আয়ুর প্রহর পর্ব-২২+২৩

0
863

#আয়ুর_প্রহর
#পর্ব_২২
#আয়িশা_নুর_তৃষ্ণা
______
কিছুদিনের মধ্যেই কোর্টের রায় এসে গেল।
এতোদিন আয়ুশকে বহু দৌড়ঝাঁপ করতে হয়েছে।আজকে রায়ের ফাইনাল তারিখ। চুড়ান্ত শুনানি হবে আজ‌।অবশেষে আজকে সে একটু শান্ত হলো।

আজকে প্রহর আর অনীতাকে নিয়ে কোর্টে গিয়েছিলো আয়ু্শ।কোর্টে যখন জজ সাহেব রায় কেসের চুড়ান্ত রায় দিচ্ছিলেন,তখন যেন আয়ুশের বুকের ধুকপুকানি বেড়ে যাচ্ছিলো।আয়ুশের একপাশে বসেছিল প্রহর।আর অন্যপাশে অনীতা।আয়ু্শ তাদের দু’জনের হাত খুব শক্ত করে ধরে রাখে।
প্রহর বুঝতে পারে আয়ুশের মনের কথা,ব্যাথা।তাই সে আয়ুশের কাঁধে আলতো করে হাত রাখে।আয়ুশ প্রহরের দিকে তাকালে প্রহর আয়ুশকে ইশারায় স্বান্তনা দেয়,“ যা হবে,সব ভালো হবে।”

রায় ঘোষণা করা হলো।মিস্টার শামসুজ্জামান ও মিসেস শেহনাজকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।বড় বড় উকিল হায়ার করেও তার আর তাদের বাসায় ফিরতে পারেনি,পারবেও না।আয়ুশ আদালতে প্রমাণ হিসেবে রেকর্ডার আর তার সাক্ষ্য সাথে পলাশ চাচার সাক্ষ্য পেশ করার পরই তারা তাদের অপরাধ স্বীকার করে নেয়।এখন তাদের আর নিস্তার নেই।আপাতত জেলখানাকেই নিজ আবাস হিসেবে ধরে নিয়ে সেখানেই বাকী জীবন পাড়ি দিতে হবে।

আদালতের কাজ সমাপ্ত হওয়ার পর শামসুজ্জামান আর শেহনাজকে যখন ফের জেলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো,তখন তারা পুলিশদের কাছে একটু সময় চায়।অনীতার সাথে কথা বলার জন্য।

শেহনাজ পারভীন জানেন,সৎ বোন হলেও ছোট থেকেই অনীতাকে আয়ু্শ নিজের বোন মনে করে।অনীতাকে আয়ুশ নিজের কলিজা মনে করে।অনীতা আয়ুশ কে যাই বলুক না কেন,আয়ুশ সেটা করতে প্রস্তুত।এখন তিনি ভাবছেন,যদি অনীতাকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে আয়ুশকে বলে শাস্তি কিছুটা কমানো যায়।
তাই অনীতার সাথে দেখা করতে চাইলেন তারা। কিন্তু অনীতা মা-বাবার সাথে দেখা করতে চাইছিলো না।তখনি আয়ুশ অনীতাকে বলে,

“ তোর যদি ইচ্ছে হয়,তাহলে তোর বাবা -মায়ের সাথে দেখা করতে পারিস।
আমি তোকে কখনোই কোনোকিছুর জন্য জোর করবো না অনী।তবে আমি তোকে এতটুকু বলবো,শত অপরাধ করলেও ওরা তোর বাবা-মা।একটু দেখা অন্তত করে আয়।ভালো হবে।”

-—“ তোর ও তো বাবা আছে সেখানে।তুইও আয় আমার সাথে।”
-—“ যে মানুষটা তার নিজ হাতে আমার মায়ের শ্বাসরোধ করেছিল,তার কাছে অন্তত যেতে পারবো না অনী।সে আমার মায়ের,আমার জন্মদাত্রীর খু’নি অনী।আমি যাবো না।আমি চাই ওদের সাথে আর কখনো আমার দেখা না হোক। কিন্তু তুই যা, শেষ দেখা হিসেবে হলেও দেখা করে আয়।”
আয়ুশের শেষোক্ত কথা অনীতার মনে ধরলো।তাই সে বললো,
-—“ তা যা বলেছিস ভাইয়া!শেষ দেখা হিসেবে দেখা তো করতেই পারি।”
বলেই একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বাবা-মায়ের কাছে যায় অনীতা।

