আয়ুর প্রহর পর্ব-১২

0
1805

#আয়ুর_প্রহর
#পর্ব_১২
#আয়িশা_নুর_তৃষ্ণা
___
নিশুতি রাত।চারদিকে গভীর নিস্তব্ধতার মধ্যে ফিসফিসিয়ে উঠছে গাছের পাতার কড়মড় শব্দ। এই শব্দ তেমন গভীর না হলেও তা ভাটা পড়লো জোরেশোরে উঠা গু’লির আওয়াজে।

প্রণয় জানালা দিয়ে অনীতার রুমে ঢোকার সময় তার দিকেই গুলিটা ধেয়ে আসছিল। সে কিছু বুঝতে না পারলেও ততক্ষণে একটা বলিষ্ঠ হাত এসে তাকে জানালা দিয়ে ঠেলে ভিতরে ফেলে দেয়।আর নিজে গড়িয়ে জানালার পাশ থেকে সরে যায়।গু’লিটা মাটি ফুঁড়ে নিচে চলে যায়।
__

বিশাল বড় দশতলা অ্যাপার্টমেন্টের নবম তলায় ছোট্ট একটা সিক্রেট রুমের মধ্যে একপাশে একটা ইজিচেয়ার আরেকপাশে দুইটা চেয়ারের মাঝে একটা বড় সাইজের টেবিল রেখে দুইটা চেয়ারে সামনাসামনি বসে আছে দুইজন লোক। তাদের মধ্যে চলছে বিস্তর কথোপকথন।

–“ স্যার এতো রাতে ডেকে পাঠালেন!কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আছে নাকি?”

–“ অফকোর্স মাই বয়! এইজন্যই তো তোমাকে ডেকে আনা।”‌ পান চিবুতে চিবুতে বললেন ক্রাইম ব্রাঞ্চের হেড অফিসার মিস্টার পারভেজ আনোয়ার।

সামনে থাকা যুবক বললো,
-“ তো দেরী করছেন কেন স্যার!বলে ফেলুন।আপনার ফোন পেয়ে সাথে সাথে চলে এসেছি আমি।”

যুবকের কথা শুনে চেয়ারে হেলান দিলেন পারভেজ আনোয়ার। তারপর হঠাৎ করেই সামনে এগিয়ে বললেন,

–“ এতো দিনে তোমার মনোবাসনা পূরন হতে যাচ্ছে ইয়ংম্যান।”
–“ পলাশ আঙ্কেলের কাছ থেকে স্বীকারোক্তি পাওয়া গিয়েছে স্যার?উনি কিন্তু কিছু করেননি”
হতচকিত হয়ে বললো যুবক।

–“ হ্যাঁ ইয়ংম্যান!তবে এখনো ও খোলাসা করে কিছু বলেনি। শুধু বলেছে আজ রাতেই সব হাতেনাতে ধরা পড়বে। আমাদের নজর রাখতে বলেছে।আর বলেছে তোমার প্ল্যান অনুযায়ীই আজকে সব কিছু হবে।তা কি প্ল্যান করেছিলে বাছা”?

পারভেজ আনোয়ারের কথা শুনে যুবক দাঁড়িয়ে পড়লো।বললো,
“ স্যার? আমি ওকে বলেছিলাম যা হবে সব কাল।ও লাফিয়ে আজ কেন গেল স্যার!এখন কি করবো আমরা ?কোনো প্রস্তুতি ও তো নেইনি।এখন কি করবো স্যার?ইমিডিয়েটলি ফোর্স রেডি করতে হবে।ওইখানে কোন সময় কি হবে বলা যাবে না।”

পারভেজ মাহতাব মৃদু গলায় বললেন,
–“ এতো উত্তেজিত হইয়ো না আয়ুশ।বসে পড়ো। আমাদের ঠান্ডা মাথায় সব ভাবতে হবে।তার আগে আমাকে খুলে বলো তোমার কি কি প্ল্যান ছিল।ব্যাস্ততার জন্য তো কিছু জানতেই পারিনি।তবে তোমার উপর আমার সম্পূর্ণ বিশ্বাস আছে মাই বয়!

