আয়ুর প্রহর পর্ব-২০+২১

0
876

#আয়ুর_প্রহর
#পর্ব_২০
#আয়িশা_নুর_তৃষ্ণা
___
বিকট শব্দে গু’লি করার আওয়াজ হলো। মিস্টার শামসুজ্জামানের হাত থেকে বন্দু’ক ছিটকে নিচে পড়ে গেল।আয়ুশ বন্দুক তার কাছে নিয়ে এলো।
তৎক্ষণাৎ কয়েকজন অফিসার বাড়িতে ঢুকে পড়লেন। শামসুজ্জামানের কাছে গিয়ে তাকে ধরে ফেললেন তারা।

এইদিকে শেহনাজ পারভীন হতচকিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।এতোকিছু একসাথে ঘটে যাবে,তিনি তা কল্পনাও করতে পারেননি। আশ্চর্য হয়ে গিয়েছেন।সবচেয়ে বেশি আশ্চর্য হয়েছেন যা দেখে, শামসুজ্জামানকে লক্ষ্য করে আর কেউ নয়,তারই মেয়ে অনীতা শুট করেছে।

মিস্টার শামসুজ্জামানকে নিচে আনা হলো।তারপর একজন অফিসার শামসুজ্জামানকে হ্যান্ডকাফ পড়িয়ে বললেন,
-“ ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট!”
তারপর শেহনাজের হাত থেকে সোফার কভার খুলে তার হাতেও হ্যান্ডকাফ পড়িয়ে দিয়ে বললেন,
-“ আপনিও!”

শেহনাজ আর শামসুজ্জামান একসাথে বলে উঠলো,
-“ আমাদের অপরাধ?”
তাদের কথা শুনে এক অফিসার তাদের উদ্দেশ্য করে বললেন,
-“ বাকী যা কথা হবে সব থানায়।এখন আপনারা আমাদের সাথে চলুন।”
ততক্ষণে অনীতা ও তার রুম থেকে বেরিয়ে এসেছে।সে আসলে আয়ুশ তাকে জিজ্ঞেস করলো,
-“ বাসায় একা থাকতে পারবি অনী,নাকি থানায় যাবি আমাদের সাথে?”
-“ না ভাইয়া!তোরা যা।আজকে এমনিতেই যা ধকল গিয়েছে,তাই আর যাবো না। তাছাড়া এসব মানুষদের পরিণতি দেখতেও আমার আর ইচ্ছে হচ্ছে না। তোরা যা।”

শেষ কথাটা বাবা-মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো অনীতা।মায়ের বলা সব কথা তার রুমের দরজার আড়াল থেকেই শুনেছে সে‌।মা-বাবার পূর্ব ষড়যন্ত্র সবই জানে অনীতা। কিন্তু তার মা তার নিয়ে এতোটা নোংরা কথা বলবে আর তার বাবা নিজের ঔরসজাত ছেলের দিকে বন্দুক তাক করবে এতদূর ভাবতে পারেনি অনীতা।

অনীতা নিজেও ক্রাইম ডিপার্টমেন্টে কাজ করতে আগ্রহী।তাই আগে থেকেই অস্ত্র সঠিকভাবে পরিচালনার ট্রেনিং দিয়ে রেখেছে সে।তার লাইসেন্স কৃত পিস্তল ও আছে।আয়ুশের সাথে দু’বার ডিপার্টমেন্টেও গিয়েছিলো সে।আয়ুশ আগে থেকেই অনীতাকে আজকে রাতের বিষয়ে জানিয়ে রেখেছিল।আর বলেছিল,সে যেন তার দরজার আড়াল থেকে সব লক্ষ্য করে,আর কোনো বিপদ হলে যেন নিজের বুদ্ধি খাটিয়ে কাজ করে।অনীতা তাই করেছে।নিজের বাবার উপর থেকে বিশ্বাস উবে গিয়েছে তার। কিন্তু চাইলেই তো মে’রে ফেলতে পারবে না।খাপে খাপে নিশানা ঠিক রেখে ঠিক বাবার হাতে শ্যুট করেছে অনীতা।

