#আয়ুর_প্রহর
#পর্ব_১৬
#আয়িশা_নুর_তৃষ্ণা
___
প্রহর প্রেমাকে ইশারায় বসতে বলে আয়ুশের পিছুপিছু সেও বেডরুমের দিকে যেতে লাগলো।প্রহর রুমে ঢুকামাত্রই আয়ুশ পিছু ফিরে প্রহরের মুখোমুখি হয়ে প্রহরের দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো।প্রহর চোখ বন্ধ করে ফেলল..।
আয়ুশ প্রহরের সামনে ঘেঁষে দাঁড়িয়ে দরজা লাগালো।
আয়ুশ দরজা আটকানোর পর বিছানায় গিয়ে বসে প্রহরকে বললো,
-“ চোখ খুলুন ম্যাডাম।আমি এখানে !”
আয়ুশের কথা শুনে প্রহর চোখ খুলে ফেললো।এইভাবে আয়ুশের একটু কাছাকাছি হওয়ায় প্রহর খানিকটা লজ্জা পেল।
কিন্তু লজ্জা সামলিয়ে প্রহর বলে উঠলো,
-“ আপনাকে কতগুলো ফোন দিয়েছি।একটা ফোন ও ধরেননি ”?
প্রহরের গলায় শুনা গেল সামান্য অনুযোগ।
আয়ুশ তখনি ফোন হাতে নিয়ে দেখলো প্রহরের নাম্বার থেকে ১০ টা মিসডকল এসেছে।আয়ু্শ বিনয়ী স্বরে বললো,
-“ স্যরি প্রহর।আমি খেয়াল করিনি।আসলে ফোন সাইলেন্ট করা ছিল।”
প্রহর কিছু বললো না।চুপ করে রইলো।একটু পর নিজ থেকেই বললো,
-“একটা প্রশ্ন করবো?”
প্রহরের কথা শুনে আয়ুশ প্রহরের চোখের দিকে তাকালো।প্রহরের চোখে সে দেখতে পেলো,হাজারো প্রশ্ন। তবুও বললো,
-“ বলো!”
-“ আপনি মূলত কি কাজ করেন?”
প্রহরের প্রশ্ন শুনে আয়ুশ খানিকটা দম নিল।তারপর বলল,
-“ তুমি যেহেতু আমার স্ত্রী,তাই আমার পেশা কি,আমি কি কাজ করি, সবকিছু সম্পর্কে জানার অধিকার তোমার আছে বলে আমি মনে করি। কিন্তু সবকিছুরই একটা সঠিক সময় থাকে।আমি মনে করি,তোমাকে আমার সম্পর্কে সব বলার এখনো সঠিক সময় আসেনি।তাই কিছু মনে করো না প্রহর।আমি তোমাকে সব বলবো। নিশ্চয়ই বলবো।তুমি শুধু একটু অপেক্ষা করো।দেখবে আমারও বলতে হবে না,সময়ই বলে দিবে।ক্লিয়ার?”
প্রহর মাথা নাড়ালো।আয়ুশের প্রশ্ন শুনে আয়ুশের মনোভাব দেখে সে যতোটা টা খুশি হয়েছে, তারচেয়ে বেশি কষ্টও পেয়েছে।আয়ুশ কি এমন কাজ করে যে তা প্রহরকেও বলতে পারবে না!
কিন্তু কারো উপর তো জোর করে অধিকার খাটানো যায় না।তার উপর প্রহরের তো বেশ লজ্জা করে আয়ুশের সাথে এভাবে কথা বলতে।তাই আয়ুশকে অনেক কথা বলার, জিজ্ঞাসা করার থাকলেও সে বলতে পারছে না, জিজ্ঞেস করতে পারছে না।
প্রহরের মুখের অঙ্গভঙ্গি দেখে আয়ুশ কিছু একটা বুঝলো।সে মৃদুস্বরে প্রহরকে ডাক দিয়ে বললো,
-“ প্রহর!”
-“ জ্বি বলুন।”
-“ দাঁড়িয়ে কেন?আমার পাশে এসে বসো!”
প্রহর যেন আয়ুশের এই কথাটার জন্যই অপেক্ষা করছিল।এখন পর্যন্ত সে আয়ু্শের অতোটা কাছে যেতে পারেনি। কিন্তু আয়ুশের পাশে বসেছে অনেকবার।তখন লজ্জা লাগলেও লজ্জার থেকে ভালোলাগা কাজ করে বেশি।
প্রহর আয়ুশের পাশে চুপটি করে বসে পড়লো।আয়ুশ প্রহরের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“ তুমি মনে হয় খুব কম কথা বলো প্রহর তাই না?”