তাদের কাছে যাওয়ার পর__
মিসেস শেহনাজ অনীতাকে দেখেই মেকি কেঁদে উঠেন।গলায় কান্নার ভাব এনে আবেগপ্রবণ হওয়ার অভিনয় করে অনীতাকে বলত লাগেন,

“ অনী-রে। আমাদের এখান থেকে নিয়ে যেতে বল না রে।আয়ুশকে বল,আমি তাকে বাড়িতে জায়গা দিবো।আমাকে এখান থেকে নিয়ে যেতে বল।”
-—“ তোমার কি মনে হয় মা?ভাইয়ার যাওয়ার আর কোনো জায়গা নেই।বাড়িতে থাকার লোভে ভাইয়া তোমাদের শাস্তি মওকুফ করবে নাকি?!”

-— “ তা জানি না।তবে আমরা মিলেমিশে থাকবো।অনীরে,তুইই বল।আমি আর তোর বাবা ওই অন্ধকার কারাগারে কিভাবে থাকবো?কী নোংরা জায়গাগুলো। ওগুলো কি আমাদের থাকার জন্য যোগ্য জায়গা বল?একটা কাজের লোক ও নেই।ওখানে কিভাবে থাকবো রে?আয়ু্শ তো তোর কথা শুনে।ওকে বল না,আমাদের এখান থেকে বের করে নিয়ে যেতে।”

মায়ের কথা শুনে অনীতার চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো।তার মানে তার মা এখন তাকে এসব বলার জন্য ডেকেছে।সে দাঁতে দাঁত চেপে উত্তর দিলো,

“ যখন বড়মাকে মেরেছিলে তখন থেকেই ভি আই পি কারাগারের ব্যাবস্থা করে রাখতে পারলে না?তখন মন কোথায় ছিল?জানতে না,সত্য কোনোদিন চাপা থাকে না?দেখলে তো, তোমাদের জঘন্য কর্মের ফল কত সুন্দর। আগে থেকে এতোকিছু ভাবলে না,যে একবার ধরা পড়লে কি হবে?এখন থাক,ওই চার দেয়ালের কারাগারে।পাপের প্রায়শ্চিত্ত কিছুটা হলেও করো।অন্তত এখন অনুতাপ করো।ভালো লাগবে।”

মেয়ের মুখের এমন কথা শুনে শামসুজ্জামান রেগে গিয়ে কিছু বলতে গেলে শেহনাজ কনুইয়ের খোঁচা দিয়ে শামসুজ্জামানকে কথা বলতে নিষেধ করলেন।এখন অনীতার সাথে শান্তভাবে কথা বলতে হবে।তার মনটাকে গলিয়ে করুণা নিতে হবে।তাই তিনি আবার বললেন,

-—“ কার জন্য করেছি,বল তো অনী! আমাদের সুখের জন্যই তো।আহানাকে না মা’রলে জীবনে শান্তিতে থাকতে পারতাম?এতো আরাম-আয়েশ একা একা ভোগ করতে পারতাম?বল।”

এইবার মায়ের এহেন কথা শুনে অনীতা রেগে যায়,সে বলে
-—“ আমার না এখন খুব ঘৃণা হচ্ছে এই ভেবে যে,তুমি আমার মা!যদি সৃষ্টিকর্তার নিয়মসমূহে এমন কোনো নিয়ম থাকতো যে,যে যার মতো ইচ্ছেনুযায়ী মা বেছে নিবে,তাহলে আমি কখনোই তোমার গর্ভে আসতাম না।প্রয়োজন হলে,কোনো সহজ সরল দরিদ্র মহিলার ঘরে জন্মাতাম‌। তবুও তোমার মতো খু’নির ঘরে নয়।
একজন ভালো মানুষকে মার’লে শান্তি পাওয়া যায়!জানতাম না তো মা!
তো এখন তো ভালোই হয়েছে।বড়মাকে মেরেছো,এখন খুব শান্তিতে থাকো।আশা করছি তোমাদের এখানে খুব ভালো লাগবে।
জানতো মা, সৃষ্টিকর্তা ছাড় দেন কিন্তু ছেড়ে দেন না।এখন বুঝছো তো!”