অনীতার কথা শুনে আয়ুশ বললো,
-“ আচ্ছা,তবে থাক।আর পলাশ চাচা…..
মাথা পিছু ঘুরিয়ে পলাশ চাচাকে কিছু বলতে যাবে আয়ুশ,তখনি দেখে পলাশ চাচা সেখানে নেই। হতচকিত গলায় আয়ুশ বলে,
“ পলাশ‌ চাচা…পলাশ চাচা কোথায় গেল?একটু আগে তো এইখানেই ছিল ।”
আয়ুশের কথা শুনে সবার খেয়াল হলো, সত্যিই তো পলাশ কোথাও নেই।
আয়ুশ বললো,“আমি বাইরে থেকে দেখে আসছি।আপনারা সবাই এই দুইজনকে নিয়ে থানায় চলে যান।”বলেই আয়ুশ বাসা থেকে বের হতে লাগলো।

তখনি এক অফিসার খেয়াল করলেন সোফায় কিছু একটা রাখা।তিনি বলেন উঠলেন,
-—“ স্যার,সোফায় কিছু একটা রাখা আছে।একটা ফোন আরেকটা কাগজ।”

অফিসারের কথা শুনে আয়ুশ দাঁড়িয়ে পড়লো। তড়িৎ গতিতে এসে দেখলো,সোফায় একটা ফোন আরেকটা কাগজ রাখা।সে কাগজ খুলে তার মধ্যকার লিখা পড়তে লাগলো।তাতে ভাঙা ভাঙা অক্ষরে লিখা আছে,

“ স্নেহের আয়ুশ।আমি জানি,যখন তুমি এ চিরকুটটি পড়বে,তখন আমি তোমার কাছাকাছি থাকবো না।এটা এইজন্য জানি,কেননা,আমি চলে যাওয়ার আগ মুহূর্ত ছাড়া এ চিরকুট তোমাকে কখনোই লিখতাম না।
সে যাই হোক,মূল কথায় আসি।
আমি চলে যাচ্ছি।আর কখনো দেখা হবে না আমাদের।আমাকে আর ভুলেও খোঁজার চেষ্টা করো না আয়ুশ।আমি অনেক দূরে চলে যাবো।
এতোদিন মনের মধ্যে যে পাপ পুষে রেখেছিলাম,আহানা আমার হত্যা’কারীদের ধরিয়ে দিতে পেরে সে কষ্ট অনেকটাই লাঘব হবে আমার।
আমি জানি, আমি এই কাজটি পারবো।তাই আগেই লিখে রাখলাম।
আর এই ফোনটার ভিডিও রেকর্ডারে শেহনাজের বলা সব কথা রেকর্ড করা হয়েছে।এ প্রমাণাদি তোমাদের অনেক সাহায্য করবে।

তোমাদের সাহায্য করতে পেরে নিজের পাপের প্রায়শ্চিত্ত হয়ে গিয়েছে আমার,তাই মনে করছি। কিন্তু আমিও তো আহানা আপার হ’ত্যাকে আত্মহত্যা বলে স্বীকারোক্তি দিয়েছিলাম।তার জন্য আমার ও শাস্তি হতে পারে। কিন্তু আমি এ বয়সে জেলে বন্দী হতে চাইনা।তাই আমাকে খুঁজো না আয়ুশ বাবা।চলি। ভালোভাবে থেকো।
আসি
পলাশ চাচা”

পুরো চিঠি পড়া শেষ করে আয়ুশ একটা নিঃশ্বাস ফেললো।পলাশ চাচা তাদের যথেষ্ট সাহায্য করেছে।পলাশ চাচা না থাকলে হয়তো আয়ুশ তার মা আহানার খু’নিদের ধরতে পারতো না। তাছাড়া পলাশ চাচাও বা ওইসময় কি করতে পারতেন?নিজের প্রাণ বাঁচানোর জন্যই তো হ’ত্যাকে আত্নহ’ত্যা বলে সাক্ষ্য দিয়েছেন।আয়ুশ নিজেই তো পরিস্থিতি দেখেছে।আর পলাশ চাচা তো নিজের করা অন্যায়ের স্বীকারের পাশপাশি প্রায়শ্চিত্ত ও করে গিয়েছে।তাই পলাশ চাচার চলে যাওয়াকে আয়ুশ মেনে নিল।