-“ কে বলেছে?”
-“ কে বলবে আর?আমি তো দেখছি তোমাকে। যতদিন দেখেছি,খুব শান্ত।তুমি কি সবসময় এরকম শান্তই থাকো?”
প্রহর মাথা দুলিয়ে না বললো।
আয়ুশ প্রহরের মুখ থেকে কথা বের করার জন্য বললো,
-“ তোমার কথা বলতে ভালো লাগে না?”
-“ এখন লাগে না।”
-“ আগে ভালো লাগতো।”
-“ হ্যাঁ খুব ভালো লাগতো।”
-“ এখন ভালো লাগে না কেন?”
প্রহর কিছু বললো না।
-“ বিয়ে হয়েছে,বড় হয়ে গিয়েছো এইজন্য ভালো লাগে না?”
-“ না,এর কত আগে আগে থেকেই আমি তেমন কথা বলি না।”
-“ কেন বলো না।”
-“ কথা বলা ছেঁড়ে দিয়েছি।”
-“ কেন কথা বলা ছেঁড়ে দিয়েছো?আমায় বলা যাবে?”
প্রহর আড়ষ্ট গলায় বললো,
-“ না মানে…”
-“ কি?”
-“ বলছি,একটু দাঁড়ান”
-“ দাঁড়াবো?”
-“ এই না না,এটাতো কথার কথা বললাম। আচ্ছা,এখনি বলছি।শুনুন তবে”
প্রহর চুপিচুপি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলতে শুরু করলো,
“ কোনো এক কারণে খুব অল্প বয়সেই আমাকে পড়াশোনার জন্য হোস্টেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।আমি সবসময় ক্লাসের টপার ছিলাম।কেউ আমাকে টপকে যেতে পারতো না।এই নিয়ে আমার কোনো অহংকার ছিল না।আমি ঠিকমতো পড়েছি,তাই পেরেছি। কিন্তু আমার সাথে যারা পড়তো,তারা আমাকে কেমন সহ্য করতে পারতো না।ঠিক সহ্য নয়,এটাকে বলা যায় হিংসা।
ওদের সাথে কোনো কথা বলতে না বলতেই ওরা তিলকে তাল বানিয়ে ফেলতো।আমার নামে অপবাদ রটানোর জন্য খুব চেষ্টা করেও কখনো পেরে উঠেনি।তাই আমার সাথে সবসময় খুব খারাপ ব্যাবহার করতো, একমাত্র পরীক্ষার সময় ছাড়া।
পরীক্ষার সময় আমি তাদের খুব প্রিয় হয়ে যেতাম। পরীক্ষার হলে তারা একবার ডাক দিলেই আমি মাথা ঘুরিয়ে তাকাতাম।নিজে না লিখে তাদের বলে দিতাম এই ভেবে যে,হয়তো এই পরীক্ষায় বলে দেওয়ার পর তারা আমার সাথে খুব ভালো ব্যবহার করবে।
কিন্তু না,যখনি পরীক্ষা শেষ হতো,ওরা বলতো আমি নাকি কাউকে কিছু বলে দেইনি।
এসব শুনে আমার প্রচন্ড মন খারাপ হতো। তবুও ওরা কিছু জিজ্ঞেস করলে উত্তর দিতাম।আমার কিছু পার্সোনাল সমস্যা ওদের সাথে শেয়ার করলে ওরা ওটা নিয়েও কটু’ক্তি করতো।কোনো দুষ্টুমি করলেও তাতে হাজার ভুল ধরতে পিছপা হতো না কেউ।
কোনো দুঃখের কথা শেয়ার করলে তারা আমায় স্বান্তনা দিবে কি কথার জালে পিষে ফেলে দিতো আমায়।আস্তে আস্তে আমি বুঝতে পারি,ওদের থেকে আমার দুরে থাকতে হবে।
কিন্তু দূরে থাকবো কিভাবে! চব্বিশ ঘন্টা যাদের সাথে হোস্টেলে থাকছি, তাদের এড়িয়ে যাওয়া অতোটাও সহজ ছিল না আমার জন্য।
তাই না এড়িয়ে কথা বলা কমিয়ে দিলাম। কিন্তু কথা না বলে আর কতদিন!