সামনে থাকা যুবক অর্থাৎ আয়ুশ সাথে সাথে চেয়ারে বসে পড়লো।সে তার প্ল্যান বলতে লাগলো।পারভেজ আনোয়ারের গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনতে লাগলেন আয়ুশের কথা। কাঙ্ক্ষিত দিনের আগেই প্ল্যান অনুযায়ী পলাশের কাজ করা কোনো বিপদ বইয়ে আনবে না তো?
____

মিস্টার শামসুজ্জামানের স্ত্রী মিসেস শেহনাজ পারভীনের থেকে টাকা নিতে এসেছে পলাশ।পলাশ ছিল মিস্টার শামসুজ্জামানের অতি পুরনো এক কাজের লোক।

মিস্টার এবং মিসেস শামসুজ্জামানের অতীতে করা এক নিকৃষ্ট কাজের একমাত্র সাক্ষী ছিল পলাশ।ওইসময় পলাশের মুখ বন্ধ রাখতে তাকে পাঁচ লক্ষ টাকা দেওয়া হয় এবং তাকে এই এলাকা থেকে বহুদূরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

আজ ১৮ বছর পর আবার পলাশ ফিরে এসেছে টাকা চাইতে।তার দাবী,তাকে আরো টাকা দিতে হবে।নাহলে তাদের অতীতের ঘৃণ্য কর্মকান্ড সকলের কাছে প্রকাশ করে দিবে।

আয়ুশের বিয়ের দুই দিন পরেই রাতে হঠাৎ পলাশের ফোন থেকে এহেন হুমকি পায় মিসেস শেহনাজ।তার সাথে কথা বলতেই গেস্টরুমে গিয়েছিলেন তিনি।

ওইসময় উনার মেয়ে অনিতা পানি খাওয়ার জন্য ড্রয়িংরুমে এলে কারো গলার আওয়াজ শুনতে পেয়ে ড্রয়িংরুমে এগিয়ে যেতে থাকে। পলাশের সাথে তর্কে লিপ্ত থাকার কারণে তিনি কারো পায়ের আওয়াজ খেয়াল করেননি। কিন্তু ওইদিন ভাগ্যবশত উনার স্বামী অর্থাৎ আয়ুশের বাবা মিস্টার শামসুজ্জামান দেশে ফিরে আসেন
তিনি ওইসময় এসে অনীতাকে সামলিয়ে ফেলেন এবং তার রুমে পাঠিয়ে দেন।

তারপর উনারা দুইজন মিলে প্ল্যান করেন,পলাশকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার কেননা,পলাশই একমাত্র যে তাদের ওই ঘৃণ্য কর্মকান্ডের সাক্ষী ছিল।তাই পলাশের মুখ বন্ধ করা জরুরী।আগে অনেক টাকাই দিয়েছেন আয়ুশকে। কিন্তু এখন আবার টাকা চাচ্ছে পলাশ।তার মানে এরপর আবার ও চাইবে।মিস্টার শামসুজ্জামান এর অঢেল সম্পত্তি থাকলেও অন্যকে দিতে তিনি নারাজ। কিছুদিন পরপর পলাশকে টাকা দিতে পারবেননা তিনি।তাই পলাশকে বাসায় ডেকে তাকে মে’রে ফেলার প্ল্যান করছিলেন দুইজন।

কিন্তু উনারা এটা জানতেন না,পলাশ ছাড়াও অন্য একজন আড়ালে থেকে তাদের করা ঘৃণ্য কর্মকান্ডের সাক্ষী হয়েছিল।আর এখন এই নোংরা ষড়যন্ত্রের প্রত্যক্ষদর্শী হচ্ছে আরেকজন।

ওইসময় অনীতার সাথে মিস্টার শামসুজ্জামানের করা কোমল আচরণ অনীতার কাছে সন্দেহ হয়ে ঠেকে।যে বাবা একটা ছেলের সাথে দেখার পর তার বিয়ের জন্য তড়িঘড়ি করেছিলেন এরপর এমন কি হলো যে ওই বাবা এতো সুন্দর ব্যবহার করলেন ওর সাথে?

অনীতার বিষয়টা খটকা লাগে। ইতিমধ্যেই ওর কাছে আয়ুশের ফোন আসে।আয়ুশ ফোন দিয়ে অনীতাকে বলে,

-“সজাগ আছিস অনী?”
-“ হ্যাঁ ভাইয়া তেষ্টা পেয়েছিল।তাই উঠেছি!”
-“ গলা ভিজিয়েছিস?পানি খেয়েছিস?”
-“ হ্যাঁ ভাইয়া। কিন্তু তুই এতো রাতে ফোন দিলি যে?এনি প্রবলেম?
-“ হ্যাঁ একটা কথা জিজ্ঞেস করতে ফোন দিলাম।”
-“ তো বল।”
-“তোর বাবা এসেছে?”
-“ এটা কেমন কথা ভাইয়া?আমার বাবা কি তোর বাবা না?তুই সবসময় এমন বলিস কেন ভাইয়া?”
-“ বলবো বলবো।একদিন সব বলবো।ওইদিন তুই ও এই মানুষটাকে ঘৃণা করবি অনী!”
-“ এটা কেমন কথা ভাইয়া?”
-“ বাদ দে।যেটা জানার জন্য ফোন করেছি সেটা বল,এসেছে তোর বাবা?”
-“ হ্যাঁ..এসেছে তো!একটু আগেই এসেছে”
-“ বাসায় তুই তোর মা-বাবা,বাসার কাজের ছেলে-মেয়ে ছাড়া আর কেউ আছে?”
-“ তা ঠিক জানি না ভাইয়া।ওরা সবাই আছে দেখছিলাম। কিন্তু গেস্টরুমে একটু আগে কারো আওয়াজ পেয়েছিলাম।বাসায় তো কোনো গেস্ট নেই।আর আমাদের বাসায় তো গেস্ট ছাড়া কারো গেস্টরুমে থাকা এলাউ না।”