কাগজ আর ফোন পকেটে পুরে আয়ুশ শামসুজ্জামান আর শেহনাজসহ বাকী অফিসারদের নিয়ে থানায় চলে গেল।অনীতা বাসায় একা বসে রইলো।

_______
আয়ুশ তার বাবা আর সৎ মায়ের বিরুদ্ধে থানায় আগেই এফ আই আর করে রেখেছিল।তার সাথের অফিসারদের সাথে সব প্রমাণাদি নিয়ে সে রাতেই থানায় চলে এলো।
প্রমাণাদি বলতে,সবচেয়ে বড় প্রমাণ পলাশের রেকর্ড করা ভিডিওতে পলাশের মুখ না দেখা গেলেও শেহনাজের মুখ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।আর পলাশ ও শেহনাজের কথাও স্পষ্ট শোনা গিয়েছে। শামসুজ্জামান বন্দুক তাক করার সময় আয়ুশ চতুরতার সহিত তার শার্টের বুকের পাশে পকেটে থাকা পেন ক্যামেরা দিয়ে শামসুজ্জামানের পজিশন রেকর্ড করে নিয়েছে।
তাই শেহনাজ আর শামসুজ্জামানকে আহানার হত্যা’কারী হিসেবে চিহ্নিত করা হলো।আর এতো শক্ত প্রমানাদির জন্য তারাও তাদের অপরাধ অস্বীকার করার জো পেল না।
__
ফজরের আযান শোনা যাচ্ছে।
মিস্টার শামসুজ্জামান আর শেহনাজকে আলাদা আলাদা লকাবে রাখা হয়েছে।সকাল ১০:০০ টার মধ্যেই তাদের কোর্টে চালান করা হবে।
আয়ুশ মসজিদে গিয়ে ফজরের নামাজ পড়ে অনেকক্ষণ বসে রইলো।নিজের মায়ের জন্য অনেকক্ষণ দোয়া করলো।তার ভিতরটা ফেটে আসছে।খুব জোরে কান্না করতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু পারছে না সে।তবে তার শুকিয়ে যাওয়া চোআ থেকে দুয়েকফোটা অশ্রু নিরবে বের হয়েছে‌ মাত্র।চোখের পানি গন্ডাদেশে আসা মাত্রই পুরো গালে চোখের পানি মাখিয়ে নিয়েছে সে।
একটু দেরী করেই মসজিদ থেকে বের হলো আয়ু্শ। পথিমধ্যে দেখতে পেলো এই সকাল বেলা একটা মা তার ছোট্ট ছেলেকে নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। প্রাতঃভ্রমণ করছে।
আয়ুশের দু চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।
ফের মনে পড়ে যায় তার যায় তার মায়ের কথা।
আয়ুশ যখন ছোট ছিল,তার বাবা তাকে সময় দিতো না বললেই চলে।যা সময় দিতো সব আয়ুশের মা আহানা দিতেন।
আয়ুশকে সময় দেওয়ার জন্য,আয়ুশ কে মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য তিনি ব্যাবসা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছিলেন।
আয়ুশকে নিয়ে তিনি প্রায়ই প্রাতঃভ্রমণে বের হতেন।কখনো কখনো বিকেলে বের হতেন।আয়ুশ কে নানান কিছু দেখাতেন।সবসময় আগলে রাখতেন।

“ এতো তাড়াতাড়ি এতো কিছু শিখালে কি এতো তাড়াতাড়ি চল যাওয়ার জন্যেই!তোমার আগলে রাখার দিনগুলো এতো অল্প সময় কেন ছিল মা!তোমার মতো কেউ আমার মাথায় অতি স্নেহে হাত বুলিয়ে দেয় না।তোমার মতো করে আমায় “ আব্বা” বলে কেউ ডাকে না।তোমার মতো করে কেউ আমায় হাসায় না।তোমার মতো আমায় কেউ ভালোবাসে না মা!তোমার জন্য আমি মা ডাকতে পারি না।আমার ধমনীতে কান্নাদের আটকে দেই।বাবার আদর আমি পাইনি।কিন্তু তুমি আমায় একসাথে বাবা-মায়ের আদর দিয়েছো।যখন কাউকে তার মায়ের সাথে দেখি,আমার তোমাকে মনে পড়ে মা।তুমি আমার অনুপ্রেরণা ছিলে।তুমি ছিলে শুধু “আমার মা”!আজ কোথায় গেলে মা!”