মাঝেমধ্যে দুই-তিন মাসে কয়েকদিনের জন্য বাড়িতে যেতাম। বাড়িতে গেলে ভাইয়া আর প্রেমার সাথে খুনসুটি করে অনেক কথা বলতাম।কিন্তু ভাইয়া আর প্রেমার সাথে এতো খুনসুটি মা সহ্য করতে পারতেন না।
আমি কথা বললে বলতেন— সারাক্ষণ এতো কথা কিভাবে বলতে পারিস তুই?তোর জবান আটকে যেতে পারে না?
এসব সহ আরো নানান কথা শুনতে শুনতে ভাইয়া আর প্রেমার সাথে প্রকাশ্যে কথা বলাও বন্ধ হয়ে যায়।আগে যা ও হোস্টেল থেকে ২-৩ মাসে আসতাম। কিন্তু এরপরের দিনগুলোতে স্কুল বন্ধ থাকলেও আমি বাবাকে বলে ওম্যান হোস্টেলে থেকে যেতাম।সবাই যেখানে বাসায় যেয়ে যেয়ে মায়ের হাতের মজার মজার রান্না খেতো, সেই জায়গায় আমি ওম্যান হোস্টেলে বড় বড় ডিভোর্সী,রাগী মহিলাদের সাথে একই রুমে থেকে বইয়ের মধ্যে মুখ গুঁজে বসে থাকতাম।
বাসায় বছরে একবার আসতাম।তখনি ভাইয়া আর প্রেমার সাথে কথা হতো।
বহুদিন পর পর বাসায় আসতাম বিধায় আস্তে আস্তে ভাইয়া আর প্রেমার সাথে কথা বলাও কমে যায়।
বাসায় বকা খেয়ে,মায়ের থেকে পাওয়া দুঃখ ভুলতে নিজের মনকে হাসিখুশি রাখতে হোস্টেলে দুষ্টুমি করতাম, কিন্তু মনকে খুশি করতে গিয়ে মনকে দুঃখ দিয়ে ফেলেছিলাম বেশি।আমার হাসিখুশি মুখের চেয়ে দুঃখী মুখই সবার কাছে অধিক পছন্দনীয় ছিল।তাই সবার সাথে কথা বলা কমিয়ে দিয়েছি।”
এতটুকু বলেই প্রহর মাথা নিচু করে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো।তার চোখে থেকে একফোঁটা পানি গড়িয়ে তার হাতে পড়লো।
আয়ুশ প্রহরের হাতে হাত রাখলো।প্রহরের চোখ থেকে পড়া গরম অশ্রু প্রহরের হাত থেকে মুছে দিলো।নরম গলায় বললো,
“ কাঁদছো কেন মেয়ে?কারো আচরণে কখনো কাঁদবে না।ওরা কখনোই তোমার আপন কেউ ছিল না।ওদের জন্য কখনোই কাঁদবে না।কাঁদবে নিজের আনন্দের জন্য,নিজের আর নিজের কাছের মানুষদের সফলতার জন্য।বুঝেছো?”
প্রহর মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বললো।
আয়ুশ আবার বললো,
“আজ কেঁদেছো না!মনে রেখো—এটাই তোমার শেষ কান্না।এরপর থেকে আর কোনোদিন আমি তোমার চোখে একফোঁটা পানি আসতে দিবো না।একদম দিবো না।আই প্রমিজ প্রহর।এরপর যতো কান্না হবে সব আনন্দের সুখের।আমি থাকতে দুঃখ তোমাকে আর কখনো ছুঁতে পারবে না প্রহর!”
বলে আয়ুশ প্রহরের এক হাত নিয়ে নিজের বুকের উপর রেখে বললো,
-“ দেখো প্রহর!আমার ভিতর থেকে কেমন আওয়াজ আসছে।আমার শপথ কতটা দৃঢ় আমার হৃদয় তা সাক্ষী দিচ্ছে।অনুভব করো প্রহর!”
প্রহর চোখ বন্ধ করে আয়ুশের হৃদস্পন্দন অনুভব করতে লাগলো।একজন স্বচ্ছ হৃদয়ের মানুষের—হৃদস্পন্দন।তাকে ঘিরে তার খুব কাছের একজন মানুষের— হৃদয়ের স্পন্দন।তার জীবনে হঠাৎ আসা খুব প্রিয় একজন মানুষের— হৃদয়ের স্পন্দন!
একটু পর প্রহর চোখ খুলল।নিজেই আয়ুশের বুক থেকে নিজের হাত নামিয়ে নিল। লজ্জা পেয়েছে সে!