শেহনাজ চুপ হয়ে গেলেন।অন্যদিকে শামসুজ্জামান শেহনাজের দিকে রাগান্বিত চোখে তাকিয়ে কি যেন বিড়বিড় করতে লাগলেন।

তখনি একজন কর্তব্যরত কনস্টেবল বললেন,
“ অনেক সময় দিয়েছি আপনাদের।কথা শেষ।এবার চলুন।” বলেই শামসুজ্জামান আর শেহনাজের কাছে এগিয়ে আসেন তিনি। সাথে আরো কয়েকজন কনস্টেবল।

এ কথা শুনে অনীতা তার বাবা-মায়ের দিকে তাকায়।সে বলে,

“ আশা করছি,চার দেয়ালের মাঝে তোমাদের র জীবন বেশ ভালোই কাটবে।চললাম।ভালো থেকো।” বলেই চলে যেতে লাগে অনীতা। তার ইচ্ছে হয়, পিছু ফিরে বাবা -মাকে একটাবার জড়িয়ে ধরতে।জড়িয়ে ধরে একটু কান্না করতে। কিন্তু কেন জানি তার পা পিছু ফিরতে তাকে বাঁধা দেয়।কান্না আটকে রেখে অনীতা কোর্টের বাইরে যেতে অগ্রসর হয়।বাইরে আয়ুশ আর প্রহর তার জন্য অপেক্ষা করছে।

এইদিকে শামসুজ্জামান আর শেহনাজকে পাশপাশি দুইটা লকাবে রাখা হয়েছিল। জেলখানার শিকের ফাঁক দিয়ে তারা দুইজন কথা কাটাকাটি করতে থাকে। তাদের কথার আওয়াজে একজন কনস্টেবল এসে তাদের ধমক দিয়ে গেলে শামসুজ্জামান শেহনাজের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে কয়েকটা গালি দিয়ে বলে,

-“ তোর জন্যই আমার জীবনটা পুরো শেষ কালনাগীন।তোর চমড়ার রং সাদা হলেও তোর নোংরা নোংরা প্ররোচনায়ই আমি আমার সব শেষ করেছি।সব হারিয়েছি তোর জন্য।চাইলে ভুল শোধরাতে পারতাম। কিন্তু তোর জন্যই আজকে আমার এই হাল।…….!”

-—“ দোষ কি আমার একার নাকি?তুমিই তো আমকে প্রথম পছন্দ করেছিলে।আর আহানাকে মা’রারা প্ল্যানটা তো দু’জনে মিলেই বানিয়েছিলাম। কিন্তু তুমি এখন………….

শেহনাজ আরও কিছু বলতে উদ্যাত হলে একজন মহিলা কনস্টেবল এসে মিসেস শেহনাজকে শামসুজ্জামানের থেকে দূরে আলাদা লকাবে নিয়ে রাখেন। শামসুজ্জামান একা একাই শেহনাজকে গালাগালি করতে থাকেন। পাশাপাশি নিজেকেও ধিক্কার দিতে থাকেন। কিন্তু এখন কোনো লাভ নেই।
__
অনীতা কোর্ট থেকে বের হলে আয়ুশ অনীতা আর প্রহরকে নিয়ে তার মায়ের কবরের কাছে যায়। অনীতা আর প্রহর দূরে দাঁড়িয়ে থাকে।আয়ুশ একা একা মায়ের কবর জিয়ারত করে সেখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে একা একা তার মায়ের সাথে কথা বলে।
মায়ের কবরের উপর থেকে হালকা কিছু মাটি উঠিয়ে হাতের তালু চোখের কাছে নিয়ে আসে আয়ুশ‌।হাতের তালুতে রাখা ওই মাটির উপর আয়ুশের চোখের পানি টুপটুপ করে পড়ে।সে বিড়বিড় করে বলতে থাকে,
“ আজকে আমি তোমার হত্যা’কারীদের শাস্তি দিতে পেরেছি মা।তুমি চলে যাবার পর তোমার আয়ুশ তোমাকে যে কথা দিয়েছিল।তা আজ সে পূর্ণ করেছে মা।”

বলেই আবারো ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে আয়ুশ। শুধু ভাঙা ভাঙা গলায় বলে “ ওপারে ভালো থেকো মা।”

দূর থেকে আয়ুশের নিরব কান্না দৃষ্টিগোচর হয় প্রহর আর অনীতার।নিজের কাছের মানুষের মন খারাপ আমাদের মন খারাপ হয়,আর তাদের মন ভালো থাকলে আমরাও খুশি থাকি।