বিড়বিড় করে নিজের সাথে কথাটুকু বলে দীর্ঘশ্বাস ফেললো আয়ুশ!অনেক যুদ্ধ করে চোখের কোণে পানির ফোটাদের আটকালো আয়ুশ।

একটা ফোন পেয়ে থানায় ফিরে এলো আয়ুশ। মিস্টার শামসুজ্জামান আয়ুশের সাথে দেখা করতে চাচ্ছেন।প্রথমে কারণটা না বুঝতে পারলেও পরে বুঝলো আয়ুশ। তবুও গেল সে।
লকাবের গ্রিলের সামনে যেতেই মিস্টার শামসুজ্জামান আয়ুশকে দেখতে পেয়ে বলে উঠলেন,
“ আয়ুশ তুমি না আমার ছেলে।আমাকে তুমি কিভাবে এখানে ধরে রাখতে পারো । শেহনাজ না হয়,তোমার কেউ না।ওকে তুমি বন্দী রাখতে পারো। কিন্তু তুমি তো আমার রক্ত।আমার অংশ।আমাকে এখানে বন্দী রাখতে তোমার একটুও কষ্ট হবে না আয়ুশ?”
আয়ুশ চোয়াল শক্ত করে বললো,”আপনি আর কিছু বলবেন?আর কিছু বলার আছে আপনার?”
মিস্টার শামসুজ্জামান মুখের ভাব পরিবর্তন করে ফেললেন।স্বর কাঁদো কাঁদো করে বললেন,

-—“ কি আর বলবো বলো।তোমার সাথে আমার কতোকিছুই বলার ছিল। ইচ্ছে ছিল,বাবা-ছেলে কত গল্প করবো।কিন্তু তুমি তো আমায় এইখানে আটকে রেখছো।আমাকে বাহিরে নিয়ে যাও না আয়ুশ?”
-— আমি তো আপনাকে এখান থেকে বের করতে পারবো না আর।সব প্রমাণ রেকর্ড হয়ে গিয়েছে।”
-—তবুও..একটু দেখো আমায় ছাড়াতে পারো কী না!

আয়ুশ মুখের চোয়াল শক্ত করে বললেন,
-—“ কি মনে করেছেন আপনি?আমি চাইলেন আপনি ছাড়া পেয়ে যাবেন?এখানেই থাকতে হবে আপনার ।এখানেই।আর কি বললেন,বাবা-ছেলে মিলে গল্প করার খুব ইচ্ছে আপনার।এমন ইচ্ছে থাকলে ভুলে যান।আমি আপনার ছেলে নই।যখন দিনের পর দিন বিভিন্ন কাজে দূরে থেকেছেন,একবার ও তো ফোন দিয়ে আমার কথা জিজ্ঞেস করেননি। শুধুমাত্র নিজের জৈবিক চাহিদা ছাড়া আমাদের মা-ছেলের খোঁজ করতেও সময় পাননি আপনি।আজকে লকাবে ঢুকানোর পর ছেলের সাথে খুব গল্প করার ইচ্ছে হচ্ছে তাই না?ভুলে যান।
আমার মাকে খুব কষ্ট দিয়ে মে’রেছেন আপনারা দু’জন।আপনাদের ফা’সি না হওয়া পর্যন্ত আমি দমবো না।এতোদিন ক্ষমতার জোর দেখিয়ে আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েছিলেন।এখন আমার মায়ের ছেলে পুরো আইন জানে।আপনাকে আপনার যোগ্য শাস্তি আমি দিবোই।দয়া করে আর কিছু বলবেন না।তাহলে আমি ভুলে যাবো আপনি একসময় সম্পর্কে আমার কি হতেন।বিদায়!”বলেই আয়ুশ চলে যেতে লাগলো।