-“ তাহলে গিয়ে দেখিসনি কে এসেছে?”
-“ দেখতে গিয়েছিলাম। কিন্তু……….”
-“ কিন্তু কি? কি হয়েছে?বল অনী!”

অনীতা আয়ুশ কে বলতে থাকে সে ড্রয়িংরুমে পানি খেতে যাওয়ার পর কি কি হয়েছিল।ভাইকে খুব বিশ্বাস করে অনীতা। পরিবারের আর কারো সাথে আয়ুশের সম্পর্ক তেমন ভালো না থাকলে আয়ুশ অনীতার সাথে যোগাযোগ রাখে।

অনীতার কথা শুনে আয়ুশ চিন্তায় পড়ে যায়। কিন্তু মুহুর্তের মধ্যেই বুঝতে পারে যে,তার বাবা ভীষণ চতুর।হয়তো উনার ওয়াইফ বা বিশ্বস্ত কোনো লোক কোনো প্ল্যান করছিল গেস্টরুমে।এইরকম অনুমান করে আয়ুশ অনীতাকে গেস্টরুমে উঁকি দিয়ে দেখতে বলে।আরো বলে,

-“ শোন,অতি সাবধানে ওই রুমে উঁকি দিবি।পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকবি।কে বা কারা আছে ভালো করে দেখবি।কি কথা বলে যাও শুনবি।ফোন নিয়ে গিয়ে রেকর্ড করে রাখবি।পরে মনে করে আমায় জানাবি।মনে থাকবে তো?”

-“ হ্যাঁ ভাইয়া মনে থাকবে। এখুনি যাচ্ছি।”
-“ সাবধানে যাবি কিন্তু অনী!”
-“ আচ্ছা ভাইয়া।কিন্তু একটা কথা!”
-“‌হ্যাঁ,বল।
-“ বাবা যদি দেখে ফেলে।”
-“ আমার যতদূর মনে হচ্ছে,উনি তোকে দেখবে না।উনি রুমের ভিতর থাকতে পারে।যেহেতু তোকে উনি পাঠিয়ে দিয়েছে। তবুও যদি দেখে সত্যিটা বলে দিবি।”

আয়ু্শের কথা শুনে আঁতকে উঠে অনীতা।সে বলে,
-“ সত্যিটা বললে বাবা আস্ত রাখবে না যে ভাইয়া।”
-“ আরে বোকা।পুরো সত্যিটা বলবি কেন। শুধু বলবি যে, তোর কেমন লাগছিল।মনে হচ্ছিলো,এইরুমে কেউ আছে।তাই দেখতে এসেছিস।এতটুকু শুনলে সন্দেহ করবে না।”

-“ আচ্ছা ভাইয়া। তাহলে এতটুকুই বলবো।”
-“ সাবধানে যাস অনী।টেক কেয়ার!”
-“ আচ্ছা ভাইয়া।আসছি। আল্লাহ হাফেজ।”
-“ আল্লাহ হাফেজ ”
বলে‌ ফোন রাখে অনীতা।

ভাইয়ের কথা শুনে কিছু একটা রহস্যের গন্ধ পেতে থাকে অনীতা।ভাইয়া এভাবে কেন তাকে কথা শুনতে বলবে! নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে।কারণ ছাড়া তো আয়ুশ কোনো কাজ করে না।হয়তো এটার মধ্যে কিছু আছে।তাই ভাইয়ের কথা শুনে অনীতা গেস্টরুমের দিকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

স্বভাব বিরুদ্ধ হলেও সে পা টিপে টিপে গেস্ট রুমের কাছে আসে।দরজার বাইরে পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে থেকে মা আর বাবার কথালাপ শুনে সে শিউরে উঠে।এতোটা জঘন্য তার বাবা মা!জানা ছিল না তো!

চলবে…………….