আয়ুশ প্রহর আর অনীতা দু’জনেরই বেশ কাছের।তাই আয়ুশের কান্না দেখে প্রহর আর অনীতা দু’জন দু’জনের হাতে হাত রেখে নিজেরাও কেঁদে ফেললো।
__
সন্তানের দোয়া বাবা-মায়ের জন্য কবুল হয়।তাই আয়ুশ মায়ের কবরের কাছে আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে তার মায়ের জন্য দোয়া করলো।সূরা ইয়াসিন পড়লো।আরো কিছু দোয়া পড়ার পর সে তার মায়ের কবরের পাশ থেকে বেরিয়ে অনীতা আর প্রহরের কাছে এলো।

এসে দেখলো প্রহর আর অনীতা দুজনের চোখেই পানি ছলছল করছে।এ দেখে সে তার দু হাত প্রহর আর অনীতা দু’জনের মাথায় রেখে দুজনের মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
-“ কাঁদে না।”
তারপর প্রহরকে বললো,
-—“ প্রহর!যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হয়,আজ অথবা আগামীকাল!তুমি আমার সাথে তোমার বাবার বাড়ি যাবে।”

আয়ুশের কথা শুনে প্রহর অবাক নেত্রে আয়ুশের দিকে তাকালো।আয়ুশ তো জানে প্রহরের মা কেমন!তবুও প্রহরের বাসায় কেন যেতে চাচ্ছে আয়ুশ?
জিজ্ঞাসু নয়নে আয়ুশের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন পরে প্রহর,
“ কিন্তু কেন?”
“ যেতে হবে প্রহর।যেতে হবে।কারণ আছে বলেই বলছি।আমরা আজকালের মধ্যেই রওনা দিবো।রেডি থেকো।”
__
চলবে….

#আয়ুর_প্রহর
#পর্ব_২৩
#আয়িশা_নুর_তৃষ্ণা
________________
পৃথিবীর যে প্রান্তে প্রহর আছে সেখানে এখন গোধূলির শেষ অংশ বিদ্যমান।বাচ্চারা খেলাধুলা শেষ করে নিজের বাড়ি ফিরে যাচ্ছে।সারদিন ব্যাস্ত থাকা ক্লান্ত মানুষটি জ্যামে উপোস করে বাসে গাদাগাদি করে ঢুলতে ঢুলতে বাড়ি যাচ্ছে।জীবিকার তাগিদে কিছু মানুষ সেই সকাল থেকে তাদের কর্মের খোঁজ করছে।না পেয়ে হাল না ছেড়ে অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছে।পাখিরা যে যার নীড়ে ফিরে যাচ্ছে।

প্রহর ও আজ যাচ্ছে তার বাড়ি।তার বাড়ি বলতে তার বাবার বাড়ি । তার মায়ের বাড়ি।

শুধু সে একা যাচ্ছে না।তার সাথে যাচ্ছে আয়ুশ,প্রণয় আর প্রেমা।প্রহর অনীতাকেও সাথে নিতে চেয়েছিলো।অনীতার মা-বাবা জেলে।এই অবস্থায় একটু হাওয়া বদল করলে অনীতার ভালো লাগবে। অনীতাকে তাদের সাথে যাওয়ার জন্য প্রহর খুব অনুরোধ করেছিল।কিন্তু কোনো এক অজ্ঞাত কারণে অনীতা বারবার না করে দিয়েছে।আয়ুশ অনীতাকে রিকোয়েস্ট করলেও সে রাজি হয়নি।

আয়ুশ দের বাসার একটু দূরেই অনীতার খালমণির বাসা।তিনি অনীতার মায়ের মতো হিংস্র মহিলা নন। সম্পর্কের খাতিরে বোনের সাথে ভালো সম্পর্ক থাকলেও অন্যের সংসার ধ্বংস করে সে সংসার নিজের দখল করে নেওয়ার বিষয়টা তিনি কখনোই সমর্থন করেন না। কিন্তু শেহনাজের করা বিষয়টা তিনি আগে জানতেন না।তার বোন একজন খু’নি এটা মেনে নিতে কষ্ট হয়েছিল তার। তবুও মেনে নিয়েছেন তিনি।