শামসুজ্জামান বুঝলেন,উনার ন্যাকা কাঁদায় ও আয়ুশের মন সহজে পরিবর্তন হবে না। কিন্তু তাও হাল ছাড়লেন না তিনি।নিজের গলার স্বর নরম করে আয়ুশকে ডাক দিলেন,
“ নিজের বাবাকে এভাবে রেখে কষ্ট হবে না তোমার আয়ুশ বাবা?”
শামসুজ্জামানের উক্ত কথা শুনে আয়ুশ দাঁড়িয়ে পড়লো।কতোদিন পর তার বাবা তাকে বাবা বলে ডাক দিয়েছে।রক্তের টান আয়ুশের শিরায় শিরায় বয়ে গেল।সে পিছনে তাকালো। শামসুজ্জামানের মুখের হাসি প্রসারিত হলো। আয়ুশ শামসুজ্জামানের কাছে যাবে কী না তা ভাবতে লাগলো। মুহুর্তেই মত চুড়ান্ত করে সে শামসুজ্জামানের লকাবের দিকে দ্রুত পায়ে এগুতে লাগলো!

চলবে………

#আয়ুর_প্রহর
#পর্ব_২১
#আয়িশা_নুর_তৃষ্ণা
______
“ নিজের বাবাকে এভাবে রেখে কষ্ট হবে না তোমার আয়ুশ বাবা?”
শামসুজ্জামানের উক্ত কথা শুনে আয়ুশ দাঁড়িয়ে পড়লো।কতোদিন পর তার বাবা তাকে বাবা বলে ডাক দিয়েছে।রক্তের টান আয়ুশের শিরায় শিরায় বয়ে গেল।সে পিছনে তাকালো। শামসুজ্জামানের মুখের হাসি প্রসারিত হলো। আয়ুশ শামসুজ্জামানের কাছে যাবে কী না তা ভাবতে লাগলো। মুহুর্তেই মত চুড়ান্ত করে সে শামসুজ্জামানের লকাবের দিকে দ্রুত পায়ে এগুতে লাগলো!

শামসুজ্জামান লকাবের গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন।আয়ুশ শামসুজ্জামানের ঠিক কাছটায় গিয়ে শক্ত গলায় বলে,

“ আপনার মুখ থেকে বাবা ডাক শুনতেও আমার ঘৃণা করে মিস্টার শামসুজ্জামান।আপনি আমার বাবা নন। সম্পর্কের দিক দিয়ে আমার বাবা হলেও আমি আপনাকে আমার বাবা বলে স্বীকার করতেও লজ্জা হয় আমার!

বিশ্বাস করুন,যে হাত দিয়ে আপনি আমার মায়ের গলা চে’পে ধরেছিলেন,ওই হাতটা আমার জাস্ট কে’টে ফেলতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু করবো না শুধুমাত্র সম্পর্কের জন্য।আমি অস্বীকার করলেও আপনি আমার জন্মদাতা এ কথা পাল্টে যাবে না। শুধুমাত্র ওইজন্য আমি আপনাকে কিছু করিনি।আমার নিজের প্রতি ঘৃণা হয় এই ভেবে যে আমার শরীরে আপনার রক্ত বইছে।আপনাকে আমি শুধু ধিক্কার জানাই।ধিক্কার আপনাকে!

