল্পবয়সী মনে হচ্ছে।তুমি কি করে……………

লোকটার কথা শুনে আয়ুশ বুঝতে পারলো,সে কোন জায়গায় এসেছে।লোকটার কথা বলতে থাকলে থামবেই না তাই লোকটার কথা শেষ না হতেই আয়ুশ বলল,“আঙ্কেল আমাদের ফ্যামিলি থেকেই বিয়ে দিয়েছে।”

লোকটা আয়ুশের দিকে সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকালো,তারপর প্রহরের দিকে তাকাতেই দেখলো প্রহর চুপটি করে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে।আসলে লোকটার এতো কথায় আয়ুশ নিজেকে সামলিয়ে নিলেও লোকটার পুরো কথা বুঝে প্রহর খানিকটা লজ্জা পেয়েছে।তাই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে সে সব শুনছে। হঠাৎ আয়ুশের কনুইয়ের গুঁতোয় প্রহর চোখ তুলে সামনে তাকাতেই দেখতে পেলো,লোকটা তার দিকে তাকিয়ে আছে।বেচারি কিছু বুঝতে না পেরে দোকানীর দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়িয়ে ভ্যাবলামার্কা একটা হাসি দিলো।

দোকানী বেশি কথা বলুক বা যেমনই হোক না কেন,লোকটার মন মানসিকতা বেশ ভালোই। তাইতো তিনি আয়ুশদের কথা মেনে নিয়ে যা যা লাগে একটা সংসারের জন্য যাবতীয় বিষয় নিজে দাঁড়িয়ে ওদের নিয়ে দিলেন।এই প্রথম এতোগুলো জিনিস কিনছে তাও আবার নিজের সংসারের জন্য ভাবতেই প্রহরের সারা শরীর জুড়ে শীহরণ বয়ে গেল।সেও এখন সংসার করবে।কত্তো বড় হয়ে গেছে সে!!
__
দুইটা খাট,দুইটা তোশক,চারটা বালিশ,কয়েকটা হাঁড়ি,পাতিল,জিনিসপত্র রাখার জন্য বড় দুইটা ড্রয়ার,দুইটা আলনা,একটা বাসনদানী,দুইটা ছোট টি-টেবিল,একটা ডাইনিং টেবিল,ছয়টা চেয়ার,চারটা সোফা,চামচ,কড়াই,বাসন,গ্লাস,জগ থেকে শুরু করে ভিমবার,মাজন,পেস্ট,ব্রাশ,সাবান শ্যাম্পু শলাঝাড়ু, ফুলঝাড়ু,জানালা আর দরজায় লাগানোর জন্য পর্দা,একটা আয়না,বেডকভার,গামছা,তোয়ালে,ব’টি পর্যন্ত একটি সংসারের যাবতীয় যা যা লাগে সব গৃহস্থালি জিনিস কিনলো তারা।সাথে প্রহরের জন্য তিনসেট কামিজ,একটা বোরখা,একটা নিকাব,আয়ুশের নিজের জন্য দুইটা গেঞ্জি,দুইটা শার্ট আর দুইটা প্যান্ট কিনা হলো।হারপিক আর বাথরুমের ব্রাশ কিনার সময় হেসে উঠলো প্রহর!তার হাসি দেখে আয়ুশ তার দিকে কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো।প্রহর ভাবলো,এই লোকের মুখটা সবসময় এমন থাকে কেন?হাসতে পারে না?সবসময় কেমন যেন ভ্রু কুঁচকে থাকে! ভ্রু’কুঁচনেওয়ালা পটাস একটা!

সব কিনা শেষে দুইটা পিকআপ বোঝাই করে সব জিনিসপত্র বাসায় নিয়ে আসা হলো। সবকিছু ম্যানেজ করে ঠিক জায়গায় রাখতে রাখতে রাত হয়ে গেল।সব গুছিয়ে নেওয়ার পর আয়ুশ প্রহরকে গোসল সেরে আসতে বললো।দু’জন দুই গোসলখানায় গোসল করলো।গোসল শেষে আয়ুশ বাহিরে গেল।আজ যেহেতু প্রথম দিন,তাই কারোরই কিছু রান্না করার মুড নেই।অতঃপর আয়ুশ বাইরে থেকে তাদের দুজনের জন্য খাবার নিয়ে এলো।

রাতের খাওয়া শেষে যখন দু’জন বিছানার দু ধারে বসে ভাবছে,কে কোথায় ঘুমোবে,তখনই হঠাৎ আয়ুশের ফোন বেজে উঠে। প্রহর খেয়াল করে,ফোন রিসিভ করে ওপাশ থেকে কিছু কথা বলা মাত্রই মাত্রই আয়ুশের মুখের ভঙ্গি পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে।আয়ু্শ “আসছি” বলে সাথে সাথে বাসা থেকে বের হয়ে পড়ে! কিছু না বুঝে প্রহর আয়ুশকে পিছন থেকে ডাক দিতে যাবে তখনই……………………

চলবে কি…?