বোনের হিংস্রতার জন্যই বোন শাস্তি পেয়েছে। কিন্তু তাই বলে এই নয়,তিনি অনীতাকে অস্বীকার করবেন।এমন ধাঁচের মহিলা তিনি নন।
এই পরিস্থিতিতে অনীতার মনের অবস্থা বুঝতে পারছেন তিনি। তাই তিনি আজ নিজেই ফোন করে অনীতাকে তার বাসায় ডেকেছেন।বলেছেন,অনীতা যেন কিছুদিন হলেও তার বাসায় থাকে।

অনীতা সুযোগটাকে কাজে লাগালো।সে আয়ুশকে বললো,এই কিছুদিন সে একটু একা থাকতে চায়।তার খালামণিদের বাসায় যেতে চায় সে।
ভালো লাগলে তারপর আয়ুশদের বাসায় নিজেই আসবে সে।

আয়ুশ ও অনেক ভেবে অনীতার কথায় সম্মতি দিলো।সে বুঝতে পারছে,অনীতার মধ্যে কিছু একটা ঘাপলা আছে। কিন্তু কী,সেটা বোধগম্য হলো না তার!
____________
বদ্ধ ঘর। দেয়ালে মাথা ঠুকছেন সাবিনা।কী করে পারলেন তিনি নিজের গর্ভজাত সন্তানের সাথে এমন করতে!নিজেকে
পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মা হিসেবে মনে হচ্ছে আজ!

প্রণয় একটু আগে ফোন দিয়ে মিসেস সাবিনাকে জানিয়েছেন,প্রহর আর আয়ু্শকে নিয়ে সে বাড়িতে ফিরছে।প্রহরের রুমটা একটু গুছিয়ে রাখলে ভালো হবে।

প্রণয়ের কথা শুনে বিরক্তি অনুভব করলেও প্রহরের ঘর গুছাতে গেলেন সাবিনা।যে করেই হোক,বিয়েটা হয়েছে আয়ুশ আর প্রহরের।এখন তারা এই বাড়িতে আসছে।যাই হোক, আয়ুশ তাদের নতুন জামাই।তারা আসলে তাদের তো আর তাড়িয়ে দিতে পারবেন না তিনি। তাছাড়া রাত ও হয়ে আসছে।ওরা আসলে আজ অবশ্যই থাকবে।তাই বাধ্য হয়েই প্রহরের রুম পরিষ্কারের কাজে লেগে গেলেন তিনি।

রুমটা আসলে প্রহরের নিজের নয়।রুমটা প্রহরের দাদীর।প্রহর যখন ছোট ছিল,সে তার দাদীর সাথেই থাকতো।প্রহরের দাদী প্রহরকে খুব আদর করতেন।তিনি যতদিন ছিলেন প্রহরের সব আবদার তিনিই পূরণ করার চেষ্টা করতেন।
কয়েকবছর হলো মা’রা গিয়েছেন তিনি।তিনি বেঁচে থাকতেই প্রেমা আর প্রণয়কে আলাদা আলাদা রুম দেওয়া হয়েছিলো।প্রহরকে হোস্টেলে পাঠিয়ে দেওয়ার দরুন তার জন্য আলাদা রুম নির্ধারণ করা হয়নি। হোস্টেল থেকে এলে সে তার দাদীর রুমেই থাকতো।

প্রহরের দাদী মারা যাওয়ার আগে বলে গিয়েছেন,উনার মৃত্যুর পর উনার বড় নাতনী অর্থাৎ প্রহর যেন উনার রুমে থাকে।উনার মৃত্যুর পর থেকেই এই রুমটা প্রহরের জন্য বরাদ্দ।
প্রহরের রুমে তেমন কেউ আসে না একমাত্র প্রণয় আর প্রেমা ছাড়া।প্রহর হোস্টেল থেকে ফিরলে ভাই-বোনরা মিলে এই রুমেই আড্ডা দিতো।
প্রহর দাদীকে খুব বেশি ভালোবাসতো।তাই এই রুম ছেড়ে সে প্রেমার রুমে প্রেমার সাথে থাকতে যেতো না।