কিন্তু সেইসাথে আপনাকে ধন্যবাদ ও।কেননা,আপনি আমাকে আপনার থেকে দূরে দূরে রাখলেও মা চলে যাওয়ার পর আপনি আমার খরচ বহন করতেন।যদিও মা হারা সন্তানের যত্ন রাখার বিষয়টা আপনার মাথায় কখনো আসেনি। তবুও আমাকে দেওয়া খরচের জন্য আপনাকে আবারো অসংখ্য ধন্যবাদ।
আর একটা কথা।এইবার আপনার ক্ষমতা আর টাকা দিয়ে কিচ্ছু করতে পারবেন না।আমি আইনের লোক। সমস্ত নিউজ চ্যানেলে আপনার শ্যুট করা,আপনার স্ত্রীর সবকিছু স্বীকার করার ক্লিপ সমস্ত বড় বড় নিউজ চ্যানেলে পাঠিয়ে দিয়েছি। ইতিমধ্যেই প্রায় সবগুলো নিউজ চ্যানেলেই সম্প্রচার করা হয়ে গিয়েছে।এবার আর পাবেন না আপনি।
আর কখনো আমাকে ডাকবেন না।দরকার হলে আমিই আসবো।চলি।”

আয়ুশ চলে যেতে লাগলো।পুনরায় শামসুজ্জামান পিছন থেকে ডাকলেন,
“ আমাকে এখান থেকে বের করে নিয়ে যাও প্লিজ।”
আয়ু্শ ঈষৎ হেসে পিছু ফিরে গাইতে লাগলো,
“ তুমি হাকিম হইয়া হুকুম করো,
পুলিশ হইয়া ধরো!
স্বর্প হইয়া দংশন করো,
ওঝা হইয়া ঝাড়ো!”
______

থানা থেকে বাড়ি ফিরলো আয়ুশ।কলিংবেল বাজালো।প্রহর যেন আয়ুশের অপেক্ষায় ছিল।সে দৌড়ে এসে দরজা খুললো।
আয়ুশ বাসার ভিতরে ঢুকে সোফায় বসে পড়লো।প্রহর সাথে সাথে জগ থেকে এক গ্লাস পানি ঢেলে আয়ু্শের সামনে দিলো।আয়ুশকে খুব ক্লান্ত মনে হচ্ছে।
সত্যিই আয়ুশ খুব ক্লান্ত ছিল।ঢকঢক করে পুরো এক গ্লাস পানি শেষ করে প্রহরকে জিজ্ঞেস করলো,
-—“ প্রণয় আর প্রেমা কোথায়?”
-—“ ভাইয়া বাইরে গিয়েছে। কিছু বাজার নিয়ে আসবে বললো।আর প্রেমা একটু আগেই গোসল করতে গেলো।”
-—“ আচ্ছা!” বলে সোফায় হেলান দিয়ে চোখ বুঁজে রইলো আয়ুশ।

-—“ কিছু হয়েছে আপনার?শরীর খারাপ লাগছে?” আয়ুশের চোখ বুজে আছে দেখে জিজ্ঞেস করলো প্রহর।

চোখ খুলে ঈষৎ হেসে আয়ুশ উত্তর দিলো-—“ কিছু হয়নি।”
-—“ যে কাজ করতে গিয়েছিলেন,তা সম্পূর্ণ হয়েছে?”
আয়ুশের পাশে বসতে বসতে জিজ্ঞেস করলো প্রহর।
প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে খানিকক্ষণ প্রহরের দিকে তাকিয়ে রইলো আয়ুশ।

হঠাৎই বাচ্চাদের মতো দুহাত মুখে চেপে কেঁদে উঠলো আয়ুশ। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে সে।
আকস্মিকভাবে এমন ঘটনার দরুন প্রহর অবাক না হয়ে পারলো না।আয়ুশের কাঁধে আলতো করে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলো,
“ কি হয়েছে আপনার?এভাবে কাঁদছেন কেন?এভাবে কাঁদবেন না প্লিজ।”
আচমকাই আয়ুশ প্রহরের কাঁধে নিজের মাথা রাখলো।কান্না করতে করতেই বলতে লাগলো,
“ আমার মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে প্রহর খুব।যে মা আমার ছোট ছোট হাত নিয়ে খেলা করতো।আমায় খাইয়ে দিতো।আমায় ঘুম পাড়িয়ে দিতো।আমার আমার মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে।
জানো প্রহর,আমার মাকে যখন মা’রা হয়েছিল তখন আমার কতো কষ্ট হয়েছিল।ছয় বছরের ছিলাম আমি। তবুও কাউকে কিচ্ছুটি বলতে পারিনি।তবে ওইসময় মনে মনে শপথ করেছিলাম,যখন বড় হবো আমার মায়ের মৃত্যু’র প্রতিশোধ আমি নিবো।আজকে আমার মাকে আমার খুব মনে পড়ছে প্রহর।খুব।”