আয়ুশ এবারের প্রহরের দুই গালে নিজের দুই হাত রাখলো।এক ফোঁটা জল প্রহরের গন্ডাদেশ বেয়ে পড়ার পর আরেক ফোঁটা জল চোখের কোণে এসে জমে গিয়েছিল।আয়ুশ আলতো করে প্রহরের চোখের কোণের জল মুছে দিল।তারপর বললো,
-“ একটু হাসবে প্রহর”?!
প্রহর মুচকি হাসলো।
আয়ুশ প্রহরের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো।তারপর বললো,
-“ তোমার এই হাসিখুশি মুখ আমাকে কতোটা তৃপ্তি দিচ্ছে আমি কখনোই তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না।কেন এমন তৃপ্তি পাচ্ছি তাও অজানা।আমি শুধু জানি,তোমার এমন হাসিমাখা মুখ দেখতে আমার খুব ভালো লাগছে।”
এবার প্রহর লাজুক হাসলো।
আয়ুশ প্রহরের গাল থেকে হাত সরিয়ে একহাত দিয়ে প্রহরের থুতনি উঠিয়ে বললো,
-“ এখনই এমন লজ্জা পেলে হবে?এখন থেকে আমার সাথে অনেক অনেক কথা বলবে।কেমন!পারবে না?”
প্রহর হ্যাঁসুচক মাথা নাড়ালো।
প্রহরকে এমন কথা বলে আয়ুশ নিজেই অবাক হয়ে গেল।
ছোটবেলায় যা কথা বলতো সব মায়ের সাথে।মা চলে যাওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত সে কারো সাথে এভাবে এমনকরে কথা বলেনি,যেভাবে প্রহরের সাথে কথা বলছে।কখনো কারো সাথে বেশি কথা বলতে ইচ্ছে হয়নি তার।বেশি কথা বলা বরাবরই অপছন্দীয় ছিল তার।সবসময় গম্ভীর থেকেছে সে।
কিন্তু এমন কি হলো,সে প্রহরের মুখ থেকে কথা শুনতে চাচ্ছে।তার মুখ থেকে কথা বের করার জন্য নিজেও চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছে।
কাজ ব্যাতীত কখনোই কারোর ব্যাক্তিগত বিষয় সম্পর্কিত কোনো কথা শুনতে আয়ুশের আগ্রহ জন্মায়নি। কিন্তু বেশ আশ্চর্যজনক ভাবে প্রহরের ব্যাক্তিগত জীবন,পূর্ব দূঃখী জীবনের সম্পর্কে জানতে আয়ুশের বেশ আগ্রহ।কেন এমন আগ্রহ তার।আর শুধুমাত্র প্রহরের ক্ষেত্রেই এমন কেন!
এই মেয়েটা কি জাদু করেছে তাকে যে,তার কথা শুনলে আয়ুশের অন্তর জুড়িয়ে যায়।কি এমন রয়েছে এই মেয়ের মধ্যে যা আয়ুশকে বারবার প্রহরের কাছে টেনে আনে!কি এমন হয়েছে তার যে সে চাইলেও প্রহরের সাথে রাগ দেখিয়ে একফোঁটা কথা বলতে পারে না!
কি এমন রয়েছে এই মেয়ের কথায়,যে তার মুখ থেকে কথা না শুনতে পারলে আয়ুশের একরত্তি ভালো লাগে না!
আচ্ছা! এরই নাম কি ভালোবাসা?
আয়ুশ আর ভাবতে পারে না।সে প্রহরকে নিজের কাছে আরেকটু টেনে নেয়।তারপর জিজ্ঞেস করে,
-“ ভালোবাসো আমায়?”
আয়ুশের আকস্মিক প্রশ্নে প্রহরের শ্যামরঙা মুখ লাজে লাল হয়ে যায়।ভারী লজ্জা পেয়েছে সে।
আয়ুশ প্রহরের কনুইয়ে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলে,
-“ কি হলো বলো? ভালোবাসো আমায়?”
-“ মমমমমমমমমমম”
-“ মমমম কি প্রহর! বলো না আমায় ভালোবাসো কি না!”
প্রহর কিছু বলতে পারে না।তার মুখ দিয়ে ঠোট ফুটে কিছু বের হতে চায় না।আয়ুশের কথায় এতো লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে বসে আছে সে!
হঠাৎই সে বলে উঠে,
“ প্রেমা না খেয়ে আছে।আমার সাথে একসাথে খাবে।আপনি তো এখন খাবেন না।আমি ওকে খাবার দিয়ে আসি।হুম?”