এই রুমে মিশে আছে দাদীর ঘ্রাণ।অন্যরকম আদুরে মিষ্টি ঘ্রাণ।দাদী পান খেতে খুব ভালোবাসতেন।সাথে কড়া করে মিষ্টি জর্দা।হাতের শাহাদাত আঙ্গুলের ডগায় চুন রেখে পান চিবানোর মাঝখানে মাঝখানে কিছুটা চুন মুখের ভিতর ঢুকিয়ে দিতেন তিনি।কি আরাম নিয়ে চিবুতেন!
পান খাওয়ার পর দাদীর দুই ঠোঁট লাল হয়ে থাকতো।ওইসময় দাদীর কাছে গেলে অন্যরকম একটা ঘ্রাণ পাওয়া যেত দাদীর শরীর থেকে।এই রুমটার প্রতিটা কোণে এখনো ওইরকম ঘ্রাণ খুঁজে পায় প্রহর।
___
প্রহরের রুমে সাবিনা খুব একটা আসেননি বললেই চলে।প্রহর যখন ঘুমিয়ে থাকতো,তখন চুপিসারে মাহতাব হোসেন মেয়েকে দেখতে আসতেন। ঘুমন্ত মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে মাথায় আদর এঁকে দিতেন।সবই ঘটতো প্রহরের অজান্তে!

কিন্তু মিসেস সাবিনা কখনোই প্রহরের রুমে আসতে পারেননি। প্রহরকে দেখলেই কি একটা যন্ত্রণা যেন তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। কিছু হারিয়ে যাওয়ার অনুভুতি হৃদয়ে ফের ফিরে আসে তার!

আজকে যখন তিনি প্রহরের রুম গোছাচ্ছিলেন,তখন উনার নজর যায় প্রহরের রুমে থাকা একটা শেলফের উপরের তাকে ধুলো জমানো একটা ডায়েরীর দিকে।অন্যসময় প্রহরের বিষয়ে আগ্রহ না জন্মালেও আজ যেন এই ডায়েরীটা দেখতে বেশ কৌতুহল জন্মালো উনার।কি লিখা আছে এই ডায়েরীতে,পড়তে উগ্রদীব হয়ে উঠলেন তিনি।

“দিনটি ছিলো রবিবার।হুট করেই হোস্টেল থেকে ৩ দিনের ছুটি ঘোষণা করা হলো।সকাল সকাল আব্বু গিয়ে নিয়ে এলেন আমায়। পৌঁছুতে পৌঁছুতে ১০:০০ টা বাজলো।বাসায় আমাকে পৌঁছে দিয়েই অফিসে চলে গেলেন তিনি।হোস্টেল থেকে বাসায় ফিরে দেখি বাসায় প্রেমা আর ভাইয়া কেউ নেই।প্রেমা তার স্কুলে আর ভাইয়া কোনো একটা কাজে গিয়েছে।

বাসায় একদম ভালো লাগছিলো না।তাই একটু রেস্ট নিয়ে জোহরের নামাজের পর বাসা থেকে বের হলাম।বাসার কাছেই একটা নদী আছে‌।ইচ্ছে করছিলো নদীর ধারে যাবো। ফুরফুরে বাতাসে নিঃশ্বাস নিবো।তাই সে উদ্দেশ্যেই বোরখা পড়ে বাসা থেকে বের হলাম।
এলাকায় এতো বখাটে তা আমার জানা ছিল না।নদীর ধারে যাওয়ার পথে এই ভরদুপুরে একজন বখাটে আমায় টিজ করলো।আমার মন খারাপ হয়ে গেল। কোনোরকমে দৌড়ে ওই রাস্তা থেকে বাসায় চলে এলাম।আমার আর নদীর ধারে যাওয়া হলো না।
আগে কোনোসময় এমন পরিস্থিতিতে পড়িনি।তাই খুব কান্না পাচ্ছিলো।বাসায় ঢুকে সোফায় বসে হাঁপাতে হাঁপাতে প্রায় কেঁদেই দিচ্ছিলাম।এমন সময় মা এলো। জিজ্ঞেস করলো,আমার কি হয়েছে?আমি এতো হাঁপাচ্ছি কেন!

আমি গড়গড় করে মাকে বলে দিলাম,আমায় রাস্তায় একজন ছেলে টিজ করেছে। ভেবেছিলাম একথা শুনে মা আমায় স্বান্তনা দিবে নয়তো বকা দিবে ‌।
কিন্তু ওইদিন মা আমায় প্রচন্ড মারলো।
ওইদিন যদি প্রণয় ভাইয়া না আসতো,তাহলে ওইদিনই বোধহয় আমার শেষ দিন হতো।আমি বোধহয় মরেই যেতাম‌।আর ওটাই ভালো হতো।