আয়ুশের কথা শুনে প্রহর চমকে উঠলো।তবে এতটুকু বুঝলো,আয়ুশের মাকে খু’ন করা হয়েছিল।তবে এখন আয়ুশ কে ঘাটতে গেলো না আয়ুশ।এ বিষয়ে সে পরেও শুনতে পারবে।আপাতত আয়ুশকে শান্ত করতে হবে।

তাই সে আয়ুশকে বললো,
“ তো আপনি এভাবে কাঁদছেন কেন?এভাবে কাঁদলে মায়ের আত্না কষ্ট পাবে।মৃত ব্যাক্তিদের জন্য কাঁদতে হয়,তবে নিঃশব্দে।এভাবে জোরে জোরে কাঁদবেন না হুম?তবে আমি আপনাকে কাঁদতে মানা করবো না।আপনি যত ইচ্ছে কাঁদুন।নিঃশব্দে কেঁদে মনকে হালকা করুন। কাঁদুন!”

প্রহরের প্রশ্রয় পেয়ে আয়ুশ প্রহরের কাঁধে মাথা রেখে আবারো কাঁদতে লাগলো। প্রহর আয়ুশের চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। আয়ুশের চোখ থেকে প্রতিটি অশ্রুকণা নির্গত হওয়ার পর সে যেমন ফুঁপিয়ে উঠছে,তার সে নিঃশ্বাসের প্রতিটি শ্বাস যেন প্রহরকেও কাঁপিয়ে দিয়ে যাচ্ছে।
এভাবে অনেক সময় যাওয়ার পর প্রহর খেয়াল করলো, আয়ু্শের নিঃশ্বাস সে আগের মতো শুনতে পারছে না।তখনি সে আয়ুশ কে দেখতে নিজের মাথা একটু নোয়ালো।মাথা নুয়িয়ে দেখতে পেলো ,আয়ুশ ঘুমিয়ে পড়েছে।

প্রহর নিজেও কান্না করলে ঘুমিয়ে পড়ে।আজকে আয়ুশ ঘুমিয়ে পড়েছে।এটা দেখে একটা নিঃশ্বাস ফেলে প্রহর মুচকি হাসলো।তার আয়ুর সাথে তার কতো মিল!হিহি

আয়ুশের মাথা তার কাঁধে,আয়ুশ তার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমোচ্ছে! বিষয়টা প্রহরের বেশ লাগছে।খুব উপভোগ করছে সে পরিবেশটাকে।
কিন্তু একটু পরই খেয়াল হলো,এভাবে এক সাইডে মাথা কাত করে রেখে ঘুমোলে পরবর্তীতে আয়ুশের মাথার এই সাইডে ব্যাথা হতে পারে। কিন্তু এখন তো আয়ুশ কে কোলে করে বেডরুমেও নিয়ে যেতে পারবে না সে।আয়ুশের বলিষ্ঠ দেহের তুলনায় প্রহর চুনোপুঁটি।আবার আয়ুশ কে এখন জাগিয়ে দিতেও খারাপ লাগবে তার।তাই একটু চিন্তা করে সে সিদ্ধান্ত নিল,আয়ুশের মাথা আলতো করে নুয়িয়ে তার কোলে তার আয়ুর মাথা রাখবে।সে অনুযায়ীই প্রহর আয়ুশের মাথা নিজের কোলে রাখলো।তারপর আয়ুশের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।
আয়ুশের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতেই সে খেয়াল করলো,আয়ুশের কপালে কিছু একটা লেগে আছে।একটু নিচু হয়ে যখনই সে সেটা মুছে দিলো,তখনি আয়ুশের চোখ খুলে গেল।প্রহর ভয় পেয়ে নিজের বুকে থু থু দিলো।প্রহরের এমন কান্ডে আয়ুশ হু হু করে হেসে ফেললো।প্রহর আয়ুশের দিকে তাকিয়ে রইলো।কি প্রশান্ত লাগছে লোকটাকে!