আয়ুশ প্রহরকে যেতে দিলো না।তার হাত ধরে রাখলো।ফের জিজ্ঞেস করলো,
-“ আগে ভালোবাসো কি না তা বলো মেয়ে ?তারপর না হয় যেও!”
-“ কি বলবো?”
-“ ভালোবাসো কি না আমায়?”
-“ উমমমমম…….
এইবার প্রহর আয়ুশকে কিছু বলতে যাবে,তখনি দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হলো।প্রেমা প্রহরকে ডাকছে,
-“ এই প্রহু, তাড়াতাড়ি আয়।খিদে পেয়েছে। তাড়াতাড়ি আয় প্রহুুউউউউউউ”
প্রেমার এমন ডাকাডাকিতে প্রহর যেন খানিকটা স্বস্তি পেল।ঠিক সময়ে এসেছে প্রেমা।নয়তো এতক্ষণে লজ্জায় মরে যেতো সে।মনে মনে প্রেমাকে ধন্যবাদ জানালো সে।
কিন্তু মনে মনে ধন্যবাদ জানালেও মুখে কিঞ্চিত রাগ মিশিয়ে আয়ুশকে বললো,
-“ দেখেছেন কেমন করে ডাকছে।এটা কি নিজের বাড়ি নাকি?”
আয়ুশ হাত উপরে তুলে হাত মুচড়াতে মুচড়াতে বললো,
-“ নিজের বাড়ি না হোক বোনের বাড়ি তো।”
-“ আচ্ছা,তাহলে আমি যাই।খাবার দিয়ে আসি।”
-“ আচ্ছা,যাও।”আফসোসের স্বরে বললো আয়ুশ।
প্রহর দরজা খুলে প্রেমার সাথে ডাইনিংয়ে চলে গেল।আয়ুশ প্রহরের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো।
বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,“ এমন সময়ে কেন এলে শালিকা”!
গল্প সম্পর্কিত আলোচনা করতে জয়েন হয়ে যান আমার ছোট্ট গ্রুপ তৃষ্ণাতুশের গল্পনীড়— তুশিয়ানস এ!
চলবে……..
#আয়ুর_প্রহর
#পর্ব_১৭
#আয়িশা_নুর_তৃষ্ণা
__
রোদ্রৌজ্জল দুপুর।আয়ুশ আর প্রণয় ঘুম থেকে উঠে পড়েছে।দু’জন গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিয়েছে।
ওরা ঘুম থেকে উঠে পড়েছে দেখে প্রহর তাদের দু’জনের জন্য খাবার বাড়তে লাগলো।
আজকে প্রহর রেঁধেছে ভাত,শুকনো মরিচ আর পেঁয়াজ হালকা ভেজে আলুভর্তা,ডালভর্তা,মরিচভর্তা,ঘন ডাল আর পেঁয়াজ দিয়ে ডিমভুনা।
প্রহর ডাইনিংয়ে খাবার পরিবেশন করতে লাগলো। ততক্ষণে আয়ুশ আর প্রণয় চেয়ারে এসে বসেছে।প্রহর আয়ুশ আর প্রণয়ের সামনে প্লেট রাখতেই আয়ুশ প্রহরকে জিজ্ঞেস করলো,
-“ তুমি খেয়েছো?”
প্রহর মাথা নিচু করে বললো,“ না!”
-“ খাওনি কেন?”
-“ আপনি আর ভাইয়া খাবার খাননি তো ,তাই আমার ও আর খেতে ইচ্ছে করেনি।”
উড়নায় আঙুল প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে বললো প্রহর।
-“ এমন বললে হবে?এখনই বসে পড়ো আমাদের সাথে।খেয়ে নাও জলদি।”
-“ আপনারা খেয়ে নিন,আমি না হয় পরে…..”
-“ বেশি কথা আর একটাও নয় প্রহর,এখনি খাবে তুমি।কথা না বলে বসে পড়ো।”
প্রহর খেতে বসে পড়লো।প্রণয় তাকিয়ে তাকিয়ে তাদের কথালাপ দেখলো।বোনের প্রতি বোনের স্বামীর সুন্দর ব্যবহার দেখে সে মুচকি হাসলো।
পরক্ষণেই তার মন বিষাদে ছেয়ে গেল।সেও তো চাইলেই পারতো এমন একটা মুহুর্তে আয়ুশের জায়গায় নিজেকে দেখতে। কিন্তু….অনীতার কী হয়েছে?সে প্রণয়ের সাথে এমন ব্যাবহার করছে কেন?সে কি কখনোই প্রণয়কে তার অধিকার দিবে না?