প্রণয় ভাইয়া এসে অনেক কষ্টে মাকে থামালেন।আমার ভাইয়াটা যে আমায় কতোবার মায়ের মার থেকে আমায় বাঁচিয়েছে!তাকে যতো বেশি ধন্যবাদ দিবো,কম হয়ে যাবে।

তবুও ওইদিন রাতে আমার খুব জোর জ্বর এলো।রাতে কেউ জানেনি।একা একা মাথায় পানি দিয়েছি।
সকালে ভাইয়া আমার রুমে এসে দেখলো জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে।ভাইয়া মাকে ডাকতে যাবে,আমি নিষেধ করলাম।ওইসময় ভাইয়া চুপ রইলো।
আমার মাথায় অনবরত পানি ঢাললো আমার ভাইয়া।মুখ তিতকুটে হয়ে গিয়েছিলো।তবুও ভাইয়া আমায় জোরে করে একটা কেক খাইয়ে ঔষধ খাইয়ে আমায় শুইয়ে দিয়েছে।

ওইদিন ভাইয়া মাকে জিজ্ঞেস করেছিলো,কেন আমায় মেরেছে।মা সব বললো।ওই কথা শুনে ভাইয়া এটা একাই খুব চিল্লাচিল্লি করলো।তারপর মাকে বললো,“এই সামান্য কারণে বনুইকে কেন মারলে মা!চাইলেই বুঝাতে পারতে তাকে!

পরপর দু’দিন আমার ভাইয়াটা কিছু খায়নি।অনেক জোর করে খাইয়েছিলাম ভাইয়াকে।তারপরের দিনই ফের হোস্টেলে চলে যাই।

আমি সাধারণত কোনো কষ্টের কথা মনে রাখি না।উপরের কথাগুলো দেখে মনে হবে খুব কষ্ট নিয়ে লিখেছি। কিন্তু আসলে আমি খুব খুশি।খুউউব।কেননা,ভাইয়া ওইদিন চিল্লাচিল্লি করার পর মা বলেছিল,“ আমায় মারার মূল কারণ ছিলো,ওইদিন দুপুরে আমি ভাত না খেয়ে বাসার বাইরে গিয়েছিলাম।”

ভাইয়ার সামনে মায়ের ওই যুক্তি কতটুকু টিকেছিলো,তা আমি জানিনা। কিন্তু ওই সামান্য নড়বড়ে কথাটুকু আমার খুব ভালো লেগেছে ।মায়ের মার খাওয়ার পর শরীরে যে যন্ত্রনা হয়েছিল,সব ভুলে গিয়েছিলাম ওই একটা কথায়।মা আমার কতো খেয়াল রাখে!
সামান্য ভাত না খেয়ে যাওয়ায় এমন শাসন কজনই বা করে।
ওই কথা শোনার পর ওই মা’র আমার কাছে আদরে পরিণত হয়েছিলো।
তবে একটা কথা…..
সৃষ্টিকর্তা বোধহয় এমন একজন ভাইয়া আমাকে বেঁচে থাকার উসিলা হিসেবে দান করেছেন!
সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর! আলহামদুলিল্লাহ!”

কথাগুলো পড়েই সাবিনা বেগম কেঁদে দিলেন।মেয়েটাকে এতো শাসন করা উচিত হয়নি।খুব কষ্ট দিয়ে ফেলেছেন মেয়েটাকে।
তিনি নিজেও জানেন মেয়েটা তারই গর্ভজাত সন্তান। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে তাকে মেয়ে বলতে দ্বিধা হতো তার।
কেন?
মেয়েটার রং অন্য তার পরিবারের বাকি সদস্যদের তুলনায় একটু চাপা হওয়ার কারণে?
কি জানি!

আরেকটা পৃষ্ঠা উল্টালেন তিনি……

“ মা,
আমার কন্ঠে তোমায় মা ডাকা তুমি পছন্দ করো না। কিন্তু আমার যে তোমায় খুব মা ডাকতে ইচ্ছে করে মা।
তোমায় মা ডাকতে গেলে তুমি যদি আমায় বকা দাও,সেই বকাও আমার কাছে খুব আদুরে লাগে মা।