আয়ুশ প্রহরকে জিজ্ঞেস করলো,
-—“ এমনভাবে আমার দিকে ঝুঁকে কি করছিলে প্রহর?”
-—“ এ…আপনার কপালে কি একটা লেগে…
-— “ থামো,থামো।আমি বুঝেছি তুমি কি করতে গিয়েছিলে!”
-—“ কি করতে গিয়েছিলাম?” বোকার মতো প্রশ্ন করলো প্রহর!
-—“ তুমি আমার কপালে পাপ্পি দিতে গিয়েছিলে!” দুষ্টু হেসে বললো আয়ুশ!

আয়ুশের কথা শুনে প্রহরের কপালে ভাঁজ পড়লো।পরক্ষণেই পাপ্পি শব্দটার মানে বুঝে তার দু গালে লাল আভা ছড়িয়ে পড়লো।সে আমতা আমতা করে বললো,
-—“ না।এমন কিছু করার উদ্দেশ্যে ছিল না। সত্যিই আপনার কপালে কি একটা লেগে ছিল..তাই..

-—“ থামুন ম্যাডাম!আর কিছু বলতে হবে না আপনাকে।আমি বুঝেছি…” এবারও প্রহরের কথার মাঝখানেই তাকে থামিয়ে দিলো আয়ুশ।
-—“ কি বুঝেছেন?” জিজ্ঞাসু চোখে আয়ুশকে জিজ্ঞেস করলো প্রহর।”

প্রহরের কোলে মাথা রেখেই আয়ুশ প্রহরের নাকের ডগা আলতো করে ছুঁয়ে দিয়ে বললো,
-— এইটাই যে…….আমার ম্যাডাম মানে আপনি অনেক বোকা!”
-—“ আমি বোকা?” বলেই আয়ুশের দিকে হা করে তাকিয়ে রইলো প্রহর।পরক্ষণেই নিজের বোকা প্রশ্ন বুঝতে পেরে লজ্জা পেল সে।
বারবার প্রহরের লাজরাঙা মুখ দেখে আয়ুশের মনেও ভালোলাগার পরশ বয়ে গেল।তাহলে কী সত্যিই প্রেমে পড়েছে সে?
“এই মেয়েটা আমায় সত্যিই তার মায়ায় ফেলে দিয়েছে।এখান থেকে নিস্তার পাবো কি করে?”
আনমনে নিজেকেই জিজ্ঞাসা করলো আয়ুশ।
পরক্ষণেই নিজের মনকে ধমকি দিয়ে নিজেই প্রত্যুত্তর করলো সে,
“ একবার যখন তার মায়ায় পড়েছি,তখন আর এখান থেকে কোথাও যেতে চাই না।এখানেই থাকতে চাই আজীবন,চির জনম।”
মনে মনে এতটুকু কথা বলে একা একাই হেসে ফেললো আয়ুশ।
প্রহর অবাক দৃষ্টে আয়ুশের দিকে তাকালো।লোকটা আবার হাসছে!কি মনোমুগ্ধকর সেই হাসি!

গোসল থেকে বের হয়ে দূর থেকে প্রেমা তার প্রহু ও দুলাব্রোর মিষ্টি কথোপকথনের খানিকটা শুনতে পেলো।শুনে দূর থেকেই মুচকি হাসলো।তার বোনজামাইটা খুব ভালো মানুষ।তার প্রহুকে খুব ভালো রাখবে।খুশিতে রাখবে।আর তার প্রহুর খুশিই তো তার খুশি।মনে মনে স্রষ্টার কাছে নিজের বোনের সুখময় জীবনের প্রার্থনা করলো সে।ভালো থাকুক তার বোন!কখনো নজর না লাগুক তার বোনের সংসারে।এরপরই নিজের রুমে চলে গেলো সে।তাদের ব্যাক্তিগত সময়ে কাবাব মে হাড্ডি হতে চায় না প্রেমা!

চলবে…..