তখনি প্রহরের ডাকে প্রণয়ের ভাবনা হারালো।প্রহর জিজ্ঞেস করলো,
-“ খাচ্ছো না কেন ভাইয়া?”
প্রণয় ইতস্ততবোধ করে বললো,
-“ কোথায়?এই তো খাচ্ছি।”
-“ উঁহু, তখন থেকে দেখছি,ভাত মেখেই চলেছো। কিন্তু মুখে তুলছো না! রান্না খারাপ হয়েছে নাকি ভাইয়া?”
-“ না বনুই।তেমন কিছুই নয়।রান্না বেশ সুস্বাদু হয়েছে। খাচ্ছি তো আমি।এই দেখ,খাচ্ছি।” বলেই এক লোকমা ভাত মুখে পুরলো প্রণয়।
প্রহর মুচকি হেসে খাবার খাওয়ায় মনোযোগ দিল।
ভাই-বোনের এমন সম্পর্ক দেখে আয়ুশের অনীতার কথা মনে পড়লো। চুপিচুপি একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে সেও খাওয়ায় মনোযোগ দিল।
রান্না সত্যিই দারুন হয়েছে।
__
বিকেলে..
দুপুরের খাবারের পর প্রণয় আর আয়ুশ গোসল করে মসজিদে নামাজ পড়তে গিয়েছিল।এসে আরেকটু বিশ্রাম নিতে নিতে আসরের আযান হয়ে যায়।ওরা আসরের নামাজ পড়ে আবার বাড়িতে চলে আসে।তারপর আয়ুশ কোনো একটা কাজে চলে গিয়েছে।আর প্রণয় বিছানায় শুয়ে শুয়ে ফোন ঘাটছে।বাইরে হাঁটতে ইচ্ছে করছে তার, কিন্তু যেতে ইচ্ছে করছে না।
এইদিকে প্রেমা বসে বসে তার ফ্রেন্ডদের সাথে তার স্কুলের বিদায় অনুষ্ঠান সম্পর্কে কথা বলছে।
প্রেমা আর প্রণয় দু’জন দু’জনের রুমে ব্যাস্ত।প্রহর আর কী করবে।সে ঠিক করলো,এখন গিয়ে রুম গোছাবে।
প্রহর রুমে গোছাতে লাগলো।রুম গুছানোর পর সে একটা সেলফ গুছাতে গেল।সেলফে আয়ুশের জামাকাপড় রাখা ছিল।সেখান থেকে আয়ুশের একটা শার্ট উঠিয়ে তা ভাঁজ করতে গিয়ে প্রহর অনুভব করলো,শার্টটার মধ্যে কিছু একটা আছে।প্রহর পুরো শার্ট খুললো।শার্ট মেলাতেই তার মধ্য থেকে একটা কাগজ নিচে পড়লো।প্রহর কাগজ তুলে দেখতে লাগলো।তার চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেল।এ কী দেখছে সে..!
দেখার পর সাথে সাথেই কাগজটা শার্টের মধ্যে গুঁজে রেখে দিলো।আগে ঠিক যেমন ছিল,তেমন করে।
__
রাতে আয়ুশ বাড়ি ফিরলো।সাথে কিছু বাজার নিয়ে এলো।প্রহর রাতের জন্য পোলাও,মুরগীর মাংস আর মাছভাজা রান্না করলো।সাথে টমেটো,পেঁয়াজ,কাঁচামরিচ আর শসা দিয়ে মজাদার সালাদ বানিয়ে রাখলো।
রাতের খাবার শেষ করে সবাই ঘুমোতে গেলো।রুমে ঢুকে প্রহর দেখলো আয়ুশকে বেশ অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে।তাই সে আয়ুশের পাশে গিয়ে বসে আয়ুশকে বললো,
-“ কিছু হয়েছে?”
আয়ুশ মাথা নিচু করে বসেছিল।প্রহরের কথায় সে প্রত্যুত্তর করলো,
-“ তেমন কিছু না।একটা কথা ভাবছি।”
-“ কী কথা,আমাকে বলা যাবে?” প্রহর বেশ আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলো।
আয়ুশ বললো,
“ অবশ্যই।তোমাকেই তো জিজ্ঞেস করবো ভাবছি।”
প্রহর খানিকটা চমকালো।সে যে ওই কাগজটা দেখে ফেলেছে,তা কী আয়ুশ জেনে ফেললো নাকি।সে তো তেমন কোনো আচরণ করেনি আয়ুশের সাথে। রুমে আসার আগে আয়ুশের থেকে দূরে থেকেছে আর তার সাথে আগের চেয়ে একটু কম কথা বলেছে।এতটুকুই!তবে কি হলো,আয়ুশ বুঝে ফেললো না তো!