মাগো,ও মা।আজ না খুব খারাপ একটা স্বপ্ন দেখেছি।দেখেছি,তুমি আমায় ছেড়ে কোথাও একটা চলে যাচ্ছো।আমার না খুব ভয় করছে না।মাগো আমার না অনেক ইচ্ছে করছে তোমায় অনেকবার ডাকতে। কিন্তু এই গভীর রাতে তোমার ঘুম ভাঙিয়ে মা বলে ইচ্ছেমতো ডাকতে। কিন্তু তোমার ঘুম ভাঙিয়ে তোমায় কষ্ট দিতে মন চাচ্ছে না।মাগো আমার লিখার মতো প্রতিটি কথায় যদি তোমাকে মা বলে ডাকতে পারতাম।তোমায় একটু মা বলে ডাকি না মা,

মা ও মা মাগো।ও মা মা মা মা।আমার মা।মা আমার মা ।মা মা মা মা মা মা মা মা মা মা মা মা মা মা মা মা মা মা মা মা মা মা মা মা মা মা মা মা মা মা মা মা মা মা মা মা মা মা মা মা মা মা মা মা মা মা মা মা মা মা মা মা মা মা মা………”
মাগো,ও মা!

তোমার মুখের হাসি আমার খুব ভালো লাগে।কতো সুন্দর করে হাসো তুমি। সবার সাথে কতো সুন্দর করে হাসলো,আমার সাথে ছাড়া।আমি তোমার হাসি খুব পছন্দ করি,এটা জেনেই কি আমার সাথে এমন করো মা?
মা,
আমার না খুব ইচ্ছে করে তোমাকে জড়িয়ে ধরতে‌।তোমার কোলে মাথা রেখে ঘুমোতে।

আমি কল্পনা করি,আমি তোমার কোলে মাথা রেখেছি।আর তুমি আমার চুলে বিলি কেটে আমায় ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছো।তখন যে আমার কি ভালো লাগে মা।
কল্পনায় আমার সময়টা বেশ চমৎকার কাটে মা।খুব চমৎকার।
কল্পনায় আমি তোমার হাত ধরে,বাবার হাত ধরে হাটি।কল্পনায় আমি দেখি,আমাদের সুন্দর একটা পরিবার।যেখানে আমায় একটু আদর করলে তুমি বাবাকে বকা দাও না।যেখানে আমি তোমাকে একটিবার মা ডাকলেই তুমি খুব খুশি হও।যেখানে তুমি প্রায়শই আমার কপালে তোমার মায়ামাখা স্নেহের চুমো একে দাও।
কি সুন্দর কল্পনা তাই না মা?

মা জানো,তোমার হাতের রান্না আমার খুব ভালো লাগে।তুমি যা কিছুই রাধো না কেন, সবকিছু আমার কাছে অমৃত মনে হয়।কি চমৎকার রান্না করো তুমি।তোমার হাতের ডাল আর আলুভর্তা সাথে ঘন ডাল আমার কি যে ভালোলাগে মা!

হোস্টেলে একই খাবার খেতে খেতে একদম তিতকুটে হয়ে গিয়েছি মা।যখন বাড়ি ফিরে তোমার হাতের একটুখানি ভাত খাই,তাতেই আমার পেট ভরে যায় মা।একদম ফুলফিল!

তুমি হয়তো কখনোই আমার লিখা,আমার কথাগুলো দেখতে পাবে না।কারণ আমার কোনোকিছুই তোমাদের নজরে আসে না।
কিন্তু জানো তো মা;এই ডায়েরীটা আমার খুব প্রিয়।খুউউউউউব।
কেন জানো?
কারণ,এখানে আমি তোমায় নিয়ে,বাবাকে নিয়ে অনেক কথা বলতে পারি।আমার হৃদয়ের জমানো কথাগুলো কিছুটা প্রকাশ পায় এই ডায়েরীতে।

আরেকটা কথা বলি মা,আমি তোমায় খুব ভালোবাসি। কিন্তু কখনো মুখ ফুটে বলতে পারিনি,পারবো ও না।তবুও তোমায় খুব বেশি ভালোবাসি মা।
তুমি যেমনি হও না কেন তুমি আমার মা!
ভালোবাসি তোমায় মা!”

__
আর পড়তে পারলেন না সাবিনা।মেয়েকে বড্ড মনে পড়ছে তার।খুব মনে পড়ছে।খুব মিস করছেন তিনি প্রহরকে।এতোটা কঠিন না হলেও পারতেন তিনি!কেন যে হুট করেই এমন মন মানসিকতার হয়ে গেলেন তিনি!প্রহারের সাথে সাথে আজ আরেকজনকেও খুব মনে পড়ছে তার!খুউউউউউউউউব!

চলবে………..