তবুও প্রহর নিজেকে ধাতস্থ করে বললো,
-“ হ্যাঁ বলুন।”
-“ ভয় পেয়ো না খুব সহজ প্রশ্ন।”
-“ ভয় পাচ্ছি না তো।”
আয়ুশ সামান্য হাসলো।তারপর জিজ্ঞেস করলো,
-“ আজকে আমাদের ফ্ল্যাটে কেউ এসেছিল কিংবা আমাদের রুমে?”
-“ না তো। কেউই আসেনি।”
-“ দুপুরের পর প্রেমা বা প্রণয় আমাদের রুমে এসেছিল?”
প্রহর একটু ভেবে বললো,
-“ না তো।কেউই আসেনি।তারা তাদের রুমেই ছিল সারাদিন।”
-“ আড্ডা দাওনি ?”
-“ বিকেলের পর একটু আড্ডা দিয়েছিলাম।ড্রয়িংরুম বাদে আর কোথাও আড্ডা দেইনি আমরা।”
-“ ও আচ্ছা,তবে ঠিক আছে।” বলেই আয়ুশ ঈষৎ হাসলো।সে যা আন্দাজ করেছে তাই।তবে এতে কোনো সমস্যা নেই বলেই মনে করলো সে।
__
পরদিন সারাদিন ভালোই কাটলো।প্রণয়ের এক জায়গায় কাজ ছিল।সেখানে সে গিয়েছে।আয়ুশের আজ নাকি আবার কি জরুরী কাজ আছে।সে ও বাড়িতে নেই আজ।প্রেমা আর প্রহর সারাদিন গল্পগুজব আর রান্নায় কাটিয়েছে।বাড়িওয়ালার মেয়ে মিষ্টি আজ তাদের সাথে পরিচিত হতে এসেছিল।প্রেমা আর প্রহর যে পরিমাণ মিশুক মেয়ে, মিষ্টির সাথে ভাব জমাতে তাদের আর বেশি সময় লাগেনি।
সবাই সন্ধ্যা পর্যন্ত আড্ডা দিল।এশার পর প্রহর আর প্রেমা নামাজ পড়ার একটু পরই প্রণয় বাড়িতে আসলো।আজকে বাড়িতে গিয়েছিলো সে।
এসে ফ্রেশ হয়ে প্রেমার সাথে কথা বলতে এলো প্রণয়।প্রহর আর প্রেমা একসাথে আড্ডা দিচ্ছিলো দেখে প্রণয় বললো,
-“ ভালোই হয়েছে তোরা একসাথে আছিস।”
প্রেমা জিজ্ঞেস করলো,
-“ কিছু বলবে নাকি ভাইয়া?তোমাকে খুব আপসেট দেখাচ্ছে।”
-“ হ্যাঁ রে।বলতেই তো এলাম।আজকে বাড়িতে গিয়েছিলাম।”
-“ তো কী হয়েছে?বাড়িতে যাওয়ার পর তোমায় মে’রেছে না কী কিছু করেছে?বকেছে তোমায়?কি বলে বকেছে?বাসায় তোমার জায়গা হবে না বলেছে?আমাকে নিয়ে কিছু বলেছে?মা কি…. ”
প্রেমার কথা শেষ না হতেই প্রণয় নিজের দু হাত দু কনাএ চেপে প্রহরকে বললো,
-“ একে থামা তো বনুই।এসেছি কথা বলতে।কথা না শুনেই কান ঝালাপালা করে দিল।”
প্রহর প্রেমার কনুইয়ে খোঁচা দিয়ে মুখে আঙুল দিয়ে প্রেমাকে চুপ করে থাকতে বললো,
-“ এখন শোন।”
প্রেমা বললো,“ বলো।”
-“ তুই চুপ থাকবি?” চোখ গরম করে বললো প্রণয়।
প্রণয়ের চোখ গরম দেখে প্রেমা নিজের ঠোঁটে আঙুল দিয়ে মাথা নাড়িয়ে আচ্ছা আচ্ছা বলতে থাকলো।প্রণয় কথা বলা শুরু করলো,
-“ মা বাসায় যাওয়ার জন্য ফোন দিয়েছিল।তাই বাসায় গিয়েছিলাম।যাওয়ার পরই মা বলতে লাগলো,প্রেমাকে নিয়ে বাসায় যেতে। কিন্তু প্রেমা তো আগেই বলে দিয়েছে,তাকে যেন বাসায় যাওয়ার জন্য না বলি।বাসায় যাওয়ার ইচ্ছে হলে সে নিজেই আমায় বাসায় নিয়ে যাওয়ার কথা বলবে।এই কথাই মাকে বলেছিলাম।তারপর..”
প্রহর বললো,“ তারপর..”
প্রণয় হাত দিয়ে নিজের মুখ ঘষে প্রেমার দিকে তাকিয়ে বললো,
“ মা বললো,প্রেমার নিজের ইচ্ছায় আর কিছু চলবে না।প্রেমাকে এখানে থাকতে দিতে অনেক আপত্তি করেছিল মা।অনেক বুঝিয়েছি।তাই ওর এখানে থাকার এতো আবদার মা ফেলে দিতে পারেনি।বলেছেন প্রেমা আর কতদিন এখানে থাকবে এখানে আসার পর ফোন দিয়ে বলে দিতে ।”
প্রেমা বললো, “ এক মাসের কমে আমি যাবো না ভাইয়া।আমি আরও এক মাস থাকবো।এখনি বলে দাও।”
“আচ্ছা,এখনি কল করে বলে দিচ্ছি” বলেই প্রণয় তার মা সাবিনা বেগমকে ফোন দিলো। অনেকক্ষণ কথা বলে কথা বলা শেষ করে প্রেমার উদ্দেশ্য বললো,
মা বলেছেন,গুণে গুণে আর দশ-বারোদিন থাকতে পারবি।এরপর তোকে বাসায় চলে যেতে হবে।”
প্রণয়ের কথা শুনে প্রেমা মুখ গোমড়া করে বললো,
-“ আমি তো ভেবেছিলাম,প্রহুর কাছে পাক্কা একমাস থাকবো। সেখানে এখন মাত্র ১০-১২ দিন।”
প্রহর প্রেমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,
-“ মন খারাপ করিস না প্রেমা। আল্লাহ চাইলে আবার আসতে পারবি।মা যে এখন থাকতে দিয়েছে এইটাই অনেক।”
প্রেমা মাথা নাড়িয়ে প্রহরকে জড়িয়ে ধরলো।
তখনি কলিংবেল বেজে উঠলো।প্রেমা প্রহরকে ছেড়ে দিলে প্রহর দরজা খোলার জন্য উঠলো,আয়ুশ এসেছে হয়তো।
প্রহর উঠার পর প্রেমা ফিসফিসিয়ে প্রণয়কে জিজ্ঞেস করলো,
–“ মা এমন কেন করে ভাইয়া?”
প্রণয় মলিন মুখে বললো,“ মা বলে,এখানে বনুইয়ের কাছে থাকলে তুই নাকি অনিরাপদ থাকবি।তাই এমন…!
-“ মা কবে বুঝবে!”
বলেই দুই ভাই-বোন দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
__
রাত ১২:০০ টা।
আয়ুশ কোথাও যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে।প্রহর ও ঘুম থেকে সজাগ হয়ে গিয়েছে।প্রহরকে হঠাৎ ঘুম থেকে উঠতে দেখে আয়ুশ ও অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো।
প্রহর শোয়া অবস্থায়ই আয়ুশ কে জিজ্ঞেস করলো,
-“ কোথায় যাচ্ছেন এতো রাতে?”
-“ একটা কাজ আছে।”
প্রহর উঠে বসলো।আয়ুশের কাছে গিয়ে বললো,
-“ কি এমন কাজ যার জন্য আপনাকে যখন তখন বাইরে যেতে হয়।”
আয়ুশ প্রহরের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“ আশা করছি,তুমি তা জানো।”
-“ কিন্তু আজ কোথাও যাবেন না প্লিজ।”
-“ আমাকে যেতে হবে প্রহর।”
প্রহর বিছানা থেকে নেমে আয়ুশের হাত ধরে আয়ুশকে এনে বিছানায় বসালো।তারপর নিজে ফ্লোরে বসে আয়ু্শের হাঁটুর উপর আয়ুশের দু’ হাতের ভাঁজে নিজের হাত রাখলো।তার চোখ ছলছল করছে।ছলছল চোখেই আয়ুশকে জিজ্ঞেস করলো,
-“ একটা কথা বলি?”
-“ বলো?”
-“ আয়ু ছাড়া মানুষ বাঁচে?”
চলবে…